Monday, January 16, 2023

সত্তর দশকের কবি কাজল সেন : মলয় রায়চৌধুরী

 এক

সত্তর দশকের কবি কাজল সেনের ( জন্ম  ২৪. ০১. ১৯৫২, ) কবিতাসমগ্রের এই খণ্ডটিতে তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্হের কবিতা অন্তর্ভুক্ত :এই পীচরাস্তা শব্দের হারমোনিয়াম’ (১৯৯২) (কালিমাটি প্রকাশনী),‘বাজে শুধু শার্টের বোতাম’ (২০০২) (কালিমাটি প্রকাশনী),‘দলছুট এক স্বপ্নঠগ’ (২০০৮) (প্রিয়শিল্প প্রকাশন), ‘বাহবা কোরাস’ (২০১৪) (সৃষ্টিসুখ প্রকাশন),‘ঝুরোকবিতা’ (২০১৭) (বৈভাষিক প্রকাশনী) । এই কাব্যগ্রন্হগুলোর প্রায় সব কবিতাই গদ্যকবিতা, কয়েকটি ছাড়া, যেমন প্রস্তুত বেহালা ও পাড় ভাঙে কবিতা দুটি এবং বহু কবিতা গদ্যছন্দে লেখা । কাজল সেনের কবিতা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

গোবিন্দ ধরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন,আমার সাধ্যমতো যেমন বিভিন্ন কবির প্রচুর কবিতা পড়েছি এবং এখনও পড়ি, অন্যদিকে তেমনি কবিতা সম্পর্কিত অনেক আলোচনাও পড়ি। এইসব পড়াশোনা আমাকে কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে যেমন প্রচুর সহযোগিতা করেছে, তেমন অনুপ্রেরণাও যুগিয়েছে। কবিতা পড়ার পাশাপাশি কবিতা লেখাও আমার সমানভাবে এগিয়েছে। এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে কিছুটা অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন কবি স্বদেশ সেন, যাঁর স্নেহ ও সান্নিধ্যলাভে আমি ধন্য, বিশেষত আমি তাঁরই পদতলে বসে শিখেছি কবিতা লেখার সঠিক পাঠ। স্বদেশদা আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দেখো কাজল, তুমি কবিতা লিখছ, ভালো লিখছ, কিন্তু তাতে কিছু হয় না। ভালো কবিতা তো অনেকেই লেখে। তোমাকে লিখতে হবে এমন কবিতা, যা একেবারে নতুন, আগের মতো নয়। সেই নতুন কবিতা লেখায় তোমাকে ব্রতী হতে হবে। আর তোমার ডিকশন হবে নিজস্ব, যা ইতিমধ্যেই তোমার গড়ে উঠেছে।যদি আপনি কবিতা নিয়ে আমার কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা জানতে চান, তাহলে তার উত্তরে বলতে হয়, চ্যালেঞ্জ কিনা জানি না, তবে নিজস্ব ডিকশনে নতুনতর কবিতা লেখার কাজে আমি নিয়োজিত।”

কাজল সেন সম্পর্কে শর্মিষ্ঠা ঘোষ বলেছেন, “নিজের চেয়ে পরের ঢাক বাজাতেই তিনি পছন্দ করেন বেশি । তাই দীর্ঘ কয়েক দশক সাহিত্য চর্চা করলেও নিজের লেখা প্রকাশের চেয়ে নতুন প্রতিভা খুঁজে এনে তাদের জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করা এবং লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদনাতেই বেশি আগ্রহী । ‘কালিমাটি পত্রিকা’ বা ‘কালিমাটি অনলাইন’ এর মত জনপ্রিয় ব্লগটিও তার সাক্ষ্য বহন করে । তাঁকে আমরা দেখেছি সমাজ সচেতন সাহিত্যকর্মী হিসেবে । নতুন প্রজন্মের লেখকদের প্রতি স্নেহশীল দাদা হিসেবে ।”

 ছন্দে কবিতা লেখার তুলনায় গদ্য কবিতা লেখা কঠিন । গদ্য কবিতার বিষয়টি যখন রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়  ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখন তিনি ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকে এই প্রকরণ পরীক্ষার  অনুরোধ জানিয়েছিলেন; এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য স্মরণীয় : “মনে পড়ে একবার শ্রীমান সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, ‘ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের সে স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি৷’ সত্যেনের মতো বিচিত্র ছন্দের  স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে৷ হয়তো অভ্যাস তাঁর পথে বাধা দিয়েছিল, তাই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি” ।

সংস্কৃত গদ্যকাব্যের জগৎ-এ দণ্ডীর “দশকুমারচরিতম্”, সুবন্ধুর “বাসবদত্তা” এবং বানভট্টের “হর্ষচরিত” ও “কাদম্বরী” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দণ্ডী রচিত “দশকুমারচরিতম্গদ্যকাব্যটি পূর্বপীঠিকা এবং উত্তরপীঠিকা নামে দুই অংশে বিভক্ত।কাব্যটিতে মগধের রাজনৈতিক কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। এককালের মগধেই কিন্তু অধ্যাপনা করতেন কাজল সেন, যিনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক জলধর সেনের বংশধর । কাজল সেন সেখানে ‘কালিমাটি’ নামের একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন । 

‘দশকুমারচরিতম’ গদ্যকাব্য     মগধরাজকুমার রাজবাহন এবং মগধরাজ রাজহংসের  মন্ত্রীপুত্রের জীবনকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে ।রাজকুমার কন্দর্পকেতু এবং রাজকুমারী বাসবদত্তার প্রণয়নকাহিনী অবলম্বনে সুবন্ধুর “বাসবদত্তা” কাব্যটি রচিত। প্রাচীন ভারতীয় সমালোচকরা সুবন্ধুকে বানভট্ট-এর সাথে একাসনে বসিয়েছেন।  বানভট্ট ছিলেন সম্রাট হর্ষবর্ধনের সভাকবি। তাই তার রচিত “হর্ষচরিত” গদ্যকাব্যটিতে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালীন বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। ” হর্ষচরিত ” আটটি উচ্ছ্বাসে বিভক্ত একটি আখ্যায়িকা শ্রেনীর গদ্যকাব্য।প্রাচীনকালে পদ্যই ছিল সাহিত্য রচনার মূলস্তম্ভ এবং গদ্য ছিল মানুষের চিন্তার বাহন মাত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে দণ্ডী, সুবন্ধু এবং বানভট্ট এই ত্রয়ী প্রতিভার হাত ধরে গদ্যকাব্য চিত্রধর্মী ও সঙ্গীতধর্মী হয়ে পদ্য কাব্যের মতোই ভাবের বাহন হয়ে উঠেছে। এই একই কথা আমরা শুনি ফরাসি কবি বোদলেয়ারের গদ্যকবিতা প্যারিস স্প্লিন সম্পর্কে আরসেন হাউসেকে লেখা উৎসর্গপত্রে । বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে ।

মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগ সন্ধিক্ষণের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে নিয়ে এলেন মুক্ত ছন্দ অমিত্রাক্ষর। রচনা করলেন সনেট। অনেকের মতে তিনিই বাংলা আধুনিক কবিতার জনক ।  ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতি কবিতা নিয়ে এলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)।  আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এসে ছেয়ে ফেললেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে । মহাকাব্য ব্যতীত সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই যেখানে তিনি খাল কেটে দিয়ে নতুন স্রোত এনেছেন । কিন্তু ইউরোপীয় মননের আধুনিক কবিতার পত্তন হলো  রবীন্দ্র ভাবধারার বাইরে বসবাসকারী পাঁচজন ইংরেজির অধ্যাপকের হাতে, যাঁদের বলা হয় তিরিশের দশকের কবি :  অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)। বস্তুত বাংলা কবিতায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন এই কবিরা, বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশ, যিনি কবিতা ও ফিকশানে রবীন্দ্রনাথকেও অতিক্রম করে গেছেন ।

ইউরোপের অনেক দেশে গদ্যের বিকাশে লাতিন ভাষার গভীর প্রভাব ছিল। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন  রোমান বক্তা সিসেরো, (১০৬ - ৪৩ ) খ্রিস্টপূর্বাব্দ । অবশ্য গদ্য কবিতার চল প্রথমে ইহুদিরা  প্রাচীন যুগে আরম্ভ করেছিলেন । বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো কবিতার ইতিহাস যদিও অনেক প্রাচীন  কিন্তু সে যুগে বাংলা কবিতায় গদ্যের প্রচলন ছিলো না, যদিও যুগে যুগে এর বিষয়, আঙ্গিক, ছন্দে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।  চর্যাপদ থেকে যার যাত্রা শুরু তা এখন গীতিকবিতা, আধুনিকতা, উত্তরআধুনিকতা অতিক্রম করে পৌঁছেচে অধুনান্তিক কবিতা, ঝুরো কবিতা ও আভাঁগার্দ কবিতায় ।  আর বর্তমান কালখণ্ডে বাংলা কবিতার মূল বিবর্তন এসে স্থিতি লাভ করেছে গদ্যের লয়ে। তাই বাংলা সাহিত্যে গদ্য কবিতার সূত্রপাত  আধুনিকতায়,  যা আমরা পেয়েছি ইউরোপ থেকে। এখনকার কবিরা, সকল ভাষাতেই, কবিতায় গদ্যের লয় ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাঠ করার সময়ে মনোজগতে যে নিগূঢ় ধ্বনিদ্যোতনার সৃষ্টি হয়, সেটাই গদ্য কবিতার ছন্দ ।

ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যের বিদগ্ধ পাঠকবি অরুণ মিত্রের মতে,” আধুনিক গদ্য কবিতার জনক হলেন ফরাসি কবি অ্যালয়শিয়াস বেরত্রাঁ (১৮০৭-১৮৪১),  তিনি তাঁর প্রথম গদ্য কবিতা পড়েন ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে, দিঝঁ-র এক সাহিত্য সভায়৷ তার আগে তিনি ছন্দমিলের কবিতাও লিখেছেন৷ সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তাঁর গদ্যের পার্থক্য ছিল, তাঁর গদ্যকাব্যে ধ্বনিব্যঞ্জনা, গতিভঙ্গি এবং অদ্ভুত চিত্রকল্প প্রয়োগ ; এমনকি ‘কোনও কোনও রচনার প্রচ্ছন্ন অনুরণন এক শতাব্দী পরে তাঁকে পরাবাস্তববাদের অগ্রদূত রূপে প্রতিষ্ঠিত করে৷’ ইউরোপে সেই সময় থেকেই আধুনিক গদ্য কবিতার সূত্রপাত ঘটে  ৷ অরুণ মিত্র যেমন বলেছেন, ১৮৪২ সালে প্রকাশিত বেরত্রাঁর  গদ্য কবিতা  প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিল । এর ছন্দোময় ও কাব্যিক ভাষা পরবর্তীতে অনেককে এই ফরমেটে কবিতা লেখাতে আগ্রহী করে তোলে। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় বোদলেয়ারের গদ্যকবিতা । তারপর র‌্যাঁবো, অসকার ওয়াইল্ড, অ্যামি লাওয়েল গদ্য কবিতার প্রসার ঘটান । ভার্জিনিয়া উলফ গদ্য কবিতার আঙ্গিকে একটি উপন্যাস লেখেন ।  ফ্রান্স থেকে গদ্য কবিতার আঙ্গিক  পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা্য  ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় পাবলো নেরুদা এবং বোর্হেস, রাশিয়ায় তুর্গেনেভ, ইতালীতে মারিনেত্তি এবং ডেনমার্কে জে বি জ্যাকবসন ।  উত্তর আমেরিকায় ওয়াল্ট হুইটম্যান, রবার্ট ব্লাই, ডাবলু এস মেরউইন প্রমুখ এই ধারার সার্থক ও বিদ্যায়তনিকভাবে স্বীকৃত কবি। আমেরিকায় বিট আন্দোলনের কবিরা গদ্য কবিতায় নিয়ে এলেন চিৎকৃত আবেগ যা তার পূর্বে স্বীকৃতি পায়নি, বিশেষ করে অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল এবং ক্যাডিশ ।

