Wednesday, October 31, 2018

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাঃ
কাব্যের নান্দনিক বোধকে ভেঙে খান্ খান্ করার অস্ত্র।
-পার্থ চট্টোপাধ্যায়
বিগত শতকের ষাটের দশক। বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি দশক। এই দশকেই বাংলা কাব্যে জন্ম নিয়েছিল হাংরি জেনারেশানের কাব্য আন্দোলন। কবিতাকে জীবনের সাথে একীভূত করতে চেয়েছিলেন এই দশকের কবিরা। নিয়মকে ভাঙার ভেতর দিয়েই, প্রথাসিদ্ধ বস্তুকে বর্জন করার মধ্যেই এই আন্দোলনের কবিরা আনন্দ পেয়েছিলেন। হাংরির মুখপত্র হাংরি জেনারেশনের প্রথম বুলেটিনে এর কারণ বর্ননা করতে গিয়ে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন-“কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্থ”। কারণ কবিতার মধ্যদিয়ে জীবনের অর্থ বের করার গতানুগতিক প্রয়াসের দিন শেষ। এখন কবিতার প্রয়োজন অনর্থ বের করার কাজে লাগবে। কবিতা প্রকাশ করবে, “মানবিক দৈহিক এবং শারীরিক ক্ষুধার কথা”। “মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়”।
উল্লেখ্য মলয় রায়চৌধুরী হাংরি শব্দটি নিয়েছিলেন কবি চসারের “In the sowre hungry tyme” পংক্তি থেকে। হাংরির সাথে রয়েছে ক্ষুধার সম্পর্ক। এই আন্দোলনকে অনেকেই ক্ষুৎকাতর সম্প্রদায় বলেও চিহ্নিত করেছেন। ক্ষুধা শুধু দেহের নয়। মনের। জীবনে এবং কাব্যে এই কবিরা পূর্নভাবেই অঘোর পন্থী। এই কবিদের প্রভাবিত করেছিল এ্যাংরি কবি গোষ্ঠির কাব্য চেতনা। বীটনিক কবিদের কাব্য এবং শৃঙ্খ্লাহীন জীবনবোধ। হাংরির কবিরা সঙ্গী করেছিলেন অ্যালেন গিনেসবার্গকে। যখন হাংরির কবিরা জেলে। কাব্য লেখার অপরাধে। সেই সময় উদ্বিগ্ন অ্যালেন প্রয়াসী হয়েছিলেন কবিদের মুক্ত করতে।
হাংরি আন্দোলন শুরু হবার দু’বছরের মধ্যেই পুলিশ তৎপর হয়। ১৯৬৪র ২ সেপ্টেম্বর এগারো জন লেখকের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর করা হয়। দশ জনের নামে ওয়ারেন্ট বের হয়। গ্রেপ্তার ছয় দু’জন। একমাত্র সমীর রায় চৌধুরী ও প্রদীপ চৌধুরী ছাড়া বাকিরা পুলিশের ভয়ে সমস্ত দোষ মলয় রায়চৌধুরীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী “প্রচন্ড বৈ্দ্যুতিক ছুতার” কবিতার জন্য অপরাধী চিহ্নিত হলেন। আদালতে কেস উঠলো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ দিলেন। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এ.কে. মিত্র মলয় রায়চৌধুরীকে দোষী চিহ্নিত করলেন। দু’শো টাকা জরিমানা হল। অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড। হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে মলয় রায়চৌধুরীকে বেকসুর খালাস করে দেয়। এই ঘটনার পরেও মলয় রায়চৌধুরী হ্যাংরির দু’টো বুলেটিন বের করেন নিজের সম্পাদনায়। ১৯৬৬তে বের করেছিলেন ‘জেব্রা’ পত্রিকা। প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদনা করেন ‘স্বকাল/ফুঃ’’ পত্রিকা। সুবিমল বসাক ‘প্রতিদ্বন্দী’ ও দেবী রায় সম্পাদনা করেন ‘চিহ্ণ’’পত্রিকা। ১৯৬৮-র পরে হাংরি আন্দোলনের গতি প্রায় স্তিমিত হয়ে যায়।
