Saturday, March 30, 2019

সমীর রায়চৌধুরীর গালগল্পের দ্রব্যগুণ : জপমালা ঘোষরায়

 

সমীর রায়চৌধুরীর গালগল্পের দ্রব্যগুণ
------------------------------------------------------

জপমালা ঘোষরায়

# কলকাতার আদিপুরুষ সাবর্ণ চৌধুরীর বংশধর সমীর রায়চৌধুরী নামক বিস্ময়পুরুষের সাহিত্যকর্মের প্রতি আগ্রহ লালন করেছিলাম একেবারেই কলজছাত্রীবেলা থেকে। আমার বাবা, ৫০ এর দশকের রবীন্দ্র অনুসারী কবি। তাঁর কাছে শুনেছিলাম সমীর রায়চৌধুরী হাংরী সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা এবং অনেক পরে, ৯০ এর দশকে এসে জানলাম তিনি বাংলা পোস্টমডার্ন সাহিত্য আন্দোলনেরও পথিকৃৎ। তখন পড়ার সুযোগ বলতে কালে ভদ্রে কলেজস্ট্রিট গিয়ে কিছু বই সংগ্রহ করা। তাও মেইন স্ট্রিমের লেখকদের বই পাওয়া গেলেও ওঁর মতো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কোনো লেখকের বই তেমন পাওয়া যেত না। কাজেই বুভুক্ষা থেকেই গেছিল। পরে যে আর পাঁচজন সাহিত্যসেবকের মতো আমিও তাঁর সরাসরি স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করবো এই চমৎকারের কথা কখনো চিন্তাও করিনি। বন্ধু কবি ও প্রাবন্ধিক মৌলিনাথ বিশ্বাসের সাহায্যে এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ /ছ বছরে এসে। বলা যায় আমিই বোধ হয় শেষতম সেবক যাঁরা তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। তাঁর অজস্র গল্প প্রবন্ধ এবং কবিতা পড়ার সুযোগ যত পেয়েছি, যত তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করেছি, ততই খুলে গেছে সিমসিম। পরে সম্পাদক মৌলিনাথ আমার মত দীন কলমজীবীকে দিয়ে সমীরের জীবিতাবস্থায় তাঁর গল্পের আলোচনা লিখিয়ে নিয়েছিলেন "কালকথা" পত্রিকায়। কোনো জীবিত কিংবদন্তীকে নিয়ে লিখতে গেলে ভয়টা থাকেই সুতরাং পড়াশুনোয় কোনো ফাঁকি চলে না। সমীরের অনেক লেখালিখির মধ্যে "খুল যা সিমসিম" গল্পগ্রন্থ এবং "অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়" কাব্যগ্রন্থ দুটি মাত্র মনোযোগ দিয়ে পড়লেই আন্দাজ করা যাবে সমীর রায়চৌধুরী নামক সমুদ্রের ব্যাপ্তি ও গভীরতা। সবচেয়ে বড় ছিল তাঁর কথা বলার অসামান্য ভঙ্গী, কখনো ব্যাপ্তি থেকে শিকড়ের দিকে আসছেন পরক্ষণেই শিকড়কে রেখে দিয়ে ঘাসবিন্যসে চলে যাচ্ছেন ব্যাপ্তির দিকে। এই বিপ্রতীপ ধরতাই থেকেই সমীর রায়চৌধুরীর লেখনবিশ্বকে জানতে হবে। সমীরের জন্ম ১লা নভেম্বর ১৯৩৩ পানিহাটিতে, পরবর্তী সময় কাটিয়েছেন বিহারের পাটনা শহরে, অর্থাৎ দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান তাঁর মননকে বায়নারি থটপ্রসেসের মধ্যে লালন করেছে, যুক্তির ফাটল বা লজিকাল ক্র‍্যাক থেকে চিন্তার বিস্তারে সাহায্য করেছে। ফলত তাঁর গল্প একটা মাল্টি অ্যাঙ্গুলার ভঙ্গিমা পেয়ে গেছে এবং ভঙ্গিমা বাঙালীর আড্ডাখানার শুরু শেষ হীন চিরকেলে গালগল্পের মতো। এ প্রসঙ্গে বলি সমীরের গল্প সম্পর্কে "গালগল্প" শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাঁর ভাই, বিখ্যাত সাহিত্যিক "হাংরিপুরুষ" মলয় রায়চৌধুরী।

# একসময় মনে করা হত ছোটগল্পের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল তাৎপর্যে পৌঁছানো এবং তারজন্য চাই শক্তপোক্ত ঘটনা, স্থান কাল অনুযায়ী চরিত্র। কিন্তু এখন যেহেতু জীবন রিমোট কন্ট্রোলে বদলে বদলে যাওয়া চ্যানেল, হাজারো অ্যাপ এ ডাউনলোড করে ফেলা চমৎকার, তাই এখনকার গল্প অন্যরকম। এখন গল্পে নানারকম টুকরোটুকরো উদঘাটন বীজের মতো ছড়িয়ে যায়। জীবনের পাজলগুলো কুড়াতে কুড়াতে "আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে"। সমীরের গল্পে সমীর এভাবেই খোঁজেন সেল্ফ আইডেন্টিটি। খোলাখুলি বলতে কি, সমীরের লেখালিখিতে, তাঁর বোধের পুঁজিতে, গঠনকাঠামোয় কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকতার ছোঁয়া মাত্র নেই। আছে কালখন্ডের ক্ষয়, নিরন্তর শূন্যতা, গ্লানি ও হতাশার বিরুদ্ধে দ্রোহ। কিন্তু এই দ্রোহের উচ্চারণ উচ্চকিত, মানে ফাটিয়ে দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা নয়, এই দ্রোহ প্রত্যয়ী উচ্চারণে মজা শ্লেষ কৌতুকের রীতিতে ভাষাশব্দ ও লেখনবিশ্ব নির্মাণের। সরাসরি বলাই ভালো, সৎসাহিত্যের গুহামুখ খুলে দিয়েছে সমীর রায়চৌধুরীর গল্পবিশ্ব।

