Wednesday, August 29, 2018

হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরীর কবিতা




নাগরিক উপকথা
প্রদীপ চৌধুরী

শহরের ব্যস্ত স্কোয়ারে এখন ভীড় করেছে
আমাদের প্রিয় লোকজন, কে একজন
দুই হাত উপরে তুলে মুঠো মুঠো আগুন
কার মুখের উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে
আর তার ১ ফুট দূরে কামানের গোলার মতো
চোখ বড় করে আরেকজন, সরাসরি
সিনেমা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে ।
এসো, আমরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াই !

একজন যুবক আমার কাছে হঠাৎ চেয়ে নেয়
দেশলাই ! সিগ্রেট না জ্বেলে
সে হঠাৎ ছুটে যায়, কিছু দূরে
বিশাল বাড়ির সামনে; পকেট থেকে
বোতল বের করে যুবক সারা গায়ে
ছড়িয়ে দেয় পেট্রোল
মাত্র একটি কাঠি প্রস্তুত শ্রেণীর মত,
দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে চোখ,
চারদিকে বাঁধভাঙা পাখির সঙ্গীত—
স্বাধীনতা, এসো তার পুড়ে যাওয়া দেখি !

মিথ্যা নিয়মের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাবা
কাউকে রেহাই দেয় না, তাই তো বালিকা
কেবল একবার হারিয়ে যাওয়া অপরাধে
আর ফিরে যেতে পারেনি মনিহারি-
মেলা থেকে আলের ধারের ঘরে,
মই লাগিয়ে একদিন আব্রুহীন রাস্তা থেকে তাকে
উঠিয়ে দেয়া হয় গম্বুজনগরে;
সেখান থেকে রোজ সন্ধ্যায় চুঁইয়ে পড়ে
বীর্য ও আতরের গন্ধ— এসো,
নতমুখে কাঁপতে কাঁপতে আমরা
অপেক্ষা করি, কাঁদি ।

এই ধারাবাহিকতা একদিন খোলসের মতো
সকলের শরীর থেকে খসে পড়বে
যেদিন লালাভেজা জড়িয়ে থাকা
শরীর থেকে তুমি ছাড়িয়ে নেবে নিজেকে
আর আমাদের সম্মিলিত উত্তাপ
ছিঁড়ে কুটি কুটি টাইফুন মেঘের মতো
নিজেকে আছড়ে দেবে ১ জন কবির কাছে
তুমিই কবিতা, তুমি কাছে এসো !

পূর্ব গোলার্ধের সবাইর সঙ্গে আমরাও
দেখব একদিন অস্তগামী সূর্য
গলিত সোনার মতো শরীর বিছিয়ে দিয়েছে
শহরের আর গ্রামের
গ্রামের আর শহরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে
আর তখুনি পিঠভর্তি চুল এলিয়ে
গম্বুজ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে
আমাদের বোন;
তার মুখে গর্বিত ও অর্থপূর্ণ হাসি ।



টুকরো লেখা-৩
প্রদীপ চৌধুরী

আর অন্ধকার নেই; ধূসর আকাশ জামা-পাজামার মতো
আমার স্বাভাবিক ব্যবহারের মধ্যে চলে এসেছে ।
দিন রাত্রি আমার কাছে সমান দরকারী, আমি
যখন কাজের পর ঘুমিয়ে পড়ি—সে কি ঘুম !—
আর আবরণহীন শরীরে আবরণহীন স্বপ্নে
জড়িয়ে যাই
এই ভূখণ্ডের নরনারীর প্রতিরোধহীন চিৎকার ও
ছুটোছুটি আমাকে স্পর্শ করে না
অথচ অলিখিত দূরত্বে তখনো কেউ
ভীড়ে একা হেঁটে যাচ্ছে
...একটি যুবতী কিছুতেই বাথরুম থেকে বেরোতে পারছে না
...একজন আততায়ী তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে
অবাক হতে পারছে না
...দাবী আদায়ের বহু পরেও একজন কর্মচারী
মিছিল থেকে বেরুতে পারছে না
...আমার বান্ধবীটি কিছুতেই বলতে পারছে না
ক্ষুধা আগুনের মতো সর্বত্রগামী—
জামা-পাজামার ও আকাশের মতো সহজ ও অফুরন্ত ।



দূর প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে জয়িতা
প্রদীপ চৌধুরী

১.
(রীতিমতো) দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত গ্রহে
দাঁড়িয়ে আছি আমরা । পরস্পরের শরীর
দেখা যায় না এখান থেকে । শব্দহীন
ঠোঁটে আটকে থাকে মরুবাতাস ।
বুক-ঠেলে-বেরিয়ে-আসা মানুষের ভাষা
মানুষের বুকে ফেরে না । অভ্যস্ত প্রজনন
প্রক্রিয়ার ছায়া কাঁধের মাংসে হাত রাখে ।
জীবনের দ্বিতীয় ভাগে রহস্যময় স্বপ্ন ।
সাময়িক বিভ্রান্তি । নারীর শরীরে
কল্পনাএ একপাটি দাঁত— একি !...

প্রতিটি মানুষী-সম্পর্কে এই স্বাভাবিক চক্রান্ত ।
শরীরে মিউকাস বাড়ে ।
ইথার ফসফরাস-আলোকিত হয়ে ওঠে ।

আবিষ্ট চলাচল রেস্তোরাঁ থেকে থেকে রাস্তায়,
রাস্তা থেকে রান্নাঘরে, ফটকের কাছেই
কসাইখানায় ।
শিহরণ দম বন্ধ করে আমার, এবং ভয়,
আরো কাছাকাছি হতে সাহায্য করে ।

২.
দূর প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে জয়িতা; সেখানে আমার
ফেলে আসা জ্যাকেট এবং জিঘাংসা তীব্র আছাড়ে
জাগিয়ে দেবে তাকে । ডিসেম্বরের মাঝরাতে
বিছানায় যাবার আগে সে আর আততায়ীর ভয়ে চমকে উঠবে না,
অথবা গেরিলা-কবির ক্ষতস্থানে হাত রেখে
আচমকা আলাদা হয়ে যাবে না । আমি নিশ্চিত
স্তূপীকৃত বরফ গলাবার জরুরী তাগিদে
জয়িতা আমাকে সম্পূর্ণ নেংটো হতে প্ররোচিত করবে ।


রূপান্তর
প্রদীপ চৌধুরী

কাল রহস্যময় দূরত্বে আমার সামনে বসেছিল নারী
তার ধবধবে শরীর থেকে ঝরে পড়ছিল শিশিরের জল
আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই রূপান্তর শুরু হয়
অতিরিক্ত রক্তচাপে তার শরীর রামধনুর মতো বেঁকে যায়
একটু পরে সে সোজা হয়ে বসে
সে স্পৃষ্ঠ সবিতার মতো লাল হতে থাকে
তার বুকের রূপালী গন্ধক বিকিরিত হতে থাকে
সারা ঘরে সৌর বিকিরণ
সে আমার চোখ থেকে চোখ সরায় না ফলে
যাবতীয় সৌর রশ্মিগুলি আমার শরীরে ঢোকে
গ্রহের মতো বিশাল বুক ওঠা নামা করতে থাকে
সেখানে মাংস আছে কিন্তু তা পচে না
আকার আছে সীমারেখা নেই
ফার্নেস থেকে ছিটকে পড়া এক স্ফুলিঙ্গ
তার ঠোঁটে লেগে আছে মৃত্যুভেদী হাসি
আমি বুঝতে পারছি তার ভালোবাসার উত্তাপ
স্ফুটনাঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে
সাদা ছাইয়ের মতো আমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছি
আমি কাল নারীর ভালোবাসা জেনেছিলাম ।


গ্রহণ
প্রদীপ চৌধুরী

দলে দলে ছাদের ওপর উঠে আসছে মেয়েরা
অভিশপ্ত ২৪ ঘণ্টার আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড
শেষরাতের সংশয় ভরা আলো-অন্ধকারে
কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না শরীর
মনে হচ্ছে স্বপ্নে দেখা জীবনের যৌনপরমানু
মেঘের মতো ঘন হচ্ছে পারস্পরিক চুম্বনের টানে
শহরের বাড়িঘরগুলি একসঙ্গে
চলে যাচ্ছে হিমালয় পাহাড়ের কাছে আরো দূর
আকাশের হাতছানি মেয়েরা জেনেছে
ওদের শরীরের রেখা থেকে উপচে পড়া লালা
ও হলুদ কুসুম ভালোবাসার শেষ স্ফুলিঙ্গ স্পর্শে
একটি ওমলেটের মতো সুস্বাদু হয়ে উঠছে

রোমশ বিছানা ছড়ে দলে দলে মেয়েরা উঠে আসছে
অভিশপ্ত তিন ঘণ্টার আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকী
অন্ধকারে কক্ষচ্যুত তারাগুলি ঢুকে পড়েছে
ওদের শরীরে শিরার ভেতর আরেকটি
অতিবেগুনী পৃথিবী স্পষ্ট হচ্ছে
পিতা ও সন্তানের মধ্যে আর কোন ব্যবধান নেই
গর্ভাধারের কাছে সৃষ্টির কোন ঋণ নেই
অপেক্ষমাণ এসবের আনন্দসঙ্গীতে
আতরের মতো চেতনায় ঢুকে পড়ছে মেয়েরা
সমষ্টিগত শরীর মেগনোলিয়ার মতো স্ফীত হচ্ছে—

সন্ধিতে সুগন্ধ নিয়ে মেয়েরা ছাদের উপর উঠে আসছে
গ্রহণ শেষ হতে আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বাকি
কিছু পরে রোমশ বিছানাগুলি শতাব্দীর গিরিখাত হবে
পুরুষের সীসা নির্মিত কোমরগুলি স্তব্ধ বালিয়াড়ি
কিছু পরে বাসি কাপড়গুলিকে মেয়েরা এক এক করে
ছুঁড়ে দেবে গলির খরস্রোতা নদীতে
আকাশের আলো সরাসরি স্পর্শ করবে ওদের লুকানো ক্যাকটাস
মেয়েরা ডানা মেলে কবিদের আত্মায় ভেসে বেড়াবে


আততায়ী ও ডালিয়া
প্রদীপ চৌধুরী

লেখার টেবিলের বিপরীত দিকে আততায়ী
আমার মুখের দিকে মুখ তুলে বসে আছে ।
আমি তার নির্বাচিত লোক ।
ঘরের কোণে লুকানো অন্ধকার; সে আমাকে
কিছুই বলে না । অভিপ্রেত গলায় সে
আমার অসুবিধা, বিরক্তিকর ধারাবিবরণী
জানতে চায় ।
সামান্য অস্বস্তিতে কেবল একবার শরীর নড়ে—
তা কি অসুবিধা ?
না । আমরা যে যার সিগারেট
হাত থেকে ঠোঁটে তুলে নিই । ১ সেকেন্ড
চোখে চোখ থামে ।
আমার কাছাকাছি বিনিময়ের অপেক্ষায় সতীর্থ ।

‘বিদায়, ছোট্ট ডালিয়া ।’ আমি ধারাবাহিকতা
খুঁজে পেতে চাই । জঙ্ঘার সামান্য দূরে
ঝাঁক ঝাঁক পাখি—
কোন ধারাবাহিকতা নেই । জয়িতা,
আমার আঘাতে পুনর্মিলনের প্রতিশ্রুতি নেই ।
মাথায় যন্ত্রণা হয়, দুজনেই বাইরে আসি ।
মাথার উপরে আকাশ তেমনি রহস্যময় ।
তেমনি বিছানা ছেড়ে যেতে হয় একা বাথরুমে ।
বুকে ঘৃণা ভালবাসার চেয়ে কিছু বেশি ক্রিয়াশীল ।
দারিদ্র্য জায়গা বদল না করলে একদিন
চুম্বনের আনন্দ ও অপরাধ
কলগেট ফেনার সঙ্গে চৌমাথার টেপে... তাই হয় ।
এরপর দুর্গন্ধযুক্ত মুখ আর বিজ্ঞাপিত
দাঁতগুলি নিয়ে আমরা অপেক্ষা করব
কখন ঝলসানো মাংসের চাঁদ, অন্য
গ্রহ থেকে ছিটকে আসা এক টুকরো
প্রোটিন-সমৃদ্ধ ঊরু একেবারে থাবার
সামনে ধুপ করে পড়ে থাকবে ।

আমরা মৃতদেহে অভ্যস্ত তাই চোলাইমদের
মতো জীবনকে উত্তেজক পুঁজে, দেশীমালে
পরিণত করি । আর ভালবাসা জাগার আগে
যারা রাইফেল ও যৌনাঙ্গ হাতে তুলে নেয়,
একদিন মাঝরাতে
আততায়ীর অসম্পূর্ণতা নিয়ে তারাই দরজায়
করাঘাত করে । বলে, শুভরাত্রি, আমরা এসে গেছি !
ঐ তো উপবিষ্ট আততায়ী— নুয়ে পড়া
চেনা পথচারী ।

‘বিদায় ছোট্ট ডালিয়া’— যথাযথ বিনিময়ের
অভাবে আমার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলির জন্যে
সামনেই অপেক্ষা করছে আততায়ী । আমার
উন্মোচন না হওয়া অব্দি একই ভঙ্গীতে
মুখোমুখি বসে থাকবে সারারাত । পরবর্তী
ভোরে আমাকে একই অবস্থায় ফেলে রেখে
রাসায়নিক পোষাকে বেরিয়ে যাবে । জয়িতা,
বলাৎকার দীর্ঘজীবী হোক !

আকম্পিত রাত্রিতে আমি সারাক্ষণ দেশলাই
আলোতে যার চোখে চোখ রেখে ১ সেকেণ্ড
থেমে গিয়েছিলাম, এরপর প্রতি রাতেই সে
আমার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়; আমাকে দেখে ।
একদিন একটি বালকও দিগন্তরেখার আলো দেখেছিল
সেই বালক একদিন আলের পথ ধরে
ধানখেতের রহস্য ছাড়িয়ে আরো দূরে
মৃতদেহ ও আগুনের
খোঁজে বেরিয়ে পড়ে । আর মাঝরাতে আমার
ঘরে ফিরে আসে আততায়ী । একা ।


স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্য-১
প্রদীপ চৌধুরী

তোমার শরীরে যে অতুলনীয় গর্ত
আমি দেখেছি ( এক জায়গায় অন্তত )
এবং আমার সন্ত্রাসবাদী বিবেক
( তুমি তা কি সম্পূর্ণ দেখেছো ? ) — এরপর
মানুষ হিসেবে আমরা আর কোন্‌ নতুন সর্বনাশে ভয় পাবো ?
ঐ গর্ত আছে জেনেও
সারাজীবন তোমার দিকে তাকাবো
স্বাভাবিকভাবে; তুমিও
জলের ওপর ঘুরপাক খেয়ে
ফিরে আসবে আমার অবয়বহীন
ক্ষুধার্ত শরীরের কাছে;
মানুষের কোষের অধঃপতনের স্বাদ
আমরা জেনেছি—
সমগ্র শরীরে এই অধঃপতন
বারবার না ঘটিয়ে আমাদের উপায় নেই
অবশিষ্ট প্রজন্মও এই মরণশীলতার মধ্যে চলে যাবে ।


স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্য-২
প্রদীপ চৌধুরী

এই অভিপ্রেত নির্বাসন কেন মেনে নেয়া হয়েছে কে জানে ?
শীততাপ অনিয়ন্ত্রিত কারাগার—
কেন দাবার চাল ফেলে রেখে পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি
জীবন্ত পাথরের মত অনিবার্য !
মনে পড়ে— ১নং ভ্রূণ হত্যার পর ভয়ে কয়েক রাত ঘুমুতে পারিনি
২য় বারও সেই ভয় কাটানো যায়নি
৩য় বারের আগেই আমরা জেনে নিয়েছিলাম “উঠিয়ে-নেয়া-পদ্ধতি”