হাংরি জেনারেশনের বাংলা কবিতা আন্দোলনের রাজাধিরাজ বলা যায় মলয় রায়চৌধুরীকে। মলয় রায় চৌধুরী জন্মেছেন ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। জন্মস্থান বিহারের পাটনা।
২০০৪ এ ‘প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি’ প্রবন্ধে মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন-“স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখন্ডে”। আর এই ভাবনাই একসময়ে মলয়কে হ্যাংরির মত আন্দোলনের জন্ম দিতে বাধ্য করে। উল্লেখ্  করা যায় ওসওয়াল্ড স্পেংলার লিখেছিলেন-‘The Decline of the West’ নামের একটি বইএই গ্রন্থের মূল বক্তব্যই হাংরির আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। ওসওয়াল্ড স্পেংলার বলতে চায়েছিলেন- কোন সময়ই কোন কালচারাল হিস্ট্রি সরল রেখায় চলে না। তার প্রসার ঘটে বিভিন্ন ধারায়। এটি জৈব্য প্রক্রিয়া। আর এই কারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁক বদল ঘটবে তা আগে থেকে বলা যায় না। যখন শুধুই নিজের সৃজন ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই গ্রহণ করতে থাকে। মলয় রায়চৌধুরী ভেবেছিলেন দেশ ভাগের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভয়ানক অবসানের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। উনবিংশ শতাব্দির মনিষীদের মত আবির্ভাব এখানে অসম্ভব। তাই ডিরোজিওর পর্যায়েও  না হলেও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আন্দোলন দরকার আওয়াজ তোলা কর্তব্য।
১৯৬১।হ্যাংরির ইসতেহারে মলয় রায়চৌধুরী লিখছেন-
১. অ্যরিস্টটলের বাস্তবতাকে কখনও নকল করা হবে না, কিন্তু বলাতপ্রস্তুতির মাধ্যমে আচমকা জাপটে ধরতে হবে অপ্রস্তুত ছেনালি অস্তি।
২. নৈঃশব্দকে অটুট রেখে নির্বাককে বাস্তব হয়ে উঠতে হবে।
৩. ঠিক সেই রকম সৃষ্টি-উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃ্থিবীকে চুরমার করে পূর্নবার বিশৃঙ্খ্লা থেকে শুরু করা যায়।
৪. লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগাতে হবে।
৫. ফাঁস করে দেয়া হবে যে, কেবল কান্তি সত্তা হিসাবেই জীবন ও অস্তিত্ব স্বীকৃত।
৬. অন্যের প্রদত্ত বোধ-জ্ঞানের চেয়ে বরং সমস্ত রকম সন্দেহ ও অসহায়তাকে গ্রহণ করা হবে।
৭. দ্বিপদ-উন্নতিকামী প্রাণীদের তাবৎ মূল্যবোধকে আক্রমন করে ছারখার করা হবে
৮. চরম সততার উদ্দেশ্যে সব রকম চাটুকারদের মাগিদের শপৎ পূর্বক পরিত্যাগ করা হবে।
৯. আত্মাবিস্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে।
মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সব্যসাচী লেখকদের অন্যতম। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক হিসেবে তিনি সফল। তিনিই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যাঁর হাতে বাংলা পোষ্টমর্ডান সাহিত্যের যথার্থ জন্ম
মলয় রায়চৌধুরীর কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা দশটি। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য-“জখম”, “শয়তানের মুখ(১৯৬৩), আমার অমীমাংসিত শুভা (১৯৬৪), তুলকালাম আত্মহত্যা (১৯৬৫), মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর (১৯৮৭), কৌনপের লুচি মাংস(২০০৩), পোস্টমর্ডান আহ্লাদের কবিতা(২০০১), আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ(২০০০), যা লাগবে বলবেন(১৯৯৬), ছত্রখান (১৯৯৫), চিৎকার সমগ্র(১৯৯৫), ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো ( ২০১৭ ) প্রভৃতি।