# সমীরের গল্পে অন্ধকার ততটা অন্ধকার নয়, শূন্যতা ততটা শূন্যতা নয়। শূন্যদশকে লেখা তাঁর একটি সাড়া জাগানো গল্প "মেথিশাকের গন্ধ" শুরুর আগে তিনি কোনো প্লট ভাবেন নি। তিনি ভাবেনও না। একটা বিষয়হীনতা দিয়েই শুরু করেছেন। কলকাতার নর্দার্ন পার্ক, ব্রহ্মপুরের বাড়িতে হঠাৎ লোডশেডিং এবং নিশ্চিদ্র অন্ধকার বাড়ি। তিথিগত আঁধারে আকাশের আলোটুকুও নেই। বসার ঘর থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আপাত অদৃশ্য অথচ ঘ্রাণ আছে এমন এক "সামথিং"কে ইডিকেট করে তাঁর থটপ্রসেস বহুস্তরীয় অন্ধকারকে বহু কৌণিকতায় বিশ্লেষণ করতে করতে জীবনধর্মের মুক্তমুখে এগিয়ে যাচ্ছে।"একজায়গায় গিয়ে নিশ্চয়ই মেথিশাকের গন্ধের সঙ্গে শেফালির উপস্থিতির জৈব গন্ধ মিশবেই" এটাই জীবনমুুুুখীতা। একথা চিন্তা করতে করতে অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই গল্পকার এগোচ্ছেন, যেখানে মেথিশাক রান্না করতে করতে হঠাৎ ঘটে যাওয়া অন্ধকারে শেফালির হাত থেকে একটি কাঁচের শিশি পড়ে ভেঙে চুড়মার হয়ে যাচ্ছে এবং শেফালি অন্ধকার ভেদ করে চেঁচিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে "এদিকে এসো না"। অর্থাৎ অন্ধকারে একজনের অভ্যস্ত যাপনেও ভাঙচুর আসছে। আবার নিমেষেই ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল দৃশ্যমান যা কিছু। সমস্ত "সামথিং" তখন "নাথিং" হয়ে গেল। এখান থেকেই উঠে আসছে একটা জাদু বাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়্যালিজম, অন্ধকারের বহুস্তর। একস্তরে শৈশবে মায়ের শেখানো সাবধানবাণীতে জুজুবুড়ি আর খোক্কস ভয়, আবার রাঙাদিদুর গপ্পে সেই খোক্কসজয়ের নির্দেশনা, এটা একটা স্তর। তার পরই রাঙা দিদুর মৃত্যুর পর মা যখন বললেন দিদু অন্ধকারের দেশে চলে গেছে, এবং সমীরের মনে হল কত প্রিয়জন সেই অন্ধকারের দেশে চলে গেল "সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাসা তৈরি হল" এটাও একটা স্তর। এভাবেই অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে মনে হল মা এবং ছোড়দির কথা যাঁরা মেথিশাক ভালোবাসতেন। "অন্ধকারের কত অলিগলি, অন্ধকারের মধ্যে একধরণের ফাটল"। এই প্রসঙ্গে এই অদৃশ্যের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে শিল্পী অমিতাভ ধরের ছবি। ম্যাজিকাল রিয়্যালিটি। দুদিন আগে অন্ধকারে চলে যাওয়া শিল্পী বাঁধন দাসের থিওরি মনে আসছে "বাঁধনের কথা আজ খুব বেশী করে মনে পড়ছে। মাত্র দুদিন হল সে মারা গেছে।.......বাঁধন বলত অন্ধকারের স্থানিকতা। স্পেস যেভাবে সম্পর্ক গড়ে"। মেথিশাকটা আসলে এই গল্পে কোন বিষয়ই নয়। মেথিশাকের গন্ধকে কেন্দ্রকরে ভেদের শনাক্তকরণ থেকে অভেদের দিকে যাত্রা। এভাবেই বহুস্তর ভেদ করতে করতে শেষে এসে বললেন ডাইনিং টেবিলের কাছে একফালি শীতরোদ্দুর যেমন খুব চেনা এবং এবাড়ির নিজস্ব সম্পদ, তেমনি অন্ধকারটুকুও চেনা জানা, এবাড়ির নিজস্ব, যার সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই। সে হল "কালো রঙের কাজ"। প্রি-মডার্নের মতো আলোর বিপরীত অন্ধকার তো নয়ই, পাস্ট-মর্ডান বা আধুনিকোত্তরের মতো আলোর পরিপূরকও না। এখানে দুটোই সহজ এবং সমান (আলো= অন্ধকার)। এভাবেই যেখানে ছেড়ে দিলেন সেখানে অন্ধকার আনবাউন্ড, এন্ডলেস এবং আলোর চেয়েও আলোকিত হয়ে উঠল। এটাই সমীরের গল্পহীন গল্পের অভিনবত্ব এটাই পোস্টমডার্ন।

# সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের নামকরণগুলিও অন্যরকম, যেমন, বহুজাতিক ভূতের গল্পের খসড়া, শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন, স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা ওমলেট অবধি, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুকখু, কবিরাজ চাঁদচুড়ামণি শ্রীব্রজেশচন্দ্র কথিত দ্রব্যগুণ, একমিনিট বিয়াল্লিশ সেকেন্ড ওসামা বিন লাদেনের ক্যাম্পে ইত্যাদি। বোঝা যাচ্ছে নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক। সমীরের গল্পকে গালগল্প বলার কারণ হল তিনি কোনো প্লট ভেবে নিয়ে গল্প লিখতে বসেন না। কোনো কাল্পনিক চরিত্রও থাকে না। তিনি নিজে একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তি সমীরের জীবনের অভিজ্ঞতার সূতোগুলোকে টেনে টেনে এনে জুড়ে দেন গল্পের মধ্যে। প্রসঙ্গক্রমে অনেক বাস্তব চরিত্র এসে যায়। কিন্তু তারা এমন ভাবে আসে যে তাদের কোনো কৈফিয়ত ও থাকে না। বা কৈফিয়তি দায়টাও সমীরের থাকে না। যেমন শুভাপ্রসন্ন, বাঁধন দাস, অমিতাভ ধর, কালীকৃষ্ণ, শ্যামল মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি যথাযথ ভাবেই তাঁর গল্পে আছে। আবার খুল যা সিমসিম গল্পের চাবিওয়ালা আসগর আসলে চাবিওয়ালা আসগরই। অন্য কেউ না। কিন্তু তার উপস্থিতি, ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদি নিয়ে চরিত্রটিকে এমন অদ্ভুত ম্যাজিক্যালি রিয়্যাল করে তুললেন যে সে একটা গল্প হয়ে উঠল। প্লট বিহীন গল্প।

