বন্ধুবর
বাসব রায় পর-পর তাঁর দুটি পোস্টে জামিল, মলয় এবং বিশেষত গিন্সবার্গের
জিগির তুলে আমায় উস্কে দিলেন কিছু লিখতে, বিশেষত সেই গিন্সবার্গ বিষয়ে।
যদি বলি মার্কিন দেশের যীশু অ্যালেন গিন্সবার্গ, অতিরেক হলো কি? বুদ্ধের
আবির্ভাবের মতোই আশ্চর্য কবিতাক্ষেত্রে তাঁর আগমন। আশ্চর্য, কেননা তিনি
জন্মেছিলেন ---- তৃতীয় বিশ্বের কোন খোঁড়া দেশে নয়, ---- আমেরিকায়।
এরিস্টটল থেকে এ অব্দি 'কাব্যাত্মক ন্যায়' নিয়ে বড়ফড়াঙ্গি চলে আসছে, কেউ কি
ভেবেছেন সাহিত্য-ব্যাপারে একটা 'অন্যায়'ও দগদগ করে পাশাপাশি? যাঁরা
গেঁতো, 'স্থা'-বাসী, তাঁরা কিছুতেই কবুল করেন না যে সমাজের সর্বস্থানে
যেরকম অশুভ ও অশুদ্ধতা চলছে, সেখানে সাহিত্যেও আর 'শুভ' বা 'শুদ্ধতা' আশা
করা যায় না। বাসববাবু ঠিকই বলেছেন, যাঁরা আজ সত্যিকারের সৃষ্টিশীল সাহিত্য
করছেন, খেয়াল করবেন শব্দের ব্যবহার, ডিসকোর্স, সংকেত, প্রতীক, চিত্রকল্পে
তাঁরা আমূল-চুল বদল ঘটিয়ে ফেলেছেন, বা তাঁরা সেই বদলের পক্ষপাতি। এই যে
স্থা-বিরোধিতা, বা প্রতিষ্ঠানবিরুদ্ধতা, এটা আসলে একটা আবহমান লড়াই। 'যা
চলছে' আর 'যা হওয়া উচিত'-এর নিরন্তর নিরলস সংগ্রাম। যা খদ্দরী
প্রজাতন্ত্র, খাঁকি মিলিটারিতন্ত্র, লাল-কম্যুনিস্টতন্ত্র বা তিমূলতন্ত্রের
কাছে তুমুল অবাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত ধ্বনি। আর সেখানে, সেই ওয়াশিংটনের কথাই
বলছি, কবিতা নয় ---- রয়েছে একটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক বেনিয়া কনসেপশন, যা
বিশ্ব-রাজনীতিকে জমা-খরচের নিক্তিতে পরখ করে বাজারে ছাড়ে। সম্ভবত এই
কারণেই আমেরিকা ভালো কবিকে জন্ম দিয়েছে খুব কম। ওয়ালেস স্টিউইংসের
দেহরক্ষার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর লেখনজগতে একা গিন্সবার্গই সেই বিরল
অস্তিত্ব, 'হাউল'-সূত্রে বারংবার উচ্চারিত যাঁর নাম।
মহাকবি গিন্সবার্গ সম্পর্কে প্রথম পড়ি মলয় রায়চৌধুরীর বদান্যে। অতঃপর আমার জেএনইউ-প্রোডাক্ট সাংবাদিক বন্ধু পলাশ বিশ্বাসের মুখে, বিশদে। জানতে পারি, প্রতিভাবান, মেধাস্পৃহ এই হীরে বাঙালির জ্ঞানের আলোয় আসেন, তাঁর উত্তরণের যখন সবে হাতেখড়ি, প্রায় তার সমসময়ে। প্রায় আড়াই দশক ধরে তাঁর সঙ্গে বাঙালির সবিমুগ্ধ আলাপচারিতা। বহির্বিশ্বে একমাত্র বাঙালিকেই তিনি পেয়েছিলেন একান্ত আপন করে। অনেক বসন্ত দেখেছিল বাঙালি তাঁর পাশাপাশি ---- বন্ধুত্বের অনাবিল আনন্দে।
