Wednesday, June 27, 2018

দাদা সমীর রায়চৌধুরী সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ

১.
দাদার প্রথম পোস্টিং ধানবাদে, থাকতো একটা গ্যারাজের ওপরে একতলার ফ্ল্যাটে । একবার গিয়ে দেখি দাদা অফিসে গেছে আর দাদার বন্ধু দীপক মজুমদার বাসন মাজছেন ।
২.
আমি মাটিতে, দাদা চেয়ারে, দাঁড়িয়ে মেজদা, দুইপাশে জাঠতুতো বোন ডলি আর মনু । চেয়ারটা দাদা নিলামে দু'টাকায় কিনে এনেছিল ।

৩.
চাকরি করার সময়ে দাদা ভেবে রেখেছিলেন যে অবসর নিয়ে কলকাতায় নিজের বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে "হাওয়া৪৯" নামে একটা দার্শনিক-সাহিত্যিক পত্রিকা বের করবেন । পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে লেখা চাইতে গেলে কেউই পাত্তা দেননি, এমনকি যাঁরা দাদার চাকুরিস্হলে অতিথি হয়ে সস্ত্রীক নিয়মিত থাকতে যেতেন, তাঁরাও । দাদাকে সঙ্গ-সাহচর্য দিতে এগিয়ে এলেন তরুণ-অতিতরুণরা, যাঁরা নিজেরাই অন্যরকম ভাবা আরম্ভ করেছিলেন ।
৪.
দাদাকে ঠাকুমা খুব ভালোবাসতেন । হাংরি আন্দোলনে দাদার গ্রেপ্তারির সংবাদে সেই দিনই ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয় আর উনি মারা যান ।
৫.
শীতকালে স্কুলে যাবার সময়ে দাদা একটা ঢোলা ডবল-ব্রেস্ট কোট পরে যেতো ; পরে সেটা আমিও পরেছি । কোটটা ছিল ঠাকুর্দার, পেশোয়ারে থাকার সময়ে পরতেন । ঠাকুমা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন, আর প্রথম বংশধরকে উপহার দিয়েছিলেন ।
৬.
দাদার ব্রহ্মপুরের বাড়িতে থাকার সময়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সামনের বড়ো বারান্দার মাপের মশারি তৈরি করিয়ে তার ভেতরে চেয়ার-টেবিল নিয়ে 'দারা শিকো' লিখেছিলেন ; যারা ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসতো তারা ওই মশারির ভেতরে বসেই আড্ডা দিতো । দাদা পাটনা থেকে ফিরে দ্যাখেন যে ওনার প্রিয় সবেদাগাছ কেটে ফেলেছেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ শ্যামল, হোমাগ্নির কাঠের প্রয়োজন মেটাতে ।
৭.
চাইবাসায় হাড়িয়া মহুয়া ইত্যাদি নেশার জিনিসের কথা শুনে পিটার অরলভস্কিকে নিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ গিয়েছিলেন দাদার বাসায় । দাদা প্রথম দিন ওদের তালশাঁস আর জাম খাইয়েছিল । ওনারা খাবার পর বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও নেশা না হওয়ায় দাদাকে জিগ্যেস করেন ব্যাপারটা কী । দাদা বলে, "আয়নায় দ্যাখো, তোমাদের জিভে পয়জানাস ব্লু কালার" । দুজনেই ভয় পেয়ে যান । পরের দিন দাদা ওনাদের হাটে নিয়ে যায় হাড়িয়া আর মহুয়া খাওয়াবার জন্য । 

