Saturday, December 28, 2019

মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ : বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়


বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ
-----------------------------------------
মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে হঠাৎ লিখছি কেন? এইজন্যে নয় যে আমার বই বেরোচ্ছে, আর বইএর ব্লার্বে তিনি যাচ্ছেতাই রকমের ভালো লিখে দিয়েছেন। সে তিনি অমনিও লিখতেন। (কাজ আদায় হয়েই গিয়েছে ) আমায় স্নেহ করেন, ভালোবাসেন একটু। আমি তাঁর বেশ-বয়সের অবন্তিকাদের মধ্যে একজন। ডিট্যাচড, পড়ুয়া, চোখে চশমা আঁটা, উচ্চাশী অবন্তিকা। তিনি আমার পিতৃপ্রতিম। জাগতিকে তাঁকে তেমনই ভালোবাসি। আর অন্য এক জায়গায় তাঁকে ভালোবাসি, যেমন ক’রে তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “ডিটেকটিভ নোংরা পরীর কঙ্কাল প্রেমিকে”, অনেক আগে মরে যাওয়া কঙ্কালকে, এক বৃদ্ধের কংকালকে, তার জীবনের কনসেপ্টকে ভালোবেসে ফেলেছিল ইন্সপেক্টর রিমা খান। কেন? সেই গণিতবিদ, উৎশৃংক্ষল কংকালের পৌরুষের জন্য। আমি এই অদ্ভুত আখ্যানটি লিখছি কারণ, কবে এই কিংবদন্তীস্বরূপ বৃদ্ধ ফট ক’রে মরে যাবেন। এখনো দেখা করিনি। ফোন করিনি। যদি মরে যান, একা ফ্ল্যাটে ছটফট করবো শোকে। সেই ভয়ে, এখন কিছু দিয়ে রাখা। টিকে যেতেও পারেন অনেকদিন আরো। ভীষণ জীবনীশক্তি। জীবনকে ভালোবেসে চুষে খাবার ইচ্ছে।
মলয় রচৌকে দাদা বলার দূরভিলাষ হয় নি কখনো আমার। এই গ্যালিভার কেন যে লিলিপুটের সংসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় সারা শরীরে তাদের মই বেয়ে উঠতে দেন, সেই নিয়ে আমার এক চাপা ক্ষোভ ছিল। ইনি ভীষন পণ্ডিত। বাকি বড় বড় কবিদের মতো দূর থেকে কিছু কিছু জ্ঞানের কথা লিখলেই লোকে আশেপাশে ঘুরতো বেশী বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের মতো নতুন শিঙওলাদের, এবং আমাদের চাইতেও আরো আরো খাজা জনগণকে উনি প্রশ্রয় দেন। এই মার্কেটিঙের স্টাইলটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষালী কড়া মদের মতো তীব্র আত্মবিশ্বাসে উনি যে এটা ক’রে যান, প্রচণ্ড টেক-স্যাভি, সরাসরি, আড়ালহীন প্রচার, এটাও আমার আজকাল ভালই লাগে।
তাঁর হাত দিয়ে যে কবিতা বেরিয়েছিল, (“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কবি মলয় রায়চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে।প্রকাশের পর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয় এবং মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে মামলাটি নাকচ হয়ে যায়। মামলা চলাকালীন সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে মলয় রায়চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনুদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম" সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।” (উইকিপিডিয়া থেকে)), সেই কবিতা কারোর হাত থেকে বেরোনো শক্ত। সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী তা জানে। আমি আর তা নিয়ে বলি কেন। ওরকম একটা কোনদিন নামাতে পারলে বুঝতাম, হুঁ, কিছু করা গেলো। হবে না। সে আধার নেই আমার। তাই বলে ওনার এখনকার অনেক কেমন-যেন কবিতাকে লাইক টাইক দিতে পারি না। প্রয়োজনও নেই। যার এত উপন্যাস আছে, তাকে কেবা কবিতায় যাচে?
মলয় রচৌএর উপন্যাসগুলি ভীষণ ভীষণ আণ্ডাররেটেড। বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওরকম উপন্যাস বেশি লেখা হয় নি। ভালোয় মন্দে শুধু না, অদ্ভুত অন্য ধারার জন্য। কেন লেখা হয় নি তার বড় কারণ আমার মতে এই যে, ওরকম টেস্টোস্টেরন সম্বলিত প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী নেই মনে হয় বাংলা সাহিত্যজগতে। এই জগতের ক্যাচাল আমি তেমন জানি না। কিন্তু মলয় রচৌ, মাঝে মাঝেই কাজের মেয়ে না এলে স্ত্রীএর সঙ্গে মন দিয়ে রান্নাবান্না বাসনমাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে ফেলেন। করার তো কথাই। জানি না তিনি জীবনে কতটা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক অর্থে। খালি জানি, ইনবক্সে যখন কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন “বলে ফ্যাল । আজকে কাজের বউ আসেনি । বুড়ো-বুড়িকে অনেক কাজ করতে হবে । লাঞ্চে খিচুড়ি । ডিনারে প্যাটিস।”, কি ভালো যে লাগে! এই বুড়ি, যাঁকে আমি খালি ছবিতে দেখেছি, একসময়ের দাপুটে হকি খেলোয়াড়, তাঁকে এই “অ-কংকাল প্রেমিক” ভীষণ দাপটে ভালোবেসে গেছেন, এমন একটা ছবি বেশ মনে মনে আঁকতে পারি, এঁকে ভালো লাগে।
মলয় রচৌএর উপন্যাসের পুরুষদের মতো প্রেমিক আমি বাংলা উপন্যাসে কম দেখেছি। তাঁর “ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক” উপন্যাসে, এক গণিতবিদ, বহুগামী অবিবাহিত পুরুষ, হঠাৎ এক স্বল্পপরিচিত সহকর্মী মহিলার “চলুন পালাই” ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের অন্য দিকে, তামিল দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নাগরিক সভ্যতার থেকে পালাতে চেয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষিতা তরুণী মায়া, আর মায়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে গেছিলেন সেই গণিতবিদ। এই উপন্যাসটি ছোট্ট, গোগ্রাসে গেলার মতো, নানান ভাবে রগরগে, আর নানান ভাবে ভীষণ ভীষণ সেরিব্রাল, মস্তিষ্কপ্রবণ। এই উপন্যাসে, জঙ্গুলে জীবনে ফিরতে চাওয়া মায়ার ঋতুস্রাবকালে, তাকে নিজ হাতে ধুইয়ে দিয়েছে তার প্রেমিক। অথচ দুজনে দুজনকে ডেকেছে “আপনির” দূরত্বের পবিত্রতায়, নিজেদের স্বত্ত্বাকে আলাদা বোঝাতে, “পবিত্রতার মতো অস্পষ্ট” শব্দকে ধূলিসাৎ করেও। এই উপন্যাসটির একটি রিভিউ আমি আগেও করেছি। বিশদে যাবো না। শুধু, এই প্রেমিকের প্রতি আমার গভীর মায়া যে বলে “চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে, কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে, লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন। জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন, আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি?”