কাজল সেনের গদ্য কবিতা পড়ার সময়ে মনে পড়লো, বোদলেয়ার তাঁর গদ্য কবিতা প্যারিস স্প্লিন  আরসেন হাউসেকে উৎসর্গ করার সময়ে সঙ্গের চিঠিতে  লিখেছিলেন, প্রিয় বন্ধু, আমি আপনাকে একটা ছোটো কাজ পাঠাচ্ছি যাকে কেউই বলতে পারবেন না যে এর  মুড়ো বা লেজ নেই, কেননা, বরং বিপরীত, এতে যা কিছু আছে তা সবই  মুড়ো আর লেজ, পর্যায়ক্রমে এবং ব্যতিহার্যভাবে । দয়া করে ভেবে দেখুন কতো সূক্ষ্ম সুবিধা এই মিশেল আমাদের সবাইকে দেয়, আপনাকে, আমাকে, এবং পাঠককে । আমরা যেখানে ইচ্ছে থামতে পারি --- আমি, আমার ভাবাবেশ, আপনি, পাণ্ডুলিপি, এবং পাঠক, তাঁর পড়া ; কেননা আমি অধৈর্য পাঠককে ফালতু প্লটের সীমাহীন সুতোয় বাঁধতে চাই না । যেকোনো একটা কশেরুকায় টান দিন, এবং এই প্যাঁচালো কল্পনার দুটি অর্ধাংশ ব্যথাহীনভাবে নিজেদের জুড়ে নেবে । অসংখ্য টুকরো করুন, আপনি দেখবেন যে প্রতিটি নিজের জীবন যাপন করতে পারে । এই আশায় যে বৃক্ষমূলের কয়েকটা বেশ জীবন্ত হয়ে আপনাকে আনন্দ দেবে আর আপনার মনোরঞ্জন করবে আমি এই সমগ্র সাপটিকে আপনাকে উৎসর্গ করছি । আপনাকে আমার একটা সংক্ষিপ্ত স্বীকৃতি দেবার আছে । পাতা ওলটাবার সময়ে, অন্তত কুড়িবার, অ্যালোয়শিয়াস বেরত্রাঁর বিখ্যাত ‘গাসপার্ড অব দি নাইট’ ( এই বইটা কি আপনার, আমার, অজানা নয়, এবং আমাদের কয়েকজন বন্ধুর   “বিখ্যাত” হবার দাবি করার অধিকার আছে ? ), তেমন কিছু করার প্রয়াসের চিন্তা মাথায় এলো, প্রাচীন জীবনকে তুলে ধরার জন্য যে প্রণালী তিনি প্রয়োগ করেছিলেন, অদ্ভুতরকম ছবি তুলে ধরে, আধুনিক জীবনের, বরং আধুনিক ও বিমূর্ত জীবনযাপনের । আমাদের মধ্যে কে-ই বা স্বপ্ন দেখেনি, তার উচ্চাকাঙ্খী দিনগুলোয়, কাব্যিক গদ্যের অলৌকিকতা সম্পর্কে, ছন্দ ও মিল বাদ দিয়েও যা সঙ্গীতময়, যথেষ্ট নমনীয় এবং যথেষ্ট বেসুরো, যাকে আত্মার গীতিময় প্রসারণে মানিয়ে নেয়া যায়, ভাবাচ্ছন্নতার তরঙ্গের সঙ্গে, চেতনা যে মোচড় ও বাঁকবদল করে তার সঙ্গে ? আমার এই ধারণার সূত্রপাত ঘটেছিল মূলত বিশাল শহরগুলোয় যাতায়াতের কারণে, তাদের সংখ্যাহীন যোগাযোগের পারস্পরিক বিভাজন থেকে । আপনি নিজেই, প্রিয় বন্ধু, আপনি কি শার্শি বসানোর ফেরিঅলার কানফাটানো চিৎকারকে গানে অনুবাদ করার জন্য উৎসাহিত হননি, তাদের ওপরদিকের জানালার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া দুঃখি চিৎকারকে  গীতিময় গদ্যে প্রকাশ করতে চাননি, পথের সবচেয়ে উঁচু কুয়াশা ভেদ করে যা উঠে যায় ?” 

তবে রবীন্দ্রনাথ  মনে করতেন যে,  গদ্য কবিতার জনক মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-৯২)৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর আদর্শকেই অনুসরণ করেছেন ৷ হুইটম্যানের গদ্যকাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত : “আধুনিক পাশ্চত্য সাহিত্যে গদ্যে কাব্য রচনা করেছেন ওয়াল্ট হুইটম্যান৷ সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তার প্রভেদ নেই, তবে ভাবের দিক থেকে তাকে কাব্য না বলে থাকবার জো নেই৷” এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল হাংরি আন্দোলনের মামলার সময়ে আমার পক্ষের সাক্ষী অধ্যাপক তরুণ সান্যাল যখন বিচারক অমলকুমার মিত্রকে বলেন যে আমার গদ্যকবিতা প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার তুলনীয় ওয়াল্ট হুইটম্যানের লিভস অফ গ্রাসের সঙ্গে, তখন বিচারক তরুণ সান্যালের বক্তব্য নাকচ করে বলেছিলেন, ‘ওসব বিদেশি কবিদের আমরা মান্যতা দিই না।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  বলেছেন -- গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে,মনকে দুলিয়ে তোলে, এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার আনুসঙ্গ হয়ে। সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে স্বভাবতই তার দোলা দেবার শক্তি আছে, আর-এক হচ্ছে পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার। এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয়।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই গদ্য কবিতার জনক৷ ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১১) অনুবাদকালেই রবীন্দ্রনাথের মনে গদ্য কবিতা লেখার ইচ্ছা জাগে৷ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজির মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস’ সৃষ্টি করা৷ প্রথমেই তিনি ‘লিপিকায়’ (১৯২১) কিছু গদ্য কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ৷ উনি বলেছেন, ‘আমি স্বয়ং এই কাব্য রচনার চেষ্টা করেছিলুম ‘লিপিকায়’ অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাই নি৷ ‘লিপিকা’ লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখিনি৷” ‘পুনশ্চ’ কাব্যের (১৯৩২) ভূমিকায় সেই কৈফিয়তই তিনি দিয়েছেন এভাবে, ‘বোধ হয় ভীরুতাই তার কারণ৷’ সেই ভীরুতা কাটল আরও দশ বছর পরে’ ‘পুনশ্চ’-তে ৷ ‘পুনশ্চ’ কাব্যের একটি উলেখযোগ্য দীর্ঘ গদ্যকবিতা ‘শিশুতীর্থ’ । ‘লিপিকা’র কিছু কবিতা বাদ দিলে ‘শিশুতীর্থ’ই তাঁর প্রথম গদ্য কবিতা৷  “পুনশ্চঃ কাব্যের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেন, যখন কবিতাগুলো পড়বে তখন পূর্বাভাস মতো মনে করো না এগুলো পদ্য। অনেকে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রুষ্ট হয়ে ওঠে। গদ্যের প্রতি গদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে,সে নারীর সৌন্দর্য নয়। পুনশ্চঃ কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে? পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে অতিব্যপ্তি দোষ ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠছে এ কথা যদি বলি তবে শক্রপক্ষ বলে বসবে পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এই জিনিসটা জল নয়, তাই বলে মাটিও নয়। তাহলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি? সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে, মুখে বলবার জো নেই। না হয় তাঁমাই হলো, অর্থাৎ এমন কোনও ধাতু যা দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে, তিলোত্তমাও হতে হয়। অর্থাৎ রূপরসাত্মক গদ্য,অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তৈজস গদ্য।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছন্দ’ প্রবন্ধে বলেছেন : ‘এমন মেয়ে দেখা যায় যার সহজ চলনের মধ্যেই বিনা ছন্দের ছন্দ আছে৷ কবিরা সেই অনায়াসের চলন দেখেই নানা উপমা খুঁজে বেড়ায়৷ সে মেয়ের চলনটাই কাব্য তাতে নাচের তাল নাইবা লাগল, তার সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল দিতে গেলে বিপত্তি ঘটবে৷ তখন মৃদঙ্গকে দোষ দেব না তার চলনকে? সে চলন নদীর ঘাট থেকে আরম্ভকরে রান্নাঘর, বাসরঘর পর্যন্ত৷ তার জন্য মাল-মশলা বাছাই করে বিশেষ ঠাট বানাতে হয় না৷ গদ্য কাব্যেরও এই দশা৷ সে নাচে না, সে চলে৷ সে সহজে চলে বলেই তার গতি সর্বত্র৷ সেই গতিভঙ্গি আবাঁধা৷ ভিড়ের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পোশাকি শাড়ির প্রান্ততুলে ধরা আধা ঘোমটা টানা সাবধান চাল তার নয়৷’ 

‘শেষ সপ্তক’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সম্প্রতি কতগুলো গদ্য কবিতা জড়ো করে ‘শেষ সপ্তক’ নাম দিয়ে একখানি বই বের করেছি। সমালোচকরা ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি বলবেন। আমি কাব্যের পসারি, আমি শুধাই— লেখাগুলোর ভিতর কি স্বাদ নেই, ভঙ্গি নেই, থেকে থেকে কটাক্ষ নেই, সদর দরজার চেয়ে এর খিড়কির দুয়ারের দিকেই কি ইশারা নেই, গদ্যের বকুনির মুখে রাশ টেনে তার মধ্যে কি কোথাও দুলকির চাল আনা হয়নি, চিন্তাগর্ভ কথার মুখে কোনখানে অচিন্ত্যের ইঙ্গিত কি লাগল না, এর মধ্যে ছন্দোরাজকতার নিয়ন্ত্রিত শাসন না থাকলেও আত্মরাজকতার অনিয়ন্ত্রিত সংযম নেই কি? সেই সংযমের গুনে থেমে-যাওয়া কিংবা বেঁকে-যাওয়া কথার মধ্যে কোথাও কি নীরবের সরবতা পাওয়া যাচ্ছে না?” রবীন্দ্রনাথ পংক্তির ভাবপর্বগুলোর অসমতা রেখেছেন। এছাড়া শব্দের যথার্থ স্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, যেমন- ‘সে ট্রামে চলেছিলো’ স্থানে করেছেন, ‘সে চলেছিলো ট্রামে’। ফলে গদ্যে পদ্যের রঙ ধরেছে।

গদ্য কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, ‘বেঁকে যাওয়া কথার মধ্যে নীরবতার সরবতা’ তা কাজল সেনের ‘বাজে শুধু শার্টের বোতাম’ কাব্যগ্রন্হের ‘ডিম পাড়া ভালো কাজ’ কবিতাটা পড়লে স্পষ্ট হয়: 

