অর্ক চট্টোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস
ছোটোলোকের ছোটোবেলা
এবার আসি ১৯৯৯ – ২০০৩-এ লিখিত ও ২০০৪ সালে কোবার্ক পাবলিশাসফ প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘ছোতোলোকের ছোটোবেলা’য় । “উপন্যাস” শব্দটি মলয়ের গদ্যের ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য তা অবশ্য বিতর্কসাপেক্ষ । উপনঅস হিল্পের ধারাটি তাঁর কাছে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ফসলমাত্র । এই ধারাটির ভাঙনলীলাই তাঁর চারণ এবং নড়ন-চড়ন । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সাথে মুখোমুখি হবার আগে ও পরে ভারতীয় সাহিত্যে এক দ্বিধাবিভক্তি লক্ষ্য করা যায় যে কারণে সমালোচিকা মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় “Twice born Indian Fiction” শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন । ভারতীয় সাইত্যের এই দোআঁশলা রূপ মলয়ের গদ্যের আনাচে-কানাচে । গল্প বলার থেকে বেশি না-বলা, না বলতে পারা । প্রতিটা গল্পই শুরু হয় হবে হবে করে তারপর আর হয় না, ফুরিয়ে যায় , ফুরোয় না শুধু অনন্ত সিরিজ— গল্প থেকে গল্পান্তর । বদলে যায় । বদলে বদলে যায় । এমনই এক বহুরৈখিক ন্যারেটিভ ট্যানজেন্টের গদ্য হল মলয় রায়চৌধুরীর “উপন্যাস” । প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ইওরোপীয় আভান্ত গার্দের মতই এক প্রতিশিল্প ( anti-art ) ও প্রতিসন্দর্ভবাদী অবস্হান বা অনবস্হান তৈরি করে —মলয়ের অভিযোগ— “শিল্প-সংস্কৃতি, প্রতিভা, মাস্টারপিস, এইরকম যাবতীয় কনসেপ্ট এনেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা” । ‘হাওয়া-৪৯’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ইংরেজরা আসার পর রবীন্দ্রনাথ ও সুনীতিবাবু মিলে ‘আর্ট’ থেকে ‘কলা’র অনুবাদ-কাঠামো খাযা করেছেন গূঢ় নান্দনিক অভিসন্ধি নিয়ে । মলয় তাই স্বঘোষিতভাবেই প্রতি-লেখক । মলব যখন বলেন—“আসলে ইতিহাসকে বা কালকে বাদ দিয়ে এবার ভূগোল বা স্আনকে গুরুত্ব দিতে হবে”, তখন তাঁর কথায় উত্তরআধুনিকতায়, আধুনিকতার সময়ের মতো, স্হানিকতার গুরুত্বের জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে যায় । স্হানিক এবং খণ্ডীকৃত প্রতর্কই মহাসন্দর্ভের বিরোধিতা করে এক বিকল্প ইতিহাস নির্মাণে সচেষ্ট হয় । “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” তেমনই এক “local history”—মলয়ের সাংস্কৃতিক সংকরায়ণের কাইনি, যেখানে প্রাব মহাকাব্যের ঢঙে অসংখ্য ও বিচিত্র প্লট ও ক্যারেক্টার দেখা দেয় । একটি প্যারাগ্রাফ শেষ হতে না হতেই হারিয়ে যায় । অধুনান্তিক কাহিনি দর্শনে অসমাপ্ত ও অসমাপ্য এই গল্পগুলিই হল এক-একটি ট্যানজেন্ট । ট্রিলজির “লেখকের কথা” শীর্ষক অংশে তিনি লেখেন তাঁর গল্পের গড়াপেটা হল —“প্রট্যাগনিস্ট-কেন্দ্রিক মেট্রপলিটান সাহিত্য বহির্ভূত এমনই এক প্রারম্ভ যার বুনোট কিছুটা এগোলে চরিত্রেরা ফুরিয়ে এবং হারিয়ে যেতে থাকে । যেমনটা ভারতীয় সমাজে ঘটতে থাকে।” এই সতত বিলীয়মানতা মলয়ের মুসাফির অপরীকৃত জীবন ও তাঁর চারপাশে সাবর্ণ চৌধুরীদের একান্নবর্তি পরিবারে ভাঙনেরও চালচিত্র হয়ে যায় । যেমন নিজের মেজমামা ছ্যানের মৃত্যুতে লেখা ছোটোগল্পে মলয় পুরো গল্পটা লেখেন ন্যারেটিভকে হাইপোথিসিসে বদলে দিয়ে । ছ্যানের জীবনের প্রতিটি গল্পেরই এক বিকল্প বা প্রতি-গল্প ( anti-narrative ) আছে । সত্য তাই অনির্ণেয়ই থেকে যায় । প্যারাগ্রাফগুলি এক-একটি গল্প ও তার বিকল্পকে নির্ভার টেক্সট বানিয়ে পরপর সাজিয়ে ফেলে ।
ইতিহাসের এমনই লীনতাপ পাটনাত বাখরগঞ্জ এলাকার ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় । সেকানে চেয়ারে বসা বা রোজ স্নান করা বিলাসিতামাত্র । ন্যারেটিভ পেন্ডুলামের মতো পায়চারি করে ১৭০৯ সনে রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত উত্তরপাড়ায় । উত্তরপাড়ার সাবর্ণ ভিলা তখনই খণ্ডহর । আমার জন্মের পর আমি অবশ্য সে খন্ডহরও দেখিনি । সেখানে এখন ফ্ল্যাটবাড়ি । এই দ্বিস্হানিক ইতিহাসে বালক মলয় যেন বিনিময়যোগ্য বস্তুবিশেষ । ইমলিতলা, পানিহাটি, উত্তরপাড়া, আহিরিটোলা— সর্বত্রই তিনি “অন্যান্য”— অপর । প্রথমে ক্যাথলিক স্কুলে তারপর ব্রাহ্ম রামমোহন রায় সেমিনারিতে । কোন্নগরের আত্মীয়রা তাকে “খোট্টা খ্রিস্টান” বলে ডাকতেন—“ইমলিতলায় আমরা ছিলাম বঙ্গসংকর । মামারবাড়ি পানিহাটিতে গেলে খোট্টাসংকর।” মলয়ের চেতনা সদা সংকরায়িত জগৎ যেখানে ক্যাথলিক স্কুলের পিয়ানো টিচার মিস ডরোথির গায়ের পারফিউম ঘৃতকুমারী পাতার শাঁসের গন্ধের মতো ঠেকত বালক মলয়ের নাকে ।
এই আখ্যানে ইতিহাস আর কিংবদন্তিকে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখক । ইতিহাস লোককথা ও মিথ নির্মাণে এক আত্ম-বিধ্বংসী জিরো-পয়েন্ট — ডায়াস্পোরার জিরো হিসট্রি বা ইতিহাসহীনতা । দেশ থেকে দেশান্তরে হস্তান্তরিত হতে থাকা উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী তার অতীত তথা সিকড়ের ইতিহাস থেকে উৎখাত হয় । এই মিথিক পরিসর ঔপনিবেশিকতার যুক্তিবদ্ধ প্রতর্কের বিরোধিতা করে । ইতিহাস এখানে শুধুই এক রেফারেন্স ফ্রেম যেন । গ্রন্হের শেষাংশে লেখক নিজেই একে লাতিন আমেরিকান ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে তুলনা করেছেন । তবে তাঁর উপনিবেশ বিরোধী অবস্হানের সাথে তাঁর জীবনেরও এক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আক্রমণের সময়ে তাঁর পূর্বপুরুষরা সিরাজের পক্ষেই ছিলেন । সিরাজের পক্ষাবলম্বনকে ইমলিতলার বাড়িতে সাবর্ণ চৌধুরীদের “স্ট্র্যাটেজিক ব্লান্ডার” বলে মনে করা হত । ইংরেজদের বিরাগভাজন জমিদারবংশ এভাবেই ইমলিতলার ফেকলু ছোটলোক হয়ে ওঠে ।
সাবর্ণ চৌধুরী বংশের এই মিথিক ইতিহাস এক অসম্ভব বৈচিত্র্যের জাদুঘর — কপিলের দাদু ও তার ব্রাত্য হয়ে রকে খিস্তির টোল তৈরি, উত্তরপাড়ার সাবর্ণ ভিলার খণ্ডহরে ন’কাকিমার স্মৃতিতে ক্রন্দনরত ন’কাকা, আহিরিটোলার ঘনান্ধকার রান্নাঘরে রান্না করতে-করতে প্রঅয়ান্ধ পিসিমা –এই সব আধা বিশ্বাসগামী চরিত্রের চলাচল এখানে । পড়তে-পড়তে মনে হয় স্যামুয়ের জনসন থেকে ভিক্টিরীয় যুগ পর্যন্ত ঘনায়মান পরিবারকেন্দ্রিক “panoramic novel” ( এক ধরনের সমাজ ও সামাজিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিক উপন্যাস )-এর কাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছেন লেখক । বাংলা-বিহার মিলিয়ে জাতি-ধর্মের এক হাইব্রিড বুনোটে মলয়ের বেড়ে-ওঠা দেখতে পাই আমরা ; দেকি তাঁর ইন্দ্রিয়াদির উন্মেষ, নারীর প্রতি উদগ্রতার শারীরিকতার প্রকাশ । অনিশ্চিত যার জন্ম-ইতিহাস , সেই মেজদা বা বুড়োর বাড়িতে বেবুশ্যে মাগি আনা, হাত থেকে খিল পড়ে গিয়ে শব্দে ধরা পড়ে যাওয়া, মুন্সিজি-পত্নীর নগ্ন “সুডৌল গ্র্যানিট দেহ” আর দোলের রঙ মাখানোর মোচ্ছবের মধ্যেও শোনা যায় “মাসিক” হল “ম্যাজিক” শব্দের বঙ্গীয়করণ — ছোটোবেলাকার এক-দু গাছা বিধিনিষেধ । সংকরায়ণ কিন্তু আনপ্রহিবিটেড, অবশ্যম্ভাবী । তাই তো বন্ধনীমুক্ত হয় — ” এ হো ! কা হো ! আইভ্যান হো !
নখদন্ত
আমার পাঠের অনুক্রমে বছর পাঁচেক ফিরে গিয়ে ‘আওয়া ৪৯’ এর মে ২০০২ সংখ্যায় প্রকাসিত উপন্যাস ‘নখদন্ত : একটি পোস্টমডার্ন সাতকাহন’–এর দিকে নজর দি । শিরোনাম পড়ে আমার প্রাক-মলয় পর্বের গদ্য ধেকে একটা কথা মনে পড়ে গেল — “লোমচোখ”, যা তাড়া করে, ঠিক যেমন মলয় তাড়া করেন আমায় । ‘নখদন্ত’ আদ্যান্ত পোস্টমডার্ন আঙ্গিকে লেখা একটি সেল্ফ রিফ্লেকসিভ উপন্যাস, যেকানে রামায়ণের সাত কাণ্ডের নামে নামাঙ্কিত সাতটি দিনের ঘটনা হল ফ্রেম স্টোরি । এখানে পাওয়া যায় লেখক মলয় রায়চৌধুরীর ব্যক্তিগত ডায়েরি যেখানে তাঁর দাঁত মাজা, ওষুধ খাওয়া আর কমোদ পরিষ্কারে অযথা বিলম্বের পাশেই স্আন পায় তাঁর কাইনির নির্মাণসূত্র । লখনউতে মমতা অবস্হির আত্মহতভার খবর আর প্রতিবেশী