অনুপম মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’
জখম : একটা সেতু : পেছনে আকাশ । সামনে আকাশ । যে দিকে চোখ যায় কিছুটা হলেও আকাশ । আকাশ । লাল । লাল হতে পারে সূর্যের আগামি মৃত্যুর জন্য । হতে পারে আগ্নেয়গিরির লাভা বমনের অসংযমের জন্য । সেহেতু একটা লোক । লোকটা কি মলয় ? মলয়ের রঙ কি হলুদ ? তাঁর মুখে কি নরম হয়ে আসা ডিমের আদল আছে ? হতে পারেন লোকটা মলয় !
দু-হাতে কান চাপা দিয়েছে লোকটা । মুখে তার মমির মতো আতঙ্কিত বিস্ময় । বিস্মিত আতঙ্ক । আমাদের আতঙ্ক । মুখ তার চিরকালের মতো হাঁ হয়ে গেছে । চোখ বিস্ফারিত — চিরবিসজফোরণেই হয়তো । আমাদের বিস্ময় । মমির মুখে যে বিস্ময় গলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে । হয়তো কোনো ভ্রুণের মমি — মাতৃগর্ভেও আতঙ্কেই যে ফাঁকা হয়ে গেছে ওই আকাশ মাতৃজঠরের চামড়া । সেতুটি । অস্তিত্বের মধ্যে । জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত । প্রথম জন্ম থেকে প্রথম মৃত্যু পর্যন্ত । অসেতুসম্ভব তবু নয়ই বা কেন ?
পেছনে কিছু অস্পষ্ট মূর্তি । ছায়ামূর্তি বলব না তাদের । তারা কি মলয়ের পেছনে ? তারা কি আসছে ? না চলে যাচ্ছে ? ওরা কি কারও স্বজন হতে পারে ?
বিশ্বচরাচরে ছুটে চলেছে যে আর্তনাদ — মলয় কি তাকে কিছু বাড়ালেন ? বাড়াতে কি পারে কেউ ? ‘জখম’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই দীর্ঘ কবিতার প্রণেতা একজন চিরশিশু । বড়ো হওয়ার কোনো ইচ্ছে তাঁর নেই । ইনোসেন্সের বাইরে গিয়ে সেই ক্ষমতাও তাঁর নেই । ইনোসেন্ট না হলে কে চায় কবিতাকে বদলে দিতে ? মানুষকে সুন্দরকে দেখার চোখ বদলে দিতে ? অসম্ভব শৈশব, অবিশ্বাস্য কান্না বুকে না জমিয়ে এই কাজে নামা যায় না, যাবে না ।
‘জখম’ খুব স্পষ্টভাবে মলয় রায়চৌধুরীর মনের নৌকোয় বিশৃঙ্খলাকে তুলে আনে । একই সঙ্গে যন্ত্রণা ও আনন্দ, আশা এবং হতাশা । এক বিশ্বজনীন কম্পোজিশন । এক ম্যানিফেস্ট — যে কোনো রকম মনের, যে মনে আঁচড় কাটছে যাতনা ও উদ্বেগ । কেন ‘আধুনিক’ বললাম, ‘অধুনান্তিক’ বললাম না ?