৮.
চাইবাসায় নিমডি টিলার ওপরের চালাঘরে একা থাকতে ভালোলাগে না বলে দাদা কলকাতা থেকে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গেল ; সেই বন্ধু কোনো চাকরি করত না, তাই সুবিধাই হল দাদার । বন্ধুটি দাদার চালাবাড়িতে আড়াই বছর থেকে গেল আর প্রতিদিন কবিতা লেখার ফুরসত পেয়ে গেল । দাদা তার জামা-গেঞ্জি-ট্রাউজার-চটিও কিনে দিত। ট্যুরে গেলে একটি পরিচিত পরিবারে তাকে অতিথি হিসাবে রেখে যেত দাদা। সেই বন্ধুর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।
৯.
দাদা একবার বলেছিল, "আমি মোটর সাইকেল ভালো চালাতে পারি মানে এই নয় যে রাস্তায় আরো যারা চালাচ্ছে তারাও ভালোভাবে চালাতে পারে, কে কখন ধাক্কা মারবে তার ঠিক নেই । ব্যাপারটা ধর্মের মতন : অন্যের বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার কাছে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু আসে-যায় না ।"
১০.
সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার সময়ে দাদা আর দাদার বন্ধু অমিত মৈত্র উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে "লেখা" নামে একটা চটি-পত্রিকা প্রকাশ করত । সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজনের কবিতা পড়ে দাদার তা প্রশংসনীয় মনে হওয়ায় আর্টস বিভাগে গিয়ে কবিতাটির রচনাকারের সঙ্গে আলাপ করে। সেই তরুণটির কবিতার বই দাদা প্রথম মাইনে পেয়ে প্রকাশ করেছিল । তার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।
১১.
শৈশবে দাদার একটা চোখ ট্যারা ছিল । কুড়িজনের সংসার চালিয়ে পাটনার একমাত্র চোখের ডাক্তার ( জগজীবন রামের বাবা ) দেখাবার মতন টাকা বাবার ছিল না । বাবার দোকানে ডাক্তারের বৃদ্ধ বাঙালি কমপাউণ্ডার আড্ডা মারতে আসতেন । তিনি অন্য একজনের ট্যারা-চোখ সারাবার প্রেসক্রিপশান এনে দিলে বাবা দাদার চশমা করিয়ে দেন । দাদার ট্যারা চোখ সোজা হয়ে গেল, কিন্তু সারাজীবনের জন্য বাঁচোখ খারাপ হয়ে গেল ।
১২.
দোতলার ছাদে তিনচাকার সাইকেলে বসে একদিক থেকে আরেক দিকে যেতে-যেতে দাদা চেঁচাচ্ছিল, "এই বুড়ো ( মানে মেজদা ) গলা ছাড়, গলা ছাড়, নেমে যা, লাগছে গলায়।" আমার ছোটো জাঠতুতো বোন মনু চেঁচিয়ে উঠল, "বড়দা, তোমার পিঠে একটা লালমুখো বাঁদর, ফ্রি রাইড নিচ্ছে ।" দাদা লাফিয়ে নেমে দ্যাখে সত্যিই একটা বাঁদর, ছাদে দেয়া বড়ি খেতে এসে চেপে গেছে দাদার কাঁধে । 
১৩.
বাড়ির কাজের লোক শিউনন্নির বকুনি দেবার অধিকার ছিল না গৃহস্বামীর ছেলেকে । "রামচরিতমানস" পুরো মুখস্হ ছিল শিউনন্নির, আর বকুনির বদলে উপযুক্ত কোট করত, যার একটা প্রায়ই দাদাকে শুনিয়ে বলত, "তুলসী দেখি সুবেষু ভুলহিঁ মূঢ় ন চতুর নর, সুন্দর কেকিহি পেখু বচন সুধাসম অসন অহি" । মানে, ময়ূর যতোই সুন্দর হোক, সাপ খায় যেন সুধা চাটছে । ( স্মৃতি থেকে, তাই কিছু ভুল থাকতে পারে ।
১৪.
প্রতিবেশী হুলাসবাবুর বাড়িতে গিয়ে একটা খেলা খেলতে দাদার ভালো লাগতো । চোখ বুজে "রামচরিতমানস" বইটা খুলে যেকোনো দোহায় 'রামশলাকা' দিয়ে নির্দেশ করা । 'রামশলাকা' ছিল ক্রুশকাঠির মাপের লোহার কাঠি । দোহাটা ব্যাখ্যা করে হুলাসবাবু ভবিষ্যত বলতেন ।
১৫.
মেজজ্যাঠা জামের ভিনিগারের ব্যবসা ফাঁদার পরিকল্পনা করেছিলেন । তিন ফিটের এনামেলের গামলা জামে ভরে তার ওপর দাদাকে লেফ্ট-রাইট করতে বলতেন । দাদা পা দিয়ে জাম পেষার সময়ে চেঁচিয়ে একটা গান গাইতো, "তুফান মেল, ইসকে পহিয়ে জোর সে চলতে, অওর অপনা রাস্তা তয় করতে, সবলোগ ইসসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল, তুফান মেল" ( বোধহয় কাননবালার গাওয়া দাদার প্রিয় কোনো ফিল্মের, স্মৃতি থেকে লিখলুম )
১৬.
প্রতিদিন রাতের খাবার পর বড়জেঠিমা আমাদের ভাইবোনদের একত্র করে গল্প বলতেন, আরব্য রজনী, ইশপের ফেবল, বেতাল ইত্যাদি থেকে অংশ নিয়ে নিজের মতন করে মিলিয়ে-মিশিয়ে অবিশ্বাস্য কাহিনি । আমরা লন্ঠন ঘিরে বসতুম । দাদা লন্ঠনটা নিভিয়ে দিতো, বলতো আলো জ্বললে গল্পটা দেখতে পাবো না ।