বাঙালির খ্যাপামিই সেই অমোঘ সূত্র-রজ্জু যে-কারণে গিন্সবার্গকে বাঙালি টানতে পেরেছিল। পাগলামি বা খ্যাপামি বাঙালির মজ্জাগত। জীবনের প্রত্যেক অংশে প্রত্যেক বাঙালিই কোনো না কোনভাবে আকুলতায় জড়িয়ে আছে। এই পাগলামি আসলে সেই সাধনা সেই সব্বনেশে প্রেম সেই প্যাশন যা এক সৃষ্টির থেকে আরেক সৃষ্টির পানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথকে, এক আরম্ভের থেকে আরেক আরম্ভের দিকে ছোটায় বিনয় মজুমদারকে, এক মানুষের থেকে আরেক মানুষের দিকে ঠেলে দেয় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। বাঙালির বেঁচে থাকার অবলম্বনই এই পাগলামি। ইন্টার-ডিসিপ্লিনারির চতুরন্ত টপকে বাঙালি এখন সারা বিশ্বের উঠোন দাপাচ্ছে। রাজনীতি, খেলার মাঠ, সাহিত্য, সিনেমা, গান, বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, চতুর্দিকে বাঙালির ধুমা অ্যাটাক। সর্বত্র তার বুম্বাচাক! থিওরি অব কেঅস। যুক্তিভাঙার নেশামাত্রে মন মানছে না বাঙালির। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। হয়ে যাক পাগলামির নতুন দখলতি। হুররে!
মার্কিন খ্যাপাদের সূচি শুরু হয়েছে সম্ভবত গিন্সবার্গের নাম দিয়ে। কী খ্যাপামিতে কী কবিত্বে তাঁর আমোঘতা পরম নিন্দুকেও স্বীকার করেন। শরৎ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, "একদিন খবর পাওয়া গেল, দু'জন আমেরিকান কবি কলকাতায় এসেছে। .... গিয়ে দেখি, প্রায় আসবাবহীন একখানা ঘরে দু'জন সাহেব এসেছে সত্যি। তাদের একজন থুপথুপ করে কাপড় কাচছে কলঘরে, অন্যজন ছুরিতে তরিতরকারি কুটছে। পরনে আন্ডারওয়্যার, খালি গা ....।" ইনিই অ্যালেন গিন্সবার্গ। নামটির সঙ্গে ল্যাজেমুড়ে জুড়ে রয়েছে 'বিট' কথাটা। ভিড়ের মধ্যেও বিটবংশকে শনাক্ত করা দুষ্কর নয়। "মেয়েরা পরে কালো মোজা, লম্বা চুল রাখে, লিপস্টিক মাখে না, আর পুরুষেরা রাখে দাড়ি আর ঘাড় বেয়ে নামা লম্বা চুল, তীব্রতম শীত ছাড়া টুপি কিংবা ওভারকোট পরে না; জামা জুতো বা দেহের পরিছন্নতা-সাধন তাদের হিসেবে অনাচার।" (বুদ্ধদেব বসু) এই বংশের আদি কবি জ্যাক কেরুয়াক। অ্যালেনের, অর্থাৎ কেরুয়াকের পরেই যাঁর স্থান এবং যিনি এই উন্মুখর আন্দোলনের স্রষ্টা, তিনি মোটেও লম্বা ছিলেন না, বরং যথেষ্টই বেঁটের দিকে, ছিপছিপে শরীর, গায়ের কালার হলদে ঘেঁষা ম্লান, চোখে চশমা, নেহাৎ 'ভদ্রলোকে'র মতোই দাড়িগোঁফ কামানো, পরিষ্কার সিঁথি-কাটা চুল কিন্তু মাথা নোয়ালে অল্প টাক। অর্থাৎ চেহারায় শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ একটিও নেই, যদিও পালিশহীন জুতো, ইস্ত্রিহীন প্যান্ট আর গলা-খোলা কোর্তায় গোষ্ঠি-চেতনার ছাপ স্পষ্ট। ---- এই হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ।
