Wednesday, November 20, 2019

হাংরি জেনারেশন - বাংলা সাহিত্যে প্রথম আভাঁ গার্দ আন্দোলন : অভিজিৎ পাল

 
হাংরি জেনারেশন : বাংলা সাহিত্যে প্রথম  আভাঁ গার্দ  আন্দোলন  
অভিজিৎ পাল      
          ১৯৩১ সালে লেখা পল ভালেরির এই বক্তব্য দিয়ে আরম্ভ করি, 
কেননা পশ্চিমবাংলার হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের আভাঁ গার্দ 
কাজগুলোর ক্ষেত্রে বক্তব্যটা খাটে : “আমাদের কারুশিল্পগুলো উন্নত 
হয়েছিল, তাদের প্রকার ও প্রয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সময়ে, 
তা বর্তমান সময় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, এবং বস্তুসমূহের ওপরে 
তখনকার লোকেদের প্রভাবক্ষমতা আমাদের সময়কার লোকেদের তুলনায়
 তুচ্ছ ছিল । আমাদের টেকনিকের বিস্ময়কর ক্রমবিকাশ, তারা যে 
অভিযোজ্যতা এবং যথাযথতা  অর্জন করেছে, তারা যে ধারণাগুলো
 আর অভ্যাসগুলো তৈরি করেছে তা নিশ্চিত করে যে সৌন্দয্যের 
প্রাচীন সংজ্ঞায় গভীর পরিবর্তন আসন্ন। সমস্ত কারুকলাতে একটি 
বস্তুগত উপাদান রয়েছে যা আর আগের মতো বিবেচনা বা অনুশীলন 
করা যায় না, যা আমাদের আধুনিক জ্ঞান এবং শক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয় । 
গত বিশ বছরে পাত্র বা স্থান বা কাল প্রাচীনকালে যা ছিল তা থেকে 
একেবারে আলাদা । কারুকৃতির পুরো কৌশলে রূপান্তর ঘটাতে আমাদের
 অবশ্যই অন্যরকম উদ্ভাবন আশা করতে হবে, যার ফলে  শৈল্পিক আবিষ্কার
 নিজেই প্রভাবিত হবে, এমনকি আমাদের কারুকৃতির ধারণায় বিপুল 
ও আশ্চর্যজনক পরিবর্তন আনবে। "
          পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোণের সময় থেকে আভাঁ গার্দ কাজগুলো নিজেদের মুক্ত মঞ্চ পেয়ে গিয়েছিল । লক্ষনীয় যে এই বিস্ফোরণ সম্ভব হয়েছিল হাংরি জেনারেশনের সাহসী কার্যক্রমের কারণে । তাঁরাই পথপ্রদর্শক । হাংরি জেনারেশন দেখিয়ে দিতে পেরেছিল যে কেবল একফালি কাগজ বা একফর্মার পত্রিকা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে উথালপাথাল ঘটিয়ে দিতে পারে ; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকার বা সংবাদপত্রের দয়াদাক্ষিণ্যের প্রয়োজন নেই । এটি তাঁদের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান যা ডাডা এবং সুররিয়ালিস্টদের তোলপাড়ের সঙ্গে তুলনীয় । মনে রাখা প্রয়োজন যে হাংরি জেনারেশনের এই ফালিকাগজ ও এক ফর্মার পত্রিকা তাঁদের রচনাবলীকে আমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় পৌঁছে দিয়েছিল । 
        এই প্রসঙ্গে অলোক গোস্বামী লিখেছেন: “এই সম্মীলিত পদক্ষেপের ফলেই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুল পদক্ষেপগুলোও পারেনি গতিরোধ করতে। আর তাই লিটল ম্যাগাজিনকে কে বা কাহারা সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেই তথ্য আজ আর প্রাধান্য পায় না। তার পরিবর্তে উঠে আসে সোমেন চন্দ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার,শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষ,বাসুদেব দাশগুপ্ত, মলয় রায়চৌধুরী,উদয়ন ঘোষ,অরূপরতন বসু,কৃষ্ণগোপাল মল্লিক,সুবিমল মিশ্র,সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,দেবেশ রায় এবং এরকম আরও অসংখ্য নাম। এদের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনাকে পাঠকের সামনে প্রথম তুলে ধরেছে লিটল ম্যাগাজিনই। গড়পড়তা সাহিত্যের পরিবর্তে পাঠককে আগ্রহী করেছে নতুন রচনারীতির স্বাদ গ্রহণ করতে। সেই প্রচেষ্টা যে বিফল হয়নি তার প্রমাণ,পরবর্তিতে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো বাধ্য হয়েছে নিজেদের ছাঁচ থেকে বেরিয়ে ওদের কারো কারো লেখা ছাপতে। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়নি। সেসব লেখকেরা জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না রেখে শুধু মাত্র লিটল ম্যাগাজিনকেই তাদের রচনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিন শুধু তাদের লেখাই প্রকাশ করেনি, সীমিত সামর্থ সত্বেও সেসব লেখকেদের বইপত্রও প্রকাশ করেছে। করে চলেছে। সুতরাং থোড় বড়ি খাড়া সাহিত্যের চর্চা করার পরিবর্তে ব্যতিক্রমী এবং নিরীক্ষা মূলক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলা সাহিত্যের সৃজনীধারাটাকে সজীব রেখেছে যে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই সেটা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লিটল ম্যাগাজিন যদি এই দায়িত্ব পালন না করতো তাহলে বাংলা সাহিত্যের দশা কী হোত তার প্রমাণও হাতের কাছে মজুত আছে। বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকাগুলো পাঠক মনোরঞ্জনের ফাঁদে আটকা পড়ে রীতিমত ধুঁকতে শুরু করেছে। একদা হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হওয়া দুর্গাপুজো সংখ্যাগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বকর্মা পুজো সংখ্যায়। তাতেও যেহেতু সামাল দেয়া যাচ্ছে না তাই এখন সাহিত্য সম্ভারগুলোর সঙ্গে বিনামূল্যে চামচ, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, শ্যাম্পুর স্যাসে বিতরণ করেও লোক টানতে হচ্ছে। এরপর আগামীতে যদি পুজো সংখ্যাগুলো জন্মাষ্টমী সংখ্যায় পরিণত হয় এবং বাই ওয়ান গেট ওয়ান ব্যবস্থা চালু হয় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যেহেতু প্রসাদ কবির সুরে স্বখাত সলিল সংক্রান্ত গানটা গাইতে পারছে না তাই নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে অজুহাত দিচ্ছে বাঙালি পাঠকের উদাসীনতাকে। সেই অজুহাত যে কতটা মিথ্যে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যার প্রতি পাঠকের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। আমার বক্তব্যকে কারো যদি অতিশয়োক্তি মনে হয় তাহলে তাকে অনুরোধ করব বইমেলায় কিংবা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় গিয়ে বিক্রির পরিসংখ্যানটা জেনে নিতে। এই জনপ্রিয়তাও শুধু নতুন রীতির গল্প কবিতা প্রকাশের কারণে বৃদ্ধি পায়নি, সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে যে ধরণের চর্চা লিটল ম্যাগাজিন করে চলেছে সেসব বাণিজ্যিক পত্রিকার কাছে কল্পনাতীত।”   এখন “আভাঁ গার্দ” বিষয়টির তাত্বিক দিকটি দেখা যাক । পিটার বার্জার তো বলেইছেন যে “আভাঁ গার্দ কী ? প্রশ্নটা শুনলেই মনে তা উস্কানিমূলক ।” তিনি সত্য কথা বলেছেন । পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের উল্লেখ করলে তা উস্কানিমূলক প্রস্তাব হয়ে দাঁড়ায় ।
