Saturday, September 29, 2018

সুপ্রীতি বর্মন : আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরীর পজিটিভ ইরটিসিজম



বুদ্ধদেব বসু ইরটিক উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘রাতভর বৃষ্টি’, কিন্তু তিনি ইরটিক প্রেমের কবিতা লেখেননি। মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্বের কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ইরটিক প্রেমের কবিতা, মলয় রায়চৌধুরী ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’। মলয় রায়চৌধুরী দ্বিতীয় পর্বেও বহু ইরটিক কবিতা লিখেছেন, একজন বাউলের প্রেমের পজিটিভ ইরটিসিজমের কবিতা । কোটিজন্মের যায় পিপাসা বিন্দুমাত্র জলপানে ।
মলয় রায়চৌধুরী এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, একজন বাউল । শব্দ, চিত্রকল্প, বাকবন্ধ তাঁর একতারা, গুবা, সারিন্দা, ডুবকি,  নুপর, খমক । সকল পথ হারিয়ে ফেলা তরুণী-প্রেমিকার গূঢ় তলাতল খুঁজে তুলে এনেছেন রত্নধন, চাঁদের উদয় দেখিয়েছেন অমাবস্যায় । অভেদের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি নবদ্বার-পিয়াসী এক জাজ্বল্যমান প্রতিমূর্তি, যাঁর হৃদয়ের কোলাজে স্বর্ণালী কলমের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে স্থলপদ্মে ভাসমান ‘ন্যাংটো তন্বী, । আড়ালের দরমা ছুঁড়ে ফেলে অকপট সহবাস, নগ্নমূর্তির দাম্পত্য কিংবা প্রেমিকের সত্তায়, কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা । ধূসর চিত্রকল্পের পরোয়া না করে, পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচারীতায় না ভুগে, নারীজন্মে পুরুষত্বের অসীম সোহাগশশী কলঙ্কিত না করে, প্রেমের পবিত্র অর্ঘ্যে অর্চনায় হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ, যে অর্চনার মায়াবী বর্ণনা আছে তাঁর ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে, খুশি মণ্ডলের উদ্দেশ্যে যিশু বিশ্বাসের প্রেমপূজা । আদালতে জেল-জরিমানার ভ্রূকুটি, বন্ধুদের রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়া, তবুও কবির বাউলসত্তাকে কে কবে চোখ রাঙিয়ে অবরুদ্ধ করতে পেরেছে ? মলয় রায়চৌধুরীর মতো অতো দম কারোর নেই ; এ  এক সাহসী স্পর্ধা অতল-নিতল-তলাতল সন্ধানের । তাই আমিও কোনও রোক-টোখ ছাড়া স্বাধীনচেতা মননে তাঁর প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কয়েকটির বিশ্লেষণ করছি । । বিশ্লেষণের গভীরতার মাপনযোগ্যে যতটা ইহ-দেহবাদের যে আনন্দ তুলে ধরেছি তা শুধু নিঃস্বার্থ ঐশ্বর্গিক প্রেমের অঞ্জলি, আমার স্বামী-সোহাগের অভিজ্ঞতা থেকে।

“ঘাস” কবিতাটিতে হৃদয়গ্রাহী প্রেম নিবেদনের পংক্তি কথকথা :  “আমি জন্মাবো কুমারী উরুদ্বয়ের মাঝে কোঁকড়া কৃষ্ণ ঘাস হয়ে তাতে লুকানো গন্ধমাদনের ঝর্না। মহীরুহ নই তাই জিরোই মনে হয় শুকিয়ে গেছি।”  ঢেউ তুলি তোমার ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়তি বীজ ফেলবো রাতে। তখন মনে হয় গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়ায় নিকোটিনের আসক্তি ওষ্ঠদ্বয়ের হিমাঙ্কে দূর্বল দূর্বাঘাসে আখচার মৌসুমীর অকাল বর্ষণ হবে। সর্বভুক শিখায় উজ্জ্বলা পোড়ামাটি বীর্য উত্থিত  হয় পুরুষালি ঘাসে আর প্রেমিকার দেহে উদ্ভাসিত অপরিমেয় গভীরতায় সংক্ষিপ্ত চিল্কা হ্রদ। অবুঝ কিশোরী খামচে ধরে তক্ষক জিভের টপাটপ গ্রাসে অধিগ্রহন ফেনায়িত ঢেউ। অধিগ্রাসে পুরুষালী ঘাস সমর্পিত পাষান ঈশ্বরী বেদী তোমাকে। মৃন্ময়ীর চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ ক্ষুরের ডগায় নাছোড় প্রেমিকের মাথাচাড়া। বিছানায় এলানো মৃত্তিকার নগ্নকায়ার সাথে ভূরাজত্বে তৃষ্ণার্ত সঙ্গীর নাগপাশে মুঠোয় অধঃক্ষেপ মৈথুন। মলয় রায়চৌধুরীর ইরটিক কবিতাগুলো বাউলের দেহতত্বের ভূবনমঞ্চ ।

“ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতায়” কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়ায় বসে আছেন ন্যাংটো তন্বী।

যৌননৌকায় টালমাটাল পুংঅশ্বের রোমের কেশর ঝাঁকানো ভরাডুবি পিচ্ছিল স্রোতের উষ্ণ প্রসবন।

অশ্বারোহীর রক্ষাকবচ কনডোম,,, ফানেলে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের উৎসেচক কেরোসিনে চোবানো আর বর্হিগত অপসারনে ডেসিমেলে কম্পমান স্যাঁতসেতে ধরিত্রী। চুষিকাঠির ইচ্ছেমতন রস নিংড়ানো সরস জিহ্বায় উৎকোচ গাঁটের পর গাঁট খেজুর গাছ। গৃহস্থের পরিপাটি তোশক বিছানা আজ হুলুস্থুলুস দুন্ধুভির  গর্জনে কুমারী মেঘে জমাট জলঙ্গি কামনার রসমজ্জায়। লাজুক ঘোমটায় তরুণাস্থির চলন রুফটপের সানসাইনে মালসায় জমেছে গতরাতের ঋতুস্রাব। পুংঘোড়ার ঈষৎ কম্পিত লাফে অচিন পাখির সন্ধান।

“বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় কাম রজঃগুণে প্রেমিক জেদি মন সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবে। সে দেউলিয়া থাকতে চায়,  নিঃস্ব, কারণ প্রেম হল তার একমাত্র পাথেয় । সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার প্রিয়তমার বিরহের উদ্বিগ্নতা । দুর্নিবার যন্ত্রনায় ছিন্ন প্রেমিক-স্বত্তার উৎকন্ঠিত হৃদয় প্রেমিকাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিতে চায় আপন ক্ষুধায়। লকলকে জিহ্বায় শ্যাওলা জমেছে  নিরাসক্তির ঘোমটার উদাসীনতায় । কবি যেন গা ঠেশে, ছাড়ো ছাড়ো, একরাশ আকাঙ্খায় অশ্রাব্য ঘুমের স্নিগ্ধতার দূরত্ব গড়ে ফেলেছেন ।তাই বোধহয় চোখের পালকি থেকে বিদায় নিয়েছে দৈহিক স্পর্শের টান— কন্যা এখন যুবতী।

প্রতিবেশী নাভিগহ্বরে শুয়ে আছে সোঁদা গন্ধের বিনুনি,  কবি-প্রেমিকের বীর্যের আঠালো স্রোতে নিংড়ে পেতে চাইছে আজ জরায়ুর গন্ধ, সে প্রেমিকা, সে শুভা, সে বাউলের সঙ্গিনী। মলয়-বাউলের কাছে স্বর্গ-নরক, জন্মান্তর, মূর্তি, মন্দির, শাস্ত্রগ্রন্হ স্বীকৃত ছিল না ; ধর্মের হাংরি ম্যানিফেস্টোয় তিনি লিখেছিলেন সেসব কথা ।

মশারীর রৌদ্রদগ্ধ আঁতুড়ঘরে হাপরের দীর্ঘশ্বাসে রাত্রিযাপনের কোলাজে নিতম্বের দূর্দন্ডপ্রতাপে শ্রীমতি সোহাগটুকু নিংড়ে রক্তিম টিপে করেছে বন্দী। আঠালো স্রাবে বৈদ্যুতিক ঝাপটা কবি আজ হয়েছেন ছুতোর; কবি বলেছেন যিশুখ্রিস্ট ছুতোর ছিলেন, শুভা তাঁর মেরি ম্যাগডালেন। প্রেমিকের অপটু ধস্তাধস্তি কুঠারে প্রেমিকার নাভিতে উছলিয়ে বৈতরিনী জাহ্নবীর ছলাকলায় গূঢ় অভ্যন্তর সরস মরণ-পতন। উড়ুক্কু কলা ঊরুদ্বয়ে আগোল প্রেমিকার  যৌবনতটে কবির আঁশ কামড়ে যোনির সুস্থতা নাড়ি ছেঁড়া রোমান্টিসিজম শুভার প্রতি কাঙাল হৃদয় প্রেমিক মলয়ের। তিনি চিৎকার করে বলছেন, শুভার স্তনের বিছানায় আমাকে শুতে দাও, শেষবার ঘুমোতে দাও, মর্মান্তিক আকুতি এক ব্যথিতচিত্তের । ভরাট স্তনের শিমূলে মাথা গোঁজার ঠাঁই। উদ্দাম ন্যাংটো তন্বীর আঁচড়ে কোঁকড়ানো চুলে মেঘের কার্নিশ আকন্ঠ ভরে যাচ্ছে আজ ধাতুর স্রোতে।

রূপশালী নাভিমাসে বীর্যস্নেহে স্নিগ্ধ গথিক ভাস্কর্য আঁকশি রূপে নেতিয়ে থাকা দূর্বল শরীরী বাকলের হেতাল বনে আনতে চায় মরা কোটালের বান। পরিপক্ক সোহাগের ডোরে যন্ত্রণা মন্থনে উদ্যত উদ্ধত জেদী আদি যৌনতা ঢোঁড়া সাপ স্ফীতগতরে ঊরুজাত রোঁয়াওঠা শিহরনের কম্বলে দগ্ধভূমি পুরুষত্বের ঔরসে নিষিক্ত জরায়ু আজ তার একচ্ছত্র অধিকার। তাই আজ সব প্রয়োজন শূন্য প্রেমিকার গর্ভে ঔরসজাত সন্তান রূপে শুক্র থেকে প্রেমিকের জন্ম হোক এ যেন এক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমিকের দৃঢ় অঙ্গীকার, কালজয়ী উৎসর্গীকরণ, বাউলের দেহতত্ত্বের সঙ্গমে।         

পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি নামছে স্তনে আর তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরের সমগ্র অসহায়তা। যোনি মেলে ধরো, বাউল-প্রেমিকের আকুতির টান পাঁজরাবদ্ধ উৎসবে । কুমারী অমাবস্যায় পদ্মবোঁটার উন্মোচন অন্তর্বাস ছিঁড়ে বেআব্রু শুভার রজঃস্বলায় প্রেমিক শ্লেষা হয়ে মিশে যেতে চায়।মায়ের যোনিবর্ত্মে অাত্মগোপন বা ধিক্কার স্বীয় অধিকারে তাই অথৈ বানে পিতার আত্মমৈথুনের পেচ্ছাপে তার বয়ে যাওয়া কেবল এক নিষ্পাপ প্রেমিকের স্বীকারোক্তি শুভার প্রতি তার শেষ প্রয়োজন।তাই ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে চায় এক প্রেমিকের পাপতাড়িত কঙ্কাল। এক অসাধারণ সান্ধ্যভাষায় রাঙানো চিত্র প্রেমিক সোহাগ স্বপ্ন গর্ভবতী শ্রীময়ী শুভার আসন্ন প্রস্ফুটিত কুসুম। শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলে ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে।রূপায়নে যেন কোন অন্তরীক্ষের দেবশিশু উন্মোচনে আজ বেজে ওঠে বাউলের দেহযন্ত্র । অন্তিমে বিপর্যয়ে আলোড়িত-হৃদয় এক নিষ্পাপ প্রেমীর ।  গরীবের দেওয়াল জুড়ে দেখবে কেমনে তোমার প্রতুষ্যের বাসি ওষ্ঠমধুর সঞ্চয় যামিনীর কোলাহল। তাই আরশি থাকার পরেও স্বয়ংদর্শন ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রেমিকের আত্মসমীক্ষণ— অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি অনন্তকালের জন্য।

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো”—, এই কবিতায় এক আশ্চর্য উপস্হাপন প্রেমিকসত্তা মলয়ের যা হৃদয়গ্রাহী সংলাপের চৌম্বকীয় আকর্ষণে গ্রথিত করবে মস্তিষ্ক– এক উচাটন-উন্মাদ শোকে পাঠক তাতে সহজেই যোগসূত্র খুঁজে পাবেন, যদি তাঁর আত্মত্যাগ নিঃস্বার্থ প্রেমের নিমিত্ত হয়। সংসারীর অতৃপ্ত ন্যাকা দেহভাষা নয়। বাউলের দেহবন্দনা । আজ তবে  প্রেমালাপে সঙ্গীতময় হোক নগ্ন শরীরে। পুরুষ ঠোঁটে আর নগ্ন দৃষ্টির উন্মাদ প্রেমে কামার্ত শৃঙ্গারে নারী তুমি আভূষিত হও। আর নেশারু হোক অতৃপ্ত প্রেমের আগুন প্রেমিকার দেহরহস্যের জতুগৃহে। কারণ আজ অতিরিক্ত বাচনিক ক্রিয়াজাত অগ্নির উপশম হোক তোমার মাই চটকানো দুগ্ধ পানে ছটফটানি/ অস্থিরতা জাগ্রত হোক নবকল্লোলে প্রেমিকার মুখশ্রীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তোমার ন্যাংটো তন্বী আজ হোক আমার উন্মুক্ত আরশি, স্বর্গসুখ পাই স্বীয় মুখদর্শনে আর এটাই আমার ভ্যালেনটাইন দিনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ষোলোকলায় উন্মুক্ত বিভঙ্গে আলতা চরণে রমণী তুমি তাই নিঃস্ব আজ আমি ঘুমহীন নৈঃশব্দে যন্ত্রনায় আবদ্ধ এক পাগল প্রেমী যার আজ আত্মধ্বংসের ভ্যালেনটাইন কার্ড বা গিফ্টপ্যাক  কাটা মাথার রক্তক্ষরণ। আজ তবে তার উচ্ছন্নে, প্রেমে, শরীর সার্বভৌম নয়, তাই আমি মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো। জঙ্ঘাহীন তাই অনাবৃষ্টির শোক, তবুও তোমার যৌনগন্ধী বেড়ায় আবদ্ধ যোনির হাসিমারা অভয়ারণ্যে আশ্রয় নিক নিষ্পাপ স্কন্ধহীন দামাল পুরুষ প্রেমিক লক্ষ্মীতত্ত্ব জাগাক সে রাতপেঁচার শীৎকারে তুমিও আঙুলে জড়িয়ে তাকে, ঝড় তোলো, বিদ্যুত খেলাও।

মলয়ের কাটা মাথা তোমার কোলে রেখো, তোমাদের কোলে রেখো— কিন্তু মৈথুনানন্দে চিত্তপ্রাণ জাগে কপালে।কঙ্কালসার হিম  ন্যাংটো শরীর তোমার বিবর্জিত রোমন্থন শীৎকার কি করে আজ সম্ভব তোমার সাথে সঙ্গম, কেবল মাথার সাথে । আমিও নির্বাক সাতপাঁচ ভেবে কাপুরুষ ভীত শামুকের ন্যায় মাথা মাংসল যোনিকেশরে ঢুকে আত্মগোপন করি চন্দ্রাহত ওষ্ঠে। মনে আছে একদিন শতরূপা গৌরচন্দ্রিকায় আমার মুখশ্রীর লাবণ্যে হতদগ্ধ হয়েছিলে তুমি কিশোরী, বলেছিলে চলো পালাই, একসাথে তবেই অমাবস্যার চাঁদে আমাদের প্রেমের মোক্ষ প্রাপ্তি কিন্তু আমি কাপুরুষ ভীতু প্রেমিক কাঙাল তোমার প্রেমে। মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ বইয়ের প্রথম প্যারা আরম্ভ হয়েছে এক যুবতী এক পুরুষের হাত ধরে যখন বলেছিল, ‘চলুন পালাই’। সাহসিকতার মাস্তুলে জমেছে আজ অস্তরাগের বিষাদনৌকা, কেন ভাসাতে পারিনি সেদিন।
তুমিও শিহরিত,  কুন্ডলী পাকিয়ে দাঁতের কর্ষণে চুঁইয়ে পড়তে থাকে উঁচিয়ে থাকা অমৃতদুগ্ধ বোঁটার উষ্ণপ্রসবন সিঙ্গেল মল্ট হাঁ করা মুখে ঢালতে লেগেছো অনর্গল আর ঘামে দরদর করে ভিজে আমিও প্রাচীন পুরুষাঙ্গ বর্জিত ঠোঁটে ডুব দিই অতলান্ত অলকানন্দায়। তাঁর আনন্দ, নৃত্য, গীতিময়তা যেন র‌্যাবেলেস্ক ।
আমরা জানি মলয় রায়চৌধুরীর প্রিয় পানীয় হল সিঙ্গল মল্ট ও আবসাঁথ । বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেনেরও প্রিয় ছিল আবসাঁথ । স্লিভলেস ব্লাউজ তোমার ভিজে সপসপ অন্তর্বাস আর আমার বাউলসুলভ একা মাথার জরায়ুমুখে গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গের কোন স্কোপ নেই আর। শুধু মস্তকের ঔদ্ধত্ব্যে আজ হতে খুব ইচ্ছা করে জ্যান্ত লকলকে জিব্রাগ্রীবা। উঁকি দিয়ে চতুরঙ্গ কৌশলে কোন লাউডগা উদোম করুক তোমায় আমার জিহ্বায় লুকানো তীক্ষ্ণ করাত। হস্তকরপদ্মহীন তাই রুদালির শোক আলিঙ্গনে লুপ্ত তোমার কষিয়ে বুকে জাপটে ধরার বাহুডোর। আজ তাই হতে চাই নিঃষ্পাপ সন্তান অঙ্গ বিবর্জিত তোমার কৃষ্ণগহ্বরের প্রসবে। আজ না হয় সম্ভ্রান্ত লাবণ্যরসে মাধুর্য আনুক রমণীয় লাস্যে তোমার উন্মোচিত জ্যোৎস্নাময় যোনির গোলাপপাপড়ি তাতেই শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁট দিয়ে একটু আদর ঘষি আর তাতেই উদ্গীরন হোক  মায়াবী মাদকের সিঙ্গল মল্ট। লিঙ্গকলা উচ্ছেদ তাই আমাকে আর উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না। আজ শুধু সম্রাট- মস্তকে হয়েছি জেহাদি। চোখ মুদে তবুও তোমার কস্তুরী ঘ্রাণের নাভিতে দিতে চাই আহুতি আমার চারুকলার কেশগুচ্ছের ঝিম ধরা মাতলামো। মার্জিত করো আজ আমায় কারণ আজ আমি এমন এক ব্যাধ যান্ত্রিক নখ ও দাঁতের শান দেওয়া অস্ত্রছাড়া তাই অসহায় হয়েছে তোমার হুক।

“বুড়ি” কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরীর এক আশ্চর্য সৃষ্টি যেখানে বাউলের অন্তিম চরণে মোচড়ানো প্রেমিক  হৃদয়ে নিঃস্ব রিক্ততার শূন্যতার যন্ত্রণার সাথে মিলেমিশে একাকার তার বুড়ি স্ত্রীর প্রতি যে নাকি তার দিদিমার বয়সী:-

এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে–
কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।

“স্বচ্ছ দেওয়াল” কবিতায়—– একটি লজ্জার দেওয়াল প্রতি কুমারীর অলক্ষ্যে যুগে যুগে অনুরাগের আকাঙ্খায় জেগে থাকে  আর তার অধিবাস উন্মুক্ত হয় কোন যৌবনের বান ডাকে। ছিঁড়ে যায় সেই স্বচ্ছ দেওয়াল যার ভাঙা ও ভাঙতে দুটোতেই অনাবিল আনন্দ জেগে ওঠে।কোন আড়াল আর অবশিষ্ট থাকে না দুজনের মাঝে শুধুই এক আসন্ন-আনন্দের  নবাঙ্কুরের জন্ম:-

“দেওয়ালখানা
বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে
সেই যুবকের জন্য
যাকে সে ভাঙতে দেবে
যুবকেরা তবু গলদঘর্ম হয়
যে ভাঙছে তারও
অহমিকা নাচে ঘামে
রসের নাগর খেতাব মিলেছে
প্রেমিকের।
দেওয়ালখানা প্রেমের ঘামেতে ভিজিয়ে ফেলা দরকার।”

