Monday, September 27, 2021

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে রবীন্দ্র গুহ এবং অজিত রায়

 

"অজিত, মলয় কী বলে খেয়াল রেখো। এই সময়ের প্রকৃত দ্রোহপুরুষ মলয়, ও জানে রক্তের দাগ কথাটা কী! সাহিত্যের ফ্যাক্ট আর জীবনের ফ্যাক্ট বলতে পৃথক কিছু নেই, এ তুমি ভালোভাবেই জানো। মগজ হাতুড়ি বিষপাথর বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য চাই, চাই-ই তিক্তবিরক্ত ভাষা, তিরিক্ষি ভাষা, জলজংলীর ভাষা, নরককুণ্ডের ভাষা। সাহিত্য অভিজ্ঞতার ফল নয়, অবিকৃত অভিজ্ঞতাই সাহিত্য।" ----- এটি একটি চিঠির অংশ, পত্রলেখক রবীন্দ্র গুহ। রবীনদা এই চিঠি আমাকে লেখেন ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০০। বর্তমান নিবন্ধের বাঙমুখে চিঠিটির উদ্ধৃতি, যেহেতু মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আমার ভাবনাও অনেকাংশে এই বয়ানের অনুরূপ, আমি এখানে বিষয়টিকে খানিক বিশদ করতে পারি মাত্র, এর বেশি কিছু না।
মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি।
বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।
নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুণ স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক-বর্তমান তথা বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়।
বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল, বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।
তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।
উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভুবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, 'আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিলেন কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'
মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার। বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'
আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার তরফ থেকে স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।

 

Sunday, September 26, 2021

মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমিকাদের সম্পর্কে খসরু পরভেজ

 


  • [ শ্রদ্ধাভাজন কবি মলয় রায়চৌধুরীকে খসরু পরভেজ ] ]
    একজন কবিরই থাকতে পারে অনেক প্রেমিক। অন্য কারও নয়, অন্য কারও নয়। একজন মানুষের বহু প্রেমিক থাকা পাপ। একজন মানুষের জীবনে প্রেম- প্রেম খেলা অপরাধ । একজন কবিরই অনেকগুলো প্রেমিক থাকতে পারে । যাকে নিয়ে দীঘল প্রেমের কবিতা লেখা যায়। একজন কবির জীবনে পাপ বলে কিছু নেই ।
    তোমার বহু প্রেমিক থাকবে তা কি করে হয় ? তুমি কি কবিতা লিখতে জানো ? তুমি কি কিউপিড বোঝো ? চেনো কি সাইকি , এমনকি আফ্রোদিতিকে ? তুমি কি
    হোরেসের কান্না শুনেছো ? শুনেছো কি কান পেতে ওভিদের গান ? কিছুই শোনো নি তুমি, চেনো নি ! হতভাগ্য তুমি ! তুমি কি বর্ণের জাদুতে ফুল ফোটাতে পারো ? অথবা হাতের তালুতে রঙিন ঘুড়ির মতো আকাশকে নামিয়ে আনতে পারো ? পারো না, পারো না, পারো না। তোমার একটাই প্রেমিক থাকবে। এমনকি নাও থাকতে পারে! তোমার শুধুই ব্যাকডেটেড বউ থাকবে। তুমি স্নো-পাউডার, প্যারাসুটের বোতল নিয়ে ঘরে ফিরবে এবং সুবোধ বালকের মতো বউয়ের কোলে শুয়ে চাঁদ দেখবে। তুমি কখনো বুঝবে না নারী নামের গভীর মর্মার্থ! এমনকি নারীর প্রজাপতি রঙ! বুঝবে না কখনো পুুরষসুন্দর । তুমি পোস্ট মর্ডানিজম বোঝো ? চেনো কি হাংরী কিংবদন্তি ? বোঝো না ? চেনো না ? তোমরা শুধু বউয়ের ব্লাউজের মাপটাই বুঝলে ! শিখলে কিভাবে শার্টের বেতাম লাগাতে হয়, রুমালে ফুল তুলতে হয়। চিনলে বড়জোর জামাইষষ্টি অথবা বারুণীর বাজার!
    প্রেমকে বুঝতে হলে কবি হতে হয়। কবির বুকেই সাজানো থাকে অসংখ্য প্রেমিকের ফুলচিহ্ন ।
    একবার আমি এক দিনমজুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার কোনো প্রেমিক আছে কিনা! সে বিস্ময়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল , মনে হলো প্রেমিক শব্দটি জীবনে সে এই প্রথমবারের মতো শুনেছে। আমি একজন গৃহিণীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার কোনো প্রেমিক আছে কিনা ! সে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বলেছিল, খোকার বাপই তার প্রেমিক। আমি একজন কৃষককে প্রশ্ন করেছিলাম তারও কোনো প্রেমিক আছে কিনা ! সেও প্রেমিক শব্দের অর্থ বুঝতে পারে নি । বুঝিয়ে বলার পর সে বলেছিল, মাটিই তার প্রেমিক , সবুজই তাঁর প্রেম। একজন দেশপ্রেমিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন প্রেমিক বলতে তিনি একজন বেশ্যাকেই বোঝেন। একজন কবিকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন কবিতাই তার প্রেমিক। এই বিশ্বের যা কিছু সুন্দর সবই তার প্রেম।
    কবির প্রেমিক বলে নির্দিষ্ট কিছু নেই । সে বহু প্রেমিকে বিশ্বাসী। তাই তার থাকতে পারে কোনো অনামিকা, তানিয়া, খেয়া, কৃতি ঘোঘ, সোনালী মিত্র, আসমা অধরা, সোনালী চক্রবর্তী কিংবা শুভ্রা রায় । অসংখ্য ফুল, প্রজাপতি, বৃক্ষ, নদী, আকাশ অথবা জ্বলজ্বলে কিছু স্মৃতি ও স্বপ্ন । এ সবই তো তার কবিতা!

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে রবীন্দ্র গুহ

 

বিশিষ্ট সাহিত্যিক অজিত রায় লিখেছেন, 'ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল, বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।' ...
"'অজিত রায় ভাষাবিদ ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুরের মতো নিরপেক্ষ, স্পষ্টবাদী, পোস্ট-মডার্নিস্ট। তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য। ফাদার পিয়ের ফালোঁ মলয়কে একটি পত্রে লিখেছিলেন, 'আপনি হতাশা আর বিতৃষ্ণার মুখোশ পরেই লেখেন; তবু আমার বিশ্বাস, আপনার এই মুখোশ-পরা কৃত্রিমতাই নয়, আমরা সবাই কোন একটা মুখোশ পরি, আদর্শবাদিতার মুখোশই হোক কিংবা আদর্শ প্রত্যাখ্যানের মুখোশ। তাতে অসত্য হয় না, মুখোশ তো চাইই। .... শুনেছি, আপনার নামে অনেক অভিযোগ অনেকে তোলে, গালাগালিও দেয়।'
"এই মুখোশ কথাটা নিয়ে তখন বিস্তর ঘোটালা হয়েছিল। বাবু লেখকরা চটে গেছিলেন। মলয়ের 'দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন' কথাটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাজ্জাদ শরিফকে বলেছিল, 'আমরাই তো বলেছিলাম মুখোশ খুলে ফেলুন, হাংরিরা বলেছিল মুখোশ পরে নিন।' সুনীল ডাহা মিথ্যে বলেছিল। হাংরিরাই বাবুদের মুখোশ খুলতে বলে, বাড়িতে বাড়িতে অফিসে চিঠি বিলি করে। ফলে, সুনীল-সহ তার প্রিয় দলদাসদের অলখ-জ্বালা ক্ষোভ। বাবু শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলল : 'এরা বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, উচ্চাভিলাষী, আবেগপ্রবণ, অসহিষ্ণু, খ্যাতিলোভী এবং শতবিদ্রোহ সত্ত্বেও পুলিশের রক্তচক্ষু দর্শনে সন্ত্রস্ত।' বাবু শরৎ আরো বলেছিল, 'এই কারণে মলয় লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে পালাল।' ..... পালাল যদি, কে বেঁচে আছে তবে?"
---------------------------------------------------
'শহর' ৪৩-এ আসছে মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে রবীন্দ্র গুহর জোরঝড় লেখা : 'মুখোশধারী বদনাম মলয় কীভাবে আজও বেঁচে আছেন'। পুজোর পরই প্রকাশ পাচ্ছে। দাম ২০০/-

 

Friday, September 24, 2021

হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে কৌশিক সরকার

 