# "বহুজাতিক ভূতের গল্পের খসড়া" একটি খসড়া মাত্র নয়, বিশ্বায়নের হাজারো বাস্তব মজার মধ্যে একটি ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক মজা। সমীরের লেখায় এই ঐতিহাসিক ধরতাইটাই অ্যাবসলিউট সত্য। জীবনের কত দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর্যোগ, কত জ্যোৎস্না মেঘ কুয়াশা, অন্ধকারের ফাটল দিয়ে তিনি সব ম্যাজিকের মত দেখতে পান এবং সেভাবেই দেখান পাঠক বা শ্রোতাকে। কোনো পাব্লিশার প্লিজ আহত হবেন না! আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। বইপাড়ার ব্যবসা নিয়ে সমীরের যা মনে হয়েছে আমি তার বিশ্লেষক মাত্র। এখানে কার্তিক নামের লোকটি বইপাড়ার পেশাদার ভৌতিক গল্প লিখিয়ে। বোধোদয় নামক দোকান অথবা সংস্থা থেকে তার জন্য রেডিমিক্স প্যাকেটে ভূতের গল্প লেখার অর্ডার এসেছে। ছবিছাবা সহ থিম দেওয়া আছে সেই অনুযায়ী গল্পের প্লট ভাবতে হবে। বাজারে কী ধরণের ভূতের গল্পের কাটতি আছে সেই অনুযায়ী অর্ডার। ছোটোদের ভূতের গল্প কার্তিক অনেক লিখেছে কিন্তু এবার তাকে লিখতে হবে বড়দের ভূতের গল্প, তাও আবার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডকে সামনে রেখে বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল বা বহুজাতিক ভূতের গল্প। সমীর কোনো চরিত্রকে কখনো আঘাত করেন না বরং একটা সহজ আনন্দময়তায় ছড়িয়ে দেন। কিন্তু মুশকিলটা হল কার্তিকের ভূতের গল্পের খসড়া আর জমে না কিছুতেই। হাজার চেষ্টা করেও সে বহুজাতিক ভূতকে নামাতে পারেনা। " বোধোদয় বলে এমন তো হওয়ার কথা নয়। নামকরা ব্র‍্যান্ডনেম। সবচেয়ে বেশী কাটছে। প্রশ্ন করে আবছায়া ছিল? -- হ্যাঁ, আর পোড়োবাড়ি? -- সেও ছিল। নিশাচর চলাফেরা? -- ছিল বৈকি, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখু? --- তাও তো ছিল..... তাহলে অসুবিধা টা কোথায়?.... কার্তিক বুঝতে পারে না শেষ পর্যন্ত সেল্ফমেডের প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরে.... কেবলই অনুমেয়র দিকে তাকিয়ে আরও আরও... ভূতভাবনের বহুব্রীহি।.... একদিন পেয়ে যাবে। ধরা ছোঁয়ায় আসবে মনের মতো ভূত..." এভাবেই একটা ফ্যান্টাসি, এক আনন্দময় জগতের চলা ফেরার কথা। একটা সমস্যার কথা বলা হল কিন্তু কোনোরকম ক্যাওস ছাড়া, তছনছ ছাড়াই একটা ম্যাজিক রিয়ালিজমের মোড়কে।

# কালখণ্ডের চমৎকার কৌতুক হল বুদ্ধিজীবীদের বাজারায়ন তথা বিশ্বপুঁজিবাদ। একথা বোধহয় আধিপত্যবাদীরা বুঝে ওঠার আগেই বুঝে ফেলেছিলেন কতিপয় গোত্রচিহ্নহারা দ্রোহপুরুষ, তার মধ্যে সমীর রায়চৌধুরী অন্যতম। "শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন" গল্পে এই বাজারায়ন আর ভোগবাদের সম্পন্নতা ও বিপন্নতা দুই ই চিহ্নিত করেছেন ডবল ডুয়ালিটিতে। তাবড় তাবড় দেশীয় বণিকদের মদতে চমকদার সাবান, তেল, কেশকালা, মাজন এসব তৈরী করছে।এই সব সামগ্রীর দ্রব্যগুণ বিচারের জন্য কোথাও কোনো বাণিজ্যসংস্থা দশ বিলিয়ন খরচা করছে বিজ্ঞাপন বাবদ। এদের সমবেত আক্রমনের ফলে আমজনতা বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিগবাজারে তারা বলিপ্রদত্ত হয়েও বুঝতে পারছে না যে ভোগবাদ আসলে একটি রোগ। ধর্মের টোপ গেলানো হিন্দু মাঙ্গলিক বচন "ওঁ হ্রীং শ্রী ওঁ লক্ষ্মীবাসুদেবায় নমঃ"। পিনাকী বলে ক্রেতাকে বিব্রত না করে বাজার দখল করতে হবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অনেক কবি লেখক ডকু ফিল্মমেকার সবাইকে টপকে অ্যাসাইনমেন্টটা পায় নায়ক সুব্রত। অফিস থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নিয়ে পুরীতে হোটেলে এসে ওঠে।সে খায় দায় আর লক্ষ্য করে কে কেমনভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করে। মুখশ্রীতে কেমন মহিমা খেলা করে। ব্রাশের ডিজাইন দেখে, টিউবের প্যাকিং। ফেনা গল্প স্বাদ মেজাজ ব্রাশের আকার ছন্দ।গাদা টুথপেস্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে পেয়ে যায় বাজারায়ণের সূত্র। "স্রেফ টুথপেস্টের টিউবের মুখটা এক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিতে হবে। গোপন থাকবে এই কৌশল। দাম মাত্র দুটাকা কমিয়ে একটা ঝুটো মিতব্যয়িতার গিমিক ধরে রাখতে হবে বাজারে। অথবা শুরুতে কোনো ফ্রি গিফট বা এক্সট্রা কুড়ি পার্সেন্টের ভড়ং। মনোযোগের কেন্দ্র সরিয়ে দিতে হবে। তাহলেই ফোর্টি পারসেন্ট অতিরিক্ত টুথপেস্ট ড্রেনআউট হয়ে যাবে। কেননা টিউবের মুখের ডায়ামিটার আগের চেয়ে এক মিলিমিটার বেড়ে গেছে।" অদ্ভুত রসময়তায় পণ্যের পৃথিবীর অসাড়তাকে তুলে ধরা হল এই গল্পে।

# " স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা ওমলেট অবধি" নামক গল্পেও যথারীতি কোনো আদ্যপ্রান্ত গল্প নেই। বর্তমান পণ্যতাড়িত সুপার ফাস্ট জীবনে প্রতুল তার মৃত মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েও তাঁকে স্মরণ করার সময় নেই। ছবিটাও সে দেয়ালে টাঙায় নি তার পিছনের যুক্তিটা হল। ঘুরতে বেরোতে মায়ের ছবিটা তাকে আক্রান্ত করবে। মনখারাপ করলে তার কাজের গতি রুদ্ধ হবে। অথচ সে চায় মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী খুব জাঁকজমকপূর্ণ করে পালন করতে। তার ধারণা এভাবেই মাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি তার মধ্যে আর সময় পাবে না বলে আজ সে তন্নতন্ন করে মায়ের ছবি খুঁজছে। সারাবাড়ি আলমারি আনাচ কানাচ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে সে অনেক দৈনন্দিন কাজ ভুলে যাচ্ছে কিন্তু মিমি, তার কয়েকমাসের সন্তান, তার শিশুখাদ্য আনতে ভুলছে না। এটাকে সমীর বলছেন "স্মৃতির হুলিয়া" হুলিয়া শব্দটি একটি মিশ্র সংস্কৃতির অপশব্দ, যা মেকিতাকে ইন্ডিকেট করে। প্রতুল অশোকের বাড়ি যেতে ভুলে যাচ্ছে, অশোক তার বাড়ি এলে সে মায়ের ছবি খুঁজতে খুঁজতেই অশোকের সঙ্গে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অ্যাডভান্টেজ ডিস অ্যাডভান্টেজ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে সেখানে স্মৃতির মূল্য কতটুকু? এর মধ্যেই অনিমা জানাচ্ছে তার একসপ্তাহ আগে পেঁয়াজের বাক্সে ডিম রেখে ভুলে যাওয়া। প্রতুল বলে ওটাকে ওমলেট করে দিতে। অনিমা বলে মায়ের ছবি দুপুরে খুঁজবে আপাতত ওমলেট দিয়ে চা খাওয়া হোক। এভাবেই গল্পটির শেষহীন শেষ। এখানে ডিম শুধুমাত্র খাদ্যবস্তু থাকলো না, দ্বিতীয় ডায়মেন্সনে ডিম সৃষ্টি ও পরম্পরার দ্যোতক হয়ে উঠলো, কেননা ডিম থেকে দ্বিতীয় প্রজন্ম, যেমন প্রতুলের মায়ের থেকে প্রতুল, তার এবং অনিমার মিলন থেকে তাদের কন্যা সন্তান মিমির জন্ম। লেখক ককর্কশতাহীন সাংকেতিকতার মধ্যে দিয়ে দেখালেন আমাদের পণ্যায়িত জীবনের অসাড়তা।