সারা জীবনই কি এইভাবে চূড়ান্ত
সময়ে উঠিয়ে নিতে হবে ?
হয়ত তা-ই; এবং যথা সময়ে আমাদের
ছেলেকেও এই পদ্ধতি শিখিয়ে দিতে হবে ।



স্ত্রীলোক
প্রদীপ চৌধুরী

নিওন ভর্তি ঘরে লুটোপুটি খাচ্ছে রাত্রি । লেখার
টেবিলে স্তূপীকৃত সরঞ্জাম । সামনে
পেছনে শেল্‌ফ গাদাগাদি বই, রেকর্ডার
ও ঢেকে রাখা জল ।
আমার মাথা স্থির ও পরনে পরিষ্কার লিনেন ।

আমি নিজেকে যুক্ত করতে পারছি না ।
দরকারী ও অদরকারী সন কাজের কথা—
সেই রাত্রিতে আমার ‘জাগরণ’ তাৎপর্য
হারিয়ে ফেলে । দেয়ালের একটু উপরে,
যেখানে আমার ছায়া, বিস্তৃত হয়ে পড়েছের
খোলাখুলি পাহাড়
আর দিগন্তরেখার কাছে আমি দাঁড়িয়ে আছি, একা ।

মাঝরাতে প্রিয় স্ত্রীলোক আমার ঘরে ঢুকে পড়ে ।
তার চোখ অপলক । দেখি তার ফর্সা শরীরে
অন্ধকার ভর করেছে— বছরের জমাট বিস্মৃতি
তাকে দেয়ালের ওপাশে নিয়ে যায় ।

সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে । আমি
তার নিশি-পাওয়া গলা শুনতে পাচ্ছি না
হায়েনার মতো কানের দুল জ্বলজ্বল করছে । কার ?
৫ গজ দূরত্ব পেরিয়ে সে আমার কাছে আসতে পারছে না ।
আমার সহানুভূতি । বিশ্বাসঘাতকতা তাকে
প্ররোচিত করছে । মাসিক জলোচ্ছ্বাসের মতো
রাত্রির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তার শরীরের অন্ধকার ।
একদিন মাঝরাতে আমার প্রিয় স্ত্রীলোক
আমাকে ছেড়ে এলডোরাডো দেশে পাড়ি দেয়

আরো বহুরাত আমি ঐ দেয়াল সরাতে পারবো না ।
আর আমার মনে পড়বে ঐ অন্ধকার শরীরে
একে একে ফুটে ওঠা নক্ষত্রগুলিকে—
তারা কিভাবে ফুটে উঠেছিল
আর কিভাবে ঝরে পড়েছিল অভিকর্ষের টানে ।


অধিগ্রহণ
প্রদীপ চৌধুরী

সুরভিত ঊরুতে হাত রেখে দেখি তেমনই
প্রদাহ আছে, কিন্তু সেই পাখিগুলি
ভুল ব্যবহারের ফলে উড়ে গেছে, চোখে পড়ে,
কালো কালো ক্ষত; তাদের ঝলসানো
পালকগুলি সারামুখে লেগে আছে ।
অভ্যস্ত আঙুল জানে এ কার অধিগ্রহণ ।

আমার অপভ্রমণের শেষ পাতা কটি
নিজেরাই উড়ে গেছে; আবছায়া রাস্তায়
অভিযাত্রী, সতীর্থ ও রোমশ উষ্ণতা—
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত; নির্দিষ্ট নিয়মে
চণ্ডাল গঙ্গার কাছে এসে যায়, বলে ‘যাবে নাকি !’

গলুইয়ের ভেতর বসে আমরা যে যার
ঊরুতে হাত রাখি, আমাদের কামনার
আগুনে পোড়ে পাখির শরীর—
গোল ইস্পাতের মতো চকচকে থালায়
ঝলসানো টুকরোগুলি জড়ো করি—,

একটি রহস্যময় জেটি শুয়ে সব কিছু দেখে ।

যুদ্ধ
প্রদীপ চৌধুরী

একটি মৃত গ্রহ থেকে যুদ্ধের সংকেত
ভেসে আসছে এখানে
এখানে এক ডিভিসন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল
নৈঃশব্দ্য বেতার থেকে শোনা যায় নারীর ফিস্‌ফিস্‌

ওদের কোমর থেকে খসে পড়েছে লাইফ্-বেল্ট
এক শতাব্দীর ভুল যুদ্ধের শেষে ওদের
রাইফেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে
বুনো পাখির ঝাঁক

ওদের দণ্ডাজ্ঞাই ওদের স্বাধীনতা
ওদের গ্রেনেডগুলি বিস্ফোরিত হয়েছে—
এখন ইউকেলিপটাসের গন্ধে পুনরায়
জেগে ওঠে মহামারীগ্রস্ত এলাকা

Tuesday, August 28, 2018

সুবিমল বসাকের "প্রত্নবীজ" আলোচনা : করেছেন অলোক রায় : বলেছেন 'পাথব্রেকিং' ন্যারেটিভ

প্রত্নবীজের সন্ধানে
অধ্যাপক অলোক রায় লিখিত

প্রত্যেক বছর পুজোসংখ্যায় কতগুলি উপন্যাস ছাপা হয় তার হিসেব জানা নেই। দশ-বারোটি বাজারি পত্রিকায় সম্ভবত শ'খানেক উপন্যাস বের হয়। এ ছাড়া তথাকথিত ছোট পত্রিকাতেও আজকাল উপন্যাস থাকে বা উপন্যাসোপম গল্প। এত যে লেখা হয়, তার মধ্যে মনে দাগ কাটে এমন উপন্যাস সংখ্যায় নগণ্য। অ্যাকাডেমিক বিচার এখন শিকেয় তোলা থাক, সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কথাই বলছি। উপন্যাসের শিল্পরূপ নিত্য পরিবর্তমান। নিটোল পরিপুষ্ট ইচ্ছাপূরণের কাহিনী আজও লেখা হয়। ভোগ্য পণ্যের মত বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এ ধরণের গল্প হয়তো জনপ্রিয়ও বটে। তা না হলে বাজারি পত্রিকা এমন উপন্যাস ছাপে কেন ? কিন্তু বাজার দখল করার প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় ছাড়াও উপন্যাস লেখা হয় ।তাকে যথার্থ উপন্যাস বলা যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় থাকতে পারে। তবু এর দরকার আছে । এমন কিছু কথা বলতে হয়, যা এতদিন কবিতাতেই বলা হয়েছে। কিংবা প্রবন্ধে। এমন উপন্যাসের আধারে পরিবেশ করা হলে আপত্তির কিছু নেঈ। উপন্যাস মিশ্রশিল্প। উপন্যাস খুবই নমনীয় সহজবশ্য শিল্পরূপ। তবে উপন্যাসের অনেক পরিবর্তন সত্বেও তার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা যোগ অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা যদি কিছু থাকে তা হলো বাস্তবের স্বরূপ-সত্য নিয়ে।

সুবিমল বসাকের প্রথম উপন্যাস বা গদ্যন্যাস ছাতামাথা (১৯৬৫) আমি পড়িনি । দ্বিতীয় উপন্যাস প্রত্নবীজ (১৯৯৬) কয়েক বছর আগে ছাপা হলেও সদ্য আমি পড়বার সুযোগ পেয়েছি। উপন্যাস, কিন্তু আদৌ অবসর-বিনোদনের সামগ্রী নয় । পড়ে চমকে উঠতে হয় । কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। একটা প্রবল আলোড়ন তোলা সম্ভব। অথচ সেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এটাই বিস্ময়কর। অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রত্যেক বছর বাংলায় যে একশো-দেড়শো উপন্যাস বেরোচ্ছে, তার নিশ্চয় বিশেষ একজাতের ভোক্তা আছে। তাঁরা প্রত্নবীজ পড়তে উৎসাহ বোধ নাও করতে পারেন। 

ঠিক কার্যকারণ জানি না। তবে একটা আশঙ্কার কথা জানিয়ে রাখি। ছয়ের দশকের গোড়ায় হাংরি জেনারেশন নামে যে বুলেটিন বেরিয়েছিল, এবং তারপর এই নামে ক্ষুধার্ত প্রজন্ম নামে যে-সাহিত্যান্দোন প্রসার লাভ করেছিল, তার স্রষ্টা ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। এই পত্রিকার যে-সংখ্যায় (অষ্টম সংখ্যায়) সুবিমল বসাকের লেখা ছাপাহয়, সেই সংখ্যাটি অশ্লীলতার দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয় (অবশ্য তাঁর লেখার জন্যই এমনটা ঘটেছিল তা নয়)। মলয় রায়চৌধুরীর জেব্রা (১, ২) পত্রিকায় (১৯৬৫, ১৯৬৭) সুবিমল বসাকের গেরিলা আক্রোশ আর জাবড়া ছাপা হয়। সুবিমল বসাক ''নিয়ন্ত্রিত" আর একটি পত্রিকার কথা জানা যাচ্ছে-- প্রতিদ্বন্দ্বী, তাতে ছাপা হয় সুবিমল বসাকের বেশ কয়েকটি গদ্যরচনা-- যেমন, প্রতিবিম্ব, আগ্রাসী অপকর্ম, মেরামতহীন ফাটল। প্রত্নবীজ বইটির শেষে মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন সেই পুরনো যোগসূত্রের কথা মনে করিয়ে দিল। 'ব্রিটিশ রাজত্বের কুষ্ঠে বাঙালির পচনশীলতা ও অবক্ষয়' বা বাঙালির মধ্যে লভ্য 'ব্রিটিশ রাজত্যের ফেলে যাওয়া মূল্যবোধ' ইত্যাদি প্রসঙ্গ উপন্যাসব্যাখ্যায় কতটা সাহায্য করে, সে বিষয়ে সংশয় আছে।মলয় রায়চৌধুরী দাবি করেছেন প্রত্নবীজ হলো 'সাবঅলটার্ন উপন্যাস'। হয়তো তাই। নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসের ধারণা পেয়েছি গ্রামশির রচনায়। ভারতবর্ষেও অধুনা সাবঅলটার্ন ইতিহাস লেখা হচ্ছে, লিখছেন রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র ও অনেকে। কিন্তু সাবঅলটার্ন উপন্যাস? ফরাসি ঐতিহাসিক ইমানুয়েল ল্য রোয়া লাদুরীর 'মঁতাইউ'কে নিয়ে লেখা বইটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের আকর-গ্রন্থ বলা যেতে পারে। একালে আমরা যাকে 'আনাল' (Annales) বলছি, তার মধ্যে ইতিহাসের বড় সময় থেকে ছোট সময়ে নেমে আসার প্রয়াস মেলে। এইখানে ঐতিহাসিকের সঙ্গে সাংবাদিকের মিল ও অমিল।অশীন দাশগুপ্তের ভাষায় "ঐতিহাসিক অতীতকালের সাংবাদিক এবং সাংবাদিক বর্তমানের ঐতিহাসিক"। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক । তাঁর লেখার বিষয় অচিরকালের মধ্যে ইতিহাসে পরিণত হবে, হয়তো ইতিমধ্যেই হয়েছে। এদিক থেকে তাঁর রচনা 'আনাল-ধর্মী' হতে পারে, কিন্তু হাংরি জেনারেশন বা সাবঅলটার্ন সাহিত্যের প্রসঙ্গ প্রত্নবীজের আলোচনায় না আনাই ভালো। মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন ( "সুবিমল বসাক অমন অঢেল যুক্তিহীনতাকে পাঠকের সোপর্দ করেছেন"), এবং প্রচ্ছদের লেখক পরিচয় এদিক থেকে কিছুটা বিভ্রান্তিকর ("সাবঅলটার্ন এই উপন্যাস বস্তুত শ্রেণী-সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত")।
কাহিনীর সূচনায় লেখক স্হান-কাল-পাত্রের নির্দেশ দিয়েছেন -- "বাংলার বাইরে গড়ে ওঠে বাঙালিদের নিজস্ব ঘরানার এলাকা। এই সব বাঙালিরা মিশে গেছেন বিভিন্ন রাজ্যের ভূমিপুত্রের সাথা। ভাষা, সংস্কৃতি সব গ্রাস করে মিলিয়ে গেছেন তাদের মাঝে। সে জীবন, যে বাংলাভাষা, সে সংস্কৃতি বাঙালির, তবু তা অন্যরকম।... তাদের যে কী ইতিহাস তা কেউ জানে না। এই রচনাটি সেই সব মিথের গল্প।" কাহিনী তাই ইতিহাসও বটে। অবশ্য এখানে ভুল বোঝার একটু সম্ভাবনা আছে। বিহারের রাজধানির কোনো এক মহল্লায় বসবাসকারী বাঙালিকে নিয়ে উপন্যাস লেখা সুবিমল বসাকের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রবাসী বাঙালি মধুবাবুর আট-ন' বছরের ছেলে, বাঙালি মাইজি 'খোকা কে মাই', আর খোকার ঠাইনি কেন্দ্রে আছে বটে, তাদের চোখ দিয়েই হয়তো লেখক দেখেছেন প্রতিবেশী ভগযোগিনী আর তার স্বামী হালওয়াইয়ের দোকানদার রামখেলাওনকে। সেই সঙ্গে এসেছে দুলহানিয়া বাতাসিয়া, কচরি-ফুলৌরি দোকানের তেতরি, মোদির দোকানের নগীনা, কাজের মেয়ে সুগিয়ার মা, বিপৎ গোপ, ফেকন চামার, খোটন আর বুলকন, বুধনি ডাইনি। "চারোওর মহল্লার গোয়ালা, কাহার, কুর্মি, কুমহার, ধানুক, দোসাদ জাতের ভিড়।" এর মধ্যে মুনেশ্বরবাবু, নাগেশ্বর পরসাদ, বিন্ধেশ্বরী সিং, রামাধারীর মতো অর্থবান মানুষ দুচারজন আছেন, কিন্তু প্রত্নবীজ যেমন প্রবাসী বাঙালীর কাহিনী নয়, তেমনি লালা-কায়েতদেরও কাহিনী নয়।
মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, "পাটনা শহরের কয়েকটি পাড়াকে এই সাবঅলটার্ন শ্রেণী দিয়েছেন তাঁদের বহুল প্রচারিত খ্যাতি। ঐ পাড়াগুলির মধ্যে থেকে সুবিমল বসাক বেছে নিয়েছেন লোদিপুর নামের কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত পাড়াটি।" এই পাড়ায় ভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীন কাহার কোয়রি ডোম চামার দুসাধ মুসাহার হাজাম ধোবি বড়হি ক্রমশ একাকার । কিন্তু যেসব মানুষগুলির দেখা মিলল উপন্যাসে, তারা কেউ কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত বলে মনে হয় না। বিপৎ গোপ ও তার চ্যালাচামুণ্ডাদের চোর-ডাকাতেরা ভয় পেতে পারে, কিন্তু দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বেড়ানো তাদের পেশা নয়। অন্যদিকে এরা প্রায় কেউই নির্বিত্ত সহায়সম্বলহীন নয় । এদের নিজেদের একটা সমাজ আছে ( মুসহর শুধু অস্পৃশ্য নয়, তার জলের ছিটে লাগলে এদের 'জাত' যাবে)।সেখানে বহুল প্রচারিত প্রথানুগত্যের সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতির কেউ বিরোধিতা করে বলে মনে হয় না। কাজেই ঠিক বোঝা গেল না কীভাবে "একটি পাড়ার সকলেই আধুনিকতার একাধিক রোগে ভুগছে এবং তার মধ্যেই গড়ে উঠছে বহুমুখী ঐক্যের প্রবণতাগুলি, যেগুলি আধুনিকতাকে ছাপিয়ে বা ডিঙিয়ে একটি নবতর নৈতিকতা ও বৈধতার জন্যে উন্মুখ।"
কেউ-কেউ আজ এমনকথা বলছেন, উপন্যাস মাত্রই ঐতিহাসিক, উপন্যাস মাত্রই আঞ্চলিক।সুবিমল বসাক সচেতনভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেবেন বলে উপন্যাস লেখেননি ( তবে 'ইতিহাসের' কথা তাঁর মনে ছিল ) । পরিবর্তমান সমাজে বিশেষ একটি অংশের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ইতিহাসের সামগ্রী -- বর্তমানের কাহিনী হলেও তা ইতিহাস। বিশেষত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতাকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। ঢোঁড়াইচরিতমানস-এ সতীনাথকে টীকা-টিপ্পনীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলি উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষাব্যবহার চমকপ্রদ লেগেছিল একসময়। কিন্তু সশেষ পর্যন্ত চরিত্রকে ফোটাবার প্রয়োজনেই বিশেষ ভাষা ব্যবহার । তা না হলে অপরিচিত মহল্লা, ততোধিক অপরিচিত মানুষজন, আর তাদের ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগ -- অপরিচয়জনিত বিস্ময়রস সৃষ্টিতে সক্ষম, কিন্তু উপন্যাস হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করতে অক্ষম। প্রত্নবীজ নানা কারণে অসামান্যতা দাবি করে, কিন্তু ভুল জায়গায় জোর দিলে উপন্যাসের ভ্রান্তপাঠের সম্ভাবনা বাড়ে।
অবশ্য সাহিত্যের পাঠ-পাঠান্তর থাকতেই পারে। কাকে বলে যথার্থপাঠ আর কাকে বলে ভ্রান্তপাঠ -- নিঃসংশয়ে কখনই বলা সম্ভব নয়। আমি আমার নিজের মত করে প্রত্নবীজ পড়েছি। আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আর একজন পাঠকের অমিল হতেই পারে। তবে সুবিমল বসাকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণশক্তি ও ভাষা ব্যবহারে নৈপুণ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাহিনীর প্রেক্ষিতের সঙ্গে ভূচরিত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে---
ওদিকে নালা রোড, করবিঘাইয়া, এদিকে মন্দিরি রাজাপুর, মানপুরা, চিৎকোহরা-- এলাকা জুড়ে সার-সার মাথা, তালগাছের। ফাঁকা মাঠে দাঁড়ালে তাড়বন্না যেন মেঘের মতো আকাশে লেপ্টে।
লোদিপুর গয়া রোড দোকানে দোকানে ঢিবরি আর পঞ্চলাইটের রোশনী। ফেরার পথে--- পটনা-গয়া রোডে গঙগা আস্নান যাত্রিদের পায়ের ্অহত আওয়াজ শোনা যায়। এদিকে মিশনারি স্কুলের উল্টোদিকের বস্তি থেকে লোদিপুর, এ.আর.পি., ব্যাঙ্ক রোড, তিমোহানি, বাঁশঘাট, মন্দিরি -- যত সব ছেলে-জওয়ান লোক আছে, রাম নামে ছড়াছড়ি।
চারোওর লোকজন, পহেলবান, মুসাফির। দুদিকে রিক্সা, বৈলগাড়ি, সাইকেল, টমটম, ফিটন। আনা-জানা বন্ধ।
পাক্কি সড়কের কিনারে, মিশনারি ইস্কুলের পাশেই, বিপৎ গোপের ভাড়ি খাটাল। রাস্তার ধারে ইঁটের দিওয়ার, ভেতরে খাটাল। বাঁশের বাল্লায় খাড়া করা ছাউনি -- পুয়াল-খড়ের ওপরে খপরৈল --- অনেকখানি এলাকা জুড়ে। বিপৎ গোপের অখাড়া পটনাভর মশহুর।