    আমি নিজে দারুণ ক্ষুধার্ত কিন্তু ক্ষুধার্তদের সম্পর্কে আমার কোনো ইলুসান নেই ওরা কেউ গদ্য লিখতে জানে না কবিতাও শৈলেশ্বর দুর্দান্ত লিখলেও উত্তর জীবনানন্দ পরিসরে সে ঢুকতে পারেনি প্রিমিটিভ ফোর্সকে পাথেয় করে দুঃস্বপ্নকে যতদূর চারিয়ে দেওয়া যায় ইতস্তত নিরক্ষর ষাঁড়ের গোঁয়ার অ্যারেনায় কিন্তু ওতে বাংলা কবিতার ভাগবত তথা পাগান তাগৎটুকুই কেবল মূর্ত হয়ে ওঠে বাসুর কথা ধরো ও যতক্ষণ সন্দীপনকে নকল করেছে ততক্ষণ ভাল লিখেছে কিন্তু তারপর হেজে গেল সুভাষের প্রোজ অনেকদূর যেতে পারত পেট্রন না পেলে মোদোকেলানে হয়ে লাভ নেই শক্তি মদখোর হয়েও নিজকে ফিউএল করে ভস্মীভূত লিখে গেছে আগুন কবিতা অহোরাত্র বহ্নি সেবন ওদেশে যেমন জ্যাক কেরুয়াক তুমুল হুইস্কি অ্যালকোহলিক অথচ কী চূড়ান্ত মিউটেটিভ প্রযোজনা অন দা রোড থেকে বিগ সার এর শিফটটা একবার খতিয়ে দ্যাখো গাড়ির চেয়ে ক্ষিপ্র পিকাপে মনের সুখে অ্যাকসিলারেটরে পা দাবিয়ে লেখা ততোধিক দাঁড়িকমাহীন সমস্ত ট্রাফিক আইন লালবাতি লঙ্ঘন করে ও নিজেকে প্রুস্তিয়ান বলত আসলে ওর গদ্য ওলট-পালট মেলটিংপট একদম পেনেলোপির তুল্য অনর্গল কেরুয়াক একের পর এক ড্রাংকন বাউটে জীবন জিনিয়াস জলদি ফুঁকে দিলেও জান লড়িয়ে লিখে গেছে ওদেশে লোকে জানে ঢেলে লিখলে টিঁকে যাব আর ওরা পড়াশোনা কখনো থামায় না মরতেও ভয় পায় না এখানে সেলিন পড়ে কী শিখল বাসু সুভাষ নাথিং সব কটা ছাপোষা বিপ্লবী কারুর বিয়ে পর্যন্ত ভাঙল না অথচ অন দা রোড শুরুই হচ্ছে মাগির সঙ্গে স্প্লিট আপ দিয়ে তফাৎটা বোঝো এরা সবাই ভাল বর যেমন সুনীল শ্যামল সন্দীপন কারুর ডিভোর্স হয়নি সুনীল অবশ্য রাজ খুলাসা করেছে যে বহুবার দাম্পত্য বিপর্যস্ত হয়েও শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি হয়নি কারণ বড় ফাটল কখনো ধরেনি আসল কারণটা হল সুনীল আলটিমেটলি বলেছিল খরচ দু হাত করো কিন্তু হিসেব লেখার দরকার নেই যখন যেমন আমদানি তত্র অপব্যয়, ক্লিয়ার! খরচের পাই ফয়সলার খতিয়ান লিখে দেহমন কালিসার করতে হবে না; মেয়েরা আর কী চায় ব্ল্যাঙ্ক চেক আমার বেশ মনে আছে আমি যমের অরুচি বলেই বলছি এসব কক্ষনো লিখতে হয় না আমি হয়্বান দুরাত্মা যখন আর্ট কলেজে পড়ি আমি লিজাকে রোজ লাগাতাম একদিন সে হাত পাতলো অর্থাৎ পয়সা দে আমি তো হতবাক খুব হার্ট হয়েছিলাম কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি আমিই পাপী মিয়া কালপা যেকোনো রিলেসানের অনটলজিকাল বেসিসটাই হচ্ছে পওসা আমি ফোকতাই চুদেছি এই জন্য মীনাক্ষী বলেছিল জিব খসে যাবে! শক্তির ভয় আমার পিছু নিয়েছে পড়েছ জীবনানন্দ ফেল এত সটান হটেনটট পিশাচসিদ্ধ নটবায়োগ্রাফি টোটটাল পোয়েট্রি বলতে ঠিক যা বোঝায়: অন্তর্ধান! শক্তি জানত কোথায় কোন ভাবে জীবনানন্দকে সারপাস করা যায় ও ব্যাটা ভাড়ুয়া ছিল না বিয়ে ভাঙলে ভাঙবে আমি পারসনালি ক্ষুধার্তদের খুব সমর্থক কিন্তু তারা মিয়ার এনার্কিস্ট এমনকি পলিটিকালি ইনকরেক্ট বাসু তো সিপিএম হয়ে গেসল এত বড় বিপ্লবী আসলে ওয়েস্টার্ন লিটরেচারকে রিঅ্যাপ্রপ্রিয়েট করতে পারেনি কোনো ব্যাটাই এদিকে বাংলা সাহিত্যও পড়েনি আমি যেমন অ্যালাও মি খারাপ লাগলেও রবীন্দ্রনাথ পড়ি ওটা আমার গঙ্গার স্বরের নিজস্ব লেগ্যাসি মলয়দার কবিতা আমি পড়িনি খুব বলতেন প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার নিয়ে বিস্তারিত ছবি আঁকতে আমি আমল দিইনি অতএব ট্যাগ করেছ ভাল কথা কিন্তু ও লেখাটা সৃজিতের বাইশে শ্রাবণ না কী একটা ছবি ছিল দেখেছ তো আর তার এক্সট্রাটেরেস্ট্রুয়াল চরিত্র গৌতম ঘোষ যেখানে ভেটেরান ফ্রাস্ট্রু হাংরি কবির যে ভারসান ইতিহাস কথিকা হাজির করেছে বাসবের লেখাটা তার চেয়ে বেশি সত্য নয় যে যতটুকু জানে কী আর করা যাবে এভাবে সাহিত্যের ইতিহাস বারবার তলিয়ে যায় বিবিধ ডিজগাইসে আত্মবিস্মরণের আর্কাইভ থেকে তাকে পুনরুদ্ধার করো...

Thursday, September 23, 2021

হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অজিত রায় লিখেছেন

 