১৭.
দাদার সজনেগাছ ভরে গিয়েছিল শুঁয়াপোকায় । দাদা বলেছিল, গাছটা মানুষের থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য শুঁয়াপোকার বর্ম পরে নিয়েছে ।
১৮.
দাদা পাড়ার বন্ধু বুল্লুদের বাড়ি থেকে হোমিওপ্যাথির শিশিতে জল এনেছিল, বলেছিল, নতুন ধরণের জল বেরিয়েছে, মাথায় ঘষলেই ফেনায় ফেনা । জল মেখে মাথায় ফেনা দেখে জেঠিমা বলেছিলেন, ফেলে দে, ফেলে দে, নিশ্চই মন্তর পড়া । ইমলিতলার বাড়িতে ওইভাবেই শ্যাম্পুর প্রবেশ ।
১৯.
কোনো কারণে শাস্তি দেবার জন্য বড়জ্যাঠা শরকাঠি নিয়ে দাদাকে মারার জন্য ডাক পাড়লে দাদা আমাদের ছাদ থেকে পাশের বাড়ি হুলাসবাবুদের ছাদে লাফ মেরে পালাতো । দুই বাড়ির মাঝে চার ফিট চওড়া গলি ছিল ।
২০.
"তোমাদের বাড়ির রোদ" এই কথাটাও দাদা কাজের বউয়ের কাছ থেকে পেয়েছিল ; প্রত্যেকের বাড়িতে যে রোদ আসে তা তার নিজস্ব ।
২১.
কমরেডরা যে সময়ে দারিদ্রকে মহিমান্বিত করে গল্প-উপন্যাস লিখছিলেন, দাদা বললেন যে প্রলেতারিয়েতের সৌন্দর্য্যবোধ ও জ্ঞান নিয়ে লিখবেন । কাজের বউ আসার আগে প্রতিদিন ফুলদানিকে টেবিলের মাঝখান থেকে সরিয়ে কোনে বা পাশে রেখে দিতেন । কাজের বউ সকালে কাজে এসে ফুলদানিটা আবার টেবিলের মাঝখানে রেখে দিত, এবং বিরক্তি প্রকাশ করতো ।
২২.
ইঁদুর মারার জাঁতিকলে ইঁদুর মরলে দাদা ছাদে উঠে বা মাঠে গিয়ে ইঁদুরটার ল্যাজ ধরে ঘোরাতো আর আকাশে চিলেরা চক্কোর দেয়া আরম্ভ করলে "চিল কা বাচ্চা চিলোড়িয়া" বলে আকাশে ছুঁড়ে দিতো চিলেদের দিকে । কোনো একটা চিল ছোঁ মেরে ইঁদুরটাকে ধরে নিয়ে উড়ে চলে যেতো। 
২৩.
ইমলিতলার বাড়িতে সিনেমা দেখাকে মনে করা হতো অধঃপতন । বাড়িতে যাতে কেউ টের না পান তাই একটা ফিল্মের প্রথম অর্ধেক দেখে ইনটারভালের সময়ে গেটপাসটা আমায় দিয়ে দাদা বাড়ি চলে যেতো । পরের দিন আমি প্রথম অর্ধেক দেখতুম আর বেরিয়ে গেটপাসটা দাদাকে দিয়ে বাড়ি চলে যেতুম ।
২৪.
কানাগলির শেষে দলিতদের উঠোনের গর্তে চারপা বাঁধা শুয়োরকে গনগনে লোহা ঢোকাবার আর্তনাদ শোনার পরদিন দাদা বলতো, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, বাড়ি ফিরে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিতে হবে, আজকের খাবার শুয়োরের মাংসর সঙ্গে তাড়ি।
২৫.
সাইকেলের টায়ারকে কাঠি মেরে-মেরে গোলা রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত নিয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় প্রতিবার দাদা জিততো ।
২৬.
একটা নীল মাছিকে মেরে, সুতোয় বেঁধে, গোপাল হালুইকরের ভিমরুলের ঝাঁকে গিজগিজে জিলিপির ওপর ফেলতো দাদা । একটা ভিমরুল যেই নীল মাছিটাকে কামড়ে ধরতো, দাদা ওই সুতোটা ঘুড়ির মতন ভিমরুল ওড়াতে-ওড়াতে ইমলিতলার গলি দিয়ে দৌড়োতো। পেছনে পাড়ার ছেলের দল ।