‘জখম’-এর প্রতিটি রঙ ও রঙহীনতা, আকার ও আকারহীনতা ক্লস্ট্রোফোবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় । মোকাবিলা করতে চায় অ্যাংস্টের সঙ্গে —
ওফ
আমার ভালোলাগছে না এইসব
আমি মরে যাব আমি মরে যাব আমি মরে যাব
আমার দুঃখকষ্ট বুঝতে না পেরে ভেতরে ভেতরে আমার হাড়গোড় চিড় খেয়ে যাচ্ছে
খারাপভাবে জড়ো করা গা-গতর দিয়ে তৈরি হয়েছে আমার দেহাভিমান
সমস্ত বারণ আমান্য কোরে আমি আমার আত্মার কাছে যেতে চাইছি
উপরের উদ্ধার থেকেই বলছি ‘জখম’-এর পরিস্হিতিকে আধুনিক বলা সঙ্গত । মলয় এখানে তাঁর আধুনিকতায় হাঁপিয়ে উঠেছেন । ছটফট করছেন, শারীরিকতায় যেতে চাইছেন আত্মার কাছে । আমি বলতে চাইব চেতনা থেকে চৈতন্যের দিকে । অধুনান্তিকের দিকে । বোদলেয়ার থেকে গিন্সবার্গে নয়, রামপ্রসাদে । ‘জখম’ অধুনান্তিক নয়, কারণ এখানে জার্নির শুরুয়াত আছে — মানচিত্র চিনে নেয়া আছে — রাস্তার হালহদিশ জেনে নেওয়ার প্রমাণ আছে — জার্নিটা নেই । আধুনিকতার মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে — পোস্টমর্টেমের বর্ণনা আছে — মৃতদেহটা উধাও হয়নি, বাতাসের পচা গন্ধে তার প্রমাণ । অবশ্য অধুনান্তিকের জন্মের আগে তারা আকাশে ফুটে উঠেছে — সেটাই রাস্তা চেনাচ্ছে মলয়কে । তিনি লিখছেন :
এখন আমি প্রত্যেকটা ব্যাপারের শব্দ শুনতে পাচ্ছি
আমি আমার নিজের পাশে শুয়ে নিজেকে ভালোবাসলুম
উলিয়াম ব্লেকের সঙ্গে শুয়ে রইলুম তার আঙুরমাচানের নিচে
হুইটম্যানের চটের ওপর শুয়ে মৌচাক থেকে বাড়তি মধু ঝরে পড়ার গম্ভীর শব্দ শুনলুম
নীলার লেপের নিচে শুয়ে আদ্দেক রাত্তিরে উঠে এলুম নিজের ঠাণ্ডা বিছানায়
জীবনানন্দের বিছানার খোঁজে
‘জখম’-এর কবির স্বজন এঁরাই । এঁরা — আধুনিকতার মধ্যেই এঁরা ছিলেন, কিন্তু কদাচ তার সীমার ধারণায় এঁরা আঁটেননি । এঁদের মধ্যেও আমরা ক্লস্ট্রোফোবিয়ার সঙ্গে লড়াই এবং চৈতন্যের ছোঁয়ায় অ্যাংস্ট থেকে সোনার ফসল ফলাতে দেখি । বোদলেয়ার এঁদের সঙ্গে একই পংক্তিতে খেতে বসতেন না । যতই স্বর্গের স্বপ্ন দেখুন, আতঙ্কের স্বর্গ ছোঁয়া হয়নি তাঁর ।
আই আতঙ্ক আধুনিকতার আমদানি । সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার, ছুটে চলার ধারণা ও আকাঙ্খাই এর জন্ক-জননী । প্রকৃতির উপরে মানুষের জয়লাভ সম্ভব — এই অবাস্তবতা এর পৃষ্ঠপোষখ । মানুষের আবহমান অর্জনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান কথা বলতে চাইল — কিছু সংখ্যালঘু মানুষের দৌলতে এই স্পর্ধাও দেখা দিতে পারল । উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বোদলেয়ার অবক্ষয়ী আধুনিকতার অবতার হয়ে উঠলেন । তাঁর মুভমেন্ট শেষ পর্যন্ত নাম নিল The Decadence । এই নাম থেকেই বোঝা যেতে পারে চরিত্র । এই সাহিত্যের