# "কবিরাজ চাঁদ চুড়ামণি শ্রীব্রজেশচন্দ্র কথিত দ্রব্যগুণ " "আলজাজিরা" "একমিনিট বিয়াল্লিশ সেকেন্ড ওসামাবিন লাদেনের ক্যাম্পে" প্রভৃতি গল্পে দেখতে পাই কীভাবে বাংলা গল্পের ভাষাপ্রয়োগ শব্দের স্থানিকতা ও অর্থবোধকতা পাল্টে পাল্টে যেতে পারে। আলোচক কৌশিক চক্রবর্তীর ভাষায় তা হয়ে উঠতে পারে "রুবিক পৃথিবীর মাল্টিক্রোম হাতছানি"। "এই গল্পগুলিতে তিনি আতঙ্ক ও ভয়কে রিলেট করতে পারেন চমস্কি কথিত সাবভার্ট টেরারিজমের সঙ্গে। যেভাবে আমেরিকার জনগণের মধ্যে ওসামা নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে আফগান যুদ্ধকে নৈতিক করে তোলাহয়, তার পিছনে রয়েছে আসলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। মানুষের আই ওয়াশ করা হয়, মানুষ আসলটা ধরতে পারে না। এই সূত্রটিকে তুলে ধরতে গিয়ে সমীর লিখলেন বিদেশী লাইব্রেরী তে প্রবেশ করতে গিয়ে সিকিউরিটি চেক উপলক্ষে একর ধরণের কাল্পনিক ভয়ের বাতাবরণ। এ প্রসঙ্গে এসেছে এয়ারপোর্ট এ অত্যধিক কড়াকড়ি আর হেনস্থার শিকার হয়েছে ভারত আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষ, এমন কি ভারতে জেট ক্যাটাগরির সিকিউরিটি পাওয়া নেতা রাহুল গান্ধীর কথাও। যে ভয় কারণ বিহীন অথচ যে ভয় মিথ্যাকে সত্য করে দিতে পারে। এই ঘটনার নিরিখে বলিউডে শাহরুখ খান অভিনীত একটি চলচ্চিত্র মনে পড়ে " মাই নেম ইজ খান" এতেও দেখেছি সহজ সরল একটি মানুষ এই হেনস্থার শিকার হয়ে অত্যাচারিত হয়েও কিছুতেই প্রমাণ করতে পারে না যে " মাই নেম ইজ খান, বাট আই অ্যাম নট এ টেররিস্ট" শুধু মাত্র তার পদবী খান বলে তাকে এই হেনস্থা। সমীরের গল্পে এই ঘটনা তীব্র দংশনের রূপ না নিয়ে শুধু মাত্র অবলোকনের ধরতাইটুকু রেখে গেছে। ১১সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের সময় আগুন হানার থেকে বাঁচার জন্য এক দম্পতি জানলা দিয়ে নীচে ঝাঁপ দিচ্ছে। এটা একটা বিভ্রম ঠিক কথাই। কিন্তু পাজল্ড মানুষ মুহূর্তের বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় এই ভুল করে এবং আমরা জানি মানুষ এরকম করেওছিল। ইতিহাস তার সাক্ষী। সমীরের অবলোকন থেকে আমরা যা পাই, মনস্তত্ত্ববিদ হিসেব করে দেখেছিলেন সেই দম্পতি পতনকালীন অতিরিক্ত আয়ু পেয়েছিল ১মিনিট ৪২ সেকেন্ড যখন পতন আর উড়ান খুব কাছাকাছি। তাছাড়া অপরের আয়োজিত মৃত্যুর চেয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যু অনেক বেশী সম্মানের। এখানে কোনো পরাজয় নেই। এটাও যেমন লেখক দেখাতে চেয়েছেন তেমনি উড়ান শব্দটাকে যোগ করে মৃত্যুর সঙ্গে মুক্তিকে যুক্ত করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তেও যেখানে কোনো আত্মগ্লানি নেই। হত্যা আআর আত্মহত্যায় যে যার ঈশ্বর খুঁজে নেয়। এভাবেই মুক্তমুখে ছেড়ে দিয়েছেন গল্পটা।

# সমীর রায়চোধুরীর গল্প ও কবিতার লক্ষণ নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। আমি নিজেও আগে অন্যত্র তাঁর আরও অন্যান্য গল্প নিয়ে আলোচনা করেছি। তার থেকে মূল যে বিষয়টি উঠে আসে সেটি হল, সমীর রায়চৌধুরী আদ্যপ্রান্ত একজন পোস্টমডার্ন লেখক, যেখানে লেখকের স্বাধীনতা অবাধ। তথাকথিত অদ্যাপক অনুশাসিত গদ্য নয়। ফলত তাঁর রচনা ডিক্যাননাইসড, পাঠ্যবস্তু বাঁধনমুক্ত, রাইজোমেটিক এবং ডিন্যারোটিভাইজড। অধুনান্তিকের স্বরূপ নিয়ে এখনো অনেকের জিজ্ঞাসা এটা কি কোনো দর্শন? না কি চিন্তাচেতনার স্তর বিশেষ? না কি কোনো আইন? সমীর রায়চৌধুরী বলতে চান পোস্টমডার্ন আসলে কিছু কাললক্ষণ, সময়ের প্রবহমানতার সূত্রেই এর চলন গমন। তাই একে অস্বীকার করা মানে জীবনের স্রোতকে অস্বীকার করা।

