( হাংরি আন্দোলন বিষয়ে জারা মাস্টকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, বাঁদিকে বসে আছেন )
ছয়ের দশক । নেহেরুর দ্বিতীয় যোজনা অনেকটা সরে গেছে বোম্বাই মডেলের দিকে । ঔপনিবেশিক খেসারত দিতে ভারত-চিন যুদ্ধ । ভারত পাকিস্তন যুদ্ধ । স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখি, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, উত্তরঔপনিবেশিক ভারতে তা সেই সেময় দিশা হারিয়েছে । বাংলা সাহিত্যে তখন মূল ধারা দুটি । একটি বুদ্ধদেব বসু, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, কবিতা সিংহ, শতভিষা নামক পত্রিকাসহ খ্যাতির মধ্যগগনে । অন্য ধারাটি বামপন্হী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু প্রমুখরা । এই সময়কালে সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভাব হলো হাংরি আন্দোলনকারীদের । যা খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, নেতৃত্ব দিলেন মলয় রায়চৌধুরী নামের একুশ বছরের যুবক । কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাবুরা ইস্তাহার দেখেছে ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনে, রাজনৈতিক দলে । তা বলে সাহিত্য আন্দোলনে ইস্তাহার বিলি করে ! ভাবগতিক দেখে নড়ে চড়ে বসলেন প্রাতিষ্ঠানিক কবি-সাহিত্যিকের দল । প্রতিটি বিষয়ের ওপর হাংরি আন্দোলনকরীদের আলাদা আলাদা ইস্তাহার ছিল । সাহিত্য বিষয়ক প্রথম ইস্তাহারটি লেখা হয় ইংরেজিতে, প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে । কারণ সেটির রচয়িতা মলয় রায়চৌধুরী পাটনার বাসিন্দা, সেখানে কোনো বাংলা প্রেস নেই । পরে ১৯৬২ সালের এপ্রিলে বাংলায় ইস্তাহার প্রকাশিত হয় । ক্রিয়েটর মালয় রায়চৌধুরী, লিডার উল্টোডাঙা বস্তিতে সেই সময়ে বাস করা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ও সম্পাদক হাওড়ার এক বস্তিবাসী হারাধন ধাড়া ( দেবী রায় ) । কী ছিল সেই ইস্তাহারে ?
Haradhan Dhara with his wife and parents সেই ইস্তাহার ছিল এই রকম : মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র পরাজিত । কবিতাই এখন একামাত্র আশ্রয় । এখন প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন অনর্থ বের করা । চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নেবে কবিতা । শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার চালাকি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবল ল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানানোর কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফূর্তিতে । অন্তরজগতের নিষ্কুন্ঠ বিদ্রোহ, অন্তরাত্মার নিদারুণ বিরক্তি, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রচিত হবে কবিতা । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক বা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতন অনুন্মেষিনী হয়ে যেতে পারে ।
Subimal Basak with his wife and son সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ল হাংরি আন্দোলন । একে একে এসে যোগ দিলেন বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, বাসিদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, রবিউল, শম্ভু রক্ষিত, তপন দাশ, এবং আরও অনেকে । তখনকার প্রচলিত রীতি মানেননি হাংরিরা, তাঁদের কোনো সম্পাদকীয় দপতর বা হেড কোয়ার্টার ছিল না। যে যার মতো করে ফালি কাগজে বুলেটিন বার করত, খরচ দিতেন মলয় এবং সমীর । পত্রিকাগুলোর নামও ছিল একেবারে ভিন্ন, স্বকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জেব্রা, জিরাফ, প্রতিদ্বন্দ্বী, উন্মার্গ, ওয়েস্ট পেপার, ধৃতরাষ্ট্র, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি । প্রকাশিত বুলেটিনগুলি কফি হাউসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংবাদপত্র দপতরে, কলেজে হাতে হাতে বিলি করা হতো ।
Some members of Hungry Andolon in 1964 হাংরি আন্দোলন বহিরাগত এমন তকমা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা দল বাঁধতে লাগলেন ভিতরে ভিতরে । শক্তি চট্টোপধ্যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে 'সীমান্ত পপস্তাব' কবিতায় লিখলেন :
"কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছেনা
যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে ? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে
তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?"