উপাদানগুলোকে মিলিয়ে নেওয়া যায় শেষ তিনটে খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে রচিত গ্রিক সাহিত্যের সঙ্গে, বা সম্রাট অগাস্টাসের মৃত্যুর ( ১৪ খ্রিস্টাব্দ ) পরে রচিত রোমান সাহিত্যের সঙ্গেও । এমন একটা সভ্যতা — যে তার সঙ্গে সূক্ষ্ম মূল্যবোধ এবং সৌন্দর্যবোধকে আঁকড়ে থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সেরা সময়টা পেরিয়ে এসেছে, এবং ক্ষয়জনিত মধুর স্বাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে অতিপক্ক ফলের মতো ।
বোদলেয়ারের কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্স এবং বৃহত্তর ইউরোপের সভ্যতারও একই হাল হয়েছিল । বোদলেয়ারের Les Fleurs du Mal প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিকের যে কোনো শর্তেও বিপ্রতীপে শিল্পসাহিত্যকে বসাতে চাইল । বসাতে চাইল নীতি এবং যৌনতার বিপ্রতীপে । শিল্পসাইত্যকে বলতে চাইল — একজন শিল্পী কেবলমাত্র তার স্টাইলকে উন্নত করে যাবেন, জৈবিক প্রবৃত্তিগুলোকে কোনো স্হান দেবেন না । অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর পোশাক চাপিয়ে দিতে হবে । প্রাকৃতিক লাবণ্যের ওপর রঙ । মানবিক অভিজ্ঞাতার বাইরে যাওয়ার জন্য ড্রাগ নেবেন, যৌনতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালাবেন । র্যাঁবো যেমন বলেছিলেন — The systematic derangement of all senses.
ওই সময়ের চরিত্রে ছিল অবসাদ, একঘেয়েমি, মানসিক অস্হিরতা এবং শক্তিহীনতা । সেই রাস্তাতেই দেখা দিল বিংশ শতাব্দীর সূচনা । লক্ষণগুলো থেকেই গেল ।
সেই The Decadence ছিল সুররিয়ালিজমের পূর্বপথিক । আঁদ্রে ব্রেতোঁ ১৯২৪ সালে Manifesto of Surrealism দ্বারা সুররিয়ালিজমের সূত্রপাত করলেন । স্বাধীন ও মুক্ত সৃজনশীলতার ওপরে যে কোনো বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষিত হল । বলাই যায়, The Decadence না আসলে সুররিয়ালিজম হয়তো দেখা দিত না । সুররিয়ালিজম উড়িয়ে দিল যুক্তি, প্রতিষ্ঠিত নীতি, সমাজ ও শিল্পের যে কোনো প্রথা, এবং শিল্পপদ্ধতির ওপরে কোনোরকম পূর্বধারণা ও উদ্দেশ্যের শাসন । মনের নির্জন স্তর, অবচেতন স্তরকে বাধাহীন কাজ করতে দেওয়া হল । বলা হল এটিই জ্ঞানের একমাত্র উৎস । সুররিয়াল কবি-শিল্পীরা অটোমেটিক রাইটিং-এর দিকে চলে গেলেন । স্বপ্নের উপাদানগুলোকে কাজে লাগালেন । থাকতে চাইলেন তন্দ্রা ও জাগরণের মধ্যবর্তী স্তরে । সৃজন করলেন প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম বিভ্রম । দিকপালরা হলেন আঁদ্রে ব্রেতোঁ, লুই আরাগঁ, সালভাদর দালি ।
শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সুররিয়ালিজমের চেয়ে বড়ো কোনো মুভমেন্ট বিংশ শতাব্দীতে আসেনি । অধিকাংশ শিল্পকর্মে সাহিত্যে এর প্রভাব আছে । আমাদের দেশে জীবনানন্দ দাশ এর প্রভাব স্বীকার করেছেন তাঁর কবিতায় । এই ২০১৩ সালেও অনেকের লেখায় এর ছোঁয়া আছে । যে কোনো কবিতাপত্রেই চোখে পড়ছে । এই ধরণের টেক্সট সহজে জনপ্রিয়ও হয় ।
‘আমি’ — এই ‘আমি’কে নিয়ে জলঘোলা কিছু কম হয়নি, হয় না । পোস্টমডার্নরা ‘আমি’ নিয়ে সংকোচে থাকেন । ‘নতুন কবিতা’ নিয়ে যারা কথা বলছেন, তারাও । কিন্তু ঘটনা হল ‘আমি’-র সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরের সেভাবে কোনো যোগ থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই । ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারে বিশ্বজনীন আমি — আর সেখানেই হয়তো চ্যালেঞ্জ । ঘটনা হল ‘আমি’র বাইরে কোনো পৃথিবী হয় না । নিজেকে জানাই জানার শেষ উচ্চারণ — অন্তত সেই কথা ও কাহিনী । নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া — এক জীবন যথেষ্ট নয় তার জন্য । ‘আমি’কে অবলম্বন করে ধ্যান করলে ক্রমে আর অজ্ঞাতকে অনতিক্রম্য মনে হয় না, তার সঙ্গে মিশে যাওয়াও সম্ভবপর মনে হয় । আমি এক অবলম্বনও হয়ে উঠতে পারে ( যেমন বিগ্রহ ), মুখ লোকোনোর আড়াল নয় ( যেমন সুনীলের ‘আমি’ ) ।
সংক্যা কি একটা ফ্যালাসি বলা যায় ‘জখম’এর টেক্সটে ? কিছু উদাহরণ :
৪৫০০০ ডানহাত, ১৩৫ জোড়া পা, ১৯৬৫ মডেল
২৭৬০ লক্ষ টাকার মানিঅর্ডারফর্ম, ৬৮০০০ প্রচারপত্র,
৪৯ জোড়া আরামখেকো লাশ, ৫.৩৮ ডি.সে. শীত,
১ জোড়া জংলি হাঁস, ৪০০০ লোক, ২০০০ কঙ্কাল,
৫০০ লিটার রাজনীতি, ৩৫০০০০ আমলা, ২৫০০০ আঁত
এখানে ৪০০০ অনায়াসে ৪৫ হতে পারত, ২৫০০০ হতে পারত ২৫০ । অনেকে হয়তো একে কবির খেয়াল বলবেন । খেয়াল হলেই বা কী যায় আসে ? কবির খেয়াল না থাকলে কার থাকবে ? তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে । সেটা যুক্তির ব্যাপার । ‘কেন’-র বাইরে বেরিয়ে যাওয়া । অতিকথন । লাগাম ফেলে দিয়ে । সুররিয়াল অবশ্যই । দালি যেমন মানবদেহের কোনো একটা অঙ্গকে অসদ্ভাবের দিকে বাড়িয়ে দিতেন । সেই অঙ্গ লেনিনের হলেও ।
প্রতীকের ব্যবহার একটা প্রসঙ্গ । ‘আমি’ নিজেই একটা প্রতীক । তাঁর শরীর, তাঁর শরীরচেতনা — প্রতীক । প্রকৃতি-প্রতীক । প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ — প্রতীক । সৌন্দর্য — প্রতীক । সমাজচেতনা — প্রতীক । সমগ্র কবিতাটিকেই আমরা অর্থময়তার দিকে না তাকিয়েই, কেউ কবিতাটিকেই আমরা অর্থময়তার বহুস্তরিকতাকে বারবার ছুঁতে ও অতিক্রম করতে দেখি । অবশ্য প্রতিকী তাৎপর্যের দিকে না তাকিয়েই, কেউ কবিতাটি অনায়াসে পড়তে পারেন । কোনো হানি তাতে হবে না । পোস্টমডার্ন পরিসরেও ‘জখম’ তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি টেক্সট । শিবলিঙ্গ তো শিবের যৌনাঙ্গ — এটাই তো যথেষ্ট । সেখানে পুরো শিবকে পাওয়া যাবে কিনা — এই চিন্তায় ফল কী ? কয়েকটি পংক্তি :-