মলয় রায়চৌধুরী যখন কাব্য চর্চা শুরু করেছেন সেই সময় চীনে পরমানু বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। দক্ষিন আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জেল জীবন শুরু হচ্ছে। চীন ভারতের যুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজিত হচ্ছে ভারতে। হিন্দু মুসুলমানের দাঙ্গা চলছে। ১৯৬৪তে প্রয়াত হচ্ছেন জহরলাল নেহেরু।
এই টালমাটাল সময়ে কবিতা লিখতে এসে সরাসরি প্রথা ভাঙার খেলায় মেতে উঠলেন তিনি। পুরাতন ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। শব্দ ব্যবহারে নিজস্ব রীতির জন্ম দিলেন। অকথ্য শব্দকে কবিতার কারুসজ্জায় নিয়ে এলেন দ্বিধা ছাড়াই। নিয়ে এলেন যৌনতার খুল্লামখুল্ল প্রয়োগ।
‘প্রচন্ড বৈ্দ্যুতিক ছুতার’। বাংলা কাব্য সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন। এই কবিতা লেখার অপরাধে অশ্লীলতার দায়ে দন্ডিত হন কবি মলয় রায়চৌধুরী। এই দীর্ঘ কবিতায় তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অপশাসনের জন্য রাগের গন গনে আগুনে যেমন ফুঁসছেন; ঠিক তেমনি তাঁর ক্ষোভকে উগরে দিচ্ছেন মধ্যবৃত্তের ভন্ডামির দিকে। শ্লীলতার অশ্লীলতার সীমারেখা বলে সত্যি কি কিছু হয়? কবিতার মোটিভ যদি এমন শব্দের মধ্যে মানানসই হয় যা সমাজের ন্যাকা ভাবনায় অশ্লীল, তার দায় কবির নয়। প্রসঙ্গত চয়ণ করছি এই কবিতার কিছু অংশ। এই অংশগুলি প্রমান দেবে আমাদের বলতে চাওয়া বক্তব্যের সারবত্তাকে।
১. মা, তুমি আমায় কঙ্কা্ল রূপে ভূমিষ্ট করলে না কেন!
তাহলে আমি দুকোটি আলোক বর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
২. সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্ন ভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উতসব
৩. আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমার শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
৪. হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যু যৌন-পর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠ খেয়োখেয়ি।
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা পড়তে পড়তে অবাক হতে হয়, নিজেকে নিয়ে তিনি যেন শব ব্যবচ্ছেদের টেবিলে ছুঁরি কাঁচি হাতে চিরে চিরে দেখছেন ব্যবচ্ছেদি চিকিৎসকের মত। তা নয়তো কিভাবে এমন নিজের সমালোচনায় নিজে মগ্ন হতে পারছেন?
“আদালতের পেঙ্গুইনদের সাথে খেলা করে এলুম
আমার এই কাঁতরা চেহারা দেখে বুঝে নাও প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না”। ( কপর্দকহীনতা )
                                         শাসক ও শাসন যন্ত্র ভারতবর্ষের পক্ষে স্বাধীনতা লাভের পরেও কী ভয়ঙ্কর তা মলয়ের কবিতায় বারে বারে ধরা দিয়েছে। ‘লোহার রড’ নামে সেই প্রখ্যাত কবিতায় অনেকটা শ্লেষের সঙ্গেই তাই তিনি বলছেন-
“এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়ে
এক জোড়া পাকা চুল ধরে নিয়ে গেছে”। (লোহার রড)