। বা যে বলে “জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে । জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ? আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে।”। আমি নিশ্চিত যে, মলয় রচৌও এরকমই আকাশমুখো লেজের কুকুর। তিনি প্রবলভাবে, ভিতর থেকে, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী। “অরূপ, তোমার এঁটো কাঁটা” উপন্যাসে তিনি যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মহিলা চরিত্র বানিয়েছেন, যে লোভে লালসায়, ভালোবাসায়, প্রতিশোধে, ভীষণ রকম জীবন্ত ও অসহায়, মেয়েদের সবটুকু নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালো না বাসতে পারলে, রূপের মধ্যে ওরকম অরূপ, আর তার এঁটো কাঁটাসহ মচ্ছগন্ধ ধরে রাখা যায় না। এখানেই মলয় রচৌএর পৌরুষ। যে রকম পৌরুষ “দেহি পদপল্লবম উদারম” এর মতো উদাত্ত হাঁক দিতে পারতো জয়দেবের কালে, পারে একালেও। তাঁর “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” আর “ছোটোলোকের যুববেলা” তেমনই অকপট, দাপুটে, উজ্জীবিত, ভিগরস। নিজেকে বিশ্রেণীকরণ করেছেন শুধু জোর করে নয়। তিনি সেরকম হয়েও উঠেছেন। তাঁর মেজদার জন্মরহস্য পড়ে এক একবার মনে হয়েছে, সবটা বলে দেওয়া কি তাঁর ঠিক কাজ হয়েছে পরিবারের প্রতি? আবার এক একবার মনে হয়েছে, বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন। বিহারের প্রান্তিক মানুষের জীবন, তাঁর লেখায় দারুণ উঠে এসেছে। “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাস যেমন লিরিক্যাল কোথাও কোথাও, তেমনই, গভীর রাজনৈতিক চেতনায় প্রোথিত। তাঁর অনেক উপন্যাসই তাই। খুব কাটাকাটা, খুব ন্যাকামোহীন, নির্মোহ, নিজের প্রতিও, নিজের নায়কদের প্রতিও, অনেকটা নায়িকাদের প্রতিও। এরকম ধারাবিবরণী বাংলায় লেখা কম উপন্যাসেই আছে। খানিকটা সমরেশ বসুর “যুগযুগ জীয়ে”তে কাছাকাছি কিছু স্বাদ পাই। তাও, এই উপন্যাসগুলি লেখার ধরণে অনেক আলাদা। আর এই সবের পরেও রচৌকে জিগালে, তাঁর সব জীবনদর্শনের মধ্যে, সব ছাপিয়ে, হয়তো কৈশোরের ভুবনমোহিনী রাণা উঠে আসবে, প্রথম চুমুর টেণ্ডারনেস নিয়ে। কিশোর পুরুষে।
এই লেখাটা আবেগতাড়িত। খাপছাড়া। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যে আজ লিখবোই, বলে লিখে ফেলা। পরে হয়তো সংশোধন করবো আরো। উপন্যাসগুলোর, প্রবন্ধগুলোর, কবিতাগুলোর, ইদানীং লেখা ওনার কিছু কেমন-যেন-ভাল-না কবিতাগুলোও আলোচনা করা যাবে আরো কিছু। তবে এই লেখা অনেকাংশে ব্যক্তিগত ভাবের লেখা। তাই এভাবেই অকপটে লিখছি। আমার গবেষণাপত্রটি যখন শেষও হয় নি, রচৌ আমাকে তখনই খুব উতসাহ দিতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর যে অবন্তিকা, তা তখনই লেখা। পরে যখন গবেষণাপত্রটি বেরোলো, আমার ক্ষীণ অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, ফেসবুকে প্রায় সাতশোবার শেয়ার হওয়া এই লেখা, এবং আরো অনেকবার শেয়ার হওয়া লেখার নানান রেফারেন্স কিছুতেই টুইটারের মুখ দেখলো না বাঙ্গালি সমাজে। অথচ টুইটার কাউণ্টই জার্নাল মেট্রিক গ্রাহ্য করে। এই অশীতিপর বৃদ্ধ তখন, না বলতেই, বহুবার, চুপচাপ, এন্তার লোককে, সংস্থাকে ট্যাগ করে, টুইট করেছেন আমার গবেষণার লিংক, বহুদিন। ভালোবাসি কি সাধে?
আমি যখন ভুলভাল কবিতা লিখতাম, একেবারে বাজে লিখতাম, একবার ওনাকে বলেছিলাম, “এই ছাপোষা জীবন! কোথাও যাই না। চাকরি, ছেলে, আর পড়াশুনো। কবিতায় প্রেমের, পৃথিবীর, মানুষের হাওয়া লাগবে কী করে?”। উনি দুকথায় বলেছিলেন “এটা কোন কাজের কথা না। লিখে যাও। হবে”। তারপর বলেছিলাম, “এখন চাকরি, গবেষণা (গবেষণা না ছাই)। সাহিত্য বাকি পরে পড়বো”। উনি বলেছিলেন, “এটা কোন কাজের কথা না। কমবয়সে না পড়লে রেসেপটিভিটি থাকে না, এখনই পড়তে হবে”। এই দুটো আপাতঃসাধারণ কথা, ওনার গম্ভীর পৌরুষের জোরেই, আমায় পালটে দিয়েছিল অনেকটা। এখন হাবিজাবি যা একটু লিখি, মনের দরজা খুলে গেছে তাই। মলয় রচৌরা বাংলাভাষাকে স্পর্ধা আর সাহস এনে দিয়েছিলেন। আমাকে, আমাদের এখনো সেই সাহস ভাঙ্গিয়েই খেতে হয়।
আমাকে নিয়ে লেখা সেই কবিতাটা-
বহতা অংশুমালী, তোর ওই মহেঞ্জোদারোর লিপি উদ্ধার
কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝা করে তোকে দেখে
ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে আলফা গামা পাই ফাই
কস থিটা জেড মাইনাস এক্স ইনটু আর কিছু নাই
অনন্তে রয়েছে বটে ধূমকেতুর জলে তোর আলোময় মুখ
প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে যাচ্ছে রকেটের ফুলঝুরি জ্বেলে
কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরে ওরে ইউক্লিডিনি কবি
নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস মঙ্গল থেকে অমঙ্গল
মোটেই আলাদা নয় কী রে বাবা ত্রিকোণমিতির জটিলতা
মারো গুলি প্রেম-ফেম, নাঃ, ফেমকে গুলি নয়, ওটার জন্যই
ঘামের ফসফরাস ওড়াচ্ছিস ব্রহ্মাণ্ড নিখিলে গুণ ভাগ যোগ
আর নিশ্ছিদ্র বিয়োগে প্রবলেম বলে কিছু নেই সবই সমাধান