“অবন্তিকার শতনাম” কবিতায় ফিরে এসেছেন আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরী ; দ্রাক্ষাস্তনে একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর জপমালা শীর্ণ কায়ার শ্বাসরুদ্ধ নাছোড়বান্দা আলিঙ্গনে শঙ্খিনী আড়মোড়া ভাঙে ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠে পুরুষোত্তম ব্যাকুল উগ্র নিঃশ্বাসের উৎকোচে চাঁই বাঁধে শঙ্কা কাছ ছাড়া ফুটন্ত দুধে। অবন্তিকাকে একশো নামের ব্যঞ্জনায় জপে জাগ্রত হয় প্রেমিকের সদাজাগ্রত কুন্ডলীচক্র দৈহিক নবরসের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোড়নে শতনামে অবন্তিকা তোমায় খোঁজে। আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া, বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী…বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে,প্যান্টির নাম পিকাসো যোনি তার কোন আদল আদরা নেই।ভগ্নাংঙ্কুরের নাম কোন মিষ্টান্ন দ্রব্য বিশেষ জিহ্বার লালার উৎসেচক।ওষ্ঠের নাম আফ্রিকান সাফারি আর পাছা দুটির নাম গোলাপসুন্দরী। উরুর নাম ককেশিয়া আরো কতক নামের শিরোপার ব্যাঞ্জনায় অবন্তিকার শতনাম মুক্তকন্ঠে জপ করছে কোন প্রেমের তপস্যায় লীন পাগল প্রেমিক।”—এরকম কবিতা কেবল মলয় রায়চৌধুরীই লিখতে পারেন, যা আনন্দের, উদ্দীপনার, প্রেমের, রসমগ্নতার, সহজিয়া, দেহসাধনার গান, মধুস্রাবী, তন্ময়তায় নিবিষ্ট । মধ্যবিত্ত কবিচেতনার বাইরে ।

“পপির ফুল” কবিতাটিও রহস্যময়—- এই কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী পোস্তগাছের ফুল ও ফল নিয়ে লিখেছেন অথচ তা সান্ধ্যভাষায় । পোস্তফুলের রঙ গোলাপি, ফল সবুজ, আঁচড় দিলে আফিম তৈরি হয়, পেকে গেলে ফেটে পোস্তর বীজ পাই । কিন্তু  এই নিষিক্ত প্রেমে অধ্যুষিত পঙক্তিগুলো ছেঁকে তোলে রোমকূপে জেগে ওঠা ফুলেল শয্যার কমফর্ট জোন। নরম অঙ্গুলির পেন্সিলস্কেচে হালকা ছোঁয়ায় আঁচড়ে তন্বী-সঙ্গিনী কবোষ্ণ কব্জি জেঁকে বসে ঘনত্বে চারকোল শেডে রোমকূপে আসক্তি ক্যানভাসে। রামকিঙ্করের স্থাপত্যে সটান এলানো বিবস্ত্র কালীমূর্তি পদমূলে বিছানো তোরঙ্গ বলশালী সুউচ্চ গতর পুরুষালি সিংহনাদে  ইজেলে টানা রঙের তৈলচিত্রে মধুদ্রবনে মহাপরিনির্বান। সাতলহরীর ছন্দপতনের ঝংকারে ভার্জিন কলসের জল মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করে যাও যত চেটে খাও তত নেশায় আদম হয়ে ওঠো। রাতের পোশাকের খোলসের তলায় স্তন দৃঢ়মুষ্ঠিতে পিচ্ছিল দলিত স্তনের গোলাপী রঙে আবিষ্ট বোঁটায় অসমাপ্ত চুম্বন আঁকড়ে ধরে শেষটুকু আবরন চাদরে অবন্তিকা তুই ইরটিক প্রেমের আগার :-

“বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ অবন্তিকা
শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা”

“নেভো মোম নেভো” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন লেডি ম্যাকবেথকে নিয়ে ; লেডি ম্যাকবেথ মোমবাতি নিয়ে পাগলের মতো ছুটছেন :-

“পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন
লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার।”

“রাবণের চোখ” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন কুলসুম আপাকে নিয়ে । তাঁর আত্মজীবনীতে আমরা জেনেছি কৈশোরে মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের বাড়িতে হাসের ডিম কিনতে যেতেন । কুলসুম আপা তাঁকে মাংস খাইয়ে বশ করে একদিন রেপ করেছিলেন, কবিতাটির পৃষ্ঠভূমি পাঠক যদি জানতে না পারেন তাহলে এই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না :-

শৈশবের কথা । সদ্যপ্রসূত কালো ছাগলির গা থেকে
রক্ত-ক্বাথ পুঁছে দিতে-দিতে বলেছিল কুলসুম আপা
‘এভাবেই প্রাণ আসে পৃথিবীতে ; আমরাও এসেছি
একইভাবে’ । হাঁস-মুরগির ঘরে নিয়ে গিয়ে আপা
আমার বাঁ-হাতখানা নিজের তপ্ত তুরুপে চেপে
বলেছিল, ‘মানুষ জন্মায় এই সিন্দুকের ডালা খুলে’ ।
রাবণের দশজোড়া চোখে আমি ও-সিন্দুক
আতঙ্কিত রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত খুলে বন্ধ করে দিই ।

“জ্যামিতির উৎস”  কবিতায় মহালয়ায় বীরেন ভদ্রর চণ্ডীপাঠকে দূর্গার পরিবর্তে দেবী অবন্তিকার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃষ্টির রহস্যের উন্মোচনে বাউল-প্রেমিকের সংলাপে। সিকোয়েন্স এ সৃষ্টিকর্তাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অনুভবকে আঙ্গিক দিয়েছে প্রেমিকার শরীরের প্রতি আঁকে বাঁকে অপরূপা তিলোত্তমার সৃষ্টি। অবন্তিকাই কবিতা, তাঁর নিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মলয় এই কবিতায়:-

অবন্তিকা বললি তুই :
নৌকো মাতাল হতে যাবে কেন ? এ-যুগে সমুদ্রটা নিজেই মাতাল !
আমি বললুম :
যত জ্যামিতি কি শুধু তোরই দখলে ? কার কাছ থেকে পেলি ?
অবন্তিকা বললি তুই:
আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব !
রেনে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো !
ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভূজ !
লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল !
ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নিখুঁত বর্তুলতা!
শ্রীধর দিলেন আয়তন !
নারায়ণ পণ্ডিত দিলেন দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা !
আর তুই কী দিলি ? অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর ?
আমি বললুম :
আমি দিয়েছি প্রেম !
অবন্তিকা তুই বললি :
প্রেম তো আলো হয়ে বেগে আসে আর তত বেগে চলে যায় !
সাম্প্রতিক কালে মলয় রায়চৌধুরী নিজের কবিতাকে বলেছেন ডোমনি ; বাউল মলয়ের কাছে কবিতাই তাঁর দয়াল, মলয় স্বয়ং একজন সাঁই । এই কবিতার নাম ‘মলয় সাঁইয়ের গান’:-

ডোমনি, তুইই দয়াল, কালো জাগুয়ার চামড়ায় মোড়া দেহ তোর
দু’জনে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে যা শিখেছি তা পশুসঙ্গের মহাবোধ
ডোমনি, তুইই দয়াল, ঘামের ত্বকে মোড়া বিকেলের পাঁকবিলাসিনী
পুলিশের গুলি খেয়ে কিশোরী বয়সে তুই খোঁড়া হয়ে গেলি
ডোমনি, তুইই দয়াল, মেছুনির হাজা-হাত, কাগজকুড়ানিয়াফাটল-গোড়ালি
কী করে মগজে নিয়ে যাবো সুষুম্নার মুখে ইড়ার রাস্তায় জড়ো করা বীজ
ডোমনি, তুইই দয়াল, বন্দু ধারণের যোগ্য করে তুলবি কবে
দম নেবো আর ছাড়ব না দঞ যাতে কুম্ভকে থাকি বহুক্ষণ
ডোমনি, তুইই দয়াল, পচা মাংসের গন্ধ তোর মুখে, ঠোঁটেতে কাকের রক্ত
তোর লবণামৃতে সকাল-সন্ধে চান করিয়ে পাপিষ্ঠ করে তুলবি আমাকে
ডোমনি, তুইই দয়াল, শ্রেনিহীন করে দিস, আমিশাষী রসে
নাভিচক্রে কাতুকুতু থিতু করে আসক্তির স্বর্ণলতা দিয়ে মুড়ে দিস
ডোমনি, তুইই দয়াল, বলে দে কেমন করে কুণ্ডলনী চক্র জেগে যাবে
তর্জনীতে অষ্টগুণ ধরে রাখবার ক্রিয়া তোয়াক্কাবিহীন করে দিবি
ডোমনি, তুইই দয়াল, আমাকে যথেচ্ছাচারী মূর্খ করে তোল
নিরক্ষর হয়ে যেতে চাই, অশুদ্ধচিত্ত, নির্বোধ, কমলকুলিশ
ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত ধরাধরি করে ডুব দিই বিষ্ঠার পাঁকে

“মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব” কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী আধুনিক জীবনের কর্মব্যস্ত নারীদের বাউল-সঙ্গিনীর আসনে বসিয়েছেন, কবিতা হয়ে উঠেছে অধুনান্তিক, উত্তরাধুনিক, প্রেমিকার প্রয়োজনও উত্তরাধুনিক দেহবন্দনার গুপিযন্ত্র  :-

ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?
ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?
ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,
জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?
ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে
উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি
ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়
চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস
ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো
আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি
ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল
আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস
পরিশেষে বলি,  মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতার পর্যালোচনার বিশ্লেষণে এইকথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে প্রত্যেকটি সৃষ্টিতে চাক্ষুষমান এক পজিটিভ ইরটিসিজম, এক বেপরোয়া উন্মাদ প্রেমের রসানুভূতি,  যাতে তাঁর প্রেয়সীর আঙ্গিক মাধুর্যে চিত্রিত হয়, মধুবনীপটের সান্ধ্যভাষায় রঙীন লৈখিক-চিত্রে বর্ণিল হয়ে ওঠে পাঠক-পাঠিকার মনের ও দেহের জগত ।









Thursday, September 27, 2018

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে বাসব রায়

মলয় রায়চৌধুরী আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র দুটো কারণে। ফিফটিজ-এ লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর ভাষায় একেবারে রাবীন্দ্রিক ছাপ নেই। তখন যাঁরা লিখছিলেন বাংলা ভাষায়, মলয় ঠিক তার উলটোদিক থেকে লিখেছেন এবং লিখতে লিখতে নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করেছেন। চলমান গদ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাকে অস্বীকার করে লেখা সত্যিই কঠিন বিষয় ছিল, এমনকি আজও তা সমান সত্য। এখানে অজিত রায়ের ভাষার কথা বলতে হয় যে তিনি সমকালকে অতিক্রম করেছেন, অন্তত ভাষার দিক থেকে। 
 
এবং মলয়ের নিজেকে উপুড় করে দেওয়ার ক্ষমতাকে আমি সেলাম করি। মলয় নিজেকেই যেন ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকেন, আর তখন যে রক্তপাত হয় সেটাই তাঁর লেখালিখি। ছোটলোকের ছেলেবেলা, ডুবজলে, মেধার বাতানুকূল, নামগন্ধ যাই পড়ি না কেন, মলয় সেখানে নিজের মাংসের টুকরোই সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন বাঁক বদলের জন্য, যেন সেটাই তাঁর কাজ। মলয়ের সেরা লেখা কোনটা? আমি জানি না, সম্ভবত মলয়ও জানেন না। কেননা তিনি সেরা লেখা লিখতে চাননি কখনো, চেয়েছিলেন চলমান সাহিত্যের ওপর হাতুড়ির ঘা মেরে নিজের ভাষাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। এবং কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি সফল। 

