কবিতা লেখে একজন কিন্তু ফুটবল খেলে এগারো জন ।
আন্দোলন করতে লোক লাগে । পত্রিকা লাগে । চাঁদা তুলতে হয় । টাকা লাগে । কিন্তু যিনি লেখেন, তাঁর কিছু লাগে না । তাঁর লাগে একটা কলম, সাদা কাগজ, আর এক বাটি আগুন -- যেটা তাঁর মাধায় থাকে । যাঁরা দেখতে পান, তাঁরা দেখেন, লেখকের মাথা থেকে চুলের ভিতর দিয়ে মাঘ নিশীথের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে ।
বাংলা কবিতায় আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তেমন কোনও কাজে লাগেনি । গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বড়ো আন্দোলনের নাম 'হাংরি' । 'টাইম' ম্যাগাজিনে তার কাইনি ছাপা হয়েছিল, আবার এদিকে উচ্চ আদালতে উঠেছিল । এত বড় সৌভাগ্য আর কোনো সাহিত্য আন্দোলন উদযাপন করতে পারেনি ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা চিঠি লিখছেন আয়ওয়া থেকে সমীর রায়চৌধুরীকে ।
আমেরিকার 'বিট আন্দোলন' ১৯৬৪ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে -- সেটাই জানাচ্ছেন সুনীল । তিনি লিখছেন, 'বিট আন্দোলন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে -- সবাই বিচ্ছিন্ন, অনেকের সঙ্গে অনেকের ঝগড়া । একমাত্র অ্যালেনই আনকমপ্রোমাইজিং এখনও । বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গেছে -- এখন ওর নকল আন্দোলন আমাদের ভারতবর্ষে আরম্ভ হওয়া স্বাভাবিক । আমি আয়ওয়া ছাড়ছি ১০/১২ তারিখ । তারপর কিছুদিন নিউ ইয়র্ক । তারপর মার্গারিটের সঙ্গে দেখা করব প্যারিসে । তারপর যদি পয়সা থাকে লণ্ডন ও রোমে দু'চারদিন ।'
'গোখরোর আন্দোলিত উহুরু' নামে একটি গদ্যে মলয় রায়চৌধুরী চুরমার করে ছেড়ে দেওয়া একটি মন্তব্য করেছিলেন -- 'কবিতা হল আস্তিনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ । কবিতার বিষয়বস্তু এখন আমি । আমিই সিসমোগ্রাফ, আমিই ভূমিকম্প, আমিই ভাঙাচোরা খেতখামার।' এই কথা যিনি লিখতে পারেন, তিনি কবি নন, তিনি 'ঋষি' । কিছুটা হাত গোটানো, কিছুটা মস্তান, কিন্তু তিনি ঋষি এবং একজন হাংরি । এই মহৎ কথাগুলো বলে ফেলে মলয় কি হাংরি আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিলেন ? কেননা তিনি নিজেই বলছেন, 'আমি মনে করি ১৯৬৫ সনে যেদিন পুলিশ আমাকে চার্জশিটের সঙ্গে শৈলেশ্বর, সুভাষ প্রভৃতির মুচলেকা দেয়, সেদিনই হাংরি আন্দোলন ভেঙে যায় ।' কী আশ্চর্য ! সুনীল লিখছেন এক বছর আগে আয়ওয়া থেকে, বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গিয়েছে । আর মলয় বলছেন হাংরি শেষ হয়ে গেল ।
সেই সময়, ১৯৬৪, মির্জাপুর স্ট্রিট থেকে একটি কুশ্রী লিফলেট ছাড়া হয় বাজারে, তার রচয়িতা ও প্রকাসক ছিলেন পাঁচের দশকের পাঁচটি ( তিনটিও বলা যায় ) শ্রেষ্ঠ ভূকম্পনের একটি -- 'ফিরে এসো চাকার' কবি বিনয় মজুমদার ।
কী লেখা হয়েছিল লিফলেটে ? একটি অংশ তুলে দিই :
'শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এ যাবৎ পাঠাকপাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি । -- কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ?...রেকটাম বিট করে দিয়েচি বলেই এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল।'
একজন বৃহৎ কবি আরেকজন বৃহৎ কবিকে এত খারাপ ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন, আগে জানা ছিল না । তবে কে কাকে আক্রমণ করছেন, সেটা আমার বিষয় নয় । কবিরাই তো কবিদের সবচেয়ে খারাপ ভাষায় আক্রমণ করে এসেছেন সারা পৃথিবীতে । কবিরাই কবিদের সহ্য করতে পারেন না, কবিরাই আবার অন্যদের বলেন অসহিষ্ণু, গভীরে নেমে খোঁজ করলেই দেখা যাবে এসব ব্যক্তিগত কারণে । রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম -- ওগুলো সব আসলে 'বাহানা'। মহম্মদ দারউইস বলেছিলেন : 'তোমার কুৎসা ওরা করতই, এতদিন অপেক্ষা করছিল একটা রাষ্ট্রীয় সংকটের জন্য, সংকটের সময় একজন কবিকে পেটানো অনেক সহজ হয়ে যায়, সংকটের জন্য কে দায়ী, সেটা তৎক্ষণাৎ বিচার করা যায় না, কিন্তু অন্ধকার ঝোপে লাঠি চালানো যায় ।'
একটা আন্দোলন কি তুবড়ির মতো আকাশে উঠে, মাটিতে নামতে নামতেই ফুরিয়ে যায় ? একটা আন্দোলন কি 'এক্সপায়ারি ডেট'-সমেত জন্ম লাভ করে ?আমি সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে লক্ষ করেছি আকাশে উঠতে এবং আকাশ থেকে নামতে এবং ছাই হয়ে ভস্ম হয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে গেলেও একটা যুগ লাগে । নিজেকে বিনাশ করে ভস্ম নিজেই ঝরে পড়ে মাটিতে, কিন্তু মাটির পোড়া অংশ তখন ইতিহাসের নবীন মাথা তুলে ধরে । সেটা 'হাংরি' যেমন করেছে, 'শ্রুতি'ও করেছে । কিন্তু নাম হল 'কৃত্তিবাস'-এর । নাম হয়েছে 'কবিতা'র । এখানেই তো মজা ! 'কবিতা' কোনো ঘোষিত আন্দোলন করেনি । কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে 'কবিতা' হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় 'গেম চেঞ্জার' । শত অপমানের ভিতর মাথা তুলে দাঁড়ালেন বরিশালের জীবনানন্দ দাশ । একাই হয়ে উঠলেন একটি জাতি । একাই হয়ে উঠলেন একটি ভাষা । একাই হয়ে উঠলেন একটি উপমহাদেশ ।
হাংরিদের সঙ্গে থেকে এবং নিজেকে আপৎকালীন অবস্হায় সরিয়ে নিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি একজন লেখক একাই তার মৌলিক ভাষাশৈলী নিয়ে একশো । সে নিজেই মানুষ, সভ্যতা এবং সমাজ বিপ্লবের স্হাবর নিদর্শন । কাজেই অনেকে মিলেজুলে ওভাবে হয় না ।'
অনেকে মিলে ফুটবল খেলতে হয়, মৃগয়ায় যেতে হয়, পাহাড় কাটতে হয়, কিন্তু ভাষা তৈরি করার সময় কেউ পাশে থাকেন না , তখন একজন লেখক একা এবং নিষ্ঠুর, তিনি জানেন তাঁকে বিরাট পাহাড়ের ভিতর নিজের গাঁইতি চালিয়ে একটা গুহা বানাতে হবে ।
গুহাগাত্রে প্রতিটি বাক্যের শেষে যেন তাঁর সই থাকে ।
আমরা জানি প্রতিটি বাক্যের শেষে কোনও লেখক সই করেন না, কিন্তু সই থেকে যায় ।
[ প্রতিদিন ( ছুটি ) পত্রিকায় ১৪ই মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ]
No comments:
Post a Comment