কিন্তু একটা কথা। গিন্সের সঙ্গে 'বিট' লেবেলটা সাঁটা থাকলেও, তিনি কিন্তু একেবারে আলাদা খাতের কবি। কোন নির্দিষ্ট খেপের মোহর দেগে তাঁকে চালানো যায় না। গিন্সবার্গের শেষ দিকের কবিতাগুলো দেখলে মনে হবে তিনি বিট কবিই নন, বরং আপাত বিটতন্ত্র-বিরোধী। আসলে, একটা 'হুজুগ' হিশেবে সূচনা ঘটেছিল বিট-আন্দোলনের। এবং ফেরলিংগোট্টি থেকে শুরু করে কেরুয়াক, গিন্সবার্গ এবং গ্রেগরি করসো প্রমুখ ব্যতিরেকেও হাঙ্গামার কাল জুড়ে ছিলেন কামিংস, মিলার, নরমান, গুডম্যান প্রমুখ। আন্দোলন ষাট দশকের পয়লাভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল বার্লিন, পারি, কোপেনহেগেন প্রভৃতিতে। এবং যদি বলা বেশি না ঠেকে, বলতে পারি, তারই একটা ঢেউ গিন্সবার্গ ও তাঁর সগোত্ররা এনে আছড়েছিলেন বাংলা কবিতার তটভূমিতে, হাংরি আন্দোলন যার অনিবার্য বাই-প্রোডাক্ট। যাই হোক, এখানে বলার কথা, বিট-আদর্শ ও বিট-ধর্মের মিল কোন-কোন ক্ষেত্রে, গিন্সবার্গের কবিতায়, নেই-ই। গিন্স শেষবয়সে বুঝেছিলেন, হিটলার ব'নে পুরো গ্লোবটাকে দাপানো সহজ, কিন্তু 'আজ' (সেই বিশ শতকের শেষপাদে) 'রিভোল্ট' করে সফল হবার সুযোগ নেই। তাই, বিট পোয়েট্রি বলতেই যে দুরন্ত বেলাগাম গতির কথা মনে পড়ে, যিনি খোদ বিট আন্দোলনকে এইভাবে পরিচিত করেছিলেন এবং হাঙ্গামাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ---- সেই গিন্সবার্গের দুরন্ত প্রবহমান জীবনস্রোতের মধ্যবর্তী বিন্দুতে দণ্ডায়মান থেকেও, শেষাবধি মনে হয়েছে :
"... all movement stops
and I walk in the timeless sadness of existence,
Tenderness flowing three the buildings
My fingertips touching reality's face."
গিন্সবার্গ ছিলেন রাজনীতিক চেতনার মানুষ। এবং সেক্ষেত্রে কোনরকম আপোষের তেল গায়ে মাখেন নি। তাঁর সাফ কথা : "রাজনীতির কর্কশা ছবির মধ্যে কোথাও না কোথাও তার একটা মুদ্রা এমন আছেই, যেখানে স্রেফ কবিতা, কবিতা আর কবিতাই কামান দাগতে পারে।" এই চেতনা থেকেই তিনি, মার্কিন গবরমেন্টের বিখ্যাত কাস্টমস বিল্ডিংয়ের বলতে গেলে পাশেই অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সভাগারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পাঠ করেন তাঁর কবিতা :
"স্বর্গ যদি হয় তবে ঠিক এইরকম ---
উচ্চ আদালতে থাকবে না কোন বুদ্ধ
না রিপাবলিকান, না ডেমোক্র্যাট ..."
