Thursday, June 28, 2018

বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী

  মহারাজা রঞ্জিত সিংহের গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, বাবার অমন নাম রেখেছিলেন । আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর শহরে, ১৯১২ সালে । পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ ১৩ই নভেম্বর ১৭৮০ । বাবাও জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর । ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয় বা সেজ ভাই । অন্যান্য ভাইদের পোশাকি আর ডাক নাম দুটিই থাকলেও, বাবার ওই একটি নামই ছিল, রঞ্জিত । ঠাকুর্দার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেছিলেন দাদুর পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী ।
        ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, পোরট্রেট আঁকতে পারতেন, এবং সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন রাজপরিবারের ডাকে সপরিবারে ভারতের এক রাজ দরবার থেকে আরেক রাজ দরবারে চলে যেতেন । লাহোরে গিয়ে তিনি ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরায় ফোটো তুলতে শেখেন, যাতে ফোটো তুলে তা থেকে ছবি আঁকতে সুবিধা হয় এবং রাজ পরিবারের মহিলাদের এক নাগাড়ে বসে থাকতে না হয় । সেসময়ে মেয়ো স্কুল অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিঙ, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই তিনি ফোটো তোলা শেখেন । ফোটো তোলা হতো সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে । পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হতো, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হতো, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হতো ।  
         ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরা ছিল বেশ ভারি ; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হতো । বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হতো । ফোটো তোলা হতো ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে । ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু’এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হতো । স্টুডিওতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হতো, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয় । এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে ড্যাগেরোটাইপের ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক । বাবা এই প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না । শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরা তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় । বাবা মারা যাবার পর যখন পাটনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসলুম, দেখেছিলুম তিনতলার একটা ঘরে থাক-থাক কাচের প্লেট, কড়িকাঠ থেকে র‌্যাকে সাজানো । ইতিহাসবোধ না থাকলে যা হয়, আমি বা দাদা আমরা কেউই সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস করিনি ।
         দাদুর ছেলেরাও ফোটো তোলা আর ছবি আঁকায় সড়গড় হলে দাদু ১৮৮৬ সালে ফোটোগ্রাফির ভ্রাম্যমান ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, এবং সংস্হাটির তিনি নাম দেন ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ । হুগলি জেলায় গঙ্গা নদীর ধারে উত্তরপাড়ার পাশে এখন যেখানে বালি ব্রিজের সংলগ্ন ফ্লাইওভার, তখন একটা রাস্তা ছিল, সেখানে একটা দপতর খুলে নকাকাকে চালাতে বলেছিলেন । কিন্তু নকাকা তা সামলাতে পারেননি, হঠাৎ বৈরাগ্যে আক্রান্ত হবার কারণে ।
         দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়জেঠা, মেজজেঠা, বাবা, পিসিমা আর নকাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি । দাদু হঠাৎ মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা পাটনায় থিতু হতে বাধ্য হন এবং তখন নতুনকাকা আর ছোটোকাকাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় । নতুনকাকা নিয়মিত স্কুল করলেও ছোটোকাকার আগ্রহ না থাকায় তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন । জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান । দাদু সংস্কৃত আর ফারসি লিখতে-পড়তে পারতেন । বাবা ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ।
         দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে  ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান । বড়জেঠার মুখে শুনেছি যে বাহাওলপুরের সেই সময়ের ডাকটিকিটে আমিরের পোরট্রেট ছিল দাদুর আঁকা । ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান । বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান । দুম্বা  একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়জেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু  ।
         ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল । কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক । রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারন ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন । এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু । কিশোরীমোহন তাঁর বড় মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন । বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে । বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে ; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী । দাদু প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন ; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে ।
         দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য ডাক পড়লে দাদু সপরিবারে পাটনায় যান, আর সেখানেই হৃদরোগে মারা যান । পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল দাদুর ওপর ; তিনি মারা যেতে ঠাকুমা বিপদে পড়েন । তাঁরা একটি মাটির দেয়ালের ওপর টালির চালার বাসা ভাড়া করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই সফল না হতে পারায় বাবা দাদুর প্রতিষ্ঠিত সংস্হা ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি আঁকা আর ফোটো তোলার একটি স্হায়ী দোকান চালাবাড়ির কাছেই, বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে, খোলেন । ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই কলকাতা মিউজিয়ামের সহকিউরেটার লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে বড়জেঠা  পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ বর্গের একটি চাকরি পান । পরে অবশ্য তিনি নিজের যোগ্যতার দরুন পদোন্নতি পেয়ে পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ হয়েছিলেন। বড়জেঠা মাটির মূর্তি তৈরি করায় আর অয়েল-পেইন্টিং আঁকায় দক্ষ ছিলেন । ছোটোবেলায় ছুটির দিনে আমি মিউজিয়ামের এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে !
         দাদু মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল,  থাকতে চলে গেলে,  পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর কাকাবাবুর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটি ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব  ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । ছোটোকাকা ৯০ বছর বয়সে মারা যান, নিঃসন্তান ; উত্তরপাড়ার বাড়ির অংশ ছোটো শালার প্রথম পক্ষের মেয়েকে দিয়ে গেছেন ।
         বিহারের ভূমিকম্পে চালাবাড়ি ধ্বসে পড়ার পর বড়জেঠা ঠাকুমার আর বড়জেঠিমার গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে একটি নিম্নবর্গ ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় বাড়ি কেনেন । তখন নিম্নবর্গের লোকেদের বলা হতো অস্পৃশ্য, আর সেকারণেই দুসাধ-মুসহর-কাহার-ডোম-চামার পরিবার অধ্যুষিত ঘিঞ্জি নিচুচালা-বস্তির সস্তা এলাকায় বাড়ি কেনা সহজ হয়। তেঁতুলগাছটা দাদার জন্মের সময়ে ছিল, আমি দেখিনি, কেননা তেঁতুলগাছটা কেটে সেই জায়গায় জলের কল আর গ্যাসবাতির থাম বসিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার । পাটনার অন্যান্য বাঙালিরা ইমলিতলাকে বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া । সেকারণে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ওই ছোটোলোক ছাপ্পা পড়ে গিয়েছিল । পাটনার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বাঙালিরা ওই সরু গলির ভেতরে ঢুকে দিনের বেলাতেও আমাদের বাড়ি আসতেন না । বড়জেঠা যেতেন তাদের বাড়ি, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য । আমি যখন স্কুলে ঢুকলুম তখন স্কুলের বন্ধুরাও ইমলিতলা শুনে আমাদের বাড়ি আসতে চাইত না ; অনেকে নাম শুনেই ভয় পেত, অঞ্চলের কুখ্যাত নিবাসীদের কাজকর্মের দরুন । মেজদা, যাকে শিশু অবস্হায় এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়জেঠা কিনেছিলেন, পাড়ার চাপ এড়াতে না পেরে পুলিশের নথিতে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, মাদকের দরুন কম বয়সে মারা গিয়েছিল ।
         বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বেশ রাত করে । ফোটো তোলা, জিনিসপত্র বিক্রি আর ডার্করুমের কাজ তাঁকে একা করতে হত বলে ভোরবেলা জলখাবার খেয়ে সোজা গিয়ে ডার্করুমে ঢুকতেন, তারপর রাতে দোকান বন্ধ করার পর আবার ঢুকতেন ডার্করুমে । বিহারে সেসময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তাই কাজ পেতে অসুবিধা হতো না । মা আর বাবা দুজনের চরিত্রেই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সবায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা । বাবা বাড়ির প্রধান রোজগেরে হলেও নিজের ভাইদের আর তাদের ছেলে-মেয়েদের, মানে আমাদের জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনদের, সমান চোখে দেখতেন। বড়জেঠা ইমলিতলা বাড়ির ট্যাক্স আর সবজি কিনতেন, বাবা বাদবাকি সমস্ত খরচ করতেন, ঠাকুমাকে টাকা পাঠাতেন, উত্তরপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স দিতেন । চালগমের দোকানদারকে মাসে একবার, মায়ের তৈরি ফিরিস্তির কাগজ, দোকানে যাবার পথে বাবা দিয়ে যেতেন আর সে ইমলিতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত । পরিবারের সদস্যদের পোশাকের জন্য বাবা দর্জিকে বলে রেখেছিলেন, তার দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দিতে হতো, সে তৈরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত । একইভাবে ছিল জুতোর দোকানের সঙ্গে বন্দোবস্ত । চুল কাটার জন্য মাসে একবার নাপিত আসত, পরে বাবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিত ।
         ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা-দাদা-আমি যে ঘরটায় থাকতুম সেটাই ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ঘর । লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো । চেয়ার-টেবিল ছিল না, দোকানের মালপত্র যে প্যাকিংবাক্সতে আসত তার ওপর চাদর পেতে বই রাখার ব্যবস্হা ছিল । পাড়ার কুসঙ্গ-কুখ্যাতির প্রভাব দাদার ওপর পড়তে পারে অনুমান করে ম্যাট্রিক পাশের পর ১৯৪৯ সালে দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল পাণিহাটিতে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য । কলকাতায় দাদা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কলেজে বন্ধু হিসেবে পান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী প্রমুখ তরুণ কবিদের । দাদা বিহার সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি পেলে তাঁর পোস্টিঙের জায়গায় বন্ধুরা একা বা দলবল নিয়ে পৌঁছোতেন । ছোটোবেলায় আমি একবার তাড়ি খেয়েছিলুম, মানে পাড়ার এক সর্বজনীন দাদু খাইয়ে দিয়েছিল । মুখে তাড়ির গন্ধ পেয়ে মা আমায় আমাদের ঘরে শেকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ; বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে শেকল খোলা হয় । মায়ের সব সময় আশঙ্কা ছিল যে আমরা দুই ভাইও মেজদার মতন অসামাজিক চরিত্রের মানুষ হয়ে যেতে পারি । পাড়ায় মেলামেশায় কোনো নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ছিল না । ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে অনেকের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকোবার স্মৃতি আছে ।
         ইমলিতলার বাড়িতে জলের কল ছিল না ; বড়জেঠা তো অফিস চলে যেতেন, জল ভরে এনে দেবার লোক না এলে দুপুরে বাবা যখন দোকান থেকে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের স্নান করার জল নিজেই কল থেকে ভরে আনতেন। শীতকালেও ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন । দাদা আর আমি ইমলিতলায় রাস্তার কল থেকে জল ভরে এনেছি, রাস্তার কলে স্নান করেছি । বাবার নির্দেশ ছিল যে বাড়ির সব কাজ আমাদেরও করতে হবে, প্রয়োজনে কয়লা ভাঙা আর উনোন পরিষ্কার, জঞ্জাল ফেলে আসাও । বাবা রাস্তার কলে স্নান করতে লজ্জা পেতেন । ২০০৫ - ২০০৮ নাগাদ আমি কলকাতার রাস্তা থেকেও খাবার জল ভরে আনতুম পেপসির বোতলে করে, কেননা তিন তলায় কোনো ভারি জলের টিন নিয়ে বা মিনারাল ওয়াটারের বড়ো বোতল নিয়ে রিকশাঅলা উঠতে চাইত না । মাঝে-মাঝে দাদার বাড়ি গিয়ে দুটো থলেতে পেপসির বোতলে জল ভরে আমি আর আমার স্ত্রী সলিলা রিকশা করে নিয়ে আসতুম নাকতলার বাড়িতে। এই সমস্ত অসুবিধার জন্যেই নাকতলার ফ্ল্যাটটা বেচে মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে চলে আসতে হয়েছে ।
         বাবা চিরকাল শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি আর পায়ে পামশু পরতেন । তাঁর ভাইয়েরা শাদা ছাড়া অন্যান্য রঙের শার্ট বা পাঞ্জাবি পরলেও বাবার পোশাকের অন্যথা হতো না, শীতকাল ছাড়া, যখন উনি নস্যি রঙের শাল গায়ে দিতেন, বা ওই রঙের উলের পাঞ্জাবি পরতেন । দোকানে যাবার তাড়ায় বাবার দ্রুত হাঁটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । ইমলিতলায় থাকতে দুবার ওনার পা দোকানে যাবার পথে  ভেঙে গিয়েছিল ; বাবার পা ভাঙা মানে আর্থিক দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক অবস্হা  ; দাদাকে গিয়ে দোকানে বসতে হত । উত্তরপাড়া থেকে চাকুরিহীন কোনো জ্ঞাতির ছেলেকে নিয়ে এলেও তাদের অবাঙালি পরিবেশে মানিয়ে নিতে এতই অসুবিধা হত যে কয়েক দিনেই তারা ফেরত চলে যেত । পরে দরিয়াপুরে গিয়ে বাবার যখন আরেকবার পা ভেঙেছিল তখন আমি দোকানদারি করেছি । গরিব হলে যা হয়, গতি কেবল সরকারি হাসপাতাল, সেখানে কিউ, কেননা প্রায়ভেটে কোনো নার্সিং হোম ছিল না সেসময়ে ; এখন তো প্রতিটি রাস্তায় একজন করে হাড়ের ডাক্তার । বড়জেঠির এক বান্ধবীর স্বামী ছিল ছুতোর ; ওনার পা ভেঙে যেতে, জেঠিমার বান্ধবীর  কথামতো বাবার পায়ে বসাবার জন্য ছুতোরকে দিয়ে কাঠের খাপ তৈরি করিয়ে পায়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা হয়েছিল । প্রথমবার বানিয়ে দেয়া খাপটা দ্বিতীয়বার কাজে লেগে গিয়েছিল ।
         বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল সেই বাড়ির মালিক উঠে যাবার নোটিস দিলে বাবা পড়েন মহাবিপদে । বিকল্পের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি তখনকার বারি রোডে দরিয়াপুরে একটা চালাবাড়ি কেনেন ; সেটা ছিল একজন কামারের হাপর-বসানো ঘর, পেছনে আর পাশে সামান্য জমিতে ঝোপ । এই এলাকাটাও সেসময়ে গরিবদের পাড়া ছিল, ধারণার অতীত দুস্হ সুন্নি মুসলমানদের পাড়া । বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা চলে বেশ কয়েকবছর ; সেই সুযোগে দরিয়াপুরে দোকানঘর তৈরি করে ফেলা হয় । তৈরি হয়ে গেলে পুরোনো দোকানের পাট গুটিয়ে বাবা চলে আসেন দরিয়াপুরে । ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’-এর খ্যাতির কারণে পুরোনো খদ্দেররা দরিয়াপুরে আসত । এখন এই সংস্হা চালায় দাদার বড় ছেলে হৃদয়েশ ।
         দরিয়াপুরে যখন দোকান তৈরি হচ্ছিল তখন আমি ওই বাড়িতে একা থাকতুম, কেননা ইমলিতলার প্রাত্যহিক মাতালদের চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাঁটির দরুন পড়তে বসে বেশ অসুবিধা হত । তাছাড়া দরিয়াপুরে ইলেকট্রিসিটি ছিল, কলের জল ছিল। ছোটোদের হাতখরচের জন্য বাবা টাকা দিতেন না ; বলতেন যার যা চাই জানিয়ে দাও, কিনে এনে দেব । স্কুলের বাৎসরিক ফলাফলের রিপোর্টে বাবা কখনও কাউকে ‘গুড’ দিতেন না । নব্বুইয়ের কোঠায় মার্কস পেলেও দিতেন না ; বলতেন আরও বেশি পেতে হবে । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকলে আমার চরিত্রদূষণ ঘটতে পারে অনুমান করে বছরখানেক পরে মা আর বাবা রাতে শুতে আসতেন । মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনতেন । দিনের বেলা ইমলিতলায় গিয়ে খেতে হতো । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকার সময়ে বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিদধিক চরিত্রদূষণ যে ঘটত না তা বলা যাবে না ।
         বাবা আর মা দুজনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়া বা তীর্থকর্ম করা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন না ; আমার মনে হয় কাজের চাপে উনি সংস্কারমুক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে । । আমি কখনও তাঁদের তীর্থক্ষেত্রে বেড়াতে যেতে দেখিনি ।   জেঠা-কাকারাও কেউ আগ্রহী ছিলেন না ; পাটনার বাইরে যেতে হলে তাঁরা যেতেন কেবল দেশের বাড়ি, অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় । তবে বাবা নিয়মিত পৈতে বদলাতেন, একাদশীর দিন লুচি খেতেন । কালীঘাটের কালী আমাদের পারিবারিক দেবতা, যেহেতু তা আমাদের কোনো পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত, সেকারণে বাড়িতে পারিবারিক দেবতা আর তার সেবাযত্ন করার প্রয়োজন হতো না । পৈতে পরতেন বড়জেঠা আর ছোটোকাকা, যদিও খাওয়ার কোনো নিষেধ মানতেন না, মেজজেঠা কখনও পৈতে পরতেন আবার কখনও কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দিতেন ।  দাদার আর আমার ছোটোবেলায় পৈতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমরা স্বরূপে এসে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম । পৈতেহীন হবার কারণে বাবা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে মনে হয় না ; এই প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা তোলেননি ।