আগুনের মতো সব লেখা বেরিয়ে আসছে । নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিক, ঝরঝরে গদ্য, তথাকথিত অশ্লীল ও যৌনশব্দের মিশেল, একবার পড়লে আর একটা পড়তে ইচ্ছা হবে । গ্রন্হ প্রকাশিত হতে লাগল আন্দোলনকারীদের । শৈলেশ্বর ঘোষের 'জন্মনিয়ন্ত্রণ', সুভাষ ঘোষের 'আমার চাবি', 'যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট', ফালগুনী রায় লিখলেন 'নষ্ট আত্মার টেলিভিশন', বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখলেন, 'রন্ধনশালা', সুবিমল বসাক লিখলেন 'ছাতামাথা', মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন 'শয়তানের মুখ', ত্রিদিব মিত্র লিখলেন 'হত্যাকাণ্ড', প্রদীপ চৌধুরী লিখলেন 'চৌষট্টি ভুতের খেয়া', আরও অনেকের লেখা বই ।
আঁকার জগতে প্রসারিত হল হাংরি ভাবধারা । যোগ দিলেন অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । মাত্র সাতাশ বছর বয়সে অনিল করঞ্জাই দিল্লির ললিতকলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কলকাতায় আন্দোলনের ধারা ঝড় তুলেছে । বিভিন্ন জীবজন্তু, জোকার, রাক্ষস, দেবতার মুখোশ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, কবি, লেখক, সাংবাদিক, সরকারি আধিকারিকদের পাঠিয়ে বল হলো 'দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন' । পত্রিকার দপতরে বাচ্চাদের চটির বাক্স পাঠিয়ে বলা হলো রিভিউ করতে । নিমতলা শ্মশানঘাট, মাইকেলের কবর, খালাসিটোলা-মদের আড্ডায় কবিতা উৎসব করলেন তাঁরা, হাওড়া স্টেশনে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়লেন ত্রিদিব মিত্র ও মলয় রায়চৌধুরী । মাইকেল এবং জীবনানন্দ ছাড়া অন্য কোনও কাব্যপ্রতিভাকে স্বীকার করতেন না তাঁরা । রবীন্দ্রনাথকে তাঁর গানের জন্য শ্রদ্ধা করতেন । রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন বাসুদেব দাশগুপ্ত ও মলয় রায়চৌধুরী ।
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের আঁকা হাংরি আন্দোলনের পোস্টার
হাংরি আন্দোলনের সংবাদ বিদেশেও পৌঁছালো । আমেরিকার 'টাইম' ম্যাগাজিনে ফোটোসহ হাংরি আন্দোলনকারীদের সংবাদ প্রকাশিত হবার পর ভারতের অন্যান্য ভাষায় ছড়িয়ে পড়ল । ১৯৬৩ সালে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পাটনায় গিয়ে দেখা করলেন বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ । বেনারসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক লেখকরা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । ১৯৬৪ সালে পুলিশ তাঁদের ওপর অ্যাকশান নেয়া আরম্ভ করলে, আমেরিকা থেকে অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম এর কর্তাব্যক্তি আবু সয়ীদ আইয়ুবকে ১৯৬৪ সালের ৬ই অক্টোবর চিঠি লেখেন :-
"আপনার বাগাড়ম্বর আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে । মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন ? 'আমার কোনো পদমর্যাদা নেই', এসব কথার মানে কি ? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড আছে । ভারতীয় কমিটির এগজিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে । বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি আপত্তিকর উপাদানের কথা । মশায়, আপনি এবং পুলিশই একমাত্র লেখাগুলি আপত্তিকর বলছেন । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি । পুলিশ নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । " ( দেশ, অক্টোবর, ২০১৫ )
আবু সয়ীদ আইয়ুব অ্যালেন গিন্সবার্গকে জবাবে বলেন, "আই ডু নট অ্যাগ্রি উইথ ইউ দ্যাট ইট ইজ দি পপাইম টাস্ক অব দি কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম টু টেক আপ দিস কজ অব দিস ইমম্যাচিয়র ইমিটেটরস অব আমেরিকান পোয়েট্রি।"