অজিত রায় লিখেছেন
'আমার' হাংরি সমগ্র'
---------------------------
১.
কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন। যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন। তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়। জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে। হাংরি সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে। তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়। সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা। সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।
১৯৫৯-৬০। বৃটিশবীর্যিত মুলুকের পোঁদে গাঁড়সা পুঁতে গাদি সামলাচ্ছেন নেহেরু। দেশের দুই প্রান্তে পার্টিশানের টসটসে পাঁচড়া। পুব পাকিস্তান থেকে আগত অন্যৎপুষ্ট মানুষের কিছু থোপনা তখনও আনলোড হচ্ছে শেয়ালদার টেসেলেটেড চাতালে। হাভাতে মানুষের কেরবালা বিধানবাবুর গড় জুড়ে ছিৎরে পড়ছে। দেশভাগের সময় পুব বাঙলা থেকে যে কিশোরগুলো বাবা-মায়ের কড়ে ধরে কলকাতায় এসেছিল, তারা এদণ্ডে গাগতরে বেতর, কিন্তু বয়সে ও মগজে সাজোয়ান। দেশভাগের খসা চোকলা। কাঁধের চিক্কুটে ঝোলায় কবিতার লাজুক খাতা আর কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ ঢুয়ে কলকাতার রাস্তায় গলিঘুঁজিতে এক রাত্তির হিল্লের মনসুবায় চোখমুখ কালিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাঁঝের আলা মদ্দিম হলে সারমেয় অধ্যাসিত ফুটপাতে, হয়ত-বা কোনও দয়াল বন্ধুর ঘাড়ে অথবা গেরস্ত বাড়ির হেঁসেল-ঠোরে রাত গুজরান। ইহাদের প্রত্যেকের বুকে কবিতা নামের পিলপিলে গণ্ডুপদটি ক্ষণে ক্ষণে ঢসন মারে। ইহারা সকলে প্রবল কবিতা-পিশাচ। পিশাচ, কেননা ইহাদের মাঘার ঘিলুতে জবরদস্ত পুঁজরক্ত যাহা গোপন আঁধারে কলম দিয়া চোয়ায় আর দেউলের দেউটি সহসা নিভায়।
ষাটোত্তর গরদিশের দিনগুলি। গেরস্তের জবরদখল-করা হেঁসেলে আচকা নোটিশ হয়ে গেল। ভাঙা আয়না, দাঁড় টুনানো চিরুনি, তেলের শিশি, জীর্ণ ফতুয়া, কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ আর লজ্জাবতী কবিতার ধুকড়ি নিয়ে পথে দাঁড়াল সুভাষ। সুভাষ শলা করল, ----- শৈল, চ, দুজনে মিলে একটা ঘর নিই। টালায় ১৬-বি শ্যামচরণ মুখার্জি স্ট্রিটের একতলায় দুর্গন্ধ-পীড়িত ফালি-খানেক ঘর যোগাড়ও হয়ে গেল। খিড়কির পাল্লা সরালেই ড্রেনের ধারে পাছা ঝুলিয়ে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কৃশগাঁড় বিভীষিকা।
সুভাষের গেরামের ইশকুলে কমপয়সার চাকরি। দু-বেলা যুৎসই অন্ন জোটে না বটে, কিন্তু গদ্যের হাতটি খাসা। তাহাতে ড্যাশ ও হাইফেনের যাচাই ভুরিভোজ। শৈলেশ্বরেরও মতিগতি উনিশবিশ। অল্প অশহুরে, তথা জন্মলব্ধ সারল্য ও সততা। ফলে মানিকজোড় হতে সূর্যঘড়ি লাগেনি। দুজনেই টিউশানি ধরে, আর ছাড়ে। হপ্তায় দু-দেড় দিন ভিজিট, আর চার-পাঁচদিন একুনে নাগা। ফলে আট থেকে দশদিনের মাথায় জবাব হয়ে যায়। খাওয়ার পয়সা নেই। বৃদ্ধ পিতা পঙ্গুত্বের লেংগি খেয়ে খাটের প্রাণী। ছাত্র-রাজনীতির গাজোয়ারি-প্রসূত 'লম্বা' হাঁকন বাবদ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নীমসম্বন্ধ। ফলে, দিনগুলি বেজায় নড়বড়ে, জীবনযাত্রা ধূরিপথহীন। সাহিত্য করা তো দূর অস্ত, সাহিত্যের জিগির-মাত্রে পিছদাঁড়ায় কাঁপন। ডাইনির ছমছমে খিখি অষ্টপ্রহর। ক্কচিৎ পকেটে বাড়তি খুচরো জুটলে শ্যালদার চোরা-হোটেলে জলের সঙ্গে পাঞ্চ করে, ভরদুপুরে কান্ট্রি-লিকার। শ্যামবাজারের জন্তা হোটেলে ছ'আনায় ভরপেট খানা। লেটনাইটে ঘুমের ধাক্কায়, বাড়ি। একজনের ঘুম জুটত, অন্যজনের জুটত না। শৈলেশ্বরের ছিল ইনসোমনিয়ার ব্যামো। সারা-সারারাত মরা মাছের নিস্পন্দ চাউনি সিলিং-পানে।
সুভাষরা একসময় ক'জন বন্ধু মিলে 'এষণা' নামে একটা কাগজ বের করত। খুবই পাতি, অতীব বালখিল্য সে কাগজ। সুভাষ-বাদে অন্যরা সবাই মামুলি মাস্টারবেট-করা লেখক, মানে পার্ট-টাইম। অল্প খিঁচে নিল, ব্যস, সাহিত্যের বাঘ মারা হয়ে গেল। আপিসে-আপিসে কেরানিগিরি, আর রোববার সকালে পাঁচ পয়সায় আধ প্যাকেট ক্যাপস্টান কিনে শ্যামবাজার কফিহাউসে ধুন্ধুমার আড্ডা। কফির কাপ আর তামাকের কড়া ধোঁয়ায় বাঙালির বেড়ে বাফুনারি। শৈলেশ্বর-সুভাষরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়, গেঁয়ো বুদ্ধি, গেঁয়ো কথাবার্তা। অপরপ্রান্তে, ধাউড়দের মুখে বিদিশি বই, ফরেন-কলমচিদের রেফারেন্স। ইনজিরির ছররা। দুজনের মধ্যে শৈলেশ্বরের বুদ্ধি একটু খোলা, মওকা বুঝে, সময় থাকতে কাগজটাকে নিজের হেফাজতে নিল। কাপ্তানি সুভাষের, কিন্তু কলকাঠি শৈলর হাতে। অবশ্য, চারটে মাত্র ইস্যুই হাপিস হয়েছিল 'এষণা'র।। হাংরি জেনারেশান সাহিত্যের ঐ ছিল গর্ভ-সূচনা। অচিরেই এষণার ছাদনায় এসে ভেঁড়ে প্রদীপ আর সুবো।
এবং আরও একজন। বছরটা ১৯৬৩।
ছেলেটির বয়স কুড়ি। রুজির যোগাড়ে গোড়ার দিকে থাকত কলকাতায়। টালা ব্রিজের কাছে খেলাত বাবু লেনে। বারোঘর এক উঠোনের একটি পোড়া বাড়িতে। সারাদিন রুজির খোঁজে, ফিরত রাত নিবিড়ে। পরে ন্যূনাধিক একটা হিল্লে হলে, অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে পাকাপোক্ত নোঙর। সেও ছিল দেশভাগের ঠাঁটা চোকলা। ডাঁসা বাঙাল। জিরজিরে শরীর। উপদ্রুত মন। চাঁচাড়ি-ঘেরা তার এক-কাটরা বাড়ি। ছেঁড়া শাড়ির গাঁঠরি। বাতায় ঠোঁসা সরষে তেলের শিশি। একটিপ তেল মেখে, শ্যালো টিপে দু-বালতি জলে স্নান সেরে ও গামছায় সর্বাঙ্গ মুছে, ভাঙা আয়নার সামনে ব্যাকব্রাশে টেরি চিরে দরমার দরজা ভেজিয়ে এক রোববার সে ঐ 'এষণা'র ঠেকে। লেট এন্ট্রি।
ছেলেটির নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত।
হালিতেই সে ঝুলি থেকে বের করে এগিয়ে দ্যায় একটি লিটল ম্যাগাজিন। পবিত্র বল্লভ সম্পাদিত 'উপদ্রুত'। তাহাতে একটি দীর্ঘ গদ্য, ------ নাম 'রন্ধনশালা'। সে বলেছিল, 'গল্প'।
বাসুদেব 'রন্ধনশালা' রচনা করেন একষট্টিতে। তেষট্টিতে সেটি ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়। গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে। শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না। এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়। বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।
রন্ধনশালার হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়। খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে।
আসলে, শৈলেশ্বর জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে যে ছোটলোক বা সংখ্যালঘুর মনোভাব কাজ করছিল, রন্ধনশালা ও তৎ-পরবর্তী গদ্যসমূহে সেটাকেই ঝাড়বাতির তলায় মেলে ধরেছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত।
২.
শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের। চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না। প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, তথাকথিত 'ছোটলোক' ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা। আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি। প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক। ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি। সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা। পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল। এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন। এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়। বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন। এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মনং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো। অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।" আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন। প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল। উভয়ে মিশে গ্লোকাল। এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ। শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা। হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'। সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না। বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন। যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।
পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন। এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন। দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা। সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল। মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল। সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই। আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে। তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে। কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে। একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন। এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সমর সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি। সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়। এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে। হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'। শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত। তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'। কী ব্যাপার?? কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে। তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়। ধন্দ কাটে না। বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?' উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।
এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা। অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।
দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন। তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে। তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক। পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা। উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা। দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি। শবেবরাত। আখেরি চাহার শুম্বা।
আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট। আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন। সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।
ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা। ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে। অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।' এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল। এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।
৩.