ডিম পাড়া যাদের স্বভাব তারা ডিম পাড়ে অবরে সবরে

ওম দেওয়া কেউ কেউ ওম দেয় ওমের গভীরে

আমি বলি এই সব ডিম পাড়া ভালো কাজ আরও ভালো যত্নে ওম দেওয়া

ডিমের যা কারিগরি দু’চার বা দশ দিনে রপ্ত করে নেওয়া

এই ভাবে আরও শেখা কীভাবে কঠিন শ্রমে শাড়ি ঘেরে মেয়েলি শরীর

শাড়ির দেরাজে গোঁজা নতুন ভ্রমণসূচি ভেজে রোম পেলিংয়ের হিম

আসলে কোথাও থাকে ঠিকানা যাবার আর আস্তানা জোটে কোনো ঘরে

তাঁতের সীমানা ছেড়ে  হঠাৎ উজিয়ে আসা সুতো ওড়ে মৌসুমী ঝড়ে

রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে  বিষ্ণু দে শেষ বয়সে প্রবর্তন করেন আরেক ধরনের কাব্যিক গদ্যরীতি । মূলত ত্রিশের দশকের কবিদের হাতেই ঘটে গদ্যছন্দের আবির্ভাব। গদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ  পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করলেও তিনি সম্ভবত বোদলেরিয় সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি ।   জীবনানন্দ দাশই নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের গদ্যকবিতা।  বাংলা গদ্যকবিতা  ছন্দনির্ভর কবিতার সমকক্ষ রূপ নিলো তিরিশের দু-জন কবির কলমে – প্রথমে জীবনানন্দ দাশ (১৯৩৫ – ১৯৫৪) এবং তারপর বুদ্ধদেব বসু-র  (১৯৫২-১৯৭১)  । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত দিক-নির্দেশক প্রবন্ধ , "কাব্যের মুক্তি", লিখলেও কাজে-কর্মে কোন গদ্যকবিতা লেখেন নি। বরং মন্তব্য করেছিলেন, "সাত্ত্বিক কবিমাত্রেই গদ্য-পদ্যের বিবাদ মেটাতে চেয়েছেন, কিন্তু কৃতকার্য হন নি। এতদিন পরে রবীন্দ্রনাথের অধ্যবসায়ে হয়তো সে বিরোধ ঘুচল। স্বরাজ্য মজ্জায় মজ্জায় না থাকলে, নৈরাজ্য অমঙ্গলপ্রসূ। তাই, ভয় পাই, তপস্যকঠিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যেটা মোক্ষ, আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়তো সর্বনাশের সূত্রপাত।" । তিরিশের দশকে সমর সেন-এর গদ্যকবিতা বাহুল্যহীন ঋজু স্টাইলে নবায়ন ঘটিয়েছিল।সমসাময়িক কবি জসীম উদ্দিন পল্লীকবি খ্যাতি লাভ করেছেন, কিন্তু গদ্য কবিতা লেখেননি । অক্ষরবৃত্তের পয়ার থেকে চতুর্দশপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তকছন্দের যে বিবর্তন, সে বিবর্তনের ধারায়ই এসেছে গদ্যকবিতার ছন্দ। 

দুই

কাজল সেনের কবিতা পড়তে বসে মনে পড়ল ‘ অ্যাণ্ড আওয়ার ফেসেস, মাই হার্ট, ব্রিফ অ্যাজ ফোটোস’ বইতে জন বার্জারের এই কথাগুলো : “কবিতা, এমনকি আখ্যানের আঙ্গিকে হলেও, গল্পের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সব গল্পই কোনো না কোনো ধরনের যুদ্ধ বিষয়ক, যার শেষ জয় বা পরাজয় ঘটে। গল্পে সবকিছু শেষের দিকে এগোয়, যখন ফলাফল জানা যায়। পক্ষান্তরে কবিতা, ফলাফল নির্বিশেষে, যুদ্ধক্ষেত্র অতিক্রম করে, আহতদের যত্ন নেয়, বিজয়ী বা ভীত-সন্ত্রস্তদের উন্মাদ স্বগতসংলাপ শোনে । তাই কবিতা  এক ধরনের শান্তির আবহাওয়া তৈরি করে । অ্যানেশথেসিয়া বা সহজ আশ্বাস দিয়ে নয়, বরং স্বীকৃতি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে কবিতা-বিশেষ পড়ার পর, পাঠকের  ওপর তার প্রভাব, যতোই মিহি হোক,  সহজে বিলীন হয় না কেননা একটি কবিতা পড়ার প্রক্রিয়ায় আছে এই স্বীকৃতি যে কবিরা মাতৃভাষা বা লেখনভাষা তাকে স্বীকার করেছে, আশ্রয় দিয়েছে, অভিজ্ঞতার বনেদ গড়ে দিয়েছে ।”

কাজল সেন ঝুরো কবিতা ও ঝুরো গল্প নামে একটি নতুন আঙ্গিকের সৃষ্টি করেছেন । শর্মিষ্ঠা ঘোষকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কাজল সেন বলেছেন, “একদিন স্বদেশদা কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, দেখো কাজল, প্রচলিত ধারায় তুমি কেমন লিখছ বা কতটা ভালো লিখছ, তা কিন্তু বিচার্য নয়, বরং তুমি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারছ কিনা সেটাই আসল ব্যাপার। স্বদেশদা আমাকে কথাটা বলেছিলেন কবিতা লেখার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাঁর এই কথাটাই আমার সাহিত্য জীবনে ‘অমোঘ বাণী’র মতোই আমাকে আলোড়িত করে চলেছে। আর হয়তো ঠিক এখান থেকেই আমার ‘ঝুরো’ ভাবনাটা মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগল।”  তিনি আরও বলেছেন, “ ঝুরোগল্প ও ঝুরোকবিতা লেখার আমাদের এই প্রয়াস শুধুমাত্র বাংলাসাহিত্যে নয়, সম্ভবত বিশ্বসাহিত্যেও হয়নি। অধ্যাপক ড. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় রীতিমতো গবেষণা করে জানিয়েছেন, ঝুরোগল্প ও ঝুরোকবিতা লেখার কোনো নমুনা বিশ্বসাহিত্যে এখনও পর্যন্ত তিনি খুঁজে পাননি।”

শর্মিষ্ঠা ঘোষকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কাজল সেন বলেছেন, “অণুপরিবারে বেড়ে ওঠা জেট যুগের মানুষদের নিয়তির প্রাসঙ্গিকতায় ‘ঝুরো’ ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। বরং ভাবনাটা এসেছে এই জগত ও জীবনের সামগ্রীক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে। আমি আদৌ নতুন কিছু বলছি না, একথা তোরা সবাই জানিস যে, যে কোনো মানুষের জীবন মানে সেজন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যত দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড... অতিবাহিত করেছে, তার যোগফল মাত্র। এবং এই প্রতিটি একক সময়ে সে অসংখ্য ঘটনা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, চিন্তা ভাবনা, মানসিকতার মুখোমুখি হয়েছে। এইসব এক ঘটনার সঙ্গে অন্যান্য ঘটনার, এক পরিস্থিতির সঙ্গে অন্যান্য পরিস্থিতির, এক মানসিকতার সঙ্গে অন্যান্য মানসিকতার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, আবার না থাকতেও পারে। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা থাকতেই পারে। আর এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই তার সেই তথাকথিত জীবনটা অসংখ্য অসম্পূর্ণতার সমষ্টি মাত্র। অসংগতি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এই প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি হয়ে যদি তার সেই তথাকথিত জীবনের খন্ডাংশগুলিকে উপজীব্য করে সাহিত্য বা শিল্প সৃষ্টি করতে কেউ আগ্রহী হন, তাহলে তাকে সেই অসম্পূর্ণতাকেই মেলে ধরতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। সেই লেখা বা সৃজনটি হবে ‘ওপেন এন্ডেড’। ঝুরো অর্থাৎ ঝরে পড়া। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণতা বা পরিণতি টানতে গেলে তা হবে কৃত্রিম ও অবাস্তব। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলি, অনেকেই ‘ঝুরোগল্প’র সঙ্গে ‘অণুগল্প’কে গুলিয়ে ফেলছেন। এই দুটি গল্পের ফর্ম ও ফরম্যাট কিন্তু একেবারেই আলাদা। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও আলাদা আলাদা। আশাকরি সংক্ষেপে হলেও বিষয়টা বোঝাতে পেরেছি।”

এক সাক্ষাৎকারে গোবিন্দ ধর জানতে চেয়েছিলেন, সাহিত্যে কেমন করে আকৃষ্ট হলেন তিনি । তার উত্তরে কাজল সেন বলেছেন, “কখন থেকে লেখালেখি শুরু করেন?” উত্তরে  কাজল সেন বলেছিলেন, “আমি মনে করি, ক্রিয়েটিভিটির ক্ষেত্রে যাঁরাই যে কোনো বিষয়ে জীবনে সাফল্য অর্জন করেন, তাঁরা সবাই নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে অর্থাৎ খুব কম বয়স থেকেই সেই বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন এবং চর্চা শুরু করেন। সচেতনভাবে যে সেই চর্চার সূচনা হয়, তা নয়। কিন্তু চর্চায় বাধা না পড়লে অদূর ভবিষ্যতে তা অধ্যাবসায়ে উন্নীত হয়। এবং সেই অধ্যাবসায় তাঁকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কেউ সেই নিতান্ত ছেলেবেলা থেকে যে কোনো বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, তা সে সৃজনশীল সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া যাইহোক না কেন, তার পটভূমিতে থাকে পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিত। ব্যক্তিগত ভাবে যদি আমার নিজের কথা বলতে হয়, তাহলে জানাই, আমি সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলাম একান্তই পারিবারিক কারণে। আমার দাদু (ঠাকুরদাদা) ছিলেন সাহিত্যসাধক। সাহিত্যরচনা এবং পত্রিকা সম্পাদনা, দু’ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সুপরিচিত। আমার জন্মের পর থেকেই, মানে যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই দাদুর সাহিত্যসাধনার কথা শুনে আসছি। খুব স্বাভাবিক কারণেই এর একটা প্রভাব আমার মনে রেখাপাত করেছিল। এবং তখন থেকেই আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিল।” উল্লেখ্য যে প্রখ্যাত সাহিত্যিক জলধর সেন হলেন কাজল সেনের ঠাকুর্দা ।