সাধনবাবুর মৃত্যু একই বন্ধনী তৈরি করে, যার ভিতর থেকে উঠে আসে এক-এক করে পাঁচটি গল্প— “শেষ হাসি”, “শহীদ”, “জিরোনাম্বার মানুষ”, “ভাগ্য লিখনে হরফের দরকার নেই ” এবং “অট্টহাস্য অবিনির্মাণ” । এই পাঁচটি গল্প মলয়ের অথরিয়াল ফ্রেম ন্যারেটিভে বাঁধা, বাঁধা মৃত্যু আর হাসিতেও । আলাদা-আলাদা পত্রিকার জন্য লেখা এই গল্পগুলোর মধ্যে “অর্গানিক লিঙ্ক” আছে । একক ব্যক্তির ইতিহাস একানে নাযির যোগ । ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষের পণ্যায়ণ অদ্ভূত ভাবে প্যাসিভ এক ব্ল্যাক হিউমারে দেখিবে গেছেন মলয় । প্রথম গল্পে এলিজাবেথ জুটমিলের [ যেন এক নয়া ঔপনিবেশিক পরিসর ] মজুর কাঙ্গাল চামারকে পুলিশ যৌন অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিকেষ করে, তখন তার মুখের ঐ উদ্ভট হাসি দিবে শুরু হয় এই সিরিজ । ইংরেজদের আগে পাট আর জুটের চাষ, উপনিবেশে আর উত্তরউপনিবেশে পাটকল, জুটমিল, সেখানে ইউনিয়নের দলাদলি, মজুরদের আত্মহত্যা, কলের রেজিস্টারে নাম না থাকা “জিরো নাম্বার শ্রমিক”— এইসব নিবেই মলয়ের আন্ধার পোলিটিকাল কনটেন্ট । উপস্হাপনা ও বিবরণ যত তীক্ষ্ণ, ততই নির্ভার ও আবেগহীন । মলয় ঠিক ট্যাজেডি লিখতে চাননি । পাতাজোড়া বন্ধ কারখানা ও আত্ম্ত্যা-করা শ্রমিকদের নামের তালিকা, চটকলগুলোতে স্বাধীনতার আগে-পরে মালিকানার হাতবদলের পাতার পর পাতা লিস্টি— সংখ্যা এবং তথ্য এখানে স্বয়ম্ভর ; রেফারেন্সিং রাজনৈতিক রিপোর্টের আবহ তৈরি করেছে । কাঙ্গাল চামারের পোঁদে গোঁজা রদ থেকে গান ভেসে এসেছে– “জোর কা ঝটকা ধিরে সে লগে” । রাজপুত কন্সটেবলের মৃত্যুতে অভিযুক্ত কাঙ্গাল চামার হাপিশ হয়ে যায় । পরের গল্পে ঐ একই জুটমিলের পে ক্লাকফ সত্য আচাজ্জির আত্মহত্যা এক স্বঘোষিত শহীদত্বের বাচন । শহীদত্ব কি স্বয়ম্ভর ? নাকি শহীদ হতে গেলে নির্ভর করতে হয় অপরের ওপর ? তারপর আসে থার্ড সিরিজ— কাঙ্গাল চামারের পরিবর্তে দুই অস্তিত্বহীন “জিরো নাম্বার ওয়ার্কার” খালেদালি মণ্ডল ও বৈকুন্ঠ সুর । সিমাহিন দারিদ্র, ক্ষুধা, শেষে ভিক্ষার কলকাতায় খালেদালি মণ্ডলের মৃত্যু । তাও যেন শান্তি নেই । মর্গ থেকে দেহের অদলবদল —খালেদালির জায়গায় হিন্দু শরীর — দিবাকর যুগি । ডেডবডির ধর্ম নিরুপণে মলয়ের জিরো নাম্বার ভারতবর্ষে এ যেন নিকেষ ও হাপিশে এক চৈত্র সেল — “খালেদালি মণ্ডলের দেহ গেল কোথায় স্যার ? এই দিবাকর যুগি লোকটার দেহ আর আইডেনটিটি দুই-ই আছে । কলকাতার মর্গে যে লোকটার দেহ আছে তার কিন্তু আইডেনটিটি নেই । আর খালেদালি মন্ডলের দেহও নেই আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ ?”
ফোর্থ সিরিজ খালেদালির ছেলে আমিনুলের চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসা । মাথায় টাইপরাইটার চড়ানো বেকার যুবকদের ভাগ্য পরীকআ মলয়ের চোখা বিদ্রূপ, যা প্রতীকী সংবাদ ও কথপোকথনে সমসময়ের এক সিরিওকমিক ছায়া হয়ে যায় । টাইপ রাইটারবাহীরা গেয়ে ওঠে —“হুমহ না ভাই হুমহু না” — ( সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটির প্রয়োগ ) । “খপোধ বাড়ে” “রোদ বাড়ে” “ক্লান্তি বাড়ে” আর তারই সঙ্গে লাইনও ।
শেষ গল্পে কাঙ্গাল চামারের মরণোত্তর হাসি মিশে যায় শহরের পার্কে সক্কাল বেলায় আমলাদের লাফিং প্র্যাকটিসের সাথে । দেখতে থাকে অর্ণব । বৃষ্টিভেজা ঐ সকালে গোগ্রাসে পড়ে ফ্যালে স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে বিভ্রাটের খবর । পতাকা উত্তোলনের সময়ে পতাকাটি না খুলে দণ্ডের ওপর থেকে পুঁটলিসহ মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের সামনে এসে পড়ে । অনুষ্ঠান অবশ্য চলতে থাকে । পরে জানা যায় পাটের দড়ি দিয়ে কাঠের কপিকলে বাঁধাতেই এই বিপত্তি । স্বাধীনতার ঐ পতাকাহীন দণ্ড কাঙ্গাল চামারের যৌনাঙ্গ হয়ে ওঠে, যার বীর্য ও রক্তে চকমক করছিল পুলিশের বুট । পতাকাহীন ঐ দণ্ড সহাস্য ক্যাসট্রেশানের প্রতীক হয়ে ওঠে । এই হল মলয়ের উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ যেখানে দেশভাগের মানদণ্ড বলতে বোঝায় নুনুর খোসা— ছাড়ানো, অথবা না-ছাড়ানো । তাই কথনের কিনারায় আবার শোনা যায় প্রপাত-সংকেতের মত ঐ হাসি, ঠিক যেন বাখতিনীয় কার্নিভাল লাফটার ( রুশ দার্শনিক মিখাইল বাখতিন হাসিকে বিপ্লবী রদবদল ঘটানোর হাতিয়ার মনে করেন ), যা নিতান্তই অশান্তিকামী ও রাজনৈতিক ।
“নখদন্ত”-র ফ্রেম ন্যারেটিভে লেকক-প্রতিস্বের এক অনর্গল নিমফাণ চকলতে থাকে । মলয় কী বই পড়ছেন, কী করছেন, কী দেখচেন —কোন যাপন ও পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে আদল পাচ্ছে তাঁর কাহিনিরা— এসব যেমন আছে, তেমনই আছে প্ররোচনামূলক নানা বভক্তিগত পোলেমিক । শঙ্খ ঘোষ থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়— এসট্যাবলিশমেন্ট ও আপোষের প্রতি তীব্র শ্লেষ ।
উল্লেখযোগ্য ফ্রেম স্টোরি জুড়ে “Notes” নামক অংশগুলি, যেকানে বাংলা ্রফে ইংরাজি ভাষায় নানা অ্যাফরিজম পাওয়া যায় । ট্রান্সলিটারেশন পাঠ অভিজ্ঞতাকে মোচড় দেয় । যৌক্তিক সামান্যিকৃন প্রক্রিয়ায় লেকক এক বিমূর্ত এবং প্রাব দার্শনিক স্পেস তৈরি করেন উপনভাসটির ভিতর, উদাহরণস্বরূপ — ” নাথিং ইজ টু মিন ফর ইম্যাজিনেশন অ্যাজ নাথিং অন আর্থ ইজ ইনসিগনিফিক্যান্ট” । উপন্যাসটিতে মলয় নিজেই “ঋদ্ধ” আর “মুগ্ধ” হওয়ার মধ্যে ফারাক করেন । মলয় মুগ্ধ নয়, ঋদ্ধ হতে চান । আর আমরা ?
অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা
আমি যখন মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস পড়িনি তখনও আমি মলয়কে আর মলয় আমাকে পড়ছিলাম । পড়েই যাচ্ছিলাম । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়তে গিয়ে নোট পরীক্ষক অতনুকে দেখলাম পচাছেঁড়া নোটের ধড়পাকড়ের ভিতর বসে বসে পোড়া নোটের গন্ধকে মানুষের পোড়া মাংসের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে, আমার মনে পড়ল বছর দুয়েক আগে লিখতে শুরু করা এযাবৎ অসম্পূর্ণ আমার উপন্যাসের প্রথম দুটি লাইন — ” মৃত্যুর মত দশ টাকার কয়েন । মৃত্যুর যত দশ টাকার কয়েন ।”
‘এই অধম ওই অধম’ পেরিয়ে মলয়ের ট্রিলজিতে হাত দিয়েছি, একদিন পড়ন্ত বিকেলে সোমানাথদার ( সম্পাদক : অপর ) টেলিফোন ও এই লেখার অবতারণা । তারপর ফেসবুকে মলয়দার সাথে কথা, ই-মেল চালাচালি । তাঁর ও তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সাহায্যে কলেজ স্ট্রিটের আনাচে-কানাচে হাতে-হাতে হাতেনাতে পাওয়া মলয়দার উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধমূলক গদ্য ।
সবই মলয়ের কথামত । যেমন ‘হাওয়া-৪৯’কে দেওয়া ইনটারভিউতে তিনি বলেন— ” আমার বই তো গাদাগাদা বিক্রি হয় না, কোনো ফিক্সড পাবলিশারও নেই । পড়তে হলে বইটা খুঁজে খুঁজে জোগাড় করতে হয় ; অর্থাৎ , আমার বই যিনি পড়েন বাধ্য হয়েই পড়েন, পড়তেই হয় বলে পড়েন ।” আমিও তেমনই এক শ্রমিক-পাঠক । অন্বেষণের কায়িকতায় পাঠ প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণ ও বিয়োজন দুইই ঘটে । খোঁজা ও পড়ার এই গল্পে উত্তরপাড়া শহরতলির সহস্মৃতি শেয়ার করি আমরা দু’জন । এই স্হানিক এককত্ব মলয়ের আখ্যানে এক কূটাভাস হয়ে দেখা দেয় যখন ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ার জন্মস্হান বা উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বিলীয়মান ঐশ্বর্য — এইসব গম্বুজ পাশ কাটিয়ে মলয়ের কাহিনীগুলি ধারণ করতে থাকে অন্তর্দেশীয় প্রবাসের এক নব্য-বাঙালিয়ানাকে, যা দোআঁশলা, বহুভাষিক, বহু-সাংস্কৃতিক ও অধুনান্তিক সমাজ ভাবনার্ দোসর । এই সব শাখা-প্রশাখা থেকে ফিরে তাকালে শিকড়ের গম্বুজস্বরূপ ইমলিতলা বা উত্তরপাড়ায় এন অনাবিল তরলতা তৈরি হয় । মলয়ের আখ্যান এই ” Space of Flows” [ পরিসর যখন সদা ধাবমান, একক অবস্হান নয় ] এর স্মৃতিবাহী ।
শ্রমসাধ্য প্রাপ্তি দিয়েই শুরু করি । ‘বিষয়মুখ’ পত্রিকার ২০০৭ জুলাই – ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ পড়তে-পড়তে যে পেনসিল দিয়ে মার্ক করছিলাম, দেখলাম সেটার শিষটা ভাঙা । তারপর ঐ এঁটোকাঁটা শিষ দিয়েই মার্ক করা শুরু করলাম । এই ‘এঁটোকাঁটা’ মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালির মুখোশ-উচ্ছিষ্ট যেন । উৎকৃষ্ট এবং উৎ-সৃষ্ট । পিতামহ-মাতামহের গুপ্ত যৌনজীবনের এঁটোকাঁটা । প্রয়াত দাদুর চিঠি-চাপাটি দিয়ে শুরু এই খনন । টেক্সট যেন এক খননায়ন — চোরাগোপ্তা খুলামকুচি আমদানি করে । সাধু বাংলায় লেখা অতীতের হলুদ ন্যারেটিভ জাক্সটাপোজড হয় প্রজন্মান্তরের ই-মেল বা চ্যাট-এর সঙ্গে । কাহিনির প্রবাহ বেনারসে, শিকড় বর্ধমানে । ইন্দিরা ব্যানার্জির প্রয়াত দাদু অতুল মুখোপাধ্যায় বা “অতুল মূর্খ”র বন্ধু শিশির দত্তর লেখা যে ন্যারেটিভ মলয়ের উপন্যাসের মেরুদণ্ড, তা এক জটিল বহুকথন সম্বলিত প্যালিম্পসেস্ট । শিশির দত্তর সাধু বাংলার ওপর পাঠিকা তথা কাইনির অন্যতম প্রধান চরিত্র কল্যাণী/কেকা বউদির ন্যারেটোরিয়াল প্রেজেন্স । তার ওপর আবার নির্মলবাবুর ( অতুলের বন্ধু ) বাবা, যার ডায়েরিতে শিশির লিখেছিলেন এই কাহিনি, তাঁর প্রফেসোরিয়াল নোটস — লেককের বিমূর্ত ও তাত্ত্বিক পরিসর ; এই ত্রিস্তরিত আখ্যানের সমান্তরাল চলে লিখন আর পাঠ । শিশির পড়েন বন্ধুর বাবা তথা প্রফেসরের সমাজভাবনার র্যানডাম নোটস, আর তারই ওপর লিখে ফ্যালেন নিজের বৈদেশিক যৌন কাহিনি । অন্যদিকে কেকা বউদি, যিনি নিঃসন্দেহে মলয়ের উপন্যাসের র্যাডিকাল নায়িকা, তিনিও তো শিশির কাহিনির পাঠিকাই । তবে শিশিরের মতন তিনিও লেখা ও পাঠ দুই করে থাকেন । শিশিরের কাহিনিকে ক্রমাগত আন্ডারকাট করতে থাকে কেকা-কথনের বলনকলা ।
ইমপোটেন্ট ও বধুনির্যাতনকারী প্রসন্নকান্তির বিদ্রোহিনী স্ত্রী কল্যাণী পাড়ার ছেলে অতুলের সাথে বেনারস পালিয়ে আসেন । সেখানে অতুল আর কল্যাণী তথা নামান্তরে কেকা শুরু করে গাঁজাচরস আফিমের ব্যবসা — “দ্রুত ধনী হবার ব্যধি” । বেনারসের মন্দির চত্ত্বরে কালো গ্র্যানাইটের ফ্যালিক এক লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে কেকা । কিন্তু ক্রমশই অতুলের কাছে কেকার শরীর আকর্ষণ হারায় আর অতুল লিপ্ত হয় অন্য-অন্যান্য নারীশরীরের সাথে । মার্কিনী জোসেফিনের সঙ্গে শয্যা আমদানি করে হাইব্রিড এক শিশুপুত্র ‘কং’ । ‘কং’কে প্রতিপালনের দায় পড়ে কেকার ওপর । জোসেফিন তখন উধাও । শিশিরের কাহিনির সিংহভাগ জুড়ে থাকে কেকার ভাষায় “কভাবলা কামুক”টার সাথে ভাইকিং রমণী ম্যাডেলিন ক্যরিয়েটের সঙ্গম-লীলা । সাধু ভাষার মোচড়ে বলা এই যৌন আখ্যান পর্নোগ্রাফি আর এসক্যাটোলজির মধ্যিখানে থেকে যায় । কখনও তা প্লেজার দেয়, কখনও কুন্দেরায়েস্ক এক বিষাদ । এক অতলান্ত অনুভব । অ্যাটলান্টিকের এপার থেকে ওপার— সংকরায়ণের গন্ধ এই শরীরময় এঁটোকাঁটায় । মলয়ের বর্ণনাগুণে এই ইনটারকোর্স মিস্টিক এক রিচুয়ালে পরিণত হয় — “অগরু” এবং “কান্তা” নামে ছয়টি করে শিশির তরল প্রলেপ সূর্যাস্তের পর ফোরপ্লের ফোরগ্রাউন্ড তৈরি করে । শিশিরের এই ‘বিদকুটে’ সাধু বাংলা কি তবে রক্ষণশীল এক ভাষা-পদক্ষেপ, যেমনটা কেকা বলে — “আর লিখলি তো লিখলি এই বিদকুটে বাংলায় কেন ? সোজা বাংলায় লিখতে গেলে নোংরা করে ফেলতিস ?” শিশির তথা ‘শিশু’ আর ম্যাডেলিন তথা ‘ম্যাডি’র শরীর যেন ভাইকিং রাজগৌরবের