আবার ভৌগলিক অবস্হানের সঙ্গে মিলিয়ে রচিত হয় চরিত্রের মুখের ভাষা। ভগযোগিনী বা রামখেলাওন, সুগিয়ার মা বা বিপৎ গোপ যে-ভাষায় কথা বলে, তাকে হিন্দি ভাষার নিদর্শন বললে ভুল হবে।'বাংলা ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগে' বাংলা কথাসাহিত্যে অভিনব সামগ্রী। আসলে হিন্দিভাষী মহল্লার মানুষজন ঠিক যে-ভাষায় কথা বলে, আগাগোড়া তার ব্যবহার কাহিনীর পক্ষে গুরুভার হয়ে উঠত। 'খোকা-কে-মাই' হিন্দি বাংলা মিশ্র ভাষায় কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভগযোগিনীও অনেক সময়ে সেই ভাষা ব্যবহার করে --

হ্যাঁ রে, কাল রাতে কান্না করছিলি কাহে?
আমাকে বহুত পিটেছিল--
পিটেছিল ? কাহে ? নিশা-ভাঙ করেছিল নাকি?
নেহি খোকা-কে মাই। ওকরে আদত এহি। ঐসে ঐসে পিটেছিল--
সে কি ? তোর লাগেনি ? খুব চেল্লামিল্লি করছিলি যে --
উ তো ঐ সেহি রোনা করেছিলাম।

মাঝে-মাঝে মিশ্র ভাষার বাংলা রূপান্তর [মৌগিঅনকে সামনে সরম কৌচিকা -- (মেয়েদের সামনে আবার লজ্জা কিসের!) কা বাত হ্যায় ? ব্যাপার কি ? ববন্ডর হো গয়া -- (সাংঘাতিক ব্যাপার), কখনও বন্ধনীর মধ্যে অর্থনির্দেশ (দিবালি -- দেউলিয়া)] বর্ণনা অংশে সাধারণত বাঙালির মুখের ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে, হয়তো মাঝে-মাঝে উদ্ধৃতিচিহ্ণের মধ্যে হিন্দি দুচারটি কথা--

যেই যায়, পণ্ডিতজি তার মাথায় লাগিয়ে দেয় ফাগের টিকা। তারপর গোটা মুখমণ্ডলে, ক্রমশ হাতে-পায়ে, পেটে। আবির মাখালে নাকি 'মাতামৈয়া' ( মানে মা শেতলা, অর্থাৎ বসন্ত)হয় না।
ঘাস-নেওয়ারির তৈরি হোলিকা, চারিদিক ঘিরে জড়ো করা তুম্বাকার গোইঠা, কাঠ-বাঁশ, টায়ার, কাগজ, শুকনো পাতা -- সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চা-জোয়ানরা বসে থাকে দূরে। আগুনের লকলকে আলো, ফটাফট আওয়াজ আর সেই সঙ্গে কালো ধোঁয়া মিশে যায় আকাশে বাতাসে। পোড়া গন্ধে ভরে যায় পরিবেশ। বাচ্চা-জোয়ানরা শিকে কাঁচা আলু একটা-তিনটে-পাঁচটা-সাতটা গেঁথে ছুঁড়ে ফেলে আগুনে । দহন শেষে ছাই উড়িয়ে শিক খুঁজে-বেছে বার করে আনো পোড়া আলু, হাতে-হাতে বিলি হয় পরসাদি।

প্রত্নবীজ-এ প্রচলিত উপন্যাসের নিটোল কাহিনীবৃত্ত প্রত্যাশা করে লাভ নেই। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক, তাই তাঁর রচনায় কিছুটা সাংবাদিকতার ধরন এসেছে। পনেরোটি পরিচ্ছেদে মহল্লের নানা ধরনের মানুষ এসেছে। কারও জীবনের আদ্যন্ত কাহিনী বর্ণন লেখকের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো ন'বছরের খোকার চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে বলে তাকে কাহিনীর যোগসূত্র বলা যেতে পারে। কিন্তু সব জায়গায় সেও নেই, বা তার চোখ দিয়ে সব কিছু দেখাও হয়নি। বুধনি কিংবা ফেকন কিংবা বুলকনকে নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটগল্প রচনা সম্ভব ছিল। কিন্তু সুবিমল বসাকের ঝোঁক ব্যক্তিচরিত্র নয়। অশীন দাশগুপ্ত যাকে বলেন ব্যক্তিসময়, তার ব্যবহার সেভাবে ঘটে না। বড়সময়ের উল্লেখ দুএক জায়গায় আছে, কিন্তু কালনির্দেশ কাহিনীকারের উদ্দেশ্য নয় -- "এক জমানা ছিল, যখন অংগ্রেজ সরকারের খুফিয়াসিআইডিরা তার ওপর নজরদারি করত। কত লাখো-লাখো নওজয়ান তাঁর গানা শুনে সুরাজি দলে ভিড়ে্ছে, ভারি রকম চাঁদা দিত সুরাজি দলে।" ছোটসময় নিয়েই প্রত্নবীজ-এর কথাকারের কারবার । তাই 'তাড়ি নয় বৈশাখি', বাতাসিয়ার শাদির প্রস্তুতি থেকে গৌনা, মাঝে-মাঝে রঙিন ফেরিওয়ালা, হালওয়াইয়ের নজারা, তেল মালিশ, অখাড়াবাজি, মাদারিঅলার করিশমা -- এই সব নিয়ে মহল্লার বিচ্ছিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়েই পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে। উৎসব-অনুষ্ঠান বর্ণনার মধ্যে কাহিনীর ভাবৈক্য সন্ধান করলে একেবারে ভুল হবে না।

বছরভর কত তোহার-পরব-- ছট, কার্তিক পূর্ণমাসি, দশহরা, দিওয়ালি, পুষ-সংক্রান্তি, হোলি, তীজ, কর্মা, বৈশাখি, গোবর্ধনপুজা, চিত্রগুপ্তপুজা -- এছাড়েও সৎনারানজীর কথা, অখণ্ড সংকীর্তন । কিন্তু হোলি আর দিওয়ালির মতো এমন জমকালো পরব নেই। দশহরাও তেমন করে মানায় না। হোলি হচ্ছে বসন্ত ঋতুর পরব-- জওয়ানি ও মিলনের উৎসব; দিওয়ালি হলো রোশনাইয়ের, লছমি-পুজন। গোবর্ধনপুজা -- গোয়ালা আহিররা করে, বিপৎ গোপের অখাড়ায় খুব ধুমধাম করে উৎসব মানায়, পুজাপাঠ, গানা-ঢোলক, কুস্তি-দাঁও-পেঁচের নুমাইশ চলে। চিত্রগুপ্তপুজা -- দিওয়ালির পর স্রেফ লালা-কায়েতরা। এই দিনে লালারা কোনো লিখা-পঢ়ির কাম করে না, কলম ছোঁয় না। লাখ জরুরত থাকলেও এক অক্ষরও লিখবে না-- মানিঅর্ডার, কর্জ-পর্চা, ডাক্তারি নুস্খা--- কোথাও না। ছট পরব চলে মাহিনা ভর; সুরজ দেওতার পূজা, গঙ্গার কিনারে অস্হায়ী ঝোড়ি। খুব নিয়ম আচার।

হোলি আর দিওয়ালির কাহিনীরূপ সুসম্পূর্ণ। বিহারিদের জীবনচিত্র অবলম্বনে সাংবাদিক অসামান্য সংবাদ-বিচিত্রা রচনা করতে পারেন। কিন্তু সুবিমল বসাক সাহিত্যিক --- তাই নিরুদ্দেশ সংবাদ বা চমক সৃষ্টির প্রয়োজন খাসখবর রচনা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি অঞ্চলকে অবলম্বন করে অঞ্চলের মানুষ, অঞ্চলের মানুষকে অবলম্বন করে হাশাআকাঙ্খাময় জীবনের গভীর সত্যকে ধরতে চান।
ভূমিপুত্রদের সঙ্গে বহিরাগত বাঙালিদের মিলে-মিশে থাকারই কথা। মহল্লায় কয়েকঘর বাঙালির কথা বলা হয়েছে --- খোকা, খোকা-কে-মাই, 'পঢ়ালিখা আদমি খোকার বাবা, ঠাইনি, মিউনিসিপালিটির ট্যাক্স কালেক্টর চিন্তাহরণবাবু, বাঙালি মাস্টারিনিজি আর তার মর্দ। এরা পরিপার্শ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেদের। অবশ্য দূরত্ব থেকেই যায়। আর এই দূরদৃষ্টি থেকে প্রত্নবীজ লেখা। মাস্টারিনিজির মর্দের কয়েকদিন তবিয়েত আচ্ছানেই, ঘরেই বসে আছে, "মাথা টনটনায়, পায়ের তলহটি গরম।" কতক্ষণ আর কিতাব পড়া যায়। তাই "মাঝে-মাঝে খিড়কি দিয়ে আসমান দেখে, পঞ্ছি দেখে, বাদল দেখে, দুরে মকান, মাটির বাড়ি, খাপরার ছাদ, আঙ্গন-ওসারা দেখে।" দু-মঞ্জিলার ওপর থেকে দেখে রামখেলাওণকে তেলমালিশ করে ভগযোগিনী ।--- "মাস্টারিনিজির মর্দের নজর ধুঁধলে যায়, কপালে জোর দরদ মহসুস হয়। চুপচাপ কুর্সিতে শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। হাত থেকে কখন যে কিভাবে পড়ে যায়, পতা তক চলে না তার।" প্রত্নবীজ পড়ার প্রতিক্রিয়া আমারও অনেকটা এই রকমই --- পিছনে ফেলে আসা এক জীবন, তার দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, সেখানে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। খোকা তো চিরকাল ন'বছর বয়সেই থাকবে না!
(কালিমাটি পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০১)

সুবিমল বসাকের হাবিজাবি--- ২১শে ফেব্রুয়ারি ও পাপের চেহারা
ফালগুনী রায় লিখিত

২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহিদেরা সুবিমল বসাকের মতই প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্যে নিহত না হলেও সুবিমল শহিদ হয়েছিলেন বাঙাল ভাষার জন্যে -- অর্থাৎ মসী, অসি অপেক্ষাও শক্তিশালী এই প্রবচনের সূত্র ধরে বলা যায় কলকাতার অ্যাকাডেমিক অধ্যাপক বা আধুনিক কবি কেউ-কেউ বাড়িতে যারা মা'র সঙ্গে বাঙাল ভাষায় এবং কলেজে কফিহাউসে খালাসিটোলায় বা বেশ্যার সঙ্গে ক্যালকেশিয়ান ডায়ালেক্টে কথা বলেন --- তাঁরা সুবিমলের ভাষারীতিকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন--- কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদরা যেমন একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় সেইমত সুবিমল বসাকও শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের উপহাস-গালাগালের গ্লোরিকে ম্লান করে দিয়ে একই ভাষারীতিতে লিখে চলেছেন (১৯৬৪ থেকে)--- লিখে চলবেন।
সুবিমল গদ্য লেখেন এবং কবিতাও --- সুবিমল রবীন্দ্রনাথের মত দাড়ি রাখেন না কিন্তু টাইপমেশিনের সাহায্যে অই ভদ্রলোকের একটা প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন ছাত্রাবস্হায়--- দেখেছিলুম। সুবিমল রবিঠাকুরের মত গান বা নাটক লেখেননি কোনোদিন, সো হোয়াট ? রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সুবিমল লিখতেন কি ? বিশেষত বাঙাল ভাষায়, উপরন্তু যখন দু'বাংলাকে কেন্দ্র করে পাবলিশাররা তাদের পড়ে যাওয়া মার্কেটকে পুনরায় তোলবার চেষ্টা করছে, তখন লক্ষ্য করে দেখুন, সুবিমলের 'বাংলাদেশ' নামে বাঙাল ভাষায় লেখা লিফলেটটিতে কত কম বঙ্গবন্ধু বা বাংলা-দেশ-এর রেফারেন্স।

আরশির ওই পারে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরে-ফিরে প্রতিশোধ লিতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহান'ই আমি নিত্যি দেহি আরশিতে

---মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বাঙালি খ্রিষ্টান ছিলেন, তিনি রাবণের ভেতর দেখতে পেয়েছিলেন --- আপন আত্মার ছায়া --- অনুরূপভাবেই সুবিমল ভগবান-বন্দনা করেননি--- শয়তানের ভেতর দেখেছেন নিজস্ব প্রতিবিম্ব--- কিন্তু এর ফলে যদি কেউ বলে, আর দেখতে হবে না --- ও শালা নিশ্চয় মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত, তখন ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়া গত্যন্তর আছে কি ? উপনিষদেও বলা হয়েছিল তিনি আছেন --- রবীন্দ্রনাথও বুঝে ছিলেন ব্যাপারটা--- রবীন্দ্রনাথও কি উপনিষদের চর্বিতচর্বণ ? ব্যাপারটা বলতে হল এই কারণে যে আধুনিক গদ্য-পদ্য'র আন্দোলন-এ (সত্য গুহ লিখিত) পট করে লিখে দেয়া হয়--- অমুক-অমুক কবিরা তমুক-তমুক কবিদের চর্বিত চর্বণ করে কবিতা লিখে চলেছেন। কবিতা লেখা ব্যাপারটা নোট মুখস্হ করে এম.এ. ডিগ্রি পাওয়ার মত সহজ নাকি, যে আশুবাবু গোপালবাবু সুকুমারবাবু ইত্যাদির থিওরি-থিসিসের চর্বিত চর্বণ করলেই বভিষ্যতে অধ্যাপক হওয়া বা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে বাংলা পড়ানো যাবে।
সুকুমার টের পেয়েছেন--- ব্যর্থতা নিয়া থাকায়ও কারু-কারু সার্থকতা... হেজেহুইতে ট্যার পাই --- কতো-কতো ব্যাপারে ম্যায়ালোকেরে কাৎ কইরা ফেলে বাজারের মাগি। সুবিমল দেখেছেন---

এই শহরের মাগিদের কোঠায় দেহি সরকারি 'নিরোধ'এর বিজ্ঞাপন
কালোবাজারের খয়রাতি দানে না-জানি কতো মন্দির তৈয়ার হইতাসে
এই কিনারে বোমা পরীক্ষা --- আরেক কিনারায় হাসপাতাল

সুবিমল লিখেছেন---

সুখি মানুষেরা একতলা দুইতলা কইরা উইঠ্যা যায় উপরে
হাতের লাগল থাকে ম্যায়ামানুষ চেনবান্ধা কুত্তা, আদালতের আইন-কানুন

এভাবে সুবিমল যা-কিছু টের পেয়েছেন দেখেছেন সবকিছু লিখে রেখে গ্যাছেন, এমন কি শেষ কবিতার প্রথম দুই লাইন---

ভিয়েৎনামের উপর আমারিকার যুদ্ধনীতি সবরাষ্ট্রের অসমর্থন
অহনই শোওনের তোড়জোড় করতাসো, রাত্র হপায় পড়লো--

এভাবেই বাংলাদেশ আন্দোলনের জোয়ার আসার আগে থেকেই পদ্মাপারের ছেলে সুবিমল দ্যাশের ভাষায় গদ্য লিখে বিদেশে পরিচিত হয়ে গেছে, এখন আমরা যারা খুব বাংলাদেশ নিয়ে লেখালিখি মাতামাতি সভাসমিতি করি, তারা যদি সুবিমল-এর ভাষারীতিকে আক্রমণ করি বা এ-সম্পর্কে উদাসীন থাকি তবে সেটা একটা পাপের পর্যায়ে গিয়ে পড়বে...
( কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৯৭১)

অজয় সেন লিখিত 'হাবিজাবি, বকবকানি ও খোলা জানলা'
সুবিমল বসাকের সাথে প্রথম আলাপ কলেজ স্ট্রীটের 'বিভূতি কেবিনে'। সেখানে শৈলেশ্বর, বাসুদেব, সুভাষ অনেকেই আসত, কাছাকাছি কফিহাউস থাকা সত্তেও 'বিভূতি কেবিন' তাদের অনায়াসে সাঁতরানোর জায়গা ছিল।১৯৬৩-৬৪-এর ওই আড্ডাখানায় শুনতাম বেশি, লক্ষ্য করতাম বেশি হাংরির নব্যযুবকদের, এদের মধ্যে আমার কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ও সুবিমল বসাক। পরে সুবিমলের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কারণে এক ধরণের ভালোলাগা জন্ম নিয়েছিল, বলা বাহুল্য, আজও যা চিড় খায়নি এতটুকু। ওর অফিসে গিয়ে অনেক দিন অনেক সময় কাটিয়েছি, ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটি কর্মচারীর নাম. কে কি রকম, কার কি দুর্বলতা, কি কি গুণ খুঁটিনাটি আমাকে সে বলত নিচুস্বরে, চা খেতে-খেতে এই সব গল্প হত আমাদের। আর যে আলোচনার মধ্যে এসব কিছুই থাকত না, তা হল লেখালিখি। সে নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের লেখালিখি সুবিমল বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ত, যেটা আমার তাকে ভালো লাগার কারণ। কে কোথায় একটা ভালো লেখা লিখেছেন, সেই লেখার সমালোচনা করে ভালো কি মন্দ অনায়াসে জানিয়ে দিত। আমার লেখা যে সে পছন্দ করে তা প্রথম দিন আলাপের পরই জানিয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম বেশ খানিকটা। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম এই কারণে সদ্য লিখতে আসা নব্য যুবককে উৎসাহ ও প্রচ্ছন্ন সাহস যোগানোর জন্য।

সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে ছাই-চাপা আগুন। সে সময় হাংরি আন্দোলন ঝড় তুলেছিল দেশে তো বটেই, বিদেশেও তার ঝাপটা লেগেছিল, সে সময় পুতু পুতু রক্ষণশীলরা চেঁচামেচি শুরু করেন, ফলতঃ শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্য রচনা করেছেন, সমাজের ভেজানো দরোজা একের পর এক খুলে দিচ্ছেন, তাদের এসব উদ্যম চিন্তাভাবনা ভালো লাগেনি প্রশাসন এবং এক শ্রেণীর ব্যাঙদের কাছে, ফলতঃ ধরপাকড়, হাজতবাস, কোর্টকাছারি অমোঘ হয়ে নেমে আসে হাংরি আন্দোলনের কবি-সাহিত্যিকদের ওপর। এদের মধ্যে অনেকে,( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ) মুচলেকা দিয়ে দেন, ভাবটা এমনই যে ওপাড়ায় আমি নেজে যাইনি, আমাকে ওরা নিয়ে গেছিলো। সুবিমল ও অন্য কয়েকজন নিজেদের মতই লেখালিখি করে গেছেন। কাউকে, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই। সুবিমলের লেখার মধ্যে একটা প্রাদেশিক সাযুজ্য লক্ষ করি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি প্রাদেশিক কবিতা অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্হ রচনাতেও মাহিরিআনা দেখিয়েছেন। দুটো উপন্যাস, ছয়টি গল্প-গদ্য সংগ্রহ, দুটি কবিতার নিজস্ব চটি বই।প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন অনেক। অনুবাদ সাহিত্যে ২০০৭ সালে যশপাল রচিত অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত সুবিমল। যদিও তা অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।

সুবিমল বসাকের লেখালিখি --- প্রথম কবিতার বই 'হাবিজাবি' যখন প্রকাশিত, তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে। অধিকাংশ কবিতা ওই সময়ের লেখা, মনে হয় নিজের সম্পর্কে ভাবনা, সমাজের উঠোনে নিজেকে নগ্ন করে খতিয়ে দেখা, নিজের পরিবেশকে খুঁড়তে-খুঁড়তে নিজের সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ, ভাবনা আবিষ্কার করা। ফলতঃ কবিতাগুলোয় প্রেম-অপ্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসাহীনতা, চোরাস্রোতের মত চিন্তা, ঈর্ষা, স্নেহ, জীবন-পারাপার-ভাবনা, দুঃখকষ্ট, অবজ্ঞা-উপহাস, হতাশা, চিল-চিৎকার যাবতীয় ব্যাপার উঠে এসেছে ওই কবিতাগুলির মধ্যে।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতার প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, তো যেটা লক্ষ করি, 'হাবিজাবি' কবিতার বইয়ের মধ্যে, তা হলো ভাষা। সুবিমলের কথায় --- আমার মায়ের ভাষা। পূর্ববাংলার ভাষা তো মাটির ভাষা। এখন লক্ষনীয় 'মা' কোন অর্থে? দেশ-মা না গর্ভধারিণি-মা ? এক অদ্ভুত দেশজ কধ্য ভাষায় এরকম লেখা আমি কখনও পড়িনি। বাংলা সাহিত্যে কবিতার জগতে সুবিমল পাথ-ব্রেকিং।

১৯৭০ থেকে ২০০০ সালে প্রায় তিরিশ বছর বাদে দ্বিতীয় কবিতার বই 'বকবকানি' । মোট চব্বিশটি কবিতার চটি বই। রাজনীতি, ব্যাঙ্গ, যৌনতা, দার্শনিক স্ট্রিট রিয়্যালিটির পাশ কাটিয়ে এক মানভাষার আকুতি। 'বকবকানি' সে-অর্থে এক সার্থক দলিল। অবশ্য হাংরি আন্দোলনের বাঁকবদল ছিল উত্তরঔপনিবেশিক এপার-বাংলার ফসল। সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যে জীবনবোধ গড়ে দেয়, তা থেকে এই মোড়বদল আলাদা করা যায়। কবিতা ছাড়াও সুবিমল বসাক অত্যন্ত নিপুণভাবে গদ্য রচনা করেছেন; গদ্য সংগ্রহ যে কয়টি হাতে পেয়েছি, ইতস্তত পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, মনে হয়েছে সুবিমল আরও গদ্য লিখতে পারতেন। তবে তিনি যে একজন সফল গদ্যকার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি হিন্দি কবিতার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন 'প্রতিবেশি জানালায়'। অনুবাদ সাহিত্যেও সুবিমল যে মাহির তা বলাই বাহুল্য।

অনুবাদ সাহিত্যে গল্পের মধ্যে ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'তিসরি কসম', শ্রেষ্ঠ গল্প প্রেমচন্দের 'পঞ্চ পরমেশ্বর', 'দুই সখী'। প্রবন্ধ অনুবাদের ক্ষেত্রে 'জীবনসার', হিন্দি কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংকলন 'প্রতিবেশিন জানালা'। শ্রীকান্ত বর্মার 'উজ্জয়িনীর রাস্তা', জগদীশ চতুর্বেদীর 'বোবাদের পল্লীতে' যথেষ্ট দাগ কাটে পাঠকদের মনে, কারণ প্রত্যেকটি অনুবাদ-কবিতায় হাংরি কবিতার ঝলক উঁকি মারে। কবিতার জীবনকে সামলাতে না পারলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায় --- পাঠককুলকে তাই খবরদারি, সাবধানবাণী প্রকৃতই চেতাবনি। সুবিমল বসাক ঢাকায় গেছিলেন তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির আশে-পাশে যে-সব বুজুর্গরা থাকতেন, তাঁদেরই সান্ধ্য আসরে তাঁদের অনুরোধে লুপ্তপ্রায় এক প্রাচীন শিল্পকলাকে তুলে ধরেছেন। ঢাকার হিন্দু বাঙালিদের 'বিয়ার গীত' ও 'ঢাকাই ছড়া' সংকলনে। খাস কলকাতায় বছর তিরিশ পূর্বেও বিবাহ উৎসবে এসব গানের প্রচলন ছিল, ক্রমশ হ্রাস পেতে-পেতে এসব গান আজ আর কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে শোনা যায় না, হয়তো আর্থ সামাজিক, শহুরে মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি, দ্বিতীয়ত এসব গানের উত্তরসূরী তাঁরা রেখে যাননি, তবু এখনও গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রাচীনা, বিবাহ উৎসবে আনন্দে উত্তেজনায় গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন এই সব গান।তা সুবিমল বসাকের অবদান।

হাংরি আন্দোলনের পুরোধা সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে বহু বিচিত্র শিল্পগামী। এখনও তাঁকে লিখে যেতে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করি। তার কারণ তিনি জানেন এমন গদ্য অথবা কবিতা নেই--- যা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ঠাণ্ডাযুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারে --- তাই সুবিমলকে অনুরোধ--- লিখুন, আরও লিখুন। থামিয়ে দিন পৃথিবীর ঙাণ্ডাযুদ্ধ ও উলঙ্গ বিবাদ।

ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত

লেবেলসমূহ: Antiestablishment Discourse, Hungry Generation, Subaltern Literature

কলিম খান লিখিত : সুবিমল বসাক, এক সুন্দর মানুষের কথা
"তোমার সঙ্গে যারা থাকে, তোমার বাবা মা জেঠা জেঠিমা কাকিমা মাসি পিসি ঠাকুরদা ঠাকুরমা ধাইমা দাদা দিদি বৌদি....এদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ?" --- এ প্রশ্ন যৌথ পরিবারে বাস করে এমন বাংলাভাষী শিশু-কিশোরীকে ( যাদের বয়স সাত-আট বছরের কম ) জিজ্ঞেস করলে বেশ অদ্ভুত উত্তর পাওয়া যায়। দেখা যায়, যাকে সে সবচেয়ে বেশি সুন্দর বা সুন্দরী বলে ঘোষণা করছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার রূপলাবণ্য দৃষ্টিনন্দন বা বিউটিফুল নয়; অথচ তাকেই সে সুন্দর বা সুন্দরী বলছে ! তার মানে সুন্দর বলতে তারা রূপবান-রূপবতী বা বিউটিফুল বোঝে না, অন্য কিছু বোঝে।

বিষয়টি নিয়ে একটু এগোলে দেখা যায়, শিশু-কিশোরটি যাকে সুন্দর বা সুন্দরী বলছে, তার রূপ দৃষ্টিনন্দন বা দৃষ্টিকটু যাই হোক, সে আসলে শিশুটিকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তার মানে, বাংলাভাষী শিশুদের ভাষাজ্ঞান অনুসারে যে ব্যক্তি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, সে-ই সুন্দর বা সুন্দরী! এই লেখকও তার শৈশবে তার ঠাকুমাকেই বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর মহিলা বলে জানত। এমনও দেখা গেছে, পরিবারের সকলের অবহেলার মাঝে এক অতি কুরূপা দাসীর নিত্য পরিচর্যায় বড় হয়ে ওঠা শিশু তার সেই কুরূপা দাসীকেই 'সুন্দরী' বলে ঘোষণা করছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেকেই এই প্রকার সত্যের সন্মুখীন হয়ে থাকবেন। তার মানে, যাদের প্রতি শিশু-কিশোরদের ভালবাসা উৎসারিত হয়, তাদেরই তারা বিউটিফুল দেখে। সেক্ষেত্রে মানতেই হবে যে, মানুষের মনের রঙেই পান্না সবুজ হয় -- এই রবি-বাক্য এক্ষেত্রেও সক্রিয় রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে আরও একটু এগোলে আর-এক সত্যের সন্ধান মেলে দেখা যায়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, পুরাণাদি গ্রন্থে, গ্রামবাংলার মানুষের মুখের ভাষায় সুন্দর শব্দটি সাধারণভাবে বিউটিফুল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, হয় না। হয় না যে, তার অজস্র প্রমাণ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 'সুন্দর কথা', সুন্দর গান'... এসব তো আমরা বলি, এমনকি বঙ্গীয় শব্দকোষ রচয়িতা শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও জানাচ্ছেন যে--- কর্পূরমঞ্জরী গ্রন্থে একটি পদে রয়েছে 'সুন্দর শব্দাবলী': বিদ্যাসুন্দর গ্রন্হে রয়েছে 'সুন্দর নাম': বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্হাবলীতে রয়েছে 'সুন্দর স্পর্শ', 'পরিতে সুন্দর', ঘ্রাণে সুন্দর'... ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষাজ্ঞানীরা জানেন, ইংরেজিতে Beautiful words, beautiful name, beautiful to wear, beautiful to smell... এরকম শব্দবন্ধ রীতিসম্মত নয়। কিন্তু বাংলায় দেখা যাচ্ছে সেরকম শব্দবন্ধ কেবল তৈরিই করা যায় না, হয়ে থাকে, হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তার মানে বাংলা ভাষায় সুন্দর বা সুন্দরী শব্দের মানে শুধুমাত্র বিউটিফুল নয়, আরও অনেক কিছু। প্রশ্ন হল কী সেই মানে ?

বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ-এর কাজ করতে গিয়ে 'সুন্দর শব্দের সেই অর্থটি আমার চোখে পড়ে যায়। দেখি, 'সমুদ্র'এর মতো 'সুন্দর' শব্দটিরও জন্ম হয়েছে 'উন্দ' ক্রিয়ামূলের শব্দপরিবারে। [সু+/উন্দ+অর--কতৃবাচ্যে। উন্দএর মানে হল 'নিজের উচ্চতাকে কমিয়ে অন্যের সমান বা সমান্তরাল করা' বা 'সামঞ্জস্য বিধান করা' ( উ=উদগতি; ন= না-করণ; দ= পারিপার্শ্বিককে দান )। এই ক্রিয়া থেকে জাত ইঁদুর, ওল, সমুদ্র, সুন্দর, সুন্দরী, সৌন্দয্য প্রভৃতি কুড়িটি শব্দ নিয়ে গড়ে উঠেছে উন্দ-এর নিজস্ব শব্দপরিবার। সমস্ত প্রাচীন বাংলা অভিধান এই সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। ইংরেজি wound শব্দটি এই পরিবারেরই সন্তান।] সেই সুবাদে সুন্দর শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল -- 'সু-উন-দানের অস্তিত্ব রহে যাহাতে' । অর্থাৎ আপন শক্তির জোরে উপরে ওঠা গেলেও, উপরে ওঠাকে কমিয়ে পারিপার্শ্বিক সত্তাদের সেই শক্তি খুব ভালভাবে দান করে যে, সেই হল সুন্দর। তার মানে সুন্দর সে-ই, যে সর্বদা পারিপার্শ্বিকের সমান হওয়ার চেষ্টা চালায়, আপন উন্নয়ন থামিয়ে পরিপার্শ্বের উন্নয়নে যত্নবান হয়; যে যথার্থে সামঞ্জস্যমূলক সমানতায় বিশ্বাসী যথার্থ সাম্যবাদী; যে সক্রিয়ভাবে সমোচ্চশীলতার নীতি অনুসরণ করে থাকে। জল সমোচ্চশীল বলেই তার মহা আধারটি 'সমুদ্র' পদবাচ্য, যে 'সমুদ্র' শব্দটি একই উন্দ ক্রিয়া থেকে জাত হয়েছে। এই সেই কারণ, যেকারণে পুরাণাদি গ্রন্থে জনসাধারণ বোঝাতে 'জল' শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। মোট কথা, 'সুন্দর' শব্দের প্রকৃত অর্থ হল ( পরিপার্শ্বের সঙ্গে ) সুসামঞ্জস্য সাধন করে যে ।

বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ ছেড়ে সামাজিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, সুন্দরী (সু-উন্দ-র-ঈ) সেই নারী, যিনি তাঁর চারপাশের মানুষের মনকে আর্দ্র করে আপন সমানতার বোধ দান করেন। তার মানর আমার মা/মাসিমা/জ্যাঠাইমা/ঠাকুমা/দিদিমারা যেমন আমাদের মনের আশ্রয় হয়ে ওঠেন, মনে হয় যেন তাঁর কাছে গিয়ে নিশ্চিন্তে সব কথা বলা যায়, তিনি আমাদের মনকে আর্দ্র করে দেন, তিনি আমাদের সমান এই বোধ দান করেন, সেই জন্যই তাঁরা সুন্দরী। বাংলাভাষী বহু মা-মাসিমাকে দেখা যায় রিকশয় উঠে, তাঁর সঙ্গে রিকশাওলার উচ্চনীচ অবস্হানের ভেদ অমান্য করে, তিনি রিকশওলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন এবং অচিরে রিকশওলার পরিবার?

হাংরি আন্দোলনে বিভাজন সম্পর্কে কৃশানু বসুর বক্তব্য

বাংলাভাষী সাহিত্য-অনুরাগীদের মতে,বাংলায় সাহিত্য আন্দোলন 
বলতে একটি আন্দোলনের কথাই বলা যায় এবং সেটির নাম
-----হাংরি জেনারেশন আন্দোলন।
বলাবাহুল্য আমিও মোটামুটি এই মতামতটির 
পক্ষেই থেকেছি!
তো এই আন্দোলনটি ঘিরে বহু কথা বহু আলোচনা যে হয়নি,তেমনও নয়।তবে অদ্ভুতভাবে এই আন্দোলনটির কথা উঠলেই,প্রথমে বুঝে নিতে হয়,আলোচক কোন পক্ষের 'হাংরি'!মলয় রায়চৌধুরী,শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সমীর রায়চৌধুরী,সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, দেবী রায়দের 'হাংরি' নাকি শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত,প্রদীপ চৌধুরী,সুবো আচার্যদের 'হাংরি'?

মজার ব্যাপার,গতবছরেই কলকাতার দুই দুটো প্রকাশনা থেকে দুই দুটো 'হাংরি সংকলন' প্রকাশিত হয়েছে।এবং দুটি প্রকাশনাই মূলত মেইনস্ট্রিম সাহিত্যের ব্যবসাই করে থাকে।'হাংরি' ব্যবসা কোনটির বেশি,জানা না গেলেও সংকলন গ্রন্থ দুটি নিয়ে অনেক মজার গল্প বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।যাইহোক! সংকলন গ্রন্থ দুটির একটিতে যেমন মলয়-সমীর-শক্তি-দেবী রায়েদের কোনো লেখালেখি বা লেখালেখির উল্লেখ নেই,তেমনি অন্য সংকলনটিতেও শৈলেশ্বর ঘোষেরা অস্বস্তিকরভাবে অনুপস্থিত!শৈলেশ্বর ঘোষের কথা আলাদাভাবে বলার কারণ,আমি মনে করি,হাংরির কোনো সংকলন থেকেই শৈলেশ্বর ঘোষ,মলয় রায়চৌধুরী এবং ফালগুনী রায়কে বাদ দেওয়া যায়না!

একটি আন্দোলন গড়ে ওঠার পর,সে আন্দোলনের গতিপথ কেমন হবে,তা ঘিরে বিতর্ক থাকটাই স্বাভাবিক।মতভেদ থাকাটাও কখনো কখনো জরুরী।কিন্তু 'দুই প্রকারের হাংরি'-র দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই কখনো কখনো একেবারেই ছেলেমানুষি ঝগড়ার পর্যায়ে চলে গেছে।এই ঝগড়ার ফসল তুলেছে এবং এখনো তুলছে তথাকথিত কিছু নিম্নমেধার লোভী কবি-যশোপ্রার্থী এবং সম্পাদক!

হাংরি আন্দোলন এবং সে আন্দোলনের ভাঙন প্রসঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর বেশ কিছু লেখালেখি আছে।'হাংরি কিংবদন্তী' নামে একটি বইও আছে।শৈলেশ্বর ঘোষও লিখেছেন, 'হাংরি জেনারেশন আন্দোলন'।

বলাবাহুল্য, কলকাতায় দুইপ্রকারের হাংরিরই কিছু কিছু অনুগত 'কর্মী' রয়েছেন।এবং এই কর্মীদের অধিকাংশই একশো শতাংশ 'ডেডিকেটেড'!শৈলেশ্বরপন্থীদের সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী অথবা সমীর রায়চৌধুরীর লেখালেখি প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে,তাদের একটি অংশের নির্ভর করতে হয়,শৈলেশ্বর ঘোষ কী কী বলে বা লিখে গেছেন, তার উপর!অন্যদিকে মলয় অনুরাগীদের একটি বৃহৎ অংশ তো শৈলেশ্বরের মতো উল্লেখযোগ্য কবির একটি কবিতা না পড়েও তাঁকে খারিজ করে বসে থাকেন!


হাংরি আন্দোলনের বিভাজন নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী একটি ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, সমীর রায়চৌধুরীর মতে এই বিভাজনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল শঙ্খ ঘোষের।

শৈলেশ্বরদার শঙ্খ-প্রীতি ছিল বরাবরের।মাঝরাতে শঙ্খের সঙ্গে টেলিফোন-আলাপ,পরামর্শ এবং আদানপ্রদানের রাজনীতি ছিল।তবু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা,হাংরি বিভাজনের সময় কবি শঙ্খ ঘোষ এতখানি 'পাওয়ারফুল' ছিলেন!শঙ্খ ঘোষ শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে প্রশস্তিসূচক কিছু বললে বা লিখলেই হাংরি আন্দোলনের বিভাজনের বীজ রোপন করা হয়ে যাবে,ব্যাপারটি এতটাও সরল নয়!

এখানে আরো একটি তথ্য জানিয়ে রাখার ইচ্ছে হচ্ছে।কলকাতা থেকে একটি লিটলম্যাগাজিন শৈলেশ্বর ঘোষকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে।তো শৈলেশ্বরের ইচ্ছে অনুযায়ী কবি শঙ্খ ঘোষ এবং অমিতাভ দাশগুপ্তকে সংখ্যাটিতে লিখতে বলা হলে,দুজনেই 'ব্যস্ততার' কারণে এড়িয়ে যান!

***************************************************  যে কারণে শৈলেশ্বর ঘোষের রচনা 'প্রতিভাস'-এর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি :
 কবি শৈলেশ্বর ঘোষের মেয়ে শ্রীমতি জীজা ঘোষ-এর কপিরাইট সম্পর্কিত হুমকি :
২৬.১১.২০১৩
প্রতি : প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদক : চন্দ্রগ্রহণ
৭ বরদাকান্ত রোড
দমদম, কলকাতা ৭০০ ০৩০


মহাশয়,
আমি, শ্রীমতি জীজা ঘোষ, স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষ-এর কন্যা, আপনার সম্পাদিত পত্রিকা 'চন্দ্রগ্রহণ'-এর 'হাংরি আন্দোলন সংখ্যা' ( শারদীয় ১৪২০, নবমবর্ষ, সংখ্যা ১৭, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ )-য়, আমার বাবার কয়েকটি কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়াই । ইতিমধ্যে ফোনে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে । তখনও যা জানিয়েছিলাম তা আবারও জানাই -- আপনি আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া বাবার রচনাগুলি আপনার পত্রিকা 'চন্দ্রগ্রহণ'-এ ছেপে ঘোরতর অন্যায় করেছেন ।


আপনাকে আগেও জানিয়েছি, আবারও জানাচ্ছি যে, আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষের কোনো কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আর কোনো দিনও কোনো সংকলনে ছাপবেন না বা ছাপাবেন না । আমি আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে জেনেছি যে, কোনো কবি বা লেখকের মৃত্যুর পর ৫০ বছর পর সেটা জাতীয় সম্পত্তি হয় । তখন তাঁর রচনা যে কেউ ছাপতে পারে । 


আমি জানি, এ কাজ আপনি শ্রীমলয় রায়চৌধুরী ও শ্রীসমীর রায়চৌধুরীর দ্বারা নির্দেশিত হয়েই করেছেন । আমার বাবাকে জীবিতথাকাকালীন যাঁরা কুৎসিতভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আক্রমণ করেছেন , তাঁদের সঙ্গে আমার বাবার কোনো সংকলনে কোনো লেখা থাক, এটা আমি বা আমার পরিবারের কেউ চাই না । আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষ-এর এটাই ইচ্ছা ছিল । স্বাভাবিকভাবেই আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আমার স্বর্গীয় বাবার ইচ্ছার সন্মান জানাতে চাই ।


আপনাকে আবারও বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া আমার বাবার কোনো রচনা -- কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আর ছাপবেন না বা ছাপাবেন না । এর পরও যদি না শোনেন তবে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্হা গ্রহণ করতে বাধ্য হব ।


বিনীত নিবেদন
জীজা ঘোষ


Monday, August 27, 2018

মলয় রায়চৌধুরীর বিতর্ক : সম্পাদনা মধুসূদন রায়

মধুসূদন রায়
আমার সাম্প্রতিকতম পোস্ট এবং এই পোস্টের প্রচ্ছদ দেখেই বুঝতে পারছেন কোন বিতর্কে জড়ানোর কথা বলছি । এবার তাহলে সত্যিটা বলাই যায় ।


মলয় রায়চৌধুরী এবং তাঁকে ঘিরে সাড়া জাগানো হাংরি সাহিত্য আন্দোলন – সবমিলিয়ে একটি বিতর্ক । সেইসব মিলিয়েই এই বই । যার সম্পাদনার দায়িত্বটি আমার উপর । সুতরাং এমন একটি বিষয়, যেখানে নিজের অস্তিত্ব কিছুটা হলেও জড়িয়ে যাওয়া – একটা অস্থিরতা, উদ্বেলতা । নিজের ভূগোল একেবারের সূক্ষ্ম এবং ক্ষুদ্র বলেই তাকে নিয়ে নিরীক্ষা করা যায় । কে না জানে, নিজস্বতাকে অতিক্রম করা বড় বিপজ্জনক !

মলয় রায়চৌধুরী -একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক । তাঁর চিন্তাভাবনার স্তরকে কোন নির্দিষ্ট আইডেন্টিটি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না অথচ সাহিত্যে তিনি নিজেই আইডেন্টিটি । বলা যায় বাংলা ভাষার চির প্রতিষ্ঠিত আধুনিক চিন্তাভাবনার স্তরকে নাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁর প্রবেশ।

সে কারণেই ‘হাংরি আন্দোলন’ । আর যার আফটার এফেক্ট আমি আপনি অনুভব করে চলেছি অবিরত । অথচ এই আমার আপনার মনের মধ্যেই ঢুকে আছে এক বিষ-বীজ, হাংরিদের লেখা মানে গালাগাল ও অশ্লীল শব্দের কোলাজের ভেক্টর রূপ । সত্যিই কী তাই ?


কেন প্রয়োজন ছিল হাংরি আন্দোলনের ? মলয় রায়চৌধুরী কেন বিতর্কিত একটি নাম ?