        মা, বাবা এবং শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দেয়, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে আমি কোনো শিক্ষক সেই সময়ে পাইনি যখন তা জরুরি ছিল । প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক কনভেন্টে পেয়েছিলুম সিসটার আইরিনকে আর যাযক ফাদার হিলম্যানকে । শৈশবের বইতে বর্ণিত সমস্ত জিনিস যাতে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে পারি তার দিকে খেয়াল রাখতেন সিসটার আইরিন আর স্বদেশ আয়ারল্যাণ্ডে গেলে অনেককিছু সংগ্রহ করে আনতেন, স্কুল সংল্গন ফার্মে নিয়ে গিয়ে ফল, ফুল, গাছ, জন্তুতের চাক্ষুষ করাতেন । ফাদার হিলম্যানের সৌজন্যে আমি কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম ; উনি ফোটো তুলতে ভালোবাসতেন আর বাবার সঙ্গে ওনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, আমাকে দোকানে দেখতে পেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে নিয়ে গিয়ে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি করে দেন; সপ্তাহে একদিন চার্চে বাইবেল ক্লাসে নিয়ে গিয়ে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের কাহিনি শোনাতেন । পরে যখন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন সেমিনারিতে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলুম, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠল না ; এই স্কুলে যিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী করলেন, তিনি গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী , আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের সুমিতাদি।
         মা আর বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল সততা, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনে একক লড়াই করার চারিত্র্য । বাবা দোকানদার হয়েও সৎ ছিলেন, যা আজকের দিনে অকল্পনীয় । কেবল সৎ নয়, তাঁর ছিল সৎসাহস । হাংরি আন্দোলনের সময়ে আদালতের মামলায় বন্ধুরা যখন আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, আর লড়াইটা আমার একক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি আমার চরিত্রগঠনে মা আর বাবার অবদানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলুম । বাবা কলকাতায় লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে অমন মকদ্দমা কেন করা হয়েছে আর তখনই জানা যায় যে কলকাতার কয়েকজন সমাজকর্তা-বুদ্ধিজীবীর নালিশ কাজ করেছে এর পেছনে, যাদের বলা হয় এসট্যাবলিশমেন্টের ধারক-বাহক । মকদ্দমা চলার সময়ে বাবা কয়েকবার পাটনা থেকে দুএক দিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আসতেন । যারা আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল আর চামড়া বাঁচাবার জন্য রাজসাক্ষী বা সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেল তাদের পরিবারের কাউকে কোনো দিন আসতে দেখিনি কোর্টে ; অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের ছেলের সাহিত্যকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি।
         বাবা আমাদের বাড়ির ক্ষমতাকেন্দ্র হলেও ছোটোদের কাউকে শাসন করতেন না । তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বলতেন, “অ, ও শুধরে নেবে ।” তারপর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বলতেন, “কী, শুধরে নিবি তো ? বড় হয়েছিস, শুধরে নিতে শেখ।” বড়জেঠা শাসন করতেন, নিজে থেকে নয়, জেঠিমা-কাকিমারা অভিযোগ করলে, কিন্তু অভিযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন । বড়জেঠার দুই মেয়ের বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল । মেজজেঠা আর কাকাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্হা করেন বাবা, তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজেঠার এক মেয়ে মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে মেজজেঠা অমত জানান ; মেজজেঠার অমত হওয়ায় বাবা তাঁকে বোঝালেও তিনি রাজি হননি । বাবা তাঁর বিরুদ্ধতা করে মেজজেঠাকে অপমানিত করতে চাননি । শেষে আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন যে ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয় । আমার ছোটোশালী এক যুবককে বিয়ে করতে চাইলে নাগপুরে অভিভাবকরা রাজি হলেন না, তখন তার বিয়েও দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে হল ।
        দাদা যখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন সেখানে সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে বেলার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর দাদা পাটনায় গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে তিনি তক্ষুনি রাজি হয়ে যান । আমি অফিসের কাজে নাগপুরে গিয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় আর সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ওর অভিভাবকরা সেদিনেই সায় দেন । বাবাও টেলিগ্রামে অনুমোদন জানিয়ে দেন । কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এই বিয়েকে মা আর বাবা বলতেন, “তোদেরটা বৈপ্লবিক বিয়ে, পরিবারদের মাথা গলাতে হল না, হপ্তার পর হপ্তা রোদ-বৃষ্টি ঠেঙিয়ে প্রেম করতে হল না, ব্যাস, একজন আরেকজনকে বললি বিয়ে করব, করে ফেললি ।”
       আমি লেখালিখির চেষ্টা করছি, মায়ের কাছে সেকথা জানতে পেরে ১৯৫৮ সালে বাবা আগফা-গেভার্ট কোম্পানির একটা দামি ডায়েরি দিয়েছিলেন, আর তাতেই আমি কবিতা মকসো করা শুরু করেছিলুম । বাড়িতে ইংরেজি ভাষার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহ গড়তে চাই জানতে পেরে বাবা বলতেন বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতে । বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পছন্দ করে নিতুম আর পেয়ে যেতুম । বাংলা বই, বিশেষ করে কবিতার বই দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন । পরে বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও প্রচুর বই আর পত্রিকা পেতুম । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কলকাতার পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এসে আমার বইগুলো নিয়ে সারা ঘরে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছিল । বাবার দোকানের কাচের আলমারি ভেঙে দিয়েছিল । মায়ের বিয়ের তোরঙ্গ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করার সময়ে ওনার বিয়ের পুরোনো বেনারসি ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল । কিন্তু আমাকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ তখন বাবাকে বেশ বিচলিত দেখেছিলুম, যা উনি সচরাচর হতেন না । ছোটোবেলায় আমি বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছি ; ফিরে এসে মনে হয়নি যে বাবা বিচলিত ; উনি আমাকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা জিজ্ঞাসাও করতেন না । পরে, আমার মেয়ের কাছে গল্প করেছিলেন যে আমি ওনাদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতুম ।
         অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে ছিলেন কয়েক দিন । তিনি নানা শহরে ঘুরে বেশ কিছু ফিল্মে ফোটোম তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দেন ডেভেলাপ করার জন্য । বাবা ডেভেলাপ করে দ্যাখেন গিন্সবার্গ কেবল নুলো, ভিখারি, দুস্হ, পথের পাশে অসুস্হ লোক, কুষ্ঠরোগি-- এদের ফোটো তুলেছে । তখন গিন্সবার্গের সঙ্গে ওনার একচোট ঝগড়া হয়েছিল । বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, “তোমরা যতই বড় কবি-লেখক হওনা কেন, আমাদের দেশটাকে এইভাবেই দেখাতে চাইবে ; কেন ? ফোটো তোলার আর কোনো বিষয় কি নেই !” গিন্সবার্গ সম্পর্কে যে গবেষকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁদের সবাইকে এই ঘটনার কথা জানালেও, কেউই নিজেদের লেখায় এই বিতর্কটা অন্তর্ভুক্ত করেননি । পরে , পাটনার বাড়িতে বা কলকাতায়, বিদেশিরা এলে আমি তাঁদের বলতুম যে ফোটো তুলে থাকলে দেশে ফিরে ডেভেলাপ আর প্রিন্ট করিও ।
         আমি প্রথম চাকরিটা পাই পাটনাতেই । তারপর ১৯৭৯ নাগাদ গ্রামোন্নয়নের চাকরি পেয়ে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে যাই লখনউ । দাদা সপরিবারে পাটনা ফেরার পর মা আর বাবা আমার কাছে লখনউ চলে আসেন । লখনউতে ১৯৮২ সালের ১৮ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান । মা মারা যেতে বাবা বেশ একা বোধ করতেন, কেননা আমি আর সলিলা দুজনেই অফিসে চলে যেতুম আর ছেলে-মেয়ে চলে যেতে স্কুলে । দাদা তাই বাবাকে পাটনায় নিয়ে যান । লখনউ থেকে আমি ১৯৮৭ সালে বদলি হয়ে মুম্বাই চলে যাই । বাবাকে তখন মুম্বাই নিয়ে গেলে ভালো হতো ; মুম্বাইতে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পাটনার চেয়ে উন্নত । ১৯৯১ সালের ৮ই অক্টোবর বাবা পাটনায় মারা যান ।