জাস্ট তুমি পিক-আপ করে নাও কোন প্রবলেমটাকে
সবচেয়ে কঠিন আর সমস্যাতীত বলে মনে হয়, ব্যাস
ঝুঁকে পড়ো খোলা চুল লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ
গ্যাজেটের গর্ভ চিরে তুলে নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা
হাজার বছর আগে তোর সে-পুরুষ প্রেমপত্র লিখে রেখে গেছে
মহেঞ্জোদারোর লিপি দিয়ে ; এখন উদ্ধার তোকে করতে হবেই
বহতা অংশুমালী, পড় পড়, পড়ে বল ঠিক কী লিখেছিলুম তোকে–
অমরত্ব অমরত্ব ! বহতা অংশুমালী, বাদবাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে
আমার চিঠির বার্তা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে তুই আমাকে জানাস
------------------------------------------------------
লেখায় বানান ভুল আছে নিশ্চই। কাল ঠিক করবো। কত কথা বাদ গেলো। পরে ঢোকাবো। কিন্তু অনেক সন্তানের বৃদ্ধ পিতাকে প্রস্টেটের ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সবচে’ ছোট মেয়েটা যেমন পৌরুষের বেঞ্চমার্ক তৈরি ক’রে মনের মধ্যে সেই বেঞ্চমার্কের উপরের রাজকুমার খোঁজে, তেমনই এই অশীতিপর পিতৃপ্রতিমকে দেখি। আর যেমন ক’রে রিমা খান কঙ্কাল প্রেমিককে ভালোবাসে, ভালোবাসি এঁকে। স্বধর্মে স্থিত, অতি প্রচারমুখী, ঝপঝপ কমেণ্ট ক’রে মুশকিলে ফেলে দেওয়া স্নেহার্দ্র, প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। আমাদের খুব কাছে আছেন বলে, বড় বেশি ছোঁওয়া লেগে গেলো। দূরে চলে গেলে, মানুষ বুঝবে, গেলো কেউ। আর আমরা কেউ কেউ, একা ফ্ল্যাটে হাপসে কাঁদবো।

Friday, December 27, 2019

"দি হাংরিয়ালিস্টস" -- হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রামাণ্য বই

হাংরি জেনারেশনের কথা বলবে এই বই, উদ্বোধন হল অক্সফোর্ড বুক স্টোরে

book inauguration
‘দ্য হাংরিয়ালিস্টস’ বইটির উদ্বোধন হল শহরের এক বই বিপণীতে। — ছবি: সংগৃহীত।
১৯৬১-র পটনায় এক ইস্তেহার প্রকাশের পর থেকেই যে হাংরি আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে
পড়েছিল বাংলার কাব্যসাহিত্যে— সেই আন্দোলনের কথা, তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা নামগুলোর যাপন, জীবনবোধ ও তাৎক্ষণিক নানা মুহূর্ত ও তাঁদের কবিতাকেসময়ের ক্রম মেনে দুই মলাটে পুরেছেন
মৈত্রেয়ী বি চৌধুরী।
বইয়ের নাম ‘দ্য হাংরিয়ালিস্টস’। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বুক স্টোরে বইটির উদ্বোধন করলেন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আনন্দ লাল।
আন্দোলন আরম্ভ করেন মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হারাধন ধাড়া। 
 পরবর্তীতে বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এক নিঃশ্বাসে নামগুলো
পড়ে গেলে, ১৯৬০-এর উত্তাল আগুনে আন্দোলনের সঙ্গে নামগুলোর যোগসূত্র খুঁজে পেতে
 অসুবিধা হয় না। জিওফ্রে চসারের 'In Sowre Hungry Tyme' বাক্য থেকে ‘হাংরি’ শব্দটিকেই
 বেছে নেন কবি মলয় রায়চৌধুরী। সেই শব্দের নামেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কবি-সাহিত্যিকদের
গোষ্ঠী ‘হাংরি জেনারেশন’ নামে চিহ্নিত হতে থাকেন।

কেবলমাত্র বাংলাই নয়, সুদূর ইউরোপেও একটা যুদ্ধ বিশ্বসাহিত্যের ভাষা, যৌনতার ভাবনা,
এমনকি জীবনশৈলীর মোচড়কেও তখন বদলে বদলে দিচ্ছে। আর সেই ঢেউয়ে শামিল হচ্ছেন
বাংলা ভাষাভাষী এক শ্রেণির সাহিত্যিক।দু’দেশের কবি-সাহিত্যিকদের নিবিড় যোগাযোগ,
সমাজতাত্ত্বিক দর্শন নিয়ে আলোচনা, তর্ক তখন তুঙ্গে।
তাই স্বভাবতই হাংরি জেনারেশনের অন্যতম পথিকৃৎ অ্যালেন গিনসবার্গের এ দেশে ভ্রমণ ও
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মোলাকাত, এ দেশের হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকদের সঙ্গে তাঁর মত আদানপ্রদান— এ সবের ইতিহাসকেই এই বইতে ধরেছেন লেখক। বইটির প্রকাশক ‘পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া’।

Wednesday, December 11, 2019

হাংরি জেনারেশন - মলয় রায়চৌধুরীর 'ডুবজলে' 'জলাঞ্জলি' 'নামগন্ধ' উপন্যাসত্রয়ী : সমীর সেনগুপ্ত


          যাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, আর যাকে চিনি না -- তাদের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, 
বা এমনকি ভাবতে গেলেও -- দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা তুলনাত্মক পরিবর্তন এসে যেতে বাধ্য । 
আজ যদি আমাকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পর্কে লিখতে বলা হয়, 
আমার রচনা কিছু পরিমাণে নিরঙ্কুশ হবেই -- কারণ এঁদের কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে 
চিনতুম না, এঁদের কাজ বিষয়ে আমার হাতে আছে শুধুই এঁদের কাজ, আর হয়তো কিছু
 দ্বৈতীয়িক তথ্য, মানুষটিকে আমার জানা নেই । অর্থাৎ একটি বিন্দুতে আছি আমি, আর 
একটি বিন্দুতে আছে তাঁর কাজ -- সম্পর্কটা দ্বিমাত্রিক ; কিন্তু যে-মুহূর্তে আমি মানুষটিকে
 জানছি সেই মুহূর্তে সম্পাদ্যটি তৃতীয় একটি আয়তন পাচ্ছে, তাঁর কাজ সম্পর্কে আমার 
মূল্যায়ন প্রভাবিত হচ্ছে আমার মনের মধ্যে নির্মিত তাঁর ভাবমূর্তির দ্বারা । সঙ্গে সঙ্গেই 
অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা ।
          মলয় রায়চৌধুরীকে আমি চিনি -- ঘনিষ্ঠতা যাকে বলে হয়তো নেই, কিন্তু মানুষটিকে 
জানি, এবং পছন্দ করি, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলে এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধও আছে