মৃত্যুর আগে একদশক তিনি কবিতায় টার্গেট করেছিলেন হোয়াইট হাউসকে। সেই হোয়াইট হাউস, যেখানে রয়েছে সিআইএ-র বাজেট, জার্মান মাথাব্যথা, সৈন্যদের লুকোনো দূরভাষী যন্ত্র আর এফবিআই-এর ছারপোকা। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের গুঁজে দেয়া পিলপিলে বিষয়টাকে 'রাবণ' ঘোষণা করে আমেরিকান প্রয়াসকে নাম দিয়েছিলেন 'রেগনের থিইস্টিক প্যারোনিয়া'। এহেন সাহস আর কোনও আমেরিকান কবির ছিল কি?
বিদ্রোহ করেছিলেন গিন্সবার্গ, কিন্তু বিদ্রোহই তাঁকে 'প্রতিষ্ঠিত' করে ফেলল। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে 'হাউলে'র। আড়াইশোর বেশি ডলার ঢুকেছে ফি মাসে, তাঁর পকেটে। এখনো 'বিদ্রোহী' বলা যাবে কি তাঁকে? অথচ তিনি আজও আমাদের নমস্য। নমস্য ও শ্রদ্ধেয় তাঁর অনন্য মানব-কবিতার কারণে। এই সেই কবি যিনি শোনাতে পারেন :
"I saw the best minds of my generation destroyed
by madness, starving hysterical naked." (Howl)
"A bitter cold winter night
Conspirators at cafe tables
discussing mystic jails."
(Planet News)
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বম্ব ফাবড়ানো হলে তিনি কি 'গান্ধীবাবা'র ভূমিকায় নেমেছিলেন? যদ্দূর শুনেছি, তিনি তখন থেকেই 'হোলিম্যান'। এমনিতে মার্কিন দেশে হোলিম্যান হওয়াটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তামাম কলপূর্যা তো তেনাদেরই হাতে। ওঁরা সেই 'পাওয়া' আর 'ভোগে'র যথেচ্ছাচার থেকে রেহাই পেতে হোলিম্যান হতেই পারেন। কিন্তু না, অ্যালেন ওঁদের দলে নন। 'রিয়ালিটি স্যান্ডউইচেস' (১৯৬৩) থেকে শুরু করে হারপার অ্যান্ড রো প্রকাশিত তাঁর '৪৭ থেকে '৮০ সন অব্দি লেখা তাঁর সমস্ত কবিতা সংগ্ৰহ, তাঁর জার্নাল, চিঠিপত্র আর ক্যাসেটবন্দী সাক্ষাৎকার অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে শাস্ত্রীয় সভাগারে তাঁর মত ব্রাত্যজন জন্মেছেন খুব কমই।
বুদ্ধ, চৈতন্য আর রামকৃষ্ণর ভারতভূমিতে বাষট্টি সাল নাগাদ অ্যালেন, তাঁর বন্ধু পিটার অৱলভস্কিকে সঙ্গে নিয়ে, 'ঈশ্বর' খুঁজতে আসেননি। অধিকন্তু, এই ভাষাদেশের মরচে পড়া মানুষগুলোকে একটু চনমনিয়ে দেবার ঘোর সদিচ্ছা নিমতলা শ্মশানঘাট, খালাসিটোলা, চাইবাসা আর কাশীর পথে ঘাটে মাঠে ঘুরিয়ে মেরেছে তাঁকে। একটা কিছু গড়ে তোলার ছটফটানি তাঁকে তিষ্টতে দেয়নি একদণ্ডও। মানুষের জীবনটা দিশা না পেয়ে পুরো ভগ্নস্তূপে বদলে যাওয়ার আগেই তিনি সেটা চাইছিলেন। এটাও স্বীকার করা ভালো, যে, অ্যালেন বা বিট মানেই 'তছনছ' 'ডিস্টার্ব' 'ডেস্ট্রয়' বা 'নিছক যৌনতা' নয়। কেননা তিনি জানতেন কামশাস্ত্র-কোকশাস্ত্র সহ বাংলা ভাষায় বহু সুড়সুড়িবিদ প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের বইয়ের গরুর গাড়ি