 
আজ অজিত রায়, এর আগে নবারুণ, যে ভাষায় লিখছেন সেটা মলয় রায়চৌধুরীরই লিগ্যাসি।

Sunday, September 23, 2018

মাসুদ হেলাল : হাংরি আন্দোলন- সাহিত্যের স্বকীয় অভিসন্দর্ভ

হাংরি আন্দোলন: সাহিত্যের স্বকীয় অভিসন্দর্ভ
অনেকদিন বাদে মলয় রায় চৌধুরী পড়তে ঘাঁটছিলাম । তাঁর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা ‘ইলেক্ট্রিফায়িং ! আগে অনেকবার পড়লেও বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোনে কোথাও শেয়ার বা অপাত্রে আলোচনা করতে ইচ্ছে হয়নি । এটা ‘নৈবেদ্য কবিতা’ । মলয় রায় চৌধুরীর জেল-জরিমানার কবিতা এই ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’! যে জন্য তাঁর হাতকড়া পড়েছিল এবং চোর-ছেঁচড়াদের সাথে কারাভোগ করতে হয়েছিল । একই সাথে পূণঃপাঠ করলাম সাহিত্যে কাল্ট মুভমেন্ট (১৯৬১-১৯৬৫) ‘হাংরি আন্দোলন’ বা 'হাংরি জেনারেশন' ও এর ডিসকোর্স নিয়ে যার ফলশ্রুতি এই কবিতা । যেখানে ছিল এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী এক অনন্যডিসকোর্স । যাকে গবেষকরা বলেন- “দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া,অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, প্রকল্পনার মনোবীজ, জ্ঞান পরিমণ্ডল, ভাষা-পরাভাষা, বাচনিক নির্মিতি, উপস্হাপনার ব্যঞ্জনা, মানবিক সম্পর্ক বিন্যাসের অনুষঙ্গ,কৌমসমাজের অর্গল, দেশজ অধিবাস্তব পরিবর্ধন ক্রিয়া” ।
প্রসঙ্গত: ১৯৫৩ সালে গ্রেট ব্রিটেনে এ. আলভারেজ ও তাঁর অন্যান্য দোসরদের ঐতিহাসিক ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’গ্রুপ, যাঁরা চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের প্রজন্মের প্রতিস্ব নির্মাণের উপাদান ও লক্ষণগুলোর কার্যকারণের সামাজিক-দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে বের করার; যখন সবে তাঁদের দেশ ভারত মহাদেশ থেকে দর্পচূর্ণ হয়ে ফিরেছিল, যা ছিল তাদের আর্থরাজনৈতিক স্খলনের সূত্রপাত । একই সঙ্গে স্বরণ করা হয় আমেরিকার ‘বিট জেনারেশন’ এর কথা । এসবের মৌল চেতনা ও অনুরননে তৈরি হয়েছিল ‘হাংরি আন্দোলনে’র প্রারম্ভিকা, যা সমকালীন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের এস্টাবলিশমেন্টকে ভীষনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের মূলে ছিলদেশভাগে পশ্চিমবাংলার পুঁজিকাঠামোয় তীব্র আঘাত । এর সাথে যুথবদ্ধও ছিলেন অনেক বিখ্যাত পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিক । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বাসু, বিনয় মজুমদার, ফালগুনি রয় সহ অনেক বিদগ্ধজন । যদিও ‘অ্যাংরি, বিট জেনারেশনহাংরি মুভমেন্টের কিছু ফেলোসফিক্যাল পার্থক্য রয়েছে এবং পরবর্তীতে শক্তি’সহ অনেকে এ আন্দোলন থেকে সরে পড়েছিলেন । তথাপি আন্দোলনগুলো সাহিত্যে একেকটি স্বকীয় জায়গা করে নিয়ে সাহিত্যকে নতুন করে পরিসর নিতে সহায়তা করেছে ।
উৎসুক পাঠক যারা এখনও ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়ে উঠেননি । খুঁজে-টুজে পড়ে নেন ।

তামারা ইয়াসমিন : হাংরি মুভমেন্ট : কালচারাল বাস্টার্ড আর হা-ভবঘুরেদের বিপ্লব ।

https://roar.media/bangla/main/literature/hungry-movement-an-unsung-cultural-revolution
3242 Views
ষাটের দশক। দেশভাগের পর পশ্চিম বাংলায় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু কলোনিতে বাড়ছে মানুষের ভিড়, অন্যদিকে স্বরাজের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে চলছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। ঠিক এই সময় আবির্ভাব ঘটলো একদল তরুণ কবির। এক পাতার বুলেটিনে তারা জীবন, দর্শন, রাজনীতি আর যৌনতা বিষয়ে কবিতা, গদ্য, অনুগল্প আর স্কেচ ছাপালো। তারপর কফি হাউজ, পত্রিকা দপ্তর, কলেজের বাংলা বিভাগ আর লাইব্রেরি গিয়ে বিলি করতে থাকলো হ্যান্ডবিল আকারে। কলকাতার মোড়গুলোতে দাঁড়িয়ে পাঠ করলো তাদের রচনাগুলো। রচনাপাঠের জায়গাকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড় জমে যায়। রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের ভক্ত বাঙালি এমন ধারার কবিতা আগে শোনেনি। কোনো কোনো কবিতার প্রথম লাইনটাই ধাক্কা দিয়ে গেল- “তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়”। আবার কোনোটায় উঠে এলো বাস্তব জীবনের প্রহসন- “আমি খালি পেটে ইন্টারভ্যু দিতে গিয়ে বলে এলুম অর্থমন্ত্রীর কাকিমার নাম”। বাংলা সাহিত্যকে এই প্রথমবারের মতো বুদ্ধিজীবীদের সভা থেকে নামিয়ে আনা হলো রাস্তায়, সাধারণ মানুষের মাঝে। যে তরুণ কবিরা এই বিপ্লব ঘটালো, তারা নিজেদের দাবি করল 'হাংরি জেনারেশন' হিসেবে। আর এই ক্ষুধার্ত কবিদের নেতৃত্ব দিলেন ২১ বছরের এক তরুণ, মলয় রায়চৌধুরী; ভবিষ্যতে যিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলবেন ‘একজন কালচারাল বাস্টার্ড’।
Advertisement
আন্দোলনের সময় মলয় রায়চৌধুরী; Source: pranabchat.blogspot.com
তবে শুধু কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি এই ক্ষুধার্ত কবির দল। ১৯৬৩ সালের কথা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমএলএ, সচিব, লেখক এবং সাংবাদিকরা পেতে থাকলেন বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। কোনোটা জন্তু-জানোয়ারের, কোনোটা দানবের। জোকার, মিকি মাউস, দেবতা- কোনো ধরনের মুখোশই বাদ গেল না। প্রতিটি মুখোশের সাথে লেখা থাকে, “দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন”। অন্যদিকে কবি সাহিত্যিকদের পাঠানো হলো বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা "Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry"। মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে ছোটগল্পের নামে আসতে লাগল সাদা কাগজ, আর বুক রিভিউয়ের জন্য পাঠানো হতো জুতোর বাক্স। প্রথাগত সাহিত্য আর সংস্কারের বিরুদ্ধে ক্রমে আরও জোরদার হলো 'হাংরি মুভমেন্ট'। কখনো তারা একটি বইয়ের দাম ধরলেন এক লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি বি সিল, আবার কখনো চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে শেষদিন পুড়িয়ে ফেললেন সমস্ত চিত্রকর্ম। কিন্তু প্রশাসনকে খেপিয়ে হাংরিয়ালিস্টদের এই আন্দোলন বেশিদিন চলতে পারল না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছয় কবির হাতে হাতকড়া পরানো হলো অশ্লীল রচনা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে। কিন্তু, সাহিত্য কি কখনো অশ্লীল হয়? নাকি এর পুরোটাই ছিল প্রতিষ্ঠিত সমাজের মুখোশধারী ভীত সুশীল শ্রেণীর ষড়যন্ত্র?
হাংরি মুভমেন্টের কথা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রেও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'বাইশে শ্রাবণ' চলচ্চিত্রের নিবারণ চক্রবর্তীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? নিবারণরূপী গৌতম ঘোষকে সৃজিত হাজির করেছিলেন একজন হাংরিয়ালিস্ট কবির চরিত্রে। উদ্ধত, অহংকারী আর খ্যাপাটে নিবারণ সিস্টেম নিয়ে বললেন- "একটা পঁচে যাওয়া সিস্টেম, প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে যাওয়া। কয়েকটা লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।” এই সিস্টেমের সাথে হাংরি প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। হাংরিয়ালিস্ট কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,
"কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না
যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে
তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?"
https://assets.roar.media/assets/GqqnkqBIEQg5T0G9_16602232_1368676819869867_6703701947626399845_o.jpg
হাংরি আন্দোলনের ইশতেহার; Source: revolvy.com
হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের মুভমেন্টকে 'কালচারাল কাউন্টার' বলতেন। পশ্চিমা বিশ্বে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি প্রজন্ম, কালচারাল কাউন্টার ঘটিয়ে নতুনধারার এক সমাজের বীজ বুনে ফেলেছে। আমেরিকার 'বিট জেনারেশন' আর ব্রিটেনের 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' গোষ্ঠির লেখকেরা মূলধারার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আঘাত হেনে বিশ্বে জনপ্রিয়। অনেকে এজন্য হাংরি জেনারেশনকে বিট জেনারেশনের সাথে তুলনা করলেন। বিট জেনারেশনের অনুপ্রেরণাতে হোক বা যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে রীতিমতো ইশতেহার ছাপিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন মলয় রায়চৌধুরী। বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন প্রচলিত ধারার সাহিত্য আর সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কবিতার ইশতেহারে তিনি লিখলেন, “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত”। লিখলেন, “এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে”। রাজনৈতিক ইশতেহারে বললেন,“রাজনৈতিক বিশ্বাসের চেহারা পালটে দেওয়া হবে”। এই হাংরিয়ালিস্টদের ইশতেহারে লিড দিলেন উল্টোডাঙা বস্তির বাসিন্দা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর প্রকাশক ও সম্পাদক হাওড়া বস্তিবাসী দেবী রায়। মলয়ের বড় দাদা সমীর রায়চৌধুরী প্রথম জীবনে কৃত্তিবাসের সাথে যুক্ত থাকলেও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। হাংরি বুলেটিন ছাপানোর অধিকাংশ খরচ সমীরই দিতেন। ১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণাবিধান মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, সতীন্দ্র ভৌমিক, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, তপন দাশ, মনোহর দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হাংরি আন্দোলনের লেখকেরা। ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে: শৈলেশ্বর ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ডেভিড গার্সিয়া এবং সুবিমল বসাক; Source: revolvy.com
মলয় এই আন্দোলনের ধারণা নিয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের বাক্য “The Sour Hungry Time” আর জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘The Decline of the West’ গ্রন্থ থেকে। শৈলেশ্বর ঘোষের মতে, ‘হাংরি জেনারেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে বিনয় মজুমদারের কবিতার সমালোচনা করতে গিয়ে শক্তি বলেছিলেন, বিদেশের সাহিত্যকেন্দ্রে যে ধরনের আন্দোলন চলছে, তেমন আন্দোলন এখানে হলে তা কেবলমাত্র ক্ষুধা সংক্রান্ত হতে পারে। “ওদিকে ওদেশে সামাজিক অবস্হা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে। আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত।” শক্তির এই ক্ষুধা অবশ্য শুধু আক্ষরিক অর্থেই ক্ষুধা ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষুধা, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের ক্ষুধা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা আর অবদমিত বাসনা পূরণের ক্ষুধা। 
Advertisement
হাংরিয়ালিস্টদের এই ক্ষুধার্ত কার্যক্রম বুঝতে হলে তাদের সামাজিক অবস্থাটা বুঝতে হবে। এই হাংরি জেনারেশনের কবিরা শৈশব এবং কৈশোরে দেশভাগ দেখেছে। এদের একটি বড় অংশ বেড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারে। তাদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ছিল না। যারা পশ্চিমবঙ্গের ছিলেন, তাদেরও অনেকে বেড়ে উঠেছিলেন মানবেতর পরিবেশে। এই লেখকেরা জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কবিদের মধ্যে হাংরিরা কেবল মাইকেল মধুসূদন আর জীবনানন্দকে শ্রদ্ধা করতেন। মলয় অবশ্য ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান। সেই সময় পশ্চিম বাংলায় বামপন্থীরা সক্রিয়। কিন্তু এই হাংরি জেনারেশনকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না তারা। এই তরুণেরা মার্কসকেও নাকচ করে দিয়েছিলেন। মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতাগুলো সোভিয়েত ভাঙার ২৫ বছর পূর্বেই অনুধাবন করেছিলেন এই বিপ্লবীরা। এবার তারা কবিতা, স্কেচ আর পোস্টারে তুলে আনলেন সমাজকে। ‘জখম’ কবিতায় মলয় লিখলেন-
“মানুষের দেয়া আইনানুগ মৃত্যুদণ্ড পেয়ে কেবল মানুষই মরে যাচ্ছে
ফ্যাক্ট্রি আর বিবাহ দুটোরই রেজিস্ট্রি হয়ে চোলেছে নিয়মমাফিক
কোল্কাতায় মদের ব্যবসা থেকে নৈতিক মাইনে পাচ্ছে ৪৫০০০ ডান হাত
১ একরে ১৩৫ জোড়া পায়ের ঠেসাঠেসি আরাম খাচ্ছে ১৯৬৫ মডেলের কোল্কাতা”
হাংরি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে অনিল করঞ্জাইয়ের স্কেচ; Source: kaalkuut.com
হাংরি মুভমেন্ট দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দেশীয় পত্রিকাগুলো আন্দোলনকারীদের নিয়ে মুখরোচক সব সংবাদ লিখে চলল। তাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কর্মকাণ্ড পত্রিকায় নিয়মিত ছাপতে থাকলো। শিরোনামে লিখলো: “হা-ঘরে সম্প্রদায়”, “কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা”, “সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?”, "Erotic Lives & Loves of Hungry Generation"। কলকাতা, বেনারস আর নেপাল গিয়ে হিপীনীদের সাথে তাদের অবাধ যৌনচর্চার বর্ণনা ছাপালো কিছু সংবাদপত্র। হাংরিয়ানদের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচারও শুরু হল। বলা হলো, তারা বিটনিকদের মতো মাদকাসক্ত। প্রকৃতপক্ষে, হাংরিয়ালিস্টরা সৃজনশীলতা বৃদ্ধির আশায় মাদক নিতেন না। ব্যক্তিবিশেষে মদ্যপান বা নেশাদ্রব্যের অভ্যাস থাকলেও তা আন্দোলনের সাথে সামগ্রিকভাবে জড়িত ছিল না। হাংরি কবিদের বিকৃত যৌনতার ধারক বলেও চালানোর চেষ্টা হলো। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মেসে এক ঘরে থাকতেন, তাই ছড়ানো হল তারা সমকামী। এভাবে সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রচার চলতে লাগল।