 ভিতরে ভিতরে l তাছাড়া অনেক বিষয়েই মলয়ের পড়াশোনা ও অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বিস্মিত
 করে, এবং লেখা পড়ে মনে হয় দুনিয়াদারির অভিজ্ঞতাতেও মলয় রায়চৌধুরী আমার চেয়ে 
এগিয়ে -- কিন্তু মলয়ের কাজ আমি সাধারণভাবে পছন্দ করি না । মলয়ের সঙ্গে কোথাও
 আমার একটা আদর্শগত দূরত্ব আছে বলে মনে করি, এবং সে দূরত্ব অসেতুসম্ভব ।
 তফাতটা সাহিত্যসংক্রান্ত বোধের, এবং রুচির । দীর্ঘ দিন ধরে, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাকে
 এক দিকে নিয়ে গেছে, মলয়কে সম্পূর্ণ অন্য দিকে । ফলে, মলয় যাকে কবিতা বলে মনে করেন, 
আমার কাছে তা অগ্রাহ্য, মলয়ের যা সাহিত্যিক আদর্শ, আমার কাছে তা মনোযোগের যোগ্য নয়,
 এবং আমার বিচারে যা সাহিত্যের ধ্রুবপদ, মলয়ের বিচারে -- মলয়ের লেখা পড়ে মনে হয়, তা
 শুচিবায়ুগ্রস্ত, উচ্চমন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের জন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের দ্বারা রচিত ।
 এই যেখানে পরিস্হিতি, সেখানে মলয় রায়চৌধুরীর লেখার আলোচনার প্রস্তাব আমার বিনয়ের
 সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল । কারণ বিরুদ্ধ আলোচনা স্বাগত হলেও, পক্ষপাতপূর্ণ 
আলোচনা না করাই উচিত । আর, মলয়ের লেখা আমার ভালো লাগে না, এটা এমনকিছু
 একটা জরুরি কথা নয় যে, ভুরি পরিমাণ কালি-কাগজ খরচ করে সে-কথাটা বলে বেড়াতে হবে ।
          কিন্তু আসল ব্যাপারটা অতো সরল নয় । মলয় রায়চৌধুরীর লেখা আমার ভালো লাগে 
না এতে কোনও ভুল নেই ঠিকই, কিন্তু বোধহয় কুড়ি বছর পর আমি একটি উপন্যাস রাত
 জেগে পড়ে উঠলাম, সেটি মলয় রায়চৌধুরীর ‘জলাঞ্জলি’ । রাত সাড়ে বারোটায় বইটা 
হাতে করে শুতে গিয়েছিলাম, যখন শেষ করে উঠলাম, তখন কাক ডাকতে আরম্ভ করেছে। 
এবং পড়তে পড়তে মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে মলয় ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপহার
 দিয়েছিলেন, সেটি পড়তে আরম্ভ করেও সেদিন আপিস-টাপিস বাদ দিতে হয়েছিল ।
          কারণ মলয় প্রথম থেকেই এমন এক জগতে আমাকে নিয়ে প্রবেশ করেন, যা আমার 
সম্পূর্ণ অপরিচিত -- শুধু অপরিচিত নয়, অচিন্ত্যনীয় । এ কোন পৃথিবী যা বাতিল নোটের 
দুর্গন্ধ-স্তূপকে ঘিরে ঘিরে আবর্তিত হয় -- বাস্তব সেখানে ওই টাকর ভাগাড়ের ভিতর থেকে
 ভাপের মতো ধোঁয়াতে থাকে । টাকা -- কারেন্সি নোট, যা আমাদের সমস্ত সুখের-দুঃখের, 
প্রাপ্তির-অপ্রাপ্তির, সার্থকতার-অসার্থকতার জগদ্দল প্রতীকমাত্র, ওগুলোর মধ্যে চিরন্তনতা নেই । 
নেই যে, সেটা আমরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারলেই, কথাটা আমাদের উপলব্ধিকে স্পর্শ করে না । 
যেমন দশ কোটি টাকা মানে কত টাকা আমি বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, কিন্তু পুরোপুরি বুঝি না,
 তেমনি কারেন্সি নোটের নশ্বরতার ব্যাপারটাও, মলয় না-বোঝালে, কোনও দিন সত্যি-সত্যি
 বুঝতে পারতুম কিনা সন্দেহ । আমরা সবাই জানি কারেন্সি নোট হাতে হাতে ঘুরে একদিন
 নোংরা হয়, ধারগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়, কাগজ ল্যাতপেতে হয়ে যায়, ভাঁজে ভাঁজে 
মাঝখানটা ফুটো হয়, ক্রমে সেই ফুটোটা বড় হতে হতে নোটতা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায় ।
 তারপর কী হয় ? নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয় নোটখানা । 
কিন্তু সেই কোনও না কোনও ভাবে ব্যাপারটা যে কী ব্যাপার সেটা কখনই জানতে পারতুম না,
 মলয় রায়চৌধুরীর লেখা না পড়লে । ‘কারেন্সি’ মানেই আমরা জানি যেটা আছে, যেটা
 কারেন্ট অর্থাৎ বর্তমান, যেটা আমি ও আমার প্রতিবেশীর মধ্যে যোগসূত্র । এবং এইরকম
 একটা বিভ্রান্তি আমাদের মনে, ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায় যে, আজ যেটা বর্তমান
 আছে কালও সেটাই বর্তমান থাকবে । আমরা যারা টাকার বাজারের প্রত্যন্তসীমায় জীবন 
কাটাই, হঠাৎ হাতে এক গোছা চকচকে নোট এসে পড়লে তাদের মনটা খুশি হয়ে ওঠে,
 তাদের বউয়েরা সেগুলো পাট করে আলমারির ভেতরের দিকে রেখে দেয়, অথচ কোনও
 তো কারণ নেই, তেলতেলে অর্ধগলিত নোটের চেয়ে তার তো ক্রয় ক্ষমতা বেশি নয় ।
 তাহলে কেন গ্রেশাম সাহেবের নিয়ম সারা পৃথিবী ভরে সত্য, নতুন নোট হাতে পেতে কেন 
সারা পৃথিবীর মানুষ লালায়িত ? জানি না ।
          আর মলয় যে মানুষগুলির বর্ণনা করেন, তারা ওই গলিত নোটের মতোই বহুব্যবহৃত
 পুরোনো ভাবনাচিন্তার জগতের মানুষ । তারা যা ভাবে, যেভাবে ভাবে তা বহু বহু পুরুষ 
ধরে তাদের পূর্বজরা ভেবে এসেছে । কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর লেখার তলায় তলায় এই বার্তা
 থাকে, যে এই ভাবনাটাই শেষ কথা নয়, ধ্রুব নয়, নতুনভাবেও চিন্তা করা সম্ভব -- 
মলয় রায়চৌধুরীর অতনু হঠাৎ গলিত নোট গোনার আরামের চাকরি ছেড়ে, গ্যাজেটে
 ক্যাসেটে সাজানো ফ্ল্যাট ফেলে রেখে একদিন উধাও হয়ে যায়, অনেকদিন পর তার খোঁজ
 পাওয়া যায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেডবুক থেকে মন্ত্র পড়ে নকশাল তরুণতরুণীদের গণবিবাহ 
দিচ্ছে । পুরোনো নোট ধ্বংস করে ফেলবার পদ্ধতিটা মলয় দেখান, নতুন নোট তৈরি হওয়ার
 পদ্ধতিটা দেখান না -- সেটা আমাদের আন্দাজ করে নিতে হয় । মলয়ের উপন্যাসের জগতেও,
 বাতিল ভাবনার মানুষেরা রাজত্ব করে, মনে হয় তারাই রাজত্ব করে যাবে -- কিন্তু না, 
অতনুরাও তাদের মধ্যে থাকে, তাদের রাজত্ব তলায় তলায় টলমল করছে । পুরোনো নোটের
 মতো তারাও একদিন বাতিল হয়ে যাবে -- এটাই কি মলয় রায়চৌধুরীর বার্তা ?
        কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয় রাত জেগে মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস পড়ে ওঠার ।
          আমাদের ঘটনাহীন মধ্যবিত্ত জীবনের সবচেয়ে নীরস নীরক্ত নির্বর্ণ অংশ আমাদের 
চাকরিজীবনের কাহিনি । মলয়ও চাকরিটা করতেন একঘেয়ে ঘটনাহীন -- 
ব্যাঙ্কের নিস্তরঙ্গ চাকরি । কিন্তু মলয় আরও একবার প্রমাণ করলেন, যে বেড়াতে জানে, 
তার কাছে লিলুয়াভ্রমণও রোমাঞ্চকর হতে পারে ; যে দেখতে জানে, তার কাছে ব্যঙ্কের 
আপিসঘর হয়ে উঠতে পারে আমাজন অববাহিকার চেয়েও রহস্যময় । চরিটপগুলি,
 শুধু জীবন্ত বললে কিছুই বলা হয় না, বাঁধা বুলি হয়ে গেছে-- স্পন্দমান, তাদের কথোপকথন
 স্পষ্ট শোনা যায় এতো বেশি জীবন্ত । মলয়ের লেখা পড়তে পড়তে স্পষ্ট দেখতে 
পাই সেই সব যুবক যুবতীদের, যারা রাত জেগে পড়াশোনা করে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের 
পরীক্ষায় ভালো ফল দেখিয়ে, প্রতিযোগীতামূক পরীক্ষায় অন্যদের হটিয়ে, অবশেষে একটা
 গালভরা ডেজিগনেশনওয়ালা চাকরিতে ঢুকলো । এবার যুবকটি একটি নারী সংগ্রহ করবে,
 যুবতীটি একটি পুরুষকে --- তারপর একটা বাড়ি, তারপর সন্তান -- অন্য পাঁচ সাধারণ মানুষ
 যেভাবে জীবন কাটায়, মানুষের পক্ষে যে-জীবন স্বাভাবিক বলে সামাজিকভাবে সীকৃত, 
সে-জীবনের মূলস্রোতের শরিক হবার পথে কঠিনতম বাধাটি অতিক্রম করল সে ।
 কিন্তু কী চাকরি ? না, দিনের পর দিন একটা বন্ধ ঘরে বসে পুরোনো নোংরা নোট গোনা, 
সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন, দিনে সাত-আট ঘণ্টা, আর কোনও কাজ নেই, শুধু নোংরা নোট বাণ্ডিল 
বেঁধে বেঁধে, গর্ত করে করে, পোড়াবার জন্য পাঠানো । এর চেয়ে অবাস্তব কোনও অবস্হার
 কথা কল্পনা করা কঠিন ।
          কাজ মানে এমনকিছু যা মানুষের সত্যিকারের বেঁচে থাকার পদ্ধতিটার সঙ্গে যুক্ত । 
কুমোর যখন হাঁড়ি গড়ে তখন হাঁড়িটার সঙ্গে মানবসমাজের যোগাযোগের সূত্রটি সে খুব 
স্পষ্টভাবে দেখতে পায় -- হয়তো জিগ্যেস করলে  বুঝিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু নিজে বোঝে
 তাতে কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু টাকা, কারেন্সি নোট --- আধুনিক মানবসমাজের 
এই অপরিহার্য উপজাত, এর সঙ্গে মানুষের উপভোগের, অথবা প্রয়োজনের নিবৃত্তির, 
কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই, কারণ এটি আদৌ কোনও ভোগ্যপণ্য নয় । টাকা চিবিয়ে খিদে 
মেটে না, টাকা গায়ে জড়ালে শীত কাটে না -- পুড়িয়ে আগুন করলে খানিকটা কাটতে 
পারে হয়তো । অথচ খিদের সময়ে খাবার পেলে যত খুশি হই, টাকা হাতে পেলে ততটাই
 খুশি হই -- কারণ টাকাটার সাহায্যে পৌঁছোনো যাবে পছন্দমতো খাবারের কাছে । 
ব্যাপারটার অন্তর্গত হেত্বাভাস যে কত সত্য তা টের পাওয়া যায় ঘটনাটাকে চরমে
 টেনে নিয়ে গেলে -- ধরা যাক সেই ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে -- ভিখারিনী মেয়েটি 
যখন অনাহারে মৃত্যুপথযাত্রী, যখন তার শরীরে আর খাদ্যসন্ধানের বল অবশিষ্ট নেই, 
তখন তার পাশে এক বাণ্ডিল টাকা রেখে গেলে যা হতো । কিন্তু টাকা ও খাদ্যের পার্থক্যটা
 বুঝতে চাইলে ক্ষুধায় অমন মৃত্যুপথযাত্রী হতে হয় -- যে অভিজ্ঞতা জীবনে, অন্তত মলয়ের
 গল্পের পাঠকদের জীবনে, ঘটবার সম্ভাবনা খুব বেশি বলে মনে হয় না ।
          আমি যে চাকরিটা করতাম সেটাও খুব বর্ণহীন চাকরি -- কিন্তু সত্যিকারের বর্ণহীন 
চাকরি বলতে কী বোঝায় মলয়ের লেখা পড়ে তা বুঝতে পারলাম । আসলে আমরা তথাকথিত
 লেখাপড়া শিখে যেসব শাদা কলারের চাকরি করি তার কোনওটার সঙ্গেই তো আসলে বেঁচে
 থাকা ব্যাপারটার কোনও যেগ নেই, কাজেই তার মধ্যে থেকে কৃত্রিমতার কটূ স্বাদ ছাড়ানো
 যায় না কোনও মতেই । মনে আছে একবার ওপরওয়ালার সঙ্গে নিষ্ফল ঝগড়া করে নিজের
 ঘরে ফিরে এসে ভাবছিলাম কাল থেকে আর আপিসে না এলে কী হয় । ভাবতে ভাবতে জানলার
 পর্দা সরাতে দূরে ভারত ব্যাটারির কারখানার চিমনিটায় চোখ পড়ল । একটা লোক এই বৈশাখের
 ভরা দুপরে তেতে থাকা চিমনিটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে । আমি দেখতে লাগলাম । ক্রমেই উঠে যাচ্ছে
 লোকটি, তারপর মাটি থেকে প্রায় একশো ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে চিমনি সাফ করতে লাগল ।
 নিয়নের আলো জ্বালা পর্দাটানা ঠাণ্ডা ঘরে বসে বসে আমি ভাবতে লাগলাম, ও লোকটি কি
 চাকরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবে কখনও ?