বোঝাই সংস্করণ বাজারে গিজগিজ করছে। তিনি যে সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ঝড় বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন ---- 'হাউল' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই 'কৃত্তিবাসে'র সেই সংখ্যাটা (১৯৬৩, মার্চ), গিন্সবার্গের তোলা একটি ফোটোগ্রাফ ব্লক করে ছাপা হয়েছিল যাতে। ছবিটা অ্যালেনের শুধু হাত নয়, চোখ মাত্র নয়, মনেরও যুৎসই ছাপ ফুটে উঠেছিল। দোমড়ানো জীর্ণ একটি ফ্রকপরা মেয়ের ---- যাকে নিয়ে ব্যবসা চালানো হচ্ছে ---- আধশোয়া আধন্যাংটো ছবি। কভারে বোল্ড হরফে 'কৃত্তিবাস' এমত ঘোষণা করতে পেছপা হয়নি, যে, "তীব্র উদাসীন উন্মত্ত ধীমান ক্রুদ্ধ সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত শান্ত বীটনিক ভয়ংকর মগ্ন চতুর সৎ ভূতগ্রস্ত ধার্মিক ও অতৃপ্ত কবিদের ব্যক্তিগত রচনা, কবিতা ও বিস্ফোরণ।" বলা বেশি, ওই সংকলনেই কৃত্তিবাসের লেখক-কবিরা পহেলি-বার, যাকে বলে, মুখ খুললেন। মুখ খোলালেন মহাকবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।
মহাকবি গিন্সবার্গ সম্পর্কে প্রথম পড়ি মলয় রায়চৌধুরীর বদান্যে। অতঃপর আমার জেএনইউ-প্রোডাক্ট সাংবাদিক বন্ধু পলাশ বিশ্বাসের মুখে, বিশদে। জানতে পারি, প্রতিভাবান, মেধাস্পৃহ এই হীরে বাঙালির জ্ঞানের আলোয় আসেন, তাঁর উত্তরণের যখন সবে হাতেখড়ি, প্রায় তার সমসময়ে। প্রায় আড়াই দশক ধরে তাঁর সঙ্গে বাঙালির সবিমুগ্ধ আলাপচারিতা। বহির্বিশ্বে একমাত্র বাঙালিকেই তিনি পেয়েছিলেন একান্ত আপন করে। অনেক বসন্ত দেখেছিল বাঙালি তাঁর পাশাপাশি ---- বন্ধুত্বের অনাবিল আনন্দে।
বাঙালির খ্যাপামিই সেই অমোঘ সূত্র-রজ্জু যে-কারণে গিন্সবার্গকে বাঙালি টানতে পেরেছিল। পাগলামি বা খ্যাপামি বাঙালির মজ্জাগত। জীবনের প্রত্যেক অংশে প্রত্যেক বাঙালিই কোনো না কোনভাবে আকুলতায় জড়িয়ে আছে। এই পাগলামি আসলে সেই সাধনা সেই সব্বনেশে প্রেম সেই প্যাশন যা এক সৃষ্টির থেকে আরেক সৃষ্টির পানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথকে, এক আরম্ভের থেকে আরেক আরম্ভের দিকে ছোটায় বিনয় মজুমদারকে, এক মানুষের থেকে আরেক মানুষের দিকে ঠেলে দেয় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। বাঙালির বেঁচে থাকার অবলম্বনই এই পাগলামি। ইন্টার-ডিসিপ্লিনারির চতুরন্ত টপকে বাঙালি এখন সারা বিশ্বের উঠোন দাপাচ্ছে। রাজনীতি, খেলার মাঠ, সাহিত্য, সিনেমা, গান, বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, চতুর্দিকে বাঙালির ধুমা অ্যাটাক। সর্বত্র তার বুম্বাচাক! থিওরি অব কেঅস। যুক্তিভাঙার নেশামাত্রে মন মানছে না বাঙালির। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। হয়ে যাক পাগলামির নতুন দখলতি। হুররে!