 *********
মলয় রায়চৌধুরীর পিতা প্রয়াত রঞ্জিত রায়চৌধুরী ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ তারিখে পাটনা থেকে মলয়চৌধুরীর স্ত্রী সলিলাদেবী'কে মুম্বাইতে যে চিঠি লিখেছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এখানে দেয়া হল ।
মলয় রায়চৌধুরীর পিতা-মাতা

মলয় রায়চৌধুরীর স্ত্রী সলিলা দেবী

স্নেহের সলিলা,


তোমার চিঠি ঠিক সময়েই পেয়েছি, কিন্তু শরীরের ধৈর্য্যের অভাবে ঠিক সময়ে উত্তর দিতে পারিনি । শরীরটা খুব ভালো নয় আর মনেও কোনো শান্তি নেই । বরং ভদ্রকালীতেই বেশ শান্তিতে ছিলাম । আর বেশিদিন এ-পৃথিবীতে থাকতে আর ইচ্ছে নেই ।
ফণার শরীর এখন কেমন আছে জানাবে । আমার মনে হয় লিভারের দুর্বলতার জন্য হচ্ছে । হোমিওপ্যাথিক কিংবা বায়োকেমিক ঔষধ খেয়ে ঠিক হবে । রেগুলার বায়োকেমিক ঔষধ খেলে সকলেরই শরীর ঠিক থাকে । আমি তো তাইই খাই । কিন্তু শরীরের আর নেবার ক্ষমতা নেই । বারোটা বায়োকেমিক ঔষধ জার্মান মেক সিলড কিনে রাখো । এবং একটা ভালো বায়োকেমিক বই । আর সিম্পটম দেখে খেলে সকলেরই উপকার হবে । কারণ বায়োকেমিক ঠিক ঔষধ নয়, ওটা শরীরের যে সল্ট-এর অভাব হয়, যে সিম্পটম তৈরি হয়, তারই ঔষধ । অল্প পরিমাণ ব্যবহার করলে সেই রোগ সারিয়ে দেয় । শরীরের কোনো ক্ষতি করে না ।
এখন তুমি অফিস জয়েন করেছ বোধহয় । এখানের খবর সেই একইরকম। আমি ওই ওপরে বসে থাকি । কাগজ পেলে পড়ি । দোকানে একদম যাই না । শরীর ভালো থাকলে হাথুয়া মার্কেট  পর্যন্ত সকালে ঘুরে আসি । বেলা আর চামার উপেন্দ্র, ওরাই মাইন, আর অবসর সময়ে মিনু, টোটন, বিটু ওরাই সব দোকানদারি করে । এখন আমার কোনও দাম নেই । টোটনের রেজাল্ট বেরোয়নি, তবে খবর পেয়েছে পাশ করেছে । সাইন্সে ভালো নম্বরই পেয়েছে । সাবিত্রীদের বাড়ির খবর সেই একই রকম । ধাবু অপারেশান করিয়েছিল, এখন ঠিক আছে তবে মাঝে-মাঝে পাইন হয় । দেশের কোনও খবর পাইনি । আজ সেন্টুর সঙ্গে দেখা হল রাস্তায় । ও তো এখানে আর আসে না । সাবিত্রীদের বাড়িতেই নাবে । তোমাদের সব খবর দেবে । সবাই আমার স্নেহ ভালোবাসা নেবে । ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবে ।
অনুশ্রীর চিঠিও পেয়েছি । বাপ্পাকে চিঠি দেব ।


ইতি বাবু

********
মলয় রায়চৌধুরী

*****

Wednesday, June 27, 2018

দাদা সমীর রায়চৌধুরী সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ

১.
দাদার প্রথম পোস্টিং ধানবাদে, থাকতো একটা গ্যারাজের ওপরে একতলার ফ্ল্যাটে । একবার গিয়ে দেখি দাদা অফিসে গেছে আর দাদার বন্ধু দীপক মজুমদার বাসন মাজছেন ।
২.
আমি মাটিতে, দাদা চেয়ারে, দাঁড়িয়ে মেজদা, দুইপাশে জাঠতুতো বোন ডলি আর মনু । চেয়ারটা দাদা নিলামে দু'টাকায় কিনে এনেছিল ।