Tuesday, March 19, 2019

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

  Samir Roychoudhury

Bombay
২০/৫
সুনীল
         তোর দীর্ঘ চিঠি পেলাম । তোর মানসিক অবস্হা জেনে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। শক্তিকে আমরাই এত বড় করে তুলেছি । এর মূল দায়িত্ব তোর, আমার ও মলয়ের । এবং এখনো আমার প্রতিটি বন্ধুকে বড় করেই তুলতে চাই আমি । শক্তিকে লেখার জন্য প্রাথমিক উৎসাহ তুইই দিয়েছিলি । বারেবারে বাহবা দিয়ে “বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি” একথা তুইই প্রথম তুলেছিস । অর্থাৎ শুধু এই যে আজ শক্তি সেকথা নিজে বলছে । চাইবাসায় থাকতেই তোকে বাদ দিয়ে শিল্পের সিংহাসনে বসার একটা ঘোরতর প্ল্যান উৎপল ও শক্তি অনেকদিন আগেই করেছিল । আমাকেও উপস্হিত থাকতে হয়েছিল এই সব আলোচনায় । পত্রিকা বের করার প্ল্যান তখনই হয়। আন্দোলনের ব্যাপারটাও মলয় বারবার তাগাদা দিতে থাকে । আমি বরাবরই কৃত্তিবাসকে ছাড়তে পারব না জানিয়েছি । নানান সেন্টিমেন্টাল কারণে কৃত্তিবাসকে আমি আমার নিজের পত্রিকা মনে করি । অনেকের মতন ‘সুনীলের কাগজ’ মনে করা সম্ভব নয় । শক্তি ও উৎপল তোকে বাদ দিয়ে ‘জেব্রা’ বার করতে পারবে কিনা মনে হয় না । অন্তত মলয় এটা হতে দেবে না। তাছাড়া সমস্ত নীচতার মধ্যেও সূক্ষ্ম বোধশক্তির দংশন শক্তিও এড়াতে পারবে না । আমাদের মধ্যে একটা ভাঙন গড়ে উঠবে এ আমার বিশ্বাস হয় না । হলে শক্তিরই প্রচণ্ড ক্ষতি হবে । টাকাপয়সার দরকার ওর শিল্পের জন্যও, শীলাও আছে, দার্শনিক ঋণও প্রয়োজন, সমীর ও মলয়কে ও সেইসঙ্গে সুনীলকে বাদ দিলে যে মারাত্মক অবস্হায় ও পড়বে তা ও জানে । আমাকে শক্তি লিখেছে ‘জেব্রা’য় তোর লেখা থাকছে । বেরোতে নাকি মাস দুয়েক দেরি । বরং উৎপলই একটু বেশিমাত্রায় তোর বিরোধী । হয়তো ঈর্ষা, হয়তো অন্য কোনো কারণ । উৎপলকে খুশি রাখতে গিয়ে হয়তো এই সব জটিলতায় শক্তি বাধ্য হচ্ছে । মলয়ের অভিমান এই যে তুই ওকে বিন্দুমাত্র স্নেহ করিস না ; নিতান্ত ছেলেমানুষী । সেবার শীলা পাটনায় ভর্তি হতে গেলে শক্তিকে পাটনায় নিয়ে যাই আমি । সেখানে মলয় ওকে এই আন্দোলন সম্পর্কে Convince করে । ছোটোগল্পে লিখেছে যে গল্পটা, তারই প্লট ও প্ল্যান মলয় শক্তিকে দেয় ( ক্ষুৎকাতর আক্রমণ )। ঠিক হয় যে কলকাতায় গিয়ে পুস্তিকা বের করে ব্যাপারটা আরম্ভ হবে । আমরা সবাই থাকবো। তুইও নিশ্চয়ই । আমাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করেই শক্তি কলকাতায় ফিরেই ব্যাপারটা আরম্ভ করে দেয় । এদিকে ট্রেনিং-এ চলে আসতে হয় আমাকে । মলয় পাটনায় । কলকাতায় শক্তি একা নানান ভাবে নিজের স্বপক্ষে সিংহাসন গড়ে তোলে ক্রমে । তুই ব্যাপারটায় যোগ না দেওয়ায়, যেটা ভুল-বোঝাবুঝিতে পেছিয়ে গেছে, আজ অবস্হা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা মলয়ও বলেছে । মলয় এখন যেকোনো রকমে তোকে চায় । ফলে হয়তো তোকে এই ধরণের আক্রমণ চালাচ্ছে । অদ্ভুত সব জটিলতা । ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা কবিতা সংকলন বার করতে চায় ও । আমাকে লিখেছে তোকে পদ্য পাঠাতে বলতে । ব্যাপারটা নিজেই সম্পাদনা করতে চায়, শক্তির জটিলতা এড়িয়ে । সন্দীপনও বোধহয় একটা গদ্য সংকলন বের করবে । আমি ‘চিহ্ণ’, ‘ছোটগল্প’ ও ‘জেব্রা’র জন্য ছোটগল্প পাঠিয়েছি ওদেরই অনুরোধে ।
         খ্যাতির প্রতি শক্তির প্রলোভন চিরদিনই আছে । ওর পরিবেশ অনুযায়ী হয়তো এটা স্বাভাবিক । আসলে মানুষ না হয়েই শিল্পী হওয়া যায়, এটাই যতো গণ্ডগোলের। ছোটোলোক, নীচ ও চোরও শিল্পী হতে পারে । শিল্পী হওয়ার জন্য বরং এসব ব্যাপার সাহায্যই করে । ফলে বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব নিয়ে গণ্ডোগোল বাধে ।
         এক মুহূর্তেই হয়তো শক্তির সমস্ত দম্ভ, অহংকার, নীচতা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বাংলাদেশের কাছে । এর উপযুক্ত নজিরের অভাব নেই আমার কাছে ; কিন্তু শক্তির বিরুদ্ধে বা কারোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন । আমার কতকগুলো নিজস্ব আদর্শ আছে, তা ভুল বা ঠিক হোক আমি তা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই । প্রতিক্রিয়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না ।
         কৃত্তিবাসের জন্যও তোর যে আদর্শ, তাকে ধরে রাখতে হবে তোকে, আশপাশের কারো চিৎকারে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই । কৃত্তিবাস আমরা বের করে যাবোই । আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসি । শক্তি শিল্পী হিসেবে অনেক বড়ো ও মানুষের চেয়ে শিল্পকে অনেক অনেক বড়ো মনে করে । আমি শিল্পকে পৃথক মনে করতে পারি না ।
         প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক এবং উচিতও । শক্তি বা উৎপলের মতো কবিতা না লিখলে কবি নয়, এসব ছেলেমানুষীতে আমি বিশ্বাস করি না । শক্তির কিছু-কিছু কবিতা যেমন আমাকে উন্মত্ত  বিহ্বল করে, অলোকরঞ্জনের কোনো কোনো কবিতায় আমি তেমনই প্রস্ফূট হয়ে যাই । সেই মুহূর্তে অলোকরঞ্জনকে আমার সমস্ত সত্তার মালিক মনে হয় । কি করে তাকে অস্বীকার করি ? তেমনই হয়তো এমনও কেউ আছেন যাঁর তারাপদর পদ্যে আরোগ্য হয় । এসব শ্রেষ্ঠত্ব স্হির করার আমরা কে ? যাঁরা কবিতা পড়েন তাঁদের ওপরই, সময়ের ওপর, এসব ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ঢাক ঢোল নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কি যে সুখ আমি বুঝি না । এসব চালিয়ে গেলে শক্তি অনেক বড়ো ভুল করবে । যতো বড়ো হতে পারে ও তাকে নিজ হাতে খর্ব করবে । হয়তো অ্যালেনের বিশ্বজোড়া নাম দেখে ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে । একথা শক্তি কয়েকবার বলেওছে আমাকে ।
         জুনে পনেরো তারিখে এখান থেকে রওনা হয়ে সতেরো তারিখে চাইবাসা পৌঁছোব। তুই আয় না তখন । শক্তিকেও আসতে বলব । একসঙ্গে তিনজন থাকলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে আপনা থেকেই । চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে । বেলাও বেশ সুস্হ হয়ে উঠেছে।
         চিঠি দিস । হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধেই না হয় কয়েকটা প্রচণ্ড গদ্য ও পদ্য লেখ । হাংরি জেনারেশনের একটা বিশেষ পুস্তিকায় বের করব আমি ; মলয়ও রাজি হবে । আসলে এই সব আন্দোলনের চেয়ে হৃদয়ের আন্দোলনটাই আগে দরকার ।
         সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ হয়তো এভাবেই আত্মসাৎ করে যেতে হবে আমাকে । তবু এবং হয়তো এই জন্যেই শিল্পের চেয়ে আমি মানুষকে পৃথক করতে পারি না, বড়ো মনে করার বা ছোট মনে করার কারণ খুঁজে পাই না ।
                                                                       সমীর রায়চৌধুরী