আর তাই ‘মলয় রায়চৌধুরীর বিতর্ক’ ।

শীতল চৌধুরী, অজিত রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু ও মলয় রায়চৌধুরী প্রমুখদের লেখায় সমৃদ্ধ ।
বার্ণিক প্রকাশন থেকে প্রকাশের পথে এই বইটির প্রচ্ছদটি নির্মাণ করেছেন সুমন সেন Suman Sen ।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত মলয় রায়চৌধুরীর
ছবি – চন্দ্রিল গোস্বামী ।

                                             

হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা


Sunday, August 26, 2018

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর চাইবাসার প্রেমিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম ( বিয়ের পর বন্দ্যোপাধ্যায় )































শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রায় তিন বছর চাইবাসায় ছিলেন । থাকতেন সমীর রায়চৌধুরীর নিমডি টিলার চালাঘরে সমীরের সঙ্গে । সমীর যখন ট্যুরে যেতেন তখন শক্তিকে মধুটোলার সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেতেন । শক্তি সুধীরবাবুর মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েন এবং ঔপন্যাসিক থেকে হয়ে ওঠেন কবি । প্রতিদিন শীলার জন্য প্রেমের কবিতা লিখে শীলাকে শোনাতেন । শীলা কলেজে গেলে ফেরার পথে অপেক্ষা করতেন । শক্তির প্রেমের ফসল "হে প্রেম হৈ নৈঃশব্দ্য" । কিন্তু শীলার সঙ্গে শক্তির বিয়ে অনুমোদন করেননি সুধীর বাবু ; তার কারণ শক্তি প্রতিদিন মহুয়ার মদ খেয়ে ফিরতেন এবং বেকার ছিলেন ।

সুধীরবাবু শীলাকে শক্তির প্রভাব থেকে দূরে রাখার জন্য পাটনায় মলয় রায়চৌধুরীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন । শীলা পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেন ।

শক্তি সন্দেহ করেছিলেন যে তাঁকে শীলার কাছ থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রে সমীর ও মলয়ের হাত আছে । ফলে শক্তি হাংরি আন্দোলন ছেড়ে চলে যান । তিনি এতোই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে হাংরি মামলায় মলয়ের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন । তাঁর ও শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে আদালত মলয়কে একমাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল ।

শৈলেশ্বর ঘোষ ও মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে বাসব রায়


শৈলেশ্বর ঘোষ ও শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে সমরজিৎ সিংহ


হাংরি আন্দোলনে শঙ্খ ও সুনীলের অবদান : সমীর রায়চৌধুরী


Wednesday, August 22, 2018

ভণ্ডকবি শৈলেশ্বর ঘোষের তৃণমূলের দলদাস হবার অনুষ্ঠান

প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজে ক্ষমতার লোক হবার আগে শৈলেশ্বর ঘোষের কোটেশান । লোকটা যে আসলে ভণ্ডকবি ছিল তার প্রমাণ মৃত্যুর আগে তৃণমূলের দলদাস হয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষীর খাবার চেষ্টা ।

" একজন যিনি কবি হযে় উঠতে চান, তার আত্মবিমোচন পদ্ধতি শুরু হতেই যদি বুঝে যান যে তিনি ক্ষমতার বিপক্ষের লোক নন, তিনি ক্ষমতার পক্ষের লোক; তিনি যে ভাষা পেতে চান সেটি ক্ষমতাকে বিরূপ করে তুলবে -- তখন শুরু হয় তার ত্রাসের কাল | ভাষা বিমোচন তো দূরের কথা, এই সংঘর্ষের ক্ষেত্রটি থেকে পলায়নই তার বাঁচার পথ হয় | এমন রচনাকার আমরা দেখেছি যিনি ক্ষমতার ভাষাকে আঘাত করার আপাত একটা মানসিকতা দেখাচ্ছেন কিন্তু অনতিকালেই তিনি ওই পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন | তিনি ঢুকে পডে়ন ক্ষমতাসেবীর দলে |" শৈলেশ্বর ঘোষ (ভাষা বিমোচন)
                                           
                    মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আয়োজিত সভায় ভণ্ডকবি

Saturday, August 18, 2018

অঞ্জন আচার্য : স্মরণ - আমার উৎপল আবিষ্কার, উৎপল ভাবনা

স্মরণ : আমার উৎপল-আবিষ্কার, উৎপল-ভাবনা

০৯ অক্টোবর ২০১৫, ১৩:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫, ১২:৫৪
অঞ্জন আচার্য
উৎপলকুমার বসু নামটির সঙ্গে আমি প্রথম পরিচিত হই একটি গানের মধ্য দিয়ে। কথাটি অদ্ভুত শোনালেও গল্পটি এমন। ২০০২-০৩ সালের কথা। মফস্বল শহর ময়মনসিংহে তখন সাহিত্যচর্চায় ব্যস্ত আমরা। সাহিত্য সংসদ করি। পরিচয় হয় অনেক সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে। সন্ধ্যায় আড্ডা দিই ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে। লেখক-বন্ধু সাদ্দু, কবির, যুবারা একটা গান বাঁধে। কী যে আনন্দের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে সেই গান তারা গেয়ে শোনাত সবাইকে! মনটা ভরে উঠত।
‘মন ‍মানে না বৃষ্টি হলো এত/সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে/আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল/স্পর্শ করি জলের অধিকারে।’ গানটা শুনে বেশ আপ্লুত হই আমি। সাদ্দুর মুখেই জানতে পারি, এটি একটি কবিতা, কবি উৎপলকুমার বসুর। সে সময় না জানলেও আজ জানি, সেটা উৎপলের ‘নবধারাজলে’ কবিতার প্রথম অংশ।

সেই ভালো লাগা থাকে আমার অনেক দিন। এরপর দুর্গাবাড়ির বৈকালিক লাইব্রেরিতে বসে উৎপলকুমারের কবিতার ওপর একটা আলোচনা পড়ি ‘দেশ’ পত্রিকায়। লিখেছিলেন কবি জয় গোস্বামী। সেই অনন্যসাধারণ আলোচনাটি দারুণভাবে নাড়া দেয় ‍আমাকে। একে একে আবিষ্কার করি উৎপল বসুকে।

সেই লেখার একটি কবিতা এখনো আমি মনে মনে পাঠ করি : ‘বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা—বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।’ কবিতাটি উৎপলকুমারের ‘সলমা-জরির কাজ’ বইয়ের সপ্তম ক্রম কবিতা।

ময়মনসিংহের মতো ছোট্ট শহরে বসে উৎপলকুমার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা সহজ ছিল না। তবে মনের ভেতর উৎপল ছিল। তাঁর কবিতা ছিল। আমায় ভাবাত। ২০০৫ সালে ঢাকায় পুরোপুরি চলে আসার পর সে কী সংগ্রামী জীবন আমার! চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে মফস্বলের ঘ্রাণে ভরা এই আমি তখন কংক্রিটের নগরীর চাপায় পিষ্টপ্রায়। তবে লেখার ইচ্ছেটা হাত ফসকে যায়নি কখনো। ঢাকায় এসে নতুন করে অনেককেই পাই সাহিত্য-বন্ধু হিসেবে।

এদের অনেকেই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে লেখায়, পড়ায়, চিন্তা-চেতনায়। আমি তাদের সঙ্গে দৌড়ে পারি না। তবে বুকের ভেতর লালিত স্বপ্নের জোরেই নিজেকে জ্যামিতিক হারে খাটাতে থাকি। উৎপলকুমার তখনও ভেতরে বুদবুদ দিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। পড়া হয় তাঁর অনেক কবিতা। জানা হয়ে যায় তাঁকে নিয়ে অনেক জানা-অজানা কথা।
এবার একটু ইতিহাসের কাছ থেকে ধার নিই কিছু তথ্য। সময়টা ১৯৬১, বাংলা সাহিত্যের অবস্থা প্রায় অনেকটাই স্থবির। সেই স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে আন্দোলনের ডাক দেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়সহ আরো কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক।

ইশতেহারগুলোর মধ্যে ছিল কবিতা-বিষয়ক প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেম্বর ১৯৬১), মুক্তি-বিষয়ক ১৪-বিন্দু ইশতাহার (১৯৬২), রাজনীতি-বিষয়ক ইশতাহার (১৯৬৩)। যা পরিচিত ‘হাংরি মুভমেন্ট’ বা ‘হাংরি আন্দোলন’ নামে। অনেকে যাকে বলেন ‘হাংরিয়ালিস্ট’, ‘ক্ষুধিত’, ‘ক্ষুৎকাতর’, ‘ক্ষুধার্ত আন্দোলন’।
‘আর্তি’ বা ‘কাতরতা’ শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারবে না বলে আন্দোলনকারীরা শেষতক গ্রহণ করেন ‘হাংরি’ শব্দটি।

আন্দোলনকারীরা ‘হাংরি’ শব্দটি সংগ্রহ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে। আর তাত্ত্বিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থটির দর্শন থেকে।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে সূত্রপাত হয় হাংরি আন্দোলনের। শুরুর দিকে আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক গভীর হলেও ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায়। নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।

১৯৬২-৬৩ সালে এই হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফাল্গুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

এরপর ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা। সেগুলো হলো : সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ‘ফুঃ’, সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত ‘এষণা’, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি ‘দ্য ওয়েস্ট পেপার’।

সত্তর দশকের শেষ দিকে আন্দোলনটিকে পুনরায় জীবিত করার যখন অসফল প্রয়াস করা হয়েছিল, তখন অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন ‘জিরাফ’, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন ‘আর্তনাদ’; এবং অন্যান্যরা প্রকাশ করেন ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’, ‘ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ’, ‘রোবট’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’ ইত্যাদি পত্রিকা।

১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য ও সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়।

মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। মোকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু যোগমায়াদেবী কলেজের প্রভাষকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, বিশ্বভারতী থেকে রাসটিকেট হন প্রদীপ চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে বদলি করে দেওয়া হয় কলকাতার বাইরে, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান।

এ সময় অনেকে ভয়ে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে চলে যান। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেস্টিগেটিং বোর্ড, যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারাল।

গ্রেপ্তারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ডভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পাণ্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল, তা আর তাঁরা ফেরত পাননি কোনো কবিই।

হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত পাটনা থেকে এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। কখনো বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তাঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতেহার লেখা ছাড়াও কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করতেন।

হ্যান্ডবিলের মতো বুলেটিনগুলো তাঁরা বিতরণ করতেন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদি জায়গায়। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এটিই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতো প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নিজেরাই, কেননা অধিকাংশ বুলেটিন সংগ্রাহকের পক্ষেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

উৎপলকুমারের মৃত্যুর পর (৩ অক্টোবর) মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখেন : ‘হাংরি বুলেটিনে কবিতা লেখার অপরাধে যোগমায়াদেবী কলেজের লেকচারারের চাকরি থেকে ১৯৬৪ সালে বরখাস্ত হয়েছিলেন উৎপলকুমার বসু।’ পরের দিন (৪ অক্টোবর) তিনি আরো লিখছেন : ‘হাংরি মামলায় উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে কেন যে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত জানা হলো না; উত্তরে ওনার নির্বাক গাম্ভীর্যকেও ডিকোড করতে পারিনি।’

এই রাজসাক্ষী দেওয়ার পর ১৯৬৫ সালে অভিমানাহত উৎপল বসবাস আরম্ভ করেন লন্ডনে গিয়ে। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বিয়ে করেন এবং কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। সেখানে দীর্ঘ সময় কাটান তিনি। ১৯৭৭ সালে ২৩ জানুয়ারি বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীকে (মলয় রায়চৌধুরীর বড় ভাই) লেখা একটি চিঠি পেলাম কিছুদিন আগে। সেই চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, কী অস্থির ও ফেরারি জীবন পার করেছেন উৎপল বসু।

উৎপলকুমার বসু
২৩/১/১৯৭৭
লন্ডন

প্রিয় সমীর
তোমার চিঠি পেলাম। আরো অনেককে বাড়ির ব্যাপারে লিখেছি। তোমার কাছ থেকেই প্রথম আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া গেল। তুমি অবিলম্বে তোমার বাঁশদ্রোণীর বাড়ির ঠিকানা আমাকে জানিও। সান্ত্বনার দিদি টালিগঞ্জে থাকেন। তিনি ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এসি বিদ্যুৎ কি না অবশ্যই জানিও।
আমরা লন্ডন থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বা মার্চ মাসে কলকাতায় পৌঁছব। প্রথম দু'এক দিন হয়তো সান্ত্বনার দিদির বাড়িতে কাটবে। তারপর থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের ঘরবাড়ির জিনিষপত্র জাহাজে কলকাতায় পৌঁছে যাবে আশা করা যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে এই সব জিনিস রওনা হচ্ছে। এখন তুমুল বেগে গোছানো এবং লিস্ট করা চলছে। বহুদিন এ দেশে থাকলাম... প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় প্রচুর জিনিসপত্র জমেছে। রাশীকৃত বই কাগজ হাঁড়ি-বাসন বাক্স-ট্রাঙ্কের জঙ্গলে বসে এই চিঠি লিখছি।
আজ এই পর্যন্ত। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হবে নিশ্চই।
ইতি
উৎপল

১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকেই উৎপল অনন্য, অনুনকরণীয়৷ তাঁর কবিতার ডিকশন, আলো-আঁধারি ভাষা তাঁকে জীবনানন্দ-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে চিরস্মরণীয় করে রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজের কবিতার ভাষাকে ক্রমাগত ভাঙচুর করতে করতে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক ম্যাজিক-উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছতে পিঠে এক ব্যাগ অতি-প্রাকৃতিক মন্তাজ ও মাথায় এক আকাশ নক্ষত্র প্রয়োজন।
তবুও তাঁর কবিতাকে ‘দুর্বোধ্য’ বলা যাবে না, বরং বলা যায় উৎপলকুমারের কবিতা এক আশ্চর্য ছায়াময়তা, রহস্য-ইশারায় গভীরভাবে ছুঁয়ে এসেছে বাংলা কবিতার পাঠককুলকে৷ ‘পুরী সিরিজ’ কিংবা ‘আবার পুরী সিরিজ’-এর বিখ্যাত ‘ট্রাভেল পোয়েট্রি’ বাংলা কবিতার পাঠককে প্রথম পরিচয় করায় অদ্ভুত এক ‘পোস্টমডার্ন কনশাসনেস’-এর সঙ্গে, যেখানে ভ্রাম্যমাণ বোহেমিয়ানা গিয়ে মেশে সমুদ্রের সীমাহীনতায়, ঢেউ, সিগারেট, বালি, সিগাল—সব ছুঁয়ে যেখানে মহাজীবনের করিডোরে হেঁটে চলে আমাদের পুরোনো হাসি, ভেসে যায় ছেঁড়া চিরকুটে লেখা কবেকার নাম৷
ভূতত্ত্ববিদ উৎপল ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবীতে, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ইস্তেফা দিয়েছেন কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে, ভাগ্যান্বেষণে চলে গিয়েছেন ইউরোপে, ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজেকে জড়িয়েছেন সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে। তাঁর কবিতায় আমরা তাই পাই এক ধরনের ব্যাপ্তি, যা সমাজ, কাঁটাতার, জাগতিক সবকিছু ছাড়িয়ে ছুঁয়ে নেয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সেই অনন্ত চলাচলের সেতুকে। যেখানে সত্যি বলতে কি, খুব কম কবিই এ পর্যন্ত পা রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

১৯৩৭ সালে কলকাতার ভবানীপুরে জন্ম উৎপলকুমার বসুর। ৫০’র দশকে যাত্রা শুরু তাঁর। ১৯৫৬ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘কৃত্তিবাস’ থেকে প্রকাশ করেন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কাব্যশৈলী, অভিব্যক্তি এবং কবিতার কাঠামো দিয়েই অচিরেই পাঠক মনে জায়গা করে নেন।

১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটতেই তাতে যোগ দেন তিনি,এবং তাঁর কবিতা রচনার ধারায় ঘটে বাঁকবদল। দুই দশক পর আশির দশকের দিকে কলকাতায় ফিরে আবার কবিতা লেখা শুরু করেন উৎপলকুমার। তাঁর সমসাময়িক, এমনকি তরুণতর কবিদের তুলনায় তাঁর কবিতা ছিল সম্পূর্ণ নূতন। নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তুস্বভাবের যথাযথ বর্ণনা তাঁর কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য। বস্তুর অভ্যন্তর সত্যের অভিমুখে কবিতাকে চালনা করেছেন উৎপল বসু। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবন-প্রকৃতি কোনো রহস্যভূমি রচনা না করেই তাঁর কবিতাতে মেলে ধরেন চলমান সমাজবাস্তবতা।

একাধিকবার এই সৈকতে এসে
বলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছু
কলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,
শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসে
                        পড়েছে সাগরজলে।

স্তব্ধতা থেকে কোলাহলে
আবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকে
পাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীন
পতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে—
                চলেছি সকলে।

এই মদ কীভাবে করব পান—
বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?
ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলি
ঘুমন্ত খ্রিষ্টগাছে ফুটেছিল—
কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?
(কহবতীর নাচ)