মার্কিন খ্যাপাদের সূচি শুরু হয়েছে সম্ভবত গিন্সবার্গের নাম দিয়ে। কী খ্যাপামিতে কী কবিত্বে তাঁর আমোঘতা পরম নিন্দুকেও স্বীকার করেন। শরৎ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, "একদিন খবর পাওয়া গেল, দু'জন আমেরিকান কবি কলকাতায় এসেছে। .... গিয়ে দেখি, প্রায় আসবাবহীন একখানা ঘরে দু'জন সাহেব এসেছে সত্যি। তাদের একজন থুপথুপ করে কাপড় কাচছে কলঘরে, অন্যজন ছুরিতে তরিতরকারি কুটছে। পরনে আন্ডারওয়্যার, খালি গা ....।" ইনিই অ্যালেন গিন্সবার্গ। নামটির সঙ্গে ল্যাজেমুড়ে জুড়ে রয়েছে 'বিট' কথাটা। ভিড়ের মধ্যেও বিটবংশকে শনাক্ত করা দুষ্কর নয়। "মেয়েরা পরে কালো মোজা, লম্বা চুল রাখে, লিপস্টিক মাখে না, আর পুরুষেরা রাখে দাড়ি আর ঘাড় বেয়ে নামা লম্বা চুল, তীব্রতম শীত ছাড়া টুপি কিংবা ওভারকোট পরে না; জামা জুতো বা দেহের পরিছন্নতা-সাধন তাদের হিসেবে অনাচার।" (বুদ্ধদেব বসু) এই বংশের আদি কবি জ্যাক কেরুয়াক। অ্যালেনের, অর্থাৎ কেরুয়াকের পরেই যাঁর স্থান এবং যিনি এই উন্মুখর আন্দোলনের স্রষ্টা, তিনি মোটেও লম্বা ছিলেন না, বরং যথেষ্টই বেঁটের দিকে, ছিপছিপে শরীর, গায়ের কালার হলদে ঘেঁষা ম্লান, চোখে চশমা, নেহাৎ 'ভদ্রলোকে'র মতোই দাড়িগোঁফ কামানো, পরিষ্কার সিঁথি-কাটা চুল কিন্তু মাথা নোয়ালে অল্প টাক। অর্থাৎ চেহারায় শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ একটিও নেই, যদিও পালিশহীন জুতো, ইস্ত্রিহীন প্যান্ট আর গলা-খোলা কোর্তায় গোষ্ঠি-চেতনার ছাপ স্পষ্ট। ---- এই হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ।
কিন্তু একটা কথা। গিন্সের সঙ্গে 'বিট' লেবেলটা সাঁটা থাকলেও, তিনি কিন্তু একেবারে আলাদা খাতের কবি। কোন নির্দিষ্ট খেপের মোহর দেগে তাঁকে চালানো যায় না। গিন্সবার্গের শেষ দিকের কবিতাগুলো দেখলে মনে হবে তিনি বিট কবিই নন, বরং আপাত বিটতন্ত্র-বিরোধী। আসলে, একটা 'হুজুগ' হিশেবে সূচনা ঘটেছিল বিট-আন্দোলনের। এবং ফেরলিংগোট্টি থেকে শুরু করে কেরুয়াক, গিন্সবার্গ এবং গ্রেগরি করসো প্রমুখ ব্যতিরেকেও হাঙ্গামার কাল জুড়ে ছিলেন কামিংস, মিলার, নরমান, গুডম্যান প্রমুখ। আন্দোলন ষাট দশকের পয়লাভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল বার্লিন, পারি, কোপেনহেগেন প্রভৃতিতে। এবং যদি বলা বেশি না ঠেকে, বলতে পারি, তারই একটা ঢেউ গিন্সবার্গ ও তাঁর সগোত্ররা এনে আছড়েছিলেন বাংলা কবিতার তটভূমিতে, হাংরি আন্দোলন যার অনিবার্য বাই-প্রোডাক্ট। যাই হোক, এখানে বলার কথা, বিট-আদর্শ ও বিট-ধর্মের মিল কোন-কোন ক্ষেত্রে, গিন্সবার্গের কবিতায়, নেই-ই। গিন্স শেষবয়সে বুঝেছিলেন, হিটলার ব'নে পুরো গ্লোবটাকে দাপানো সহজ, কিন্তু 'আজ' (সেই বিশ শতকের শেষপাদে) 'রিভোল্ট' করে সফল হবার সুযোগ নেই। তাই, বিট পোয়েট্রি বলতেই যে দুরন্ত বেলাগাম গতির কথা মনে পড়ে, যিনি খোদ বিট আন্দোলনকে এইভাবে পরিচিত করেছিলেন এবং হাঙ্গামাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ---- সেই গিন্সবার্গের দুরন্ত প্রবহমান জীবনস্রোতের মধ্যবর্তী বিন্দুতে দণ্ডায়মান থেকেও, শেষাবধি মনে হয়েছে :
"... all movement stops
and I walk in the timeless sadness of existence,
Tenderness flowing three the buildings
My fingertips touching reality's face."
গিন্সবার্গ ছিলেন রাজনীতিক চেতনার মানুষ। এবং সেক্ষেত্রে কোনরকম আপোষের তেল গায়ে মাখেন নি। তাঁর সাফ কথা : "রাজনীতির কর্কশা ছবির মধ্যে কোথাও না কোথাও তার একটা মুদ্রা এমন আছেই, যেখানে স্রেফ কবিতা, কবিতা আর কবিতাই কামান দাগতে পারে।" এই চেতনা থেকেই তিনি, মার্কিন গবরমেন্টের বিখ্যাত কাস্টমস বিল্ডিংয়ের বলতে গেলে পাশেই অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সভাগারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পাঠ করেন তাঁর কবিতা :
"স্বর্গ যদি হয় তবে ঠিক এইরকম ---
উচ্চ আদালতে থাকবে না কোন বুদ্ধ
না রিপাবলিকান, না ডেমোক্র্যাট ..."
মৃত্যুর আগে একদশক তিনি কবিতায় টার্গেট করেছিলেন হোয়াইট হাউসকে। সেই হোয়াইট হাউস, যেখানে রয়েছে সিআইএ-র বাজেট, জার্মান মাথাব্যথা, সৈন্যদের লুকোনো দূরভাষী যন্ত্র আর এফবিআই-এর ছারপোকা। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের গুঁজে দেয়া পিলপিলে বিষয়টাকে 'রাবণ' ঘোষণা করে আমেরিকান প্রয়াসকে নাম দিয়েছিলেন 'রেগনের থিইস্টিক প্যারোনিয়া'। এহেন সাহস আর কোনও আমেরিকান কবির ছিল কি?
বিদ্রোহ করেছিলেন গিন্সবার্গ, কিন্তু বিদ্রোহই তাঁকে 'প্রতিষ্ঠিত' করে ফেলল। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে 'হাউলে'র। আড়াইশোর বেশি ডলার ঢুকেছে ফি মাসে, তাঁর পকেটে। এখনো 'বিদ্রোহী' বলা যাবে কি তাঁকে? অথচ তিনি আজও আমাদের নমস্য। নমস্য ও শ্রদ্ধেয় তাঁর অনন্য মানব-কবিতার কারণে। এই সেই কবি যিনি শোনাতে পারেন :
"I saw the best minds of my generation destroyed
by madness, starving hysterical naked." (Howl)
"A bitter cold winter night
Conspirators at cafe tables
discussing mystic jails."