৩.
চাকরি করার সময়ে দাদা ভেবে রেখেছিলেন যে অবসর নিয়ে কলকাতায় নিজের বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে "হাওয়া৪৯" নামে একটা দার্শনিক-সাহিত্যিক পত্রিকা বের করবেন । পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে লেখা চাইতে গেলে কেউই পাত্তা দেননি, এমনকি যাঁরা দাদার চাকুরিস্হলে অতিথি হয়ে সস্ত্রীক নিয়মিত থাকতে যেতেন, তাঁরাও । দাদাকে সঙ্গ-সাহচর্য দিতে এগিয়ে এলেন তরুণ-অতিতরুণরা, যাঁরা নিজেরাই অন্যরকম ভাবা আরম্ভ করেছিলেন ।
৪.
দাদাকে ঠাকুমা খুব ভালোবাসতেন । হাংরি আন্দোলনে দাদার গ্রেপ্তারির সংবাদে সেই দিনই ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয় আর উনি মারা যান ।
৫.
শীতকালে স্কুলে যাবার সময়ে দাদা একটা ঢোলা ডবল-ব্রেস্ট কোট পরে যেতো ; পরে সেটা আমিও পরেছি । কোটটা ছিল ঠাকুর্দার, পেশোয়ারে থাকার সময়ে পরতেন । ঠাকুমা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন, আর প্রথম বংশধরকে উপহার দিয়েছিলেন ।
৬.
দাদার ব্রহ্মপুরের বাড়িতে থাকার সময়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সামনের বড়ো বারান্দার মাপের মশারি তৈরি করিয়ে তার ভেতরে চেয়ার-টেবিল নিয়ে 'দারা শিকো' লিখেছিলেন ; যারা ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসতো তারা ওই মশারির ভেতরে বসেই আড্ডা দিতো । দাদা পাটনা থেকে ফিরে দ্যাখেন যে ওনার প্রিয় সবেদাগাছ কেটে ফেলেছেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ শ্যামল, হোমাগ্নির কাঠের প্রয়োজন মেটাতে ।
৭.
চাইবাসায় হাড়িয়া মহুয়া ইত্যাদি নেশার জিনিসের কথা শুনে পিটার অরলভস্কিকে নিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ গিয়েছিলেন দাদার বাসায় । দাদা প্রথম দিন ওদের তালশাঁস আর জাম খাইয়েছিল । ওনারা খাবার পর বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও নেশা না হওয়ায় দাদাকে জিগ্যেস করেন ব্যাপারটা কী । দাদা বলে, "আয়নায় দ্যাখো, তোমাদের জিভে পয়জানাস ব্লু কালার" । দুজনেই ভয় পেয়ে যান । পরের দিন দাদা ওনাদের হাটে নিয়ে যায় হাড়িয়া আর মহুয়া খাওয়াবার জন্য । 

৮.
চাইবাসায় নিমডি টিলার ওপরের চালাঘরে একা থাকতে ভালোলাগে না বলে দাদা কলকাতা থেকে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গেল ; সেই বন্ধু কোনো চাকরি করত না, তাই সুবিধাই হল দাদার । বন্ধুটি দাদার চালাবাড়িতে আড়াই বছর থেকে গেল আর প্রতিদিন কবিতা লেখার ফুরসত পেয়ে গেল । দাদা তার জামা-গেঞ্জি-ট্রাউজার-চটিও কিনে দিত। ট্যুরে গেলে একটি পরিচিত পরিবারে তাকে অতিথি হিসাবে রেখে যেত দাদা। সেই বন্ধুর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।
৯.
দাদা একবার বলেছিল, "আমি মোটর সাইকেল ভালো চালাতে পারি মানে এই নয় যে রাস্তায় আরো যারা চালাচ্ছে তারাও ভালোভাবে চালাতে পারে, কে কখন ধাক্কা মারবে তার ঠিক নেই । ব্যাপারটা ধর্মের মতন : অন্যের বিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার কাছে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু আসে-যায় না ।"
১০.
সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার সময়ে দাদা আর দাদার বন্ধু অমিত মৈত্র উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে "লেখা" নামে একটা চটি-পত্রিকা প্রকাশ করত । সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজনের কবিতা পড়ে দাদার তা প্রশংসনীয় মনে হওয়ায় আর্টস বিভাগে গিয়ে কবিতাটির রচনাকারের সঙ্গে আলাপ করে। সেই তরুণটির কবিতার বই দাদা প্রথম মাইনে পেয়ে প্রকাশ করেছিল । তার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।
১১.
শৈশবে দাদার একটা চোখ ট্যারা ছিল । কুড়িজনের সংসার চালিয়ে পাটনার একমাত্র চোখের ডাক্তার ( জগজীবন রামের বাবা ) দেখাবার মতন টাকা বাবার ছিল না । বাবার দোকানে ডাক্তারের বৃদ্ধ বাঙালি কমপাউণ্ডার আড্ডা মারতে আসতেন । তিনি অন্য একজনের ট্যারা-চোখ সারাবার প্রেসক্রিপশান এনে দিলে বাবা দাদার চশমা করিয়ে দেন । দাদার ট্যারা চোখ সোজা হয়ে গেল, কিন্তু সারাজীবনের জন্য বাঁচোখ খারাপ হয়ে গেল ।
১২.
দোতলার ছাদে তিনচাকার সাইকেলে বসে একদিক থেকে আরেক দিকে যেতে-যেতে দাদা চেঁচাচ্ছিল, "এই বুড়ো ( মানে মেজদা ) গলা ছাড়, গলা ছাড়, নেমে যা, লাগছে গলায়।" আমার ছোটো জাঠতুতো বোন মনু চেঁচিয়ে উঠল, "বড়দা, তোমার পিঠে একটা লালমুখো বাঁদর, ফ্রি রাইড নিচ্ছে ।" দাদা লাফিয়ে নেমে দ্যাখে সত্যিই একটা বাঁদর, ছাদে দেয়া বড়ি খেতে এসে চেপে গেছে দাদার কাঁধে । 
১৩.
বাড়ির কাজের লোক শিউনন্নির বকুনি দেবার অধিকার ছিল না গৃহস্বামীর ছেলেকে । "রামচরিতমানস" পুরো মুখস্হ ছিল শিউনন্নির, আর বকুনির বদলে উপযুক্ত কোট করত, যার একটা প্রায়ই দাদাকে শুনিয়ে বলত, "তুলসী দেখি সুবেষু ভুলহিঁ মূঢ় ন চতুর নর, সুন্দর কেকিহি পেখু বচন সুধাসম অসন অহি" । মানে, ময়ূর যতোই সুন্দর হোক, সাপ খায় যেন সুধা চাটছে । ( স্মৃতি থেকে, তাই কিছু ভুল থাকতে পারে ।
১৪.
প্রতিবেশী হুলাসবাবুর বাড়িতে গিয়ে একটা খেলা খেলতে দাদার ভালো লাগতো । চোখ বুজে "রামচরিতমানস" বইটা খুলে যেকোনো দোহায় 'রামশলাকা' দিয়ে নির্দেশ করা । 'রামশলাকা' ছিল ক্রুশকাঠির মাপের লোহার কাঠি । দোহাটা ব্যাখ্যা করে হুলাসবাবু ভবিষ্যত বলতেন ।
১৫.
মেজজ্যাঠা জামের ভিনিগারের ব্যবসা ফাঁদার পরিকল্পনা করেছিলেন । তিন ফিটের এনামেলের গামলা জামে ভরে তার ওপর দাদাকে লেফ্ট-রাইট করতে বলতেন । দাদা পা দিয়ে জাম পেষার সময়ে চেঁচিয়ে একটা গান গাইতো, "তুফান মেল, ইসকে পহিয়ে জোর সে চলতে, অওর অপনা রাস্তা তয় করতে, সবলোগ ইসসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল, তুফান মেল" ( বোধহয় কাননবালার গাওয়া দাদার প্রিয় কোনো ফিল্মের, স্মৃতি থেকে লিখলুম )
১৬.
প্রতিদিন রাতের খাবার পর বড়জেঠিমা আমাদের ভাইবোনদের একত্র করে গল্প বলতেন, আরব্য রজনী, ইশপের ফেবল, বেতাল ইত্যাদি থেকে অংশ নিয়ে নিজের মতন করে মিলিয়ে-মিশিয়ে অবিশ্বাস্য কাহিনি । আমরা লন্ঠন ঘিরে বসতুম । দাদা লন্ঠনটা নিভিয়ে দিতো, বলতো আলো জ্বললে গল্পটা দেখতে পাবো না ।