কল্লোল আর কৃত্তিবাসী গোষ্ঠী যা পারেনি, হাংরিরা কিন্তু তা-ই করে দেখিয়েছিলেন। হাংরি কবিতাগুলো বাকিদের চোখের সামনেই আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছিলো। ১৯৬৪ সালের ১০ই জুন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়কে চিঠি লিখলেন-
"কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দু'একজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।"
হাংরিদের এই অভ্যুত্থানে মূলধারার বাংলা কবিতায় পরিবর্তন হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দেখা গেল না, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক আর প্রশাসনের হর্তাকর্তাদের প্রতিক্রিয়াটা ঠিকই দেখা গেল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে এগারো জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো। মলয় রায়চৌধুরী, মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী- এই ছয় কবিকে গ্রেপ্তার করলো পুলিশ। এই লেখকদের বাড়িঘর তল্লাশী করার সময় পুলিশ বহু লেখা নষ্ট করলো। পাশাপাশি বই, ফাইল, টাইপরাইটার ইত্যাদিসহ সব ধরনের কাগজপত্র উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এগুলো আর কখনও ফেরত দেয়া হয়নি। হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে আদালতে নেওয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীকে। জিজ্ঞাসাবাদের পর মলয় ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হলো। মলয়ের 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' নামের কবিতাটিকে অশ্লীল আখ্যা দিয়ে চার্জশিট গঠন করল পুলিশ। মলয় লিখেছিলেন-
“আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়”
তৎকালীন পত্রিকা এই কবিতাকে 'বেহুদা' বললেও এই একটিমাত্র কবিতাই পরবর্তীতে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে জায়গা করে নিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত, ‘Modern And Postmodern Poetry of the Millenium’  সংকলনে।

যে ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, তাদের কারও কারও চাকরি চলে গেল, কারও হলো বদলি। সবার স্বাভাবিক জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে অনেকে আন্দোলন ছেড়ে দিলেন। এই সময় বদলে যায় চিত্র। মলয়ের সাথে যিনি ছিলেন হাংরি বুলেটিনের লিডার, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিলেন তার বিপক্ষে। অন্যদিকে মলয়ের পক্ষে সাক্ষী দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ভরা আদালতে সুনীল বললেন, কবিতাটিতে কোনো অশ্লীলতা নেই। নিম্নআদালত সাজা দিলেও পরবর্তীতে উচ্চআদালতের দেওয়া রায়ে, ১৯৬৭ সালে বেকসুর খালাস পেলেন মলয় রায়চৌধুরী।

মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা পত্রিকার প্রচ্ছদ;
হাংরি জেনারেশন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় দারুণ আঘাত হেনেছিল।  প্রতিঘাতে তাদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর হাংরি মুভমেন্ট জ্বলে উঠতে পারেনি। হ্যান্ডবিল আকারে প্রকাশিত হাংরি বুলেটিনগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। বুলেটিনের বাইরে হাংরি আন্দোলনকারীরা জেব্রা, প্রতিদ্বন্দ্বী, উন্মার্গ, চিহ্ন, এষণা, ফুঃসতীন্দ্র এবং দি ওয়েস্ট পেপার নামে কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিল। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র এবং ঢাকার বাংলা একাডেমি মিলে এর মাত্র কয়েকটি বুলেটিন আর পত্রিকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
‘হাংরি জেনারেশন’ যেসব সাহিত্যিকদের জন্ম দিয়েছে, তারা ব্যক্তিগত জীবনে এক অর্থে অসফল হলেও তাদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসঙ্গতিকে, এত অল্প সময়ে এভাবে কলমের আঘাতে আর কোনো সাহিত্যকেন্দ্রিক আন্দোলন, জর্জরিত করতে পারেনি।

তথ্যসূত্র

১। ক্ষুধার্ত সংকলন; সম্পাদনা: শৈলেশ্বর ঘোষ; প্রকাশক: সাহিত্য অকাদেমী, নিউ দিল্লি; প্রকাশকাল: ১৯৯৫








Saturday, September 15, 2018

ভালোবাসা


প্রতিষ্ঠানবিরোধী ১০০ কবির কবিতার প্রদর্শনী, আজেরবাইজানের বাকু শহরে

যে কবিদের বিশেষ কবিতার জন্য রাষ্ট্র তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বা হাজতে পুরেছিল বা জেলে ঢুকিয়েছিল, সেরকম ১০০ জন কবির বিশেষ কবিতাটি নিয়ে আজেরবাইজানের বাকু শহরে সম্প্রতি একটি প্রদর্শনী হলো । মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ।











 

Friday, September 14, 2018

সমরজিৎ সিংহ : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ( মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর )


মলয় রায়চৌধুরী কে ?