জলধর সেন (১৩ মার্চ ১৮৬০ - ১৫ মার্চ ১৯৩৯) বাঙালি ভ্রমণ কাহিনী, রম্যরচনা ও উপন্যাস লেখক । তৎকালীন নদিয়া জেলার কুমারখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায়) তার নিবাস ছিল । তবে তার আদি নিবাস অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের নিকট অবস্থিত দেগঙ্গা (বা দেগঙ্গ)৷ তার প্রপিতামহ কুমারখালির ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম-কুঠির দেওয়ানীর কাজ পেয়ে কুমারখালিতে যান এবং সেই থেকে তারা সেখানে বাস করেন৷ তারা দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ এবং "দেগঙ্গের সেন" নামে পরিচিত ছিলেন৷ ১৩ মার্চ ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালি গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায়) তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হলধর সেন । ১৮৮১ সালে স্ত্রী, কন্যা ও মাতাকে হারিয়ে হিমালয়ে চলে যান। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কুমারখালি থেকে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন এবং তারপর কলকাতার জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউসনে এল.এ পর্যন্ত পড়েন । এরপর গোয়ালন্দ বিদ্যালয়ে, দেরাদুনে এবং মহিষাদলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন । ১২৯৭ বঙ্গাব্দে তিনি হিমালয় বেড়াতে যান । তার ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসচিত্র, হিমালয়। তার রচিত গল্পের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নৈবেদ্য, কাঙ্গালের ঠাকুর, বড় মানুষ প্রভৃতি। তার রচিত উপন্যাস হল দুঃখিনী, অভাগী, উৎস প্রভৃতি। তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হরিনাথ গ্রন্থাবলী, ও প্রমথনাথের কাব্য গ্রন্থাবলীগ্রামবার্তা, সাপ্তাহিক বসুমতী, হিতবাদী, সুলভ সমাচার প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকাতে তিনি সম্পাদক বা সহ-সম্পাদক হিসাবে যুক্ত ছিলেন । পরে ১৩২০ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর তিনি ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার সাহিত্যকর্মের জন্য ব্রিটিশ সরকার 'রায় বাহাদুর' উপাধি দেয়

 

কাজল সেন বহুকাল কলকাতার বাইরে থেকেছেন । এই প্রসঙ্গে গোবিন্দ ধরের প্রশ্নের উত্তরে কাজল সেন বলেছেন, “আমি একটা কথা বিশ্বাস করি, সাহিত্যের ইতিহাস অবশ্যই আছে, কিন্তু সাহিত্যের কোনো ভূগোল হয় না। আমি বাঙালি বা বাংলাভাষী, তাই আমার জন্ম ও বসবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অথবা বাংলাদেশে হওয়া বাঞ্ছনীয়, এমন তো কোনো শর্ত বা নিয়ম কি আছে? আছে নাকি? তা আমার জন্ম ও বসবাস যদি পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে না হয়, তাহলে যেখানে আছি সেখান থেকে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চায় তো কোনো বাধা থাকতে পারে না! সুতরাং বহির্বঙ্গ বা বাদ বাংলায় বসবাসকারী কবি সাহিত্যিকরা সেই প্রাচীনকাল থেকে সেখান থেকেই সাহিত্যরচনা করে চলেছেন। এবং তাঁরা বাংলা সাহিত্যকে রীতিমতো সমৃদ্ধ করেছেন। এবং এখনও করে চলেছেন। এখানে তার উদাহরণ তুলে ধরতে গেলে সাক্ষাৎকার অনেক দীর্ঘ হবে। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, এর আগে এধরনের কোনো বিভাজন ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই বিভাজনের নামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ-রাজনীতি শুরু হয়েছে। বাদ বাংলার কবি   সাহিত্যিকদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ ব্যবহার ও আচরণ করা হচ্ছে। তাদের প্রাপ্য সম্মান, স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। এটা অত্যন্ত অশোভন ও অপ্রত্যাশিত।”

 

কলকাতার বাইরে থাকার কারণে কাজল সেনের কবিতাসমগ্র প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে যখন কিনা এ যুগের খ্যাতিমান ও সুপ্রতিষ্ঠিত তিন কবিব্যক্তিত্ব— অমিতাভ গুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি করে কবিতাসমগ্র আছে। তিন জনই পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সরকারি পুরস্কারে ভূষিত। কলকাতার বাইরে থাকা এবং যোগাযোগের অভাবে কাজল সেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং প্রকাশকদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন । তাছাড়া তাঁর কবিতা যেহেতু বর্তমান কালখণ্ডের ঝুরো বা ভঙ্গুর পরিসরকে তুলে আনতে চেয়েছে, তিনি প্রতিষ্ঠানের বা দরবারি ভালো লাগার  কবিতা লেখেননি । ১২২ সংখ্যক ঝুরো কবিতাটা পড়লে তাঁর কাব্যিক আক্রমণ ও আশা একযোগে স্পষ্ট হয় ;

মণিমালা জানে বসন্তোৎসব শুরু হবে আজই

কিছুটা পলাশডাঙা বাকিটা শিমুলডাঙা

খেটে খাওয়া মানুষগুলো খেটে খেটে ঘুরে ফিরবে রাতে

তখন অবশ্য লালরঙ ঢাকা পড়ে যাবে আঁধারে

তবে মণিমালা জানে আঁধার চিরে কীভাবে লালিমা ফুটে ওঠে

 

তিন

বাংলায় গদ্য কবিতার বিবর্তন, আধুনিকতা থেকে অধুনান্তিকতায় উত্তরণ বুদ্ধদেব বসু থেকে কাজল সেনের কবিতায় পৌঁছে টের পাওয়া যায় । বুদ্ধদেব বসু প্রভাবিত ছিলেন শার্ল বোদলেয়ারের ‘ফ্লনিয়র’ ভাবনা দিয়ে । উনিশ শতকের প্যারিস মহানগরের পথে-পথে  টহলক্রিয়াকে চিহ্ণিত করে শার্ল বদল্যার একটি ভাবকল্প তৈরি করে দিয়ে গেছেন । ক্রিয়াটিকে তিনি বলেছেন ‘ফ্ল্যানেরি’ এবং ওই পথচর দর্শককে বলেছেন ‘ফ্লনিয়র’।  বুদ্ধদেব বসু-র ‘একদিন চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা’ গ্রন্থের ‘দোকানিরা’ কবিতাটা পড়লে বোদলেয়ারের প্রভাব টের পাওয়া যায়  :

ষোলো বছর আগে, প্রথম যখন এ-পাড়ায় এসেছিলাম,

তখনের আসবাব ছিলো অন্য রকম। ঘাস ছিলো তখন,

যেখানে-সেখানে নারকোলের ঝাঁকড়া মাথা,

যেখানে-সেখানে গুল্মরের গুঁড়ো, আর মাঠে-মাঠে

জ'মে-থাকা বৃষ্টি, গ্যাসের আলোয় বেগুনি আর সবুজ,

স্বপ্ন আর বীজাণুর গর্ভধারিণী।

আর মশা। হয়তো জোনাকি, আর দূরত্ব। হাটবাজার

প্রয়োজনের দূরত্ব।

এখন সব বদলে গেছে। মাঠের বদলে পাঁচতলা বাড়ি,

ডোবার কবরের উপর রেস্তরাঁ। সারাদিন কর্তব্যপরায়ণ

ট্রাফিক। আর পথ চলতে ঝরা পাতা, ব্যাঙের ছাতা,

থমথমে সন্ধ্যার বদলে – এখন দোকান, অনেক, বিচিত্র,

ডাইন-বাঁয়ে বক্তৃতার মতো বর্ধিষ্ণু । ঝক্ঝকে রঙিন

মলাটে আনকোরা, বা পুরনো কবির বইয়ের খাতার মতো

ফুটপাতে। অথবা কোনো চিলতে রোয়াকে ম্যাজিকের

মতো গজিয়ে ওঠা। সারি-সারি উন্নতির হাস্যময়

দাঁতের মতো, দোকান।

এই দোকানগুলো দেখতে আমার ভালো লাগে :

এখানে খেলা করে অমর লোভ, সনাতন দম্ভ ; অভাবের

সঙ্গে প্রয়োজনের যুদ্ধ চলে ; মহিলারা লজ্জা ভুলে

নিজেদের স্তন আর বাহুর ডৌল নিরীক্ষণ করেন ;

কাচের জানালায় প্রতিহত হ'য়ে কত ইচ্ছা মাছির মতো

ম'রে যায়।

আর দোকানিরা – তাদেরও আমি লক্ষ্য করি। তাদের

চাটুকারী ভঙ্গি, তাদের গৃধ্নু ও সতর্ক চোখ, আর সেই

তাদের অপেক্ষার ধৈর্য । আপনি ভাবছেন তারা

শুধু সাজিয়ে রাখে, জুগিয়ে যায়, গছিয়ে দেয়, হিশেব

লেখে, টাকা গোনে, খুচরো মেলায় ? কখনো আপনার

মনে হয়নি আসল কথাটা ? অপেক্ষা করে তারা,

অপেক্ষা ক'রে থাকে : ঐ তাদের কাজ, তাদের বৃত্তি ।

যখন এক খদ্দের চ'লে গেছে, অন্য জন এখনো

আসেনি, তখন আমি দেখেছি তাদের – কাউন্টারে

কনুই রাখা, হাতের গর্তে থুঁতনি, তাকিয়ে আছে

পথের দিকে, দূরের দিকে, এক অস্পষ্ট ভবিতব্যের

ছায়ার মধ্যে যেন

তখন মনে হয় তাদের চোখে বিষাদ, যেন স্থির জলে

মাছের মতো ভেসে উঠলো । যেন মাছের মতোই বোবা তাদের দৃষ্টি ।

সুভদ্র পাঠক, ঐ চোখে কোনো চিত্রকল্প কি

দেখতে পান না ! আপনি, আমি – প্রত্যেকে আমরা

যে যার মতো দোকান খুলে বসেছি, অপেক্ষা

দুলছে হৃৎপিণ্ডে । শীত এলে গ্রীষ্মের জন্য,

গ্রীষ্ম এলে বর্ষার ; স্ত্রীর জন্য অন্ধকার অপেক্ষা,

সন্তানের জন্য কৌতূহলী : অর্থ, খ্যাতি,

যাত্রা, ভ্রমণ, প্রত্যাগমন, হয়তো ভাগ্যের কোনো

ইঙ্গিতের জন্য – অন্ত নেই। চিঠি আসবে কার,

সন্ধেবেলা ঘরে যখন আলো জ্বলেনি হঠাত

কার টোকা পড়বে দরজায় ? ভরদুপুরে

ট্রামে উঠে ফিরে পাবো কোনো

হারানো বন্ধুকে ? এমনি, দুলছে আমাদের

হৃৎপিণ্ড, দিনের পর দিন, ঋতুর পর ঋতু,

অবিরাম । সবচেয়ে ভীষণ কথা এই যে

মাঝে-মাঝে সত্যি টোকা পড়ে, বাল্যসখীকে ফিরে পাই

ফ্লরিডায় । কিন্তু যেহেতু আমরা থামতে পারি না,

তাই আবার তাকিয়ে থাকি পথের দিকে, দূরের দিকে,

সেই ঝাপসা দিগন্তের দিকে, যেখানে আমি, আমার

বাল্যসখী, আর ফ্লরিডার তট, সব এক বিন্দুর মধ্যে

বিলীয়মান।

মানুষ, মানুষ, মর্মাহত মানুষ, তুমি কি জানো

তোমার অপেক্ষার শেষ লক্ষ্য কে ? তুমি কি জানো

তোমারই জন্য মৃত্যুর সৃষ্টি হয়েছিলো ?