Monday, March 18, 2019

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর চিঠি

পাটনা
১.৯.১৯৬২
সুনীলদা,
         শক্তিদাকে আমি ভয়ংকর ভালবাসি, অথচ শক্তিদা আমাকে ভালো তো বাসেই না, উপরন্তু উদাসীন । আপনি লক্ষ করে থাকবেন, আধুনিক কবিতা বা আধুনিক ছোটগল্প সম্পর্কে আমার এমন কোনো প্রবন্ধ নেই যাতে শক্তিদার নাম নেই । শক্তিদা তো আমার কথা ভুলেই থাকেন । কেবল কলকাতার কিছু যুবকের সঙ্গে সময় কাটান, যারা শক্তিদাকে শ্রদ্ধা করা তো দূরের কথা, আমার মতন ভালোবাসে না ।
         শক্তিদা একেবারে মেয়েদের মতো । সুতরাং শক্তিদাকে আমার কাছে টেনে এনে, আমার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাগিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো চতুর্দিক থেকে ওঁকে আক্রমণ করে দিশেহারা করে দেওয়া, তারপর উপর্যুপরি আকর্ষণ করা -- অনেকটা মেফিসটোফিলিসের মতো।
         আমি জানি, আক্রমণের পর হঠাৎ আহ্বান জানালে, তখন আর আমার সম্পর্কে শক্তিদার উদাসীন থাকা সম্ভব হবে না । আর আমি ছাড়া এখন শক্তিদার চলবেও না ।
         শক্তিদাকে আমি লিখেছি, প্রেসের সব কাজ আপনাকে বুঝিয়ে দিতে । এই ইশারাটা আমি আশা করেছিলাম কাজ করবে । ভেবেছিলাম যে শক্তিদা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, যে সুনীলদা সম্পর্কে আমি আজ পর্যন্ত কোথাও কিছু লিখিনি, তাঁকেই বলছি দায়িত্বটা দিতে। কিন্তু এর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি, ধরতে পারলেন না কি আমার বলার উদ্দেশ্যটা । পাটনায় যখন এসেছিলেন শক্তিদা, তখন ওঁর সমস্ত রচনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ওনাকে জানিয়েছিলাম । অথচ উনি বুঝতেই পারলেন না শুধু ওঁর রচনারই আমি পারছি আলোচনা করতে, আরও যাঁদের নাম উনি করলেন যাঁদের সম্পর্কে আমায় হ্যাঁ-হুঁ দিয়ে সারতে হলো ।
         শক্তিদা আমার আক্রমণাত্মক চিঠি আপনাকে দেখিয়েছেন । ঠিক তারপরেই আহ্বানের চিঠিটা পেয়ে উনি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছেন । বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই যে আক্রমণ করাটা ছিল আহ্বানের অন্য রূপ । শক্তিদাকে অপমান করা আমার পক্ষে অসম্ভব । কারণ, দাদার চেয়েও শক্তিদাকে বোধহয় আমি বেশি ভালোবাসি । এখন, শক্তিদাকে ভালো বাসতেই হবে আমায় । শক্তিদা কলকাতায় আরও অনেকের সঙ্গে ঘুরবেন । আমার সম্পর্কে উদাসীন থাকবেন, এটা আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ।
         আমি যে চিঠি লিখব, শক্তিদা তার উত্তর দেবেন দাদাকে । অথচ দাদা বা আপনি শক্তিদাকে যতোটা ভালোবাসেন, আমি ওঁকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি ।
         আপনি হয়তো বলবেন, “শক্তি যেরকম মেয়েলি, তুমি সেরকম ছেলেমানুষ” -- ( শ্রীমান লিখেছেন । )-- কিন্তু এটা লৌকিকতার ব্যাপার নয় । শক্তিদাকে আমি ভালোবাসি, আর ওখান থেকে সরে আসা সম্ভব নয় । শ্রদ্ধা করি আপনাকে বেশি, কিন্তু শক্তিদাকে করি এমন কিছু একটা, যেটা ভায়োলেন্ট, হট, ডেসপারেট ।
         শক্তিদার লেখা দিয়ে আমি এই যুগটাকেই চিহ্ণিত করতে চাইছি । এটাও কি শক্তিদার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি ?
         প্রণাম নেবেন ।
                                                                             মলয়

