Tuesday, May 26, 2020

Malay Roychoudhury Quote

তুমি যাকে ঘৃণা করছ সে যদি তা জানতে না পারে তাহলে ঘৃণা করার কোনো মানে হয় না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

পরস্পরের ভাষা না জানলে, সঙ্গমের রহস্য আরও গভীর হয়ে ওঠে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

প্রকৃত সুন্দরীর দিকে দ্বিতীয়বার তাকালে সৌন্দর্যের পরিভাষা যৌনতায় পালটে যায় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

মানুষ পৃথিবীর প্রতি অপার বিরক্তি নিয়ে জন্মায়; তাই সে জন্মেই কাঁদতে আরম্ভ করে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

অপবাদ আকর্ষণ করার ক্ষমতা না থাকলে জীবদ্দশায় একজন কবির খ্যাতি বৃথা ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যেকোনো ব্যাপার তোমাকে নষ্ট করে দিতে পারে, তা অসাধারণ কবিতা হোক বা অপরূপা প্রেমিকা
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন বিভাগে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্যাঙাত হয়ে পেছন-পেছন হাঁটছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় । আমায় দেখে হাত তুললেন, অর্থাৎ দ্যাখো, আমি কোথায় পৌঁছেছি । দেখলুম । জানি না ওনার মৃতদেহ নন্দন চত্ত্বরে রাখা হয়েছিল কিনা, একুশ বন্দুকের সেলামি দেয়া হয়েছিল কিনা । ওনার প্রতিদ্বন্দ্বী সুনীলের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল, আর শক্তিকে শ্মশানে সেলামি দেয়া হয়েছিল ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কখনও সাহিত্য-আলোচকদের মনের মতন লেখার চেষ্টা করা উচিত নয় । নিজের মনের মতন লিখতে গেলে রিস্ক নিতেই হবে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সৌরমণ্ডলের বাইরের মানুষদের কথা যখনই চিন্তা করা হয়, তখন তাদের কুৎসিত দেখানো হয় কেন? তারা হয়তো ঐশ্বর্য রায় বচ্চন আর ঋতিক রোশনের চেয়ে ভালো দেখতে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

পৃথিবীতে বসবাস করার মতো জায়গা আর রইলো না । এরকম জায়গা মগজে আসতে থাকলে, বুঝতে হবে মৃত্যু বেশ কাছাকাছি
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কতোগুলো অঘটন মগজে পূঞ্জিভূত হলে একটা কবিতা চিন্তায় খেলতে আরম্ভ করে?
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কোনো-কোনো কবিতা মধু খেয়ে, ফেলে চলে যাওয়া, মৌমাছির চাকের মতন । মধুর খোঁজে মোম প্রাপ্তি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আমার মতের সঙ্গে তোমার মত মিলুক ; তোমার মতের সঙ্গে আমার মত মিলুক--এই ভাবনা থেকেই চাড্ডিতন্ত্র বা মোল্লাতন্ত্র ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

তোমার লিঙ্গও সঠিক সময়ে তোমার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করতে পারে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

ক্ষমা করার আগে গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত 
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

এই বয়সে কোনো যুবতী ভালোবাসার প্রস্তাব জানালে অমঙ্গলের আশঙ্কায় আক্রান্ত হই ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

জীবন সম্পর্কে সব কথা বলা প্রায় অসম্ভব কেননা বাংলা ভাষায় তার জন্য সঠিক অভিব্যক্তি এখনও পাওয়া যায় না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আমি ভাগ্যবান যে আয়নাকে ঘৃণা করার দরকার হয় না । আমার টাক পড়েনি; কখনও পড়বেও না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

মানব সম্প্রদায়ের মুক্তির তাত্বিকরা শেষ পর্যন্ত গণহত্যাকারীতে রূপান্তরিত হয় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সবচেয়ে বাজে আবিষ্কার হল লাউডস্পিকার, বিশেষ করে যখন তা সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের দানব হয়ে ওঠে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কবিতা মনের বিশৃঙ্খলাকে কয়েদ করে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

প্রতিটি শব্দেই যদি ক্রিয়া লুকিয়ে থাকে, তাহলে একটিমাত্র সত্য বলে কিছু হয় না; যা হয় তা হল কর্ম । ক্রিয়াপদে নিহিত থাকে কর্মশক্তি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বাংলা সাহিত্য অর্থবহ ‘পাবলিক ইডিয়ম' গড়ে তুলতে পারেনি, যেমনটা জয়েস একা পেরেছেন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আদালতের জজরাই যখন সন্দেহের ঊর্দ্ধে নন বলে বিধায়করা দাবি করছেন, তখন সাহিত্যের বিচারকরা কোন যুক্তিতে সন্দেহের ঊর্দ্ধে?
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

ব্যর্থ বিপ্লবী বিদেশে গিয়ে মার্ক্সের কবর দেখতে যান । ব্যর্থ কবি বিদেশে গিয়ে বদল্যারের কবর দেখতে যান।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

এককালে যারা অবক্ষয়বিরোধী ছিল তারাই বঙ্গসমাজে অবক্ষয় নিয়ে এলো ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বক্সিং ম্যাচ যারা দেখতে যায় তারা হার-জিতের মাধ্যমে জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজে
---মলয় রায়চৌধুরী

অলোক গোস্বামী : হাংরি আন্দোলনের নেতৃত্ব ও মামলা

বইমেলা থেকে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরলাম। কাঁধে করে নিয়ে এলাম ক্ষুধার্ত পত্রিকা এবং ক্ষুধার্ত লেখকদের বইপত্র। মাথার ভেতর ঠেসে আনলাম অরূপ বাণী--হাও টু বি এ গুড প্রতিষ্ঠান বিরোধী ( ওরফে ক্ষুধার্ত)। শুধু মাথায় রাখাটা যেহেতু যথেষ্ট নয় তাই সেসব জ্ঞান উগরে দিলাম যে যার কলমে। প্রকাশিত হোতে শুরু করলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।যথারীতি বিজ্ঞাপনের তোয়াক্কা না রেখে পকেটের টাকায়।
মনোজ রাউতের ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হলো শৈলেশ্বর ঘোষের প্রবন্ধ সংকলন, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য।’ অরুণেশ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ,‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা।’ গাঁটের একটা কড়িও না খরচ করে বই প্রকাশের মত মহান ঘটনা দুজনের জীবনেই সেই প্রথম।
যথারীতি তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল উত্তরবঙ্গের সাহিত্য জগতে। আমাদের ভেতরে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনরুত্থানের ভূত দেখতে থাকলো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের প্রতিহত করা যায় সেসবের পরিকল্পনা ভাঁজা শুরু হলো। সে এক উৎকট পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠানের স্ব-নিযুক্ত দালালবৃন্দ না পারছে আমাদের অস্বীকার করতে, না পারছে স্বীকার করতে।
ঘটনা প্রবাহ যেদিকে চলছিল তাতে হয়তো সত্যি সত্যিই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনারুত্থান ঘটে যেত এবং নকশাল আন্দোলনের মতো উত্তরবঙ্গই হোত তার এপিসেন্টার। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘটনা গড়ালো উল্টো দিকে! ক্ষুধার্তদের বই/পত্রিকা যত পড়ি তত বিভ্রান্তি বাড়ে। আবিষ্কার করি, সুভাষ এবং শৈলেশ্বরের চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকা বিস্তর ফারাক! প্রদীপ চৌধুরীর পত্রিকা পড়ে বিভ্রান্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। অরুণেশ ঘোষের লেখাপত্র থেকে সেই বিভ্রান্তি বেড়ে দাঁড়ায় চৌগুণ। সুবো আচার্য তো শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিশ্বরূপ দর্শন করছেন! সুবিমল বসাক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। কেন?
ভাবনায় পড়ে যাই, কোনটাকে বলব ক্ষুধার্ত চেতনা! কেউ লিখছেন প্রতিবাদের সাহিত্য কেউ বলছেন প্রতিবাদ নাকি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়! কেউ একগাছা দড়ির এক প্রান্ত নিজের কোমরে বেঁধে অন্য প্রান্ত অসীমের কোমরে বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তো অন্য জন গা-গতরের শব্দ ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে! কেউ লিখছে জাদুবাস্তববাদী গল্প কেউ বলছে লেখাকে মিথ, মেটাফর, অ্যালিগরি মুক্ত করতে। যামু কই? একজন ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করছেন, অন্যজন সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করে বলেছেন, ক্ষুধার্ত চেতনা যার যার তার তার। বেশ। মেনে নেয়াই যেত কিন্তু তাহলে ক্ষুধার্ত সাহিত্য ওদের ঘোষনা মোতাবেক আন্দোলন হয় কিভাবে! বিচ্ছিন্ন কর্মসূচিকে আন্দোলন বলা যায়?
আমাদের এই দোলাচলের মাঝে ঘটে গেল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাহিত্য সমুদ্রে মাথা চাড়া দিলো সাবমেরিন মলয়।মলয় রায়চৌধুরীকে সাবমেরিন বলার কারণ মামলার নিষ্পত্তির পর মলয় রীতিমত ডিক্লেয়ার করে ক্ষুধার্তদের সঙ্গে যাবতীয় সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন এবং জীবিকার উন্নতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু উনি যে তলে তলে আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেটা বোঝা যায়নি।
সব জানপহেচান চুরমার করে দিতে ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকায় ভেসে উঠলেন মলয়।এবং কামান দাগলেন। খানিকটা চুনসুরকি খসে পড়লো। উঁকি দিলো ইটের সামান্য অংশ। জানা গেল, শৈলেশ্বর ঘোষ নয়, মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন ওই আন্দোলনের মূল হোতা। জানা গেল, ক্ষুধার্তদের অনেকেই হাজতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নিয়েছিলেন। এবং সে কারণেই মলয় রায়চৌধুরীর জামিন মিলতে ঝামেলা হয়েছিল।
সামান্য চুনসুরকির খসে পড়া থেকে খানিকটা জানা গেল বটে কিন্তু মানা গেল কি? না। সেটা সম্ভবও নয় কারণ একেই তো ভিন্ন ইতিহাস জানছি অন্যদিকে জানা ইতিহাসের মালিকরা চোখের সামনে। সেদিক থেকে মলয় রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ অচেনা। তার ওপরে আবার বাড়তি বোঝা মলয়ের উৎকট বুক চাপড়ানি। তাছাড়াও ওই লেখায় এত আঙসাঙ কথা ছিল যে চট করে বিশ্বাস করতে অসুবিধেই হয়েছিল।
হয়ত খামতিটা মলয়ও বুঝেছিলেন তাই পরের মিসাইলটা দাগলেন ডঃ উত্তম দাশের হাত দিয়ে। ডঃ দাশ তার ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তাতে মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করলেন মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র। কেস ডায়েরি, মুচলেকা, সাক্ষদান পর্ব, আদালতের রায়, সবকিছুর সার্টিফায়েড কপি এই প্রথমবার প্রকাশ্যে এলো। ফলে এই বিস্ফোরণটির তীব্রতা ছিল মারাত্মক। প্রকৃত সত্য জানাজানি হয়েছিল। আমরাও বুঝলাম একদা শৈলেশ্বর দ্বারা পেশ করা তথ্যের পুরোটাই ছিল গোঁজামিলে ভরা।
মহাদিগন্ত পত্রিকাটা আমার হাতে এসেছিল অদ্ভুত ভাবে। এবার সেই গল্প।
কোচবিহার থেকে অরুণেশদাকে নিয়ে আমি, রাজা, মনোজ রওনা দিয়েছিলাম মাথাভাঙার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ মাথাভাঙা কেন? কারণ পৃথিবীতে ওটাই একমাত্র স্থান যেখানে অরুণেশদা খুব স্বচ্ছন্দ থাকতেন। এই স্বাচ্ছন্দ যোগানোর দায়ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছিল মাথাভাঙা বয়েজগণ। কারা তারা? তারা প্রায় প্রত্যেকই বিখ্যাত কবি। যেমন নিত্য মালাকার,সন্তোষ সিংহ, অনুভব সরকার, কমল সাহা।

নবদ্বীপ থেকে মাথাভাঙায় গিয়ে থিতু হওয়া নিত্য মালাকারের কবি পরিচয় বাংলা কবিতা জগতের প্রায় সবাই জানেন। জানেন সন্তোষ সিংহের কথাও। তবে সন্তোষদা সম্পর্কে একটা বিশেষ তথ্য হয়ত অনেকের জানা নেই সেটা হলো স্বপ্নে পাওয়া বেশকিছু কবিতা নিয়ে একটা বই আছে সন্তোষদার যার ভূমিকা লিখেছিলেন ডঃ অশ্রুকুমার সিকদার।
সবচে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো স্বভূমিকায় এরা প্রত্যেকে উজ্জ্বল হওয়া সত্বেও এদের অরুণেশ অনুরাগ ছিল অসীম। প্রায় শেষদিন পর্যন্ত অরুণেশ ঘোষকে ওরা ভালোবাসা দিয়েছেন। সব রকম ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণেশ ঘোষের।
বিষয়টাকে আশ্চর্যজনক বলার কারণ অসূয়াক্লিন্ন সাহিত্য পরিবেশে এমন প্রীতি সহজে চোখে পড়ে না। বলাবাহুল্য অরুণেশদারও যথেষ্ট প্রিয়স্থান ছিল মাথাভাঙা, তা তিনি যতই বলুন না কেন জটেশ্বরের বেশ্যাপাড়ার পরিবেশই ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম স্থান।
মাথাভাঙার কথা বলতে গিয়ে আরও একজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে--সুব্রত রায়। কবিতা লেখা এবং কবিতা কেন্দ্রিক জীবন যাপন, দুটো নেশাতেই বুঁদ ছিল। এমন ছেলের কাছে অরুণেশ ঘোষ যে একমাত্র অনুসরণযোগ্য কবি হবেন তাতে আর সন্দেহ কিসের?
বেশীদিন কবিতা লিখতে পারেনি সুব্রত। বেঁচে থাকলে তো লিখবে? আত্মহত্যা করেছিল। হয়ত আরো আগেই কাজটা করে বসতো নেহাত সন্তোষদা প্রতিনিয়ত তার প্রিয় ছাত্রটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন তাই কিছুদিন বাড়তি আয়ু পেয়েছিল সুব্রত।
আমরা অনন্য, ফালগুনি এবং এরকম আরও কিছু নাম জানি কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ওরকম কত যুবক যে উন্মাদের মতো সাহিত্যকে ভালোবেসে সর্বস্বান্ত হয়েছে তাদের খবরও রাখি না! আজ মনে হয়, সাহিত্যকে বোধহয় পরস্ত্রীর মতো ভালোবাসতে হয়। কামনা যতই উদগ্র হোক তাতে বাধ্যতামূলক ভাবেই খানিকটা সংযম বজায় রাখতে হয়।এই সম্পর্ককে কখনও পরিণতি দিতে চাইতে নেই, চোরাগোপ্তা আকর্ষণটুকু বজায় রেখে চলতে হয়।
থাক তত্ত্বকথা, ওই সফরেই অরুণেশের ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে।
কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। 
 সেদিনই তথ্য প্রমাণে জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে।


Monday, May 25, 2020

Malay Roychoudhury Quote

"পবিত্র বই" আর "অপবিত্র বই"-এর পার্থক্য হল যে "অপবিত্র বই" কেবলমাত্র কবিরাই লিখতে পারেন
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

গ্ল্যামারের আকর্ষণ হল ক্যাটওয়াকের শেষে যুবতীদের সমবেত ঘামের গন্ধ, যা অত্যন্ত দামি পারফিউম দিয়েও চাপা পড়ে না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সকলেই ভাবে ‘পৌঁছে গেছি' । পেছন ফিরে তাকিয়ে টের পায় যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কেউ আমাকে ঘৃণা করলে তা উপভোগ করি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

পশুরা জানতেই পারল না যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

ধর্ম যে উদ্দেশ্যহীন এবং ভাঁওতা তা সবচেয়ে ভালো করে জানে সেই বুড়োগুলো যারা নারী ও কিশোরদের মানববোমা তৈরি করে পাঠায় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

প্রগতির একরৈখিক ধারণা প্রিমিটিভ ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

"প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটি হল Confessions of pain; যে কবিরা এই কবিতাটিকে হিংসে করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে আমার যন্ত্রণাবোধকে হিংসে করেন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায় উন্মদের মস্তিষ্কে, অথচ উন্মাদনা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

তুমি যদি নার্সিসিস্ট না হও, তাহলে তুমি আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কবি নও ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

ভালো মানুষের পক্ষে ভালো বন্ধু পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

মরে গেলে আত্মার সদ্গতির জন্য শোকপ্রকাশ করবেন না; আমার আত্মা নেই । আমার গ্রন্হগুলোর আত্মা আছে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কবিতার উৎস কোনো-না-কোনো রহস্য যার উন্মোচন অন্য উপায়ে সম্ভব নয় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

গাঙচিল নামে এক প্রকাশনা সংস্হার কর্ণধার আমাকে বললেন যে, "আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোয় না, তাই প্রকাশ করতে পারব না ।" সুনীলের চেয়ে বুদ্ধদেব কি বেশি বিকোয় ??
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যার নির্বাণ কিংবা মহানির্বাণ ঘটে সে তা জানতে পারে না । তাহলে নির্বাণ বলতে কী বোঝায়?
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যোনিকে ফর্সা করে তোলার বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখি টিভিতে । যোনি কালো হোক বা ফর্সা তাতে প্রেমিকের কীই বা এসে যায়!
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

জোয়ার, ভাটা, এল নিনো, নিম্নচাপ, ঘূর্ণাবর্ত, বন্যা! জলের অসুখ হল প্রকৃতির জলাতঙ্ক ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সব ধর্মের পুরোহিতরাই নানা বস্তু নিয়ে নানা-রকমের আচরণ করেন । দেখে মনে হয় বাচ্চাদের খেলা । তাই বোধহয় ধর্মগুলোয় নানা খোকোনপ্রিয় গাঁজাখুরি গল্প গড়ে ওঠে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

অন্ধকারে বিছানাকে দুই পক্ষের আরণ্যক বধ্যভূমি করে তোলাই ফুলশয্যা ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

ভারতে অনেক পরিবার হাজার বছর ধরে গরিব । তবু তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় না কেন? জাতপাতের বর্ণবিভাজনের কারণে !
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