১৭.
দাদার সজনেগাছ ভরে গিয়েছিল শুঁয়াপোকায় । দাদা বলেছিল, গাছটা মানুষের থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য শুঁয়াপোকার বর্ম পরে নিয়েছে ।
১৮.
দাদা পাড়ার বন্ধু বুল্লুদের বাড়ি থেকে হোমিওপ্যাথির শিশিতে জল এনেছিল, বলেছিল, নতুন ধরণের জল বেরিয়েছে, মাথায় ঘষলেই ফেনায় ফেনা । জল মেখে মাথায় ফেনা দেখে জেঠিমা বলেছিলেন, ফেলে দে, ফেলে দে, নিশ্চই মন্তর পড়া । ইমলিতলার বাড়িতে ওইভাবেই শ্যাম্পুর প্রবেশ ।
১৯.
কোনো কারণে শাস্তি দেবার জন্য বড়জ্যাঠা শরকাঠি নিয়ে দাদাকে মারার জন্য ডাক পাড়লে দাদা আমাদের ছাদ থেকে পাশের বাড়ি হুলাসবাবুদের ছাদে লাফ মেরে পালাতো । দুই বাড়ির মাঝে চার ফিট চওড়া গলি ছিল ।
২০.
"তোমাদের বাড়ির রোদ" এই কথাটাও দাদা কাজের বউয়ের কাছ থেকে পেয়েছিল ; প্রত্যেকের বাড়িতে যে রোদ আসে তা তার নিজস্ব ।
২১.
কমরেডরা যে সময়ে দারিদ্রকে মহিমান্বিত করে গল্প-উপন্যাস লিখছিলেন, দাদা বললেন যে প্রলেতারিয়েতের সৌন্দর্য্যবোধ ও জ্ঞান নিয়ে লিখবেন । কাজের বউ আসার আগে প্রতিদিন ফুলদানিকে টেবিলের মাঝখান থেকে সরিয়ে কোনে বা পাশে রেখে দিতেন । কাজের বউ সকালে কাজে এসে ফুলদানিটা আবার টেবিলের মাঝখানে রেখে দিত, এবং বিরক্তি প্রকাশ করতো ।
২২.
ইঁদুর মারার জাঁতিকলে ইঁদুর মরলে দাদা ছাদে উঠে বা মাঠে গিয়ে ইঁদুরটার ল্যাজ ধরে ঘোরাতো আর আকাশে চিলেরা চক্কোর দেয়া আরম্ভ করলে "চিল কা বাচ্চা চিলোড়িয়া" বলে আকাশে ছুঁড়ে দিতো চিলেদের দিকে । কোনো একটা চিল ছোঁ মেরে ইঁদুরটাকে ধরে নিয়ে উড়ে চলে যেতো। 
২৩.
ইমলিতলার বাড়িতে সিনেমা দেখাকে মনে করা হতো অধঃপতন । বাড়িতে যাতে কেউ টের না পান তাই একটা ফিল্মের প্রথম অর্ধেক দেখে ইনটারভালের সময়ে গেটপাসটা আমায় দিয়ে দাদা বাড়ি চলে যেতো । পরের দিন আমি প্রথম অর্ধেক দেখতুম আর বেরিয়ে গেটপাসটা দাদাকে দিয়ে বাড়ি চলে যেতুম ।
২৪.
কানাগলির শেষে দলিতদের উঠোনের গর্তে চারপা বাঁধা শুয়োরকে গনগনে লোহা ঢোকাবার আর্তনাদ শোনার পরদিন দাদা বলতো, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, বাড়ি ফিরে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিতে হবে, আজকের খাবার শুয়োরের মাংসর সঙ্গে তাড়ি।
২৫.
সাইকেলের টায়ারকে কাঠি মেরে-মেরে গোলা রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত নিয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় প্রতিবার দাদা জিততো ।
২৬.
একটা নীল মাছিকে মেরে, সুতোয় বেঁধে, গোপাল হালুইকরের ভিমরুলের ঝাঁকে গিজগিজে জিলিপির ওপর ফেলতো দাদা । একটা ভিমরুল যেই নীল মাছিটাকে কামড়ে ধরতো, দাদা ওই সুতোটা ঘুড়ির মতন ভিমরুল ওড়াতে-ওড়াতে ইমলিতলার গলি দিয়ে দৌড়োতো। পেছনে পাড়ার ছেলের দল ।

২৭.
উনোনের জন্য রোজ কয়লা ভাঙতে হতো দাদাকে । পরে মেজদা বা আমাকে ।
২৮.
দাদার পড়ার টেবিল ছিল একটা প্যাকিং-বাক্স, তার ওপর মায়ের পুরোনো শাড়ি পাতা । রাতে তার ওপর লন্ঠন । লন্ঠনের ভুষো দাদা পরিষ্কার করতো ।
২৯.
গোলারোড দিয়ে শব নিয়ে যাবার সময়ে শববাহকরা খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছুঁড়তো । 'রাম নাম সৎ হ্যায়' শুনতে পেলেই দাদা বলতো, "চল চল, মড়ার পয়সা লুটবো" । দাদার পেছন-পেছন আমি আর মেজদা দৌড়োতুম । দাদা ওই পয়সায় আলুকাবলি খেতো ।
৩০.
ফুটবল খেলার সময়ে দাদার জুতো দিয়ে গোলপোস্ট হতো, আর বাড়ি ফেরার সময়ে ভুলে যেতো । নতুন জুতো বাবা কিনে দিতেন কেবল পুজোর সময়ে । ততোদিন দাদা খালি পায়ে স্কুলে যেতো ।
৩১.
রবিবার করে বড়োজেঠার র্যালে সাইকেল নিয়ে মাঠে সাইকেল চালানো শিখতে যেতো দাদা । বড়োজেঠার শর্ত ছিল যে দুপুরে ওনার খাওয়া হয়ে গেলে পিঠ থেকে পা পর্যন্ত হাঁটতে হবে । স্প্রিং খাটের লোহার বাটাম ধরে বড়োজেঠার পিঠে পঞ্চাশবার হাঁটতো দাদা । জেঠা তার আগেই নাক ডাকা আরম্ভ করলে চুপচাপ নেমে পড়তো ।৩২.
হাংরি মকদ্দমার সময়ে বলা দাদার একটা কথা মনে পড়ে গেল :"অনেক মানুষ রাস্তার ঢিলের মতন নোংরা হয়, সুট মেরে-মেরে স্কুলের গেট অব্দি নিয়ে যেতে পারবি ; আবার অনেকের নোংরামি হয় পাহাড়ের মতন, লাথি মারলে তোর নিজেরই পায়ে লাগবে ।"
৩৩.
দাদার স্কুলের বইতে কোনো না কোনো গাছের পাতা থাকতো, পেজমার্ক হিসাবে ব্যবহারের জন্য । কেবল নেসফিল্ডের গ্রামারে থাকত যবার শীষ, সংরক্ষণ করতো পরের সরস্বতীপুজো পর্যন্ত । পৈতে হবার পর দাদা সরস্বতীপুজো করতো, মূর্তির নয় -- বই পুজো, তার আগে করতেন পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল ।