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

সুনীল,
         তোর চিঠিগুলো সবই পেয়েছি । তোকে একটা গল্প লিখে পাঠিয়েছি, পেয়েছিস নিশ্চয়ই । ঐটাআই কৃত্তিবাসে ছাপা হোক এই আমার ইচ্ছে । তবে এ সম্পর্কে তোর মতামত খোলাখুলিভাবে জানতে চাই । গল্পটা তোর কিরকম লেগেছে ? গল্পটার নাম ‘মুখাবয়বের দিকে’ও দেয়া যায় । আরও কয়েকটা গল্প লেখার চেষ্টা করেছি , দ্রুতই তোকে পাঠাব । ‘মুখাবয়ের দিকে’ গল্পটার মূল কথা এই যে ক্ষুধার্ত সমরেশকে একতা মস্তবড়ো খাদ্যই হজম করে নিলো । বিভিন্ন মুখচ্ছবি আত্মসাৎ করতে করতে যে ছবিটা নির্মিত হয়ে এসেছিল মালতী তাকেই গ্রাস করে নিলো ।
         পরে যা গল্পটা পাঠাচ্ছি তার নাম ‘দেরি করিয়ে দেওয়া’ । এই গল্পের মূল কথা এই যে, গঠন করার জন্যই চতুর্দিকে একটা ‘দেরি করিয়ে দেওয়ার’ ব্যবস্হা রয়েছে । সমরেশের সেজকাকার মেয়ের স্নেহ, দরজা জানালায় রঙ করার জন্য গণি মিস্ত্রির ব্যবহৃত সময় বা সেজকাকা শেষের রুগিকে যে কোরামিন দিয়ে এলেন, তাও ঐ একই ব্যবস্হার অধীনে। কিভাবে ক্রমে নিরর্থক হয়ে যায় এই ব্যবস্হা শেষ দৃশ্যে তারই প্রশ্ন উথ্থাপিত ।
         পদ্যও লিখেছি কয়েকটা। পাঠাচ্ছি । তোর যা ভালো লাগে তাই করিস । আমার মন আজকাল ভালো নেই । চাকরিটা একেবারেই ভালো লাগছে না । কলকাতায় কয়েকটা চাকরির জন্য অ্যাপলাই করেছি । পেলে ছেড়ে দিই এটা ।
         মলয়ের বের করা দুটো কাগজ পেয়েছি । একটা ইংরেজিতে অন্যটা বাংলায় । ইংরেজিতে লেখার ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলাম । ও জানিয়েছে ওটা পাটনায় ছাপিয়েছে, পাটনায় বাংলা ছাপানো সম্ভব নয় । মলয়ের কোনো কোনো মতামতের সঙ্গে যদিও আমি একমত নই তবুও ওই ধরণের প্যামফ্লেট ছাপানোয় আমার অমত নেই । শক্তিও সম্পূর্ণভাবে এর সঙ্গে যুক্ত যদিও তোকে হয়তো অন্যরকম বলে থাকতে পারে । এর পরের বার থেকে স্রষ্টা, নেতৃত্ব এই সব শব্দগুলো প্রত্যাহার করে নেবার জন্য মলয়কে জানিয়েছি । মলয় রাজি হয়েছে ; এসব বিষয়ে ও হারাধন ধাড়াকে ( দেবী রায় ) লিখেছে । এই ছেলেটিই ওখানকার কাজ সব দেখাশুনা করছে । মলয় কৃত্তিবাসেও লিখতে চায় । তোর যদি আপত্তি না থাকে ওকে জানাস । ও চায় তুই ওর প্যামফ্লেটে কিছু লিখিস এবং কবিতা দিস । তোর কি এই ধরণের প্যামফ্লেট সম্পর্কে খুব আপত্তি রয়েছে?
         কৃত্তিবাসের জন্য যে কাগজের দরকার সেটা শক্তিকে বলিস, যাতে মলয়ের বইয়ের জন্যে কেনা কাগজটাই কৃত্তিবাসকে দিয়ে দেয় । মলয়ের বইয়ের জন্য তিন রিম কাগজ ওর কাছে কেনা আছে । কৃত্তিবাস প্রেসে দেওয়া হলেই আমায় জানাবি ।
        চিঠি দিস । প্রীতি রইলো ।
                                                                              সমীর
                                                                            ৫/৪/১৯৬২
                                                                                                    














হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর চিঠি

পাটনা
১৫.১১.১৯৬২
শ্রদ্ধেয় সুনীলদা
চিঠি পেলুম আপনার । আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো হয়ে ওঠেনি আপনাকে । আমাদের আন্দোলনটা নিঃসন্দেহে সামাজিক -- যে অর্থে নীৎশে, লরেন্স বা গিন্সবার্গ সামাজিক । নামকরণটা ( হাংরি জেনারেশন ) আমাকে সেই জন্যেই করতে হয়েছে । এখন, এই সময়ে, এমন একজনও নেই, যাঁকে আমরা সমালোচক বলতে পারি । তাছাড়া সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিজেদের নাম দিয়েই আরম্ভ করতে হয় । এমনিতেও সিমবলিস্ট, ইমেজিস্ট, বিট অথবা এগজিসটেনশিয়ালিজম, প্র্যাগমাটিজম, হিউম্যানিজম -- এসবই প্রথমে নিজেদের নাম দিয়ে তারপর উপস্হাপন করতে হয়েছে ।
         প্রথমে সাহিত্যকে আত্মস্হ না করলে, আপনি জানেন, এ আন্দোলন কারোরই জনরে পড়তো না । আর এটাকে ঠিক আন্দোলন বলাটাও ভুল । আমি এমন অনেককে দেখলাম যিনি মার্কসের নাম শুনেছেন, স্পেংলারের নাম শোনেননি, নীৎশে যে ‘বার্থ অব ট্র্যাজেডির’ লেখক তা জানেন না । তবে ? এঁরাই আবার জয়েস কাফকার নাম করলেন ! একেবারে কিছু না জানা বা সম্ভাব্য কিছু জানার আগ্রহটাই, আমার মনে হয়, সততার লক্ষণ । সে যাক, আপনি লিখতে রাজি নন কেন, সেটার কথাতেই আসা যাক । মার্কসবাদী আপনি তো নন । তবে ? সেটার জন্যেই আমি হাংরি জেনারেশন নামটা দিয়েছি : কারণ নেরুদা আর মিলটন আমাদের একই সঙ্গে ‘ভালো’ লাগে । আপনি নিজের কথাটাই ভাবুন । লিখেছেন, “কবিতা এই নয় ওই নয় বলাবলির কি আছে জানি না” ; তারপরই বলেছেন, “কবিতা জিনিসটার নাম বদলে ওটাকে প্রাইভেট বায়োগ্রাফি করা যায় কিনা দেখতে চাই ।” অর্থাৎ আপনি একই সঙ্গে, আপনার কবিতার মতোই,
সলিপসিজমকে স্বীকার ও অস্বীকার করতে চাইছেন । হয়তো শক্তিদা জড়িত থাকায় আপনি লিখতে চাইছেন না, দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য থাকায় । কিন্তু রেক্সরথ, কেরুয়াক ও অ্যালেনের দৃষ্টিভঙ্গী তো একেবারে এক নয় । তবু ওঁদের একই ব্যানার । এবং সেটাও ওঁরা স্বীকার করেছেন। আমাদের ব্যাপারটা যদি আন্দোলনও হয়, তাহলে সেটা মতপ্রকাশের আন্দোলন । এখনকার তরুণরা অনেক বিষয়েই পরস্পরের থেকে পৃথক, তবু তারা সকলেই কফিহাউসে গেছে এবং যায়, কারণ, কোথাও তাদের মিল আছে, আর এটা নিয়ে হাংরি জেনারেশন ।
         অন্যেরা কি করে আন্দোলনের নাম আন্দোলন দিতো, যখন কিনা অন্যেরা এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একটা ইতিহাস লিখল না, যখন কিনা অন্যেরা রুশোর নাম না শুনেও ভোট দিতে যায়, যখন কিনা অনভেরা জানে না গ্রিসের মাটি-পৃথিবীর রঙের আর য়ুরোপের রেনেসঁসের কালে ব্যবহৃত রঙের পার্থক্য থেকেই মড়া পোড়ানোর বা কবর দেবার পার্থক্য। কি করে আপনি ভাবলেন যে অন্যেরা এগিয়ে আসবে ? গল্প আর কবিতা লেখার পর সমালোচনা হয় এখনও । কেবল প্রবন্ধ লেখেন এমন একজনও নেই । প্রত্যেক তরুণই দেখি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছে । পৃথিবীর, সমাজের, হায়েনার বাজারের দাবিকে অস্বীকার করেই হাংরি জেনারেশন ।
         কখনও, ইচ্ছে হলে, লেখা দেবেন আপনার ।
         শক্তিদার রচনাটা বোধহয় উত্তেজনায় লেখা । তাই ব্রেনের কারিকুরিতে পণ্ড হয়ে গেছে। তাছাড়া, আমার মনে হয়, রচনা ‘ভালো’ অথবা ‘খারাপ’ বা ওই ধরনের শব্দগুলো প্রাগৈতিহাসিক। অ্যাকাডেমিকও বটে । দেখা উচিত শিল্পের পর্যায়ে উঠলো কিনা । অ্যালেনের কবিতাগুলো এতো ‘খারাপ’, আর তাই সুন্দর আর শিল্পসন্মত যে, অনভেরা কেন এমন কবিতা লিখতে পারে না ভাবতে অবাক লাগে । সমালোচনার মিমিক থিয়োরিটা আসলে অ্যারিস্টটলের। আর তাই ওই কালেই ঠিক ছিল । প্র্যাগম্যাটিক, এক্সপ্রেসিভ বা অবজেকটিভ থিয়োরিগুলো কেবল থিয়োরি । আমার কেমন হাস্যকর মনে হয় ।
         আপনাকে যে টার্মগুলো পাঠিয়েছিলাম, সেগুলো কিন্তু নিজের যা ইচ্ছে তাই লিখতে বলেছিলাম । ওদেশে কোনো কবিকে ছন্দের ডেফিনিশন লিখে দিতে বলা হলে, লিখে দিতেন, ‘মারডারিং’ । এটা বোধহয় ব্যকরণের আওতার বাইরে ।
         আশা করি আর সব কুশল । প্রণামান্তে মলয় ।