আবু সয়ীদ আইয়ুবের উষ্মার কারণ ছিল । মলয় রায়চৌধুরী সেসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কবি-লেখকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "ফাক দি বাস্টার্ডস অব গাঙশালিক স্কুল অব পোয়েট্রি"। কথাগুলি একটি বিয়ের কার্ডে ছাপিয়ে সাহিত্যিকদের পাঠানো হয়েছিল ।মলয়ের দেওয়া অভিধা আইয়ুব সাহেবকে আঘাত করে থাকবে ।
বিরোধের কারণ হল, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত একটি হাংরি বুলেটিনে মলয় রায়চৌধুরীর লেখা 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' ( Stark Electric Jesus ) কবিতাটি, যার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে । এছাড়াও ওই কবিতায় প্রচলিত কাব্যভাষার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ ছিল । কবিতাটি এখানে দেয়া হল:
ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবষহ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
দিতেই হবে শুভাকে
ওঃ মলয়
কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোর্বো বুঝতে পার্ছি না
আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
যোনোকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্হতা
আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
শুভা
আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্হায়
আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হি২স্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব
ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার আপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি
তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকরা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষুধার্ত ভাষা সম্পর্কে আতঙ্কিত হচ্ছিলেন । প্রচারের সব আলো তখন হাংরি আন্দোলনের দিকে । সরকার বিব্রত হচ্ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের বৌদ্ধিক আক্রমণে । একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ( পবিত্র বল্লভ ), কয়েকজন কবি এবং পুলিশের ইনফরমাররা গোপনে তথ্য, বুলেটিন, পত্রিকা, হাংরিদের ঠিকানা ইত্যাদি যোগাড় করতে লাগল, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশান নেবার জন্য । পরিশেষে ছাব্বিশজন কবিকে লালবাজারে ডেকে জেরা করা হল । ওয়ারেন্ট ইশ্যু করা হল এগারোজনের বিরুদ্ধে । বুলেটিনের প্রকাশক হিসাবে সমীর রায়চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন চাইবাসা থেকে । তিনি সেখানে ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার । কলকাতার পুলিশ পাটনায় গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করল । গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ইন্সপেক্টররা রিকশায় বসলেন এবং মলয়কে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতের মতন রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে বহু লেখাপত্র নষ্ট করে দেওয়া হল। ফাইল, বইপত্র, টাইপরাইটার ইত্যাদি বগলদাবা করে কলকাতায় নিয়ে গেল লালবাজার পুলিশ, যা আর পরে ফিরে পাননি হাংরি আন্দোলনকারীরা। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ গ্রেপ্তার হল কলকাতায় । তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আগরতলা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলো প্রদীপ চৌধুরীকে । দেবী রায়কে বর্ধমানে পোস্টাফিসের দপতর থেকে গ্রেপ্তার করে আনা হল । সুবো আচার্য আগরতলা থেকে এক উপজাতি গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি । সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষকে দিয়ে মলয় ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় । মলয়ের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু -- এনারা মলয়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন । শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মলয়ের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে ছাড়া পান । ১৯৬৫ সালে নিম্ন আদালতে ( ব্যাংকশাল কোর্ট ) মলয়ের দণ্ডাদেশ হয় । মলয় এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ।