সাহিত্যের আখড়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র নয়াল কিছু নয়। সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, হুজুগ আর বাওয়াল যুগে যুগে। সেই কোন ১৯০৫ থেকে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি লন্ডনের ব্লুমসবেরি মহল্লার এক থুত্থুড়ে কোঠায় ফি বেস্পতি সাঁঝে জমা হতেন সস্বামী ভার্জিনিয়া উলফ, রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, জন মেনার্ড কিন্স, ই এম ফর্স্টার, লিটন স্ট্র্যাচি, ডানকান গ্রান্ট প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ঐ আড্ডাবাজরা 'ব্লুমসবেরি গ্রূপ' নামে বিখ্যাত। মোটামুটি ঐ ধাঁচেরই ছিল বাংলার বিনয় সরকার, সুনীতি চাটুজ্জে, সতীশচন্দ্র মুখুজ্জেদের 'ডন সোসাইটি'; এবং কিছু পরে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-মানিক-প্রমুখের 'কল্লোল গোষ্ঠী'। যদিও জাতে ও চরিত্রে কিঞ্চিৎ আলাদা, কিন্তু তিনটিই ছিল নিছক আড্ডা-বিশেষ। সাহিত্যের আড্ডা। যা পরবর্তী কালে সাহিত্যের কিছু খাস সামিয়ানায় ঠেক পেতে কলকাতার কফি হাউসে আরও-অঙ্ক-কষে হতো, এবং যা এখন আরো-অন্যভাবে, অন্যত্রও হয়। বুকফেয়ার, নন্দনচত্ত্বরে, ইভন ফেসবুকে এবং ব্লগে। কিন্তু সাহিত্য তথা শিল্পে সেরম বাওয়াল ওরফে মুভমেন্ট যদি কিছু হয়ে থাকে, আমাদের রামায়ণ-মহাভারত-চৈতন্যের লীলাখেলা-সমূহ বাদ দিয়ে, তাহলে তার বিসমিল্লা ধরতে হয় ১৮৩০-এর ফরাসি বোহেমিয়ানদের হুল্লোড় থেকেই। তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের ঐ ছিল সাড়াজাগানো পয়লা ভেঁপু। এবং পরবর্তী কালে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই বিগউল ফোঁকা অব্যাহত থাকে। ফলে, মার্কিন ইন্টেলেকচুয়ালদের মাথায় হঠাৎ 'Angry' ঠাপ্পাটা দেখে তেমন হাসি নির্গত করার কারণ ছিল না বিশুদ্ধবাদীদের। কারণ ঐ মার্কিন অ্যাংরিরা এতখানিই বাগী আর রাগী ছিল যে নিজেদেরকে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বলতেও ওরা রীঢ়া বোধ করত। ওরা নিজেদের জাহির করত 'Anti-Intellectual' বলে। আসলে, জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংগোটি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গেগরি করসো, ই ই কামিংস, কেনেথ রেকথ, হেনরি মিলার প্রভৃতি আমেরিকান কবি-লেখকদের, তথাকথিত সামাজিক ধ্যানধারণার প্রতি প্ৰচণ্ড রকমের অনীহা ও আক্রোশ থেকে গড়ে ওঠা ঐ গোষ্ঠী নিজেদের জাহির করত 'বিট' বলে। বিট মানে হেরো, পরাস্ত, হতাশ, গাণ্ডু আর এইরকম আরও কিছু। 'অ্যাংরি' কথাটা তো খচমচ করত চল্লিশের দশকের জ্যাজ বাজিয়েদের ঠেকে। তাছাড়া, মোটামুটি ঐ সময়েই ইংল্যান্ডের একদল তিক্ত-বিরক্ত-রাগী লেখক সেখানকার গঙ্গাজলী সাহিত্যকে লাথিয়ে রাতারাতি দাগি হয়েছিলেন 'Angry Young Men' নামে। অ্যাংরিরা ছিলেন জন ওয়েন, জন ব্রেন, কিংসলি অ্যামিশ প্রমুখ। অ্যাংরি আর বিটরা একসময় একটা জয়েন্ট অ্যান্থলজিও বের করে। যে-কারণে ঐ দুই বাওয়াল-পার্টিকে অভিন্ন ভেবে কিছু মানুষ চরম ভুল করেছিল। কিন্তু, ভুল তো ভুলই। আসলে হয়েছিল কি, কেরুয়াকের সুহৃদ হারবার্ট হাংকি তখন কুচেল দুনিয়ায় গহন চলাফেরায় মগ্ন এবং তাঁকে ছিঁচকে চোর, মাস্তান আর মাতাল-গাঁজাখোর বলে চেনানোর জন্যে 'বিট' খিস্তিটা চালু ছিল। এবং, খুব অবান্তর হবে না যদি ধরা হয় কেরুয়াক উক্ত লিংক থেকেই শব্দটা গেঁড়িয়েছিলেন।
এই বিটদের সঙ্গে বাঙালি যুবাদের হাংরি হাঙ্গামাকে গুলিয়ে ফেলার বেওকুফি বা ধাউড়বাজি ঠিক হবে না। আবার 'হাংরি'র স্রোত-সূত্র যে 'ক্ষুধার্ত' বা 'কাঙাল' ---- এটা ঠিক না। কেননা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা কখনই মার্কামারা হতে রাজি নয়, তারা হামেহাল শেষধাপের জন্য ত্বরায়। আর, ধাপগুলো হলো অবিরাম নিচের দিকে, ঘাস আর মাটির দিকে। 'মার্কা' ব্যাপারটা মৌলবাদের লক্ষণ। প্রতিষ্ঠানের কারকিত। যেমন আমাদের পৌরাণিক নামগুলো। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, শিব, কৃষ্ণ, রাম, সীতা প্রত্যেকেরই হাজারটা করে নাম। পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে লোকসভার মেম্বার, এঁদের অনেকগুলো করে নাম। যত গুণের ঘাট, তত নামের বাড়। তাছাড়া, এটাও ফ্যাক্ট, যে, ব্যক্তিকে অভিধায়িত করার জন্য যেসব শব্দকলাপ আমাদের চারপাশে ডাঁই করা আছে, এখনও, সবই সেই ব্রিটিশ মাস্টারবেশিয়ানদের নিচুড়ে-যাওয়া বইপত্র, ডিক্সনারি আর আধুনিকতাবাদী বুকনি-বীর্য থেকে হাসিল। আসলে কিন্তু, শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতিক-আর্থিক অবস্থা, তাতে সেরকম মর্ডানিস্ট স্পেশেলাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সারবীজ সব পচে-হেজে গেছে। এখন আধুনিকতা ব্যাপারটাই একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর ও ধাপ্পাবাজ।
যাই হোক। বলবার কথা এই, হাঙ্গামার শরিকরাও যেভাবে দাবি করেছেন, ---- হাংরি, আর-পাঁচটা সাহিত্য আন্দোলনের মতোই, পূর্বাপর স্বমেহিত ছিল, তাতে কোনো বাহ্যিক ক্যাটালিটিকের কলকাঠি ছিল না। যে-কারণে এই হাঙ্গামার আবির্ভাব-কালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চাশের শেষে, বিশেষত ষাটের দশকের শুরুশুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একই ধাঁচে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা আর বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাদের নিজ-নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সমাজ, চালু ধর্মীয় নীতিকানুন, আর্থিক বন্দোবস্তি আর কালচারাল বাতাবরন তামাম-কিছু ঐ নাগর-যুবাদের কাছে চরম অসহনীয়, সুতরাং পরম ত্যাজ্য ও বর্জনীয় ঠাহর হতে থাকে। প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ্ব থেকে বার্কলি, জাকার্তা, কলম্বিয়া, পিকিং ----- বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রবল বাগী ও তোড়ফোড়-প্রবণ হয়ে ওঠে। লিহাজা, বিক্ষোভের ঐ চোনা সাহিত্যের জলকেও লোনা করে ফেলবে, এ তো অতি লাজিম কথা।
বিশেষত, দেশভাগটা বাঙালির সত্যিকারের পাইন মেরে দিয়েছিল। ঐ প্রেক্ষাপটে, যখন নিত্যনতুন মৃত্যুপদ ও ভীতিপদ বাঙালির বত্রিশ ইঞ্চি পোস্তবাটা-বুক ক্ষণে ক্ষণে ভেবড়ে দিচ্ছে, মুহুর্মুহু মূক করে দিচ্ছে আস্ত-একটা বাতেল্লাবাজ জাতিকে, চেতনা সন্ত্রস্ত ও দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে, নালা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে অনাহারী নেড়ি ও মানুষের ছা, ------ আমরা তখনও অবিশ্বাস্য নজরে দেখতে পাই হাজার বছরের ঝরঝরে মূল্যবোধগুলো বাঙালির জীবনে নতুন ধারণার পথ দেখাবে বলে, তখনও, রক্তচক্ষু মেলে দাঁড়িয়ে! নতুন শক্তি জীবনকে পথ দেখাতে চায়, তখনও। ঐ রক্তচক্ষুগুলো কাদের?? কোটি কোটি মূক ও মূঢ়ের বেদনাকে মূর্ত ধ্বনিতে তবদিল করতে উঠে আসে অই, কারা??? আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙলা মায়ের আনাচ-কানাচ থেকে, অন্ধগলি আর ঘুঁজিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে অশিক্ষিত নিরক্ষর অর্ধ-নিরক্ষর ভাঙা-ভাষা ভাঙা-বানানের একগুচ্ছ অন্ত্যজ, অপর, সাব-অলটার্ন, ডায়াসপোরিক ছোটলোক। নপুংসক বুর্জোয়া শ্যাল-কুত্তায় নুচে খাবে বাংলা সাহিত্যকে, তার আগেই টিনের সুটকেশ, ভাঙা মগ, ছেঁড়া পাজামা, নোংরা গেঞ্জি ও বিষ্ঠা-লাঞ্ছিত মুর্দাফরাসের কেরবালা হা-রেরে তরিবতে ধেয়ে এলো বাংলা সংস্কৃতির মূল বিতর্দির দিকে। গোড়ার দিকে এদের পিওর লাথখোর বলে মনে হবে, এদের ভাষা গেঁয়ো আর এদের কথাবার্তা অশ্লীল স্ল্যাং-মাফিক মনে হবে, ---- সেটা একরকম রফা। মৃতের চিতায় অগ্নি-অস্তিত্বের ঐ ছিল পূর্বাভাস।
হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ছিল, নাকি হুজুগ? হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা কে? ----- এই দুটি বিতর্ক এত এত দফা এত এত এত ভাবে দলিত মর্দিত ধর্ষিত হয়েছে যে তাকে এখন কেঁদেই বাঁচতে দেওয়া উচিত। বিশেষত দ্বিতীয় প্রশ্নটি। জঙ্গল মে মোর নাচা, কিসনে দেখা? প্রত্যেকে বলে আমি, আমি, আমি। অক্ষরের গোলামি থুয়ে অক্ষরের মালিক হওয়ার সাধ, প্রত্যেকের। তাঁরা মেতে উঠেছেন অন্ধকারে, অহংকারে, ব্যক্তিগত আরোপে, আমিত্বের বহ্বাস্ফোটে। আমি, আমি, আমি। আয়ে গওয়া হরামিয়ন সব, একে মারে যান আফত-মা হ্যায়। ----- বিতর্কটি এখন যেন এই বলছে, কঁকিয়ে, ----- এবং খাবি খেয়ে মরছে।
১৯৬২। 'সম্প্রতি' পত্রিকার থার্ড সংকলনে বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমীক্ষা বেরুল 'হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব' শিরোনামে। লেখক : শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অনেকের ধারণা, বাসু-সুভাষ-শৈলরাও খেয়েছিলেন, যে, এই লেখা থেকেই হাংরি জেনারেশন নামের সূত্রপাত। ধারণাটা কিছু বাতাসও পেয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে হাংরি মামলায় 'this literary movement was started by me' বলে শক্তির স্টেটমেন্ট জমা পড়ায়। হাংরি গোষ্ঠীর এককালীন গড়িমসি সদস্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও নাকি ঐ মর্মে বয়ান রুজু করেছিলেন। কিন্তু শক্তির এ লেখা তো বেরিয়েছিল বাষট্টি সনে; অথচ, ১৯৬১ সনের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ছেপে গিয়েছিল 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের ইস্তেহারটি, তাতে বার্জাস টাইপে পরিষ্কার ছাপা হয়েছিল : স্রষ্টা মলয় রায়চোধুরী, নেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক দেবী রায়।
আসলে, পরে জানা যায়, হাংরি জেনারেশন ছিল এমনই এক চ্যাংমাছ, কারো একার মুঠোয় বেশিক্ষণ ধরা থাকেনি। হাঙ্গামার ধূসর সূচনালগ্নের আরেক শরিক, বিলেত-রিটার্ন কলেজ-প্রভাষক উৎপলকুমার বসু পরবর্তীতে (১৯৯৪) জানালেন : "হাংরি জেনারেশন সেভাবে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। যার খুশী, যেখান থেকে পারে হাংরি জেনারেশন নাম দিয়ে বুলেটিন বের করে বাজারে ছেড়ে দিত। এই আন্দোলন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। কতকগুলো ফতোয়া মলয় সমীর শক্তি লিখেছিল। এগুলোর নিচে অনেকের নাম বসিয়ে দেয়া হ'ত। বহু ক্ষেত্রেই যাদের নাম দেওয়া হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাও করা হঁ'ত না। ..... হাংরিদের সেভাবে কোন কাগজও ছিল না। হয়ত ত্রিপুরা থেকে একটা কাগজ বেরল, নাম দিয়ে দিল ---- হাংরি জেনারেশন বুলেটিন নম্বর ১২। হয়ত তার ১০ বা ১১ বেরোয়নি।"
আসলে, ১৯৬২-৬৩ সনে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে এই বাওয়ালমুখী পালাবদলের তীব্র চাগাড়ে দুটি প্রধান উপ-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরের বুকে। একটি কেন্দ্রের মধ্যমণি ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং সুবো আচার্য। অপর কেন্দ্রে ছিলেন মলয় রায়চোধুরী, সমীর রায়চোধুরী, দেবী রায় এবং সুবিমল বসাক। উভয় কেন্দ্রের সদস্যরাই, কমবেশি, তথাকথিত ছোটলোক, গরিব আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত। এবং প্রত্যেকের বয়স ছিল বিশ-পঁচিশের কোঠায়। যে-বয়সে যত আলো পড়ে, তত ভয় কমে। উপকেন্দ্র যেহেতু দুটি, সুতরাং দু-রকমের হাংরি বাওয়াল শুরু হয়েছিল। একটা, শৈল-বাসু-সুভাষদের বস্তি-কলকাতার 'ছোটলোকি' বাওয়াল; এখানে যে-দলের নাম দেওয়া যাক হাংরি -- 'এ' গ্রূপ। অন্যটা মলয়-সুবিমলদের ডায়াসপোরিক বাওয়াল, অর্থাৎ 'বি'-গ্রূপ। দ্বিতীয় গ্রূপের সর্বময় কর্তা ছিলেন পাটনার ছোটলোক আর কুচেল অধ্যুষিত দরিয়াপুর মহল্লার নামচিন ষ্টুডিওঅলা রঞ্জুবাবুর ছোটছেলে বিশ বছরের ফনকু ওরফে ফনা, অথবা ইমলিতলার মুল্লু খান ওরফে মলয় রায়চোধুরী, সেটা জোরও ধরেছিল মলয়ের জোরদার ইস্তেহারি ভাষার চটকে, অপেক্ষাকৃত বেশি; আর, তাঁদের সে-টিমও ছিল বেশ ভারি। বহু পুরনো জ্ঞানপাপী সে-দলে ভিড়েছিল। 'এ' গ্রূপ এই 'বি' গ্রূপের নাম দিয়েছিল 'চুলকে দেওয়া হাংরি জেনারেশন'। প্রথম গ্রূপটি মলয়কে 'মফসসলের অজ্ঞাত গাড়োল' বলেও চালাতে চেয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত। তাঁরা, প্রত্যেকে ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মভাবে, মলয়ের বিরোধীপক্ষ। বিশেষত আশির দশকে পুনরুত্থিত মলয়ের নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে চালানো, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাস-বিকৃতি এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রচারে দাগা পেয়েই প্রথম গ্রূপটির গোসা ধরতামাশি পেয়েছিল এবং তাঁরা পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিলেন। সুতরাং প্রথম দলটির ঐ পাঁচ শরিক যাঁরা আন্দোলন-চলাকালীন, ষাটের দশকে যা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি, আশি ও তৎ-পরবর্তী পিরিয়ডে মলয়ের মতই, নিজেদেরকে 'হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা' হিশেবে প্রচার করা শুরু করে দেন। দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না বলে এহেন পারস্পরিক কাদাহোলি। আমি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুম্ভলস চাই না, অতএব কোন্দলটি এড়িয়ে যাচ্ছি।
এ-কথা ঠিক যে হাংরি কোন ইজম ছিল না। ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া। আরও বলতে পারি, একটা ঘটনা, বাংলাভাষায় সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল এক ঢেউ, উঠে এসে, আছড়ে পড়েছিল এজি-গোয়িং সাহিত্যের ল্যাসলেসে মসৃণ চত্ত্বরে। সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের লিরিকফুলের বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনো-অব্দি একলোতা বৈপ্লবিক সমীহা।
-----------------------------------------------------