মলয় রায়চৌধুরী পড়তে পড়তে তাঁর তীব্র শ্লেষের সাথে করমর্দনের বিষয়টি পাঠক হিসেবে আমি রসিয়ে রসিয়ে অনুভব করি। সমাজ নিয়মের বাঁধাধরা ছকের কোন বিষয় নিয়েই কি ব্যঙ্গই না তিনি করেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। যেমন একটি জায়গায় লিখছেন-
“এ দেশের শাসকদের বাঁধা লিউকোপ্লাস্ট মুখে বোবা থাকার অধিকার আমার আছে।
এ দেশের নেতাদের ফোঁপরা বক্তৃতা আর গালমন্দ শোনার অধিকার আমার আছে
এ দেশের অবোরোধকারীদের আটকানো পথে হার্টফেল করার অধিকার আমার আছে।
আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে বাংলা ভাষা আমার স্বদেশ নয়”। (আমার স্বদেশ)।
শব্দ ব্যবহার থেকে শুরু করে শব্দের অমূল্য প্রয়োগে মলয় রায়চৌধুরীকে মনে রাখতেই হবে। কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, চুর্মার-এভাবে নিজের মত করে প্রয়োগ যেমন করছেন। আবার তীক্ষ্ণ ফলার মত মেদহীন দু তিনটি শব্দে নিশানা করছেন পচে যাওয়া সিস্টেমকে। আসলে সিস্টেম হয়ে ওঠা নৈতিক-অনৈতিক পচা মূল্যবোধের ওপর তাঁর যত ক্রোধ। তাঁর যত অভিমান। একটি কবিতা তুলে আনছি এ প্রসঙ্গে-
“লেখা পায়। লিখি।।
খিদে পায়খাই।।
প্রেম পায়। করি।।
জ্বালা পায়। জ্বলি।।
নেশা পায়। গিলি।।
হাসি পায়। হাসি।।
ছোঁয়া পায়। ছুঁই।।
দেখা পায়। দেখি।।
রান্না পায়। রাঁধি।।
দান পায়। থুই।।
পড়া পায়। পড়ি।।
শোয়া পায়। শুই।।
হিসি পায়। মুতি।।
হাসি পায়। তুলি।।
ঘৃ্না পায়। করি।।
হাগা পায়। হাগি।।
হাঁচি পায়। হাঁচি।।
ব্যথা পায়। কাঁদি।।
পাদ পায়। পাদি।।
নাচ পায়। নাচি।।
গান পায়। গাই।।
                        শ্বাস পায়। হই।              (ইনসমলিয়া)।
কবিতাটি এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হলে অমোঘ সত্যটি বলা হত না। জীবনানন্দের নায়ক একা হতে হতে সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। তারপর লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন চিরদিনের মত। নির্বোধ পৃ্থিবীতে বোধযুক্ত মানুষের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখলেন ‘বোধ’। যেখানে নায়ক একা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হলেন সমাজ থেকে। এরপর হয়তো বা কবির মনে হয়েছিল বিচ্ছিন্নতার পরিনতি তবে কোথায়? কিসে? ফলে ‘বোধ’ এর উপসংহার লিখলেন ‘আট বছর আগের একদিন’ নামের কবিতায়। যেখানে সমাজবিছিন্ন মানুষটি আত্মহত্যা করে বিছিন্নতার যন্ত্রনা থেকে মুক্ত পেলেন। ‘ইনসমনিয়া’র শেষে এসে মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন-
“ঘুম পায় না।
 স্বপ্ন হয় না।।‌”
টি.এস.এলিয়টের সংলাপ নির্ভর অসমাপ্ত কবিতা- Fragment of an Agon-এ ডোরিস এবং সুইনির কথোপকথনের ভেতর আছে-
Sweeney-Birth, and copulation and death.
That’s all thats all, thats all,
Birth, and copulation and death.
Doris- I’d be bored,
Sweeney- You’d be bored,
birth, and copulation and death
Doris- I’d be bored.
Birth, and copulation and death
that’s all the facts when you come to brasstacks:
Birth, and copulation and death
I’ve been born, and once is enough.”