রাস্তায় অচেনা মানুষদের ভিড়ে গা-ঘেঁষাঘেষি করে হাঁটার সময়ে একাকীত্বকে যেভাবে উপভোগ করি, সেভাবে একা ঘরের কোনে বসে হয় না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যে লোকটা ভয়ে কখনও কোনো মাদক নেয়নি সে গাঁজাটানার বিরোধিতা করবেই ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

এক-একজন মানুষকে একবার দেখলেই টের পাওয়া যায় তার মগজে সাভানার ঠিক কোন জন্তুদের উৎপাত চলছে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

জীবনে একবার অন্তত আকুল কামলালসায় আক্রান্ত হবার অভিজ্ঞতা জরুরি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

নারীর বুদ্ধিমত্তার সৌন্দর্য্যে পুরুষ প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

কবিতা লিখে ফেলার পর কি মনে করা উচিত যে জান্নাতুল ফেরদৌসে পৌঁছে গেছি ?
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সুভাষ ঘোষ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে বেরোতে পারেনি, হাংরি আন্দোলনের সময়েও। সোনাগাছিতে গিয়ে কারোর ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলতো. লিঙ্গ দাঁড়াচ্ছে না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আইভিএফ করে বউ-এর বাচ্চা হয়েছে । কবির শুক্রসংখ্যা কম । উনি, মানে কবিবর, আর প্রেমের কবিতা লেখেন না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বিশ্বাসঘাতকরা মরবার আগে আত্মসন্মানহীন শিষ্যদের তৈরি করে যায়, যারা মৃতের গোলামি করে বেঁচে থাকে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যে লোক তোমার সঙ্গে ছলনা করেছে সে চিরকাল তোমার বিরুদ্ধে কথা বলবে, এবং সে যদি লেখক হয় তাহলে তোমার বিরুদ্ধে লিখবে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

জীবনে একবার কেউ-না-কেউ পিঠে ছুরি মারবেই, আর সে-আঘাত কখনও সারবে না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য তাদের যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত করা । সউদি আরবে এই প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে কেননা আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্হে কেবল পুরুষের খতনা সম্পর্কে নির্দেশ আছে । ভারতে এখনও আছে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বিষয়-সম্পত্তির জন্য মানুষ-মানুষীর এতো লোভ হয় কেন? ভবিষ্যতের জন্য নয় । যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল তখন গুহার দখলিসত্ত্ব নিয়ে লড়াই করতে হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য । সেই প্রাগেতিহাসিক মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে বেশির ভাগ মানুষের চরিত্রে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যোনির সঙ্গে প্রসববেদনার সম্পর্ক । কিন্তু বহু তরুণী প্রসবযন্ত্রণা ভোগের সুযোগ পান না । আবার, যাঁরা সে-সুযোগ পান তাঁরা তা আবার পেতে চান ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

অনেক পরিচিত মানুষ-মানুষী স্বপ্নে বারবার আসেন, অথচ আমি চাই না তাঁরা আসুন । বোঝা যায় যে প্রতিটি ব্যাপারে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আমি লিখি গল্পহীন গল্প; অনেকে তাকেও ছোটোগল্প বলে মনে করেন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সৃজনশীল মানুষের অধঃপতনের অভিজ্ঞতা হওয়া জরুরি, কেননা তা জ্যোতিষ্কদের হয়, পশুদের হয় না
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

স্বমেহন আর কবিতার একটা যোগসূত্র আছে । দুটোই একই বয়সে আরম্ভ হয় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

টাক ঢেকে রাখার জন্য জুলিয়াস সিজার সব সময় অলিভ পাতার মুকুট পরে থাকতেন, ঘুমোবার সময় ছাড়া । তাঁকে যখন সেনেটররা ছোরা মারছিলেন, তখনও তিনি মুকুট সামলাচ্ছিলেন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

চে গ্বেভারার কবর খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, তাতে ওনার কেটে নেয়া হাত দুটো ছিল না; হাত দুটো সংরক্ষণের জন্য কিউবায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকেও হারিয়ে গিয়েছে ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

যাদের বাড়ির ভেতরেই পায়খানা থাকে তাদের প্রলেতারিয়েত বলা চলে কি?
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বাতাসের ঘ্রাণশক্তি ঝড়কে আমিষাশী করে তোলে । সে মানুষের, জীবজন্তুর, পাখিদের মাংস খেতে চায় ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

দীর্ঘশ্বাস হলো রাতের উড়ন্ত একক দাঁড়কাক
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বয়স হয়ে গেলেও বাসুদেব দাশগুপ্ত সোনাগাছির বেবি-দীপ্তি-মীরাদের মাংসের আকর্ষণ ছাড়তে পারেনি। দাদার কাছে এসে ভায়াগ্রা যোগাড় করে দিতে বলতো ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

দে'জ থেকে একটা "হাংরি জেনারেশন সংকলন" প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শঙ্খ ঘোষের লেখাও অন্তর্ভুক্ত! এই সংকলনে এমন অনেকের লেখা আছে যারা হাংরি আন্দোলনের সময়ে শুক্রকীট ছিল ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

মারাঠি কবি অরুণ কোলটকার একজন পার্সি তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন । পার্সি সমাজ সেই বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়নি । দুই ধর্মের বিয়েতে ব্যাগড়া দেয় দুটো সমাজ, আর এটা ভারতেই সবচেয়ে বেশি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

চাষিকে খেতছাড়া, মজুরকে কারখানা-ছাড়া, গেরস্হকে ঘরছাড়া করার মাধ্যমে যারা বিপ্লব করতে চায় তারা সময়ের ল্যাঙ খেয়ে কুপোকাৎ হবেই ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বাল বা ঝাঁট অনেকের কানেও হয় । তারা বেশ সন্দেহজনক ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়মিত চুল আর দাড়ি ছাঁটাতে হতো । চৈতন্যদেবকে নিয়মিত দাড়ি আর মাথা কামাতে হতো । অথচ নাপিতদের নামগুলো ইতিহাসে নেই !
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

রাজকমল চৌধুরীর মাহিষী গ্রামে মোষ বলি দিয়ে তার রক্ত মেখে সবাইকে নাচতে দেখে আমিও তাই করেছিলুম । পরে ব্যাপারটা যখনই মনে পড়েছে, ভেবেছি যে কেমন করে আমিও ওই পাল্লায় পড়েছিলুম ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

গাঁজা আর চরস ফুঁকে তার নেশায় যারা আটকে পড়ে তারা মূর্খ । ওগুলো ইচ্ছেমতো ছেড়ে দেয়া যায় । মদের নেশা ধরে ফেললে ছাড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । তবুও ছেড়ে দেয়া যায় । ইচ্ছের জোরে সবকিছু ছেড়ে দেয়া যায়।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

বাবা প্রতিটি চিঠিতে লিখতেন, "ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবি, তাহলে কেউ তোর ক্ষতি করতে পারবে না।" মা কিন্তু কোনো চিঠিতে ঈশ্বরের উল্লেখ করতেন না । মনে হয়, বিশ্বাস করতেন না ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আমার মেয়ে আর নাতনিরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, গরু-শুয়োরের মাংস খায়, আফ্রিকার বুশমিট খায় । আমার ছেলে হিন্দুর যাবতীয় দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করে, যদিও সে আর তার বউও গরু-শুয়োর-কাঙারুর মাংস খায় । ছেলের বউ ভুত-প্রেতেও গভীর বিশ্বাস করে । আমি ওদের সবাইকে বিশ্বাস করি ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

আমার স্ত্রী ভগবানে বিশ্বাস করে কিন্তু ভগবান বলতে যে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা করতে পারে না । গরুর মাংস খায় । খাবার পর বলতে থাকে, গরুর মাংস কেন যে খেলুম ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

পাঁকে হাঁটতে যে ঘেন্না হয় তা পায়ের নয়; তা মগজের ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

সধবার শব সাজাবার বিউটিশিয়ানরা বউ সাজাবার চেয়ে বেশি চার্জ করে মূলত দেহতাপের পার্থক্যের দরুন ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote


Malay Roychoudhury Quote

বয়স হয়ে গেলেও বাসুদেব দাশগুপ্ত সোনাগাছির বেবি-দীপ্তি-মীরাদের মাংসের আকর্ষণ ছাড়তে পারেনি। দাদার কাছে এসে ভায়াগ্রা যোগাড় করে দিতে বলতো ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury Quote

দে'জ থেকে একটা "হাংরি জেনারেশন সংকলন" প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শঙ্খ ঘোষের লেখাও অন্তর্ভুক্ত! এই সংকলনে এমন অনেকের লেখা আছে যারা হাংরি আন্দোলনের সময়ে শুক্রকীট ছিল ।
---মলয় রায়চৌধুরী

Thursday, May 21, 2020

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : "হে স্ফূর্তিনাথ"


মগজে-হৃৎপিণ্ডে যতি কমা কোলোন সেমিকোলোন
জন্মসূত্রে পাওয়া, ঙ চন্দ্রবিন্দু অনুস্বার বিসর্গ
জড়ো করে রাখা আছে । কে জানে কখন কার নির্দেশে
রক্তের স্রোতে মিশে গিয়ে ওদের কোনো একজন
বাটারফ্লাই সাঁতার কাটতে থাকে স্ফূর্তির মজায়--
খেয়ালই করে না আমি চিৎ বা উপুড় হয়ে নাক বা
পেচ্ছাপের সঙ্গে রক্ত বের করে উলটে পড়ে আছি
জ্ঞানহীন হয়ে । হে স্ফূর্তিনাথ, তুমি শ্বাসের মারপ্যাঁচ
রক্তের স্রোতে রঙিন মাছের মতো কেন ছেড়ে দাও?

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : আমার অন্তর্জলী যাত্রায় কুমারী অবন্তিকা


( র ), যিনি ছিলেন স্বৈরাচারী একনায়ক
       সোভিয়েত দেশের ( স ) ডিকটেটরের চেয়েও কড়া ডোজের
চিনের ( ম ) ডিকটেটরের চেয়েও মনমৌজি বউদিপাগল
পলপটের চেয়েও পল পল দিলকে পাস
              তাঁর আগের কতোগুলো ( ক ) দের হাপিশ করে দিলেন
তার হিসেব পাওয়া গেল
( ব-১ ),  ( ব-২ ), ( স-১ ), ( অ ) দের তেলংদেহি থোড়া থোড়া
      কিন্তু এনারা কেউই যোনি কেমন জানতেন কি না তা লিখে যাননি
তা লেখার জন্য এলেন আরেক স্বৈরাচারী একনায়ক ( জ )
       ইনি মাঝাসাজে লাবণ্যময়ী যোনি দেখেছিলেন
আর ডিকটেটরশিপ ভরিয়ে দিলেন যোনিতে
              তাঁকে সিংহাসন থেকে ঠেলে ফেলতে ( র ) গান গাইতে গাইতে
উদয় হন
ওরে, তোরা   নেই বা কথা বললি,
     দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী
মরিস মিথ্যে ব'কে ঝ'কে,   দেখে কেবল হাসে লোকে
     নাহয়   নিয়ে আপন মনের আগুন মনে মনেই জ্বললি
অন্তরে তোর আছে কী যে   নেই রটালি নিজে নিজে
     নাহয়   বাদ্যগুলো বন্ধ রেখে চুপেচাপেই চললি
কাজ থাকে তো কর্‌ গে না কাজ,   লাজ থাকে তো ঘুচা গে লাজ,
     ওরে,   কে যে তোরে কী বলেছে নেই বা তাতে টললি

ডিকটেটর ( জ ) কখনও গান গাইতেন না
               কেননা অন্যের দুঃস্বপ্ন কেড়ে নিজেই দেখতেন
              হুঁ হুঁ বাওয়া আমি কিন্তু কাড়তে দিইনি
নিজের দুঃস্বপ্ন নিজের স্টকেই রেখেছি
কখনও সখনও বের করে দেখে নিই
             আমার আগে কেউ শেকড়ের খিদে আবিষ্কার করতে পারেনি
কেড়ে নেয়া দুঃস্বপ্নের পেছনে দৌড়োতে দেখা গেল ( স-২ ), ( শ-১ ), ( শ-২ )
           ( উ ), ( স-৩ ), ( শ-৩) আরও অনেকে
জন্মের সময়ে তাঁদের দুর্গা টুনটুনি মধু খাবার জিভ বের করেনি
ডিকটেটর ( জ ) কে যতো নামাতে চেষ্টা করেন
            ততো বাড়ে বিষাদবায়ু, অবক্ষয়বায়ু, শোষণবায়ু
কিন্তু যোনির আর দেখা মিলল বটে তবে তা
যেতে যেতে চুপি চুপি
তাহাদের শ্রেণী যোনি ঋণ রক্ত রিরংসা ও ফাঁকি
উঁচু-নিচু নরনারী নিক্তিনিরপেক্ষ হ’য়ে আজ
মানবের সমাজের মতন একাকী
তাই অক্ষতযোনি নিয়ে আমার অন্তর্জলীযাত্রায় নাচছে অবন্তিকা
           ক্রিমেটোরিয়ামে শুয়েও টের পাচ্ছি ঘাড় থেকে ডিকটেটর ( জ )কে
নামাতে পারলেও ডিকটেটর ( র ) নিজের লাশের ভেতর থেকে
                      বেরিয়ে আসছেন দেখার জন্য
                 এই ব্যাটা মামুলি নগরভোটার আমি
                              আধারকার্ডিওলজিস্ট আমি
আমি সত্যিই মরে গেছি কিনা
             আসলে অবন্তিকা যতোদিন শ্মশানে নাচবে ততোদিন
অন্তর্জলীযাত্রায় থাকবো
                  কেননা অবন্তিকা বলেছে
এখানে গঙ্গাজল পাওয়া যায় না
                কেবল ডিলডো পাওয়া যায়
যা ডিকটেটর ( র ) আর ডিকটেটর ( জ ) দু্জনের কেউই জানতেন না

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : বৃত্ত-নৃত্য


করোনা ভাইরাস পুং তুমি তো নিজেই
মৃত্যু-নিরপেক্ষ ছিলে
এবার সঙ্গে করে নিয়ে এলে
একচক্ষু উলঙ্গ প্রেমিকাকে
যে তার এলোচুল উড়িয়ে বৃত্ত-নৃত্যে
গোড়ালি ঘুরিয়ে তুলল
সমুদ্র-মেশানো নোনা ছুটন্ত উচ্ছ্বাস
বজ্র-ডমরুর আতঙ্কধ্বনি : ওঁ স্বাহা--
তোমাদের সন্ত্রাসে সবকিছু নিরপেক্ষ
এমনকী ধর্ম, জাতি, দেশ, গাঁ ও শহর,
সাধু আর চোর, জানোয়ার, সুন্দরী গাছেরা ।
.
মানুষের বিরুদ্ধে বদলা নিতে
প্রকৃতি তোমাদের পাঠিয়েছে উচিত শিক্ষা দিতে--
কিন্তু মানবসমাজ কোনোদিন কি বদলাবে ?

