Sunday, August 5, 2018

অনির্বাণ সরকার : কবি মলয় রায়চৌধুরী এবং একটি মামলা

কবি মলয় রায়চৌধুরি এবং একটি মামলা:
.
'আর্ট ফর আর্টস সেক'- রোমান্টিক এই ধারণার বিপরীতবিন্দুতে দাঁড়িয়ে একটি কাঁপিয়ে দেয়া সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ষাট দশকের কলকাতায়, যার নাম- হাংরি আন্দোলন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫- সময় খুব বেশি নয়, মাত্র বছর চারেক, এর মাঝেই পাওয়া যাচ্ছিলো বাংলা সাহিত্যের বাঁকবদলের ইঙ্গিত। দুই ভাই মলয় রায়চৌধুরি আর সমীর রায়চৌধুরি, তাঁদের সাথে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুনির্মল বসু, দেবী রায় (আসল নাম- হারাধন ধাড়া)- এঁরা পাটনা থেকে ১৯৬১- তে প্রকাশ করেন একটি ইশতেহার। বাংলা ছাপানোর প্রেসের অভাবে ইংরেজিতেই ঐ ইশতেহার প্রকাশিত হয়। ইশতেহার প্রকাশ করে সাহিত্য আন্দোলন শুরু করার প্রথম নজির ছিলো ওইটি। 

হাংরি আন্দোলনকারীরা কি করতেন? প্রথমত প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা; কবিতায়, গল্পে ইচ্ছেমতো শব্দের প্রয়োগ- তৎকালে যেসব শব্দ বাংলা সাহিত্যে অরুচিকর বলে পরিত্যাজ্য ছিলো। তাঁরা 'মানুষের বাচ্চা', 'ঢপের কাগজ'- এইসব নামে প্রকাশ করতেন বুলেটিন। বুলেটিনের দাম লেখা থাকতো- কয়েক লক্ষ টাকা (সব বুলেটিনই প্রায় হারিয়ে গেছে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু এবং ঢাকার বাংলা একাডেমিতে কয়েকটি শুধু সংরক্ষিত আছে)। শুধু তাই নয়, তাঁরা শুঁড়িখানা, কবরে, গোরস্থানে কবিতা পাঠের আসর বসানোর পাশাপাশি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জীবজন্তুর মুখোশ পাঠিয়ে তাদের মুখোশগুলো খুলে ফেলার আহ্বান জানাতেন। পত্রিকা অফিসে জুতোর বাক্সে পাঠাতেন কবিতা, কিছুই না লিখে সাদা কাগজ পাঠাতেন- নাম দিতেন- 'ছোটগল্প'। অশ্লীল পোস্টার, লিফলেট এঁকে বিলি করতেন তাঁরা, ছবি প্রদর্শনীর পর ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিতেন।


তাঁদের এই বৈপ্লবিক ব্যাপারস্যাপার তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভালোভাবে নেয়নি। অবশ্য সরকারমাত্রেই জুজুর ভয় পায়।
.
* গ্রেফতার ও মামলা:
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবেছিল । তাঁরা হলেন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরি, দেবী রায় , সুভাষ ঘোষ , শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক । এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার কোর্টে তোলা হয় । মলয় রায়চৌধুরিকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে । মোকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরি রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরি সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান । অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করেন । লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরি এবং সমীর রায়চৌধুরিকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দফতর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারেল । ১২০বি ধারাটি ছিল ষড়যন্ত্রের, এবং সেকারণে প্রত্যেক হাংরি আন্দোলনকারী সম্পর্কে ডোসিয়ার খুলে ফেলেছিলেন কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগ । গ্রেফতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল । বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পাণ্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি ।
.
* মলয় রায়চৌধুরি ও 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার':
কবি মলয় রায়চৌধুরি হাংরি আন্দোলনের একজন পুরোধা। শুরুর দিকে ভাই সমীর রায়চৌধুরি আর সুবিমল বসাক, দেবী রায়কে নিয়ে তিনিই হাংরি আন্দোলনের সূচনা করেন। যখন হাংরি আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়, তার মধ্যে মলয় রায়চৌধুরিও ছিলেন, এবং তার একটি কবিতার বিরুদ্ধেই মূলত অভিযোগ দায়ের করা হয়। কবিতাটির নাম 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'।
কবিতাটি 'হাংরি বুলেটিন ১৯৬৪' সংখ্যায় প্রকাশের পর হাংরি আন্দোলনকারীদের মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) এবং ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এর মধ্যে মলয় রায়চৌধুরিসহ অন্যান্য যাঁরা সংখ্যাটিতে লিখেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাকি সবাইকে মুক্তি দেয়া হলেও মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশিট প্রদান করা হয় এবং ৩৫ মাসব্যাপী এ মামলা চলে। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত আর বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় (আমি ঠিক জানিনা শক্তি বিপক্ষে কেন! বোধহয় তিনি ততদিনে এ আন্দোলন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন) শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু। নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর ২০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিলো। ১৯৬৭ সালে কলকাতা উচ্চ আদালত মামলাটি খারিজ করে কবিতাটির সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। কবিতাটি ভারতের এবং ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।


এই একটি মামলাতেই কিন্তু হাংরি জেনারেশনের খ্যাতি কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত 'টাইম' ম্যাগাজিনেও এঁদের নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। 


'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতার লিংক (নিজ দায়িত্বে পড়বেন):
http://www.somewhereinblog.net/blog/pompa007blog/28880937

                                          



No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...