          সাহিত্য, ছবি আঁকা, সঙ্গীত ইত্যাদির ক্ষেত্রে “আভাঁ গার্দ” শব্দটা এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে ; সৈন্যবাহিনীর একেবারে সামনের সারিতে যে দলটা শত্রুপক্ষের ক্ষমতা আঁচ করার জন্য এগিয়ে যায়, ইংরেজিতে  ভ্যাঙ্গার্ড বা ফ্রণ্টলাইন, বাংলায় বলা যেতে পারে ‘অগ্রদূত’ বা ‘অগ্রগামী-দল’, তাদের । ফরাসি সৈন্যবাহিনীতে ১৭৯৪ সালে সামনের ঝটিকাবাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল আভাঁ গার্দ যাদের বার্তার ওপর নির্ভর করে সেনাবিহিনী এগোতো ; বলা বাহুল্য যে পরের দলটাকে বলা হতো ‘রিয়ার গার্ড’ । ১৮২৫ সালে অভিধাটি প্রথম প্রয়োগ করেন সাঁ সিমনিয়াঁ  ওলিন্দে রডরিগেস তাঁর “শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং শিল্পপতি” ( “L’artiste, le savant et l’industriel” ) প্রবন্ধে। রডরিগস লিখেছিলেন যে শিল্পীদের উচিত “জনগণের অগ্রণী হিসাবে কাজ করা" কেননা , সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য "শিল্পকলার শক্তি প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দ্রুততম”; তিনি বলেছিলেন যে তাঁরা ভিশনারি এবং সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন । উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে বামপন্হী বিপ্লবীরা রাজনৈতিক সংশোধনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের চিহ্ণিত করার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছিল অভিধাটি । বামপন্হী ভাবধারা থেকে বিযুক্ত হয়ে ইউরোপে অভিধাটা প্রয়োগ করা আরম্ভ হয় নিরীক্ষামূলক, অরক্ষণশীল, প্রথাবিরোধী, ক্যাননমুক্ত, বৈপ্লবিক, অনৈতিহ্যগত নান্দনিক বা কান্তিবিদ্যা-সম্বন্ধিয় উদ্ভাবন বা নবপ্রবর্তনকে বোঝাতে, যা প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং যা সৃজনকারী ও ভোক্তার মাঝে সমালোচনা হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল । সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আভাঁ গার্দ মূলত স্হিতাবস্হাকে আক্রমণ করে এবং     প্রথাসিদ্ধ প্রচলনের পাঁচিল ভেঙে ফেলে পরিধিকে অবিরাম বাড়াতে থাকে ; হাংরি জেনারেশন তাইই করেছিল এবং সেকারণে সদস্যরা জেলহাজতে গিয়েছিল । ডাডাবাদী বা আধুনিকতাবাদী সাহিত্য  থেকে অবিরাম ঘটে চলেছে এই প্রক্রিয়া এবং সেই কারণেই সৃজন-সেনাদের আচমকা বাঁকবদলকে বলা হয়েছে আন্দোলন । 
         বর্তমান কালখণ্ডে আভাঁ গার্দ বলতে বোঝায় কোনও বুদ্ধিজীবি, লেখক এবং শিল্পী গোষ্ঠীর কাজকে,  যাঁরা সেই কাজগুলোকে তাঁদের বিশেষ বার্তার মাধ্যমে প্রচলিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে উপস্হাপন করেন । অবিরাম হবার দরুন এককালের বৈপ্লবিক ধারাকে সমাজের মূলদলটি বা ‘রিয়ার গার্ড’ নিজের দলে মিশিয়ে নেয়, যার ফলে আবার নতুন আভাঁ গার্দ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। গ্যাব্রিয়েল ডিজায়ারে লাভেরদান্ত তাঁর “ফ্রম দি মিশন অফ আর্ট অ্যাণ্ড রোল অফ অর্টিস্টস” বইতে লিখেছেন, “শিল্প, যা সমাজের অভিব্যক্তি, নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে তার সর্বোচ্চ উড়ালে, সবচেয়ে উন্নত সামাজিক প্রবণতায় : তা হল প্রকাশকর্তার পূর্বগামী । সুতরাং জানবার জন্য যে শিল্প প্রবর্তকের উদ্দেশ্য পূরণ করছে কিনা,  সত্যিই আভাঁ গার্দ দলের মানুষ কিনা, একজনকে জানতে হবে যে মানবিকতা কোন দিকে যাচ্ছে, মানবজাতির নিয়তি কী, খুলে স্পষ্ট দেখিয়ে দিতে হবে যাবতীয় কলুষ, কল্মশ, হিংস্রতা, নোংরামি ইত্যাদি যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের বুনিয়াদ । 
          ফ্রান্সেই আভাঁ গার্দের বা ভ্যাঙ্গার্ডের সূত্রপাতের কারণ ছিল, যেমন পশ্চিমবাংলায় হাংরি জেনারেশনের উদ্ভব । প্রথমত সেই সময়ের ফ্রান্সে প্রতীকি স্তরে ফরাসি সংস্কৃতিতে লাঠি ঘোরাতেন সমাজের গণ্যমান্য অভিজাতরা এবং তাঁদের নান্দনিক মূল্যবোধকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া সাধারণ মানুষের কাছে জরুরি ছিল । অর্থাৎ সমান্তরাল সমাজটিতে এগিয়েছিল অভিজাত মূল্যবোধ আর পেছিয়েছিল সংস্কৃতি সৃষ্টিকারীদের মূল্যবোধ । আভাঁ গার্দের আগমন জরুরি হয়ে উঠেছিল সেই মূল্যায়ণ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজেদের মূল্যায়ণ পদ্ধতি স্হাপন করা । ইংরেজিভাষী অঞ্চলে তা ছিল উল্লম্ব, অর্থাৎ কেউ ওপরে এবং বাদবাকি ক্রমশ তলার দিকে ধাপেধাপে । উপনিবেশগুলোতেও ইংরেজরা এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে গিয়ে চারিয়ে দিতে পেরেছিল : গ্রেটেস্ট, গ্রেট, মেজর, মাইনর ইত্যাদি । বোদলেয়ারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও, র‌্যাঁবো-ভেরলেনের চরিত্র নিয়ে গুজব ছড়ালেও, কেউই তাঁদের, তাঁরা যখন লিখছিলেন, মাইনর হিসাবে তকমা দেগে দ্যায়নি । ফ্রান্সে লাতিন কোয়ার্টারের মতন তখনকার অ-ভদ্রলোক অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকাশক অধ্যুষিত এলাকায় মাতামাতি হলেই তারা ছিল এগিয়ে । ওপরে নয় ।