[আরম্ভ ১৯৫৩, সমাপ্ত ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ; কলকাতা]

 

আলপন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সুধীন দত্তের আভিধানিকতা ও বিষ্ণু দে প্রভৃতির দুরূহ শব্দশৈলি থেকে কবিতার ভাষাকে বের করে এনে জনপথের চওড়া সড়কে  দৌড় না করালে বাংলা কবিতা তার অস্তিত্বের আগুন হারাত। বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতাকে এইরকম অর্গলমুক্ত করার প্রয়াস” জরুরি ছিল ।ভাবগত দিক থেকে চল্লিশের কবিতা ছিল  তিরিশ দশক থেকে একেবারে আলাদা। শুধু কবিতার রূপ বা ভাবগত দিক থেকেই যে ভিন্ন তা নয়; এই দশকের প্রধান কবিদের ব্যক্তিগত আদর্শ, কবিতার ভাব বা আঙ্গিকগত চিন্তা-চেতনা ছিল অন্যদের থেকে অনেকটা স্বতন্ত্র। বলা যায়, আদর্শভিত্তিক সৃষ্টিকর্মের এক সচেতন প্রয়াস ছিলো চল্লিশের কবিতাচল্লিশের দশক মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্ধকার শহর, দুর্ভিক্ষ, অগণন মানুষের মৃত্যু, পথে পথে শবের স্তূপ, নিরন্নের মিছিল। চল্লিশের দশক মানে দাঙ্গা ও বিস্তর মানুষের হাতে বিস্তর মানুষের নিধন ।  

স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধ হওয়ার অশান্ত আবর্তের মধ্যে  চল্লিশের কবিরা মূলত গদ্যকবিতাকেই আশ্রয় করেছেন । উল্লেখ্য সমর সেন, দিনেশ দাশ, বিমলচন্দ্র ঘোষ, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, দীনেশ দাস, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, সিদ্ধেশ্বর সেন, জগন্নাথ চক্রবর্তী, কৃষ্ণ ধর, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মনীন্দ্র রায়, সুভাষ মুখােপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, রাম বসু, অরুণ মিত্র প্রমুখ। চল্লিশের দশকের কবিরা সকলেই কোনও আদর্শের সন্ধানী, জীবনাদর্শে, কাব্যাদর্শে ও ভাষাদর্শে ।  তাঁদের গদ্যকবিতায় ছন্দ নেই এমনটা নয়। এর ছন্দ গদ্যের চালে, পর্ব-বৈচিত্রে, ভাব-প্রকাশে, ভাষার বিন্যাসে এবং পদ্যের রঙ ধরানোতে। বিষয়টি পদ্য-ছন্দের চেয়ে জটিল। সুতরাং যারা গদ্যে কবিতা লিখেন তাঁরা পদ্য-ছন্দের সবকিছু জেনেই এগোন । 

যেমন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেওয়ালের লেখা’ নামের এই গদ্যকবিতাটি : 

দেওয়ালের লেখাগুলিকে

কারা যেন মুছে দিতে চাইছে ।

কারা যেন

বত্রিশ সিংহাসনের প্রচণ্ড স্পর্ধায় চক্ষু লাল ক’রে

নির্দেশ দিচ্ছে : “এবার থামো ;

এখন থেকে বিপ্লব আমাদের হুকুম মেনে চলবে” ।

একবার সিংহাসনে উঠে বসতে পারলে

তখন দেওয়ালের লেখাগুলি অশ্লীল প্রলাপের মতো মনে হয় ।

তখন অপরের পোস্টার ছেঁড়াই শ্রেণী-সংগ্রামের কাজ ;

অথবা ডজন খানেক মন্ত্রী জড়ো ক’রে রাস্তায় বক্তৃতা দেওয়া :

“সাবধান! যারা দেয়ালকে কলঙ্কিত করছ! তোমাদের পেছনে

এবার গুণ্ডা লেলিয়ে দেব ।”

তারা বত্রিশ সিংহাসনের আশ্চর্য মহিমায়

এখন থেকে বাংলা দেশের তামাম দেওয়ালগুলোকে

নতুন ক’রে চুনকাম ক’রে দেবে, যেন কোথাও কোনো

গুলি খাওয়া মানুষের রক্ত

ছিটেফোঁটাও দাগ না রাখে ।

অরুণ মিত্রের ‘রাস্তা’ নামের গদ্যকবিতায় আছে চল্লিশ দশকের বৈশিষ্ট্য:

রাস্তার কথা ছাড়া কী আছে আর?

ঘরগুলোই তো রাস্তায়

উনুনের ধোঁয়ায় কচি আওয়াজ ঘুরছে,

জাদুখেলা চলছে

পুঁতির মালা পুতুল আর রঙিন ছবির,

ছাইগাদার স্বপ্নের চারা

ছোট ছোট পাতা নাড়ছে

খুকীর হাতের লাল রুলি

খোকার ধরা ঘাড়বাঁকানো ঘোড়া

বাতাস মজিয়ে দেখছে,

ক্ষুদে ক্ষুদে পাগুলোর শব্দ ঠিক গানের মতো।

অনন্ত নীল থেকে অনন্তপ্রসাদের গলা;

হেই রাত্রি হেই দিন

পাহাড় থেকে নদী বইয়ে দাও,

জলছপছপ ঘাসের ওপর দিয়ে খোকাখুকুরা

বড়োদের নিয়ে যাক গেরস্থালিতে,

রাস্তারা পড়ে থাকুক রাস্তায়।

কেবল সময়ের প্রভাবে নয় । চল্লিশের কবিরা গদ্য কবিতার দিকে ঝুঁকেছিলেন তিরিশের ভাবনা ও ছন্দের বলয় থেকে বেরোবার জন্য, ঠিক যেমন তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরোবার জন্য নানা শৈলী অবলম্বন করেছিলেন । চল্লিশের কবি জগন্নাথ চক্রবর্তীর ‘ছায়া’ কবিতাটা পড়া যাক 

তুমি আমার খুব কাছে এসে বসেছিলে

যেমন করে সোনালি ফড়িং এসে বসে জলের কিনারে।

তুমি! সম্পূর্ণ তুমি

আমার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলে

যেমন করে লোকে জলে পড়ে—

বা প্রেমে পড়ে

তুমি নয়,তোমার ছায়া।

তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং স্বপ্ন

সবই ভিজে গিয়েছিল

অবশ্য আমিই সেজন্য দায়ী,কারণ আমিই তোমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম

আকন্ঠ জলে,আমার মধ্যে–

ঠিক আমার নয়,আমার ইচ্ছার মধ্যে এবং তোমাকেও নয়,তোমার ছায়াকে–

এখন তুমি কী করবে?

ফড়িং–এর মতো উড়তে উড়তে আবার

খুব দূরে চলে যাবে?

যদিও নিজের ছায়াকে ফেলে রেখে উড়ে যাওয়া সহজ নয়

বিশেষতঃনিজের ছায়াকে

রামধনুর গা থেকে রং মুছে ফেলা তবুও বা সহজ।

নাকি কাছে এসে বসবে?

একেবারে কাছে?

যেমন করে ফড়িং এসে বসে

জলের কিনারে?

তোমার ছায়া নয়,তুমি।

হুইটম্যানের ‘লিভস অব গ্রাস’ কাব্যগ্রন্হের ‘আই স ইন লুইজিয়ানা এ লাইভ ও গ্রোইঙ’ কবিতাটা রবীন্দ্রনাথ এই ভাবে অনুবাদ করেছিলেন :


লুইসিয়ানাতে দেখলুম একটি ওকগাছ বেড়ে উঠছে;


একলা সে দাঁড়িয়ে, তার ডালগুলো থেকে শ্যাওলা পড়ছে ঝুলে।


কোন দোসর নেই তার, ঘন সবুজ পাতায় কথা কইছে তার খুশিটি।


তার কড়া খাড়া তেজালো চেহারা মনে করিয়ে দিলে আমারই নিজেকে।


আশ্চর্য লাগল কেমন করে এ গাছ ব্যক্ত করছে খুশি-ভরা


আপন পাতাগুলো যখন না আছে ওর বন্ধু, না আছে দোসর।


আমি বেশ জানি আমি তো পারতুম না।


গুটিকতক পাতাওয়ালা একটি ডাল তার ভেঙে নিলেম,


তাতে জড়িয়ে দিলেম শ্যাওলা।


নিয়ে এসে চোখের সামনে রেখে দিলেম আমার ঘরে;


প্রিয় বন্ধুদের কথা স্মরণ করাবার জন্যে সে তা নয়।


(সম্প্র্র্রতি ঐ বন্ধুদের ছাড়া আর কোন কথা আমার মনে ছিল না।)


ও রইল একটি অদ্ভুত চিহ্নের মতো,


পুরুষের ভালোবাসা যে কী তাই মনে করাবে।


তাই যাই হোক, যদিও সেই তাজা ওকগাছ


লুইসিয়ানার বিস্তীর্ণ মাঠে একলা ঝল্মল্ করছে,


বিনা দোসরে খুশিতে ভরা পাতাগুলো প্রকাশ করছে চিরজীবন ধরে,


তবু আমার মনে হয় আমি তো পারতুম না।


কবিতটা অনুবাদ প্রসঙ্গে  রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ ওকগাছ, একলা আপন আত্মসম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় আনন্দময়, আর একদিকে একজন মানুষ, সেও কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ, কিন্তু তার আনন্দ অপো করছে প্রিয় সঙ্গের জন্য এটি কেবলমাত্র সংবাদরূপে গদ্যে বলবার বিষয় নয়। এর মধ্যে কবির আপন মনোভাবের একটি ইশারা আছে। একলা গাছের সঙ্গে তুলনায় একলা বিরহী-হৃদয়ের উৎকন্ঠা আভাসে জানানো হল। এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যঞ্জনা, এই তো কাব্য; এর মধ্যে ভাব বিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ।”


পঞ্চাশ দশকের অধিকাংশ কবি ছন্দের আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলেন আলোক সরকার, যিনি গদ্য কবিতায় এনেছেন এক ভিন্ন শৈলীর লয় ; তাঁর কবিতাগুলো এই লয়েতেই বাঁধা । এখানে তাঁর একটা বিখ্যাত গদ্য কবিতা ‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’ পড়া যাক : 


বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ
বাড়ি ফিরে আসেনি ছেলে।
অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো উঁচু নিচু আলপথ
বাবলাগাছ আকন্দফুলের গাছ।

আঙুল গোল করে ঠোঁটে রাখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে নাম
শব্দ এগিয়ে যায় গুমরে গুমরে
শব্দ এগিয়ে যায় অনেকদূর - বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।

দু ধারের ধান কেটে নেওয়া মাঠ আলো জ্বালিয়ে চলছে গরুর গাড়ি
মড়মড় করে উঠছে খড় সড়সড় করে উঠছে শুকনো পাতা।
হেমন্তের শেষদিক
কুয়াশা থেমে রয়েছে চারদিকে কুয়াশা চিরে-চিরে জ্বলছে জোনাকি।

কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে দুটো চোখ - বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে এগোচ্ছে
ঝটপট করে উঠছে বাদুড় ককিয়ে ককিয়ে উঠছে প্যাঁচা
লাফিয়ে উঠলো ইঁদুর সড়সড় করে উঠলো খড়।

বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে এগোচ্ছে
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
বড়ো বড়ো দুটো পা মড়মড় করে উঠছে সাপের খোলস
আলো-জ্বালানো গোরুর গাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে চোখের ওপারে। 