          আর, শুধুই তো নোট গোনা নয়, ব্যবহারযোগ্য নোটে আলাদা করে, অব্যবহার্যগুলো 
বাণ্ডিল বেঁধে, সই মেরে, ফুটো করে পোড়াতে পাঠানো নয় ( এ পর্যন্ত তবু তো আমরা আন্দাজ
 করতে পারি ), তার মধ্যে থেকেও মানুষের বেঁচে থাকার বিচিত্র প্রয়াস কাজ করে যেতে থাকে । 
কীভাবে বিকট বিকারের ভিতর দিয়েও জীবন তার মূল ছন্দে ফিরে আসার চেষ্টা করে তার 
অসম্ভব বর্ণনা আমরা মলয়ের লেখা থেকে পেয়ে যাই ।
‘...শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পর দিনই, অতনুর সেকশনে, ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে গর্ত করে 
নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাশি । ব্যস্ততার মাঝে, অতনুর কপালে এসে ছিটকে লাগল রসিকের
 তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠামাত্র ও স্তম্ভিত ।
 পেটে মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বার করে প্রায়-নির্বিকার রসিক
 জড়িয়ে নিলে আঙুলে আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল খাজাঞ্চিকে । সুশান্ত জানিয়েছিল, ওদের আঙুলটাঙুল
 বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুলকাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় ।
 তর্জনীর জন্যে মোটা টাকা পাবে ।…
….বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, “কী গো, আঙুলের ঘা 
শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা, জেনেশুনে ?”
“...নাতনির বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।” রসিক পাসওয়ান অমায়িক ।
এই ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, টাঙোয়া মাহতো, রামপুজন সিং, 
খলিল আহমেদ সকলেরই একটা বা দুটো আঙুল কাটা ।…’
( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, পৃ. ৩১ )
          ঘটনাটা যে লক্ষ করছে, অতনু, তাকে লাক্ষণিকভাবে সুকুমার, বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্রের
 প্রতিনিধি করে তুলে মলয় চমৎকার নাটকবোধের পরিচয় দিয়েছেন । অতনু এমনই এক যুবক,
 ‘নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের
 একটা পাঁচ টাকার প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে, পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল ।’ খাঁটি বাঙালি 
মধ্যবিত্ত চরিত্র, এই চরিত্রটিকে আমরা এতো ভালো করে চিনি যে বলার নয় । যে নিজের স্বার্থের
 গুরুতর হানি ঘটাতে রাজি আছে, কিন্তু নিজের সুকুমারত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নয় । টাকা যে দিচ্ছে,
 তার সামনে গুনে না-নিলে গোনা না-গোনা সমান, এ-কথা ইকনমিকসের  স্নাতকোত্তর 
দুনিয়াদারির মেধাবী ছাত্র অতনু বোঝে না এমন নয়, কিন্তু এই অনুশাসন পালন করতে 
তার মধ্যবিত্ত পারিপার্শ্বিকে বেড়ে ওঠা মূল্যবোধে ভয়ংকরভাবে আটকায় । তার চোখের
 সামনেই রসিক পাসওয়ানের আঙুল বিসর্জন দেবার ঘটনাটি ঘটে যায় বলে মলয়ের পাঠক, 
আমরা যারা মনে মনে অতনুর সগোত্র, ধাক্কাটা আমাদের আরও বেশি করে লাগে । আর টাকা
 গুনতে অতনুর কেমন লাগে তারও চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন মলয় :-
‘...রোজ সাড়ে দশটায় অফিসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেজা ভেজা হতদরিদ্র নিকষ নোটের বিষণ্ণ আমন্ত্রণ
 অতনুকে ছেয়ে ফ্যালে, ধূসর বিষাদমুখো নোটের ভেষজ অন্ধকূপে ও চাকরি করে চলে ভারাক্রান্ত, 
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, ঝেঁপে আসে নোটের খাঁ-খাঁ করা দুর্গন্ধ,  ম ম করে ন্যাতানো শ্বাসরুদ্ধকর
 ছাতাপড়া নোট । যেন ওৎ পেতে থাকে হাড়হাভাতে নোটেরা ।’
          কিন্তু এই গদ্যভঙ্গী আমার পছন্দ নয়, অনেক শব্দের ব্যবহার আমার রুচিতে আটকায়, 
‘হাড়হাভাতের’ ব্যবহার জীবনানন্দের ভুল প্রয়োগ বলে মনে হয় । তা ছাড়া, আমি ভেবে পাই না
 নোটের গন্ধ কী করে ‘ঝেঁপে আসে’, দুর্গন্ধ কেমন করে ‘খাঁ খাঁ’ করতে পারে ? কিন্তু এটাও
 সেই সঙ্গে মানতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরীর অভ্যাসবিরোধী শব্দব্যবহার দিয়ে, শালীন 
বাংলার অচলিত বাক্যগঠন দিয়ে, মলয় একটা কোথাও পৌঁছোতে পারেন । কিন্তু সেটা 
কতখানি মলয়ের ভাষাব্যবহারের কারণে আর কতখানি মলয়ের অচেনা অভিজ্ঞতার, 
মলয়ের অজ্ঞাত জগতের কাহিনির অমোঘ আকর্ষণে তা নিয়ে তর্ক থেকে যেতে পারে । 
মলয় যেন প্রতিজ্ঞা করে কোমর বেঁধে বসেন যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বাংলা রচনাশৈলী
 কিছুতেই ব্যবহার করবেন না । তা মলয় না করুন, তবে চেষ্টাটা নতুন নয়, মলয়ের আগে 
অনেকে করেছেন এবং করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন -- এবং মলয়ের পদ্ধতিতে আটপৌরে 
কথোপকথন রচনার কতখানি সাফল্য পাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আমার সন্দেহ যায় না । 
অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, মলয় রায়চৌধুরীর ভাষা এমনিতেই যথেষ্ট লক্ষ্যভেদী, তাকে 
দুশ্চেতার দ্বারা আরও বেশি চোখা করবার কোনও তো দরকার দেখি না । কেন মলয় 
‘ঠিক আছে’কে ‘ঠিকাছে’ লিখবেন, কোনও দরকার তো নেই । বাংলা উচ্চারণে আমাদের
 স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে, হলন্ত ব্যঞ্জনের পর স্বরবর্ণ থাকলেই, সন্ধির সামান্যতম সুযোগ
 থাকলেই তাকে সন্ধি করে উচ্চারণ করা হয় । কিন্তু লেখার সময় আমরা সেগুলো করি না ।