বর্তমানে চূড়ান্ত যান্ত্রিক জীবনযাপনের সময়ে অন্তিম আশ্রয় সম্ভবত- Life is Death
আলোচিত কবিতার ঘুম না আসা, স্বপ্ন না হওয়ার অর্থই সেই Life is Death এর দিকে এগিয়ে যাওয়া। ‘তুলকালাম আত্মহত্যা’ কবিতার একটি অংশে এই ভাবেই লিখছেন-
“এতকাল সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
যুক্তি ছিল সত্য
ঈশ্বর সত্য ছিল
অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
মুন্ডহীন দেহে দায়িত্ব রহিত চুমো
                   বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে”     (তুলকালাম আত্মহত্যা)
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় অকথ্য শব্দ প্রয়োগের ছুঁতমার্গ নেইশব্দ সেখানে আমার মনে হয় ব্রহ্ম হয়ে উঠেছে। যৌনতা এসেছে শিল্পের পোশাকে।
মলয় রায়চৌধুরীকে পড়লে আমাদের চিরকালীন নান্দনিক কাব্য বোধের দুয়ারে একটা ধাক্কা লাগে। কবিতার পূর্ন নুতন ভাষা যেন তিনিই সৃজন করলেন বাংলায়। ঠিক ঐতিহ্য বিরোধিতা নয়নিজের সময়ের উলঙ্গ বাস্তবতাকে তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করাই তাঁর স্বপ্ন। তাঁর প্রতিজ্ঞা। সনাতন কবিতা বোধের যাবতীয় বাগানকে মত্ত হাতির মত দলে পিষে এগিয়েছেন মলয়। অকথ্য ভাষা, মুখের ভাষা, সংখ্যা দিয়ে রেখার বিনির্মান, ছন্দকে তছনছ করে ছন্দ মুক্তির প্রয়াস, নৈরাজ্যের আবহাওয়া বুক চিতিয়ে সিস্টেমের বিরোধীতা এই সমস্ত মিলিয়ে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা কবিতার ব্যতিক্রমী পথিক। চয়ন করছি কথাগুলির সমর্থনে কিছু রেখা-
(১) পাজামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলেছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে    (প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার)
(২) বীর্য না থাকাটা একধরনের শৌর্য            (বং)
(৩) শ্রীনন্দর বয় ইয়ং ল্যাড কুরুকেড মাইন্ড হার্ড
কহে আর সি ডি বার্ড এ পেলাকারড কৃষ্ণকেলি
হাফ ইংলিশ হাফ বাঙ্গালি                       (এই রে)
(৪) আয়রে সেঁদো গর্ভদ্বারে জিত আমাদের
হবেই হবে লাৎখোররাই জেতে।
জীবনানন্দের পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতায় এক অর্থে নতুনের সন্ধান বন্ধ যখন, মলয় রায়চৌধুরীর মত ছুটন্ত ঘোড়ার প্রয়োজন ছিল বাংলা কাব্যের প্রয়োজনে। তিনি এসেছিলেন কোন এক ভাঙনের পথে। রুদ্ধ রাতের মতো স্থবির বাংলা কাব্যের আঙিনায় যোদ্ধার বেশে এসেছিলেন মলয়। চমকে উঠেছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রযন্ত্র। স্থিতধী পাঠক। কবিতা লেখার জন্য জেলে ঢোকানো হয়েছিল তাঁকে। দমানো যায়নি। ২০০৩ এ সেই রাষ্ট্রযন্ত্রই তাঁকে বাঁধতে চেয়েছিল অনুবাদ সাহিত্যে অকাডেমি পুরস্কার দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিতে চেয়েছিল লিটিল ম্যাগজিন পুরস্কার। প্রত্যাখান করেছেন মলয়। এ সাহস তিনিই করতে পারেনএ সাহস তাঁকেই মানায়। আজীবন সৈনিক তিনিআঘাতে ক্লান্ত নন। আদরে গলে পড়ার লোক নন। কবিতার তলোয়ারে ‘সিস্টেম’ নামক স্থবিরতাকে সুযোগ পেলেই আঘাত করেছেন। বাংলা কাব্যের এই কান্তিহীন সেনাপতি শিখিয়েছেন পালিয়ে বাঁচার থেকে নখ দাঁত বের করে প্রতিপক্ষকে আক্রমন করার নামই জীবন। অকথ্য ভাষায় হোক আর
যৌনতার খুল্লামখুল্ল প্রয়োগেই হোক-রাষ্ট্র স্থবির হলে কবি সেনাপতি জেগে আছেন আঘাতে আঘাত করে আধ মরাদের বাঁচাতে।



তথ্যসূত্রঃ
(১)প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি- মলয় রায়চৌধুরী
(২)হাংরি আন্দোলন- উইকিপিডিয়া
(৩)হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্র বিরোধী আন্দোলনঃ ড. উত্তম দাশ
(৪)হাওয়া ৪৯- মলয় রায়চৌধুরী
(৫)অবহকাল।- মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যা ২০০৩। সম্পাদনা- রতন কুমার বিশ্বাস।
(৬) মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ২০০৪-১৯৬১। আবিষ্কার প্রকাশনী।

****************

পার্থ চট্টোপাধ্যায়
গ্রাম+ডাকঃ জিরাট
জেলাঃ হুগলী
সূচক ৭১২৫০১





















No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...