Tuesday, May 19, 2020

হাংরি আন্দোলনে যোগ দেয়া সম্পর্কে অলোক গোস্বামী

একটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে আচমকাই পরিচয় ঘটেছিল রাজা সরকার, সমীরণ ঘোষ এবং মনোজ রাউতের সঙ্গে। যদিও ওদের সচরাচর কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে দেখা যেত না তবু তিনটে মুখই আমার পরিচিত ছিল। সেটাই স্বাভাবিক, শহরে কজনই বা লেখালিখি করতো! জানা ছিল ওদের পত্রিকার নাম কুরুক্ষেত্র, ঋত্বিক এবং ধৃতরাষ্ট্র। ওরা আমাকে গুরুত্ব দিতো না জন্য আমিও ওদের এড়িয়ে চলতাম। সেদিন কিভাবে যেন দূরত্বটা ঘুচে গিয়েছিল! অনুষ্ঠান শেষে আমরা চারজন দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। শুধু সেদিন নয়, তার পরের দিনও। এমন কী তার পরের পরের পরের দিনও। অবশ্য দিন না বলে সন্ধ্যে বলাটাই সঠিক হবে।
আড্ডা দিচ্ছি বটে কিন্তু টের পাচ্ছি তেমন জমছে না। আমার লেখালিখি নিয়ে ওদের তিনজনেরই কোনো মাথাব্যথা নেই। ওদের লেখাপত্র নিয়ে আমি মাথা খাটাতে চাইছি বটে কিন্তু হালে পানি পাচ্ছি না কারণ ওদের লেখালিখির ধরণ ছিল আমার ঘরানার চে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। এমন কিছু শব্দ সেসব লেখায় থাকত যেগুলোকে এতদিন অশ্লীল বলেই মেনে এসেছি।তাছাড়াও পুরোটাই এমন খিটকেলে ধরণের যে চাইলেও এগোনো যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে বন্ধুত্বও এগোনর কথা নয়। আচ্ছা, দেখা হবে, এরকম কিছু একটা বলে উঠে পড়া এবং ভবিষ্যতে ওপথ না মাড়ানোটাই ছিল স্বাভাবিক পন্থা। কিন্তু তেমনটা হলো না। কেন? জানি না। কে জানে, পুরোন দিনের গল্পে যেমন থাকত, বিধাতা অলক্ষে দাঁড়াইয়া হাসিলেন, প্রথমদিনের আলাপের ক্ষণে হয়ত তেমন কিছু ঘটেছিল! হয়ত কেন, আলবত ঘটেছিল। নাহলে আমি কেনই বা একতরফা ভাবে প্রতি সন্ধ্যেয় হাঁ করে ওদের কথা গিলে যাব? কেনই বা ওদের পরামর্শ মোতাবেক নিজের পাঠক্রম বদলে নেব!
রাজা, মনোজ এবং সমীরণের সঙ্গে যে ততদিনে হাংরিদের যোগাযোগ ঘটে গিয়েছে, সেটা কিন্তু তখন জানতাম না। অবশ্য জেনেই বা কী হোত, আমি তো হাংরি আন্দোলন কী বস্তুু সেটাই জানতামই না!
ওদের সুবাদে পরিচিত হলাম হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে। পড়লাম সুভাষ, শৈলেশ্বর, ফালগুনি, প্রদীপ, বাসুদেব, অরুণেশদের লেখাপত্র। পড়ে কাঁচামাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। এর নাম সাহিত্য! সেই কবে থেকে সাহিত্য পড়ে আসছি, সেসবে যৌন বিবরণও যথেষ্টই ছিল কিন্তু খানিকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এরকম সরাসরি নয়। পড়ে শরীর কিছুটা গরম হোত। কিন্তু এরা যেন চামড়া তুলে নিয়ে লালাভ শরীরটা দেখাচ্ছে। পড়তে গিয়ে গা ঘুলিয়ে ওঠে ! ভাবি, এসবও যদি সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে থাকে তবে তা কখনই সরস্বতীর আশীর্বাদ পুষ্ট হোতে পারে না বরং অভিশাপগ্রস্ত বলা যেতে পারে। হয়ত সে কারণেই এদের জেল জরিমানা ঘটেছিল।
তবে এদের ভেতরে বাসুদেব দাশগুপ্তর লেখাপত্র খানিকটা টেনেছিল। ওর টেকনিকে খানিকটা মুগ্ধতা জেগেছিল। মনে হয়েছিল সর্বাংশে অভিনব। তাবলে বাসুদেবের সব লেখাই যে ভালো লেগেছিল, তা নয় কেননা কিছু গল্পকে পূর্বদোষেই দুষ্ট মনে হয়েছিল।
দুঃখ পেয়েছিলাম। আচ্ছা, যাদের এত পড়াশোনা, কলম যাদের এতটা শক্তিশালী তারা কেন শব্দ সচেতন নন! অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে কি সুখ পান? কেন লেখেন এমন? বিশেষ করে অশ্লীলতার দায়ে রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার পরও!
এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পড়লাম ওদের সাক্ষাতকার এবং প্রবন্ধগুলো। চোখের সামনে থেকে বন্ধ জানালা খুলে গেল। জানলাম, সাহিত্য নিছকই বিনোদনের মাধ্যম নয়। বরং বিনোদনের সাহিত্য এক আফিম। পাঠক রুচি নামক ইওটোপিয়াকে সামনে রেখে শিল্প সংস্কৃতির যে বেসাতি চালু আছে তার মূল উদ্দেশ্য শুধুই মুনাফা নয়,জনচেতনাকে দাবিয়ে রাখাও। সাহিত্য এবং জীবনকে একই মুঠোয় ধরতে হয়।
জানলাম, সত্য যদি শিব হয়েও থাকে কিন্তু সেটা আদৌ সুন্দর নয়। তাছাড়া সত্য কখনও একমাত্রিক হয় না। বরং জীবনের মূল সত্যকে গোপন করতেই কলাকৈবল্যবাদ কিংবা প্রগতিশীলতার তত্ত্বের জন্ম।
এতদিন জানতাম, লিটল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠানের আঁতুড় ঘর। এখানে হাঁটতে শিখে কবি/লেখকবৃন্দ দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে প্রতিষ্ঠানের বারান্দায়। ব্যস, খোলা বারান্দায় এরপর যতখুশী নাচানাচি, জাগলারি, হাতসাফাই দেখানোর অনন্ত স্বাধীনতা। বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে পাঠককূল সেসব দেখে জীবন সার্থক করে তুলবে। ওই ভিড়ের মধ্যে থাকা কয়েকজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক কলার তুলে বলবেন, বন্ধুগণ, ওই যে প্রোদুনোভা ভল্ট স্পেশালিস্টকে দেখছেন, উনি আমার সাপ্লাই।
এবার জানলাম,লিটল ম্যাগাজিন কোনো সমান্তরাল সাহিত্য সৃষ্টির আখড়া নয়, বরং প্রচলিত সাহিত্যের বিপরীতে এর অবস্থান। লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আরেকটি শব্দ ওতপ্রোত জড়িত- আন্দোলন। যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য,পাঠককে সচেতন করে তার প্রত্যাশা বাড়ানো। লিটল ম্যাগাজিন বাজারি রুচির তোয়াক্কা তো রাখেই না বরং তেজস্ক্রিয় ভাষা মারফৎ প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কারণ প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণা সব সময়ই ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। জীবনের তলা থেকে উঠে আসে না। গা গতরের ভাষা ব্যবহার করে ভাষাকে এলিটিজম থেকে মুক্ত করাটাই লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান কাজ। পাঠককে ঘা মেরে জাগাতে ভাষা সন্ত্রাস ঘটাতে হবে। একমাত্র সেভাবেই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা যাবে। পরিচিত হলাম নতুন শ্লোগানের সঙ্গে, প্রতিবাদের সাহিত্য।
কিন্তু কেমন হবে সেই সব লেখাপত্র? পড়লাম,মানিক-জীবনানন্দ-জগদীশ-সতীনাথ-শান্তিরঞ্জন-অদ্বৈত-দস্তেয়ভস্কি- মিলার- জেঁনে- র‍্যাঁবো- বারোজ - কামু- কাফকা। পড়লাম মার্কসবাদ সংক্রান্ত কিছু লেখাপত্রও। কারণ একমাত্র মার্কসবাদই তাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণ করেছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিছকই আবেগ সঞ্জাত কোনও রোমান্টিক আগ্রহ নয়। এর সুস্পষ্ট আর্থ- সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। একমাত্র মার্কসবাদীরাই জানে, বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে যুক্ত করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা অসম্ভব।
জানলাম, বুঝলাম কিন্তু মেনে নিলাম কি? যদি মেনে নিয়ে থাকি কেন নিলাম? এসব কূট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফের নিজের প্রসঙ্গে ফিরতে হবে। ত্রুটি মার্জনীয়।
এমন এক পরিবারে জন্মেছি যাদের ঝুঁকি বহির্ভূত জীবন যাপন করে চলাটাই একমাত্র লক্ষ্য। কোনো ঝুট ঝামেলার আভাসটুকু পেলে সঙ্ঘারামে খিল এঁটে বসে থাকাটাই ছিল পারিবারিক রেয়াজ। মনুষ্য জীবন কি খইমুড়ি নাকি যে অহরহ ফুটবে? তার চাই নিস্তরঙ্গ জীবন।সুতরাং স্নেহ-প্রীতি-সম্মান-ভক্তি-শ্রদ্ধা -শৃঙ্খলা, এজাতীয় কিছু শব্দের প্রতি পরিবারের প্রত্যেকের ছিল অন্ধ আনুগত্য। প্রতিবাদ নামক শব্দটার ধার কাউকেই খুব একটা ধারতে দেখিনি।

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : "লকডাউনে দেবী-দেবতারা"

“লকডাউনে দেবী-দেবতারা”

ওনারা দেয়ালে, রান্নাঘরের তাকে, ওপরে চৌকাঠে
যেমনটি আমার স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউ নিজেদের
পছন্দের চাকরি পাবার, পাশ করবার, বিদেশে যাবার
আরাধ্য ও আরাধ্যাকে রেখেছিল কয়েক দশক আগে
তেমনই আছেন কিন্তু লকডাউনের জেরে ধুলোয় এমন
ঢাকা যে বোঝার উপায় নেই তিনি কোন দেবী বা দেবতা--
বুড়ি স্ত্রী তো খাটতে পারছে না রান্নাবান্নার পর । আমি
ফুলঝাড়ু দিয়ে ওনাদের ধুলোর মাস্ক খোলর প্রয়াস
করেছি একদিন, তবে পাইনি অনুমতি নাস্তিক বলে ;
ছেলে ও ছেলের বউ জেনে গেলে কেলেঙ্কারি হবে । যদিও
খুদে মাকড়সাগুলো ওদের থুতু দিয়ে তৈরি করে দিয়েছে
অক্সিজেনের নল যাতে করোনায় ফুসফুস নষ্ট না হয়।
তবুও তেলচিটে পড়ে বোঝার উপায় নেই কোনজন
বুড়ির, কেই বা ছেলের আর ছেলের বউয়ের শুকনো
মালা পরে লকডাউন কাটাচ্ছেন একা-একা । কাজের
মেয়েটি কবে ফিরবেন আর মুক্ত করবেন ওনাদের
তা হায় মাস্ক-পরা দেবী-দেবতারা বলতে অপারগ ।

Friday, May 15, 2020

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : "আমি কে ?"

আমি কে ?
উৎসর্গ : অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়


কী করে জানবো আমি কে ? সংস্কৃত মন্ত্রের গুপ্ত সন্ত্রাসে
ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং দুং ঐং হ্রীং শ্রীং দুং দুর্বোধ্য ইশারায়
দেরিদা-শোষিত যুগে ঘাপটি মেরে নিজেকে প্রশ্ন করি
অর্থ তো বিমূর্ত ও মানসিক ; আমিই আমার মানে !!
উক্তি, বাক্য ও বচনের মধ্যে আমি দিন আনি দিন খাই
যা কিনা মৌলিক বা স্বয়ংসিদ্ধ এবং সাধিত গোপনতা--
বলার ভঙ্গি, স্বরাঘাত ও কণ্ঠস্বর দিয়ে কি আমি গড়া ?
অস্পষ্ট, বিমূর্ত, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে বৈশ্বিক নিমকোষে
হয়তো বা সংজ্ঞা লুকিয়ে আছে দেহ ও দেহের বাইরে
একযোগে ওঁ হ্রীং শ্রীং ক্লীং দুং ঐং হ্রীং শ্রীং দুং হয়ে !!

হাংরিদের পোঁদ মোছার কবিতা : নন্দিনী ধর


   