Monday, September 13, 2021

জয়িতা ভট্টাচার্য নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার ( ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২১ )

 

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জয়িতা ভট্টাচার্য

মলয় : তুই তো এর আগে একটা ইনটারভিউ নিয়েছিলিস ?


জয়িতা : তাতে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়নি ।


মলয় : আচ্ছা । কী প্রশ্ন ?


জয়িতা : মামলা জেতার পর তুমি নাকি লিখেছিলে হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । তারপর বেশ কয়েক বছর সাহিত্যের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল না । সত্য ঘটনা জানতে চাই ।


মলয়: না আমি অমন কিছুই লিখিনি । কোথায়ই বা লিখবো ? মামলার সময়ে কলকাতায় দুবেলা খাওয়া জুটতো না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । কেস জেতার পর চাকরিটা ফিরে পাই । কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট নষ্ট করা আর পোড়ানোর চাকরি আর করতে চাইছিলুম না । একে তো পচা নোটের ঢিবির মাঝে বসে-বসে  শরীর খারাপ হবার যোগাড়, তার ওপর ভীষণ রিস্কি। বিপদের ব্যাপারটা লিখেছি আমার ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসে । অন্য চাকরি খুঁজছিলুম আর অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের ট্যুর করার চাকরি পেলুম লখনউতে। পরে ওটা নাবার্ডে মিশে যায় । প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হলো গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে--- চাষি, জেলে, কুমোর, কামার, হস্তশিল্পী, তাঁতি, হর্টিকালচার, পশুপালন, জলসেচ ইত্যাদি--- আমি তার আগে কিছুই জানতুম না । লেখার জগত থেকে বেরিয়ে একেবারে আলাদা জগতে পৌঁছে গেলুম । আক্রান্ত হলুম যাকে বলে রাইটার্স ব্লকে । আর এতো ট্যুর করতে হতো যে ঘোরাঘুরির একটা আলাদা আনন্দে মজে থাকতুম । আবার লেখা আরম্ভ করি পূর্ব পাকিস্তানের মাহমুদ কামাল আর মীজানুর রহমানের অবিরাম অনুরোধে। কৌরবের কমল চক্রবর্তীও চাপ দিতে থাকে । 


জয়িতা : তাহলে, তুমি যখন কলকাতায় ছিলে না তখন তোমার বিরুদ্ধে কেন প্রচার চালাতো তোমার এক সময়ের হাংরি সহযাত্রীরা ?