 লিপিনির্দিষ্ট ভাষার একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ চেহারা আছে, প্রাদেশিক উচ্চারণ যাই হোক, লিপিকে তা 
প্রভাবিত করে না ; করলে অকারণ নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় । আর খুব নতুনও নয় চেষ্টাটা -- 
আজ থেকে একশো বছর আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘করলে’ পরিবর্তে ‘কল্লে’ চালাবার চেষ্টা 
করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এমনকি তাঁর সাহিত্যিক পুত্রও, অন্তত এ-ব্যাপারে তাঁকে অনুসরণ 
করেননি । মলয় কোথাও কথ্য উচ্চারণকে অনুসরণ করে অনাকাঙ্খিত সন্ধি করেছেন, 
কোথাও করেননি । ওই একই অনুচ্ছেদে আগের বাক্যেই ‘কুকুরের ল্যাজ’কে ‘কুকুরের্ল্যাজ’ 
করেননি, বা ‘কন্ঠস্বর শুনে’কে ‘কন্ঠস্বর্শুনে’ করেননি, বা পরের বাক্যে ‘ওর কাছে’কে ‘ওর্কাছে’ 
করেননি । এসব করে পাঠককে শুধু প্রতিহতই করা হয় । মলয় যদি বলেন উনি পাঠক 
টানতে চান না, তাহলে সম্পূর্ণ নিজের ডিকশন তৈরি করুন, যেমন করেছিলেন 
কমলকুমার মজুমদার তাঁর ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ --- শ্রেষ্ঠ উদাহরণটাই দিলুম । 
মলয় রায়চৌধুরীর হাতে অস্ত্র আছে, অন্তত যে পাঠক ‘একালের রক্তকরবী’তে প্রকাশিত 
তাঁর ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাস পড়বেন, তাদের ঘায়েল করার । যখন মলয় গ্রামে কাজ করতে
 যাওয়া শহুরে ছেলেমেয়েদের বিষয়ে লেখেন :-
‘...চাষের জমিতে দাঁড়িয়ে গম-যবের তফাৎ করতে পারে না । রবি-খরিফ জানে না । জানে না কদ্দিনে আখ হয়, 
পাট হয় । অড়রডাল গাছ দেখতে কেমন । এক হেকটরে কত জয়াধান সম্ভব । কত ঘণ্টার শ্রম লাগে এক কুইন্টাল 
টমাটো কিংবা চন্দ্রমুখী আলু তুল;তে । জলবিভাজক কাকে বলে । খাল আর নালার তফাৎ।...পানচাষে অনুখাদ্য
 মিশ্রণ কতটা হবে, কেমনভাবে পুঁততে হয় আলফা আলফা গাছ, নাবি বোনা আমন ধান কখন পাশকাঠি ছাড়ে,
 স্বর্ণকুমারী জাতের ধানে খোলপচা রোগ হলে কী করা উচিত।…’
          যে-পাঠকের উদ্দেশে এসব মলয় লিখেছেন, সে পাঠক তালগাছ আর নারকেল গাছে তফাৎ
 করতে পারে না, কাক শালিক ছাড়া পাখি চেনে না, চেহারা দেখে হাসাহাসি আলাদা করতে 
পারে না -- তার কাছে প্রত্যেকটি মন্তব্য টাইসনের আপার কাট ।
          অথবা সেই অতনু, অতনু চক্রবর্তী, পায়খানায় লুকিয়ে মাইনের নোট গুনতে গিয়ে যার 
একতাড়া পাঁচ টাকার নোট নোংরায় পড়ে গিয়েছিল, সুখের চাকরি আর সাজানো ফ্ল্যাটবাড়ি 
ফেলে রেখে যে উধাও হয়ে গিয়েছিল একদিন, তাকে তার সহকর্মী আবিষ্কার করে হাজারিবাগে,
 হাণ্টারগঞ্জের কাছে ( সত্যি কি হান্টারগঞ্জ জায়গা আছে কোনও ? থাকতে পারে, জানি না ; 
এটুকু জানি ‘একালের রক্তকরবী’র বেশির ভাগ পাঠকই জানে না । আমার অবস্হান আমি
 গোপন করবার চেষ্টা করছি না, পাঠক লক্ষ করবেন ) গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছয়-সাত জোড়া
 কিশোর-কিশোরীর গণবিবাহ দিচ্ছে ।
‘...বিয়ের কোনও দশকর্মের ব্যাপার নেই । পুরুতও তো নে । খদ্দরের ঘি-রঙা পাঞ্জাবি, নোংরা শাদা পায়জামা,
 পায়ে কেডস, ঘাড় ওব্দি উস্কোখুস্কো চুল, একজন লোক একটা ছোট্ট লাল মলাটের বই থেকে মন্তর পড়ছে আর
 বর কনেরা সবাই মিলে তা আউড়ে যাচ্ছে । লোকটার মাথার ওপর মশার ঘূর্ণায়মান হ্যালো । উৎকর্ণ হতে,
 অরিন্দম বুঝতে পারল, আরে, সংস্কৃত তো নয়, বিয়ের মন্তর নয় । লোকটাতো ইংরেজিতে মন্তর পড়ছে, 
পরিষ্কার ভালো ইংরেজিতে আর আবোল তাবোল উচ্চারণে সেগুলো তারস্বরে ওগরাচ্ছে হবু স্বামী-স্ত্রী ।
...ইংরেজিতে কী পাঠ করছে কান পেতে শোনে অরিন্দম আর স্তম্ভিত হয়ে যায় । চীনে ছাপানো রেডবুক 
থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করছে, বিখ্যাত সব কোটেশান, জানে ও।’
          সত্যি বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু অবিশ্বাস করাটা রক্তে বসে গেছে । 
মলয় রায়চৌধুরী কি সত্যি কথা বলছেন ? তাহলে মলয়ের সব কৌণিকতা ক্ষমার্হ, সকল
 চালিয়াতি অবহেলার যোগ্য । এই কারণেই ক্ষমার্হ, যে মলয় আমাদের , এই দুর্ভাগা কলকাতাবাসী
 জন্মস্নবদের, বিশ্বাসহীনতার পাকা দেয়ালে একটা ফুটো করতে পেরেছেন । মলয়ের লেখা
 পড়ে মুহূর্তের জন্যও মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা । সত্যের একটা গরম হাওয়া 
বয়ে যায় আমাদের মিথ্যের সাজানো বাগানের ওপর দিয়ে, আমাদের সযত্নলালিত কালচেসবুজ 
গাছপালা পলকে শুকিয়ে ওঠে ।শুধু মনে হয়, এই কথাগুলো যদি পুরোপুরি আমাদের চেনা 
ও বিশ্বাস্য ভাষায় বলতেন মলয় ! মলয়ের কাহিনি ও মলয়ের পাঠকের মাঝখানে ভুরু কুঁচকে 
দাঁড়িয়ে থাকে মলয়ের দেহরক্ষী মাস্তান মলয়ের বাংলাভাষা, তার কোমরে গোঁজা চেম্বার
 গুরুপাঞ্জাবির তলা থেকে উঁচু হয়ে আছে, তার বীরাপ্পনের মতো চৌগোঁফা স্পষ্ট দেখা যায় । 
পাঠককে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলেই সে কড়া গলায় বলে, ‘ভিড় বাড়াবেন না দাদা, নিজের কাজে যান…’
          আর, মলয় রায়চৌধুরীর কোনও উপন্যাসেরই শেষটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, অবশ্য । 
প্রথম যখন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়েছিলাম, জুডি ও জুলিকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে 
মনে হয়নি, বিশেষ করে ‘ভালোবাসা চিরকাল ক্ষণস্হায়ী’ জাতীয় মন্তব্যের সঙ্গে । 
মলয়ের বর্ণনার গুণ হচ্ছে ডিটেলের কাজ চমৎকার -- যা দিয়ে একটা ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যতা পায় ।