বাঁদিকে প্রদীপ চৌধুরী । ডানদিকে সুবো আচার্য । বাংলা অ্যাকাডেমিতে
কলকাতায় যখন হাংরি আন্দোলন নিয়ে তোলপাড় চলছে , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন মার্কিন সরকারের টাকায় গেছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার কর্মশালায় যোগ দিতে । 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা সামলাচ্ছেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় । স্বাভাবিকভাবেই সুনীল বেশ উদ্বিগ্ন । তাঁর অবর্তমানে কলকাতা দখল করে নিচ্ছে একদল তরুণ, এবং তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না ; বন্ধুদের চিঠি পেয়ে তাঁর উদ্বেগ বাড়ছে । ১৯৬৪ সালের ১০ই জুন একটি চিঠিতে সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে লিখলেন, "কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব । দু'একজন বন্ধুবান্দব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি । এখনও সে ক্ষমতা রাখি । লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি । যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।" আসলে সুনীলও প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের মতো হাংরি আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ও বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছিলেন । আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনে হাংরি আন্দোনকারীদের রচনা তাঁর চোখের সামনেই প্রকাশিত হচ্ছিল । উক্ত চিঠিতে সেই উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে মলয় রায়চৌধুরী
কলকাতা হাইকোর্টে মলয়ের মামলাটি ওঠে বিচারক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে ।মলয়ের হয়ে মামলাটি হাইকোর্টে লড়েছিলেন ব্যারস্টার মৃগেন সেন ও তাঁর চারজন সহকারী । মৃগেন সেনের কাছে মলয়কে নিয়ে গিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন থেকে ফেরা ব্যারিস্টার, জ্যোতির্ময় দত্তের বন্ধু, করুণাশঙ্কর রায় ।
কলকাতা ব্যাংকশাল কোর্টে মলয়ের দণ্ডাদেশ
ব্যাংকশাল কোর্টে মলয়ের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন 'উপদ্রুত' পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র বল্লভ । এর পর লালবাজারের জাল সাক্ষী দিয়ে গেলেন এক অফিসার যিনি মলয় রায়চৌধুরীকে পাটনা থেকে গ্রেপ্তার করে এনেছিলেন । এরপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি প্রথম হাংরি ইস্তাহারে লিডার ছিলেন । এছাড়াও মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, অন্য দুই হাংরি শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । তারপর মলয়ের পক্ষের সাক্ষীরা । প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারককে জানালেন কবিতাটি অবসিন নয়, ভালগারও নয়, কবিতাটিতে নামমাত্র অশ্লীলতা আছে বলে তিনি মনে করেন না । একে একে সাক্ষ্য দিলেন তরুণ সান্যাল, কবি বুদ্ধদেব বসুর জামাতা জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি অজিত দত্ত'র মার্কিন-প্রবাসী পুত্র সত্রাজিৎ দত্ত । মলয়ের পক্ষে এতোজনের সাক্ষ্য সত্ত্বেও বিচারক অমলকুমার মিত্র মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারীদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন।
কলকাতা হাইকোর্ট মলয়কে ১৯৬৭ এর জাজমেন্টে বেকসুর খালাস করে দেন । মলয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকে নাকচ করে দেন বিচারক । এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় ভালো রকমের সাড়া ফেললো । টাইম ম্যাগাজিন লিখলো, 'ক্যালকাটাজ হাংরি জেনারেশন ইজ এ গ্রোইং ব্যাণ্ড অব ইয়ং বেঙ্গলি টাইগার্স উইথ টাইগার্স ইন দেয়ার ট্যাঙ্কস'।