Saturday, March 16, 2019

"দি হাংরিয়ালিস্টস" বইটি সম্পর্কে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর সাক্ষাৎকার : তোর্ষা ঘোষাল

The hungry and the restless

Torsa Ghosal

Outside the lines: Refugees from erstwhile East Pakistan flee the 1971 war. Binoy Majumdar, a prominent member of the Hungryalists, was also a refugee who was often overlooked by the literary establishment in Bengal   -  THE HINDU ARCHIVES

A new book chronicles the Hungryalist poets, who revitalised Bengali literature during the turbulent 1960s

 
Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury’s The Hungryalists: The Poets Who Sparked A Revolution offers a compelling portrait of poets such as Malay Roy Choudhury, Shakti Chattopadhyay, Samir Roychoudhury, Haradhan Dhara and Binoy Majumdar, who initiated the “Hungry Movement” to revitalise Bengali literature during the 1960s.

It was a turbulent period marked by the influx of refugees from East Bengal, the Indo-China War, the Vietnam war, and the Naxalite uprising. The Hungry Generation of poets responded to the on-going national and international turmoil, though as a group they were never quite a cohesive entity. Chattopadhyay, for instance, left the group in the mid-sixties.

Around the same time, Roy Choudhury and Dhara, along with several other Hungryalists, were held for writing “obscene” poetry. Chattopadhyay accepted a Sahitya Akademi Award in 1983. Roy Choudhury was conferred the same honour in 2003 but he refused to accept it.
Given their anti-establishment sensibilities, the Hungryalists had befriended the iconic post-war American poets, the Beats, including Allen Ginsberg and Peter Orlovsky, who were touring India at the time. The most striking feature of The Hungryalists is that though it records this significant chapter of literary history, it does so by tracing the rich internal lives of the poets — their motivations, dreams, and disappointments.

Excerpts from an interview with the author:
What drew you to the Hungry Generation?
About four years ago I read Deborah Baker’s book A Blue Hand: The Beats in India, where I found a fleeting mention of the Hungryalists. Like me, many in Bengal had heard of the Hungry Andolan and read them in Bangla but no substantial work had been done on them in English. This was when I began my research on them.

Early into the writing, I felt that narrating their dreams and disappointments was necessary because poetry wasn’t only a way of life; for them, it was life.

Since you are a poet, was it challenging for you to focus on the poets’ biographies rather than on their poetry?
As a poet and non-fiction writer, this was in fact the perfect combination. Being a poet probably made me understand their choices in life and revolt better. The Hungryalists’ fight was against elitism, casteism and authoritarianism. The sixties were a time during which any kind of sensuality in poetry or other writing was looked down upon. Buddhadeb Bose’s book Raat Bhor Brishti which released around this time was banned, copies were burnt and he was put on trial standing in a wired cage. While such a response might have been shocking in the’60s, these subjects resonate with writers such as myself too.

Why made you draw parallels between the Beats and the Hungryalists?
There have been too many comparisons between the Beats and the Hungryalists, as a result of which the Hungryalists are somewhat defensive about acknowledging the influence of the Beats. The fact remains, however, that the two groups shared a tremendous love for a new kind of poetry which joined them at the hip, in a manner of speaking. Also, the Hungryalists did mingle with the Beats, read their work, and accepted their help when necessary. While the parallels make for a great narrative and situate the Hungryalists’ revolt in an international context, there is also no doubt that the Hungryalists were poor Bengali writers with no great financial support, which is why their rebellion against elitism, classism, casteism and negation of sensuality in literature was crushed so easily.

The Hungryalists identified as outsiders, and you consider their condition as analogous to those of the refugees from East Bengal and Dalits. Could you elaborate on the analogies?
The Hungryalists came about because some of them, such as Haradhan Dhara, were Dalit writers ignored by the literati, others like Binoy Majumdar were refugees and still others like Malay were probasi Bengali writers — they were already social misfits. Coming together as a group was the only way they would get any attention of the so-called ‘cultured society’.

The Hungryalists understood the consequences of shunning mainstream dictums and had, in many ways, begun feeling the heat of being socially shunned. They formally named themselves, inspired by Geoffrey Chaucer’s line, “In the sowre hungry tyme”. But they were, perhaps, unprepared for facing legal consequences. But they were, perhaps, unprepared for facing legal consequences.

While researching how the Hungryalists were tried for writing “obscene” poetry, did you feel an event like that would pan out any differently today?
While writing about sexuality might be more acceptable today than it was in the ’60s, people are still wary of reading or reacting to anything outside their comfort zone. As far as tolerating another’s thought process is concerned, I feel people are still not as accepting. Where poetry and poets are concerned, I feel that people had more love for poets and poetry before. There was a certain sense of awe associated with poets because they presented the world from an altogether different perspective. The fact that Malay had been arrested created a huge stir internationally, but when poet Binoy Majumdar died in poverty and mental trauma in 2006, how many people were aware of it?
The need for deep poetic introspection seems mostly lost, the realm of subtlety no longer exists, and though poetry is still popular, the magic of finding value in something that doesn’t have much monetary consequence is redundant.

Torsa Ghosal is the author of Open Couplets, and professor of English at California State University, Sacramento
 
Published on March 15, 2019
 

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...