          ফরাসি সাহিত্যে ষোড়শ শতক থেকেই মিলিটারি মেটাফর প্রয়োগ করা হয়েছে । একদল লেখককে বলা হতো “La Brigade” অর্থাৎ ‘বৃহৎ সৈন্যদল’ ; ব্রিগেড বলা হতো, তাতে সেনাবাহিনীর বহু ব্যাটালিয়ান ও কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত । শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাজের ভ্যাঙ্গার্ড হতে হবে, এই আওয়াজ প্রথমে ফ্রান্সে তুলেছিলেন ক্লদ অঁরি দ্য সাঁ-সিমঁ, ১৮২৫ সালে প্রকাশিত তাঁর  Opinions Litteraires, philosophiques et industrielles bhite : "আমরা, শিল্পীরা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ভ্যানগার্ড হয়ে উঠব। শিল্পের শক্তি আসলে সবচেয়ে কার্যকর এবং দ্রুততম। আমাদের কাছে সব ধরণের অস্ত্র রয়েছে: যখন আমরা নতুন ধারণা প্রস্তাব করতে চাই, তখন আমরা সেগুলো শ্বেতপাথরে খোদাই করি বা আমরা সেগুলো একটি ক্যানভাসে আঁকি । " বৌদ্ধিক বিপ্লবের একেবারে সামনে দিকে শিল্পসাহিত্য থাকে, এই  ধারণা উনিশ শতকের মধ্যভাগে আবার দেখা দিয়েছিল, আবারও একটা বিপ্লবের ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল আর সমস্ত ফরাসী বিপ্লব প্যারিসেই শুরু হয়। ফ্রান্সে উনিশ শতকের শেষে এই অভিধাটির মান পরিবর্তিত হয়েছিল । তারপর থেকে নির্দিষ্ট শিল্প-সাহিত্যিক গোষ্ঠীকে চিহ্ণিত করার জন্য প্রয়োগ করা আরম্ভ হয়েছিল এবং নতুন গোষ্ঠীটিকে নান্দনিক অন্বেষণের অগ্রভাগ হিসাবে গণ্য করা হতে লাগলো কেননা নতুন গোষ্ঠী আগের  শৈল্পিক মানদণ্ডকে ভেঙে ফেলতে সফল হল । বিপ্লবী আলোকপ্রাপ্তির সম্মিলিত প্রত্যয়টি বিলিন হয়ে গিয়ে "আভাঁ গার্দ" অভিধাটি সাধারণত শিল্পী-সাহিত্যিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হওয়া আরম্ভ হয় । অনেক গোষ্ঠী থাকলেও, যে গোষ্ঠী একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করে, আর তখনকার থিম্যাটিক মোটিফগুলির সাথে জড়িত নয় এবং নতুন অন্বেষণ চালাচ্ছে, আর অন্বেষণের প্রক্রিয়াতে পরীক্ষামূলক, তারা “আভাঁ গার্দ” হিসাবে চিহ্ণিত হতে লাগলো।
        পরিবর্তনের মূল অভিগমন হল যে এটি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের বিপ্লবের পরিণতি, ঘটনার বৈপরীত্য,  যা সমস্ত কিছু উল্টে পাল্টে দিতে চায়, যা হাংরি জেনারেশন করতে পেরেছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি বিশেষ ধারণার প্রতিপাদন করে এবং তাহল এই যে মানবজাতির অগ্রগতি বা শিল্পসাহিত্যের বাঁকবদল একটি "বিদার" ( Rupture ) এর পরিণতি, যা হঠাৎ করে অভিনবতাকে আবিষ্কার করে এবং যা আগে থেকে চলছে এমন  সমস্ত কিছুকে পাল্টে দ্যায় এবং প্রাক্তন চিন্তাধারার পদ্ধতিতে রূপান্তরণ ঘটায়। ততোদিনে যা প্রাক্তন তা পুঁজিবাদের চাপে বাজারের খোরাক হয়ে ওঠে । ১৯৫০ সালে ইসিদোরে ইজু, যিনি ত্রিস্তঁ জারার মতন রোমানিয় ছিলেন, প্যারিসে আরম্ভ করেন ‘লেট্রিজম’ আন্দোলন, যাকে পরাবাস্তবের পরের আভাঁ গার্দ আন্দোলনের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ; ‘লেট্রিস্ট’ আন্দোলনকারীরা অক্ষর, বাক্য ও ছবির মিশ্রণ ঘটিয়ে কাজ করতেন । ইজু বলেছিলেন যে বিশ্ব সাহিত্য ক্রমশ “Le ciselant” বা স্তব্ধতা থেকে ক্রমশ “l’amplique” দিকে এগিয়ে যায়, অর্থাৎ একটা সময় আসে যখন সমসাময়িক সমাজ নতুন মাত্রাটিকে গ্রহণ করে নেয় এবং তা হয়ে ওঠে doxa বা গৃহীত কল্পমূর্তি, যার পুনরাবৃত্তি ততোদিন চলতে থাকে যতোদিন না আবার নতুন ‘ভ্যাঙ্গার্ড’ এসে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে । ইজু এই নবীনতাকে বলেছিলেন Novatique, যাকে ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের Tel quel বা “যেমন আছে” পত্রিকাগোষ্ঠীর ভাবুকরা, বিশেষ করে রলাঁ বার্থ ও মিশেল ফুকো,  বলা আরম্ভ করলেন Rupture বা “বিদার” । 
          Tel quel গোষ্ঠীর সদস্যরা আধুনিক চিন্তাধারার সূত্রপাতকে ইতিহাসে ১৮৮৬ নাগাদ একটি “জ্ঞানতাত্বিক ভাঙন” বা “epistemological break” হিসাবে চিহ্ণিত করলেন কেননা সেই বছর মালার্মে তাঁর টেক্সটগুলো প্রকাশ করেছিলেন যা Album de Vers et de Prose নামে গ্রন্হাকারে ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু এই বছরেই ফরাসি কবি মোরেয়ার “আধুনিক” সাহিত্যিক ইশতাহার Manifesto of Symbolism প্রকাশিত হয় Le Figaro সংবাদপত্রে যা প্রকৃতপক্ষে ছিল ১৮৫৬ সালে Le Salon de-তে বোদলেয়ারের লেখা “আধুনিকতা” সম্পর্কিত বক্তব্য । বোদলেয়ারের বক্তব্যটি পৃথিবী জুড়ে আধুনিকতার সংজ্ঞার স্বীকৃতি পায় । বোদলেয়ার বলেছিলেন যে “বিশুদ্ধ শিল্প”  [Ktema es aei অর্থাৎ অনন্তকালের সম্পদ] নামে পাশ্চাত্য চিন্তায় প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে তার জায়গায় আনতে হবে আধুনিক শিল্পবোধ কে, যা “আপেক্ষিক” ; শিল্প হল আংশিক শাশ্বত ও আংশিক সমসাময়িক বললেন বোদলেয়ার, এবং সমসাময়িকতা থাকার দরুণ তা আধুনিক । তিনি শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব সমকালীনতার এই ব্যাখ্যার জয়কে কোনো দুর্বোধ্য শাশ্বতের বিপক্ষে তুলে ধরলেন । 
      মোরেয়া তাঁর ইশতাহারে বলেছিলেন, "সমস্ত চারুকলার মতো, সাহিত্যেরও অবিরাম বিকাশ হয়: একটি আবর্তের সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তন কঠোরভাবে নির্ধারিত  [...]। শৈল্পিক বিবর্তনের প্রতিটি নতুন পর্ব তার আগের বৌদ্ধিক গোষ্ঠীর অবসানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হয়, তার ঠিক আগের গোষ্ঠী অনিবার্যভাবে ফুরিয়ে যায় ।” তিনি বলেছেন  সাহিত্য এবং শিল্প ক্রমাগত নৃশংস এবং বিরোধী ভাবনাচিন্তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। এটাই মৌলিক জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাস যা আভাঁ গার্দের সৃষ্টিবাদী ধারণাটিকে, নানা আন্দোলন সত্ত্বেও, টিকে থাকতে দিয়েছে। উপরোক্ত তিনটি মৌলিক ফরাসি সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে যে কেন আভাঁ গার্দ ধারণাটি ফরাসি সমালোচনামূলক শব্দভাণ্ডারে আবিষ্কার হয়েছিল এবং এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফরাসি সমালোচনামূলক ইতিহাসে সিম্বলিজম, ডাডা, ফিউচারিজম, পরাবাস্তববাদ এবং লেট্রিজমের মতো  ভ্যানগার্ডগুলির বর্ণনা করার সময়ে আভাঁ গার্দ অভিধাটি প্রয়োগ করে হয় । বস্তুত ১৮৮৬ থেকে ১৯৬০র দশক পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বাঁকবদলগুলোকে চিহ্ণিত করার জন্যই আভাঁ গার্দ অভিধাটি প্রয়োগ করা হয় ।                                                 