মলয়ের 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হল ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে, 'স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস' নামে যা হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড অনুবাদ করেছিলেন । কবিতাটি এবং তাঁর কোর্ট কেসের সংবাদ তার আগে প্রকাশিত হয়েছিল লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত 'সিটি লাইটস জার্নাল' পত্রিকায় । এই সিটি লাইটস থেকেই প্রকাশিত হতো বিট আন্দোলনের কবি ও লেখকদের বই ।
১৯৬৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্লিৎস পত্রিকায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী হাংরি আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হল । তাতে বলা হল, "পুলিশ ন্যাব ক্যালকাটা বিটনিকস । ইরটিক লাইভস অ্যাণ্ড লাভস অব হাংরি জেনারেশন।"
আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময়ে আনন্দবাজার, যুগান্তর, সাপ্তাহিক জনতা নামের সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত হাংরি আন্দোলনের খবর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হতো । দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগান্তর, আনন্দবাজর পত্রিকায় মলয় ও দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ে জনতা পত্রিকার প্রথম পাতায় একবার মলয়ের আকটি কার্টুন প্রকাশিত হল । উপরে শিরোনাম "কল্লোল যুগের প্রৌঢ় কবিও কি হাংরি?" কার্টুনের তলায় বুদ্ধদেব বসুর সাম্প্রতিক একটি লেখা থেকে কয়েক লাইন । উদ্ধৃত অংশটি লেখার কিছুদিন আগেই বুদ্ধদেব বসু আমেরিকা গিয়েছিলেন । লেখাটিতে বুদ্ধদেব বসুর এরকম লাইন ছিল, "শিথিল শাড়ি, সোনালী শরীর গলে যায় ধীরে, স্তনের বোঁটা, চোখের মতো কাঁপছে । টার পাই তার স্তন দুটি উঁচু হয়ে আমাকে দেখছে । বলি, থামো, যেও না, ময়লা জিনের প্যান্টালুন থেকে বেরিয়ে আসবে তলোয়ার, জ্বলবে আমার আগুন তোমার জোয়ারে । জবাবে সে মাথার তলা থেকে বালিশ ফেলে দেয়, দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় শাড়ি, তার উদর পালের মতো এগিয়ে আসে । এখনও তবু আমি লুব্ধ । হাড়ে হাড়ে অমর কাম ক্ষমাহীন।"
এই লেখাটি প্রমাণ করে যে কেবল যৌন শব্দপ্রয়োগের জন্যই মলয় রায়চৌধুরী আক্রান্ত হননি । তাহলে বুদ্ধদেব বসুও হতেন । আসল কারণ ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । প্রতিষ্ঠান চায়, ব্যক্তিএকক চিরকাল সরকার ও ক্ষমতাবান প্রাতিষ্ঠানিকদের পদানত থাকবে । এটাই সত্য । মলয়ের অসহ্য উপস্হিতি, সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তাদের বিব্রত করছিল । তাই সকলকে ছেড়ে দিলেও মলয় রায়চৌধুরীকে মামলার মুখোমুখি হতে হয় । হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি বেঁধে তাঁকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । হাংরি আন্দোলন মামলা চলাকালীন বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন মলয়, তাঁর কবিতা ভবনের বাড়িতে গিয়ে । বুদ্ধদেব বসু দেখা করতে চাননি ; মলয় পরিচয় দিতেই দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ।
এখন দেখা যাক মলয় রায়চৌধুরী মানুষটা কেমন । কিসের জোরে হাংরি আন্দোলনের মতো এতো বড়ো উথালপাথাল ঘটিয়ে দিতে পারলেন, তার জন্ম দিলেন, তাকে লালন করলেন, অংশগ্রহণকারীদের একত্রিত করে প্রকৃত নেতৃত্ব দিলেন । বাংলা কবিতার খোলনলচে পালটে দিয়ে জেল খাটলেন কবিতা লেখার জন্য । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখককে ভয় পাইয়ে দিলেন । মলয় রায়চৌধুরী, যিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন, সাহিত্যের আধুনিকতাবাদ একটি 'ধ্রুপদী জোচ্চোর' ।
মলয় ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন পাটনা শহরের ইমলিতলা নামের এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত পাড়ায়, যেখানে ডোম, মেথর, দুসাধ, চামার, কুমোর, দরিদ্রতম মুসলমান পরিবারের বসবাস ।
Malay seated on floor. Samir seated on chair.