তিরিশ থেকে পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত  কবিতায় চিত্রকল্প থাকতো নিটোল, প্রতীকী, একক, সমগ্র,  ব্যাখ্যাযোগ্য। বোঝা যেত যে কবির হাতে ছিল অফুরন্ত সময় এবং তাঁর জীবনের গতি কাজল সেনের সময়ের তুলনায় ছিল মন্থর। ওই সময়খণ্ডের অধিকাংশ  কবিতা তাই এক-স্হিতি, এক-অভিজ্ঞতা, এক-ছবি নির্ভর ছিল। বস্তু, স্হান, প্রাণী, সংস্হা, আইডিয়া ও সময়, যে ছয়টি জিনিসকে দিয়ে অভিজ্ঞতা-বিশেষটি গড়ে ওঠে, তার যে-কোনওটির একটির প্রতি আলোকপাত করে তাঁরা তাকে রচনার বিষয় ঘোষণা করতেন। বাস্তবের যে-প্রতিমা তাঁরা নিজের মস্তিষ্কে নথিবদ্ধ করে রাখতেন তা সংখ্যায় অল্প ছিল বলে যেটা চাই তা প্রয়োগ করতে পারতেন। তাছাড়া, ভাষার চেতনার তুলনায় তিনি নিজের চেতনা নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।


কাজল সেনের কবিতায় চিত্রকল্প হয়ে গেছে ভঙ্গুর বা ঝুরোঝুরো । তার কারণ বাস্তব জগৎ থেকে প্রতিমায় ঠাসা সংকেত অত্যন্ত দ্রুত বেগে একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে কবির পঞ্চেন্দ্রিয়ে। প্রতিমা বহনে সক্ষম উদ্দীপকগুলোকে ঘনঘন সক্রিয় হয়ে উঠতে হচ্ছে।  প্রক্রিয়াটি কালিক ও অনিবার্য। এতে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, এসমস্ত চিন্তা অবাস্তব। 


চার

কাজল সেন বাংলা ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।বাংলা সাহিত্য জলধর সেনএই পর্যায়ে গবেষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন।  জামশেদপুরের একটি কলেজে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং অবসর গ্রহণ করেছেন। সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ নিবন্ধ। পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে হাতেখড়ি হয়েছিল হাতেলেখা পত্রিকাপথিকৃতএ।  ‘সারস্বতমুদ্রিত পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। তারপর সুদীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে সম্পাদনা  করছেনকালিমাটিপত্রিকা। পাশাপাশি আন্তর্জালেকালিমাটি অনলাইনপত্রিকা সম্পাদনা করছেন বিগত বছর। 

কাজল সেনের কবিতায় আমরা সেই পাঁচটি বৈশিষ্ট্য পাই যার কথা বাংলাদেশের আলোচক লুৎফর রহমান গদ্য-ছন্দ সম্পর্কে  বলেছেন ; সেগুলো হলো : (১) গদ্য ছন্দের স্বাধীনতা: গদ্য-ছন্দের বাহন গদ্য। আমরা জানি পদ্যের চেয়ে গদ্য অনেক বেশি স্বাধীন, বৈচিত্র্যময় ও স্বেচ্ছাবিচরণকারী। তাই জন্মগতভাবেই গদ্যকবিতা মুক্ত কবিতা। ইতিপূর্বে যে মুক্তক কবিতা বিষয়ে আমরা জানতাম  সেটা তৈরি হয় পদ্যে। পদ্যকে যখন কতোগুলো নিয়মের বন্ধন থেকে মুক্ত করে গদ্যের দিকে যাত্রা করানো হয় তখন জন্ম নেয় মুক্তক কবিতা। গদ্যকবিতা এর চেয়েও মুক্ত কবিতা। এটাই ছন্দের গতিশীলতা। (২) পর্ব-বৈচিত্র: পদ্যে পর্বের একটা সামঞ্জস্য থাকে। গদ্যছন্দের পর্বগুলো দৈর্ঘের দিক থেকে বিষম হয়। পর্ব ও পংক্তি কোনোটার ওপর পদ্যের মতো ছন্দের নিয়ন্ত্রণ থাকে না । পর্বগুলোয় থাকে বৈচিত্র্য। সুতরাং পর্ব-বৈচিত্র হচ্ছে গদ্য-ছন্দের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে গদ্য-ছন্দ অধিকতর মুক্ত ছন্দ। (৩) ভাবপর্ব: উচ্চারণের সময় জিহ্বার যেখানে নিশ্চেষ্টতা হয় সেটাই যতি। পদ্যে যতি দিয়ে পর্ব নির্দিষ্ট হয়, জিহ্বার থেমে যাওয়ার কারণ ভাব,  বিষয় নয়। বাক্যে একটি ধ্বনি প্রবাহ থাকে, যতি দ্বারা যা বিভক্ত হয়, সে জন্য পদ্য-পর্ব মূলত ধ্বনি-পর্ব। কিন্তু গদ্যের পর্বগুলো যতির দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না, এতে আবেগের হ্রাস-বৃদ্ধি অনুযায়ী ভাবের প্রয়োজনে এক একটি পর্ব সৃষ্টি হয় এবং ছেদ পড়ে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গদ্যকবিতার পর্বগুলো ছেদের দ্বারা নির্দিষ্ট হয় অথচ পাঠককে তা অনুমান করে নিতে হয় । এ জন্য পর্বগুলোকে ভাবপর্ব বলে। এই ভাবপর্ব হচ্ছে গদ্য-ছন্দের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য। এজন্য রবীন্দ্রনাথ একে ভাবের ছন্দ বলেছেন। (৪) গদ্যে পদ্যের রঙ: পদ্যে ছন্দের দ্বারা বিন্যস্ত ধ্বনি হচ্ছে অতিনিয়ন্ত্রিত। সেখানে গদ্য-ছন্দের ধ্বনি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত। এর পরেও গদ্যকবিতা পড়ার সময় কানের একটা তৃপ্তি হয়। গদ্য কবিতারও একটা ধ্বনিসৌন্দর্য আছে। কবিরা বাক্যকে বিবিধ চরণে সাজিয়ে এটা করেন। এমনটা তাঁরা করেন গদ্যকবিতায় ভাষার ধ্বনিগত মাপ রক্ষার প্রয়োজনে। তাঁরা জানেন স্বাধীনতা মানে উশৃঙ্খলা নয়, বরঞ্চ অরো বিন্যাস; তবে এর শৈলী-কৌশল  সূক্ষ্ম। গদ্যকবিতার গদ্য সাধারণ গদ্যের মতো নয়। আবার সাজে-লাজে ঘোমটা-দেয়া অতিনিয়ন্ত্রিত ছন্দের বাঁধনে বাঁধাও নয়। এতে থাকে ছন্দের এক অদেখা অস্পষ্ট ঝঙ্কার। এই ঝঙ্কারই গদ্যে পদ্যের রঙ ধরানো। এটাই গদ্য-ছন্দের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য। (৫) পদ্যাভাস সৃষ্টি: গদ্যকবিতার ভাবপর্বগুলোর মধ্যে ধ্বনির ঝঙ্কার অর্থাৎ ছন্দের আভাস ফুটিয়ে তোলা কঠিন। ভাবপর্বের গদ্যকে যদি এমনভাবে সাজানো হয় যাতে পদ্যছন্দের এক অস্পষ্ট ছাপ পড়ে তাহলে একটু ধ্বনিস্পন্দন অনুভূত হতে পারে। সে জন্য সাদামাটা ভাষার সামান্য বিন্যাস প্রয়োজন হতে পারে গদ্য-ছন্দের আকৃতি ও প্রকৃতি বজায় রেখে। সুতরাং গদ্যকবিতায় পদ্যাভাস সৃষ্টি হচ্ছে গদ্য-ছন্দের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য।

দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে একবার এক আলোচনায় কাজল সেনের কবিতার প্রসঙ্গে এসেছিল । দাদা বলেছিলেন যে কাজল সেনের ‘বাজে শুধু শার্টের বোতাম’ কাব্যগ্রন্হে পাওয়া যায় বর্তমান কালখণ্ডের সময়বিশ্বকে অর্থাৎ  আমরা কাজলের কবিতায় পাই কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তি ও আবেগের দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ, ক্রমান্বয়হিনতা, অফুরন্ত অর্থময়তা, আঙ্গিকের মুক্তি, একক প্রতিস্বের অনুপস্‌ইতি, লিমিনালিটি, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়, আত্মমনস্কতা থেকে কবিতার মুক্তি, অপরিমেয় নাগাল, প্রতীকবর্জন, অভেদের সন্ধান, প্রবণতার বহুমুখিনতা ইত্যাদি । প্রকাশিতব্য এই কবিতাসমগ্রের সব কয়টা বইয়ের কবিতায় আমি এই বৈশিষ্টগুলো পেয়েছি, এমনকি ১৯৯২ সালে প্রকশিত  ‘এই পীচ রাস্তা শব্দের হারমোনিয়াম’ নামের প্রথম কাব্যগ্রন্হতেও । এটাই গদ্য কবিতার সুবিধা । ‘আমি’ শব্দটি উচ্চারিত হবেও, সমীর রায়চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, কাজল সেনের কবিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, ব্যাক্তিকেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে পরিধির দিকে ব্যপ্ত হয়ে গেছে। কেন্দ্রিকতা ভেঙে বেড়ে উঠেছে। 

কাজল সেনের ‘অবিশ্বাস জমা আছে আস্তিনে’ কবিতাটা পড়লে উপরোক্ত বক্তব্য স্পষ্ট হবে 

যে অবিশ্বাস জমা আছে আস্তিনে 

শুঁয়োপোকার মতন ক্রমশ তা

উঠে আসে ব্রহ্মতালুতে

শিরা উপশিরা ধমনী বাহিত হয়ে

অন্তর্জলী যাত্রায় ব্যগ্র আজ

অস্তিত্বের বীজ

.

এ বড় কঠিন সময় হে

বিস্তর কাটা ছেঁড়া উঠে আসে না

এক রত্তিও মাখন

অপ্রেম সহবাসে

পয়দা করে যাওয়া শুধু

বরাহের ঝাড়

ভাষাতাত্বিক অধ্যাপক প্রবাল দাশগুপ্ত বলেছিলেন, এবং ওনার কথাগুলো কাজল সেনের কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা হল এই যে, “কিছু কাল আগে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বলে একটা প্রসঙ্গ ফেঁদেছিলাম। সেই সূত্রে ভেবে বলো তো, তুমি যখন আধুনিক বিজ্ঞানের দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ দিয়ে দূরের মহতো মহীয়ান্ আর কাছের অণোর্ অণীয়ান্ জিনিসপত্রকে যথাক্রমে কাছে টেনে আনো এবং বাড়িয়ে মাঝারি আয়তনে নিয়ে আসো যাতে তোমার নজরে তাকে ধরতে পারো, তখন তুমি আদতে কী করছ? আমি বলে দিই? জিনিসটাকে তুমি তোমার বাগে আনছ, যাতে তোমার পছন্দমতো ম্যাগনিফিকেশনে দেখতে পাওবাগ, ইয়ানী বগীচা, ওই বাগান আর কী। তোমার সাজানো বাগানে নিয়ে আসতে পারলে তবে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলো, এইবার ধরতে পেরেছি। নীটশে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় দিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে ১৮৮৯ সালে, একজন প্রখ্যাত নীটশেবিদ পণ্ডিতকে চিঠি লিখে বলেন, “আমাকে তুমি ধরতে পেরেছ ভালো করেই জানি। খুব ভালো ধরেছ। এবার আমায় ছাড়তে পারবে কি? ছেড়ে দেখাও তো? অধুনান্তিক শেখাটা ওই ছাড়তে শেখার দস্তুর। বাগে আনা কথাটার ব্যুৎপত্তি যাঁরা জানেন তাঁরা ভুল ধরিয়ে দেবেন, সেই অপেক্ষায় আছি, পাঠক তুমি তখন ধরতে পারবে আসল উত্তরটা কী হবার কথা, আমি আগাম বলে রাখছি, তার পর ভুলে যেও না উত্তরটা ধরতে পারার পর ছাড়তে পারাও চাই, নইলে তোমার সঙ্গে আকাশের সংযুক্তি ছিঁড়ে যাবে, পড়ে থাকবে খালি আধুনিকবাদের যুক্তি, দেখবে যে মাটির সঙ্গে একেবারেই আকাশের কোনো যোগ নেই তাকে আর মাটি বলে চিনতেই পারছ না, মনে হচ্ছে ছাই।