এই নিরীহ, আপাত শান্ত, সাদামাটা প্রশ্নের সামনে, আমাকে,  দুমিনিট, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় ; কেননা, একজন অশিক্ষিত পাঠক বলে, মলয় রায়চৌধুরীকে আমার জানা হয়ে ওঠেনি । দু-একটি সামান্য তথ্য আমি, একেবারেই ছিল না, তা নয় ; আবার, তাও জেনেছি ‘হাংরি সাক্ষাৎকারমালা’ এবং আমার দু-একটি ‘ছিটমহলবাসী’ হাংরি বন্ধুদের সৌজন্যে, তাদের দেওয়া বইপত্তর ঘেঁটে । একে কি, সত্যিই, জানা বলে ? আমি জানি না ।

সম্ভবত, ১৯৯০ বা তার আগে-পরে, কোনও এক সময়ে, কীভাবে যেন আমার হাতে এসে পড়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার বই ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ ( ১৯৮৭ ) । বইটির রচয়িতা আর কেউ নয়, মলয় রায়চৌধুরী, যাঁকে হাংরি কবি হিসাবে, আগরতলার এই ছিটমহলে, তখনও বেশ তোল্লাই দেওয়া হতো।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, এই কবিতার বইয়ের ভাষা, ও মা ! এ তো বাংলা ভাষাই । পঞ্চাশের দশকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে মুখের ভাষাকে ঠাঁই দিতে চেয়েছিলেন কবিতায়, মলয়ও, ‘ইতর লেকসিকন’ ব্যবহার করে, নতুন করে গড়তে চাইছেন । তবে, ওই যে, সুনীলীয় ভাবে নয়। সুনীলকে কেউ-কেউ বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন ভেবে, গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ; এই তথ্য মলয়ের জানা ছিল কিনা জানি না ; তবু , তিনিও খুব সচেতনভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বাঁক বদলের, অন্তত এই বইতে । আমি বেশ মজা পাই এতে, এই সচেতন প্রয়াস দেখে ।

কবিকে নিজের শৈলী বানাতে হয়, এই ‘চালু চেতনার ফাঁদ’ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে গিয়ে, কীভাবে একজন সচেতন কবিতা-লেখক, ওই ফাঁদের ফাঁস গলায় পরে ছটফট করছেন, এটা লক্ষ্য করলে, মজা পাও্য়া যায় বৈকি! মলয়, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এ নাটুকেপনা বিস্তর করেছেন ; গিমিক বলা উচিত হবে কিনা, এ বিষয়ে সংশয় আছে বলে, আমি সেদিকে যাচ্ছি না ; তবে ওই যে নাটুকেপনা করতে গিয়ে যাত্রাপালার অভিনয়ে যা হয়ে থাকে, চিচিচকার, মলয়ের চিচিচকার, বড় বেশি কানে লাগে ; লাগে, তবে মর্মে বেঁধে না । এতদসত্বেও, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ আমাকে চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে, ভাষায় । মলয়ের সাহস ও শব্দ ব্যবহারবিধি আচ্ছন্ন করে রাখে বহুদিন :-

ফেরার সময়ে ওরা ঘিরে ধরে । ছসাতজন । প্রত্যেকেরই
রয়েছে কিছু-না-কিছু হাতে । আসার সময়ে জানতুম আজ
গোলমাল হবে, তাই তৈরি হয়েই এসেছি । তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাব না সেটা ঠিক করা আছে ।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, ‘পেরেম করতে এয়েচো
এপাড়ায় ! কেন ? নিজের বাড়িতে মাগ নেই ?’

দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি ল তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে, যেটা হাত দিয়ে টের পাই ।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি ল মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি—
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় ছিদাম লেখা একপিঠে মাকলী ওপিঠে ।
জটলা ছিৎরে যায় ! চাকু-দেবতার নামে কতোগুণ আছে
সকলে জানে না । মানব কেন অমন কুচুটে ?
প্রেমিকের জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই ? এই যে ছ’সাতজন
মনের স্বামীত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটু ঝলকে
( দোটানা ২৯ আষাঢ় ১৩৯২ )

ওই ঝলক দেখেই, হয়তো শত দোষ সত্বেও, আমার মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা ।

বাংলা কবিতার আবহমান রীতি ভেঙেচুরে দিতে, ঐতিহ্য ও ধ্যানধারণাকে পালটে দিতে, হাংরিদের আবির্ভাব, এরকমই একটা কথা, কোথায় যেন শুনেছিলাম, এবং মলয় নিজে এই হাংরিদের পুরোধাপুরুষ বলে, হয়তো, তাঁর কবিতায় ওই ধাক্কা দেবার অনলস প্রবাস আমি লক্ষ্য করি, যাকে মলয় বলতে চেয়েছেন ‘পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান’ । এইটে করেছেন ‘অচেনা ভাষা ইউনিট’ গড়ে, অন্তত তিনি তাই প্রণিধান করতে চেয়েছেন কোনও এক লেখায়, এবং যথেষ্ট ‘মাজা ঘষার পর, ঠাণ্ডা মাথায় ।’

ফলে, আমার সংশয়, আচ্ছন্নতার রেশ কাটতে না কাততেই, আরও বাড়ে, বেড়ে যায়, কেন এটা করতে চাইছেন মলয় ? এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতার জন্য ? স্রেফ বিরোধিতা, আর কিছু নয় ? পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান রূপায়ণের জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য ? তার মানে এসটাবলিশমেন্টের ক্ষমতার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা ? ব্যাপারটা বড়ো গোলমেলে মনে হয় । যদি বিরোধিতাই হয়ে থাকে উদ্দেশ্য, বচনবয়নের রূপ পালটেদেওয়াটাই যদি এসটাবলিশমিন্ট বিরোধিতা হয়ে থাকে, এলিট শব্দকোষের বদলে তিনি যে ভাষা বয়ন করেছেন ননএলিট লেকসিকন ব্যবহার করে, তা যে ওই এসটাবলিশমেন্ট-পালিত ‘তোলা আদায়কারী মস্তানবাহিনী’-রই মুখের ভাষা ‘আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির’, সে যে কার ভাষা, তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, এবং তা ব্যবহার করে পরোক্ষে, তিনিই এসটাবলিশমেন্টের পাছার কাপড় ঠিক করে দিচ্ছেন, এই ভূমিকা লক্ষ্য করেই আমার এত সংশয়:-

যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে-কে আছে
পেটো ্কিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফূট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুচি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ুমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা

দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো ।
( মেসোমশায় পর্ব, ২৭ নৈশাখ ১৩৯২ )

‘ঘুণপোকার সিংহাসন’ বা এরকম আরও কিছু কবিতা এ সংশয় আরও প্রগাঢ় করে তোলে যখন দেখি, ‘নোকরশাহির রাজ্য এনেছো এ-দেশে’ বলে মলয় তৃপ্তি পাচ্ছেন, অথচ ওই নোকরশাহিকেই তিনি করে তুলেছেন মহিমামণ্ডিত :-

ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান পপাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছ এদেশে ।
( ঘুণপোকার সিংহাসন, ২ ভাদ্র ১৩৯২ )

আমি ভুলে যেতে পারি না মলয়ের কবিতায় শ্রেণিচেতনার গাঢ় উন্মেষ দেখে, একথা আরও উল্লেখ করতে চাইছি, আমাদের দেশের বামপন্হী আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনসহ, সব আন্দোলনই মূলত এসটাবলিশমেন্টকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ;  উপরি কাঠামোতে একটু গুঁজগাঁজ দিয়ে, আরও বেশি । এর ফলে নিজেকে সংহত করে ওই এসটাবলিশমেন্ট । আমি জানি ,মলয়ের এই বাগব্যবহারবিধি তাঁর ভাষাকে দিয়েছে প্রচণ্ড গতি ও তেজ, কবিতার ক্ষীণ ও প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ধমনীতে চালিত করতে পেরেছেন টাটকা রক্ত, এক বিদ্যুৎপ্রবাহ, যার সামনে আমার সন্ত্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না । সে অর্থে হলে, মলয় সত্যিই ধন্যবাদার্হ ।

‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কতোবার যে পড়লাম তার ইয়ত্তা নেই । মনে হয় মলয়, শুধু বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যাক, এটা বোধহয় চাইছেন না । আরও কিছু চাইছেন, খুব সচেতনভাবে । এখানেই আমার আপত্তি । একটা পুরোনো বাংলা সিনেমায়, সম্ভবত ‘চারমূর্তি’ হবে সিনেমাটা, ক্যাবলা কংকাল সেজে ভয় দেখাতে গেলে, টেনিদা-রূপী চিন্ময় রায় মূর্ছা যান । জ্ঞান ফিরে এলে, উঠে, গা ঝাড়তে ঝাড়তে বন্ধুদের চিন্ময় বলেন, একটু ভড়কি দিলাম আরকি ! মলয় কি ভড়কিই দিতে চাইছেন শুধু ? আমি আরও মুশকিলে পড়ে যাই, যখন মলয় নিজেই স্বীকার করছেন, “আমি সত্যিই শিল্পের বিরুদ্ধে ও সংস্কৃতির স্বপক্ষে বলতে চেয়েছিলুম ।”

তাহলে, শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল কী ? মলয়ের যুদ্ধঘোষণা, তাহলে শিল্পের বিরুদ্ধে, যাকে তিনি কখনও ঔপনিবেশিকতার উপহার হিসেবে চি্‌হ্ণিত করতে চাইছেন, কোথাও কোথাও, সেই শিল্পের বিরুদ্ধে ? তখনই, আবার অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লক্ষ্য করতে হয়, এ কোন যুদ্ধ ? ‘মেসোমশায় পর্ব’  কবিতার যদি সাক্ষ্য নিই, দেখি, আহ্বান তিনি জানাচ্ছেন বটে যুদ্ধের, যুধিষ্ঠির/আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির/বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে/ নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে কে আছে/পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন…’, সন্দেহ নেই, তিনি যতই অস্বীকার করুন, এখানে ‘বহুতলবাড়ি’ শব্দের শ্রেণি অভিঘাতে, নতুন প্রতীকি মাত্রা পেয়েছে; দ্বাপর যুগের ওই চেতনাপ্রবাহ কী করে যেন এসে, কলকাতা শহরে, নকশাল-মাস্তান মিলেমিশে, একাকার হয়ে শ্রেণিযুদ্ধ থেকে বাঁক নিয়ে, একাকী, নিঃসঙ্গ কবির মরণপণ সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে যায় । তবু যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, আর ওই বহুতল বাড়িরই তৈরি করে দেওয়া মিথকেই ক্রমে সন্মানিত করে তুলছেন, ‘দেখে নিস তোরা/মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো’, এই ঘোষণা দিয়ে ।

শেষ পর্যন্ত ওই জ্যোতির্বলয় গড়ে তোলার জন্য মলয়ের এত কসরত, এত চেষ্টা, এত হাঁকডাক ? তাহলে যুদ্ধের আহ্বান কেন ? না কি, মলয়ও চাইছেন, যেভাবেই হোক, বা, বৈরীভাবেই হোক, এসটাবলিশমেন্টে পাতে বসার সুযোগ পেতে ? যে-আবহমান বাংলা কবিতারীতি তিনি ভাঙতে চাইছেন ঠাণ্ডা মাথায়, সেই আবহমানতা তিনি, অজান্তে, বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাঁধে করে, এটা দেখে, আমারও কষ্ট হয়, মলয়ের জন্য । তিনি, অসহায়ভাবে, কখনও কখনও, মেনে নিচ্ছেন, অক্ষরবৃত্তের বিলাসিতা, ডুবে যাচ্ছেন বৃহত্তর মায়ায় । আবার, কবিতার ভাষা বদলাতে গিয়ে, শব্দ বদলে দিচ্ছেন, কিন্তু মেনে নিচ্ছেন ব্যাকরণের রক্তচক্ষু, আঁকড়ে ধরছেন কবিতাপ্রতিমার পুরোনো কাঠামো ।

এত স্ববিরোধিতা, তবু, অল্প জানি বলেই, মলয়কে আমার ভালো লাগে । আমার, বরাবরই মনে হয়, মলয়, তাঁর রাগি চেহারা নিয়েও, প্রবল-রোমান্টিকতা বিরোধী বলে, নিজেকে বরাবর চি্‌হ্ণিত করতে চাইলেও, আদ্যোপান্ত এক রোমান্টিক কবি, বড় রোমান্টিক । তিনি প্যানপ্যানানি বলে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন একে, তবু, আমি তা বলছি, আর আমার এই বক্তব্যকে সমর্থন করতে ্গিয়ে এসে সাক্ষ্য দেবে তাঁরই কয়েকটি কবিতার পংক্তি :-