(Planet News)
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বম্ব ফাবড়ানো হলে তিনি কি 'গান্ধীবাবা'র ভূমিকায় নেমেছিলেন? যদ্দূর শুনেছি, তিনি তখন থেকেই 'হোলিম্যান'। এমনিতে মার্কিন দেশে হোলিম্যান হওয়াটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তামাম কলপূর্যা তো তেনাদেরই হাতে। ওঁরা সেই 'পাওয়া' আর 'ভোগে'র যথেচ্ছাচার থেকে রেহাই পেতে হোলিম্যান হতেই পারেন। কিন্তু না, অ্যালেন ওঁদের দলে নন। 'রিয়ালিটি স্যান্ডউইচেস' (১৯৬৩) থেকে শুরু করে হারপার অ্যান্ড রো প্রকাশিত তাঁর '৪৭ থেকে '৮০ সন অব্দি লেখা তাঁর সমস্ত কবিতা সংগ্ৰহ, তাঁর জার্নাল, চিঠিপত্র আর ক্যাসেটবন্দী সাক্ষাৎকার অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে শাস্ত্রীয় সভাগারে তাঁর মত ব্রাত্যজন জন্মেছেন খুব কমই।
বুদ্ধ, চৈতন্য আর রামকৃষ্ণর ভারতভূমিতে বাষট্টি সাল নাগাদ অ্যালেন, তাঁর বন্ধু পিটার অৱলভস্কিকে সঙ্গে নিয়ে, 'ঈশ্বর' খুঁজতে আসেননি। অধিকন্তু, এই ভাষাদেশের মরচে পড়া মানুষগুলোকে একটু চনমনিয়ে দেবার ঘোর সদিচ্ছা নিমতলা শ্মশানঘাট, খালাসিটোলা, চাইবাসা আর কাশীর পথে ঘাটে মাঠে ঘুরিয়ে মেরেছে তাঁকে। একটা কিছু গড়ে তোলার ছটফটানি তাঁকে তিষ্টতে দেয়নি একদণ্ডও। মানুষের জীবনটা দিশা না পেয়ে পুরো ভগ্নস্তূপে বদলে যাওয়ার আগেই তিনি সেটা চাইছিলেন। এটাও স্বীকার করা ভালো, যে, অ্যালেন বা বিট মানেই 'তছনছ' 'ডিস্টার্ব' 'ডেস্ট্রয়' বা 'নিছক যৌনতা' নয়। কেননা তিনি জানতেন কামশাস্ত্র-কোকশাস্ত্র সহ বাংলা ভাষায় বহু সুড়সুড়িবিদ প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের বইয়ের গরুর গাড়ি বোঝাই সংস্করণ বাজারে গিজগিজ করছে। তিনি যে সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ঝড় বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন ---- 'হাউল' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই 'কৃত্তিবাসে'র সেই সংখ্যাটা (১৯৬৩, মার্চ), গিন্সবার্গের তোলা একটি ফোটোগ্রাফ ব্লক করে ছাপা হয়েছিল যাতে। ছবিটা অ্যালেনের শুধু হাত নয়, চোখ মাত্র নয়, মনেরও যুৎসই ছাপ ফুটে উঠেছিল। দোমড়ানো জীর্ণ একটি ফ্রকপরা মেয়ের ---- যাকে নিয়ে ব্যবসা চালানো হচ্ছে ---- আধশোয়া আধন্যাংটো ছবি। কভারে বোল্ড হরফে 'কৃত্তিবাস' এমত ঘোষণা করতে পেছপা হয়নি, যে, "তীব্র উদাসীন উন্মত্ত ধীমান ক্রুদ্ধ সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত শান্ত বীটনিক ভয়ংকর মগ্ন চতুর সৎ ভূতগ্রস্ত ধার্মিক ও অতৃপ্ত কবিদের ব্যক্তিগত রচনা, কবিতা ও বিস্ফোরণ।" বলা বেশি, ওই সংকলনেই কৃত্তিবাসের লেখক-কবিরা পহেলি-বার, যাকে বলে, মুখ খুললেন। মুখ খোলালেন মহাকবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।
No comments:
Post a Comment