মলয় : অলোক গোস্বামীর ‘মেমারি লোকাল’ বইটা পড়লে জানতে পারবি । শৈলেশ্বর ঘোষ আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ওর চেলাদের বোঝাচ্ছিল যে হাংরি মামলাটা ওর ‘তিন বিধবা’ কবিতার জন্য হয়েছিল । অথচ মামলাটা হয়েছিল আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার কারণে ; জেল-জরিমানা আমারই হয়েছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষরা আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হবার দরুন অপরাধবোধে ভুগতো । উত্তম দাশ আমার লখনউয়ের বাসায় এসে মামলার কাগজপত্র নিয়ে গিয়ে ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় লেখার ফলে সব ফাঁস হয়ে যায় । ওরাও আমাকে গালমন্দ করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওরা মারা গেছে কিন্তু ওদের কুচুটে চেলারা আমাকে গালমন্দ করে চলেছে । শৈলেশ্বরের চেলারা সুভাষকেও মারধর করেছিল । সৌভাগ্যবশত আমি চেলার দল গড়তে পারিনি। মরব আর হাপিশ হয়ে যাবো । ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ নামে একটি কবিতা সঙ্কলন বার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৮ সালে। কিন্তু চার দিক থেকে এত নিন্দে হল এই সঙ্কলনের যে, রবীন্দ্রনাথ বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন। দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করলেন অনেক আশা করে, কিন্তু ছাপা গেল না তাও। খোদ রবীন্দ্রনাথকেই এরকম প্রচুর নিন্দে আর আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে ।


জয়িতা :নব্বই ও শূন্য দশকে লিখতে আসা  লিখিয়েরা অনেকেই বাস্তবিক তোমার বিশাল লেখার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অজ্ঞ । যদিও বা নামটা শুনেছে, "হাংরি" কবি হিসেবে জানে, কিন্তু সেই হাংরি আন্দোলন বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলেও সেটা মাথায় দেয় না গায়ে মাখে কিছু জানে না।


মলয় : আমি একাকীত্ব ভালোবাসি । প্রথমত, কলকাতায় ফেরার পর, আমি কলকাতার আর মফসসলের সাহিত্যসভা, কবিতাপাঠ, কবিদের বাড়িতে আড্ডা, কফিহাউসে যাতায়াত ইত্যাদি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলুম বলে ওনারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত নন । দ্বিতীয়ত, আমার বইপত্র বইবাজারে পাওয়া যায় না। আসলে প্রকাশক পাই না । গাঙচিলের অধীর বিশ্বাস একটা প্রবন্ধ সংকলন বের করার পর বললেন, “আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহ’র মতন বিক্রি হবে না। কেন ছাপবো আপনার বই  ?” দে’জ আমার বই বের করতে চায়নি কেননা ওনাদের কমিটিতে যাঁরা ছিলেন বা আছেন, তাঁরা আমার নাম অ্যাপ্রুভ করেন না । আমার বই যাঁরা প্রকাশ করেছেন তাঁরা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ; তাঁদের নেটওয়র্ক তেমন ভালো নয় । ইনটারনেটে আমার প্রচুর লেখা রয়েছে ; সেগুলো নিয়ে বই করলে গোটা পঞ্চাশেক বই হয়ে যাবে । প্রতিভাস বলেছে আমার বই একে একে প্রকাশ করবে কিন্তু কবে করবে জানি না । হাংরি আন্দোলন নিয়ে এখন বেশ কয়েকটা বই আছে-- যারা আগ্রহী তারা ঠিকই যোগাড় করে পড়ে । হাংরি নিয়ে গবেষণাও তো হচ্ছে বিদেশের আর পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে । 


জয়িতা :  "ক্ষুধার্ত আন্দোলনের" একেবারে গোড়ার কথা যদি একটু বলো এবং কোন ঘটনা ও পরিস্থিতিতে এই ভাবনার জন্ম সেটাও একটু বলো। :প্রসঙ্গত এটা মনে হলো "ক্ষুধার্ত " শব্দটির পরিবর্তে "হাংরি" ,যা কিনা সংকরায়িত একটি শব্দ এটি কেন ব্যবহার করতে হলো। সেটা কী আন্তর্জাতিকতা আনার জন্য?


মলয় : গোড়ার কথা তো বহুবার লিখেছি নেটে আর প্রিন্ট ম্যাগাজিনে । উইকিপেডিয়ায় বাংলাদেশের কোনো  সম্পাদক যা লিখেছেন সেটা পড়াচ্ছি, তাহলে আর নিজের ঢোল পেটাবার প্রসঙ্গ উঠবে না । “বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে ভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেয়া তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি । আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তারা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ।”


জয়িতা : আরেকটু বিশদ করো।


মলয় : আবার উইকির হাংরি প্রজন্মের পাতাটাই পড়াই, এটা সেকেণ্ড প্যারা, “মলয় রায়চৌধুরী হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে , অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তিনি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন । তাত্ত্বিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । সেকারণে মলয় রায়চৌধুরীকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে মনে করা হয় । হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স।তারা বললেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত ।" তারা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্থানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক ননগদনতন্ত্রের আগেকার প্রাক-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষ্যণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।”


জয়িতা :ভাবগত কল্পনার জগত ও আত্মোপলব্ধি নয় সরাসরি জৈবিক তাড়না, জীবন যন্ত্রণার প্রতি স্তরের অভিব্যক্তি কে হুবুহু তোমরা তুলে ধরতে চেয়েছ, ধ্বনি ও শব্দ পরিশিলীত ও আরোপিত না করে, একেবারে নগ্ন এই উপস্থাপনার পেছনে হাংরি ফিলোসফির কথা শুনতে চাই । 


মলয় :  আমার ছোটোবেলা কেটেছে ইমলিতলা নামে পাটনা শহরের এক বস্তিতে, যে-পাড়ায় থাকতো বিহারি অন্ত্যজ আর অত্যন্ত গরিব মুসলমানরা, যারা একটা উৎসবে পরা পোশাক পরের উৎসবে পালটাতো । তাদের কাজ ছিল চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, পিম্পগিরি, মেয়েদের বেশ্যাগিরি ইত্যাদি । পাড়াটায় নিষিদ্ধ বলে কিছু ছিল না যার দরুন আমি মধ্যবিত্ত বাঙালি মূল্যবোধের বাইরে গড়ে উঠেছি আর তাই ওই জীবন আর বাকজগত আপনা থেকে এসেছে আমার লেখালিখিতে । ইমলিতলার বাড়িতে একটা কুয়ো ছিল আর পাড়ার বউরা তাকে ঘিরে যে গানগুলো গাইতো তাকে বাঙালিরা বলতো অশ্লীল আর নোংরা, ওই যাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন গা রি রি করে, সেরকম । পাড়ার প্রভাবে দাদা খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে বাবা ওনাকে কলকাতায় সিটি কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা যে যার জীবন থেকে লেখার মাল-মশলা এনেছে ; তুই শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, অবনী ধর, দেবী রায়, সুবিমল বসাক প্রমুখকে পড়লেই টের পাবি যে দর্শনটা প্রত্যেকের জীবন থেকে পাওয়া ।


জয়িতা : যে কোনো আন্দোলন তার রেশ রেখে যায় ভবিষ্যতের কাছে তাই কোনো আন্দোলনকে ব্যর্থ বলা যায় না বিশেষত হাংরি আন্দোলনকে । কিন্তু দুঃখের বিষয়ে প্রথম পর্বের হাংরি পত্রিকাগুলি কেন সঠিকভাবে সংরক্ষণের কথা কেউ ভাবলেন না। উল্লেখযোগ্য পত্রিকা যেমন তোমার "জেব্রা ", সুবিমল বসাকের "প্রতিদ্বন্দ্বী " ,ত্রিদিব মিত্র র"উন্মার্গ", কেন হারিয়ে গেল দেবী রায়ের "চিহ্ন"অথবা প্রদীপ চৌধুরী র "ফুঃ", আলো মিত্রর ‘দি ওয়েস্ট পেপার’। কেন এই বিস্মরণ ?


মলয় : “জেব্রা” কেবল দুটো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ; সম্প্রতি মুর্শিদ ‘অখণ্ড জেব্রা’ প্রকাশ করেছে। প্রদীপ চৌধুরী মৃত্যুর আগে পর্যন্ত “ফুঃ” প্রকাশ করেছে, তবে মামলার পরে প্রদীপ ওটাকে ফরাসী আর ইংরেজিভাষী পত্রিকায় পালটে ফ্যালে---ফ্রান্সে ও বেশি পরিচিত ছিল । অন্য পত্রিকাগুলো সমীরণ মোদক সংগ্রহ করেছে কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছে না । সম্পাদকরা কেউই ভাবেনি যে এককালে হাংরি আন্দোলন খ্যাতি পাবে আর তাদের পত্রিকার চাহিদা হবে । বুলেটিনগুলোও পাওয়া যায় না --- মামলার সময়ে ভয়ে অনেকে ফেলে দিয়েছে সেগুলো । মুর্শিদাবাদের এবাদুল হক বেশ কয়েকটা বুলেটিন সংগ্রহ করে বই বের করেছিলেন ।


জয়িতা :কলকাতার প্রতি তোমার তীব্র অভিমান যথাযথ। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্রমণ ছাড়াও হাংরিয়ানদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়। এই বিষয়ে নানা গসিপ,নানা মত। এই মতবিরোধের ফলশ্রুতি আন্দোলনে ভাঙন সম্পর্কে একেবারে স্পষ্ট কথা শুনতে আগ্রহী।