সে শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ
দোলো লাশ নামাবার জন্য আছি আমি ।
( বিজ্ঞানসন্মত কীর্তি ১৯ শ্রাবণ ১৩৯২ )

আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচবো সকলে তুর্কি গাঁজাভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নমে যাক ।
( শিল্পোন্নয়ন ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )

আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে ।
( ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ ২২ শ্রাবণ ১৩৯২ )

কী রকম জ্বলে ওঠো দেখতে চেয়েছি
শাদা ত্বক এক লহমায় পুড়ে কালো
চোখ থেকে চাউনি উধাও জানুদেশ
থির থির কেঁপে ছিটকে ঘাসের ওপরে
পড়ে তুমি বারকয় নড়েচড়ে স্হির
শেষবার তারপর ঝুঁকে চুমু খাবো ।
( উৎপাদন পদ্ধতি ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )

দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি
বলবে, ‘আমাকে যেতে দিন’।
( বাজারিনী ২৮ আষাঢ় ১৩৯২ )

সাক্ষ্যপ্রমাণ থাক, দিতে গেলে আরও দেয়া যাবে বিস্তর, মলয় কী চাইছেন আর শেষ পর্যন্ত কী করতে গিয়ে কী করছেন, সেটা থাক । আমি শুরু করেছিলাম ‘মলয় রায়চৌধুরী কে?’ এই নিরীহ প্রশ্ন সামনে রেখে ; ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’  পড়ে, যত সংশয় মনে আসুক, আমি তবু আবিষ্কার করি, মলয়, এই বাংলা ভাষারই আবহমান ঐতিহ্যের পথ ধরে ক্রম অগ্রসরমান এক উজ্জবল কবি, যাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা ধনী হচ্ছে, যিনি ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ লিখে সকল স্ববিরোধিতার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হা থেকে নিজেকে উদ্ধার করেন শেষ পর্যন্ত :-

আজকে শুক্কুরবার । মাইনে পেয়েচি । বোধায় শরৎকালের পুন্নিমে ।
পাতলা মেঘের মধ্যে জ্যোসনা খেলছে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাৎ কুচকুচে কালো নেড়িকুকুরের দল
ঘেউঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
কেউ তো বিশ্বাস করবে না ! ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতোকাল ।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন !
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করেচি বুঝি ।
যা কইনি সেকথা বলেচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
কেন এই মাইনে পাওয়া ? কেন গান ! কেন তাড়ি ?

আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শুঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
( বজ্রমূর্খের তর্ক ২৭ আষাঢ় ১৩৯২ )

মলয় টের পান, প্রশ্ন করেন নিজেকেই, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নিজেই, ‘আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতে।’ ওইখানেই মলয়ের সার্থকতা, তা তিনি যতই শিল্পের বিরুদ্ধে চিচিচকার করুন । ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামে কোনও সংকলন যদি কেউ করেন, তাহলে ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ তাতে অবশ্যই সংকলিত হওয়া উচিত । না হলে বুঝব, ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামকরণ বিফলে গেল, অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ওই সংকলনটি ।
[ হাওয়া৪৯ এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে নেয়া ]



Thursday, September 13, 2018

উৎপলকুমার বসু : মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে দু-একটি কথা


         মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম ।

         তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও Polemics এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা ।

         তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে --- আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি ।

         গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । 

         বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন -- ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ?’

         বলাবাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছিলেন, ‘পলিটি’-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব -- মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।

[ হাওয়া৪৯ পত্রিকা, এপ্রিল ২০০১ ]

Tuesday, September 11, 2018

পৃথা রায়চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা



বিতর্ককে নস্যাৎ করে কজন হয়ে উঠেছেন নিজস্ব ঘরানার ব্র্যান্ড নেম? বিতর্ককে কবচকুন্ডল করেই আজও তিনি সোজা কথায় বলেন:

“একাই লড়েছিলুম।
কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’
একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে
সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত” 

তাই তো মলয় রায়চৌধুরী হাজার কোটি মেকিদের থেকে এতটা ওপরে। একাই লড়েছেন আর জিতে গেছেন, আমাদের অনেকেরই ক্ষমতা নেই এভাবে রুখে দাঁড়াবার। নিজের প্রতি, নিজের কবিতার প্রতি, সৎ থাকতে তিনিই পেরেছিলেন, পেরেছিলেন নির্দ্বিধায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।

“আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে–
ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে মূর্খ মুণ্ড
গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে”


লাইন কটা তুলে নিয়েছি ‘আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য’ কবিতা থেকে, শিহরিত হয়েছি বারবার এই কবিতা পড়ে, মনে মনে বলেছি, “যথার্থ! যথার্থ বলেছো মলয় রায়চৌধুরী, নিজের বংশগৌরবে গৌরবান্বিত তুমি। সেই আপোষহীন উচ্চশির লক্ষ্মীকান্তের বংশধর তুমি । সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের ৩৪তম উত্তরপুরুষ, প্রতি পদে রয়েছো আপোষহীন, নির্ভীক।” ১৬ই জুলাই, ২০১৭ এই কবিতা আমি পড়ি ফেসবুকেই মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টে। কবিতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতি শব্দে, ছত্রে আর আমাকে বলেছে, “চিনে নে!” এই কবিতায় কিন্তু আমরা কবির ভেতর দিয়েই মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের প্রাতিষ্ঠানিকতায় মাখানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠা, একা লড়াকু মানুষটা, যার হাতের কলম বরাবর তরোয়ালের মতোই ঝলসে উঠেছে, ফালাফালা করে দিয়েছে যা কিছু বস্তাপচা।

না, এখানে মানুষ মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে বসিনি, সেই স্পর্ধা আমার নেই, মনে মনে কেবল এই ভেবে গর্বিত হই, এই মহান কবি, সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর হন, আর এঁর লেখা পড়ে পড়ে শিউরে উঠি কেবল। নিজে যেহেতু কবিতা লিখি, তাই বিশেষ করে পড়ে ফেলি ওঁর কবিতা, বুঝি, কতটা আপাত সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে উনি নিংড়ে বার করে আনেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জটিল ভাবনা বা চলতে থাকা নানান সংঘাত। বসেছি জেঠুর কবিতা সম্পর্কে সামান্য দুকলম লিখতে,  কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেন মনে হচ্ছে কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সামনে আমরা সকলে এতোটাই ছোটো, যে তাঁর সব কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা তো করতে পারি, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বতের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে পর্বতশৃঙ্গের ভয়াল সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করার সমতুল্য।

কবি তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অশ্লীলতার দায়ে কারাবাস করেন, এ কথা সাহিত্য জগতের প্রতিটি মানুষ জানেন, এই কবিতা নিয়ে আজও প্রতিনিয়ত সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও। যা এককালে কবিকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন একপ্রকার কিংবদন্তী। বড়ো বেশি শরীরধর্মী, যৌনতার আঁশটে ভাষায় লেখা এই কবিতা পড়ে আপাতভাবে শ্লীল সমাজ চোখে-মনে কাপড় বেঁধে গান্ধারী হয়ে যান আজও, অথচ কবিতাটির ভেতর যে চরম যন্ত্রণার প্রকাশ, তা বুঝে নিতে পারলে, এই কবিতা হয়ে ওঠে অমৃত, আপাত অশ্লীল ভাষ্যের গরল মন্থন করে পাঠক পেয়ে যান অমৃত। যন্ত্রণা অপরিসীম, কবিতাটির নিচের কটি লাইনে…

“প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না”

আবার কতটা তীব্র ব্যথা অনুভব হলে কবি এমন অস্থির ভাবে লিখতে পারেন,

“আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”… 

পাঠক ঢুকে যান কবিতার ছত্রে ছত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কি মারাত্মক আঘাত করেছেন কবি প্রতিষ্ঠানকে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চাঁদ-তারা-নদী-তুমি আমি-ফল্গুধারা কাব্যভাষাকে। আর এই প্রচণ্ড বেগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা কর্কশ সপাট কবিতাকে হজম করে নিতে তখনও বহু মানুষ পারেননি, আজও অনেকে পারেননা, বলাই বাহুল্য।

ঝলসে দেওয়া কবিতার কণ্ঠ তাঁর হয়তো ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দের জন্য বেড়ে ওঠা ক্ষোভ বিদ্রোহ ভরা বুকের একেবারে ভেতরের অনুভূতির জন্য। আবার এই কবিই ‘আমার জন্মদিন নেই’ কবিতায় লিখে ফেলেন,

“ঠাকুমা কবে জেঠা আর বাবাকে প্রসব করেছিলেন 
তার তিথি ঠাকুমা জানেন
প্রসবদিন পালনের তো কোনো রেওয়াজ নেই
তাই মা আমাকে কোন তিথিতে প্রসব করেছিলেন জানি
মায়ের কষ্টের গল্প জানি
হাসপাতালে ভর্তির গল্প জানি
কিন্তু আমার জন্মদিন জানি না”…
সাধারণ পাঠক আমি, কবির অন্তরাত্মা ছুঁয়ে বলি, এতটাও নরম ভাব এই রুক্ষ জমিতে থাকে ! কেবল বারুদ আর লাভা নিয়ে যে কবির বিচরণ, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষের হৃদয় কে-ই বা সহজে বুঝেছে!
পাঠক যেন ক্রমাগত তড়িতাহত হতে থাকেন তাঁর বিজলীসম কবিতায় । কবির তাৎক্ষনিক মনের ভাব, চঞ্চলতা তিনি প্রকাশ করেন  ভিন্নধর্মী কবিতায়। আবার এই তিনিই ‘নখ কাটা ও প্রেম’ কবিতায় হঠাৎ লিখে ফেলেন, বলা ভালো প্রশ্ন করে বসেন,

“রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন–
সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?” 

