উত্তরণ দাশগুপ্ত : পাটনায় মলয়, সমীর এবং গিন্সবার্গ
‘কিল ইয়োর ডারলিংস’ ফিল্মে হ্যারি পটার খ্যাত ড্যান র্যাডক্লিফ অ্যালেন গিন্সবার্গের অভিনয় করেছিলেন এবং ‘অন দি রোড’ ফিল্মে স্যাল প্যারাডাইস অভিনয় করেছিলেন জ্যাক কেরুয়াকের ভূমিকায়-- যার দরুন বিট আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে সাম্প্রতিককালে --- নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যিকবৃন্দ । কিন্তু দুটি ফিল্মই তাঁদের ভারতে বসবাসের অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করেনি ।
গ্যারি স্নাইডার এবং তাঁর স্ত্রী জোয়ানে কাইজারের দেখাদেখি, মার্কিন বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর প্রেমিক পিটার অরলভস্কির সঙ্গে মুম্বাইতে এসে পৌঁছোন ১৯৬২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি । উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াবার সময়ে তাঁরা কিছুকাল পাটনাতেও ছিলেন, দুই কবির বাড়িতে -- তাঁরা হলেন মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরী ।
মলয়, বর্তমান সময়ের একজন আইকনিক কবি, ২০০৩ সালে তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে পাটনা থেকে তিনি সমীর এবং আরও দুজন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়কে নিয়ে হাংরি জেনারেশন সাহিত্য ও শিল্পের আন্দোলন আরম্ভ করেন । আন্দোলনটি ক্রমে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আরও শিল্পী, লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের দলে টেনে নিয়েছিল ।
মলয় এখন মুম্বাইতে থাকেন এবং সমীর কলকাতায় গিয়ে ‘হাওয়া৪৯’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন ।
পাটনার স্মৃতিচারণ করার সময়ে সমীর ( ৭৯ ) বলেছিলেন যে, “আমার একজন বন্ধু ছিল ঘোড়ার গাড়ির চালক । তার সঙ্গে বসে ঠররা ( বাংলা চোলাই ) খেতুম । একবার ঠররা খাবার আড্ডায় ও আমাকে বলেছিল ওর বড়োলোক হওয়ার গল্প ।”
দ্বারভাঙ্গার মাহারাজার প্রাসাদের আসবাব নিলাম হচ্ছিল । আমার বন্ধু সেই নিলাম থেকে সস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি কিনেছিল । গাড়িটা মেরামত করার সময়ে ও দেখল যে বসবার কুশনের ভেতরে দামি-দামি জহরত লুকোনো রয়েছে । ও জহরতগুলো বিক্রি করে রটিয়ে দিয়েছিল যে লটারি জিতেছে, আর তাইতে অনেক টাকা পেয়েছে ।
সমীরের সঙ্গে গিন্সবার্গের প্রথম দেখা হয় ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায়, তখন সেটা ছোট্টো গ্রাম ছিল । “আমার ঘরে অসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা ‘দি ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ বইটা দেখে ও জানতে চাইলো, সমীর, তুমি এই বইটা পড়েছ ? হামি উত্তরে বললুম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই । বইটার মার্জিনে দ্যাখো । আমার আর মলয়ের নোটস দেখতে পাবে।”
স্পেংলারের দর্শনে প্রেরণা পেয়ে মলয় তাঁর আন্দোলনের পরিকল্পনাভূমি তৈরি করেছিলেন । ‘হাংরি’ শব্দ পেয়েছিলেন জিওফ্রে চসারের In the sowre hungry tyme পঙক্তি থেকে ।
বিহারের বিভিন্ন বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্হানগুলো ঘোরার সময়ে এপ্রিল ১৯৬৩ সালে গিন্সবার্গ পাটনায় রায়চৌধুরীদের দরিয়াপুরের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন ।
সমীর বললেন, “একদিন আমার মে দেখলেন উঠোনে স্নানের জায়গায় উলঙ্গ হয়ে স্নান করছেন গিন্সবার্গ ।”
“মা আমাব জিগ্যেস করলেন, ‘ও অমন করে চান করছে কেন ?’ আমি বললুম ওইভাবেই ওরা নিজেদের দেশে চান করে । মায়ের ভালো লাগেনি শুনে । উনি ওপর থেকে দুটো তোয়ালে ফেলে দিলেন গিন্সবার্গের ওপর, আর বাংলায় বললেন, ‘খোকা, নিজেকে ঢেকে নাও আর এই তোয়ালে দিয়ে গা পোঁছো।’”
হাংরি আন্দোলনের কবি এবং লেখকরা দেখছিলেন প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির সীমানাগুলোকে লঙ্ঘন করার তাঁদের যে প্রয়াস তা সমসাময়িক সমাজ কতটা সহ্য করতে পারে ।
১৯৬৩ সালে আন্দোন যখন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেচে সেসময়ে তাঁরা জীবজন্তু, দানব, জোকার আর কার্টুন চরিত্রের মুখোশ পাঠিয়েছিলেন খ্যাতনামা ও প্রভাবশালী লোকেদের । মুখোশের ওপরে ছাপানো বার্তা ছিল, ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন” -- হাংরি জেনারেশনের পক্ষ থেকে ।”
১৯৬৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর যেন নরক গুলজার হলো ! মলয়, সমীর, দেবী রায় এবং তাঁদের দুই সহযোগী সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষকে সাহিত্যে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল । মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির জন্য নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছিল । পরে ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট তাঁর সাজা নাকচ করেন ।
মলয় কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেন । তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে যে, কেন তিনি সাহিত্য অকাদেমি অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাখ্যান করলেন, উত্তরে মলয় বলেছিলেন, “আমি কোনো সাহিত্য পুরস্কার নিই না, কেননা যে সংস্হা পুরস্কার দেয় সে তার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয় পুরস্কারের সঙ্গে।”
হাংরি আন্দোলনের ওপর গিন্সবার্গের প্রভাব এবং গিন্সবার্গের ওপর হাংরি আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে । মলয় এবং সমীর দাবি করেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই গিন্সবার্গকে তিনটি মাছের একটি মাথার প্রতীকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের ব্যক্তিগত মোটিফ হিসাবে এবং ‘ইনডিয়ান জার্নালসসহ ( ১৯৭০ ) তাঁর অন্যান্য বইতে ব্যবহৃত হয়েছে । মলয় বলেছিলেন যে গিন্সবার্গ ওই প্রতীক পেয়েছিলেন আকবরের সিকান্দ্রার সমাধি থেকে এবং পাটনার খুদাবক্স ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ফারসি বই ‘দীন-ই-ইলাহি’র চামড়ায় বাঁধানো প্রচ্ছদ থেকে ।
নিজের ‘ইনডিয়ান জার্নালস’ বইতে গিন্সবার্গ এই বিষয়ে উল্লেখ করেননি । কিন্তু ভারতে তাঁর আগমন বহু ইউরোপীয় ও আমেরিকানের মনে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বিটলস গায়কদের দল ।
|
.
No comments:
Post a Comment