১. বোবা গাছ থেকে অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে বাজারদরের চেয়ে অনেক সস্তায়
২. কেন পৃথিবীর মাটিতে আপেল নেমে আসে আমি জানলুম না
৩. অবলা ভিতু জাহাজকে বাঁচাতে লাইটহাউস
৪. নিজেরি চিঠি নিয়ে নিজের বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না ডাকপিওন
৫. মেঘের নিচে নিচে নেমে যায় ১২০০ মাইল ভ্রাম্যমান ছায়া
উক্ত পঙক্তিগুলোতে প্রতীক আছে । আবার যিনি চান না, তাঁর জন্য নেই । জোর গলায় বলা চলে — নেই, কারণ কোথাও কোনো দাগ নড়েচড়ে উঠছে না, যা চিরাচরিত প্রথা অনুসারে কবিতাটিতে টিকতে পারবে । যখন মলয় লেখেন —
৮০০০০০ উদ্বোধনকারী মন্ত্রী ও তাদের কাঁচিদঙ্গল
প্রাচীন মায়াপুর থেকে উড়ো খামে চলে আসে
আমরা আর প্রতীকের ধারণার সঙ্গে ঠিকঠাক এঁটে উঠতে পারছি না । যখন বলেন —
ঘুম থেকে উঠে দেখছি সারা শরীর ছড়ে গেছে
আমাদের আর প্রতীকের দরকার মনে হয় না । শিবলিঙ্গে যে মেয়েরা জল ঢালতে যায়, তারা লিঙ্গ মনে রাখলেও সেটা শিবের নয়, হতে পারে বয়ফ্রেণ্ডের । শিবকেও মনে রাখে কি ?
মলয়ের সমাজচেতনা নিয়ে হয়তো অনেক বাকবিস্তার করা যায় । কিন্তু একটা কথা ভুললে চলবে না — কবির নিজের বাইরে কোনো সমাজ হয় না । এমন কোনো কবিতা আজও প্রকাশিত হয়নি যা সামাজিক নয় । এমন কোনো টেক্সট হয় না । কবি একজন মানুষ । মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী । একজন মানুষের ভাব বা ভাবনা হয়তো সমাজের তোয়াক্কা না-ও করতে পারে — অন্য হোমো স্যাপিয়েনরা পড়বে বলেই করলেন । একটি প্রকাশিত টেক্সট সামাজিক না হয়ে পারে না । ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ও একটি সামাজিক টেক্সট । ‘সারদামঙ্গল’ও তাই । আর সমাজচেতনা ? সমাজের ফোটোগ্রাফ কি সমাজচেতনার দলিল ? মোটেই না । তাহলে তো দোকানের হিসেব খাতাই চমৎকার সামাজিক কবিতা হয়ে যেত । আর ‘ফাউস্ট’ হয়ে যেত অসমাজিক টেক্সট ।
আমার মনে হয় সমাজসচেতন টেক্সট অর্থে যেখানে কবি বা শিল্পী তাঁর মনের ঘরে আনাগোনা, আদানপ্রদান, লেনদেনগুলোকে স্রোতায়িত করেছেন । সেটা স্ট্যাটিক হলেও হতে পারে — যেমন স্বদেশ সেনের কবিতা ) গমন থাকলেও তোলপাড় নেই ) । কাইনেটিক — যেমন ‘জখম’ । কিছু পঙক্তি যেখানে মলয় একজন সমাজসচেতন কবি —
১. আমার শরীরে এখন চোলছে কেপমারি খুনজখম রাহাজানি ছিনতাই/আমার হাত-পা দিয়েই আমাকে সকলে মিলে পেটাচ্ছে
২. স্ত্রীলোকের চেয়ে য়ুরেনিয়াম আজকাল বেশি দরে বিকোয়
৩. ভারতবর্ষের ১০৮ দিকে আমি নিস্তারহীন নজর রাখছি খারাপ মানে খারাপ কিনা জেনে নিতে