বহুলব্যবহৃত শব্দগুলোকে উৎপলকুমার কবিতার শরীরে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যে, এর ফলে তৈরি হয়েছে বাক্যের নতুন মাত্রা। অনেকে অবশ্য বলেন তাঁর কবিতা 'আকারসর্বস্ব'। বর্তমান সময়ের মধ্যে ঢুকে বসে থাকা ছিল তার একটা স্বভাব, শব্দের পিঠে হাত বুলিয়ে বসে এনে একে একে তৈরি করেছেন নতুন মাত্রা। নতুনত্ব নিয়ে বেঁচে ছিলেন যতদিন তার চেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। তাঁর কবিতার কয়েকটি লাইন এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যাক :
গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকে
আঁটি ছুঁড়ে মারি। নীচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।
মাঝে মাঝে বাউল সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধহয় ছবিও তুলেছে। সেদিন
এক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনই
আমার বাণী। কিন্তু সম্ভবত এটি বলা হয়ে গেছে। অতএব
নিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা আপন মনে বিড় বিড় করি—
‘দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি।’ (সুখ-দুঃখের সাথী-১৫)
তাঁর পুরী সিরিজ (সন্ধ্যাভাষা প্রেস, ১৯৬৪), আবার পুরী সিরিজ (বিশ্ববাণী, ১৯৭৮), লোচনদাস কারিগর (প্রতিবিম্ব, ১৯৮২), খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন (প্রতিবিম্ব, ১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (প্রতিভাস, ১৯৯১), নরখাদক (দেশবাণী, ১৯৭০), ধূসর আতাগাছ (কৌরব, ১৯৯৪), সলমা-জরির কাজ (কবিতা পাক্ষিক, ১৯৯৫), অগ্রন্থিত কবিতা (কবিতাসংগ্রহ প্রথম সংস্করণ), কবিতা সংগ্রহ (দে’জ, ১৯৯৬), কহবতীর নাচ (প্রচ্ছায়া, ১৯৯৭), স্বনির্বাচিত কবিতা (মডেল, ১৯৯৮), উৎপলকুমার বসুর গল্প (প্রতিবিম্ব, ১৯৯৮), নাইট স্কুল (গান্ধার, ১৯৯৯), টুসু আমার চিন্তামণি (কবিতা পাক্ষিক, ২০০২), মীনযুদ্ধ (দাহপত্র, ২০০১), নতুন কবিতা (সৃষ্টি, ২০০২), প্রেমের কবিতা (পত্রলেখা, ২০০২), বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে (কবীর, ২০০৪), গদ্য সংগ্রহ-১ (নান্দীমুখ সংসদ, ২০০৫) তীর ও উদ্যান (কবিকথা, ২০০৬), সুখ-দুঃখের সাথী (সপ্তর্ষি, ২০০৬), কথাবার্তা (সপ্তর্ষি, ২০০৬) প্রভৃতি গ্রন্থ নানাভাবে প্রভাবিত করে পাঠক মনকে।
২০০৬ সালে ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন আনন্দ পুরস্কার। ২০১৪ সালে তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

বাংলার প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি, এই মাটি ও মানুষের প্রতি উৎপলকুমার কতখানি ব্যাকুল ছিলেন তা তাঁর ‘আমার কষ্টকথা, স্বপ্নকথা’ লেখাটি পড়লে স্পষ্ট অনুধাবন হয় :

“আমি যদিও কলকাতায় জন্মেছি, কিন্তু ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় আমার মাসি উত্তরবঙ্গের দিনহাটায় নিয়ে গিয়ে প্রতিপালন করেন। তাই আমার ছোটবেলার প্রথম অংশ কেটেছে ওই দিনহাটায়, কুচবিহারে। আমাদের এই দিনহাটা দেশবিভাগের সময় পূর্ব-পাকিস্তানে পড়বে, নাকি ভারতের সঙ্গে থাকবে, তা নিয়ে একটা চাপা আতঙ্ক ছিল। এটা যে কী ভয়ংকর জিনিস করে দিয়ে গেছে! এটা হচ্ছে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক রাজনীতির একটা কূটচাল; এবং আমরা সব সময়ই সাহেবদের কাছে মাথা নীচু করে আসছি। গান্ধীজি তো ১৫ আগস্টের স্বাধীনতার সময় পতাকা উত্তোলনে যোগদানই করেননি। তার আগের দিন পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে, কলকাতায় যেখানে-সেখানে দাঙ্গা! সে যে কী নৃশংস সময়! রাজনীতিবিদদের যা চরিত্র দেখেছি তাতে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা তলানিতে চলে গেছিল। স্বচক্ষে বা সামনাসামনি কোনো দাঙ্গা দেখিনি, তবে রাস্তায় ডেডবডি পড়ে আছে—এমন দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছি। নানা কারণে বাংলাদেশ নিয়ে আমি ভীষণ উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশ হলো আমার অতি প্রিয় স্বপ্ন-বিহ্বল দেশ। এর ভাষা, প্রকৃতি আমি যতটুকু দেখেছি তা অতি মনোমুঙ্কর। সে জন্য আমি দু'বছর আগে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন এয়ারে না গিয়ে বাসরুট বেছে নিয়েছিলাম। জানালার পাশে বসে বাংলাদেশকে যা দেখলাম, সেটা আমার ছেলেবেলায় দেখা নর্থ বেঙ্গলেরই প্রকৃতি। আমাদের দিনহাটার কাছেই লালমনিরহাট বলে একটা জায়গা ছিল। ছোটবেলায় আমরা দিনহাটা থেকে ট্রেন ধরে লালমনিরহাটে গিয়েছি, আবার ফিরে আসতাম। দিনহাটায় আমাদের বাড়ির পেছনে এক উকিল সাহেবের বাড়ি ছিল, তাঁর ছেলে পরবর্তী সমেয় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি এরশাদ। ডাকনাম পেয়ারা। আমরা পেয়ারা'দা বলে ডাকতাম, আমাদের দাদার মতো ছিলেন আর কী। তিনি, বলা যায়, আমাদের একজন লিডার ছিলেন। পেয়ারাদা আর কমল গুহ (পরবর্তীকালে কমলদা পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হয়েছিলেন) এঁদের দুজনের ভেতরে খুব বন্ধুত্ব ছিল। এঁরা ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে পিয়ার গ্রুপ। বাংলাদেশটাকে কখনই আমি অন্য দেশ বলে ভাবতে পারি না। হঠাৎ রাতারাতি একটা লাইন টেনে দিয়ে বলা হলো, এ ধারে আসবে না, ধারে যাবে না—এটা আমি কোনোদিন মানতে পারিনি। ইংরেজদের বদমায়েশির তুলনা নেই। এবং তাদের কিছু কিছু বদমায়েশি এখন আমেরিকা করছে। দেশ ছেড়ে যাব, যাব; কিন্তু তার আগে দেশটার সর্বনাশ করে দিয়ে যাব—এই হচ্ছে এদের মতলব। সবদিক থেকে। অর্থনীতির দিক থেকে, মানবিক দিক থেকে, সংস্কৃতিক দিক থেকে। কীভাবে যে এরা এখন ইরাকে ধ্বংস করছে! আফগানিস্তানে ধ্বংস করছে, গাজায় ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। এককথায়, এরাই প্রকৃত ক্রিমিনাল। ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে এদেরই প্রথম বিচার হওয়া উচিত। আমার হাতে যদি জাদুর কাঠি থাকত, তাহলে প্রথমেই এই সীমারেখা মুছে দিতাম। ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ রেখা মুছে দিতাম। আমাদের এই অঞ্চলটা হলো পূর্ব-ভারত। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ এসব বলে কিছু ছিল না। এখান থেকে দুটো বিরাট ধর্মের উৎপত্তি; তার একটা হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম, অন্যটা জৈন ধর্ম। এবং তার সঙ্গে যদি বৈষ্ণম ধর্ম ধরি তা হলে দেখা যাচ্ছে তিনটে ধর্মের উৎপত্তি এই পূর্ব-ভারত থেকে। এবং এই একেকটা ধর্মের উৎপত্তি তো সহজ কথা নয়। বহু তর্ক-বিতর্কের পর একটা ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা আসলে 'আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান'—তর্কপ্রিয় বাঙালি। আমরা দৈহিক নির্যাতন, নরহত্যা, জিঘাংসা, নৃশংসতায় বিশ্বাসী না, পছন্দ করি না, এটা আমরা হাজার হাজার বছর ধরে চর্চা করে আসছি। দেশভাগের অর্থই হচ্ছে এসব সৃষ্টি সৌন্দর্যের ব্যাপারগুলো যেন হারিয়ে যায়! আমার কখনোই কোনোদিন নিজেকে কোনো ধর্মের বলে মনে হয়নি। তখনো না, এখনো না। আমি নিঃশঙ্ক মধ্য আরবে ঘুরেছি এবং আমার প্রবাসী জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকেই মধ্য আরবের। আমার বাড়িতে ইসমাইল কাজী নামের একজন নিয়মিত আসতেন, তাকে আমি পিতৃতুল্য জ্ঞান করতাম। আমার ছেলে হওয়ার পর তিনি তার নাম দেন 'ফিরোজ'। তারপর উনি আমাকে জানান- এই নাম নিয়ে ইন্ডিয়াতে গেলে আপনি কিন্তু বিপদে পড়ে যাবেন। আমি বললাম, আমি যতই বিপদে পড়ি না কেন, আপনি যেহেতু নাম রেখেছেন তাই এই ফিরোজ নামের কোনো পরিবর্তন হবে না। আমার ছেলে এখন একটা কলেজে পড়ায়, সেই থেকে ফিরোজ নামেই পরিচিত। আমার ছেলেকে তার নাম আর 'বসু' টাইটেল দেখে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেছে—তার মা-বাবার ভেতরে কেউ মহামেডান (মুসলিম) কি না! আমি পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরেছি, থেকেছি—কিন্তু কখনোই ধর্মের কারণে বিপন্ন বোধ করিনি।”
গত ৩ অক্টোবর থেমে গেল হাংরি জেনারেশনের এই কবির কলম। কয়েক দিনের অসুস্থতা শেষে ওই দিন দুপুরে জীবনাবসান হয় মিতভাষী এই কবির। বয়স হয়েছিল তাঁর ৭৮ বছর। পরিবার সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, কয়েক দিন আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন উৎপল। দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলেন তিনি। ওই ক্লিনিকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। কবির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও নীরব অশ্রুপাত।

বারবার আজ মনে পড়ছে ‘সলমা-জরির কাজ’ কবিতাগ্রন্থের সেই কবিতাটি...
শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়
                নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওষুধে সারে না?
ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে এ-বছর কী দেখব কে জানে—
                যে-পাথরে আমরা সবাই নাম লিখিয়েছিলাম সেটি হয়ত
                        নীচে গড়িয়ে পড়ে গেছে,
        যে-জলস্রোত লাফিয়ে পার হয়েছিলাম তাকে ঘুরিয়ে
চাষজমির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল—
        যদি তাই হয়ে থাকে তবে আর তাকে আমি খুঁজে পাবো না,
এইসব ভাবি আর হাসপাতালের বিছানা শুকনো ডালপালায়,
                ছেঁড়া কাগজে আর পরিত্যক্ত সাপের খোলসে ভরে ওঠে—
এত জঞ্জাল সরাবে কে? আমি কি সময় করে উঠতে পারবো?
        আমি তো ফুলডুঙরি পাহাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি।
                        চেপারামের ঘরটা
                এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আরেকটু পা চালিয়ে
                        উঠে গেলেই হয়।

Friday, August 17, 2018

কথাকলি দত্ত : ইতিহাসের বিকৃতি

কথাকলি দত্ত : ইতিহাসের বিকৃতি
হাংরি জেনারেশন রচনা সংগ্রহ যখন দে’জ এর মতন নামী প্রকাশন সংস্হা প্রকাশ করে, তখন মনে ফুর্তি হয় । তাই বইটি তড়িঘড়ি সম্পাদকের কাছ থেকে সংগ্রহ করি । সম্পাদক সব্যসাচী সেনকে আমি জানি না । প্রথমে ভেবেছিলাম, ঘ্যাম কেউ হবেন বোধহয়, খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম, না না, তেমন কেউ নন, শৈলেশ্বর ঘোষের চামচা । শঙ্খ ঘোষ অবধি এখনও পৌঁছোতে পারেনি বেচারা, চেষ্টা যদিও আছে খুবই, তবে শঙ্খর চামচা অভীক মজুমদারের কাছ অবধি পৌঁছে গেছে । যদি ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে । কথা হচ্ছে হাংরিদের নিয়ে -- এর মধ্যে আবার শঙ্খ ঘোষ এলেন কোথ্থেকে ! অভীক ভাইটি, সব্যসাচীর ভাইপোটি, শঙ্খ ঘোষকে আমি আনিনি -- এনেছ তোমরা -- বইয়ের শুরুতে । যে মাঝারি মাপের কবিটি লম্বা জিব বের করে সারা জীবন আনন্দবাজারের পা চেটে-চেটে কবিগুরু হলেন, তিনি নাকি হাংরি ! সোনার পাথরবাটি ! কাঁঠালের আমসত্ব ! তাঁর খিদে তো অন্য ভাই অভীক, ভাইপো সব্যসাচী ।

এখন ৬৭০ পাতার বই তোমাদের প্রকাশ করতে হল শুধু শঙ্খর নির্দেশে, শৈলেশ্বরকে হিরো বানাতে এবং হাংরি স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীকে হেয় করতে ! বেচারা ! ইতিহাস চক-ডাস্টার নয় যা চাইলেই মুছে দেওয়া যায় ।

যে যাই বলুক, হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন । তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই হয়তো ছিলেন, কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী এই আন্দোলনের জনক । 

অভিভাবকবাবুরা কথা ঘোরাতে চাইলেও সত্যিটা সত্যই থাকবে । মলয়ের নেতৃত্বে ১১ টি প্রস্তাবের ইশতাহার বের করেছিল আন্দোলনকারীরা । একটা টকে যাওয়া ও পচে যাওয়া সময়ের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিবাদ ।

( ৩৬৫ দিন পত্রিকায় প্রকাশিত, দে’জ-এর সব্যসাচী সেন সম্পাদিত ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংগ্রহ’ গ্রন্হের রিভিউ)

 

Thursday, August 16, 2018

শ্রীমন্তী সেনগুপ্ত : হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্যপ্রতিভা


 
                                                                           
                                                                   Sreemanti Sengupta
এই রচনাটি আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমত, এটা এক ধরণের ফিরে আসা — আমি শব্দহীনতার মানসিক অবসাদে দীর্ঘকাল ভুগছিলাম, যখন আমার মনে হলো যে এর থেকে নিষ্ক্রমণের সহজ উপায় হবে কমপিউটারের কিবোর্ডে আঙুল রেখে টকাটক টাইপ করে যাওয়া । দ্বিতীয়ত, এই রচনাটি উৎসর্গ করেছি একজন ডিস্টার্বিং কবির প্রতি, এমন একজন যাঁর গভীরতায় প্রবেশ করার সাহস নেই আমার । এখানে আমি যা কিছু লিখব তা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আমার বোধবুদ্ধির অতীত, যিনি বাংলা ভাষার কবি, স্কলার, ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের জনক । তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ষাটের দশকের পশ্চিমবঙ্গে সক্রোধে আবির্ভুত হলেন, বাঙালির পচনরত সমাজকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে ।

আমি ইংরেজি উইকিপেডিয়া থেকে অনুবাদ করে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি :-

“হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন  মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী (মলয়ের বড় ভাই), শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারধন ধাড়া (ওরফে দেবী রায়)  আরম্ভ করেছিলেন । পরে ত্রিশের বেশি কবি এবং শিল্পীরা তে তাঁদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, ফাল্গুনী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, রবীন্দ্র গুহ এবং অনিল করঞ্জাই।

“হারি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরীর ভূমিকা তুলনীয় স্টিফেন মালর্মের সিমবলিজম , এজরা পাউণ্ডের ইমজিজম, আঁদ্রে ব্রেতঁর পরাবাস্তববাদ, এবং অ্যালেন গিন্সবার্গের বিট আন্দোলনের সঙ্গে। হাংরি আন্দোলন এখন ইংরাজিতে Hungryalism বা “ক্ষুধার্ত প্রজন্ম” নামে পরিচিত। হাংরি শব্দটি  জিওফ্রে চসারের “ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম” থেকে নেয়া হয়েছে; দর্শনটি ওসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের “দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট”-এর ওপর ভিত্তি করে । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন ইংরেজিতে মলয় রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত হয় । তবে আন্দোলনটি ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে যায় । এরপর মলয় রায়চৌধুরী কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, নাটক, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন, যে ব্যাপারগুলো বাঙালি সমাজকে ভোগান্তির শেষ প্রান্তে এনেছে ।”

“ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ইংরেজী শিক্ষক হাওয়ার্ড ম্যাককোর্ড এবং পরে বাওলিং গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক, যিনি কলকাতা সফরের সময় মলয় রায়চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, তিনি ফেরলিংঘেটি-সম্পাদিত ‘সিটি লাইাইটস জার্নাল’ ৩-এ এই বিষয়ে লিখেছিলেন : “ষাটের  দশকের শুরুতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে হাংরি জেনারেশনের সাংস্কৃতিক সংগঠনের আক্রমণের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হলেম মলয় রায়চৌধুরী”। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, “এসিড, ধ্বংসাত্মক, ক্ষতিকারক, নির্বিচার, অসম্মানজনক, ক্ষুব্ধ, আক্রমণাত্মক, হতাশাব্যঞ্জক, – এই ভয়ঙ্কর এবং বিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে চিত্রিত করে”।

এ থেকে আপনি তাঁর জীবন ও সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন, অন্তত আমি যা বলতে পারব তার তুলনায় স্পষ্ট, কেননা প্রথমত, আমি অনুভবের তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস করি যাতে পাঠকের সংবেদনকে আক্রমণ করতে পারি, এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর সঙ্গে সাইবার জগতে আমার যোগাযোগকে  আমি এই রচনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ।

আমার অশেষ ভাগ্য যে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে, যাঁকে আমি মলয়দা বলে ডাকতে ভালোবাসি, তাঁর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল । এই ঘটনাটি ‘সোশাল নেটওয়র্কিঙের’ প্রতি আমার উদাসীন অবস্হানকে কিছুটা নমনীয় করেছে । মলয়দার রচনাবলীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ ঘটে একজন বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে, দুই বছর পুর্বে, যে ব্যাপারটিকে  আমি মনে করি এ-পর্যন্ত আমার জীবনে একটি বাঁকবদলের ঘটনা । যা আমাকে যৌক্তিকতার পাহাড়চূড়া থেকে মোহাচ্ছন্ন জ্ঞানের অতলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, এবং আমি ভয়ংকর পতন থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য একটা লতাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম । তাঁর প্রথম যে রচনাটির সঙ্গে আমি পরিচিত হলাম তা ইনটারনেটে পাওয়া ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটি । আমি কবিতাটির কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি, যা পড়ার পর আমি ব্লাশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং চোখ বুজে অনুভব করতে পারছিলাম যে এক গরম হল্কা আমার মাথার চুলের গোড়া থেকে বইতে আরম্ভ করেছে :-

তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি

এর আগে আমি এরকম কবিতা কখনও পড়িনি । আমি সবচেয়ে প্রথমে আসেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম যে বাড়ির গুরুজনরা কেউ আমার কমপিউটার স্ক্রিনে উঁকি মারছেন না তো ! আমার চোখ কুঁচকে উঠল আর মণি দুটো ঘন হয়ে এলো, যেমন-যেমন আমি কবিতার ছবিগুলো মস্তিষ্কে স্পষ্ট করে তুলতে লাগলাম, তেমন তেমন ঘটতে লাগলো এগুলো ।

“এই লোকটা কী লিখছে রে বাবা ! লোকটা তো উন্মাদ আস্ফালন করছে !”  আর তারপর বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আমি আমার স্হিতির সঙ্গে আপোষ করে বুঝতে পারলাম যে কবিতাটা আমাকে মর্মপীড়ায় অভিভূত করেছে, কয়েকটা লাইন আমাকে ধর্ষণ করেছে । আমি একা ছিলাম না । অশ্লীল রচনার দায়ে মলয়দাকে আদালতে মামলার দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছিল, আর সেই মামলায় বাংলা কবিতার কয়েকজন নামিদামি মানুষ তাঁর বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

প্রায় এক সপ্তাহের ঘুমহীন দাহময় দুপুরের পর, আমি কবিতাটায় ফিরে-ফিরে যেতে লাগলাম, বয়ঃসন্ধির সেই বালিকার মতন যে সদ্য নিজের দেহের রহস্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে । বিপরীত সেক্সের মানুষকে ছোঁবার জান্তব প্রবৃত্তি, দেহকে লুটেনেবার আগ্রহ, আরন্যক আকাঙ্খায় পাগল হয়ে ওঠার উপক্রম হলো । মলয়দার ভাষার ক্ষমতা আমাকে চিরকালের জন্য যেন অসাড় করে দিয়েছিল । আর তারপর হঠাৎই ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে দেখা, আর আমাকে ঘিরে ধরল এক অদ্ভুত ভয় । স্পষ্ট কথায়, আমি এই ধরণের মানুষদের সম্পর্কে ভীষণ আতঙ্কিত ।  একদল শিল্পী আছেন যাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মের প্রতি অত্যন্ত সমর্পিত । এই এলাকায় যাঁদের পাওয়া যাবে তাঁরা হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ, অ্যামি ওয়াইনহাউজ, কুর্ট কোবেইন এবং আরও অনেক চরমপন্হী-শিল্পী ; তাঁদের জন্য শব্দবন্ধটা আমিই তৈরি করেছি । তাঁরা বিপরীত সেক্সের মানুষদের দুর্নিবার আকর্ষণ করেন, তাঁরা নিজেদের সময় ও শিল্পের সঙ্গে চূড়ান্ত ও বিপজ্জনকভাবে জড়িয়ে পড়েন । পাবলো পিকাসোকে অনেক সময়ে গ্রিক পুরাণের অর্ধেক-মানব ও অর্ধেক দানব মিনোটরের সঙ্গে তুলনা করা হয় । মিনোটরের মতো তিনি চাইতেন যে নারীদের তাঁর সামনে বলি দেয়া হোক, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলী থেকে যা প্রমাণিত, যেসব ঘটনা পিছনে ফেলে গেছে ধারাবাহিকভাবে  যন্ত্রণাগ্রস্ত স্ত্রীদের, রক্ষিতাদের ও সন্তানদের ।

মলয়দা আমাকে একবার বলেছিলেন যে তাঁর চেয়ে বয়সে কুড়ি বছর ছোটো একজন তরুণী তাঁকে থ্রেটেন করেছিলেন যে যদি মলয়দা তাঁকে বিয়ে না করেন তাহলে আত্মহত্যা করবেন । তরুণীটি নিজের কথা রেখেছিলেন । টয়লেটের অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ।

আমি লুকিয়ে মলয়দার সাইবার জগতে প্রবেশ করেছিলাম, অত্যন্ত সাবধানে, ছায়ার মতো সশ্রদ্ধ প্রশংসকরূপে, যাতে আমি নিজে না উন্মাদনার বিপদে আক্রান্ত হই, কিন্তু আমি তাতে সফল হইনি । শেষ পর্যন্ত একদিন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ তোমার কবিতায় যৌনতার এরকম খোলাখুলি প্রয়োগের ভূমিকা কি ?”

মলয়দার অবাক-করা উত্তরে ছিল সাহসিক প্রশান্তি : “ভাষার  লোভনীয় শরীরের সঙ্গে সঙ্গম করলে কবিতার জন্ম হয় ।”

শুনে, আবার আমি শব্দহীনতায় থতমত খেলাম । আমি ইনটারনেটে মলয়দার লেখাগুলোতে ঢুঁ মারতে লাগলাম ( সবই ‘ব্লগস উইথ জবস’ ট্যাগ করা ) , পাঠকের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় তারা কবিতাগুলোকে অশ্লীল তকমা দিয়েছে । মলয়দা তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “অশ্লীলতা বলতে ঠিক কী বোঝায়? শুনতে ভালো লাগে এরকম শব্দে সাজানো রোমান্টিক ছবিকেই কি কবিতা বলা হবে ? তোমরা বরং পড়া অভ্যাস করো, তাহলে ঠাহর করতে পারবে ।”
মলয়দার বিষয়ে ভাবলে আমার মনে পড়ে কমলা দাস-এর কথা, আরেকজন একমাত্র কবি যার প্রভাব আমার ওপরে একই রকম হয়েছিল । তিনিও, পাঠকের গ্রহণ করার শেকল ভেঙে নিজের কন্ঠস্বরকে কবিতায় জায়গা দিয়েছেন । এই ধরণের মানুষের কাছে কবিতা হলো তাঁদের অস্তিত্বের প্রসারণ । ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, আমি অন্তত তাই মনে করি, যেমন বন্ধুদের সম্পর্কে কুৎসা করা, অফিসের বসের সম্পর্কে গজগজ করা, দাঁত মাজা, কিংবা পেচ্ছাপ করার মতন ।

এই ধরণের মানুষরা অন্যের খারাপ লাগতে পারে ভেবে নিজের কাজকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে পারেন না, এই ভেবে যে তা করলে জনপ্রিয় হওয়া যাবে । তাঁরা বেশ বিপজ্জনক, অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’-এর আম্মুর মতন, তাঁদের থাকে চূড়ান্ত উন্মাদনা, দায়িত্বহীন এনার্জি, যেমন ভাই আর বোনের প্রেম, প্রেমের সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারা ।

আমি এখন মলয়দার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ পড়ছি । তাঁর কটু শৈশবের উষ্ণ স্মৃতিচারণা, মতামতে সমঝোতাহীন, অবাক-করা সততা এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে ও বক্রোক্তিতে পরিপূর্ণ । মলয়দার শৈশব কেটেছিল প্রাক-স্বাধীন ভারতের  বিহার রাজ্যের পাটনা শহরের এক এঁদো পাড়ায় । বালক মলয়ের চোখ দিয়ে দেখা জগতকে তিনি তুলে ধরেছেন, এবং অনেক সময়ে বর্তমানের জ্ঞানী, চোটখাওয়া লেখকের দয়াহীন সততায় গড়ে তুলেছেন ন্যারেটিভ । তাঁদের পরিবার, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশ, মিথ্যা কুসংস্কার ও অতীত গৌরবে আক্রান্ত, অসহ্য দারিদ্রের মাঝে মাথা চাড়া দিয়েছিল । মলয় দারিদ্রের কথা বলেন, প্রথম দেখা এক উলঙ্গ বিধবার কথা, দুইজন বোবা দর্জি যারা তাঁদের বাড়ির সকলের পোশাক সেলাই করত, পায়খানা থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত নিয়মপালন, পাটনা মিউজিয়ামের কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার তাঁর বড়োজেঠার সঙ্গে সেখানে গিয়ে দর্শনার্থীরা কেমন গ্রিক মূর্তির লিঙ্গে হাত দিচ্ছে তা এক বালকের বিস্ময়ে যে  ঢেউ তোলে তার বর্ণনা ।

বইটা থেকে পাঠক পাবেন অনেককিছু,  যা চাই তাই, সবকিছু, যখন কিনা প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু হয় মলয়দার পনেরো বছরের জাঠতুতো ভাই বাড়িতে একজন বেশ্যাকে এনে বিদায় দেবার সময়ে মাঝরাতে ধরা পড়ার ঘটনা । কম বললেও একথা বলতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরী একজন ডিস্টার্বিং লেখক । অনেক সময়ে আমি ওনার গড়ে তোলা দৃশ্যাবলী ও ঘটনায় প্রতিহত হই, এমনকি বিবমিষায় আক্রান্ত হই । কখনও বা মনে হয় তাঁর কবিতা যেন ফাঁদ পেতে রাখে, মর্মার্থহীন গোঁসায় ঠাশা, নঙর্থক এবং উত্তেজনাপূর্ণ । তারপর আমি ফিরে আসি সন্ধ্যার প্রশান্তিতে এবং সবকিছু আবার নিজের জায়গায় স্হান করে নেয় — সময়, ক্রোধ, মানুষের অবস্হার প্রতি অবিশ্বাস ।

সত্তর বছর বয়সের এই মানুষটার সঙ্গে কথা বলার সময়ে আমি ক্রুদ্ধ এবং নিজেকে ব্যর্থ অনুভব করি, যে লোকটা অবসর নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মুম্বাইতে থাকে । লোকটার এতো বুকের পাটা হলো কেমন করে যে বিস্ময়করভাবে নিজের সততা প্রকাশ করে ? কোন সে স্পর্ধার অনুমতি লোকটা পেয়েছে যে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে স্বাধীন । এই প্রশ্নগুলো মলয়দাকে করলে আমি ওনার দেয়া উত্তরে নিঃশব্দ হাসি শুনতে পাই:-

“তুই কি কখনও ভেবে দেখেছিস তোর জীবনে কে এমন হতে পারে যাকে তুই একই সঙ্গে ভালোবাসিস আর ঘৃণা করিস ? আমি সেই ধরণের ক্ষতিকর জীব যে আক্রান্ত হওয়াকে উপভোগ করে ! তুই কি লক্ষ্য করেছিস যে আলফা পুরুষ জানোয়ার তার বিপক্ষকে হারাবার জন্য মাথাকে ব্যবহার করে ? বাইসন, জিরাফ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার, কুমির, যেকোনো ক্ষমতাবান জানোয়ার । আমি সেই ধরণের জানোয়ারদের মতন অস্তিত্ব বজায় রাখি, যারা একটা দলের নেতৃত্ব দেয় । যেমন সিংহ । সিংহের মতন আমি একাকীত্ব পছন্দ করি । লেখার জন্য আমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করি । পাঠক তো অপ্রাসঙ্গিক । ভাষাই হলো প্রেমিকা, যাকে আমি ভালোবাসি।”

আর ব্যাস, মলয়দা নির্ণয় নিলেন যে সাম্প্রতিক কবিতাগুলোকে ‘আলফা মেল পোয়েট্রি’ নাম দেবেন । লোকটা এই রকমই, বিরক্তিকরভাবে সরল । ওনার হৃদয় আর হাতের মাঝে কোনো জেসটেশান পিরিয়ড নেই । ওনার অনুভূতি ও যন্ত্রণার মাঝে কেউ একজন কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে । আমরা যারা  ভেবেচিন্তে পা ফেলি তারা এই ধরণের ঔদ্ধত্য কেবল হাঁ করে দেখি । আমরা একে বলতে পারি ক্ষিপ্ত তারস্বর ; আমরা উত্যক্ত হয়ে পাতার পর পাতা বিতর্ক করতে পারি, ওনাকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখতে পারি, কিন্তু ওনাদের কলম কেড়ে নেবার ক্ষমতা, কষ্টযন্ত্রণা লাঘব করার ক্ষমতা, আমাদের নেই ।

একবার আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি কি সাধারণ সংসারি মানুষের মতন আচরণ করো ? বাজারে যাও, চায়ে দুধ ঢেলে চুমুক দাও ? ইত্যাদি ।”

উনি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন যে ওনার স্ত্রী বাজার ইত্যাদি করার দায়িত্ব নিয়েছেন, এবং উনি লিকার চা খান । আর খাদের কিনারায় বসবাসের চেয়ে সংসারি মানুষ হওয়া ঢের ভালো । আমার গভীর উদ্বেগকে এভাবে এড়িয়ে যাবার জন্য আমি ওনাকে ক্ষমা করতে পারিনি । লোকটা কি সত্যিই বাস্তব ?

উনি একবার বলেছিলেন, “পিকাসো সম্পর্কে তোর লেখাটা পড়লুম । দারুণ । আমার সম্পর্কে এক পাতা লিখলেই তো পারিস, কেননা এখন আমার বইগুলো পড়ে ফেলেছিল । যা ইচ্ছে লিখবি ; আমার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করার দরকার নেই । আমি গণ্ডারের-চামড়া লেখক । তোর নিজের চিন্তাধারার ওপর ভালো দখল আছে । অতএব শুরু করে দে । আমাকে তুই যাকে বলে ‘পিস অব ইয়োর মাইন্ড’, তাই দিস ।”

এই ছোটো লেখাটা মলয় রায়চৌধুরীকে উৎসর্গ করলাম । অশ্লীলতার জয় হোক।
                                           
                                       Sreemanti Sengupta

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...