মলয় রায়চৌধুরীর বাণী

শত্রুতা শেখা দরকার মাকড়সাদের থেকে ; ওইটুকু মাকড়সা অথচ শত্রুদের মুখে থুতু ছিটিয়ে কি বিশাল জালের ফাঁদ পেতে রাখে
***
ফোন করে স্বপ্নে আসতে চাইছেন এক যুবতীকবি
***
স্বপ্ন মাত্রেই পোস্টমডার্ন, তাদের অরৈখিক রাইজোম্যাটিক প্লটের কারণে
***
দেবীরা সবাই রোগের ( শীতলা, মনসা, পর্ণশর্বরী, ধূমাবতী ) আর দেবতারা সবাই চিকিৎসক ( ধন্বন্তরী, ধাত্রী, অশ্বিনীভাইরা ) কেন ?
***
যদি না চোখেচোখে রাখা হয়, তাহলে পুলিশ স্টেট হয়ে ওঠার জন্য গণতন্ত্রের মাটি সবচেয়ে নরম
***
সঙ্গমের চেয়ে যোনির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার আনন্দ বেশি
***
জলাতঙ্ক রোগটা কুকুরেরা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছে
***
আমার কখনওলাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটহয়নি ; প্রতিবারলাভ অ্যাট ফার্স্ট টাচহয়েছে
***
কবিতার জন্য নিয়তিকে বশে আনতে হয়
***
প্রতিশোধের ষড়যন্ত্রকে জিইয়ে রাখা জরুরি কেননা তা জখমকে তাজা রাখে
***
আমার যে কুষ্ঠিঠিকুজি মা তৈরি করিয়েছিলেন, তার সমস্ত ভবিষ্যবাণীকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছি
***
যে যুবতী নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করেন, তাঁর আত্মচিন্তা সম্পর্কে ধারণা করা অসম্ভব
***
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সবুজ ঘাসের ওপরে সঙ্গমের তুলনা হয় না যেমন শরৎকালের জ্যোৎস্নায় ফাঁকা মাঠে জোনাকিদের মাঝে উলঙ্গ প্রেমিকপ্রেমিকার নাচ
***
প্রেম তখনই সফল যখন তা প্রেমিক আর প্রেমিকা দুজনকেই একযোগে ধ্বংস করে দ্যায়
***
কবির প্রতিষ্ঠা অন্য কবিদের ঈর্ষায় লুকিয়ে অগ্রজ লেখকেরা ঈর্ষা করার মাধ্যমে অনুজ লেখকদের স্বীকৃতি দেন
***
তুমি যাকে ঘৃণা করছ সে যদি তা জানতে না পারে তাহলে ঘৃণা করার কোনো মানে হয় না
***
প্রকৃত সুন্দরীর দিকে দ্বিতীয়বার তাকালে সৌন্দর্যের পরিভাষা যৌনতায় পালটে যায়
***
মানুষ পৃথিবীর প্রতি অপার বিরক্তি নিয়ে জন্মায় ; তাই সে জন্মেই কাঁদতে আরম্ভ করে
***
নাগরিকদের দুঃখকষ্টযন্ত্রণা দেবার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব
***
অপবাদ আকর্ষণ করার ক্ষমতা না থাকলে জীবদ্দশায় একজন কবির খ্যাতি বৃথা
***
সবচেয়ে আনন্দদায়ক বৃষ্টি হল যখন তা ফাঁকা মাঠে তোমায় তাড়া করছে আর তা তোমায় ধরে ফেলতে ব্যর্থ হল
***
যেকোনো ব্যাপার তোমাকে নষ্ট করে দিতে পারে, তা অসাধারণ কবিতা হোক বা অপরূপা প্রেমিকা
***
কখনও সাহিত্যআলোচকদের মনের মতন লেখার চেষ্টা করা উচিত নয় নিজের মনের মতন লিখতে গেলে রিস্ক নিতেই হবে
***
তোমার লিঙ্গও সঠিক সময়ে তোমার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করতে পারে
***
ক্ষমা করার আগে গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত
***
এই বয়সে কোনো যুবতী ভালোবাসার প্রস্তাব জানালে অমঙ্গলের আশঙ্কায় আক্রান্ত হই
***
জীবন সম্পর্কে কথা বলা প্রায় অসম্ভব কেননা বাংলা ভাষায় তার জন্য সঠিক অভিব্যক্তি এখনও পাওয়া যায় না
***
আমি ভাগ্যবান যে আয়নাকে ঘৃণা করার দরকার হয় না আমার টাক পড়েনি ; কখনও পড়বেও না
***
মানব সম্প্রদায়ের মুক্তির তাত্বিকরা শেষ পর্যন্ত গণহত্যাকারীতে রূপান্তরিত হয়
***
সবচেয়ে বাজে আবিষ্কার হল লাউডস্পিকার, বিশেষ করে যখন তা সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের দানব হয়ে ওঠে
***
কবিতা মনের বিশৃঙ্খলাকে কয়েদ করে
***
প্রতিটি শব্দেই যদি ক্রিয়া লুকিয়ে থাকে, তাহলে একটিমাত্র সত্য বলে কিছু হয় না ; যা হয় তা হল কর্ম ক্রিয়াপদে নিহিত থাকে কর্মশক্তি
***
আদালতের জজরাই যখন সন্দেহের ঊর্দ্ধে নন বলে বিধায়করা দাবি করছেন, তখন সাহিত্যের বিচারকরা কোন যুক্তিতে সন্দেহের ঊর্দ্ধে ?
***
ব্যর্থ বিপ্লবী বিদেশে গিয়ে মার্ক্সের কবর দেখতে যান ব্যর্থ কবি বিদেশে গিয়ে বদল্যারের কবর দেখতে যান
***
কোথায়জায়গাটা ঠিক কোথায় ?
***
এককালে যারা অবক্ষয়বিরোধী ছিল তারাই বঙ্গসমাজে অবক্ষয় নিয়ে এলো
***
বক্সিং ম্যাচ যারা দেখতে যায় তারা হারজিতের মাধ্যমে জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজে
***
পবিত্র বইআরঅপবিত্র বই”-এর পার্থক্য হল যেঅপবিত্র বইকেবলমাত্র কবিরাই লিখতে পারেন
***
গ্ল্যামারের আকর্ষণ হল ক্যাটওয়াকের শেষে যুবতীদের সমবেত ঘামের গন্ধ, যা অত্যন্ত দামি পারফিউম দিয়েও চাপা পড়ে না
***
সকলেই ভাবেপৌঁছে গেছি পেছন ফিরে তাকিয়ে টের পায় যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে
***
কেউ আমাকে ঘৃণা করলে তা উপভোগ করি
***
পশুরা জানতেই পারল না যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী
***
ধর্ম যে উদ্দেশ্যহীন এবং ভাঁওতা তা সবচেয়ে ভালো করে জানে সেই বুড়োগুলো যারা নারী কিশোরদের মানববোমা তৈরি করে পাঠায়
***
প্রগতির একরৈখিক ধারণা  প্রিমিটিভ
***
বাজারকরা আর ভোটদেওয়া ছাড়া নাগরিকের কোনো সম্পর্ক আছে কি সমাজ আর রাষ্ট্রের সঙ্গে ?