          ইতালিয় ভাবুক রেনাতো পোজিওলি ১৯৬২ সালে তাঁর  ‘আভাঁগার্দের তত্ব’ রচনায় ( Teoria dell’arte d’avanguardia ) অভিধাটির অন্তর্গত সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চের ধ্রুবকগুলো ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক এবং দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিমাপের প্রয়াস করেছিলেন । তিনি চিত্রকলা, কবিতা, সঙ্গীত ইত্যাদির  ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তগুলো ছাপিয়ে বলতে চেয়েছেন যে অগ্রদূত বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ আদর্শ বা মানদণ্ডের শরিক হবার দরুণ তা প্রতিফলিত হয় তাঁদের প্রচলবিরোধী বা সমাজরীতিঅনীহ জীবনশৈলীতে । জার্মান সমালোচক পিটার বার্গার ১৯৭৪ সালে তাঁর ‘থিয়রি অফ দি আভাঁ গার্দ’ বইতে বলেছেন যে সমাজের রাজনৈতিক সমালোচনা করে আবির্ভূত হলেও, পুঁজিবাদের সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির কাজে যে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থাকে তাদের অসাড় করে দেয় বা যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে চলে যায় । আভাঁ গার্দের ধারণা মূলত শিল্পী, লেখক, সুরকার এবং চিন্তাবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এবং তাঁদের কাজগুলো মূলধারার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এবং  সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রান্তসীমায় তাঁদের অবস্হান থাকলেও পাশ্চাত্যদেশগুলোর বেলায় যে বক্তব্য খাটে তা বঙ্গসমাজের মতন গরিবদেশগুলোর বেলায় খাটে বলে মনে হয় না ।
        পশ্চিমবঙ্গে আভাঁ গার্দ কবে থেকে আরম্ভ হল তা চিহ্ণিত করা সহজ । আভাঁ গার্দ অভিধাটি যুদ্ধসংক্রান্ত হবার দরুন এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে কবিলেখকদের যুদ্ধের সময়কাল দিয়ে তা দেগে দেয়া যায়, অর্থাৎ ষাটের দশকে যখন সাহিত্যশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ড আক্রান্ত হল হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারী সাহিত্যগোষ্ঠির দ্বারা ।  পশ্চিমবঙ্গে যেমন, প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করার পাশাপাশি শিল্পায়নের দ্বারা উৎপাদিত কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত গণ সংস্কৃতিকেও বাঙালি আভাঁ গার্দ প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মিডিয়াগুলির প্রতিটি হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ পণ্য — এগুলি এখন মোটামুটি কারুশিল্পের প্ল্যাটফর্মের কাজ করে — অথচ এগুলো সত্যিকারের কারুশিল্পের আদর্শ নয়, উৎপাদন সম্পর্কিত  লাভ-ক্ষতির উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত। বাজার তাই নকল বা যান্ত্রিক এবং প্রায়শই আভাঁ গার্দ সংস্কৃতি থেকে চুরি করে আনুষ্ঠানিক নকশা বা আবিষ্কার ব্যবহার করে তারা আভাঁ গার্দ কারুশিল্পের চেয়ে উন্নত হওয়ার ভান করে। যেমন বিজ্ঞাপন যাঁরা তৈরি করেন সেই দোকানদাররা পরাবাস্তবতা থেকে চাক্ষুষ পদ্ধতি চুরি করে চলেছে, যদিও বিজ্ঞাপনের কাজগুলো সত্যই পরাবাস্তব প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে পারে না । বিজ্ঞাপন যেটা তৈরি করে তা হল ( kitsch ) ‘কিৎশ’-- আভাঁ গার্দের বিপরীত এবং তা রিয়ার গার্ডও নয় ।
          রেনাতো পোজিওলি যে তর্কবিন্দুগুলো দিয়ে আভাঁ গার্দকে চিহ্ণিত করেছিলেন সেগুলো পশ্চিমবাংলায় ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন এবং পরবর্তী বাঁকবদলকারী পত্রিকাগোষ্ঠির  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । ১ ) আভাঁ গার্দ বলতে বোঝায় পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথে যাত্রা ; ২ ) মার্কসবাদীরা আভাঁ গার্দ বিরোধী ; ৩ ) মার্কসবাদীরা আভাঁ গার্দকে ‘বুর্জোয়া শিল্প, নামে অভিহিত করতে ভালোবাসেন, কেননা তাঁরা আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দেন ; ৪ ) আমেরিকা -ইংল্যাণ্ডে আভাঁ গার্দ শব্দটা ব্যবহার করা হয় না, কেননা তা ফ্রান্সে উদ্ভুত, তাঁরা পোস্টমডার্ন বলা পছন্দ করেন । ; ৫ ) রাজনৈতিক এবং নান্দনিক আভাঁ গার্দ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বামপন্হীদের কারণে ; ৬ ) উৎসাহের ঝরণা থেকে আভাঁ গার্দ শিল্প-সাহিত্যের জন্ম ; ৭ ) আভাঁ গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিকরা কাজের তুলনায় প্রকাশভঙ্গীতে বেশী আগ্রহী ; ৮ ) পুরাতনপন্হীরা নিজেরাই নতুনের আবির্ভাব চান কিন্তু দেরিতে স্বীকার করেন ; ৯ ) আঁভা গার্দ জনপ্রিয় নয় তার কারণ জনগণের কাছে পৌঁছোতে দেয়া হয় না ; ১০ ) রোমান্টিসিজম আভাঁ গার্দের চেয়ে জনপ্রিয় ছিল কারণ তখন অভিজাত সমাজ অবলুপ্ত হয়ে নতুন কর্মীশ্রেনি ও মধ্যবিত্তের উদ্ভব হচ্ছিল ; ১১ ) বহু আভাঁ গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা পছন্দ করেন না ; ১১ ) একটি আভাঁ গার্দ আন্দোলন দেখে পরের প্রজন্ম দ্রুত নিজেদের আভাঁ গার্দ আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চায় ; ১২ ) আভাঁ গার্দ আন্দোলনের লেজ দীর্ঘ হয় কেননা অংশগ্রহণকারীরা পরস্পরের অচেনা এবং পরস্পরের পৃষ্ঠভূমি ভিন্ন হওয়া সত্বেও দল গড়ে তোলেন ; ১৩ ) সব দেশের আভাঁ গার্দকে বিশ্বায়ন নিজের অন্তর্গত করে ফেলতে চায় ;  ১৪ ) পুঁজিবাদের চাপে অনেকে আভাঁ গার্দ ত্যাগ করে বৈষয়িক সাফল্য চান, যেমন আগেকার কবি-শিল্পীরা রাজ দরবারের সাহায্য পেতেন ।