২৭.
উনোনের জন্য রোজ কয়লা ভাঙতে হতো দাদাকে । পরে মেজদা বা আমাকে ।
২৮.
দাদার পড়ার টেবিল ছিল একটা প্যাকিং-বাক্স, তার ওপর মায়ের পুরোনো শাড়ি পাতা । রাতে তার ওপর লন্ঠন । লন্ঠনের ভুষো দাদা পরিষ্কার করতো ।
২৯.
গোলারোড দিয়ে শব নিয়ে যাবার সময়ে শববাহকরা খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছুঁড়তো । 'রাম নাম সৎ হ্যায়' শুনতে পেলেই দাদা বলতো, "চল চল, মড়ার পয়সা লুটবো" । দাদার পেছন-পেছন আমি আর মেজদা দৌড়োতুম । দাদা ওই পয়সায় আলুকাবলি খেতো ।
৩০.
ফুটবল খেলার সময়ে দাদার জুতো দিয়ে গোলপোস্ট হতো, আর বাড়ি ফেরার সময়ে ভুলে যেতো । নতুন জুতো বাবা কিনে দিতেন কেবল পুজোর সময়ে । ততোদিন দাদা খালি পায়ে স্কুলে যেতো ।
৩১.
রবিবার করে বড়োজেঠার র্যালে সাইকেল নিয়ে মাঠে সাইকেল চালানো শিখতে যেতো দাদা । বড়োজেঠার শর্ত ছিল যে দুপুরে ওনার খাওয়া হয়ে গেলে পিঠ থেকে পা পর্যন্ত হাঁটতে হবে । স্প্রিং খাটের লোহার বাটাম ধরে বড়োজেঠার পিঠে পঞ্চাশবার হাঁটতো দাদা । জেঠা তার আগেই নাক ডাকা আরম্ভ করলে চুপচাপ নেমে পড়তো ।৩২.
হাংরি মকদ্দমার সময়ে বলা দাদার একটা কথা মনে পড়ে গেল :"অনেক মানুষ রাস্তার ঢিলের মতন নোংরা হয়, সুট মেরে-মেরে স্কুলের গেট অব্দি নিয়ে যেতে পারবি ; আবার অনেকের নোংরামি হয় পাহাড়ের মতন, লাথি মারলে তোর নিজেরই পায়ে লাগবে ।"
৩৩.
দাদার স্কুলের বইতে কোনো না কোনো গাছের পাতা থাকতো, পেজমার্ক হিসাবে ব্যবহারের জন্য । কেবল নেসফিল্ডের গ্রামারে থাকত যবার শীষ, সংরক্ষণ করতো পরের সরস্বতীপুজো পর্যন্ত । পৈতে হবার পর দাদা সরস্বতীপুজো করতো, মূর্তির নয় -- বই পুজো, তার আগে করতেন পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল ।

No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...