       
কয়েক সপ্তাহ আগে, ইংরাজি অনলাইন পত্রিকা ‘‘কাফে ডিসেনসাস’’-এ হাংরি আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি কথা লিখেছিলাম। যদিও লিঙ্গ সে লেখার একমাত্র পঠিতব্য বিষয় একদমই ছিল না, হাংরি আন্দোলনের কবিতার অন্তর্গত লিঙ্গ মতাদর্শ একটা বড়ো জায়গা জুড়ে ছিল সে লেখায়। লেখাটি পড়ে আমার থেকে বয়সে ছোট এক বান্ধবী একটি কথা জানায় আমায়। তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড়ো একটি সময় নাকি কেটেছে এক ধরণের ভয়মিশ্রিত দ্বিধায়। ফাল্গুনী রায়ের কবিতা ভালো লাগে না, ফাল্গুনী রায়ের কবিতার ছত্রে ছত্রে সে অতীব সমস্যাজনক পিতৃতান্ত্রিকতার ছোঁয়া খুঁজে পায়।কিন্তু, ঠিক জোর গলায় বলে উঠতে পারেনি এই কথাটি তার অধিকাংশ বন্ধুদের। আমার এই লেখাটি আমার সেই বান্ধবীর জন্য। তার মতো আরও অনেক ছেলেমেয়েদের জন্য। কারণ, এই ভয়ের, এই দ্বিধার স্বরূপ ও প্রকৃতি যে আমারও বড়োই চেনা।
‘‘চন্দ্রগ্রহণ’’ পত্রিকাটির বসন্ত সংখ্যা ২০১৫-র সংখ্যাটিকে বলা যেতে পারে ফাল্গুনী রায় বিশেষ সংখ্যা। ফাল্গুনী রায়, বাংলা সাহিত্যে যাঁরা হাংরি কবি বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের অন্যতম। তাঁর মৃত্যু হয় অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে, আরও অনেক হাংরি বলে পরিচিত কবিদের মতোই বোধহয়। তো, এহেন ফাল্গুনী রায়ের কবিতার সমালোচনা লিখতে গিয়ে জনৈকা শুভশ্রী দাস লিখলেন, ‘‘মফস্বলের কলেজের সাহিত্য স্নাতক আমি কলকাতার স্নাতকোত্তরে আসার আগে ‘হাংরি জেনারেশন’ বা তাদের আন্দোলনের সম্পর্কে কণামাত্রও অবগত ছিলাম না। একেবারে সম্প্রতিক কালেও কলকাতার সাহিত্যমহলে হাংরি যে খুব সোয়াস্তিদায়ক একটি বিষয় নয়, তা বুঝতে সময় লাগে না।’’ তো, বলতে বাধা নেই, আমার অবস্থান শুভশ্রীর ঠিক বিপরীতে। অর্থাৎ, ছোটোবেলা থেকে আমার বেড়ে ওঠার মধ্যে হাংরি জেনারেশনের কবিতা বা লেখালেখি অচ্ছুৎ তো ছিলই না, বরং ঠিক বিপরীত ব্যাপারটিই ছিল তুলনামূলকভাবে সত্য।
আমার চেনা-জানা দাদা-কাকুদের সামনে— যাঁরা অনেকেই তারুণ্য অর্জন করেছিলেন আশির দশকে— হাংরি জেনারেশনের খেলাপত্তর ও দর্শন সৃজনশীলতার একধরনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল তাঁদের সামনে, একভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁদের। তার সাথে ছিল হাংরি কবিদের বিরূদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের গল্প। তাঁদের চটি বই, পত্রিকা। যা কিনা ঠিক বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। অতএব, হাংরি বিষয়টির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল, আন্ডারগ্রাউন্ডের গন্ধমাখা বিদ্রোহের রোমান্টিকতা। অর্থাৎ, আনন্দবাজারীয় সাহিত্যিক আধুনিকতার থেকে বেশ একটু দূরে ‘‘বিকল্প’’ বাংলাসাহিত্য ও তৃতীয় ধারার রাজনীতির সংস্পর্শে বেড়ে উঠতে থাকা আমি হাংরিবাদী লেখালেখিকেই চিনতে শিখেছিলাম আধিপত্যকারী একটি বয়ানরূপে। গল্পটা তাহলে ঠিক কিরকম দাঁড়াল?
এইরকম, যে কোনো সাহিত্য ক্ষেত্রই একশিলাবর্তী হয় না। কাজেই মূলধারার সাহিত্যের যেমন থাকে নিজেস্ব ইতিহাস, নিজেস্ব অনুশাসন, তেমনি ব্যতিক্রমী সাহিত্যেরও থাকে সেসব। তার নিজস্ব নিয়ম, ধারা, মতাদর্শ মেনে। যেসব হয়তো আবার বহু সময়েই গড়ে ওঠে মূলধারার সাহিত্যের অনুশাসনের সাথে অবধারিত সংঘাতের ফলে। অর্থাৎ, বিকল্প বা ব্যতিক্রমী সাহিত্যেরও থাকে নিজেস্ব ক্যানন (canon), নিজস্ব আধিপত্যকারী দর্শন। তাই, একটি বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে শুভশ্রী ও আমার হাংরি-আন্দোলন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বিপরীতমুখী দুই বাস্তবতার গল্প।
তো, যে জগতে আমি হাঁটতে-চলতে, কথা বলতে শিখলাম, সেখানে হাংরি ব্যাপারটিকে অত সহজে নাকচ করা যায় না। ভয় হয়। হাংরি-জেনারেশন-উদ্ভূত পদ্যগদ্য ঠিক ভালো লাগে না বললে যদি বন্ধুরা ভাবে আমি বোকা? কিংবা রক্ষণশীল? কিংবা সামন্ততান্ত্রিক? অযথা নৈতিকতাবাদী? আর কে না জানে, বাংলা বাজারে আঁতেল হতে চাইলে এর কোনোটাই ঠিক হওয়া যাবে না?
কিন্তু, হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই তো আমার নেই। ছয়ের দশকের বহুকিছু — কম্যুনিস্ট পার্টি বিভাজন, চীন-ভারত যুদ্ধ বা নকশালবাড়ির মতোই, হাংরি জেনারেশনও আমার কাছে পরোক্ষ স্মৃতি। একধরনের ঐতিহ্য। ছয় ও সাতের দশকের ইতিহাস। এবং স্মৃতি আর ঐতিহ্যের নিয়মই বোধহয় এই যে মূল গল্প ও তার প্রথামাফিক সমাপনের অনেক অনেক পরেও তারা রয়ে যায় ইতিহাসের এঁটোকাটা হয়ে। তো, যে সব কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়েছি, সেখানে যেমন নকশালবাড়ির এঁটোকাটা হয়ে রয়ে গেলাম আমি বা আমার বন্ধুদের মতো কয়েক পিস, ছড়িয়েছিটিয়ে রইল হাংরি জেনারেশন-গন্ধী বেশ কিছু টুকরোটাকরাও।
তো, সেই হাংরির খণ্ডবিখণ্ডদের চেনা যেত কিভাবে? প্রথমত, কবিতা ও শিল্পপ্রেমের ঘনঘটা। একে তো মধ্যবিত্ত বাংলায় কবিদের অতি-উৎপাদনের একটা সমস্যা আছে। তারপরে হাংরির আঁচ গায়ে লাগলে তো কথাই নেই। কিন্তু, এ জাতীয় কবিতা ঠিক যে সে কবিতা নয়— মানে, এখন যদি আপনি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর গোটা সমগ্র গড়গড়িয়ে আওড়াতে শুরু করেন, তা হলে থোড়াই হাংরি মহলে পাত্তা পাবেন। কবিতা হতে হবে অ্যান্টি-এস্‌ট্যাবলিশমেন্ট, কাউন্টার-কালচারাল। আর, সে কারণেই বোধহয়, এই হাংরি-হাংরি ভাবেদের মুখে ক্ষণে ক্ষণেই শেনা যেত উচ্চারণ— ‘‘রবীন্দ্রনাথের কিছু হয় না’’’, ‘‘শঙ্খ ঘোষ গু লেখে’’’, ‘‘সত্যজিৎ রায় আবার কবে থেকে ফিল্মমেকার হল?’ তো, কাজেই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূলস্রোতের ক্যানন বাদ দিয়ে এস্থলে তৈরি হল অন্য এক ক্যানন— একটু কামু, একটু কাফকা, একটু মার্কেজ, একটু স্যুরিয়ালিজম, একটু ব্রেঁত। একটু জীবনানন্দ, একটু ঋত্বিক, একটু মাণিক। সবই একটু একটু একটু। আর, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পারফরমেন্স হিসেবে থাকল নেশা। তার সাথে আরও যোগ হল একধরনের প্রেমের অভিনয়, একধরনের বিশেষ প্রেমিককল্প ও প্রেমকল্প সৃষ্টির প্রয়াস। তবে, তাতে খুব বেশি ঢুকছি না এখনই। নারী ও যৌনতা বিষয়দুটি বাড়বাড়ন্ত ফণিমনসা ঝোপ—সেখানে প্রায় এই ভারতের মহামিলনের সাগরতীরের মতো নকশাল থেকে হাংরি থেকে চায়ের দোকানের ঠেক— সবার রীতিমতো হাত ধরাধরি ঐক্য। কিন্তু, সে যা হোক, হাংরিগন্ধী হিসেবে আমাদের সময়ে যা আমরা পেলাম তা হল, একধরনের ব্যাপক ডায়ালগবাজির সংস্কৃতি।
কিন্তু, গোল বাঁধল ঠিক এই সময়ে। এই হাংরি নামধারী, গন্ধধারী লেখালেখি বড়ো বোর করত আমায়। প্রথমে ভাবতাম, বোধহয় আমার খামতি। কেননা, এসব হল গিয়ে বড়ো বড়ো আঁতেলদের ব্যাপার। তাই, আবারও পড়ি। আবারো হেব্বি বোর হই। মানে, তখন ওসব চিৎকার করে বলি না বটে। কিন্তু মনে মনে জানি। ভাবি, কোথাও একটা রয়েছে একটা বড় ফাঁক। এই হাংরি শব্দবিশ্বে, তত্ত্ববিশ্বে। তাই, তাৎক্ষণিক চিৎকার করে ছিঁড়েখুঁড়ে না ফেললেও মনে মনে আত্মবিশ্বাস রাখি— এ কবিতা আসলে নয় প্রতিরোধের কবিতা। এ ভাষা আসলে নয় স্থিতিস্থাপকতা-বিরোধিতার ভাষা।
আমার বা আমার বন্ধুদের কলেজে পড়তে আসার সময়টা বড়ো জটিল। ঊনিশশো বিরানব্বুই-উত্তর সে পৃথিবীতে ভেঙে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফ্রান্সিস ফুকোয়ামার বই ‘‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি’’ রমরম করে বিকোচ্ছে বাজারে। গ্যাটচুক্তি সই করেছে ভারতবর্ষ। আর, আমরা কয়েক পিস— মার্ক্সবাদ অপ্রাসঙ্গিক, সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক রবের মধ্যে দাঁড়িয়ে— বিপ্লবীবাম আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। মানে, রীতিমতো মিউজিয়ামের কাঁচের দেরাজে দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠার যোগ্যতা আছে আমাদের আর কী। অ্যানাক্রনিজম আর কাকে বলে !
পশ্চিমবঙ্গে তখন বাম-জমানা। যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির মতো গুটিকতক এলিট কলেজ বাদ দিলে কলেজে কলেজে শাসকদলের পৃষ্টপোষকতা-পরিপুষ্ট এস.এফ.আই। নির্বাচনের নামে প্রহসন, অথবা বিলকুল না-নির্বাচন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্সি-যাদবপুরেও এস.এ–ডি.এস.এ (SA/DSA) সংগঠনগুলি— যার মধ্যে দিয়ে কিনা বহুক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল তৃতীয় ধারার কাছাকাছি থাকা ছাত্ররা— ধুঁকছে তখন। আমরা বিপ্লবী-বাম ছাত্র রাজনীতি করি বটে, কিন্তু মনে মনে সংশয় প্রচুর। হ্যাঁ, সেই সময়টা ছিল আমাদের প্রশ্ন তোলার সময়।
পাতি কথায় বলতে গেলে, সে সময়টাও ঘাঁটা, আমরাও ঘাঁটা। কোথাও একটা বোধ ছিল যে বাস্তবতার মধ্যে আমরা বাস করছি, তার ওপরে দাঁড়িয়ে কোনোদিন গড়ে উঠতে পারে না ইতিবাচক কোনো কিছু। কোথাও একটা আমাদের অনেককেই মার্ক্সীয় চিন্তাধারা একধরনের অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু যে এক ধর্মীয়তা দিয়ে আমাদের অগ্রজদের, পিতৃব্যদের দেখেছি বাম-রাজনীতির ব্যবহার করতে, তা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক আমাদের কাছে। পরিহাসের বিষয়। ওইজাতীয় বিশ্বাস আমাদের নেই। ছিল না। কিন্তু, আবার ছিলও। তাই, আমরা হাজার হাজার নয়, মিছিল করেছি বহুসময়েই আটটি-দশটি ছেলেমেয়ে মিলে। সেখানে ছিল অন্যধরনের এক বিশ্বাস ও যৌক্তিকতা মেলানো-মেশানো  একটা মাটি। সে বিশ্বাসের সাথে ছয়-সাতের দশকের বোধ ও বিশ্বাসের এক দ্বান্দ্বিক যোগাযোগ থাকলেও, খুব মিল নেই। কারণ, ওই যে বললাম প্রথমেই, আমরা ঘাঁটা। এবং, আমাদের কাছে, ছয়-সাতের দশক, বা তারও আগের সময়ের মতো, নেই কোনো রাজনৈতিক হিরোবাজির গল্প।
আর, এই ঘাঁটাপনার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ ঘটে আমাদের সাংস্কৃতিক রূচিবোধে। আমার অনেক বন্ধু-কমরেডরাই মিছিলে গলা খুলে স্লোগান দেয়, ‘‘তেভাগা-তেলেঙ্গানা নকশালবাড়ী লাল সেলাম’’, আবার মিছিলশেষে একত্রে গিটার বাজিয়ে গায়, ‘‘আমি ডানদিকে রই না/আমি বামদিকে রই না/আমি দুইদিকেতেই রই/পরাণ জলাঞ্জলি দিয়া রে’’। এ দুয়ের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব, তা আমাদের পারস্পরিক আলাপচারিতাতেও আসে না। তো, এই নীরবতার মধ্যে দাঁড়িয়েই আমাদের তৃতীয়ধারার বাম ছাত্র-আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পরিধিগুলিতে অলিখিত বৈধতা পেতে থাকে একটি বাস্তবতা। যে বিবিক্তার অভিব্যক্তি— এবং শুধুমাত্র বিবিক্তার অভিব্যক্তিই— হবে আমাদের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার মূল ভাষা। যদিও এই বোধ হয়তো আমাদের বাম-বিপ্লবী শিবিরের সংস্কৃতির মধ্যে ছিল আটের দশক বা তারও আগে থেকে। কিন্তু, তখন এই প্রবণতার অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে, আরও একাধিক দ্বন্দ্বের মধ্যে একটি হয়ে, আরও অনেক ধরনের বয়ানের মধ্যে একটি হয়ে, আমাদের সময়ে সেই একটি বয়ান হয়ে উঠেছিল প্রধান আধিপত্যকারী। বিশেষত, শহরে প্রেসিডেন্সি যাদবপুরের এলিট পরিবেশে লালিত হওয়া একটি অংশের কাছে।
কিন্তু, এই আধিপত্যকারী বয়ানটির কোনো নাম নেই। ছিল না। চালুকথায় আমরা কখনও বলে থাকি আঁতলেমি। কখনো বলে থাকি কামু-কাফকা করা। কখনো এই, কখনো সেই। তো, এই অনাম্নিতার সশব্দতা ভেঙে আমি এই ধারাটির নাম দেব বিবিক্তাবাদ। ইংরেজী করলে যার অর্থ দাঁড়ায় এ্যালিয়েনেশানিজম। সমকালীন এই বিবিক্তাবাদী সাহিত্যের হাত ধরেই আমাদের প্রজন্ম— অর্থাৎ যাঁদের জন্ম ছয় পেরিয়ে, সাত প্রায় শেষ করে আটের দশক ছুঁইছুঁই সময়ে— প্রথম ছুঁয়ে দেখেছে হাংরি-জেনারেশনের ভাবনাচিন্তা ও লেখার ইতিহাস। অর্থাৎ হাংরি জেনারেশনের সাহিত্য ও দর্শনকে আমরা বহু সময়েই চিনতে শিখেছিলাম উত্তর-হাংরি লেখালিখির মধ্য দিয়ে।
অবশ্য, নয়ের দশকের সেই শুরুর দিকে বা মধ্যবর্তী সময়ে, হাংরি জেনারেশনের লেখালিখি নিয়ে এতোগুলো সংকলন বেরোয়নি। ছয় বা সাতের দশকের বিকল্প সাহিত্যের যে বিপুল সংগ্রহশালা, তা আমাদের হাতে এসেছে বিক্ষিপ্তভাবে। এর ওর কাছ থেকে ধার করে, জেরক্স হয়ে। কোনো ছোটো পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হিসেবে। তাই, হাংরি জেনারেশনের কোনো সংসক্ত ইতিহাস সেইভাবে আমি বা আমার প্রজন্মের অনেকেই পাইনি। সেই ইতিহাস আমাদের কাছে এসেছে ছেঁড়া ছেঁড়া, টুকরো টুকরো ভাবে। গল্পে, কথায়-কথায়, গুজবে। কলেজ স্ট্রীট, কফিহাউস চত্বরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো স্মৃতিচারণে। অর্থাৎ, কিংবদন্তী হিসেবে, স্মৃতি হিসেবে। অনেকটা ঠিক যেমনভাবে আমাদের প্রজন্মের অনেকের কাছেই ধরা দেয় নকশালবাড়ির গল্পও।
তো, যতদিনে আমরা এই ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছি, ততদিনে হাংরিরা বিভক্ত। প্রায় নকশালদের মতোই। শৈলেশ্বর ঘোষের শিবিরের লোকেরা মলয় রায়চৌধুরি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের খিস্তি দিয়ে পাতা ভরায়। মলয় রায়চৌধুরী এ্যান্ড কোং কোনো হাংরি লেখালেখির সংকলন বার করলে তার থেকে বেমালুম বাদ যান শৈলেশ্বর ঘোষ। প্রথমেই বলে রাখি, সে সমস্ত গোষ্ঠী-কোন্দলে আমার কোনো আগ্রহ নেই। একটি সুসংহত হাংরি-ইতিহাস রচনা করারও কোনো ইচ্ছে নেই এ লেখায়। বরং, এই লেখা একটি ব্যক্তিগত পাঠের অভিজ্ঞতা। যে বিক্ষিপ্ততার মধ্যে দিয়ে হাংরি রচনাপঞ্জী বিভিন্ন সময়ে আমার হাতে এসেছে, সেই বিক্ষিপ্ত পাঠের ইতিহাসকেই একভাবে সম্মান জানানোর চেষ্টা করেছি এ লেখায়।
তবে, হাংরি বা উত্তর-হাংরি সমসাময়িক সাহিত্যের মূল বয়ান যদি হয় বিবিক্তা, এই ধারার লেখালেখির সাথে আমার সম্পর্কও তো আসলে বিবিক্তারই। লিঙ্গগত প্রশ্নে, শ্রেণীগত প্রশ্নে, মতাদর্শের প্রশ্নে। এই লেখা তাই আমার সেইসব বিবিক্তাবোধ ও প্রশ্নেরই একটি ধারাবিবরণী।
বিবিক্তাবাদ / আমি বড় খারাপ আছি
ছয়ের দশকের হাংরি আন্দোলনজাত আমার প্রথম পড়া কবিতাগুলির মধ্যে একটি হল ফাল্গুনী রায়ের ‘‘নির্বিকার চার্মিনার’’। পাঠকের সুবিধার্থে গোটা কবিতাটিই উদ্ধৃত করলাম নীচে —
মা, আমি আর তোমাদের অভিজাত সমাজের মাজাঘষা বাঁকাহাসি হাসতে পারব না করুণাঘন ঈশ্বরের ক্যালানেকেষ্ট সাদা দাঁত নিয়ে শয়তানের মেধাবী চোখ নিয়ে আমি আর পারব না রামকৃষ্ণীয় ভঙ্গীতে স্ত্রীকে ব্যবহার করতে মাতৃতান্ত্রিক প্রথায় চিনির বদলে স্যাকারিন খেয়ে ডায়বেটিসকে ভয় করতে পারব না অসুখী লিঙ্গ নিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার গায়েহলুদের দিন দেবদাস হতে খালাসিটোলায়