          পিটার বার্জার ১৯৮৪ সালে লেখা তাঁর  ‘থিয়োরি অফ দি আভাঁ গার্দ’ বইতে রেনাতো পোজিওলির চেয়ে বেশ ভিন্ন তর্কবিন্দু দিয়েছিলেন, যেমন ১) জনারগুলোর পার্থক্য  [ genres ] ছলনাময়, যদিও কবিতা, চিত্রকলা ইত্যাদি নাম দিয়ে তাদের আলোচনা হয় ; ২) শ্রোতা-পাঠক-দর্শকরা কখনও কৌতুহলশূন্য নয় বরং একদেশদর্শী ; ৩ ) ব্যাখ্যাকারী নিজের পক্ষপাত আরোপ করে ; ৪ ) এটা অবশম্ভাবী যে ব্যাখ্যাকারী নিজের কালখণ্ডের প্রেক্ষিতে অতীতকে যাচাই করবে ; ৫ ) ধর্ম অনেকসময়ে বাগড়া দ্যায় কেননা ধর্ম দুর্দশা কাটাবার প্রয়াস করলেও আনন্দ লাঘব করে ; ৬ ) মানুষ যখন বুঝতে পারল যে ধর্ম ব্যাপারটা ছলনাময় তখন সে এর নাম দিল দর্শন [ বিশ্বাস নয় ] ; ৭ ) আদোর্নো যদিও বলেছেন যে আভাঁ গার্দের কোনো অভীষ্ট নেই, পিটার বার্জার বলেছেন যে আভাঁ গার্দের অভিষ্ট হল আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো ; ৮ ) আভাঁ গার্দ যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, পুঁজিবাদের কারণে তাকেই প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে ; ৯ ) আভাঁ গার্দ শিল্প-সাহিত্য ব্যক্তির প্রয়োজনকে অন্তত কাল্পনিক তৃপ্তি দ্যায় যেগুলো প্রতিদিনকার জীবনযাপনে অবদমিত থাকে ; ১০ ) একটি আন্দোলনের সঙ্গে আরেকটি আন্দোলনকে মিশিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়, তা করলে তাদের উদ্দেশ্যকে গুলিয়ে ফেলা হবে ; ১১ ) ডাডা আন্দোলনের কোনো শৈলী ছিল না, তার ছিল উদ্দীপনা ও তত্ত্ব, এবং আঁভা গার্দ অভিধার তারাই জন্মদাতা, তারা প্রতিটি সংস্হার বাইরে নিজেদের রাখতে চেয়েছিল ; ১২ ) ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন যে যান্ত্রিক যুগে শিল্প-সাহিত্যকে গ্রাহ্য করায় প্রভূত পার্থক্য ঘটে গেছে, কেননা তা এখন যতো ইচ্ছে উৎপাদন হয় ; ১৩ ) শিল্প-সাহিত্য এখন মুনাফার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কবিতা খাপ খায় না ; ১৪ ) রাজনৈতিক না হলে আভাঁ গার্দ হয় না ; ১৫ ) শিল্প-সাহিত্য প্রতিদিনের জীবন থেকে আলাদা, তা ম্যাজিকাল, তার প্রতিটি কারুকাজকে একসঙ্গে গ্রথিত করা হয়, জঘন্য ধারণার মতো কবিদের একসঙ্গে থাকা উচিত ; ১৬ ) শিল্পসাহিত্য তার কার্যকরী মূল্য খুইয়ে ফ্যালে তখন তা শিক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ; ১৭ ) নাগরিক তার প্রতিদিনের জীবনে ‘কর্মচারী’ হিসাবে ক্ষুদ্র হয়ে গেছে ; শিল্প-সাহিত্যে তাকে ‘মানুষ’ হিসাবে খুঁজে পাওয়া যায় ; ১৮ ) সংস্হাগুলো তাদের অন্তর্ভুক্ত কাজকেই কেবল শিল্প-সাহিত্য বলে মনে করে -- এটা নান্দনিক কারণে ঘটে না, সামাজিক কারণে ঘটে ; ১৯ ) সত্যকার আঁভা গার্দ শিল্পী-সাহিত্যিক সিস্টেমকে ভেঙে ফেলতে চান, অবশ্য আজকের দিনে আধুনিক শিল্পী দুশঁর পক্ষে তা কঠিন হতো কেননা তিনি সিস্টেমকে ভাঙলেন অথচ তার অন্তর্গত হয়ে গেলেন [ হাংরি জেনারেশনের শৈলেশ্বর ঘোষ শেষ বয়সে সিস্টেমকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ] ; ২০ ) সংস্কৃতি এখন ইনডাস্ট্রি যার দরুন শিল্প-সাহিত্যকে খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাজার ; ২১ ) রেডিমেড জিনিসকে শিল্প-সাহিত্যে বদলে ফেললে তা শিল্প-সাহিত্য থেকে মুক্ত হয়ে যায় ভাবা ভুল, কেননা রেডিমেড ব্যাপারে শিল্পের অভিব্যক্তি খুঁজে পায় ব্যক্তি ।
          আভাঁ গার্দ সম্পর্কিত আলোচনা পুনরুজ্জীবিত হল থিয়োদোর আদোরনোর সমর্থনের দরুণ । সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্যের একটা বড়ো অংশ তখনও এবং এখনও যেহেতু বুর্জোয়াজিকে কুন্ঠিত ও হতবুদ্ধি করে, আদোরনো যুক্তি দিয়ে প্রথাগত নান্দনিক মূল্যবোধ ও আঙ্গিকের পক্ষে বৌদ্ধিক বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছিলেন । কিন্তু যাঁরা শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহ্যে কেবল নতুনত্বের জন্যই নতুনত্ব আনতে চান, এবং যাঁদের কাজের প্রধান উদ্দেশ্য হল শক দেয়া আর স্ক্যাণ্ডালাস হওয়া, তাঁদের উচিত নয় আদোরনোকে আশ্রয় করে নিজেদের সমর্থন আদায় করা । যেমন, স্ত্রাভিনস্কির ‘রাইট অব স্প্রিঙ’ এর প্রথম অনুষ্ঠানকে আদোরনো আভাঁ গার্দের স্বীকৃতি দেননি, কেননা তা ছিল ‘লোকতাত্বিক’ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মতৃপ্ত । স্ত্রাভিনস্কির সেই অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবিরোধিতা ছিল না এবং তা আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি ।   
          বিশ শতকের যে কাজগুলোকে আদোরনো আভাঁ গার্দের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাতে ছিল আমাদের নিজেদের মধ্যেকার এবং জগতসংসারে অবস্হিত যা কিছু  প্রিমিটিভ বা আদিম । এই আদিমতার কারণেই আফ্রিকার ভাস্কর্যের প্রতি পিকাসোর আকর্ষণ কিংবা মনদ্রিয়ানের ছবি আঁকায় কেবল রেখার প্রয়োগ । সেই সময়ে পাশ্চাত্য জগত জড়িয়ে পড়েছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের হত্যালীলায়, ঔপনিবেশিক  একীকরণ আর দ্রুত পণ্যায়নে, ফলে ডুবে যাচ্ছিল সেই একই বুনো সভ্যতায় যা কাটিয়ে ওঠা নিয়ে তারা এককালে গর্ব করত । আদোরনোর মতে, সমাজের আত্মসংরক্ষণ সমাজ-অনুমোদিত আত্মত্যাগ থেকে    পার্থক্যহীন হয়ে গিয়েছিল : যা আদিম মানবের মধ্যে, অহং-এর আদিম দিকগুলোয় পাওয়া যায় । আদোরনোর আভাঁ গার্দ তত্ত্ব বাস্তবের এই আদিম বৈশিষ্ট্য থেকে উৎসারিত হয় ; প্রিমিটিভ বৈশিষ্ট্যকে যা দাবিয়ে রাখে তার বিরোধিতা করে আভাঁ গার্দ ।  এই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতি, দর্শন, সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে আদোরনো জীবনভর বলেগেছেন যে “আত্মসংরক্ষণের লড়াইয়ের চেয়েও জীবনের কাজ অনেক বেশি।” আদোরনো তাঁর ‘নেগেটিভ ডায়ালেকটিকস’ ( ১৯৬৬ ) বইতে লিখেছেন যে এই তর্কে আত্মসংরক্ষণ “ইতিহাসের এতাবৎ মান্যতার বাইরে সর্বনাশের নিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়।”    