ভাবা যায়? নেকুপুষু প্রেমের কবিতা লিখে তুলতুলে ভাব ভাগ্যিস তিনি তাঁর কবিতায় আনেননি। বরাবর প্রথাভাঙ্গার নিদর্শন হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটা কবিতা। কি অসামান্য প্রেম দেখিয়েছেন তিনি তাঁর ‘বুড়ি’ কবিতায়। গভীর প্রেম এই কবিতায়।

“এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।“ 


মন খারাপ করে, গলায় ব্যথা-ব্যথা কষ্ট হয়, অথচ কি চরম প্রেম ! গভীর অনুভূতি, পরম ভরসা ফুটে ওঠে, প্রতি ছত্রে। বিষাদেরও যে এমন মিঠে সোয়াদ, তা বোধহয় এই কবিতা পড়লে তবেই বোঝা যায়। এ যেমন একাধারে প্রেমের কবিতা, তারই সাথে এ চিরশাশ্বত মৃত্যুচেতনার কবিতা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই এত আঁকড়ে থাকা, এত ভালোবাসা, এত জীবন প্রাচুর্যের মাঝেও মৃত্যুচেতনা কতটা ঘিরে রাখে আমাদের অবচেতন।
মলয় রায়চৌধুরীর দাদা,  অর্থাৎ স্বর্গত সমীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরের দিন লেখা কবির যে কবিতা, ‘সেন্স অফ লস’ এর স্তবগান’, তা যেন পাঠককে কবির জায়গায় বসিয়ে দেয়,

“কাল বাইশে জুন, ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা সমীর রায়চৌধুরী”…………
“কাল, বাইশে জুন ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা মানে মিনু” 

 
কবিতার প্রথম লাইন কবিতার মাঝামাঝি আবার ফিরে এসেছে। প্রথম লাইনের পরে এসেছে প্রয়াত দাদার পোশাকি নাম, আর মাঝখানে এসেছে দাদার ডাকনাম। এইভাবে একই লাইনের ব্যবহারে, অথচ দুবার দুরকম নামের ব্যবহারে আমরা আসল ‘সেন্স অফ লস’ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কতটা জড়িয়ে রাখেন কবি তাঁর সদ্যপ্রয়াত দাদার স্মৃতি, কতটা হারাবার বোধ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে কবির কাছে।


হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা ‘জখম’ কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরী এইভাবে আরম্ভ করেছেন :
“চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত” 

হাংরি জেনারেশানের পুরোধা কবির নিজের বিশেষ প্রিয় কবিতা ‘জখম’ থেকে নেওয়া এই কটা লাইনে দ্রিম দ্রিম করে শুরুয়াতি সুর শোনা যায় এক অনন্ত ক্ষুব্ধ আহত অস্থির কণ্ঠের কবিতার। ‘জখম’ ভর্তি কবি হৃদয় থেকেই কাব্যধারায় বেরিয়ে আসে এই অনন্ত শোণিতাভ দীর্ঘ কবিতা, কবিতায় বারবার প্রয়োগ হয়েছে তাঁর নিরীক্ষার বিশেষ বানানরীতি…

“বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে  মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়
আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়
কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল” 

আবার কি অনায়াস উচ্চারণে কবি তাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ছত্রগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সময়ে সময়ে…
“armature on thye left turned slag long ago
now eyeflesh twitching in the smoke of malay’s burning
skeleton
dismantled tempests sweep by at 99mph
uniform queues of wristwatched zombies tattle”


রাজনৈতিক বা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক যতো অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা যেন ফুটে ওঠে এই ‘জখম’ ভর্তি কবিতায়। যা তখন সত্যি ছিল, তা আজও চরম প্রাসঙ্গিক। তাই এটুকু বলাই যায়, কবি মলয় রায়চৌধুরী সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে নিজের অন্তঃস্থল খুঁড়ে, সচেতনভাবে মানুষের কথা বলে যান তাঁর কবিতায়। তিনি কাব্যকথায় মানুষের অবচেতনের সমস্ত কথা এবং সচেতন যাপনের সার কথা সমস্তই বলে যান অকপট ভাবে।
এই কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর “কবিতা পায়”; ঠিক মানুষের বাকি সব পাওয়ার মতোই কবিতাও পায়। কবিতার সাথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত হলে একাত্মতা থাকলে এবং কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে কেউ এই কথা বলতে পারেন, তা সাধারণের পক্ষে বোঝা হয়তো দুষ্কর। গতানুগতিকতার মন্থর চালে চলে আসতে থাকা বাংলা কবিতার রক্ষণশীল বেড়াকে তিনি তাঁর কথ্যভাষার বম্বশেলে গুঁড়িয়ে দিতেই “গেল গেল” রব যেমন উঠেছিলো, সেই রবের কারণগুলোকে কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও পড়ে ফেলত গোঁড়া বাঙালি । ভাষা সাহিত্যের তথাকথিত এলিট ক্লাস সেসব না পড়ে ফেললে, নিজেদের টলোমলো আসন সামলে রাখার জিগিরে কীভাবে  গেল-গেল রবের হিড়িক তুলতেন?
ভয় পেয়েছিলেন কি এই আগুন কলমকে তাঁরা?

সম্প্রতি পড়লাম তাঁর কবিতা ‘রাষ্ট্রের বহি-খাতা’; পড়েই নিজেকে এবং অসংখ্য মানুষের অত্যন্ত সমস্যাসংকুল জীবনের এক মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড়াতে হল, আমরা কি হরেদরে সকলেই এই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চাকার চোখে নিজের দেশে অভিবাসী মাত্র? আমাদের নাগরিকত্ব, আমাদের স্বদেশের শেকড় কি কেবল সরকারের ঠাপ্পা মারা, সরকারী শিলমোহর আঁকা কয়েক টুকরো কাগজের মুখাপেক্ষি?

 দলিল থাকলেও ফেলে দিতুম, তবে দলিলের জেরক্স 
দেখেছিলুম, ষোড়শ শতকের কারোর ফার্সিতে লেখা নাম 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে ষোড়শ শতকের
সেই পূর্বপুরুষে ওর রক্তের শেকড় রয়েছে?  
বাড়ির ট্যাক্স বাবা দিতেন, তার আগে দাদু
দাদুর বাবা, তার আগে নবাবের খাজনা–
বিলডার ঘুষের ঠেলা মেরে মালিকানার
সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিল 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে
 ভারতের সত্যিকারের নাগরিক?”

রাখি কবির বোন। বোনের ন্যায্য চিন্তার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি প্রতিফলিত করেছেন এই দেশের নাগরিকদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা।

কবি শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে লিখে ফেলেছেন ‘রাস্তার কবিতা’। তার ছত্রে ছত্রে লেখা আছে, বলা ভালো বয়ান করা আছে আমাদের তুচ্ছতা। আপাতদৃষ্টিতে এখানে যা শুধু কবির দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির লঘু বর্ণনা, তা আসলে গভীরে ঢুকে নাড়া দেয় আমাদের, বুঝিয়ে দেয়, এইটুকুই আমাদের মূল্য। চোখ বাঁধা অন্ধ আমাদের ঝাঁকুনি দেয় তাঁর সোজা সরল কথ্য ভাষায় লেখা গভীর অর্থবহ সমস্ত কবিতা।

“কাগজ কুড়োনোর কাজ আরম্ভ করে প্রথম ছেঁড়া নোংরা কাগজের টুকরো
তুলেই কাগজটা ছেড়ে দিতে হলো
কাগজটা দিয়ে দিলুম কুড়ানিকে
যে আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ বাছাই করছিল
আসলে যে কাগজটা তুলেছিলুম সেটায় দেখলুম
আমারই একটা কবিতা, ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় বহুদিন আগে 
প্রকাশিত হয়েছিল
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে লিখতে বসলে সামান্য কটা পাতায় তা সীমিত রাখা বড়ই কষ্টকর, অথচ সুবিশাল কিছু লেখা এখানে সম্ভব না, কারণ তা যে দুতিন পাতার ভেতর লিখতে হবে, তা কবি আগেই বলেছেন। তবুও সামান্য হয়তো বড়ো হয়ে গেল লেখাটা। তাঁর কবিতার কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসবে ‘অবন্তিকা’র কথা। এক অনবদ্য প্রেমের কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’।

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”
ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ

সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট”… 

হেন প্রেমিক বা প্রেমিকা নেই, যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত শিরশির করে উঠবে না এই কবিতা পাঠ করে।
“কি-বোর্ডে পাকাচুল পড়ে, তুলো দিয়ে সরিয়ে দিই ; চশমার লেন্সে পাকাচুল পড়ে, মুছে সরিয়ে দিই। তবু লেখালিখি ছাড়তে ইচ্ছে করে না”… সম্প্রতি কবি এমনটাই বলেছেন।

এক সাধারণ গুণমুগ্ধ পাঠিকার আসন থেকে চীৎকার করেছি, আরও, আরও লিখুন কবি, এত লিখুন যে আমাদের মগজের রক্তক্ষরণ যেন বন্ধ না হয়। রক্তের সরোবর বানান আমাদেরই হৃদয়ের ক্ষরণে, সেই সরোবরকে আয়না করে আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই ঋজু দৃপ্ত কবিতার কাঁধে ভর করে। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয়;  উন্মাদের মতো চীৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্টযন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না।” শিখি তাঁর প্রতিটি উক্তি থেকেও। কবি মলয় রায়চৌধুরীর কাছে “কবিতার কোনও সংজ্ঞা নেই, নির্দেশিকা হয় না তাই যা ইচ্ছা, যেমন ভাবে ইচ্ছা লিখুন”… এই মানুষের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কি সহজ কথা? যিনি কবিতাকেই প্রেমিকা করে নিতে পারেন, তাঁর কবিতার কাছাকাছি গিয়ে তাকে স্পর্শ করাই নিজের মধ্যে এক সুবিশাল অর্জন।
“আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলোপড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুণি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার” 


তাঁর ‘আলো’ নামক কবিতার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করছি। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি পেরেছিলেন সামগ্রিকরূপে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ফুটিয়ে তুলতে। রাষ্ট্রের শাসনের নামে যে সন্ত্রাস, যার চাবুকের নীচে আলোহীন বাঁচতে-থাকা বোবা মানুষেরা প্রতিবাদী হলেই, তারা প্রথা ভাঙতে চেষ্টা করলেই, কি কি ঘটে যায়, তা ধরে রেখেছে এই কবিতার প্রতিটি শব্দ। অথচ লড়াকু প্রতিবাদী কবি কণ্ঠ লিখে ফেলে এই কবিতার শেষ লাইন দুটি মূল উপাদান হিসেবে…

“একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।”

কলকাতার সাহিত্যজগত থেকে দূরে বসে কবি ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবে সৃষ্টিতে মেতে লিখে চলেছেন ষাটের দশক থেকে জ্যা মুক্ত তীরের মতো ক্ষিপ্র ধারালো কবিতা। তাঁর লেখা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।
সত্যিই তিনি অসীম শক্তিশালী, আমার কাছে কবিতার ঈশ্বরসম বলেই, তাঁর কবিতার কাছে সহজ মনে না পৌঁছতে পারলে আজও শ্লীল-অশ্লীল, অথবা নানান দোহাই পাড়ে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় বলি,”আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না।” কারুর আনুকূল্য অথবা হাততালি, পুরস্কার ইত্যাদির পরোয়া না করে তিনি লিখে চলেছেন আজও তাঁর বাঁধনছাড়া বেপরোয়া নিজস্ব শৈলীতে।

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...