আমার লিভার ক্রমশ পচে আসছে আমার পিতামহর সিরোসিস হয়েছিল হেরিডেটি বুঝি না আমি মদ খেয়ে কবিতা পড়ি আমার বাবা পুজোআচ্চার জন্যে করতেন উপবাস পাড়ার দাদারা ধর্মের দোহাই দিয়ে দোলের দিন টিপে দ্যান পাড়াতুতো বোনেদের মাই
মা বিদেশ ভ্রমণের দিন তোমাদের অভিজাত সমাজের অনেকেই ভদকা গিলেছেন আমি নির্বিকার তোমার চিতা থেকে ধরাবো চার্মিনার— তোমার মৃত্যুর কথা ভাবলে আমার চোখে জল আসে তখন আমি ভূমির ভূমিকম্প কিম্বা জলের জলোচ্ছ্বাসের কথা ভাবি না কুমারী প্রেমিকার শায়ার দড়িতে হাত রেখে আমি বৈষ্ণব পদাবলীর কথা ভাবিনি মা আমিও মরে যাব একদিন
বেলুর মন্দিরে প্রণামরতা এক বিদেশীনির স্কার্ট ঢাকা আন্তর্জাতিক পাইথনপাছা দেখে জেগেছিল আমার সীমাহীন যৌনতা মা তোমার যৌনতা আমৃত্যু বাবার চিতার সঙ্গে লেপ্টে থাকবে বলে আমি তোমায় ঈর্ষা করছি নিরহংকার নিয়ে লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অন্যগ্রহের জীব মনে হচ্ছে এখন আমার মুখের ওপর এসে পড়ছে ডুবন্ত সূর্যের আঁচ আর সূর্যাস্তের রং মেখে পরিবার পরিকল্পনাহীন পাখির দল ফিরে যাচ্ছে বনলতা সেনের চোখের শান্তিময় নীড়ের দিকে— ডিমে তা দেবার সময় এসেছে তাদের
লেখাটির সময় বাংলা ১৩৭৬ সন। অর্থাৎ, ইংরেজী ১৯৬৯। ফাল্গুনী রায়ের বয়স তখন চব্বিশ। তার বারো বছর পরে, ১৯৮১ সালে, মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যু হবে তাঁর। জীবনে খুব বেশি লেখেননি তিনি। বা, বলা যেতে পারে, খুবই কম লিখেছিলেন। খান পঁয়তাল্লিশটি কবিতা। খান ছয়েক গদ্য। আরও অনেক হাংরি (বা বিকল্পধারার) কবি-শিল্পীদের মতোই, তাঁর লেখার কোনো সুনির্দিষ্ট সংগ্রহশালা নেই। কখনও কখনও কোনো কোনো ছোট পত্রিকা বা ব্যাক্তিগত উদ্যেগে তাঁর রচনা সংকলন বের হয়েছে বটে, কিন্তু হলফ করে বলা যায় না যে তাঁর সব লেখাপত্তরই সংকলিত হয়েছে সেখানে।
ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে গেলে, এই বিশেষ কবিতাটির প্রেক্ষাপট নকশালবাড়ি-উত্তর বাংলা, এবং নকশালবাড়ির রাজনীতি খুব প্রত্যক্ষ ভাবেই ছায়া ফেলেছিল ফাল্গুনীর কবিতায়। তো আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে, ‘‘নির্বিকার চার্মিনার’’ কবিতাটির ফর্ম আমাদেরকে যেন একটু ভড়কেই দেয়। এক ধরনের নৈরাজ্য আছে এ ফর্মটিতে। কবিতাসুলভ কোনো পংক্তি বিভাজন নেই এখানে। নেই কোনো দাঁড়ি। দুটিমাত্র ড্যাশ ছাড়া গোটা কবিতাটি যতিচিহ্ন-বিহীন। মানে, গোটা কবিতাটিই হতে পারত একটি গদ্য। এবং তাতে করেও যে খুব ব্যাকরণসম্মত গদ্য হত, এমনটা নয়। অর্থাৎ, ফাল্গুনীর কবিতা একটি সংকর জীব— না-গদ্য,না-পদ্য। অনেকটা যেন ফরাসী কবি র‍াঁবো বা পরবর্তীসময়ের শার্ল বোঁদলেয়ারের লেখা অনুচ্ছেদ-কবিতা। যাকে ইংরেজীতে অনেকেই বলেন প্রোজপোয়েম। আর পড়তে গেলে ফাল্গুনীর কবিতায় আমরা পাই এক ধরনের বিরামহীনতাও। কবিতার কথকের বলার আছে অনেক কিছু। এতো কিছু, যে কথা বলতে শুরু করলে তার একটি বাক্যের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটি বাক্য। যেন, মাতালের প্রলাপ। যে প্রলাপেরও আবার কোনো যতি নেই। এবং, সেই যতিচিহ্ন-বিহীনতাই হয়ে ওঠে ফাল্গুনীর ফর্মজনিত বিদ্রোহের প্রতীক। যে বিদ্রোহ আসলে হাত ধরাধরি করে থাকে বিষয়ের বিদ্রোহের সাথেও। এ প্রসঙ্গে একটি সাধারণীকৃত মন্তব্য করাই যেতে পারে এখানে— এই ফর্মের বিদ্রোহও একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল হাংরি-লিখনচর্চায়।যার শরিক ফাল্গুনীও।
এই ফর্মের বিদ্রোহের সাথে সাথে তাঁর কাছে আমরা পেলাম একধরনের বিশেষ কথকতার বোধ, এক ধরনের বিশেষ লিরিকীয় বৈষয়িকতা— যাকে ইংরেজীতে বলা হয় লিরিক্যাল সাবজেক্টিভিটি। ‘‘মা, আমি আর তোমাদের অভিজাত সমাজের মাজাঘষা বাঁকাহাসি হাসতে পারব না,’’— এই উচ্চারণে আমরা শুনলাম এক ধরনের প্রত্যাখান। মধ্যবিত্ত সমাজের দ্বিচারিতা-ভণ্ডামির প্রত্যাখান। এবং, এই সশব্দ প্রত্যাখানের মধ্য দিয়েই কবিতাটির শরীরে প্রতিষ্ঠিত হল কথকের নিজের আপাদমস্তক মধ্যবিত্ত শ্রেণী-পরিচিতি। এবং এই শ্রেণী-পরিচিতিই হাংরি কবিতার মূলগত শ্রেণী-পরিচিতি। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা আধুনিক সাহিত্যের ঊনিশ শতক থেকে চলে আসা যে শ্রেণী-ধারাবাহিকতা, তার কোনো বেমালুম ভাঙন আমরা দেখলাম না হাংরি আন্দোলনে। তবে, দেখা গেল মধ্যবিত্ততারই এক অন্য অভিব্যক্তি, এক অন্যতার আলংকারিকতা। অনেকটা যেন আপাদমস্তক মধ্যবিত্ত হয়েও মধ্যবিত্ততার বিরূদ্ধে— অর্থাৎ নিজের বিরূদ্ধে—বিদ্রোহ।
‘‘নির্বিকার চার্মিনার’’ তাই হয়ে উঠল একাধারে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের ভণ্ডামির মূর্ত রূপ, তার তালিকা ও সেই ভণ্ডামি-প্রত্যাখানের ইস্তেহার। এই ইস্তেহার-ধর্মিতা হাংরি কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য। যদিও, সারা পৃথিবীতে শুধু হাংরি-কবিতাতেই এই বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে এমনটি আমি দাবী করছিনা। কিন্তু, একধরনের ইচ্ছাকৃততার রাজনীতি আছে হাংরি কবিতার তালিকাধর্মীতাতেও। অর্থাৎ, এটা বুঝতে আমাদের কারো খুব অসুবিধে হয় না যে ফাল্গুনীর কবিতা ফুলফলগাছপাতার কবিতা নয়। ফাল্গুনীর কবিতা শুধুই স্বতঃস্ফূর্ততার কবিতা নয়। ঘাড়ে সরস্বতী ভর করল, আর কবি সরসর করে লিখে চললেন, সৃষ্টিশীলতা বিষয়ে এমন সহজ কথা ফাল্গুনীর কবিতা বলে না। বরং, ফাল্গুনীর কবিতায় আছে মাপা মাপা পা ফেলা, হিসেবে করা দেদার সামাজিক সমালোচনা।
আর, দেখলাম, এই কবিতাতে বাঙালী মধ্যবিত্ত রোমান্টিকতার বিনির্মাণ। রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে প্রেম, ব্যর্থ প্রেমিকের দেবদাস প্রতিমূর্তি ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচলিত বিষয়গুলির যে আধিপত্যকারী উপস্থাপন, সেগুলিকে এক-এক করে ভাঙা হল। ভাঁজ খুলে খুলে দেখানো হল সেই রোমান্টিকতার ভেতরের কঠিন, হিংস্র বাস্তবতাকে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা পেলাম একটি ছবি— ‘‘পাড়ার দাদারা ধর্মের দোহাই দিয়ে দোলের দিন টিপে দ্যান পাড়াতুতো বোনেদের মাই’’। পেলাম আরও একটি ছবি— ‘‘মা বিদেশ ভ্রমণের দিন তোমাদের অভিজাত সমাজের অনেকেই ভদকা গিলেছেন আমি নির্বিকার তোমার চিতা থেকে ধরাব চার্মিনার”। আর, এই মাতৃশোকের বিনির্মাণ লিখতে দিয়ে ফাল্গুনী নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন বিশ্বসাহিত্যের এক ধরনের বিবিক্তাবাদি সাহিত্যের বংশলতিকায়। প্রিয় পাঠক, মনে পড়ে আলবেঁয়ার কামুর ‘‘ল অঁত্রেঞ্জার’’ উপন্যাসের নায়ক মারসঁকে? মার মৃত্যুতে যে কাঁদেনি একফোঁটাও? পরবর্তীসময়ে তার এই না কাঁদতে পারাকেই ব্যবহার করা হয় তার বিরূদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে। অর্থাৎ, কামুর উপন্যাসের ঠিক সাতাশ বছর বাদে লেখা ফাল্গুনীর কবিতায় মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির প্রতীক হিসেবে যে প্রক্রিয়া ও ছবি আমরা দেখলাম, তা ততদিনে বিশ্বসাহিত্যে বহুলচর্চিত। এবং এই চর্চিত ছকেই মোটামুটি এগোল অন্যান্য হাংরি লেখালেখিও।
যেমন ধরুন সমীরণ ঘোষের ‘‘কর্তব্যহীন কুকুরের সঙ্গে’’ কবিতাটি:
কর্তব্যহীন কুকুরের সঙ্গে আমার তিনবার দৃষ্টি বিনিময় হল
রাস্তার প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় পরস্পর বিরোধী
বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছি হয়তো ফিরে যাওয়াও
বলা যায় কোনো অতর্কিত আক্রমণের আশংকা নেই
সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধি ও বর্ণমালা ব্যবহারে
‘ভালবাসা’’মৃত্যু’ এইসব শব্দ নিয়ে প্রতিনিয়ত
বেলাভূমিতে খেলাধুলো হয় এই মাত্র
অপরাধপ্রবণ একটা শূন্য হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি
অন্যটি দিয়ে পৃথিবীর চিবুক আদর করে
নাড়িয়ে দিয়ে বলছি, ‘বালা, নাচো তো দেখি’’—
কবিতাটিতে আছে তিনটি মূল ছবি। প্রথমটির কেন্দ্রে একটি কুকুর, যার সাথে তিনবার দৃষ্টি বিনিময় হয় কবিতার কথকের। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট। এবং সেই প্রেক্ষাপটে পকেটে হাত দিয়ে কথক। বাকি যা যা কবিতাটিতে বলা হয়েছে, তা পাঠকের কাছে মূর্ত হয় কথকের বিবৃতির মধ্যে দিয়ে। সে বিবৃতিতে বিশেষণের ছড়াছড়ি। তাই, আমরা জানি, কথকের হাতদুটি ‘‘অপরাধপ্রবণ’’। পকেট ‘‘শূন্য’’। আর, এই বিশেষ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে আমরা পাঠক হিসেবে অবগত হই কবিতায় দৃশ্যমানতার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। জানতে পারি, আমাদের আবেগগত বৈষয়িকতা (emotional subjectivity) ব্যতীত আসলে সব চিত্রকল্পই অর্থহীন। তাই, কবিতাটিতে আছে একধরনের প্রগলভতার নন্দনতত্ত্ব। যে প্রগলভতায় ভর করে— প্রতিটি চিত্রকল্পকে বিশেষণে বিশেষণে মুড়ে— কবি তার পাঠককে বলে দিতে চান কেমন করে পড়তে হবে, ব্যাখা করতে হবে এইসব চিত্রকল্প। এই প্রগলভার দর্শন, পাঠককে চীৎকার করে শ্রতলিপি দিতে থাকার দর্শন আসলে আবার হাংরি কবিতার সাধারণীকৃত দর্শনও বটে। বলা যেতে পারে, সমীরণের এ কবিতায় চিত্রকল্পের তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কুকুর, শূন্য পকেট, ল্যাম্পপোস্ট— এসবই বিশ্বসাহিত্যে নাগরিক অবসাদ বোঝাতে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে কবিতায়, গল্পে। সেই ঊনিশ শতক থেকে। শুধু কবিতাতেই বা কেন, সিনেমায়, স্থিরচিত্রে, গল্প, উপন্যাসে। তাই, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এ কবিতা একধরনের গতানুগতিকতায় পরিপূর্ণ। ইংরেজীতে যাকে আমরা বলি ক্লীশে। কাজেই, কোথাও এই ক্লীশে-জর্জরিত কবিতা আমাকে বড়ো বোর করে, ক্লান্ত করে। আর, এই বোর হওয়ার যে বোধ, তার কোনো বাংলা হয় না।
আরও বোর হই যখন পড়ি এই লাইনটি— ‘‘‘ভালোবাসা’, ‘মৃত্যু’ এইসব শব্দ নিয়ে প্রতিনিয়ত / বেলাভূমিতে খেলাধুলো হয় এই মাত্র’’। আমি বুঝছি কি বলতে চাইছেন কবি। তার সাথে আমার কোনো রাজনৈতিক মতবিরোধ নেই এই বিষয়ে। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কী, একধরনের প্যাঁচপেঁচে নীতিবোধ ছাড়া আর কিছু আমি এই লাইনদুটিতে দেখতে অক্ষম। না, কোনো বিশ্লেষণ নয়, কোনো জটিল চিত্রকল্প নয়— একধরনের মধ্যবিত্ত নৈতিকতা আর হাহাকারের চাপে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে এই কবিতাপংক্তি-দুটি। একটু ঘেঁটে দেখলে যা দেখা যায় তা হল, এইজাতীয় মধ্যবিত্ত নৈতিকতার ঘোষণায় সশব্দ হাংরি কবিতার ঐতিহাসিক ভাণ্ডার। না, আমি ঠিক একথা বলতে চাইছি না যে হাংরি আন্দোলন দাঁড়িয়ে আছে কোনো একবগ্গা একশিরালতার উপরে। কিন্তু, তৎসত্বেও দেখা যায় মধ্যবিত্ত বাঙালী নৈতিকতাকে ভেঙে চুরমার করার ক্ষেত্রে হাংরি কবিতার মূল অস্ত্র কোনো জটিল সমাজতাত্ত্বিক চোখ নয়, বরং একধরনের অতীব সহজ নীতিবাক্যের সমাহার। ইংরেজীতে  যাকে বললেও বলা যেতে পারে ‘কমনসেন্সিক্যাল নলেজ’। সন্দেহ নেই, এই নীতিমালা আমাদের সামনে হাজির হয় এক ক্রোধের মুখোশ, বিদ্রোহের মুখোশ পরে। যৌবনের ক্রোধ, যৌবনের বিদ্রোহ। কিন্তু, সে মুখোশ টান মেরে খুলে ফেললে যা থাকে তা হল, নীতিজর্জরিত, নীতিজীর্ণ জ্ঞানমালা। এবং, এই নীতিমালাই যেহেতু মূল ভরসা, তাই যে মূল মধ্যবিত্ত নীতিবোধকে এই ক্রোধ বা বিদ্রোহ সমস্যায়িত করতে চাইছে, তার থেকে এই মূলগত বিদ্রোহী চেতনার তফাত খুব বেশি হয়ে ওঠে না।
বলা যেতে পারে, সমীরণের কবিতা একধরনের আত্মসচেতনতার কবিতাও। তাই, কবিতাটি পাঠকের সামনে হাজির করে তার নিজস্ব বিদ্রোহের একধরনের তত্ত্বায়নও। তাই, যখন সমীরণ লেখেন, ‘‘রাস্তার প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় পরস্পর বিরোধী / বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছি হয়তো ফিরে যাওয়াও/বলা যায় কোনো অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কা নেই’’’, তখন তাঁর কবিতার শরীরে ছায়া পড়ে কবিতার সমকালের। সমীরণের জন্ম ১৯৫২ সালে। যদিও এই কবিতার সালতারিখ জানা যায় না, বুঝে নিতে অসবিধে হয় না কবিতাটির রচনাকাল, নকশালবাড়ি-পরবর্তী বাংলা। বিশেষত ‘‘অতর্কিত আক্রমণ’’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার তুলে নিয়ে আসে আমাদের সামনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনুষঙ্গ। কিংবা, নকশালবাড়ি-পরবর্তী, ১৯৭৭-পরবর্তী মৃত্যুর মতো শান্তিময় রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার যে পরিবেশ। আর, তার সাথে সাথে কবিতাটির শরীরে মাথা তুলে দাঁড়ায় হতাশ, বিক্ষুব্ধ— অথচ স্থিতিস্থাপকতাবাদী— কথক। যার কাছে এগিয়ে ও পিছিয়ে যাওয়া আসলে সমার্থক। সমীরণের কবিতা তাই হয়ে ওঠে এক ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতার কবিতা।একথা মনে হওয়ার সাথে সাথে ভাবার চেষ্টা করি, অন্য কোনো ব্যাখ্যা কি হতে পারে এ কবিতার?
মানে, এও তো হতে পারে পারে, সমীরণের কবিতার ভাষা আসলে একধরনের তির্যকতার অভিব্যক্তি, শ্লেষের অভিব্যক্তি। যেমন ধরুন, কবিতার শেষ তিনটি পংক্তি: ‘‘অপরাধ প্রবণ একটা হাত শূন্য পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি/অন্যটি দিয়ে পৃথিবীর শূন্য চিবুক আদর করে/নাড়িয়ে দিয়ে বলছি, ‘বালা, নাচো তো দেখি’’— ’’। অস্বীকার করা যায় না, এই লাইনগুলিতে খোদাই হয়ে আছে বাস্তবতার ওপর আঘাত। কিন্তু, সেই আঘাতের চাপে কবিতাটির শরীরে ঘটে না তো কোনো বিস্ফোরণ। শেষপর্যন্ত তাই কথক থেকে যান সেই দর্শকের স্তরে। এক জন শ্লেষ-ঘর্মাক্ত, সচেতন দর্শক। তবু দর্শক তো। নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক। সক্রিয় কর্মী নন। কজেই, সমীরণের কবিতাটি রয়ে যায় ব্যর্থতার তথ্যগাথা হয়ে।
সেই ব্যর্থতার পদাঙ্ক অনুসরণ করলে দেখা যাবে যে, কবিতাটিতে বিবিক্তা বিষয়টি নিজেই একটি রাজনৈতিক একক। বিবিক্তা এখানে কোনো সূচনাবিন্দু নয়, নয় কোনো সমাপ্তিরেখার মধ্যপথ। সে নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক দর্শন। যে যে দর্শন তার ভাষাগত অবয়ব বারবার খুঁজে পায় হাংরি কবিতার যতিচিহ্নহীনতায়, পংক্তিবিভাজনে। হাংরি কবিতার অন্যতম মূল দর্শন ও ভিত্তিগত রাজনীতি তাই হয়ে ওঠে বিবিক্তা-উদযাপন। উদাহরণ দেওয়া যায় হাজার হাজার। তবু একটু বিশেষ করে বলি। নেড়ে চেড়ে দেখুন সুবো আচার্যর ‘‘জাগো স্বপ্নহীন’’ কবিতাটি।