          আভাঁ গার্দকে সমর্থনে আদোরনো ‘আগে থেকে পাওয়া’ ব্যাপারকে গুরুত্ব দেননি । আভাঁ গার্দকে ‘নতুন’ হতে হবে । উনি বলেছেন যে সিরিয়াস সঙ্গীতকে, সিরিয়াস শিল্পের মতনই, একই সঙ্গে নতুন আর  স্বীকৃত উভয়ই হতে হবে ।    প্রকৃত আভাঁ গার্দের গুণগ্রাহীতা আসে ঐতিহ্যকে বুঝতে পারার মাধ্যমে কেননা তা একই সঙ্গে তার থেকে দূরে সরে যায় আবার তার  ধারাবাহিকতাও । ফালতু অথচ অভিনব কিছু সৃষ্টি করা যেমন সহজ তেমনই সহজ অসার ও গতানুগতিক কিছু সৃষ্টি করা । অভিনবতার খাতিরেই অভিনবতা সৃষ্টি করা আর জনগণের বাজারকে খাওয়ার জন্য সৃষ্টি করায় সে ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য থাকে না । নতুন কাজ যতোই শকিঙ হোক, সেই শক কিসের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে তার বোধ না থাকে তাহলে তা হবে বেশ্যাসুলভ । আদোরনোর বক্তব্য থেকে আমরা যা পাই তা হল যে নতুনের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং অমনভাবে তৈরি থাকা তখনই সম্ভব যখন একজন গ্রাহী তার শিক্ষিত প্রবৃত্তির দ্বারা স্বীকার করতে পারবে যে প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকাজটি ঠিক কী । আদোরনোর মতে প্রকৃত সৃষ্টির মানসপ্রতিমার অভিজ্ঞতার অভাব, যার জায়গা নিয়েছে চিত্তবিনোদন বাজারের লালিকা আর রেডিমেড বাঁধাধরা জিনিসপত্র, সেগুলোই প্রাথমিক স্তরে জার্মানদের মধ্যে গড়ে দিয়েছিল সিনিসিজম যা শেষ পর্যন্ত বিটোফেনের মানুষদের বদলে ফেললো হিটলারের মানুষে ।
       বোদলেয়ারের “আধুনিকতাবাদ”-এর প্রেক্ষিতে তাঁর বৌদ্ধিক উত্তরসূরীর কথা বলার জন্য আজকে "অতিরিক্ত-আধুনিকতাবাদ"-এর বক্তব্য রাখতে গেলে একজনকে নিজেকে "উত্তরসমসাময়িক-পরবর্তী" কাঠামোর মধ্যে উপস্হাপিত করতে হবে। জাঁ পল সার্ত্রে যেমন তাঁর জার্নাল Les Temps Modernes-এ বলেছেন,  কবিতাকে সমসাময়িকতার সহজ অত্যাচার ("চরম" বা তার “অভাব”) থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে হবে এবং ভবিষ্যতের বিষয়ে প্রত্যাশা দেওয়ার কথা ভাবতে হবে; কবিতাকে অবিরাম  ভবিষ্যত আবিষ্কার করতে হবে। কবিকে কেবল তাঁর নিজস্ব সমসাময়িকের চেয়ে বেশি হতে হবে, এবং সংক্ষিপ্ত শর্তাবলী, বলা যেতে পারে যে কবিকে ভবিষ্যতের উদ্ভাবন করতে হবে। তাঁর কবিতাকে ভাবতে হবে যে কবিতা কী হতে পারে, তাত্ত্বিকভাবে এবং উপায়ের দিক থেকে তো বটেই,  ভাবের নতুন রূপের দিক থেকেও। সম্ভবত এতে কোনও সমসাময়িকতা নেই, তবে কমপক্ষে এটি কল্পনাশক্তিকে আরও সক্রিয় করবে, আরও বেশি ভালভাবে বেঁচে থাকার নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করার ক্ষমতা এবং আগত বিশ্বের তাৎপর্যের ভিত্তিগুলির কল্পনা করবে। আমরা যদি কবিতার "আধুনিক সমসাময়িক" যুগে প্রবেশ করতে চাই, তবে আমাদের বোদলেয়ারের "আপেক্ষিকবাদী" দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও কিছু যুক্ত করতে হবে । র‌্যাঁবো তাঁর সবচেয়ে অসাধারণ মুহুর্তগুলিতে  "Le voyant" ["ভাবাবেশ"] বলেছিলেন। কবি কেবল তাঁর নিজস্ব "সময়"-এ সীমাবদ্ধ হতে পারেন না । তাঁর দূরদর্শিতার ক্ষমতা থাকতে হবে। কবিতায় স্থায়ী, বাস্তব এবং ভবিষ্যত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
          প্রশ্ন উঠতে পারে যে "আভাঁ গার্দ" সাহিত্য-অভিধার জন্ম কেন বোদলেয়ারের  "আধুনিকতা" সম্পর্কিত বক্তব্যের পৃষ্ঠভূমিতে "সমসাময়িক"কে যুক্ত করেছে । আভাঁ গার্দ-এর  সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল জনগণের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করা এবং তার উন্নতি করা। এটি কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, ইউরোপে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পথও ছিল,  যা সংস্কৃতিবিশেষকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি এবং কিছু সামাজিক উথালপাথালের মাঝেও আভাঁ গার্দ ধারণাটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিল যা জনগণকে এগিয়ে যেতে প্ররোচনা দিয়েছিল। ফ্রান্সে বিপ্লবের পরে আভাঁ গার্দ একটি সফল পরিবর্তন এনেছিল ।  সেই সময় যে লোকেরা রাস্তায় নেমে লড়াই করছিল তারা শিল্প এবং কবিতা সম্পর্কে খুব বেশি জানত না (ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ, ২০০৫ ) আভাঁ গার্দ কবি বা শিল্পীর কাছে প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল তাদের মতামত এবং চিন্তাভাবনা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করার দক্ষতা। ধারণাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি শিল্পের সমস্ত দ্বন্দ্ব এবং সমস্যাগুলি সমাধান করতে এগিয়ে গিয়েছিল কারণ কারুকৃতিগুলো শিল্পীকে তার  দক্ষতা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়। আভাঁ গার্দ ছিল “আধুনিক” ব্যাপার ।  