মলয়ের শৈশব কেটেছে প্রত্যহ সন্ধ্যায় শূকরের মৃত্যুকালীন আর্ত-চিৎকার শুনে । পাড়ার গরিব অন্ত্যজরা শুকরের মাংস খেতো । শূকরকে মারার জন্য প্রাণীটাকে একটা গর্তে ফেলে দিয়ে তার দেহে গনগনে লোহার শিক বিঁধে দিত, আর তার মৃত্যকালীন চিৎকারে ভারি হয়ে উঠত মহল্লার বাতাস । কম বয়সি বাচ্চাদের মুখে ফিরত "পুরি কচৌড়ি তেল মে, জিন্না বেটা জেল মে।"
Malay Roychoudhury seated in the middle. Samir is on left. Cousin brother on right. His mother is on right.
মলয় প্রাথমিক শিক্ষা পান পাটনা শহরের মিশনারি স্কুলে । মিশনারি স্কুলের চার্চের ফাদার হিলম্যান মলয়ের বাবার ফোটোর দোকানের ক্রেতা ছিলেন ; তাঁরই সহযোগিতায় মলয় ভর্তি হন, এবং তাঁর ফিসও মুকুব করে দেয়া হয়েছিল । তারপর ক্লাস সিক্স থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে অর্থনীতিতে সান্মানিক স্নাতক হন, দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হন, এবং পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন । পাশ করা মাত্র তিনি ভাগলপুর ও শিলঙে অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবা-মা তাঁদের একা ছেড়ে যেতে বারন করেন । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী ডিস্ট্রিক্ট ফিশারিজ অফিসার হিসাবে বিহারের বিভিন্ন জেলা সদরে চাকরি করতেন । বাবা-মাকে দেখার আর কেউ ছিল না । মলয়রা দুই ভাই, কোনও বোন নেই ।
পাটনার অতিদরিদ্র ইমলিতলা পাড়ায় বসবাস করলেও, মলয়ের একটি উজ্জ্বল পারিবারিক অতীত আছে । বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী বংশের সপ্তম প্রজন্ম মলয় । বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী, মা অমিতা রায়চৌধুরী । মলয়ের বাবা ও দাদুর কোনো বিদ্যায়তনিক শিক্ষা চিল না । দাদু ফারসি, আরবি, উর্দু লিখতে পড়তে পারতেন, কিন্তু ইংরেজি জানতেন না । সেই অর্থে মলয় এবং দাদা সমীরই স্কুল-কলেজে শিক্ষিত প্রথম প্রজন্ম । মলয়ের বাবার ঠাকুর্দা সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার থেকে বিতাড়িত হন মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাল্য বিধবাকে বিবাহের কারণে । মলয়ের বাবার পাটনায় ফোটোগ্রাফির দোকান ছিল, ব্যবসাটি পত্তন করেছিলেন মলয়ের ঠাকুর্দা, সেসময়ে তা ছিল ভ্রাম্যমান ফোটোর ব্যবসা । ঠাকুর্দা বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে গিয়ে অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলে তা থেকে পেইনটিঙ আঁকতেন । মলয়ের জেঠামশায় প্রমোদ ছিলেন পাটনা মিউজিয়ামের 'কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার'।
মলয়ের ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, যিনি ফোটোর ব্যবসা আরম্ভ করেন
সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর কাছ থেকেই ১৬৯৮ সালে মাত্র তেরোশো টাকায় জোব চার্নকসুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা নামের তিনটি গ্রামের ইজারা নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন করেন । নবাবের নির্দেশে তাঁরা ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষ নেবার কারণে সাবর্ণ চৌধুরীরা অন্যান্য অভিজাত পরিবারের তুলনায় ব্রিটিশদের দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, এবং তাঁরা ক্রমশ ছত্রভঙ্গ হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েন ।
Malay's parents Ranjit & Amita before Malay was born বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করার সময় থেকেই মলয় মার্কসবাদ ও ইতিহাসের দর্শন নিয়ে পড়াশুনা ও লেখালিখি করছিলেন । 'ইতিহাসের দর্শন' শিরোনামে তিনি 'বিংশ শতাব্দী' পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলেন । দাদার বন্ধু কবি দীপক মজুমদারের পরামর্শেই তিনি ইতিহাসের পরিবর্তে ইতিহাসের দর্শনে আগ্রহী হন । ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত বইগুলি পড়ার সময়ে মলয় ইতিহাসকার অসওয়াল্ড স্পেংলারের 'দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট' বইটির সঙ্গে পরিচিত হন । 'হাংরি' শব্দটি মলয় পেয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের 'ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম' বাক্যটি থেকে । অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই এবং জিওফ্রে চসারের কবিতার লাইন মলয়কে হাংরি আন্দোলনের তাত্বিক ভিত গড়তে সাহায্য করেছিল ।