‘‘জাগো, স্বপ্নহীন’’ শুরু হয় একটি ঘোষণায়—
‘‘যে জগতে জেগে উঠি সে জগৎ রক্তের —
আকাশে নির্বাক কালপুরুষ— বিস্তৃত আকাশে
গভীর নীলিমা আছে ছড়ানো আকাশে একা শুয়ে
রক্তের পৃথিবী আর পৃথিবীর রক্তের সমূহ আঁধার একা,
যে জগতে জেগে উঠি সে জগৎ স্পষ্টতই স্বপ্নভাঙার— ’’
হ্যাঁ, যে পৃথিবীতে হাংরি কবিতার জন্ম হয়েছিল, সে পৃথিবী সত্যিই তো এক স্বপ্নভঙ্গের পৃথিবী। স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ। বামপন্থার স্বপ্নভঙ্গ, বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গ। এ পৃথিবী আমার চেনা, আমার বন্ধুদের চেনা। এবং, মার্জনা করবেন, পাঠক, এ তালিকাটির জন্য কোনো হাংরিদের বাংলা সাহিত্যের প্রয়োজন হয়নি। মানে, যে রবীন্দ্রনাথকে খিস্তি করে ভূত ভাগিয়েছে হাংরি কাকুরা (এবং নকুরাও), সে রবীন্দ্রনাথ একাই যথেষ্ট। তো, এই তমসাতালিকা পড়তে পড়তে তাই প্রশ্ন করতে বাধ্য হই— সে তো বুঝলাম। কিন্তু, তারপর?
মানে, ছয়ের দশক মানে তো শুধু স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস নয়। স্বপ্ন গড়ারও ইতিহাস। ভিয়েতনাম। খোদ আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন। ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি। বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলন। সেজার শাভেজ। আমেরিকা-মেক্সিকোর বর্ডার জুড়ে কৃষক আন্দোলন। লাতিন আমেরিকা। আফ্রিকার দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তির দাবিতে লড়াই। নারীবাদী আন্দোলন। বিকল্প যৌনতার অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা। পুরনো বামপন্থা ভেঙে নতুন বামপন্থার উদ্ভব। সে সবের অস্তিত্বকে মাথায় রেখেই বোধহয় সুবোর শেষ কয়েকটি পংক্তি— ‘‘মাঝে মাঝে টের পাই আমারই বুকের মধ্যে চন্দনের গন্ধমাখা / স্বপ্নপৃথিবী, মনে পড়ে চূড়ান্ত জ্যোৎস্নায় প্রান্তরের মধ্যে /এক কালসর্প ফণা তুলে আছে— /এক ভয়াল সুন্দরের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আর মায়া ঝরে পড়ছে / যে জগতে জেগে উঠি সে জগৎ আরক্ত প্রেমের।’’ একদিক থেকে দেখতে গেলে, এ উপসংহার ঠিক হাংরি বিবিক্তাবাদের চিরাচরিত উপসংহার নয়। বরং হতেই পারত এ কবিতা নকশালবাড়ি-অনুপ্রাণিত কোনো তরুণের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা অনুপ্রাণিত লাল টুকটুকে সূর্য আর বজ্রমুষ্টির কবিতা।
তো আমরা যারা হাংরি বা নকশালবাড়ি এ দুটোর কোনোটাই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিনি, তারা ঠিক কি করব এ পর্যবেক্ষণ নিয়ে? প্রথমত, যে অসাধারণ ব্যতিক্রমবাদের দর্শনের মধ্য দিয়ে হাংরিরা নিজেদের দেখে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করে থাকেন, এমনকী এখনও পর্যন্ত, সে প্রচেষ্টা থেকে আমরা নিজেদের একটু দূরে সরিয়ে নেব। হাংরি আন্দোলনকে আমরা দেখার চেষ্টা করব তার সমসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, তার নিজস্ব দর্শনের বুনোট ছেনে ছেনে। কাজেই, চলুন ফিরে দেখি হাংরিদের কবিতা ও কবি বিষয়ক কিছু মূল তত্ত্বায়নকে।
‘‘কবিতা মানুষের শেষ ধর্ম’’— হুম্‌ম! তাই নাকি?
কে বলল?
ধরা যাক শৈলেশ্বর ঘোষ প্রণীত ‘‘মুক্ত কবিতার ইস্তাহার’’টি। সেখানে ঊনত্রিশটি গুরুগম্ভীর ঘোষণার মধ্যে প্রথমটি হল : ‘‘কবিতা মানুষের শেষ ধর্ম। আর, তার স্বাভাবিক পরম্পরায়  বুদ্ধ যিশু রামকৃষ্ণ নয়— কবি/কবিতা পৃথিবীকে স্বাধীন মুক্ত করবে ক্রমশঃ’’, ‘‘কবিতা ব্যক্তি মানুষকে পুনরভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যায়,’’ ‘‘কবিতা অপরাধ চেতনা থেকে জেগে ওঠা গ্লানিহীন আমার সংগীত—অন্ধকারে ফুটে ওঠা ফুল।’’ অর্থাৎ, কবিতা ও কবিতার স্রষ্টাকে দেখা হয়েছে এখানে স্বশাসিত একটি একক হিসেবে। কবি নিজেই একটি পৃথক সামাজিক শ্রেণী প্রায়। কিংবা হয়ত বা শ্রেণীবহির্ভূত, সামাজিক সমস্ত এককের ঊর্দ্ধে বসবাসকারী একটি বায়বীয় উপস্থিতি। হাংরি দর্শনে বার বার পুনরাবৃত্ত হতে থাকে এ ধারণা : কবি বিষয়ে, কবিতা বিষয়ে। এবং, পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে পরিণত হয় মিথে। আর, এই পুনরাবৃত্তি থেকে বেমক্কা বাদ পড়ে যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ— সংজ্ঞায়ন। মানে, কবিতা মালটা ঠিক কী? খায় না মাথায় দেয়? মানে, কবিতা লিখলেই কী কবি হয়? তাহলে এতো চিড়বিড়ানির কী আছে? বাংলায় তো পাড়ায় পাড়ায় কবি। তাতে করে তো যে সব সমস্যা নিয়ে কাঁদুনি গাওয়া হয়েছে হাংরিদের কবিতায়, তার কোনো সুরাহা হয়েছে বলে তো জানা যায়নি!
বা, এও তো অতি বড়ো প্রশ্ন : কেন কবিতা। কেন চিত্রশিল্প নয়, যন্ত্রসঙ্গীত নয়, কণ্ঠসঙ্গীত নয়। কেন আল্পনা নয়। কেন বুনন শিল্প নয়। রন্ধনশিল্প নয়। আচ্ছা, বাল্মীকির কবিতা, আর ধরুন, ফাল্গুনী রায়ের কবিতা কি একই? শুধুই ‘কবিতা’—এ তকমার ওপর জোর দিয়ে কি তারা বসবে পংক্তিভোজনে? তাহলে এও তো বলতে হয়, বুদ্ধ, যিশু বা রামকৃষ্ণের মধ্যস্থতায় তৈরি হয়েছে অতীব শক্তিশালী একাধিক কাব্য-ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেসবের মধ্য দিয়ে বহু বহু বছর ধরে উদ্বেলিত হয়েছেন সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ। হাংরিদের দ্বারা প্রভাবিত মানুষজনদের থেকে তারা অন্তত সংখ্যা ও ভূগোল দুই দিক থেকেই অনেক অনেক বেশি ব্যাপ্ত। অতএব, এই যে ‘‘কবিতা’’ ও ‘‘বুদ্ধ যিশু রামকৃষ্ণ’’-র মধ্যে দ্বিবিভাজন তৈরি করা হয়েছে, এখানে তো ঐতিহাসিকভাবে, সমাজতাত্ত্বিকভাবে, বড়োই খোলা ও অগভীর বলে মনে হয়!
এর সাথে আমরা পেলাম আরো একটি ঘোষণা— ‘‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা।’’ হেব্বি লাগল কিন্তু শুনতে! শিল্প এখানে একধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক মতাদর্শ, একধরনের প্রতিষ্ঠান। শিল্প মানে সেই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র যার মধ্য দিয়ে প্রাধান্যকারী দর্শন ও কলাশৈলী নির্মিত হয়। শিল্প মানে পরিশীলন। পরিশীলন মানে অবদমন। পরিশীলন মানে সম্মানীয়তার রাজনীতি। পরিশীলন মানে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। পরিশীলন মানে শ্রেণীবোধ, শ্রেণী-সংস্কৃতি, পরিশীলন মানে ভদ্রলৌকিকতা। পরিশীলন মানে ভদ্রলোক-ছোটোলোক বিভেদ। বুঝলাম। এবং, খুব ভিত্তিগতভাবে যে আমার কোনো আপত্তি আছে, তাও না। কিন্তু, কবিতা শিল্প নয়? এ আবার কোন জাতীয় গেরো? বিশেষ করে এই বাংলায়, যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীচেতনার অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিকাশই ঘটল কবিতার মধ্য দিয়ে?
ইস্তাহারের ধর্মই হল এই, যে সেখানে বিশদ ব্যাখ্যার বড়ো একটা জায়গা থাকে না। হাংরি-আন্দোলনের ইস্তেহার-ধর্মিতার মধ্য দিয়ে আমরা তাই পেলাম না কোনো জটিলতার এষণা। কিন্তু, এই সব ইস্তাহারে একরকম ভাবে ধরা পড়ল হাংরি বৈপরীত্য কেমন হবে, তার নীলছক। যেমন ধরুন, এই ঘোষণা—‘‘সমাজ যেসব শব্দকে অশ্লীল বলে বর্জন করে এবং চিন্তাকে দূষণীয় বলে ধিক্কার দেয় তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সমসাময়িক জীবনের অনেক সত্য—এগুলিকে ব্যবহার করা।’’ বা, আরো একটি ঘোষণা—‘‘অস্তিত্বের গোপনতম প্রদেশে লুকানো যা কিছু সব ক্রমাগত মানুষকে মিথ্যার দিকে নিয়ে যায়, তাকে প্রকাশ করা।’’ অথবা, ‘‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’’র আহ্বান।
অর্থাৎ, হাংরি কবিতা কেমন হবে হাজির হল তার একটা আভাস। তো, মিথ্যে বলব না। ওই যখন ‘‘বোকাচোদা’’-র মতো নিরীহ কথা বললে কলেজের সহপাঠী-সহপাঠিনীদের মুখ লাল হয়ে যেত, কিংবা গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালে আমাদের কৈশোর-তরুণীবেলায় চারপাশে ভিড় করে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ত আপামর জনসাধারণ, তখন হেব্বি লাগত কিন্তু! আর, এই বয়সেও যেহেতু ক্লাসরুমের ভিতরে ও বাইরে আমার মুখ থেকে অতলান্ত সাগরের ঢেউ ভাঙার গতিতে নির্গত হতে থাকে খিস্তি, তাতে ছাত্রছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্ব সহজ হয়েছে বইকি। তেমনি নিদারুণ মজা লাগে মাইরি বুঢ্ঢা সহকর্মীদের মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে। মনে হয়, সারাজীবন ধরে খালি এই করে যাই। যাকে ইংরাজিতে বলে শক্ দেওয়া। তো, হাংরি নন্দনতত্ত্বও এই ভদ্রলোক-বর্জিত অশ্লীলতাকে— বা, তথাকথিত অশ্লীলতাকে— কবিতায় এনে, একধরনের শক্ দেওয়ার কবিতা, আঘাত হানার কবিতার আমদানী ঘটাল বাংলাভাষায়। এবং, অবাক হওয়ার কিছু নেই, বাংলার সুশিক্ষিত সমাজ যারপরনাই শক্‌ড্‌ হলও। সেই ‘‘শক্‌ড্‌’’ হওয়ার ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে বেশ কয়েকটি হাংরি বিষয়ক সাম্প্রতিক লেখায়। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে এই লেখাটিকে আর ভারাক্রান্ত করে তুলব না।
তো, কেমন ছিল সে সব লেখা? এই লেখার অগ্রভাগে ফাল্গুনী রায়ের লেখাটি দেখুন। ভাবুন সুবো আচার্যর কবিতার সূচনা: ‘‘পায়ুর ভিতরে কোন সৌন্দর্যের খোঁজ পেয়েছিল রিচার্ডটন বা গর্ডন ক্রেগ’’। কিংবা, পড়ুন এই লাইন কটি:
তাজমহলের মতো যোনির ভালবাসা তাজমহলের মতো লিঙ্গের ভালবাসা
শরীরের ভালবাসা খুব শীগ্রী নিভে যায়
আমি তবু শরীরের বাইরে দেখি না কোনো স্বর্গ দেখি না শরীরের বাইরে
আহ্ শরীর—রিলকে, তোমার ভেনাসকে প্রেগন্যান্ট করতে চাই আমি
(সুবো আচার্য, ‘‘রাইনের মারিয়া রিলকের জন্মদিনে ১৫ পয়সার ডাকটিকিট‘‘)
কিন্তু মুশকিলটা হল গিয়ে এই— এ পড়ে যে আমি কিছু মাত্র বিচলিত হলাম না! শক্‌ড্‌ হওয়া তো দূরের কথা। বরং, মনে পড়ছে চারবছর বয়সের অন্যতম প্রথম বন্ধু কুশলের কথা। ডিপথেরিয়ায় মারা যায় পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই। সেই আমার প্রথম বন্ধুবিয়োগ। কিন্তু সেই চার বছর বয়সের মধ্যেই স্কুলের শিক্ষিকাকুলের কাছে নিজের উপস্থিতি জাহির করে ছেড়েছিল। কারণ, সে ছিল অনেকটা ধানী-লঙ্কা গোত্রীয়। এহেন কুশল খাতা ভর্তি করে এঁকে রাখত পায়খানার প্যানের ছবি। আমরা দেখতাম আর হি হি করে হাসতাম। বেচারা কুশল! খাতার পায়খানার প্যানের ছবিকে কোনোদিন ‘‘মুক্ত ছবি’’ বা ‘‘মুক্ত কবিতা’’ বলার সুযোগ পেল না।
তো, এই যদি হয়, ‘‘অস্তিত্বের গোপনতম প্রদেশে’’-র উদাহরণ, তাহলে মাইরি, হাংরিদের জন্য বড়ই সমবেদনা হচ্ছে। মানে, গাঁড়, লিঙ্গ, যোনি এবং চোদাচুদি-র বাইরে যাদের নিষিদ্ধতার গল্প পৌঁছয় না, তাদের জন্য আর করুণা ছাড়া কী হতে পারে। আসলে হাংরির সমসাময়িকতা আর আমার সমসাময়িকতার মধ্যে ফারাক অনেকটাই। আমাকে বা আমার বন্ধুদের অর্থাৎ, নাগরিক আঁতেল বঙ্গের বাসিন্দাদের এসব আর বিচলিত করে না। আমাদের থেকে ছোটদের তো প্রশ্নই নেই। ‘‘অশ্লীলতা’’-র যে দোহাই দিয়ে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ আক্রমণ করে ছিল হাংরি লেখকদের, অশ্লীলতার সে সংজ্ঞা আমি মানি না। কিন্তু তার পরেও থেকে যায় বিভিন্ন প্রশ্ন।
যেমন ধরুন, ‘‘অস্তিত্বের গোপনতম প্রদেশে লুকানো যা কিছু’’-র অন্যতম সংজ্ঞা যদি হয় যৌনতা, তো তার সর্বরকম অভিব্যক্তির জন্য আছে কয়েক কোটি অর্থের একটি শিল্প। তার নাম, পর্ণোগ্রাফী। চলতি বাংলায় যাকে আমরা বলি পানু। পর্ণোগ্রাফীর রাজনীতি অতীব জটিল। কোনো যৌন নৈতিকতা দিয়ে তাকে দেখা যায় না। আমি দেখছিও না। কিন্তু, সেই প্রতিষ্ঠানটি আছে। ছিল। তার সমস্ত জটিলতা নিয়ে। তো, গাঁড়, লিঙ্গ, যৌন আর চুদুরমুদুর বিবরণ পড়তে, দেখতে মন গেলে, আমি পানু পড়ব, দেখব। সুবো আচার্য বা ফাল্গুনী রায়ের আঁতলেমি ভরা বালছাল পড়তে যাব কেন?
তো, হাংরি লেখালেখি পড়তে গেলে, দেখা যাবে, সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতাগুলির বিষয়ে এক ভয়ঙ্কর নীরবতা। সেই নীরবতা পুষ্ট হতে হতে তৈরি হয় অসংখ্য পরস্পরবিরোধিতা। তাই, এক দিকে হাংরি কবিতার দর্শন যদি হয় চিরাচরিত মধ্যবিত্ততার সংস্কৃতিতে আঘাত হানার দর্শন, সেই আঘাত হানার দর্শনের ভিতরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের বিষণ্ণতাবোধ, ব্যর্থতাবোধ। তাই, হাংরি কবিতার শরীরে বারংবার পুনরাবৃত্ত হল ‘‘আমি কতো খারাপ’’ মার্কা স্বীকারোক্তি-শ্লেষোক্তি অথবা শ্লেষোক্তি-স্বীকারোক্তি। যেমন ধরুন, সুবো আচার্যর কবিতার এই লাইন কটি: ‘‘আসলে আমার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক শূয়োরের বাচ্চা/যার টান স্বভাবত অসীমের বিপরীতে—জঘন্য সীমায় দূষিত কাদার দিকে।’’
এ ‘‘আমি’’ হতে পারে বাঙালী মধ্যবিত্ততার মূর্ত প্রতিনিধি। কিংবা, কবি নিজে। হতে পারে এই দুয়ের কাব্যিক মিশ্রণ। কিন্তু, কি এল গেল এতে? মানে, মধ্যবিত্ত এক যুবক কবির এই শ্লেষোক্তি/স্বীকারোক্তিতে বাকি সমাজের কি যায় আসে? আমারই বা কী যায় আসে? মানে, এ পৃথিবী শূয়োরের বাচ্চাতে পরিপূর্ণ, একথা জানার জন্য আমাকে কোনো হাংরি কবিতা পড়তে হয়নি। পরিবারের মধ্যেকার জীবন বা রাস্তায় বেরিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করাই সে জ্ঞানার্জনের জন্য যথেষ্ট।
তবে কি আমি বলতে চাইছি যে ভেঙে গেছে নিষিদ্ধতার বেড়াজাল? না, একদমই না। বরং, ঠিক উল্টোটা। আমি যখন ছাত্র, তখন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর ছাত্রসমাজের গলায় চেপে বসতে শুরু করেছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফাঁস। গত কুড়ি বছরে যা শক্ত হতে হতে হয়েছে লোহার শিকল। ক্রমাগত সংকীর্ণ হতে থাকা পৃথিবীজোড়া মধ্যবিত্ত সমাজ, সংশয়াকীর্ণ দৈনন্দিন জীবন। আক্ষরিক অর্থেই চাকরি আজ আছে তো কাল নেই। বিপুলসংখ্যক অতিশিক্ষিত বেকারবাহিনী। পৃথিবীজুড়ে দক্ষিণপন্থা ও ধর্মীয় মৌলবাদের পুনরুত্থান। এই লেখাটি লেখার সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। খোলাখুলিভাবে বর্ণবিদ্বেষী, অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্পের সাথে হিটলারের প্রভূত মিল খুজে পাছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক গণহত্যা। জমিহারা কৃষক। ভূমিহীন আদিবাসী। বহুজাতিকের অ্যাসেম্বলি লাইনে প্রায়-ক্রীতদাস শ্রমিকবাহিনী। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ওই একটু খিস্তি, একটু মাতলামো, একটু নেশা—আর সে সবের মধ্যে দিয়ে পার্শ্ববর্তী মধ্যবিত্তকে একটু শক দেওয়া— ক্ষণিকের আনন্দ এনে দেয় বটে, তবে তা ক্ষণিকেরই আনন্দ। আর, যৌনতার রাজনীতিরও আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে এ পৃথিবীতে। মায় ভারতবর্ষে। সেসব নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের কম্মো নয়।