        ফ্রান্সে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, বিপ্লব ঘটার পরে ১৮৪০ সালে সর্বহারা শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায়  গণতান্ত্রিক চেতনা লগ্নী ও শ্রমের প্রতি বিদ্বেষের ফলে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রের প্রতি মোহিত হয়ে ওঠে। শিল্প সমালোচক ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ তাঁর  "আভাঁ গার্দ ও কিৎশ" প্রবন্ধে যেমন উল্লেখ করেছিলেন: একই সমাজে একই সাথে টি.এস. এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ কবিতার মতো কাজ হয় আবার টিন প্যান অ্যালির গান হয় কিংবা ব্রাকের একটি চিত্রকর্ম এবং একটি স্যাটারডে ইভনিঙ পোস্টের কভার হয়; চারটিই একই সংস্কৃতির অংশ এবং একই সমাজের পণ্য। কলকাতায় যেমন দেখি ‘কোয়ার্টজ পাবলিশারের আভাঁ গার্দ বইয়ের পাশাপাশি স্টার জলসা আর জি টিভির কিৎশিয় সিরিয়ালগুলো । যেমন সাহিত্যের ক্ষেত্রে হাংরি, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, নিমসাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে তেমনই ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে চিত্রকলার ক্ষেত্রে একট আভাঁ গার্দ চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, এরকম বললে অত্যুক্তি হয় না।এবং পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের হাতে তা ক্রমশই আরাে বিকশিত হয়েছে, আরাে সংহতি অর্জন করেছে। এই বিকাশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চিত্রচর্চার সঙ্গে সমান্তরাল হলেও, তা থেকে স্বতন্ত্র। অথাৎ পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের কাজে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা, শিল্পী ভেদে প্রত্যেকের নিজস্বতা সত্ত্বেও, এক সামগ্রিক ঐক্যের ইঙ্গিতবাহী; আর সেই ঐক্যের যে বিশেষ ধরণ, সেটা অন্যান্য অঞ্চলের শিল্পীদের প্রকাশভঙ্গি থেকে একটু আলাদা।  গণেশ পাইন, রবিন মণ্ডল, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকারের আঁকা ছবিগুলোর পাশাপাশি বাংলা আর হিন্দি সিনেমার পোস্টার । অবনী ধর, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল মিশ্র, সুভাষ ঘোষ-এর ন্যারেটিভের পাশাপাশি পণ্যসাহিত্যের ন্যারেটিভ । প্রথম দিকে আভাঁ গার্দ একটি বিমূর্ত বা অযৌক্তিক শিল্পের মতো বিকাশ করা হয়েছিল যা মানুষের চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি প্রকাশ করবে। আভাঁ গার্দ ধারণাটি শক্তিশালী হবার কারণ এটি মানুষকে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে বা এমনকি “সৃষ্টিকর্তাকে” ছাপিয়ে যাবার সদিচ্ছা প্রদান করে ।
         সাহিত্য-শিল্পকে পণ্যায়নের প্রেক্ষিতে স্লাহভয় ঝিঝেক সম্প্রতি এই সম্ভাবনার বিষয়ে চিন্তা করে বেলেছেন যে বর্তমান পুঁজিবাদকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা সম্ভবত দূরদর্শীতার অভাব; তাঁর মতে আমাদের একথা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় যে পশ্চিমা পুঁজিবাদও আমাদের গণতন্ত্র এবং সুখের ধারণা এনে দিয়েছে এবং সম্ভবত এগুলি  অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলোর সাথে সংযুক্ত ; সুতরাং আমরা যদি গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দিই তবে যা জরুরি তা সাম্যবাদ বা একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যবস্থা দ্বারা পুঁজিবাদের প্রতিস্থাপনের আহ্বান জানানো নয় কেননা ওদুটো প্রমাণিত হয়নি যে তারা উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। এখনও পর্যন্ত প্রমাণ হয়নি যে আধুনিকতাবাদী কবিরা বোদলেয়ারের প্রস্তাবিত মডেলের তুলনায় "আরও ভাল" হতে পারে এমন সৃষ্টিধারা প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বোদলেয়ারের পাঠবস্তুগুলো প্রতিষ্ঠানের ভাষার সমসাময়িক, এবং সমস্ত আধুনিক গণতন্ত্রের বিশ্বজুড়ে সেটাই ঘটে গেছে । আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে যে হিটলরিয়ান ফ্যাসিবাদ "অবক্ষয়ের শিল্প" নামের কাজকে সেন্সরযোগ্য মনে  করেছিল এবং কমিউনিস্ট সরকারগুলো "পাতি বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের" ধারণাটি আবিষ্কার করেছিল। আর ধর্মের ধ্বজাধারীদের কথা বাদ দিন কেননা আমরা জানি ধর্মীয় উৎসাহ সাহিত্য-শিল্পকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় আগেও মেতেছিল আর এখনও তাই করে চলেছে, কারণ তাদের ধর্মভিত্তিক নৈতিক শৃঙ্খলার সাথে মানায় না বলে মনে করেন ধ্বজাধারীরা। পশ্চিমবঙ্গে অনিল বিশ্বাস এককালে এইরকম ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন । হিন্দুত্ববাদীরা বহু শিল্পীর কাজের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে, হুসেনকে তো দেশছাড়া করেছিল ।
      আরেকটি জিজ্ঞাসা হল  যে "আভাঁ গার্দ" সাহিত্যে-অভিধার জন্ম কেন বোদলেয়ারের এই উপলব্ধি থেকে উৎসারিত হয়েছিল যে "আধুনিকতা"র নতুন নান্দনিক বক্তব্যের সাথে "সমসাময়িক"-এর  সম্পর্ক ছিল। নতুন নান্দনিক বোধকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য "আধুনিক" শব্দটি আকস্মিকভাবে বোদলেয়ারের কাছে হাজির হয়নি । ফ্রান্সের সাহিত্যে এর দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে । ১৬৮৮ সালে ফরাসি লেখক শার্ল পেরা ( Charles Perrault ) তাঁর চার খন্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ড “প্রাচীনতা ও আধুনিকতার সমান্তর” প্রকাশ করেছিলেন ( Parallele des anciens et des modernes )। এই বইটি ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে "La querrelle des Anciens et des Moderns" বা “প্রাচীন ও আধুনিকতার বিতর্ক” নামে পরিচিত।  