মলয় : এই প্রশ্নের উত্তর অজিত রায়ের প্রবন্ধ থেকে দিই, “মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।” কলকাতার প্রতি অভিমান বলতে তুই যা বোঝাতে চাইছিস তা রয়েছে প্রতিটি সাবর্ণ চৌধুরীর রক্তে, কেননা পরিবারটা বাধ্য হয়েছিল কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ইজারা কোম্পানিকে লিখে দিতে।


জয়িতা : হাংরিদের পরস্পরের মতবিরোধ তাদের রচনার চেয়ে বেশি চর্চিত । এই বিষয়ে কী বলবে? ১৯৬৫ র পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও পরিবর্তিত রূপে হাংরিয়ালিস্ট কিছু পত্রিকা বেরোতে শুরু করে যেমন,অরুনেশ ঘোষের ‘জিরাফ’, আলোক গোস্বামী র "কনসেনট্রেশন ক্যাম্প", উত্তরবঙ্গের পত্রিকা ধৃতরাষ্ট্র,  রোবট। এই পত্রিকাগুলি র সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কতটা এবং তোমার মতামত কি। পত্রিকাগুলি কতটা হাংরি ভাবাদর্শ অনুকরণে নির্মিত।


মলয় : মতবিরোধ ডাডাবাদী, সুররিয়ালিস্ট, বিটনিক এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতেও ছিল। কৃত্তিবাস থেকে আনন্দ বাগচী আর দীপক মজুমদারকে ক্লিক করে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল । এতোগুলো মানুষ জড়ো হলে মতবিরোধ হবেই । হাংরি আন্দোলনে যারা সরকারি সাক্ষী হয়েছিল তারা আমার বিরুদ্ধে লিখতো । সুভাষ ঘোষকে মারধর করা হলো । উত্তরবঙ্গে অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, মনোজ রাউত, সমীরণ ঘোষ, জীবতোষ দাশ, দেবজ্যোতি রায় প্রমুখ আবার জাগিয়ে তুলছিলেন আন্দোলনটা কিন্তু শৈলেশ্বর লোক পাঠিয়ে তাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । অরুণেশ ঘোষ যখন উত্তম দাশের মহাদিগন্ত পড়ে সবকিছু জানতে পারলো তখন নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিল । আমি উত্তরবঙ্গে সেই সময় যাইনি, তাই ওনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি । ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ পত্রিকায় সম্ভবত লিখেছিলুম । অলোক গোস্বামীকে বাড়ির গেট থেকে শৈলেশ্বর ঘোষ তাড়িয়ে দেবার পর ও বন্ধ করে দিয়েছিল পত্রিকাটা। ওদের লেখাপত্র ভালোই এগোচ্ছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ কেন যে অমন কুচুটে ছিল কে জানে, কেননা কবিতা যা লিখতো তা এক কথায় আউটস্ট্যাণ্ডিং । 


জয়িতা :জানতে চাই আলো মিত্র র হাংরি  ইংলিশ জার্নাল  " দি ওয়েস্ট পেপার "সম্পর্কে।


মলয় : আলো ছিল ত্রিদিব মিত্রের প্রেমিকা । সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক বোল্ড । আলো চাকরি করতো বলে ইংরেজি পত্রিকাটা বের করার সুবিধা হয়ে গিয়েছিল ।  ওদের দুজনকে বাদ দিয়ে সুভাষ-শৈলেশ্বর-বাসুদেব ‘ক্ষুধার্ত’ আরম্ভ করার পর ওরা বিরক্ত হয়ে লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিল । ‘দি ওয়েস্ট পেপার’ পত্রিকার কারণে আমরা বিদেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পেরেছিলুম । আলো আর ত্রিদিব এখন হাওড়ায় নিজেদের বাড়ি তৈরি করে সেখানেই থাকে । আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই । সুবিমল বসাক বলছিল ফোন করলেও যৎসামান্য কথা বলে রেখে দ্যায় । নন্দিনী ধর নামে একজন লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনে শুধু একজন মহিলা ছিলেন কেন ! উনি ওনার ঠাকুমা-দিদিমার বয়সী কবিদের জিগ্যেস করলেই পারতেন যে তাঁরা কেউ কেন হাংরি আন্দোলনে যোগ দেননি ।


জয়িতা :হাংরি আন্দোলন বিদেশি প্রভাবিত এমন শোনো যায়। বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার তখনই প্রকাশিত হয়েছিল । র‌্যাঁবো, ভেরলেন, বোদলেয়ারের জীবনযাপন কি আকৃষ্ট করেছিল তোমাদের ? প্রসঙ্গত অ্যালেন গিনসবার্গ এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় কীভাবে এবং তাঁর কতটা অবদান এই আন্দোলনে।


মলয় : উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য বিদেশি প্রভাব ছাড়া আরম্ভ হতো না । গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক সবই তো বিদেশ থেকে এসেছে । বঙ্কিম আর মধুসূদন ইংরেজিতেই লেখা আরম্ভ করেছিলেন । বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেন প্রমুখকে আমি পড়েছি ইংরেজিতে । আগেই তো বললুম, আমার জীবন ইমলিতলা পাড়ার দ্বারা প্রভাবিত । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর গিন্সবার্গ আমাদের পাটনার বাড়িতে এসেছিল ১৯৬৩ সালে । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির পত্রিকায় আমাদের কবিতা আর মামলার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর ফেরলিংঘেট্টি আমাকে ‘হাউল’ আর ‘ক্যাডিশ’ পাঠিয়েছিল । যে লেখকরা প্রভাবের কথা বলেন তাঁরা নিজেদের লেখার কাঠামো কোথা থেকে এলো তা ভাবেন না । এমনকী সনেট, ভিলানেল, লিমেরিক লেখকরাও অমন আরোপ করেন ।


জয়িতা :ব্যক্তিগতভাবে তোমার উপন্যাস আমার অনেক বেশি প্রিয়। " Ahead of time". প্রথম উপন্যাস কবে এবং কোন ভাবনা থেকে লেখা ?


মলয় : আমার প্রথম দিকের সব উপন্যাসই জীবনের ঘটনা থেকে নেয়া । পরে নানা জেনারের উপন্যাস, যেমন ইরটিক, ডিটেকটিভ ইত্যাদি লেখার সময়ে ঘটনা তৈরি করেছি । অবশ্য তাতেও নিজের জীবনের ঘটনা মিশিয়েছি। প্রথম উপন্যাস লিখেছিলুম নব্বুই দশকের প্রথম দিকে, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, নোট নষ্ট করা আর পোড়ানোর পৃষ্ঠপটে, কর্মী বন্ধু-বন্ধুনীদের নিয়ে । দাদা “হাওয়া৪৯” পত্রিকা আরম্ভ করে একটা উপন্যাস লিখতে বলেন, তখন লিখি ; ওটা অনেকবার রিপ্রিন্ট হয়েছে  ।


জয়িতা : প্রবন্ধকার হিসেবে তোমার কথা পাঠক কম জানে। প্রবন্ধকার মলয় রায়চৌধুরী ও ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরীর জনপ্রিয়তা তেমন নেই কেন ?


মলয় : প্রকাশক পাই না তো লোকে জানবে কেমন করে ? নামকরা প্রকাশক না পেলে পাঠকদের কাছে পৌঁছোনো যায় না । প্রতিভাস যে তিনটে বই বের করেছে, সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গেছে বলে শুনেছি । প্রতিভাসও তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বহু দূরে । কবিতা জায়গা পায় লিটল ম্যাগাজিনে । উপন্যাস পায় না । আর জনপ্রিয় হতে গেলে পাল্প ফিকশান লিখতে হবে, যা আমি পারি না ।


জয়িতা :তুমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী নও ;  প্রতিষ্ঠান তোমার বিরোধী কেন ? তোমার লেখক-সত্ত্বা কলকাতার সাহিত্য-সমাজ দীর্ঘদিন অবদমিত রাখার প্রচেষ্টা করেছে । কেন ? কিসের ভয়?