সত্যি কথা বলতে কী, যে সব অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকট আমার প্রজন্মের সামনে পাখা মেলে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই হাংরি বিবিক্তা আমাকে কোনো পথ দেখায় না। কোনো নতুন বিশ্লেষণের সামনে ঘাড় ধরে দাঁড় করায় না। শেখায় না কোনো নতুন রাজনৈতিক বা শৈল্পিক পরিচিতি গড়ে তুলতে। এবং, দুর্বিনীত পরবর্তী প্রজন্মের ধৃষ্টতায় বলি— ছয় বা সাতের দশকেও দেয়নি। যে জটিলতা নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রজন্ম চোখ তুলে তাকাতে চেয়েছিল পৃথিবীর দিকে, সেখানে দাঁড়িয়ে হাংরি-উদ্ভূত বিবিক্তার ভাষা বড়ই অপ্রতুল, বড়ই অগভীর।
বড়োজোর হাংরি আন্দোলন আমাকে দিয়েছিল এক ধরনের অনুযোগ-অভিযোগের ভাষা। কাঁদুনি গাইবার ভাষা, ঘ্যানঘ্যানানির ভাষা। মধ্যবিত্ত ভদ্রলৌকিক নীতিবোধকে বোঝার একটি ভাষা। হাংরি আন্দোলন আমাকে দিয়েছে বড়োজোর উপসর্গ নথিভুক্ত করার ভাষা। কিন্তু, যে আমি বিবিক্তাকে সিরিয়াসলি নিই, সেই আমি তো একথা কখনও বিশ্বাস করি না যে কবিতা, সাহিত্য, শিল্পের কাজ কাঁদুনি গাওয়াতেই শেষ।
তাই, আমার সমসময়ে— যখন ধুড়ধাড় করে ভেঙে পড়েছে ছোটো পত্রিকা ও বাণিজ্যিক পত্রিকার লেখালেখির মধ্যকার দেওয়াল, যখন ছোটো পত্রিকা আসলে আনন্দবাজারে লেখা প্রকাশের পূর্ববর্তী হাত মক্‌শো করার স্থানমাত্র, যখন বাংলার মূলস্রোতের কবিতা, আনন্দবাজারীয় কবিতার মূল সুরই বিবিক্তা— তখন ঠিক কীভাবে দেখব হাংরি আন্দোলনজাত বিবিক্তাবাদের নন্দনতত্ত্বকে? মানে, এককালে যা ছিল মধ্যবিত্ততার পরিপন্থী, ভদ্রলৌকিকতাকে আঘাত করতে সক্ষম, তা-ই আজ হজম হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য-বাজারের বিশাল বপুর অলিগলিতে। আংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েটেড’। পড়ে দেখুন পিনাকী ঠাকুর। মন্দাক্রান্তা সেন। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়। এসব কবিতায় আছে খিস্তি। আছে বিবিক্তা। আছে নেশা, আছে মেয়েমানুষ, অথবা পুরুষমানুষ। এসবের মধ্য দিয়ে কারুর কোনো আঘাত-ফাঘাত লাগে না আর।
যেমন, আমি খারাপ থাকলেও কারুর কিছু যায় আসে না। বরং, ওই বিবিক্তাবাদই হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের মধ্যবিত্ততার শেষ মুখোশ। কোনো বিকল্প সাংস্কৃতিক দাবির আসলে নেই কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ভিত্তি। মানে, আমি ঢ্যামনা। বিপুল পরিমাণে হারামী। মেনে নিই সব কিছু, মানিয়ে নিই সব কিছুর সাথে। বিশেষ করে পরিবারের মধ্যে, চাকরিক্ষেত্রে। কিন্তু, হলে কি হবে বাওয়া, আমি কিন্তু ভীষণ অ্যালিয়েনেটেড্। তাই, মদ, গাঁজা, বহুগমন। কবিতাও লিখেছি খান কয়েক সেসব বিষয়ে। উফ্, আমি কি খারাপ! এক্কেরে হারামজাদা। তো, এই যদি হয় মোটামুটি বিরুদ্ধতার সুরের নীলছক, তাকে জায়গা দিতে প্রতিষ্ঠানের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি বিশ্বজুড়ে। তাই, খুব দ্রুতই, বিবিক্তাবাদী ধারার সাহিত্য স্থান পেয়েছে মূলস্রোতে। এই বাস্তবতা ও ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে ‘‘কবিতাই মানুষের শেষ ধর্ম’’’— এই জাতীয় ঘোষণাসমূহকে বড়ই সরলীকৃত বলে মনে হয়। মনে হয় বড়ই অপ্রতুল এই কাব্যিক ব্যতিক্রমবাদ।
দ্রোহকল্পেরও যে থাকে অপার বিদ্রোহহীনতা
তবু, কোথাও একটা একথা মেনে নিতে আমার কোনো অসুবিধে নেই যে হাংরি আন্দোলনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল এক ধরনের বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহ তার ছাপ রেখে গেছে একধরনের বাজারবিমুখীনতায়, একধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড ছোট পত্রিকা ইস্তেহার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। বলা যেতে পারে, হাংরি আন্দোলন একধরনের বিকল্প ছাপাখানার সংস্কৃতি আন্দোলন। সে বিকল্প সংস্কৃতি এক দিক থেকে একগুঁয়ে, জেদী। বাজারের বাইরেই তার মূল কেন্দ্রবিন্দু, বসবাস। আজ যখন আমি নিজে লেখালেখি করি, পত্রিকা করি, ছোটপত্রিকার রাজনৈতিক সাহিত্যিক ভূমিকা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি, তখন তো সেই বিকল্প ছাপাখানার ইতিহাসের দিকেই তাকাই অনুপ্রেরণার জন্য, শেখার জন্য। না, সেখানে শুধু হাংরি নয়, আছে হাংরি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক অনেক বিকল্প ছাপাখানা ও বিকল্প গণমাধ্যম প্রয়াস। কিন্তু, আরো একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠির সাথে সাথে, হাংরি গোষ্ঠীও যে আমার অন্যতম পূর্বসুরী, একথা আমার মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু, আবার এও তো মানি না যে বাজারবিমুখীনতার মধ্যে দিয়েই মিটে যায় সমস্ত সমস্যা। অর্থাৎ বলতে চাইছি যে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহ বলে কিছু হয় না। প্রতিটি বিদ্রোহের বয়ান, কার্যক্রমের মধ্যেই কি আসলে থাকে না সমান্তরাল বিদ্রোহহীনতার বীজও? তাই, শুধু হাংরি কেন, যে কোনো সাহিত্যিক-নান্দনিক-রাজনৈতিক আন্দোলনকেই তার দ্বান্দ্বিকতায় দেখা অতীব দুরূহ এবং কঠিন কাজ। এবং যেহেতু দুরূহ, তাই অতীব প্রয়োজনীয়।
অতএব, যখন আমরা হাংরি ইস্তাহারে পড়ি, ‘‘এসটাব্লিসমেন্টের চাকর না হওয়া’’, কিংবা ‘‘যে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ঘৃণা করা,’’ ‘‘মধ্যবিত্তের রুচি ও মূল্যবোধকে অস্বীকার করা,’’ ‘‘সমস্ত বুর্জোয়া শিক্ষাকে অস্বীকার করা’’ ও ‘‘বুর্জোয়ার সুখ ও সিকিউরিটি বর্জন করা’’, তখন কোথাও একটা, সত্যি কথা বলতে কী, রক্ত গরম হয়। মানে, না হওয়ার কী আছে? কিন্তু, তারপরেই যে প্রশ্ন ওঠে— কিন্তু কী ভাবে?
তাই, যখন সুবো আচার্যের কবিতায় পড়ি, ‘‘যে মানুষ শিল্পের প্রয়োগক্ষেত্রে কেবলই সংসারী / সুগৃহিণীর মতো নিপুণ যার ভাগবাঁটোয়ারা / তার পশ্চাৎদেশে একটি লাথি কষাবার ইচ্ছে থাকলেও / চুপ করে থেকেছি, সর্বদা’’, তখন আমার বিশেষ আগ্রহ জাগে না। সত্যি কথা বলতে কী, ওই লাথি কষাবার ইচ্ছেটি আমার চেনা। চেনা ওই চুপ করে থাকাটিও। যদিও, একথা বলতে আমার দ্বিধা নেই, প্রাত্যহিক জীবনে সবসময়ে সফল না হলেও, চুপ না থাকারই চেষ্টাই তো করি। কলম ধরাও তো সেই জন্যেই। কিন্তু, বাধ সাধে ওই সুগৃহিণীর উপমাটি। কবিতায় উপমাই তো ইতিহাসের আকর, মতাদর্শের আকর, অর্থের আকর। তাই, প্রশ্ন জাগে, সুগৃহিণীর উপমাটির মধ্য দিয়ে ঠিক কী করতে চাইছেন সুবো। আমি বলব, গার্হস্থ্যতার সাথে একধরনের রক্ষণশীলতার সমীকরণ ঘটাচ্ছেন। গৃহশ্রমের সাথে স্থিতিস্থাপকতার। আমার সেই বোধের সাথে ভিত্তিগত কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, এই যে সমীকরণটি ঘটানো হল, তার অন্যতম ফলশ্রুতি হল এই যে, গার্হস্থ্যতার রাজনীতির কোনো গভীর অনুবীক্ষণ আমরা হাংরি কবিতায় পেলাম না। আরও অনেক কিছুর মতোই, মধ্যবিত্ত/ভদ্রলৌকিক/ বুর্জোয়া সুখ ও সিকিওরিটির সাথে গার্হস্থ্যতার সমীকরণটিও হাংরি লেখালেখি ডায়লগবাজির স্তরেই থেকে গেল।
অধিকাংশ হাংরি কবিতার ঘটনাস্থল তাই পরিবার— বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারের— বাসস্থান থেকে বহুদূরে। শুধু, পারিবারিক বাসস্থানই নয়, যে কোনোরকম তথাকথিত মধ্যবিত্ত বা সর্বজনগ্রাহ্য ক্ষেত্র থেকেই এক গভীর দূরত্ব রেখে চলে হাংরি কবিতা। হাংরি কবিতার প্রধান প্রধান ঘটনাস্থল হল শুঁড়িখানা, লালবাতি অঞ্চল বা অন্যান্য প্রান্তিক ঠাঁই। অর্থাৎ, সাংস্কৃতিকভাবে, যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলৌকিক সামাজিক গণ্ডীর প্রায় ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত মেরুতে অবস্থানরত।
এবং, হাংরি কবিতায় আমরা পেলাম এক ধরনের বিশেষ কথকের প্রতিমূর্তি। একধরনের বিশেষ লিরিক সাবজেক্টিভিটি। নিম্নমধ্যবিত্ত যুবক, মূলত কর্মহীন। তাই চালচুলোহীন। জীবনে বড়ো একটা দিকনির্দেশ নেই। রাজনৈতিক ঔৎসুক্য থাকলেও বিশেষ কোনো রাজনীতি নেই। আপাদমস্তক মধ্যবিত্ত তার পরিবার, সেখানে তার অবস্থান একজন বহিরাগতের। পরিবার তার কাছে পুলিশীর প্রতীক। একাত্মতা সে খোঁজে শুঁড়িখানায়, শ্মশানে, বেশ্যাবাড়িতে। অরুণেশ ঘোষের কবিতা ‘‘ছোট শহরের অতিথি’’ সেই একাত্মতা খোঁজার একটি চিরাচরিত হাংরি ঘরানার অনুশীলন—
নক্ষত্রের তলায় যেখানে এই
ভাঙাচোরা বাস আর আস্তাবল
যেখানে মরচে পড়া লোহালক্কড়ের
আবর্জনার মধ্যে আমাদের মদ ভাঙের আড্ডা
ফিসফিসানি মেয়েদের, চাপা হাসি আর থুতু ছেটানো
দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাইতোলা
সেইখানে, ভাঙা গাড়ির আস্তাবল
তোকে বয়ে নিয়ে এসেছে তোর মা
এ যেন আমাদের ছোট শহরের বেঁটেখাটো আর দাড়িওয়ালা
ঈশ্বরের সঠিক নির্দেশ: এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে
পালিয়ে না বেড়িয়ে সোজা চলে যায় আমার এখানে
এই ভাঙা গাড়ি, নেশুড়ে আর বেশ্যাদের আস্তানায়
আমরা যখন খাটো গলায় ধমক দিচ্ছিলাম মাতালদের
‘চুপ চুপ…পুলিশ’
যখন মেয়েরা অন্তর্বাসের তলায় গুঁজে রাখছে
ময়লা দোমড়ানো মোচড়ানো লালচে দুটাকার নোট
যখন গেলাশ উপচে গড়িয়ে পড়ছে মদ
মদে ভিজে উঠছে মৃত ধাতুর কঙ্কাল
ফণা তুলে জেগে উঠেছে চারপাশে
মদের নেশায় মদের গন্ধে মরচে-পড়ার মধ্যেও
টুকরো-টাকরা হয়ে যাওয়ার মধ্যেও হিস হিস চিৎকার
অরুণেশের কবিতায় হাজির ঠিক সেই উপরোক্ত ধারার এক কথক-যুবক। যেহেতু হাংরি-দর্শনের অন্যতম মূল ঘোষণা ‘‘যুক্তির স্তর পার হয়ে গিয়ে দ্রষ্টা হিসাবে জীবনকে দেখা ও প্রকাশ করা,’’ ‘‘মানুষী অভিজ্ঞতার শেষ সীমা দেখে নেওয়া’’ এবং ‘‘যুক্তির স্তর পার হয়ে গিয়ে দ্রষ্টা হিসাবে জীবনকে দেখা ও প্রকাশ করা’’, তাই সেই কথক-যুবকের কাছে মধ্যবিত্ত প্রাত্যহিকতা ও যুক্তিবোধকে প্রতিহত করার মুল প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায় নেশা। হ্যাঁ, হাংরি কবিতায় নেশা একধরনের অস্ত্র, একধরনের প্রয়োগপদ্ধতি, একধরনের রাজনীতি, একধরনের বিদ্রোহ। এবং সেই বিদ্রোহ হাংরি কবিতায় এল সামাজিক প্রান্তিকতার নন্দনতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। সাদা বাংলায় বলতে গেলে, একধরনের ছোটলোকের সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে।
এবং, বাংলা মূলস্রোতের কবিতার প্রচ্ছন্ন গতিমুখ যদি নির্ধারিত হয়ে থাকে ভদ্রলোক শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ চেতনার সাংস্কৃতিক তথ্যায়ন, তবে হাংরি-কবিতার প্রকল্প হয়ে উঠল ঠিক এর বিপরীত: একধরনের ‘‘ছোটলোক’’ সংস্কৃতির রূপায়ণ। ‘‘ছোটলোক’’ শব্দটি একটি বাঙ্ময়তা নিয়ে হাজির হল হাংরি-দর্শনে। উদাহরণ? ভেবে দেখুন, মলয় রায়চৌধুরীর আত্মকথায় ‘‘ছোটলোক’’ শব্দটি ঠিক কতোবার ব্যবহৃত হয়েছে। তাই একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আপাতভাবে পরিশীলন-বিমুখী হাংরি-দর্শনের ভিত্তিতেই আছে সেই একই শ্রেণীবোধ, শ্রেণী-দর্শন, শ্রেণীচেতনা। আছে প্রত্যক্ষভাবেই।
কিন্তু, ‘‘ছোটলোক’’ হাংরি-দর্শনে যে অর্থনৈতিক শ্রেণীর অর্থে হাজির হল, তা নয়। ‘‘ছোটলোক’’ শব্দটি অর্থনৈতিক একটি এককের থেকেও অনেক বেশি সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের দ্যোতনায় হাজির হল হাংরি বিশ্ববীক্ষায়। ‘‘ভদ্রলোক’’ পরিচিতিকে ছুঁড়ে ফেলতে সচেষ্ট হাংরি কবি-লেখক-শিল্পী আঁকড়ে ধরতে চাইলেন ছোটলোকের সংস্কৃতিকে। ছোটোলোকামো এক্ষেত্রে হয়ে উঠল একধরনের মুখোশ, একধরনের সীমা অতিক্রম করা, একধরনের লক্ষ্মণের গণ্ডী পেরোনো।
কিন্তু, মজার কথাটা হল গিয়ে এই, তথাকথিত ছোটলোকদের অন্তর্গত, খুব, খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ, যাঁরা লেখাপড়ার সুযোগ পেলেন, সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারলেন, তাঁরা অধিকার পেতে চাইলেন ‘‘ভদ্রলৌকিক’’ বলে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে। ভদ্রলোক সংস্কৃতির অন্দরে। প্রমাণ চান? পড়ে দেখুন ভারতীয় দলিত সাহিত্যের জটিল সংগ্রহশালা। এই দ্বন্দ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে, হাংরি কবিশিল্পীদের ‘‘ছোটলোক’’ হয়ে ওঠার নির্নিমেষ চেষ্টা প্রমাণ রাখতে রাখতে গেল তাঁদের আপাদমস্তক ভদ্রলৌকিকতার। এমনকী মধ্যবিত্ততারও। ওই অনেকটা কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই—এর মতো আর কী। আর, যেকোনো মুখোশ বা পারফমেন্সে এইটাই তো মজা। যখন ইচ্ছে মুখোশ খুলে ফেলা যায়, যখন ইচ্ছে রঙচঙ মুখে ফেলে ফিরে যাওয়া যায় নিজ নিজ শ্রেণীর বেষ্টনীতে।
তবে কিনা, এসবের জন্যই প্রয়োজন ছিল আদর্শ ছোটলোকের একটি প্রতিমূর্তি তৈরি করা। কারণ, যদি একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত/নিম্ন-মধ্যবিত্ত যুবকদের ছোটোলোকের মুখোশ পড়ার মধ্য দিয়ে, তা হলে তো সেই রূপায়ণের স্বার্থেই ‘‘ছোটোলোক’’ বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাই না? তো, শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা ‘‘আমি ক্ষুধার্ত’’তে পেলাম সেইরকমই একটি সংজ্ঞায়নের প্রচেষ্টা। শৈলেশ্বর কবিতাটি শুরু করলেন এইভাবে:
আমি এক স্ত্রীলোকের গায়ে হাত দিতেই সে হয়ে গেল সোনা
আমি দরিদ্র মজুর পোর্ট কমিশনের ৫নং কোয়ার্টারে থাকি
আমার নিঃশ্বাস লেগে দুভাগ হল ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি
আমার হাত বড়ো হয়ে গেল পা ছোটো লিঙ্গ রইল ঠিক