বাংলাদেশের কবি ও আলোচক তুষার গায়েন তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ সংকলনের বই বাংলা কবিতা:অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধানে  বইতে বাংলা কবিতায় বহুল-উচ্চারিত শব্দ 'পোস্টমডার্ন' ভাবধারার স্বরূপ ব্যবচ্ছেদ করেছেন।  'বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান' প্রবন্ধে তিনি সরাসরি মডার্ন ও  পোস্টমডার্ন শব্দ যুগলের ব্যবচ্ছেদ দিয়ে শুরু করেছেন। তিনি পোস্টমডার্নের বাংলায় বহুল প্রচলিত পরিভাষা উত্তরাধুনিক বা উত্তর আধুনিক বাদ দিয়ে  প্রবাল দাশগুপ্তের ব্যবহৃত পরিভাষা 'অধুনান্তিকতা' বেছে নিয়েছেন, এবং সেই বেছে নেওয়ার পেছনের কারণগুলো বর্ণনা করেছেন।তুষার গায়েন আধুনিকতা ও অধুনান্তিকতার দর্শনগত জায়গাটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি খুবই সংক্ষেপে  দেখিয়েছেন এই দুটো কীভাবে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ভাবধারা। অর্থাৎ 'আধুনিক' মানে সমসাময়িক আর 'অধুনান্তিক' মানে আধুনিকের চেয়ে একটু এগিয়ে— এ ভাবনাটি যে ভুল তা তিনি তুলে ধরেছেন। আধুনিক ভাবধারা থেকে সৃষ্ট পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসে মানুষ অধুনান্তিক চিন্তার মধ্য দিয়ে  এসেছে এবং দিনে দিনে আরও বিশ্বায়নের দিকে ঝুঁকছে সেই আলোচনা উঠে এসেছে। অতিমারী এসে আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে যে বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বকে ছিঁড়ে ফেলার টাকা-ডলারের আর ট্যাঙ্ক-নৌবহরের কথা বোঝায় না । তা আরও গভীর ও ব্যাপক ।  কাজল সেন তাঁর শেষ দিকের এবং ঝুরো কবিতায় এই পরিসরটিকে ধরতে পেরেছেন ।

তাঁর ‘এই পীচ রাস্তা শব্দের হারমোনিয়াম’ কাব্যগ্রন্হের  ‘বাসস্টপে ছিল না কেউ’ কবিতাটি পড়লে, আমি যা বলতে চাইছি তা স্পষ্ট হবে বলে মনে হয় । ওপরে বিভিন্ন সময়ের বাংলা গদ্য কবিতা থেকে একেবারে ভিন্ন জগতে চলে গেছে কবিতাটি, কেননা সেই পশ্চিমবঙ্গ আর নেই যা একদা ছিল ওই কবিতাগুলো রচনা করার সময়ে ।

বাসস্টপে ছিল না কেউ থাকে না কোনো দিনই

উদ্ভিদের প্রত্যাশায় তবুও তোমার যৌবন

.

এভাবেই ট্রেনের জানালা থেকে সরে যায় রোদ

প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকে বাসী শালপাতা

বর্ষাকালে এবছরও বৃষ্টি হল খুব

তবুও শুকনো কুয়ো মাটি চেটেপুটে নিল সব রস

.

কৃপণ তোমার মুঠি খোলে না এমন তেজ তার

বাসস্টপে ছিল না কেউ থাকবে না কেউ কোনোদিন

লক্ষণীয় যে কবিতাটিতে বর্তমান কালখণ্ডের যে ভাঙন তা কাজল সেন উপস্হাপন করেছেন প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনে সৃষ্ট  দৃশ্যের কাইনেটিক ফ্ল্যাশ দিয়ে, যাকে সমীর রায়চৌধুরী বলেছেন লজিকাল ক্রাক বা যুক্তি ভাঙন । ছবি ভেঙে ভেঙে এগিয়েছে কবিতাটা তার শেষে আবার ফিরেছে প্রথম দৃশ্যে এবং ঘোষণা করছে যে ‘থাকে না’ নয়, আসলে ‘থাকবে না’। ভারতের যোশীমঠ শহরটা মাটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে । উনিশ শতকের বাঙালির রেনেসঁস এসে ঠেকেছে কাটমানিতে ; শিক্ষক হবার জন্য জমি জিরেত বেচে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন অশিক্ষিত যুবকেরা,  রাজনৈতিক মাফিয়াদের । স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা কী শিক্ষা নিয়ে বেরোচ্ছে ? 

পাঁচ

কাজল সেন একজন মার্কসবাদী কবি এবং সোভিয়েতের পতন ও পূর্ব ইউরোপের সাম্যবাদী ব্লকের ছত্রখান হবার পরও তিনি তাঁর চিন্তাবিশ্ব থেকে সরে যাননি । তাঁর কবিতাকে উত্তরআধুনিক বা পোস্টমডার্ন বলা ভুল । তিনি, সমীর রায়চৌধুরী যেমন বলেছেন, একজন অধুনান্তিক কবি । অধুনান্তিক ভাবনার সঙ্গে পোস্টমডার্ন বা উত্তরাধুনিকতার মিল নেই । কাজল সেন জানেন যে, সামাজিক বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আত্মক্রীড়াময় ব্যক্তি-বিশ্বের স্ফূর্তি প্রকাশের প্রবক্তা দেরিদা ও ফুকোকে নব্যরক্ষণশীল এবং প্রগতিবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন য়ূর্গেন হেবারমাস।  টেকস্টের পাশ্চাত্য ধারণায়  এডয়ার্ড সাঈদ পাশ্চাত্যের  সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারী মনোবৃত্তির উন্মোচন করেছেন । কাজল সেন মনে রেখেছেন যে,  গদ্য-ছন্দের বাহন গদ্য। আমরা জানি পদ্যের চেয়ে গদ্য অনেক বেশি স্বাধীন, বৈচিত্র্যময় ও স্বেচ্ছাবিচরণকারী। তাই জন্মগতভাবেই গদ্যকবিতা মুক্ত কবিতা।  পদ্যকে যখন কতোগুলো নিয়মের বন্ধন থেকে মুক্ত করে গদ্যের দিকে যাত্রা করানো হয় তখন জন্ম নেয় মুক্তক কবিতা। গদ্যকবিতা এর চেয়েও মুক্ত কবিতা। এটাই ছন্দের গতিশীলতা। অধুনান্তিকতা এই মুক্তি ও গতিশীলতার কথা বলে, যা আমরা কাজল সেনের ঝুরো কবিতাগুলোতে পাই ।

ঝুরো ভাবকল্পকে বর্তমান পৃথিবীর সমাজ ও রাষ্ট্রগুলোর প্রেক্ষিতে ভাবতে হবে । অতো সুন্দর সিরিয়ার শহরগুলো আজকে আমেরিকা আর রাশিয়ার আঘাতে-আঘাতে একেবারে ঝুরোঝুরো হয়ে গেছে । আফ্রিকার সমাজগুলোর বিভিন্ন ট্রাইব এমন ঝুরোঝুরো হয়ে গেছে যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাসতে-ভাসতে কোনোরকমে ইউরোপে পৌঁছিতে চাইছে । ইরানে মহিলারা হিজাব পরতে অস্বীকার করছেন বলে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে অনেককে অথচ আমাদের দেশে হিজাব পরার জন্য জোরাজুরি করা হচ্ছে । প্রকৃতিকে মানুষ এমন ঝুরোঝুরো করে দিয়েছে যে ঘটনাগুলো যেন প্রতিশোধ নিতে নেমেছে । পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা, আমেরিকায় তুষার ঝড় আর বন্যা, অস্ট্রেলিয়ায় জঙ্গলে আগুনের ফলে অজস্র গাছ আর প্রাণী নষ্ট হয়ে গেছে । ভারতে যোশীমঠ শহর ক্রমশ মাটির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে আর সেখানকার মানুষদের পালাতে বাধ্য করছে ।

কাজল সেনের মস্তিষ্কে যে প্রতিমাগুলো নথিবদ্ধ হচ্ছে তার উৎসসূত্র হল চারিপাশ থেকে তাঁর ওপর উদ্দীপকসমূহের বৃষ্টি। তা মুষলাধার, অবিরাম। বহির্জগতে উদ্ভূত শব্দতরঙ্গ, আলো ইত্যাদি আঘাত হানে কবির ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে। একবার তা উপলব্ধি করলেই, এতাবৎ অজানা এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায়, সংকেতগুলো পালটে যায় বাস্তব জগতের প্রতিকল্পে, প্রতিমায় । কাজল সেনের ক্ষেত্রে সেগুলো ঝুরঝুরে হয়ে আসে । সংকেতগুলোকে সুবিধার্থে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: কোডেড এবং আনকোডেড। পথে চলার সময়ে শুকনো লিচুপাতা দৃষ্টিগোচর হল হয়তো, উড়ে গেল হাওয়ায়। খসখস শব্দ কানে এলো। কবি এগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ধরে রাখলেন। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সংগ্রহ খরা এই সংকেতগুলো কিন্তু মানুষের বানানো নয়। ওগুলোর দ্বারা কোনও লোক বা সমাজ কোনও বার্তা পাঠায়নি। পুরো পরিদৃশ্যটি টের পাবার জন্যে কবিকে সমাজের বানানো নির্দেশিকার ওপর সরাসরি নির্ভর করতে হচ্ছে না। অর্থাৎ সমাজস্বীকৃত চিহ্ণাবলী এবং সংজ্ঞাকে খাটাবার প্রবোজন হচ্ছে না তাঁর। এরকম ঘটনা সব সময় ঘিরে থাকে মানুষকে। যখন তা কবির ইন্দ্রিয়ানুভূতির এলাকার মধ্যে ঘটে, তখন তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন, জ্ঞাতসারে-অজ্ঞাতসারে। তা থেকে আনকোডেড বার্তা সংগ্রহ করে পাল্টে ফ্যালেন মস্তিষ্কে সংরক্ষণযোগ্য প্রতিমায়। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের কবিদের জীবনে আনকোডেড সংকেত নথিবদ্ধ করার সুযোগ বেশি ছিল এবং সঙ্কেতগুলো ছিল দ্রুতিমুক্ত। ভাষার মধ্যে তাকে খেলাবার জন্যে তিনি নিজেকে প্রশ্রয় দিতেন। কাজল সেন ও তাঁর সমসাময়িক কবিদের মস্তিষ্ক এই আনকোডেড সংকেতে এতো উপচে পড়ে যে, স্লাইডের পর স্লাইড জমতে থাকে। 