মলয় : নিছক সাহিত্যিক রাজনীতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ; যেমন গানের রাজনীতি দেবব্রত বিশ্বাসকে চেপে দেবার চেষ্টা করেছিল, বড়ো মাপের কাপ্তান আর মাস্তানরা তা করেছিলেন । আনন্দবাজার পত্রিকা তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী । অধ্যাপক অভীক মজুমদার লিখেছেন, “‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে (১৯৬৬) মধ্যচৈত্রে। কবিতার সংখ্যা ৭১।  ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত, প্রচলিত সমাজ-সংসার-সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধ আর ভণ্ডামিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার গনগনে গর্জন। এক ছন্নছাড়া, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, উদ্ধত তরুণের সঙ্গে কাব্যসংলাপে সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, ওই কবিতা থেকে আর মন সরাতে পারলাম কই?” আনন্দবাজার যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে চালাতে চায়, তাহলে আমাকে ওরা ওদের বিরোধী বলেই মনে করবে । সুনীলের এই বইটার কবিতাগুলো হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে লেখা --- হাংরিদের টক্কর দেবার চেষ্টায় ।


জয়িতা : হাংরিদের প্রভাব সম্পর্কে বলো ।


মলয় : সুনীল নিজেই হাংরিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যৌনতার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । উনি লিখলেন, “শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি/মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি।” হাংরি আন্দোলনে পুলিশের মামলা দায়েরের পরেই কৃত্তিবাস একটা যৌন কবিতা সংখ্যা বের করেছিল ; সেটা যে হাংরিদের প্রভাবে, সেকথা প্রতিষ্ঠানের আলোচকরা চেপে যায়। পরবর্তীকালে মহিলা কবিরাও প্রভাবিত হয়েছেন । যেমন চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “যার কোন উত্থানপতন নেই, আমি সেই /ছাতাপড়া অঙ্গটিকে গড় না করতেই পারি/যদ্যপি সে আমার স্বামীর।” সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কাটাকুটি খেলতে গিয়ে বরাবর ভুল ঘরে ভুল গোল্লাগুলি বসিয়েছ । দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছ নিজের দুই ঠোঁট।জ্যান্ত শুক্রবীজগুলি মুখে শুষে নাও আজ আর থুৎকারে থুৎকারে ছুঁড়ে ফেলে দাও।” সুতপা সেনগুপ্ত লিখেছেন “তোমার নরম ভারি শরীরের নীচে শুয়ে/ফিরে আসছে আমারও পুরনো/খেলা ও  খেলুড়িপনা, পুরুষ ছোঁয়ার মজা/শঙখ লাগা অমৃত ছোবল/তুমিও কী অপরূপ শিখে নিচ্ছ ভাঙাগড়া/ঠোঁটে কামড়ে বুকে পিষে ফেলে/বলেছ রোয়াব নিয়ে, আমিই শাসন করব/কিছুই বোঝ না, বাচ্চা ছেলে।” রাজশ্রী চক্রবর্তী লিখেছেন, “

ডিম পাঁউরুটির মত জীবনে, তুমি এলে / একটি হলুদ রঙের কলা / নিটোল আকার দেখে, বিশ্বাস করো, / ভারি খিদে পায়।” অনুরাধা মহাপাত্র লিখেছেন, “  সঙ্গমে ভিন্ন কোন আলো নেই- প্রকৃতি অথবা ঈশ্বরের/উপবাস ও পূজার কোন চিদাকাশ নেই/ আত্মত্যাগ, আত্মহত্যা উভয়ই সমান/

প্রেমিকের মাথা আকাশে তুললেও তবু মুখ,/  নেমে আসে অন্ধ পুকুরে।” শবরী ঘোষ লিখেছেন, “এক্ষুণি একজন পুরুষ চাই আমার/  রাত্রি যেভাবে সূর্যের সঙ্গে মেলে/ সেরকম সম্পূর্ণ মিলনের জন্য চাই/ তবু প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত/ ঠিক নিরানব্বই জন হিজড়ের সঙ্গেই শুধু/ ঘুরে ফিরে দেখা হয়ে যায় আমার !/ হায় হিজড়েরা সঙ্গম জানে না।/ এখনই একজন যথার্থ পুরুষ চাই আমার/

 আমি তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছি !”


জয়িতা : আর গদ্যে ?


মলয় : আমি প্রবুদ্ধ ঘোষের লেখা থেকে তোকে শোনাচ্ছি, তাহলে টের পাবি : “আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে-- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের এই আন্দোলনের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তা’লে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবেনা বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। বুঝে নেওয়া দরকার হাংরি-প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনের নিভন্ত আগুন এবং সেই আগুনে শাসক-রাষ্ট্রের ক্রমাগত শান্তির জল ঢেলে যাওয়া; অথচ সেই নিভু আগুনের থেকে ফিনিক্সের জেগে ওঠা। নিওফ্যাসিজম্‌ বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভাবে দখল চালানো তো বটেই, তার সাথেই থাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আগ্রাসন। আর, পুঁজিবাদ নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তার উৎপাদন-পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, তেমনি সাহিত্যকেও যেহেতু পুঁজিবাদ পণ্য হিসেবেই দেখে, তাই তার উৎপাদন-কৌশলেও নতুন ফর্মুলা নিয়ে আসতে চায়। আর, সেই ফর্ম্যুলার অন্যতম হল, একদা যা ছিল প্রান্তিক, যা ছিল শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সের’ বাইরে, তাকেই কেন্দ্রের দিকে ঢুকিয়ে দেওয়া, শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সে’ তাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া। হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের সময় যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি তাদের ‘প্রান্তিক’ করে রেখেছিল, পরে সময়-সুযোগ বুঝে তাকেই প্রতিষ্ঠানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে নেয়। অ্যাণ্টি-কাল্‌চার ও কি বাজার-কাল্‌চার এ ঢুকে পড়ে? যখন তার প্রভাব এড়ানো যায়না আর, যখন ছাই হয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে ওঠে ফের তার ভাষা-সংস্কৃতি তখন বাজার নতুন ভাবে নামে? প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় বিগত সব প্রত্যাঘাতগুলো? একদা ‘ওরা অশ্লীল’ বলে চেঁচানো সাহিত্যিকেরাও লিখে ফেলেন হাংরি-দের কথা। বাণিজ্যিক ছবি হয়, সেখানে হাংরি-লেখক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রুফ-চেক্‌ করাতে মুখিয়ে থাকে। এ-ও তো এক সংস্কৃতি। প্রতিস্পর্ধাকে নমনীয় করে, দোষারোপ গুলোকে বড়ো করে প্রতিস্পর্ধী-সংস্কৃতর ‘সংস্কৃতি’-কে ভুলিয়ে দেওয়া। কারণগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া, প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতকে গুলিয়ে দেওয়া। ক্ষুধার্ত কবিরা দেখেছে প্রতিশ্রুতির গলিত শব, দেখেছে একের পর এক মিছিল ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার হয়ে যায়।  বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় লেখকের নয়। হাংরি লেখকেরা তাঁদের লেখালেখিতে জোর দিচ্ছেন পাঠের ওপর। অর্থাৎ, লেখকের ভাষাগত চাতুর্য, শব্দলালিত্য আর বিচার্য নয় বরং বিচার্য পাঠবস্তুটি। ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে হাংরি-দের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রানিং কমেণ্টারির মতোন অর্থাৎ, চলন্ত ধারাভাষ্যের মতো সাহিত্য। যা ঘটছে, যা অভিজ্ঞতা সেটাকেই গল্প বা কবিতায় তুলে আনা। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোসহ বহু প্রাচীনপন্থীর মতামত এই ছিল যে, কবিতা বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অথচ, হাংরি-দের কবিতা পড়লে কিন্তু তার উল্টোটাই মনে হয়। বড়ো বেশিই যেন বাস্তবের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে পাঠককে, সঙ্গে নিজেরাও। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে হইহই করে লেখক নিজেকেও এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লেখার মধ্যেই। এর ফলে কবিতার চিরাচরিত সম্বোধক-সম্বোধিত বা অ্যাড্রেসার-অ্যাড্রেসি নিয়ম ধাক্কা খাচ্ছে। সাহিত্য আর ততটা দূর থেকে বসে, নিরাপদে লেখার বিষয় থাকছে না; যখন পৃথিবী পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে তখন লেখাও পুড়তে বাধ্য। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়।  হাংরি-দের লেখায় আত্ম-কে আবিষ্কার, জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা অন্য কোথাও, তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো। ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখাকে বিশ্লেষণ না করেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে তাকেই আত্তীকরণ করে বাজারজাত পণ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা।”   


জয়িতা : তোমার নতুন পর্যায়ের কবিতার মানুষী ‘অবন্তিকা’ একেবারে জৈবিক ও মাটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। নেই পূর্বতন কবিদের মত নেবুলাস কল্পনা ও সৌন্দর্য পূজা। এই ব্যাপারে একটু জানতে চাইব।


মলয় : না, অবন্তিকা বনলতা সেন, নীরা, সুপর্ণা নয় । অবন্তিকা ভারতীয় পুঁজিবাদের সৃষ্টি, যাকে তুই সর্বত্র দেখতে পাবি । টিভির পর্দায়, গ্লসি পত্রিকায়, পেজ থ্রি সমাগমে, করণ জোহর-ফারহা খান টাইপের সিনেমায়, মল-মালটিপ্লেক্সে, ট্রেন দুর্ঘটনার মাংসপিণ্ডে, রুজি বাঁচাবার ধান্দায় জরায়ু কাটিয়ে ফেলা মেয়ে শ্রমিকে, সন্ধ্যার যৌনকর্মী পাড়ায়, রেভ পার্টিতে, প্লাস্টিক সার্জারির ডাক্তারের চেম্বারে, জামাই ষষ্ঠীর বাজারে, সংবাদপত্র দপতরে, কফিহাউসে, অ্যাকেডেমি-নন্দন চত্তরে । 

   









































                       

           

       


                           

       


  



হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...