স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে ; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই 'আত্মসাৎ' করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন।
মলয় রায়চৌধুরীর মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে । কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে ( তাঁর দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন ) মলয় ও সমীর উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতেন প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতেন বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল । ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য তাঁদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি । মলয় মনে করতেন, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত ।
মলয়ের প্রথম বই প্রবন্ধের, 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার', ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । হাংরি আন্দোলনের সময়ে একটি কপি দেবী রায়ের কাছে রেখে বাকি কপি পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল । মলয় পরে বলেছিলেন, ওই পুড়িয়ে দেয়াটা ছিল একটা পলিটিকাল ব্লাণ্ডার । শোনা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপর ক্ষেপে গিয়ে শক্তির উল্টোডাঙা বস্তিবাড়ির সামনে বইগুলো জড়ো করে জ্বালিয়েছিলেন মলয় । তাঁর দ্বিতীয় বইটি ছিল কবিতার ; বইয়ের নাম শয়তানের মুখ, ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয় কবি অথবা লেখক নেই যাঁর গ্রন্হ শক্তি এবং সুনীল দুজনেই প্রকাশ করেছিলেন ।
মলয়ের গ্রন্হাবলী ও সাহিত্যচর্চাকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায় । যার প্রথম পর্ব ছিল হাংরি আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত । অর্থাৎ ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল । এই সময়পর্বে তিনি 'জেব্রা' নামের একটি পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেন এবং শতাধিক হাংরি বুলেটিন প্রকাশের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন । হাংরিদের পত্রিকার কভারের ব্লকও তিনি পাটনা থেকে করিয়ে এনে দিতেন । মলয়ের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিজীবীরা পেরে উঠতেন না তার কারন মলয়ের গভীর পড়াশুনা ।
'হাওয়া-৪৯' পত্রিকায় মলয় সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন :-
"মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও পোলেমিক্সের সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা। তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ 'সাহিত্যের সেবক' বললে আমাদের স্মরণে যে ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেনিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে --- আক্রান্ত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি । গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা-যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা 'সংস্কৃতির' ঘরে তাঁর লালন-পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ, বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মআজাগতিক সচেতনতা,মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতে খড়ি হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, 'লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে?' বলা বাহুল্য তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছিলেন 'পলিটির' কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব --- মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন।"