এক ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র । স্ক্যান্ডিনেভিয় নৌযোদ্ধাগণের বংশজ অতিকায় ম্যাডেলিন ও শিশিরের এই সঙ্গমে নারী সরীর প্যাট্রিয়ার্কাল গেজের নিষ্প্রাণ পাঠবস্তু নয় । তা এক ঋদ্ধ ইতিহাসমুখরিত চিহ্ণ, যা তেরছা করে দ্যায় যৌনতার পুংশাসিত কাঠামোকে । পুরুষ হেথায় নারীর বশিকৃত ক্যাবলা-কামুক মাত্র । ম্যাডেলিন চলে যাবার পর চাবুক আসে কেকাবউদির হাতে, যখন তিনি সিডিউস করেন শিশিরকে । বিদেশি গান বদলে যায় বৈজয়ন্তীমালার “হোঁটোপে অ্যাইসি বাত”-এ । এই সিক্রেটই কেকার সম্পদ — ” আমার গায়ের রঙ আহ্লাদী পুতুল ম্যাডেলিনের মতন নয়, তাতে কী । আমি এমন অপ্সরা যার মুঠোব আছে শকুনির পাশা । মুকখু চাষা শিশির কিছুই আঁচ করতে পারেনি । ম্যাডেলিনের শেখানো এলকুমি-বেলকুমিই পুঁজি ।”
কেকার অভিসন্ধিতে শিশির এক অনুঘটক মাত্র । শিসির-কেকার শয্যা থেকে উঠে আসে ‘বং’ । কেকা হন কং-বং-এর মা — “অতুল আমার কোলে ওর বাচ্চা কংকে ধরিয়েছে । আমি ওর কোলে শিশিরের বাচ্চা বংকে ধরাব ” এই ধরাধরির গুপ্ত পারিবারিক ইতিহাস ছুঁয়ে যায় বারানসীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস– অবাধ ফ্যাগের সন্মোহন থেকে বজরং দলের উপস্হিতি যারা তুকটাক চুমুকেও আস্ত রাখেনি । এই আখ্যান শেষ হয় অতুলের নাতনি ইন্দিরা ও শিশিরপুত্র সুবীরের প্রণয়-পরিণয় দিয়ে । তারা গুপ্ত ইতিহাস সম্বলিত ডায়েরিটিকে চুপচাপ স্বস্হানে রেখে দেওয়াই সাব্যস্ত করে । টেক্সটের অপেক্ষা শুরু হয় আবার পাঠ ও লিখন বৃত্তের ভিতর ঢুকে পড়ার জন্য । শিশির জানে সে মোহরা । কেকার । কেকা অতুলের মৃত্যুতে কাঙালিভোজন করিয়ে মাদার ইন্ডিয়া সাজে । মলয়ের উপন্যাসে যৌনতা অস্তিত্ব তথা আইডেনটিটিরই বিনির্মাণ ঘটায় । শিশির-কেকারা বুঝতে পারে কত-কত আরও কত-কত শিশির-কেকাদের তারা তাদের শরীর-মন আর অস্তিত্বে পুষছে । লেখক মলয় তার ডিসকার্সিভ স্পেস তৈরি করেন নির্মলের অধ্যাপক পিতার ‘জ্ঞানবাক্যের’ পরিসরে । তাঁর ডায়েরিতেই তো লেখে শিশির । তাঁর সফল দার্শনিক অ্যাফোরিজম এক সমান্তরাল প্রাতর্কিক পরিসর নির্মাণ করে — এক প্রফেটিক স্পেস যার বয়ানে বাঙালির দোআঁশলা আধুনিকতায় এক উনিশ শতকীয় অ্যনাক্রনিস্টিক অধুনান্তিকতার রিপোর্ট পাওয়া যায় । সেখানে উঠে আসে উত্তর-উপোনিবেশের অনুসঙ্গ, ভালো-মন্দের নৈতিক বিচার ও সর্বোপরি এই ‘আমি’র আবরণ— “আমি নামক নিবাসটি যে যাবতীয় সমস্যার আগার । তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব । কতরকম আমি যে আছে— সবই অনির্ণেয়, তার ইয়ত্তা নেই । পার্শ্বচরিত্র নির্মলের প্রয়াত পিতা যেন ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’র অধুনান্তিক ডেড অথর — স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরী । শিষ বড্ডো ছোটো হয়ে গেছে, পড়াও শেষ । শিশির আর কেকার মত আমিও পড়লাম আর লিখলাম ।
No comments:
Post a Comment