২৮ নম্বর ঝুরো কবিতা পড়া যাক এই প্রসঙ্গে

ঘুড়ি ছিল লাটাই ছিল আর ছিল মাঞ্জামারা সুতো

চন্দ্রাণী ঘুড়ির ল্যাজ ধরে ঝুলছিল আকাশে

সে এক আজব দাস্তান পাট ভাঙা শাড়ির আখ্যান

গত বছর তো বলেছিলে খুব বর্ষা হবে হল কি

রামরাজাতলায় মাথা কুটে মরল অপরূপা মৃধা

একটা মরা সাপ সজনেতলায় ভাদ্র মাসে

ইচ্ছে নদী বয়ে যায় কচুয়া পাড়ায়

অধ্যাপক কুন্তল চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধ ‘সত্তরের কবিতাঃ মুক্তির কবিতা, কবিতার মুক্তি’      প্রবন্ধে লিখেছেন, “নকশালবাড়ির রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, বিপ্লবী আন্দোলন ও প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-হিংসা, ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা, অতঃপর দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থার স্বৈরাচার, এসব কিছু অনিবার্যভাবেই বেঁধে দিয়েছিলো ষাটের শেষ থেকে উত্তাল সত্তরের অগ্নিপরিধির জীবন ও শিল্পের ধ্রুবপদ। তবু ‘মুক্তির দশক’-এর সেই আগুন ভেতর ও বাইরের নানাবিধ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে খানিক ফিকে হয়ে এলে কবিতায় সমসময়ের রক্তছাপ ও ক্ষতচিহ্ন ক্রমে মিলিয়ে যেতে থাকলো, নিভৃত আাত্মমগ্নতার নানা শিল্পিত উচ্চারণে কবিতা হয়ে উঠতে থাকলো অনেকাংশেই অ-রাজনৈতিক। কবিতাকে অনেকেই চান নি সমাজ-বিপ্লবের হাতিয়ার করে তুলতে; মনে করেছিলেন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা কবি ও কবিতার স্বাধিকারকে বিপর্যস্ত করবে; বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাসে অনাস্থাও ছিলো। সমষ্টির উচ্চকিত উচ্চারণ থেকে সম্যক দূরত্বে ব্যক্তির আবেগ-অনুভব-সংশয়-উদ্বেগ-অভিমানের আঙ্গিকসচেতন অনুচ্চকিত কবিতার চর্চা অনেক শক্তিশালী কবিপ্রতিভার জন্ম দিয়েছিলো সত্তরে।” 

কাজল সেন পশ্চিমবাংলার বাইরে বসবাস করতেন বলে নকশাল আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন । যাঁরা নকশাল আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাঁদের সামনে সমগ্র ভারতের ছবি ছিল না এবং ভেবেছিলেন পশ্চিমবাংলার আন্দোলন সমগ্র ভারতকে জাগিয়ে তুলবে । পশ্চিমবঙ্গেও যে জাতিপ্রথা দূর করা যায়নি তা তাঁদের চোখে পড়েনি ; স্কুলগুলোতে মিডডে মিল রাঁধার জন্য নিম্নবর্ণের মহিলাদের নিয়োগ করা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই নকশাল আন্দোলন একশো আট টুকরো হয়ে ঝুরোঝুরো চেহারায় বনাঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে । ফলে সত্তরের কবিরা তেমনভাবে আলোচিত হন না যেমন হন অন্যান্য দশকের কবিরা । ইনটারনেটে খুঁজেও সত্তর দশকের কবিদের পাওয়া যায় না । যাঁদের পাওয়া যায় তাঁরা সরকারের ও প্রতিষ্ঠানের আদরের দরবারি কবি । 

কুন্তল চট্টোপাধ্যায় যে কবিদের কথা লিখেছেন, তাঁদের পাইনা । উনি লিখেছেন, সত্তরের যে কবিরা প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম দ্রোণাচার্য ঘোষ। কৃষক পরিবারের সন্তান হুগলীর মগরার এই তরুণ কবি পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন জেলের মধ্যেই। কবিতা ও রাজনীতি, দুই’ই সমান প্রিয় ছিল তাঁর কাছে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন দ্রোণ, তাঁর কবিতায় ছিল সেই স্বপ্নের অকপট সাহসী উচ্চারণ: ‘আমার মুক্তির ডাক আকাশে বাতাসে / শ্রমিকের কৃষকের মাঝে শুধু ভাসে, / আমার স্বপ্নের রঙ লাল – / বয়সের শব্দে শুধু শোষন ছেঁড়ার দিনকাল’ সত্তর এখানেই ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের থেকে অনেকটাই আলাদা, আলাদা এই জেলখানায় পুলিশের গুলিতে কবির মৃত্যুতে। আলাদা সেই মৃত্যু নিয়ে লেখা আর এক কবি সনৎ দাশগুপ্তের সন্তপ্ত স্মরণলিপিতে: ‘রক্তমাখা দ্রোণফুল পড়ে আছে ঘাতকের থাবার তলায় / ওই ফুল একদিন ফুটেছিল জ্যোৎস্নায়, কবিতায় / তাহার মায়ের স্নেহের ছায়ায়।’ কারান্তরালে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছিল যাদবপুরের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের ছাত্র, সম্ভাবনাময় কবি তিমিরবরণ সিংহকে। হাজারিবাগ জেলে কারারক্ষীদের গুলিতে আরও অনেকের সঙ্গে নিহত হয়েছিলেন কলকাতার নকশালপন্থী তরুণ কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়। দ্রোণ-তিমির-মুরারির মতো শহীদ কবিদের পাশাপাশি সেই সমসময়ের কবিতা লিখতে এসেছিলেন অভীক গঙ্গোপাধ্যায়, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত গুপ্ত, সাগর চক্রবর্তী, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী দেব, মৃদুল দাশগুপ্ত প্রমুখ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রতিস্পর্ধায় নারী-কলমও সোচ্চার হয়েছিল মধুমিতা মজুমদার, কল্যাণী সেনগুপ্তের কবিতায়। তুলনায় অপেক্ষাকৃত প্রবীণ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মনিভূষণ ভট্টাচার্য, সমীর রায়, কমলেশ সেন, সৃজন সেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আগেই যুক্ত ছিলেন। সত্তরের কবিতায় আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন আর এক মফস্বল শহরের কবি জয় গোস্বামী। বিষয়, ভঙ্গি, শব্দ, ছন্দ ও ছন্দোহীনতায় শুরু থেকেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন জীবনের রূপ-রূপান্তরের এক আশ্চর্য নিজস্ব জগৎ।শুরু থেকেই জয় খুঁজে নিচ্ছিলেন এক স্বতন্ত্র ইডিয়ম, কবিতার এক অন্তর্লীন পরিসর। সেই থেকে জীবন ও লিখনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, যাপন ও বাচনের এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে জয় ক্রমাগত উড়িয়ে চলেছেন তাঁর সৃজনপ্রাচুর্যের জয়পতাকা। ‘জীবন দেখায়, তাই দেখি’, এরকম এক ‘দেখা’-র দর্শন নিয়ে এসেছিলেন ব্রত চক্রবর্তী। জীবনকে দেখতে দেখতে, নিজেকেও দেখতে দেখতে, কবিতার শরীর ও ভাষা নিয়ে নানা ভাঙচুরের খেলায় মেতে ব্রত আজও তাঁর ব্রতযাত্রায় অনেকটাই ব্যতিক্রমী।”

কুন্তল চট্টোপাধ্যায় আরও লিখেছেন যে, তিরিশ থেকে ষাট, এই চার দশকের বাংলা কবিতায় কবিদের আশ্রয়-ঠিকানা ছিলো ‘কবিতা’, ‘পূর্বাশা’, ‘শতভিষা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘কবিপত্র’ ইত্যাদি কবিতা-পত্রিকা এবং সেগুলি সবই ছিলো কলকাতা-কেন্দ্রিক। সত্তরের পরিবর্তনকামী রাজনীতির অন্যতম শ্লোগান ছিলো গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার। যেন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই সত্তরে প্রকাশিত হয়েছিলো বেশ কিছু কবিতার কাগজ, কলকাতার বাইরে থেকে—‘কৌরব’, ‘ভাইরাস’ , ‘বররুচি’, ‘আমরা সত্তরের যীশু’ প্রভৃতি। বাংলা কবিতার কলকাতা-কেন্দ্রিকতা অনেকখানি বদলে গিয়ে সত্তরের কবিতা-চর্চায় দেখা গিয়েছিলো এক মফস্বলী বৃত্তান্তের সূচনা। এক অর্থে বাংলা কবিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বিকেন্দ্রীত হলো সত্তরে। নাগরিক এলিটিজমের বৃত্তায়িত আধুনিকতা থেকে দূরে নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে থাকলো জামশেদপুর, রাণাঘাট, মেদিনীপুর, পুরুলিয়ায়। বেশ কিছুটা খোলা হাওয়া বয়ে গেলো সত্তরের কবিতায়।”

সত্তরের কবি কাজল সেন কৌরব, ভাইরাস, বররুচি, আমরা সত্তরের যীশু ইত্যাদি পত্রিকার মতন গোষ্ঠী তৈরি করতে পারেননি  এবং একা হাতে ‘কালিমাটি’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন ও দলমত নির্বিশেষে রচনা প্রকাশ করেছেন তাঁর পত্রিকায় । তাঁর প্রথম সম্পাদিত মুদ্রিত পত্রিকা ‘সারস্বত’। এবং বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে ‘কালিমাটি’ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন।এছাড়া আন্তর্জালে ‘কালিমাটি অনলাইন’ পত্রিকা বিগত নয় বছর ধরে প্রতিমাসে প্রকাশিত হচ্ছে সরকার ও প্রতিষ্ঠানের বাইরের কবিদের আত্মপ্রকাশের কথা ভাবতে হয়েছে তাঁকে। 

নিজের কবিতা সম্পর্কে এক অসাধারণ আঙ্গিকে ও গদ্যছন্দে  শব্দ-ছবি যোজন করে ‘মগজে কবিতা’ শীর্ষক কবিতায় যা বলেছেন কাজল সেন সেটি দিয়েই আমার আলোচনা শেষ করি :  

মগজে ছিল ভোর কী হলো তারপর হিসেবি পায়ে পায়ে কে কাকে জড়ালো

রুমালে তবে কে বেঁধে যে দিল ছাই আকাশে তবু কেন চালতা ওড়ালো

আমি তো আছি বেশ আমার তাস নিয়ে দু’হাতে আছে ভালো গোলাম-টেক্কা

মারব যদি মারি ধুমসো গণ্ডার ধেনোতে যাবে কেটে উপোসী রাতটা

অনেক হয়েছে হে প্যাঁচ ও পয়জার ভাপকি মেরে মেরে চলবে কত আর

আঙুর হলো আজ তবে কী প্রাতরাশ অভাবী বেশ্যার গলায় সীতাহার

যে মেয়ে নেচেছে সে মেয়ে নাচবেই নাচবে আরও কত দুলালী রাধিকা

আমি তো জলে নেমে ভেজাতে চাই বেণী ধুনকি মারে ঘাই মগজে কবিতা

 

 

 

 

 

  •  

  •  

  •  

  •  

  •  

 


No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...