 চারুলতা যে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল, তার জন্য ভূপতির খবরের কাগজের হরফগুলো অবধি 
তার সময়ের সপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছে । শুনেছি, শতরঞ্জকে খিলাড়িতে যে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখানো
 হয়েছিল, যোধপুররাজের অস্ত্রাগার থেকে নিজের হাতে বেছে সেগুলোকে নির্বাচন করেছিলেন 
পরিচালক -- আর কিছু নয়, বন্দুকের কুঁদোয় রিভলভারের হাতলে তৈরির তারিখটা লেখা থাকে,
 সেটা ১৮৫৮ বা তার আগেকার তারিখ হওয়া চাই । সে তারিখ কেউ পড়তে পারুক বা না পারুক । 
ডিটেলের ব্যাপারে মলয় রায়চৌধুরীও সেই একই পথের পথিক । চমৎকার ডিটেলের কাজ মলয়ের, 
বর্ণিত বিষয় ছবির মতোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে । দুয়েকটা উদাহরণ দিই, মলয়ের লেখা যাঁরা পড়েননি, 
তাঁদের জন্যে, ‘নামগন্ধ’ থেকে :-
‘...ক্যামাক স্ট্রিট ভিড়ে ভিড়াক্কার । রাস্তার দুপাশে পুলিশের জিপ, লরি, খাকি, লাঠি, রেব্যান, খইনি, এলাহি । 
আদিত্যকে দেখতে পেল । আদিত্য যিশুকে আসতে দেখে, রেব্যান চশমা পরে নিলে । হাতে বেটন ।
 বুকে নামের তকমা । গটগটিয়ে রোয়াব । প্রোমোশান পেয়ে গেল নাকি, ওপরওলাদের টাকা খাইয়ে ।
 ওঃ, তুই তো একদম উত্তমকুমারের পাইরেটেড ভার্সান…’
          অথবা, পাটনার বারিপথের বর্ণনা, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এ । কোনও রাস্তার এমন 
জীবন্ত বর্ণনা, অন্তত বাংলায় ক্বচিৎ পড়েছি :-
‘...বারিপথের দুপাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে চট টাঙিয়ে অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুড়ির 
ষষ্ঠীপূজক ছটমাইয়ার সংসার, ভাত, ডাল, রুটির দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার,
 চেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির
 পশরা-দোকান, নানান দেবী-দেবতার মিনিমন্দির । বারিপথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে 
পাটনা সাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দুপাশে ঝকমকে দোকানপশরা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় 
হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টঙ থেকে, 
দুর্ভিক্ষের শস্যভাঁড়ার ছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চেঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে পায়ে ক্ষয়ে
 গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা ফি-বছর ভাগাভাগি হয় ।
 রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই, নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে…’
            ডিটেলের কাজে এর চেয়ে ভালো পথবর্ণনার একমাত্র দৃষ্টান্ত, বাংলায়, যা আমার মনে 
পড়ছে, তা হল সকাল বেলাকার চিৎপুর রোডের সেই বর্ণনাটি :-
‘... সকালবেলাকার প্রথম সূর্যকিরণ পড়িয়াছে শ্যাকরাগাড়ির আস্তাবলের মাথায়, আর এক সার বেলোয়াড়ি
 ঝাড়ওয়ালা মুসলমানদের দোকানের উপর । গ্যাসল্যাম্পগুলোর গায়ে সূর্যের আলো এমনি চিকমিক করিতেছে,
 সেদিকে চাহিবার জো নাই !...ম্যুনিসিপালিটির শকট কলিকাতার আবর্জনা বহন করিয়া অত্যন্ত মন্হর
 হইয়া চলিয়া যাইতেছে । ফুটপাথের পার্শ্বে সারি সারি শ্যাকরাগাড়ি আরোহীর অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ;
 সেই অবসরে অশ্বচর্মাবৃত চতুষ্পদ কঙ্কালগুলো ঘাড় হেঁট করিয়া অত্যন্ত শুকনো ঘাসের আঁটি 
অন্যমনস্কভাবে চিবাইতেছে ; তাহাদের সেই পারমার্থিক ভাব দেখিলে মনে হয় যে, অনেক ভাবিয়া
 চিন্তিয়া তাহারা তাহাদের সম্মুখস্হ ঘাসের আঁটির সঙ্গে সমস্ত জগৎসংসারের তুলনা করিয়া সারবত্তা 
ও সরসতা সম্বন্ধে  কোনো প্রভেদ দেখিতে পায় নাই । দক্ষিণে হৃতচর্ম খাসির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কতক দড়িতে
 ঝুলিতেছে, কতক খণ্ড খণ্ড আকারে শলাকা আশ্রয় করিয়া অগ্নিশিখার উপরে ঘুষ খাইতেছে এবং 
বৃহৎকায় রক্তবর্ণ কেশবিহীন শ্মশ্রুলগণ বড়ো বড়ো হাতে মস্ত মস্ত রুটি সেঁকিয়া তুলিতেছে।…’
          কলকাতায় এত সাহিত্যিকের ভিড়, আজ পর্যন্ত কালীঘাটের মন্দিরে যাবার
 রাস্তাটার এরকম একটা বর্ণনা দিলেন না কেউ ।
          কিন্তু কথা হচ্ছিল মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসের শেষ করার পদ্ধতি নিয়ে ।
 ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়ে চমক লেগেছিল, মনে হয়েছিল খুব ঔচিত্যময় সমাপ্তি ।
 কিন্তু ‘নামগন্ধ’ পড়ে খটকা লাগল একটা । কোথায় যেন একটা মিল আছে শেষটায়, 
আগের বইখানার সঙ্গে । খুশির সঙ্গে জুডি-জুলির একটা মিল আছে এটা মাথার পেছন 
দিকটায় মনে হচ্ছিল, কিন্তু মিলটা কোথায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না ।
 ‘জলাঞ্জলি’ পড়ে উঠে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা । উপন্যাসের শেষে মলয় রায়চৌধুরী 
একটা রগরগে মোচড় দিতে ভালোবাসেন । 
          যে-উপকরণ, যে-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী সাহিত্যে এসেছেন, সেই ঋদ্ধতা
 কম মানুষের থাকে । মলয়ের যা পশ্চাৎপট, মলয়ের স্মৃতিকথা পড়ে বুঝতে পারলাম, 
তা সাধারণ কলকাতাবাসী ঘটি বা বাঙাল মধ্যবিত্তের কল্পনার অতীত । 
উত্তরপাড়ার পড়ন্ত আভিজাত্যের বিলীয়মান ছায়া ছেড়ে পাটনার নিম্নমধ্যবিত্ত
 বস্তিপাড়া ঘুরে মলয় যেখানে পৌঁছোলেন তা ধারণায় আনতে পাঠকের কয়েক জন্ম কেটে যাবে ।

          

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...