***
দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের যে সাম্যবাদীরা দেশভাগ সমর্থন করেছিল, তারাই ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭এর অনেক আগে ভারতে পালিয়ে এসেছিল তাদের কি তকমা দেয়া উচিত ? বিশ্বাসঘাতক !
***
প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতারকবিতাটি হল  Confessions of pain ; যে কবিরা এই কবিতাটিকে হিংসে করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে আমার যন্ত্রণাবোধকে হিংসে করেন
***
লেসবিয়ানরা  পুরুষাঙ্গের মুখমেহন করতে পান না বলে কিপেনিস এনভিপুষে রাখেন ?
***
প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায় উন্মদের মস্তিষ্কে, অথচ উন্মাদনা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না
***
তুমি যদি নার্সিসিস্ট না হও, তাহলে তুমি আধুনিক কবি নও
***
বাঙালিরমধ্যমেধানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেকে চেঁচামেচি করেন যদি সকলেইমধ্যমেধাহতো তাহলে বিদেশে কারা পালিয়ে গিয়ে বসবাস করছে ?
***
ভালো মানুষের পক্ষে ভালো বন্ধু পাওয়া অত্যন্ত কঠিন
***
আশাবাদ : লক্ষ বছর আগে মরে গিয়েছে যে নক্ষত্র তার আলো এখন এসে পৌঁছেচে পৃথিবীতে
***
মরে গেলে আত্মার সদ্গতির জন্য শোকপ্রকাশ করবেন না ; আমার আত্মা নেই আমার গ্রন্হগুলোর আত্মা আছে
***
কবিতার উৎস কোনোনাকোনো রহস্য যার উন্মোচন অন্য উপায়ে সম্ভব নয়
***
যার নির্বাণ কিংবা মহানির্বাণ ঘটে সে তা জানতে পারে না তাহলে নির্বাণ বলতে কী বোঝায় ?
***
যোনিকে ফর্সা করে তোলার বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখি টিভিতে যোনি কালো হোক বা ফর্সা তাতে প্রেমিকের কীই বা এসে যায় !
***
জোয়ার, ভাটা, এল নিনো, নিম্নচাপ, ঘূর্ণাবর্ত, বন্যা ! জলের অসুখ হল প্রকৃতির জলাতঙ্ক
***
সব ধর্মের পুরোহিতরাই নানা রকমের আচরণ করেন দেখে মনে হয় বাচ্চাদের খেলা তাই বোধহয় ধর্মগুলোয় নানা খোকোনপ্রিয় গাঁজাখুরি গল্প গড়ে ওঠে
***
ভারতে অনেক পরিবার হাজার বছর ধরে গরিব তবু তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় না কেন ? জাতপাতের বর্ণবিভাজনের কারণে !
***
অন্ধকারে বিছানাকে আরণ্যক বধ্যভূমি করে তোলাই ফুলশয্যা
***
রাস্তায় অচেনা মানুষদের ভিড়ে গাঘেঁষাঘেষি করে হাঁটার সময়ে একাকীত্বকে যেভাবে উপভোগ করি, সেভাবে একা ঘরের কোনে বসে হয় না
***
পাশা খেলায়, মানে জুয়ায়, যুধিষ্ঠির কখনও জিততে পারেননি, তবু কেন শকুনি চরিত্রের প্রয়োজন ?
***
যে লোকটা ভয়ে কখনও কোনো মাদক নেয়নি সে গাঁজাটানার বিরোধীতা করবেই
***
একএকজন মানুষকে একবার দেখলেই টের পাওয়া যায় তার মগজে সাভানার কোন জন্তুদের উৎপাত চলছে
***
জীবনে একবার অন্তত আকুল কামলালসায় আক্রান্ত হবার অভিজ্ঞতা জরুরি
***
পরস্পরবিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে একযোগে ধরে ফেলতে পারে কবিতা
***
প্রেম শেষপর্যন্ত অনীহা, উদাসীনতা, গতানুগতিকতা, অমনোযোগ, একঘেয়েমিতে পৌঁছে ফুরিয়ে যায়
***
বিশ্বাসঘাতকরা মরবার আগে আত্মসন্মানহীন শিষ্যদের তৈরি করে যায়, যারা মৃতের গোলামি করে বেঁচে থাকে
***
যে লোক তোমার সঙ্গে ছলনা করেছে সে চিরকাল তোমার বিরুদ্ধে কথা বলবে, এবং সে যদি লেখক হয় তাহলে তোমার বিরুদ্ধে লিখবে
***
জীবনে একবার কেউনাকেউ পিঠে ছুরি মারবেই, আর সেআঘাত কখনও সারবে না
***
বিশুদ্ধ ক্ষমতার লোভ থেকে গুণ্ডা এবং রাজনেতাদের জন্ম
***
মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য তাদের যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত করা সউদি আরবে এই প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে কেননা আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্হে কেবল পুরুষের খতনা সম্পর্কে নির্দেশ আছে
***
বিষয়সম্পত্তির জন্য মানুষমানুষীর এতো লোভ হয় কেন ? ভবিষ্যতের জন্য নয় যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল তখন গুহার দখলিসত্ত্ব নিয়ে লড়াই করতে হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সেই প্রাগেতিহাসিক মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে বেশির ভাগ মানুষের চরিত্রে
***
বুড়ো বয়সের একটা ফোটো পোস্ট করেছিলুম ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে, একথা জানিয়ে যে পেনশনে টিকে আছি এবং মুম্বাইতে থাকি বহু তরুণী প্রোপোজাল পাঠিয়েছেন ! কী কারণ হতে পারে ? বাবাপ্রেমিক চাই ? মুম্বাইতে ছাদ চাই ?
***
অনেক পরিচিত মানুষমানুষী স্বপ্নে বারবার আসেন, অথচ আমি চাই না তাঁরা আসুন বোঝা যায় যে প্রতিটি ব্যাপারে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না
***
আমি লিখি গল্পহীন গল্প ; অনেকে তাকেও ছোটোগল্প বলে মনে করেন
***
সৃজনশীল মানুষের অধঃপতনের অভিজ্ঞতা হওয়া জরুরি, কেননা তা জ্যোতিষ্কদের হয়, পশুদের হয় না

[ রচনাকাল : নভেম্বরডিসেম্বর, ২০১৫ ]

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...