আসলে কবির সমাজচেতনা একটা মিথ । যে কোনো কবি, যে কোনো টেক্সট সমাজসচেতন । শুধু যে টেক্সট মৌলিক নয় — সেটা ছাড়া । ‘জখম’কে অনুসরণ করে রচিত টেক্সট সামাজিক হলেও সমাজসচেতন আমরা তাকে বলতে পারি না । সমাজে তারও অবস্হান থাকবে, যেমন মানবদেহে টিউমার আমরা । ‘জখম’কে অনুসরণ করা অসম্ভব হলেও সেই চেষ্টার উদাহরণ বাংলা কবিতায় কিন্তু আছে ।
একটা প্রসঙ্গে এই সুযোগে চলে আসা যায় । এর আগে কেউ হয়তো এই প্রসঙ্গে কথা বলেননি । ‘জখম’-এর কিছু পঙক্তি আমাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু কাব্যগ্রন্হেও কিছু পঙক্তির কাছে নিয়ে যায় । মিল খুঁজে পাই আমি । কিছু উদাহরণ দিচ্ছি —
মলয়–আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, জোতোয় পেরেক ছিল
মলয়–স্ত্রীলোকদের পায়ে-চলা রাস্তার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমি এগিয়ে যাচ্ছি তাদের অ্যামেচার আস্তানার দিকে
সুনীল–অন্ধকারে স্ত্রিলোদের মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে
মলয়–নিজের সই জাল করে চালিয়ে দিলুম গোটা শীতকাল
সুনীল–বেয়ারা পাঠিয়ে কারা টাকা তোলে ব্যাঙ্ক থেকে ? আমি তো নিজের সইটা এখনও চিনি না
মলয়–আমি অন্ধ ভিকিরির হাত থেকে ৫ পয়সার চাকতি তুলেনিয়েছিলুম/আমি খইয়ের ভেতর থেকে কাড়াকাড়ি কোরে ছিনিয়ে নিয়েছি মড়ার দয়ালু পয়সা
সুনীল–আমি ফুলের পাশে ফুল হয়ে ফুটে দেখেছি, তাকে ভালোবাসতে পারি না ।/আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম/আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
মলয়–আহ এ ভুল কোল্কাতা এ ভুল মানুষমানুষী
সুনীল–কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে/আমি এর সর্বনাশ করে যাবো–
আমরা ধরে নেব সুনীল-গিন্সবার্গ-মলয় : এই ত্রিভূজ নিয়ে অনেক বলা বাকি আছে বাংলা কবিতায় । এখানে হয়তো সন-তারিখ কাজে আসবে আমাদের ।
বাংলা ভাষা এবং যেকোনো ভাষায় লিখিত চিরস্মরণীয় দীর্ঘ কবিতাগুলির একটি হল মলয়ের ‘জখম’ । এর সম্পর্কে কথা না বলে বাংলা কবিতার কোনো আলোচনা পূর্ণ হতে পারে না । অবশ্যই একটি আধুনিক টেক্সট । কিন্তু বাংলায় শেষ আধুনিক কবিতা হিসেবেই আমরা ‘জখম’কে গ্রহণ করব । এর পর বাংলা কবিতার আধুনিকতা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, এবং তলানি জমতে শুরু করেছে । এখনও জমে চলেছে ।
এটা খুব ভালো লক্ষণ যে, চিরকাল উপেক্ষা করে এসে অবশেষে বাংলা সাহিত্যজগত মলয় রায়চৌধুরীর ওপর আলো ফেলতে শুরু করেছে । এখনও আলো না হলে আগুন ধরে যেতে পারে — এই আশঙ্কাতেই কি !
(‘স্বপ্ন’ পত্রিকার মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যায় প্রকাশিত । শরৎ ২০০৮, বাংলা ১৪১৫ । নবীনচন্দ্র কলেজ, বদরপুর, আসাম ৭৮৮ ৮০৬ )
No comments:
Post a Comment