প্রথম পর্বের পর প্রচণ্ড অভিমান, ঘৃণা ও বিরক্তিতে মলয় তাঁর সমস্ত বইপত্র বিলিয়ে দিয়ে প্রথমে লখনউ ও পরে মুম্বাই চলে যান । রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে তিনি অ্যাগরিকালচারাল রিফাইনান্স ও ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে যোগ দেন, এবং তখন থেকেই তিনি চাকুরিসূত্রে ভারতের গ্রামেগঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, কুমোর, চামার, ঝুড়ি প্রস্তুতকারী, খেতমজুর, ছুতোর প্রমুখ সমাজের তলার দিকের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হন যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধে । এআরডিসি থেকে তিনি চলে যান নাবার্ডের মুম্বাই হেড অফিসে এবং ১৯৯৭ সালে অবসর নেন কলকাতা দপতরের ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার হিসাবে, পশ্চিমবঙ্গে সম্পর্কে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ।
দ্বিতীয় পর্বের আত্মপ্রকাশ আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে । মহদিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক উত্তম দাশ তাঁর লখনউয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে কবিতা সংকলন ও ইস্তাহারগুলির সংকলন প্রকাশে উৎসাহিত করেন । দুই পর্ব মিলিয়ে, এই রচনা লেখার সময় পর্যন্ত মলয়ের কাব্যগ্রন্হ চৌদ্দটি, উপন্যাস চৌদ্দটি, ছোটোগল্প সংকলন দুটি, নাটকের বই একটি, অগ্রন্হিত কাব্যনাটক তিনটি, প্রবন্ধ সংকলন সতেরোটি, স্মৃতিকথা দুটি, অনুবাদগ্রন্হ সাতটি, সাক্ষাৎকারগ্রন্হ চারটি -- সব মিলিয়ে সত্তরটির মতো ।
সাতাত্তর বছর বয়সে এসে কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখেন । এখনও সচল মস্তিষ্ক । চিকিৎসা বিভ্রাটে আর্থ্রাইটিসে সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে কাজ করে চলেছেন । তরুন কবি ও লেখকদের বইয়ের ভূমিকা লিখে দিচ্ছেন । যৌবনের শুকনো নেশা, ক্যানাবিস, হ্যাশিস, মেস্কালিন, এলএসডি, আফিম, খালাসিটোলার বাংলা, পাটনার ঠররা, নেপালের ঠমেলে মোষের কাঁচা মাংস হরিণের মাংসের আচার আর গমের মদ ইত্যাদি থাবা বসিয়েছে স্বাস্হ্যের ওপর ।
মলয়ের যাবতীয় লেখালিখি সবই লিটল ম্যাগাজিনে । এপার বাংলা, বাংলাদেশে এবং যেখানে বাংলা ভাষার কাগজ প্রকাশিত হয় তার প্রায় সব কাগজেই মলয় কোনো না কোনো সময় লিখেছেন । প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজে মলয় কখনও একলাইনও লেখেননি । মলয় সম্ভবত একমাত্র লেখক যিনি তাঁর বইতে ঘোষণা করতেন যে তাঁর বইয়ের কারোর কোনো কপিরাইট নেই । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় স্হির অবিচল মলয় ২০০৩ সালে ফিরিয়ে দিয়েছেন অকাদেমি সাহিত্য সন্মান । যদিও তাঁর এক সময়ের হাংরি বন্ধ শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সুবিমল মাথা পেতে সরকারিপুরস্কার নিয়েছেন । মলয়ের লেখালিখির ওপর পিএইচডি করেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যলয়ের কুমার বিষ্ণু দে এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়শঙ্কর বর্মা । এম ফিল করেছেন অনেকে, এখনও কয়েকজন করছেন । তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক শুভশ্রী দাশ ।গবেষণা করেছেন মার্কিন ছাত্রী মারিনা রেজা ।
Malay at 78 on a visit to his daughter's home 'মধ্যরাত্রি' পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ সমিদুল ইসলাম একটি সাক্ষাৎকার মলয় রায়চৌধুরীকে প্রশ্ন করেছিলেন, "মলয়বাবু, আপনি কখনও নিশ্চয়ই ভেবে দেখেছেন, আপনি কী ? আপনি কে?"
জবাবে মলয় জানিয়েছিলেন, "আজিজুল হক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মলয় রায়চৌধুরী মানব সমাজের পেরিফেরির জীব, সোজা বাংলায় আমি একজন কালচারাল বা্টার্ড।"
( 'নতুনপথ এই সময়' পত্রিকার ১৪২৪ শরৎ সংখ্যায় প্রকাশিত )
Pranabkumar Chattopadhyay, 7 Baradakanta Road, Dumdum, Kolkata 700 030
No comments:
Post a Comment