শার্ল পেরা "আধুনিক" দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক ছিলেন এবং বলেছিলেন সমসাময়িক সাহিত্য ক্লাসিকাল সাহিত্যের মতোই ভালো হতে পারে । বিতর্কটি শুরু হয়েছিল যখন শার্ল পেরা তাঁর “লুই দ্য গ্রেটের শতক” ( "Le siecle de Louis le Grand") কবিতাটি তৎকালীন ফরাসি রাজা লুই চতুর্দশকে একজন প্রবুদ্ধ শাসক হিসাবে প্রশংসা করে লিখেছিলেন এবং তাতে বলেছিলেন যে রাজা চারুকলার উন্নতির জন্য এত কিছু করেছেন যে সমসাময়িক কাজগুলো ধ্রুপদী কারুকৃতির তুলনায় উন্নত হয়ে গিয়েছে । প্রতিবাদে বোলেউ-ডেসপ্রা ( Boileau-Despreaux )ও রাসিনে তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন এবং  "প্রাচীন যুগের" সমর্থকদের নেতা হিসেবে, ক্লাসিকাল কারুকৃতির তুলনায় সমসাময়িক শিল্পের আধিপত্যকে অস্বীকার করেছিলেন, আর জাগতিক বিষয়-আশয়ের প্রতি লোভের নিন্দা করেছিলেন, যা  ঘটেছিল শার্ল পেরার ক্ষেত্রে , যিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার স্পষ্ট বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। দুই দলের মধ্যে ঐতিহাসিক কলহের অবশেষে সমাধান হয়েছিল যখন দুই দলের প্রতিনিধি ফরাসি অ্যাকাদেমির সামনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মিটমাট করে নেন । তা সত্ত্বেও, অষ্টাদশ এবং উনিশ শতক পর্যন্ত ফ্রান্সে তার প্রভাব থেকে গিয়েছিল
        বোদলেয়ার সেই সময়ে অনুধাবন করেছিলেন যে আধুনিকতা সম্পর্কিত তাঁর ১৮৫৬ সালের পাঠবস্তুটিতে "আধুনিক কবিতা" ও আধুনিকতাবাদের ধারণাকে পুনরুদ্ধার করার অর্থ কী। অনেকে মনে করেন যে বোদলেয়ারের সমকালীনতার এই বক্তব্যটি আর্তুর র‌্যাঁবোর কাব্যদর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে,  যেমনটি তাঁর কবিতা “নরকে এক ঋতু”র উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন: Il faut etre absolument moderne - “আপনাকে একেবারে আধুনিক হতে হবে।” প্রকৃতপক্ষে যদি কেউ র‌্যাঁবোর উদ্ধৃতিটি গভীরভাবে পাঠ করে, তবে তা ( anti-phrase ) "বিরোধী বাক্যাংশ" হিসাবে দেখা যেতে পারে: র‌্যাঁবো তাঁর সমসাময়িকতাকে অপছন্দ করতেন, এটা তাঁর কাছে পাতিবুর্জোয়া, মামুলি, মানুষদের বস্তুবাদী সমাজের প্রতি কাপুরুষোচিত আত্মসমর্পণ বলে মনে হয়েছিল।
          যদি প্রকাশ্যে পুরস্কৃত কবিতা ( যেমনটি র‌্যাঁবো তাঁর নিজের সমসাময়িক কবিদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছিলেন : সালি প্রুধোম, ফ্রাঁসোয়া কোপি,, বাঁভিল, প্রমুখ  কবিরা "সমাজের কাছে "ঋণী" হন, তাহলে তাঁরা তো ফালতু বুর্জোয়া মহাবিশ্বের অংশ ছিলেন, যাকে র‌্যাঁবো তুচ্ছ-তাচ্ছ্যল্য করেছেন , তারপরে র‌্যাঁবো "কবিতা" নিয়ে আরকিছু করতে চাননি। "নিজেই নিজের সমসাময়িক" হওয়ার জন্য তিনি  তাঁর সময়ের অংশ হতে পারেন, তাঁর নিজস্ব বিশ্বে থাকবেন, এর প্রসঙ্গগুলো এবং সমস্যাবলীতে মগ্ন হয়ে উঠবেন। যদি, সমস্ত কাব্যিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, বস্তুবাদী কদর্যতার সমসাময়িকতাকে উপেক্ষা করা না যায় , তবে তিনি কবিতাকে ত্যাগ করে  চলে যাবেন ভাগ্যান্বেষণে, তারপরে বাণিজ্যিক ব্যবসায়ী এবং শেষ অবধি রাজা মেনেলিককে তাঁর স্বাধীনতায় সহায়তা করার জন্য বন্দুক চোরাচালানের কাজ করবেন যাতে রাজা ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন । এটিই ছিল র‌্যাঁবোর প্রতি সমসাময়িকতার আহ্বান। র‌্যাঁবোর কাছে “আপনাকে একেবারে আধুনিক হতে হবে” ছিল  নেতিবাচক, তাঁর কাব্যিক "দৃষ্টিপ্রতিভা," অর্থাৎ ভিশন পরিত্যাগ, তাঁর স্বপ্ন এবং কাব্যিক সৃষ্টির জীবনকে ত্যাগ করার বার্তা। 
    "সমসাময়িকতা" ( contemporaneity ) এবং "আধুনিকতা" ( modernity )-র মধ্যেকার  অভ্যন্তরীণ যোগসূত্র একটি নির্দিষ্ট সময়কালে শিল্প বলতে কী বোঝায় তা নির্ধারণের জন্য বিশেষ সময়ে ঐতিহাসিকভাবে একটি মূল গুণক প্রবর্তন করেছিল। ইতিহাসকরণ ( historization ) একটি পর্যায়কালীনতার ( periodization ) জন্য পথ ছেড়ে দিয়েছিল এবং অবশ্যই "আভাঁ গার্দ" ধারণাটি যুগচেতনার অংশরূপে সাহিত্য-শিল্পের ফলাফল হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এর অতিমাত্রার বৈকল্পিকতার কথা যা সার্ত্রে বলেছেন তা ওপরে আলোচনা করেছি ;  লেখকেরা তাঁর সময়ের রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, আদর্শগত বিতর্কে অংশ নেন এবং গড়ে তোলেন "বাস্তববাদী", "হস্তক্ষেপবাদী" শিল্প-সাহিত্য যেমন আজকের সমসাময়িক কাব্য রচনায় ল্যাঙ্গোয়েজ পোয়েট্রি আন্দোলনের লুই জুকোস্কি, বব পেরেলম্যান ও চার্লস বার্নস্টেইন এবং ফ্রান্সের জাঁ মারি গ্লাইজ-এর বিশৃঙ্খলার রচনাগুলো বর্তমান কালখণ্ডের আভাঁ গার্দ। সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আজ যে কবিতাকে সর্বাধিক উদ্ভাবনী বলে বিবেচনা করা হয় তা হল "আপনার সমসাময়িকতা প্রকাশ করুন" ।  "চরম সমসাময়িক" লেখার একটি প্রশংসনীয় অংশ হ'ল দৈনন্দিন জীবনের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এবং উপস্থাপন। এই সময়ের ফরাসি কবি ও তাত্বিক অঁরি মেশোনিক স্লোগান দিয়েছেন - “কবিতায় আপনাকে নিজের সমসাময়িক হতে হবে"।
          ইউরোপীয় ঐতিহ্য এবং মার্কিন সংস্কৃতির বর্তমানবাদের স্বাভাবিক দার্শনিকতায় "রাজনৈতিক" দায়বদ্ধতা সমসাময়িকতার কবিতা হিসাবে সমালোচকদের  স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে "আধুনিকতাবাদ"কে ছাড়িয়ে বা অতিক্রম করে, একটি অনৈতিহাসিক "উত্তর-আধুনিকতাবাদ" ( post-modernism ) ওই প্রবণতার সাথে খাপ খায় এবং এটি প্রত্নতত্ত্ব,  সময়ের ধারাবাহিকতা এবং ঐতিহাসিক সংশ্লেষ ইত্যাদিকে বাতিল করার মাধ্যমে নাটকীয় উপায়ে কার্যকর করে: প্রতিটি উপাদান (কবিতার মাত্রা ও ছন্দ , থিম, চিত্র, শব্দ, গদ্যযুক্তি ইত্যাদি) যে উত্তর-আধুনিক কবিতা বা গদ্যে উপস্হাপন করা হয় তা তাৎক্ষণিকভাবে "সমসাময়িক" হিসাবে স্বীকৃতি পায় । রক্ষণশীল আলোচকরা সেহেতু উত্তর-আধুনিকতা কে মান্যতা দিতে চান না, যেমন তাঁরা আভাঁ গার্দকেও স্বীকৃতি দিতে চান না । হাংরি জেনারেশন আজ বাংলা সাহিত্যপাঠের বিষয় । ছাত্রদের সেকারণে ‘আভাঁ গার্দ’ ধারণাটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি ।

No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...