আমার মাকে আমি এক দেবতার সঙ্গে শুয়ে থাকতে দেখেছি। পোর্ট কমিশনের ৫নং কোয়ার্টারে থাকা দরিদ্র মজুরের কণ্ঠে লেখা এই কবিতায় হাংরি কবিতার যে চিরাচরিত মধ্যবিত্ত বিবিক্তামিশ্রিত ক্রোধচিহ্নিত কণ্ঠস্বর, পেলাম তার থেকে একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর। বলা যেতে পারে, এই কবিতা আক্ষরিক অর্থেই নিয়ে এল একধরনের সচেতন মুখোশ ধারণের নন্দনতত্ত্ব। যেখানে, পোর্ট কমিশনের মজুরের মুখোশ পরে মধ্যবিত্ত কবি সক্রিয়ভাবে নির্মাণ করতে বসলেন এক শ্রমিকের রূপায়ণ। এবং রূপক। তাই, প্রথম তিন লাইনের মধ্যেই আমরা পেলাম কম্যুনিস্ট পার্টির রেফারেন্স। অর্থাৎ, ছয়-সাতের দশকের এক রাজনীতিমনস্ক মধ্যবিত্ত মানুষের চিন্তনজগত। এবং, এই একটি লাইনের গায়ে লেগে থাকল ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বাম-আন্দোলনের জটিল ইতিহাস। পার্টি বিভাজন, মতাদর্শগত বিতর্ক, পার্টির মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব, সেই মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। সাথে সাথে, এই প্রশ্নও এল— আসলে কি তবে কম্যুনিস্ট-আন্দোলনের ইতিহাস মূলগতভাবে মধ্যবিত্ততারই ইতিহাস? যে ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণী আসলে হাজির হয়েছে প্রধানত একটি রূপক হিসেবে? জটিল একটি রূপক, কিন্তু তবুও রূপকই। তাই, কম্যুনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী আন্দোলন-অন্তর্গত সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা যদি আমাদের সামনে হাজির করে থাকে শ্রমিকের একটি বিশেষ প্রতিমূর্তি— পটভূমিতে লাল সূর্য, মুষ্টিবদ্ধ হাত, দৃঢ়চিত্ত হাতে ধরা হাতুড়ি, পৌরুষ-উদ্দীপ্ত পেশীবহুল হাত উপরে উত্থিত— তবে শৈলেশ্বর পাঠকের সামনে হাজির করলেন শ্রমিকের আরেক প্রতিমূর্তি।
সেই প্রতিমূর্তি অনুযায়ী, পোর্ট-কমিশনের অশক্ত শরীর মজদুর নিজের লিঙ্গ নিয়ে কথা বলে। মন্তব্য করে তার মা-র যৌনতা নিয়ে। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় শ্রমিকের পৌরুষ যদি নির্মিত হয়ে থাকে তার শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে, শৈলেশ্বর তাঁর শ্রমিকের পৌরুষ নির্মাণ করলেন তার যৌনতার ওপর দাঁড়িয়ে। তাই, শৈলেশ্বরের কবিতায় আমরা পেলাম এই রকম পংক্তি: ‘‘আমি তোমার সংগে ঘুরিফিরি তোমার সংগে খাইদাই তোমার সংগে শুই /আর তোমার টাকা চুরি করি কিনে আনি একের পর এক স্ত্রীলোক, /আমি এক গির্জায় ঢুকলে খুলে পড়ে তার মাথা, আমি ক্ষুধার্ত / আমাকে দেখে বন্ধ হয়ে যায় লাইব্রেরির ঘরের দরোজা জানলা সব।’’ কিংবা ‘‘আমি মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে চলে যাই বাথরুমের ভিতর’’, অর্থাৎ, আগ্রাসী পুরুষ যৌনতা হয়ে ওঠে শৈলেশ্বরের শ্রমিকের শ্রমিকত্বের অন্যতম মূল সূচক। অতএব, শ্রমিক নামক অর্থনৈতিক এককটির একটি সাংস্কৃতিক দর্শন নির্মাণ করেন শৈলেশ্বর। সেই সাংস্কৃতিক দর্শনটির নাম ছোটোলোকামো। সেই ছোটোলোকামোর বয়ানের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে শৈলেশ্বরের বহুগামিতা, নেশা, বন্ধুদের সাথে মারামারি। অর্থাৎ, যে জীবনযাপনকে মধ্যবিত্ত ভদ্রলৌকিকতা বলবে নোংরামো, উচ্ছৃংখলতা। যাকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ তথা ভদ্রলৌকিক মার্ক্সবাদ বলবে লুম্পেনসি।
কাজেই, কীভাবে গরিব মজদুরের রূপায়ন ঘটবে বাংলা সাহিত্যের পাতায়, তা নিয়ে শৈলেশ্বর তথা হাংরিদের সাথে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী তথা মার্ক্সবাদীদের তৈরি হল একটি রাজনৈতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র। সেই লড়াইয়ে মজদুর/শ্রমিক হাজির হল একটি মাধ্যম হিসাবে, রূপক হিসেবে। মানে, সত্যি কথা বলতে কী, এ হল এক অর্ন্তশ্রেণী লড়াই। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের মধ্যেকার দুই শিবিরের লড়াই। যদিও, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, শৈলেশ্বরের কবিতার শ্রেণী-বঞ্চনার কথাও লিপিবদ্ধ হল খুব স্পষ্ট করেই : ‘‘আমি এক গির্জায় ঢুকলে খুলে পড়ে তার মাথা, আমি ক্ষুধার্ত/আমাকে দেখে বন্ধ হয়ে যায় লাইব্রেরি ঘরের দরোজা জানালা সব।’’ অথবা ‘‘আমার জ্ঞানবুদ্ধি ধ্বংস করে মনুমেন্টের মতো উঠে যায় কবিতা।’’
বলা বাহুল্য, এই প্রতিবেদনে কবিতা বা শিল্প (বলা ভালো, কবিতা-প্রতিষ্ঠান) এল শ্রেণীবোধ ও পরিকাঠামোগত শ্রেণী-হিংসার প্রতীক হয়ে। একদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে— বিশেষত বাংলা কবিতায়— এ উচ্চারণ অভাবনীয়। কিন্তু, এই সমীকরণের সাথে সাথে আমরা পেলাম আরেক ধরনের সমীকরণও— ক্ষুধার সাথে জ্ঞানচর্চার। বা, আরো বিশদে বলতে গেলে, জ্ঞানচর্চার অভাবের। আর, তার সাথে সাথে উবে গেল শারীরিক ক্ষুধার অনুষঙ্গ, দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি, অভুক্ত থাকা, দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট ও বাস্তব। মানে, মজদুর বা শ্রমিক হলেই ‘‘খাবার খাবার’’ করে চেঁচাতে হবে এমনটি বলছি না। আবার কবিতা বা লাইব্রেরি নিয়েও সেই শ্রমিকের যে খুব মাথাব্যথা থাকবে, এবং হাংরি ভাষাতেই যে থাকবে, এমনটিও তো জানি না।
আসলে প্রশ্নটি হল এইখানে যে, বাংলাসাহিত্যে শ্রমিক-সাহিত্যিকের কোনো অস্তিত্ব মূলগতভাবে নেই। কারণ, বাংলা সাহিত্য তো আসলে মধ্যবিত্তদের। লেখনী বিষয়টির সাথে মধ্যবিত্ততার সম্পর্ক অতীব গূঢ়, গভীর। তাই, যা বাংলাসাহিত্যে প্রকৃত শ্রমিক-শ্রেণীর সাহিত্যের বদলে আছে, তা হল শ্রমিক-সত্তা নিয়ে মধ্যবিত্ত চর্চা। তাই যখন শৈলেশ্বর লাইব্রেরি, মনুমেন্ট কবিতা এসব লিখলেন— এবং লিখলেন এক মজদুরের ভাষ্যে— তখন তিনিও পড়লেন ওই মধ্যবিত্ত নান্দনিকতার খপ্পরে। যেখানে শ্রমিকের কণ্ঠ ধার নিয়ে হরবোলা হলেন হাংরি কবি। সেই হরবোলার কণ্ঠে ক্ষুধা বিষয়টিকে তার শারীরবৃত্তীয়তা, অপুষ্টি ও অনাহারের ইতিহাস থেকে বিযুক্তি ঘটিয়ে পর্যবসিত করলেন সাংস্কৃতিক, প্রায় আধ্যাত্মিক দার্শনিক ক্ষুধায়। কখনো বা যৌন ক্ষুধায়। সাথে সাথে, বাংলাসাহিত্যে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আরেকটি স্টিরিওটাইপ তৈরি হল। সেই স্টিরিওটাইপের কেন্দ্রে রইল যৌন আগ্রাসন, নেশা, অপরাধপ্রবণতা। এবং যেহেতু ‘‘ছোটোলোকামো‘‘ ব্যাপারটিকে হাংরি কবিতা হাজির করল মধ্যবিত্ত রাগী যুবকের আত্মনির্মাণের একটি অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে, সেইহেতু এই ‘স্টিরিওটাইপে’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও হয়ে উঠল মধ্যবিত্ত হাংরি কবির বিদ্রোহের সূচক। আবারও সজোরে বলি, বাদ পড়ে গেল রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক লড়াই ও সংগঠনের রূপ-আকারের মতো বিষয়গুলি। অর্থাৎ যে বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে বা কাজ করতে নামলে কোনোকিছুরই কোনো সহজ সমাধান থাকে না। ‘‘আমি খারাপ আছি’’ বিবিক্তাবাদ দিয়ে কাজ চলে না। ‘‘পৃথিবী বড়ো খারাপ’’ জাতীয় চিল্লামিলিতেও সুরাহা জোটে না।
অতএব, যেটা দেখা গেলো, তা হল, এই ছোটোলোক সংস্কৃতির মহিমায়নের মধ্য দিয়ে— কেন্দ্রবিন্দুতে শ্রেণী থাকলেও—হাংরি-দর্শনে আমরা দেখলাম মার্ক্সবাদ থেকে একধরনের সরে আসা। শৈলেশ্বর ঘোষের ‘‘ভাষা-বিমোচন’’ লেখায় পেলাম এই তাত্ত্বিক সরণের একটি মূর্ত ব্যাখ্যা:
‘‘কার্ল মার্কসের মতো মহানচিন্তনবিদ এবং সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, যিনি মানুষের মনের জগতটির মানচিত্র তৈরির কাজের প্রথম পথিক— দুজন দুভাবে বাস্তবের পরিবর্তনের, রূপান্তরের কথা বলেছেন। মার্কসের চিন্তনে মানুষ যে সমাজ ব্যবস্থায় বাস করছে, সেখানে সে পরাধীন। ধনিক শ্রেণীর শোষণে তার অস্তিত্ব মিথ্যায় পর্যবসিত। সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বারা মানুষ ফিরে পেতে পারে স্বাধীনতা। সেই রূপান্তরিত বাস্তবটিই মানুষের নিজের বাস্তব যেখানে তার দুঃখের ইতি ঘটবে। সে পাবে এমন এক বাস্তব যার সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার বাস্তবের কোনো মিলই থাকবে না আর। নতুন এই বাস্তবে সে, মাছ যেমন জলে খেলা করে, সেরকম খেলতে পারবে। কিন্তু মার্কসবাদের ফলিত প্রয়োগে আমরা দেখতে পেয়েছি, ক্ষমতা থেকেই যায়, কেবল তার রূপটি পাল্টায় মাত্র। ক্ষমতা যে মূল্যবোধগুলির জন্ম দেয় পরিবর্তিত বাস্তব তার অধিকাংশগুলিরই পূজা করে। মুক্তির স্বপ্নটি পুনরায় ক্ষমতার ভাষায় বন্দী হয়ে পড়ে। আর বিপ্লবের অগ্রদূত হিসাবে যাদের সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা শেষপর্যন্ত অবদমিত এবং ক্ষমতাশূন্যই থেকে যায়। কবির আক্রমণ ওই ঝড়ের চোখটিকেই, অর্থাৎ ক্ষমতাকেই, তার আধিপত্যকে, তার মূল্যবোধগুলিকে— যেগুলির সাহায্যে সে মানুষকে শূন্য করে, মিথ্যা করে, অস্তিত্ব টুকরো টুকরো করে ফেলে।’’
মার্কসবাদের যে কোনো মনোযোগী ছাত্রের কাছে এ ব্যাখ্যা একটু বেশিই সরলীকৃত ঠেকবে। তবু, আজ ২০১৬-১৭ সালে দাঁড়িয়ে এ ব্যাখ্যার সাথে আমার খুব মূলগত পার্থক্য নেই। কিন্তু, এর মধ্যেও আছে একটা জটিলতা। যখন সুবো আচার্যের কবিতায় পড়ি:
মানুষের ভীত পায়চারি আজ ১৯৬৮ সালে
আমাকে উদাসীনতার কাছে নিয়ে যায়—
আমার জীবনে এতো রক্ত রক্ত রক্ত রক্ত এতো রক্ত কেন?
তখন, মাইরি বলছি, ১৯৬৮ সালে যাঁরা উদাসীনতার কথা বলেন, তাঁদের বিদ্রোহী বলে ভাবাটা একটু কষ্টকর হয়ে পড়ে।
না, নকশালবাড়ির রাজনীতিকে আমি সমালোচনার ঊর্দ্ধে বলে মনে করি না। গোল গোল কতোগুলো কথা বলে, উপকথা তৈরি করে নকশালবাড়ি বা বাম রাজনীতি মহিমান্বিত করার রাজনীতিতেও আমি বিশ্বাস করি না। বা, একভাবে বলতে গেলে, মহিমায়নের রাজনীতির বিলাসিতা ঐতিহাসিকভাবেই আমার প্রজন্মের পক্ষে ঠিক সম্ভবপর নয়। আমাদের দায়িত্ব কঠোর, বিশ্লেষণাত্মক অতীতচারণ। প্রশ্ন তোলা, প্রশ্ন করা। তাই, কোনো আবেগপ্রবণ জায়গা থেকে এ উচ্চারণ নয়।
কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, প্রশ্ন থেকে যায়— তাই, সমাজজোড়া ঝড়ঝাপটা থেকে গা বাঁচিয়ে থাকাই কি হাংরি দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু? গা বাঁচিয়ে থাকা আর উদাসীনতা, থুড়ি, বিবিক্তা-বিবিক্তা খেলা? তো, তারপরেও বোধহয় একটা বিষয় থেকে যায়। মানে, স্বীকার করতেই হয়, আজ নকশালবাড়ির পঞ্চাশ বছর পূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এই শিবিরের দিশাহীনতার দিকে তাকালে ওই ‘‘উদাসীনতা’’ কে বোধহয় ততটা আর দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু, যখন ফাল্গুনী রায়ের কবিতায় পড়ি, ‘‘বিপ্লবীদের পাইপগানের ছিটকিনি পরিষ্কার করে দেবার পরেও অনিচ্ছা জন্মায় গুলি চালাতে আমি শ্রীচৈতন্যের প্রেমধর্ম অনুযায়ী একযোগে নকশাল ও মিলিটারির প্রতি আমার ভালবাসা বিলোবার ফলে আমি দু-পক্ষের শত্রু হয়ে গেলাম’’ অথবা ‘‘হিংসা ভালো লাগে না আমার বিপ্লব ভালো লাগে জোতদার ও কৃষকদের যুদ্ধময় ধানক্ষেতে আমিও খেয়েছি, খুব ধানশীষের দুধ,’’ তখন কোথাও একটা খুব প্রগাঢ়ভাবে মনে হয় হাংরি বিশ্ববীক্ষার মূল রাজনীতি হল অরাজনীতির রাজনীতি।
তাই, আমরা বারবার পাই সেইজাতীয় কাব্যিক কথককে যে ঠিক রক্ষণশীল নয়, কিন্তু যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রতিরোধের সামনে তার অস্তিত্ব ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশ গুলিয়ে যায়। তাই, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবিরোধিতা তার কাছে এক হয়ে যায়। শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতির সামনে তার সম্মুখে পড়ে থাকে শুধুই কেবল ব্যক্তিগত ভোগবাদ। বড়োজোর, নান্দনিকতাবাদ। কাজেই, নকশালবাড়ির রাজনীতিকে সমস্যায়িত করে অপর কোনো দ্রোহচেতনা আমরা পেলাম না হাংরি বিশ্ববীক্ষা থেকে। তার বদলে পেলাম একধরনের অরাজনৈতিকতা, যাকে বিদ্রোহ বলে চালানোর চেষ্টা করা হল।
কিন্তু, এই চালানের চেষ্টার মধ্যে যে আছে একধরনের ইয়া বড়ো ফাঁক ও ফাঁকি, সেটাও, অল্পস্বল্প হলেও ধরা পড়তে শুরু করল হাংরি কবিতাতেই।অরুণেশ ঘোষের ‘‘ছোটো শহরের অতিথি’’ কবিতাটির কথা আগেই বলেছি এ লেখায়। চলুন, আরেকবার ফিরে যাই সেই কবিতাটিতে। হাংরি কবিতার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে কবিতাটির পটভূমি ছোটোলোকেদের পাড়া। নাগরিক আবর্জনার ভগ্নস্তূপ, আর মধ্যবিত্ততার হাত থেকে নিস্তার খুঁজতে খুঁজতে ছোটোলোকের পাড়ায় হাজির মধ্যবিত্ত কবি, রাগী যুবা— অবশ্যই ‘ক্ষুধার্তবংশীয়’। এসবের মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। সবই বড়ো হাংরি-গন্ধীয়। সেইরকমই একটি পরিপ্রেক্ষিতে, অরুণেশ তার কবিতাটি শেষ করলেন একটি মোক্ষম লাইন দিয়ে : ‘‘আর মেয়েরা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে দেখছে পুরো ব্যাপারটিকে।’’ এবং, যে মূহুর্তে লিখলেন, মূহুর্তেই কবিতাটির নিজের শরীরে, হাংরি-বয়ানের নিজস্ব উদরমধ্যে তৈরি হল একটি বিপরীত অবস্থান। এরই নাম বোধহয় দ্বান্দ্বিকতা। সেই মতো, আমরা পেলাম একধরনের বৈষয়িকতা, যা হাংরি সংগ্রহশালায় প্রায় নেই-ই বলা চলে—একধরনের নারীনির্ভর, মেয়েলি পাঠের বৈপরীত্য। হ্যাঁ, এ নিয়ে আমি বিস্মিত হই না যে হাংরি প্রকল্পটির দিকে ‘‘চোখ কুঁচকে’’ যখন তাকানোর সময় হবে, তখন ওই সন্দেহভরা দৃষ্টি হানবে রাজনৈতিকমনস্ক, পিঠ টান টান করে দাঁড়াতে ভয় না পাওয়া মেয়েরাই। যেমন, আমি হানছি এই লেখায়। অথবা, অন্যান্য যাঁরা হয়তো শারীরবৃত্তীয় ভাবে আমার মতো মেয়ে বলে চিহ্নিত নন, কিন্তু চান ওই চোখ কুঁচকে তাকানোর শরিক হতে, অন্যান্য আরো অনেক কিছুর সাথে সাথে, তাঁদের দাঁড়াতে হবে পিতৃতন্ত্র-বিরোধী যৌন ও লিঙ্গ চেতনার এক শক্তপোক্ত মাটিতে।
‘‘আর মেয়েরা চোখ কুঁচকে দেখছে পুরো ব্যাপারটাকে’’
অর্থাৎ, ঝেড়ে কাসার সময় এসেছে এবার। মানে, হাংরি আন্দোলনের অন্যতম মূল মতাদর্শগত ভিত্তি যদি হয় বিবিক্তা, হাংরি কবিতা ও লেখালেখির সাথে আমার প্রধান সম্পর্কও তবে বিবিক্তার। মানে, কোনো কোনো সময়ে হাংরি কবিতা পড়তে গিয়ে এই আন্দোলনজাত কবিদের পাতাজোড়া লাইনের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে নিয়ম ভাঙা যতি চিহ্নের ব্যবহারও। মুগ্ধ করে কবিতার পংক্তির যে ভাঙা লাইনের পৃষ্ঠাগত স্থাপত্য, সে সব বিধি ভেঙে টানা গদ্যে লেখা। সেসব গদ্য আবার ঠিক পদ্যও নয়। গদ্য ও পদ্যের মাঝামাঝি। মুগ্ধ হই বহু সময়ে পড়তে গিয়ে। এবং প্রায় তৎক্ষণাৎ, ছিটকে বেরিয়ে আসি। বন্ধ করি পড়া।
কেন? কারণ, এ প্রশ্ন বারবার করতে বাধ্য হই, করি— এই যে বিবিক্তাঘন হাংরি কাব্যবিশ্ব, এখানে ঠিক কীরকমটি স্থান দেওয়া হয়েছে আমাকে, আমার মতো একটি মানুষকে। মানে, একটি মেয়েকে। তো, শুরু করি একটি অতীব সাধারণীকৃত পর্যবেক্ষণ দিয়ে। হাংরি কবিতায় মেয়েরা হাজির হয় মূলত যৌনবস্তু হিসেবে। সেখানে যৌনচেতনা ও শরীরচেতনা ছাড়া মেয়েদের অন্য কোনো চেতনা নেই। এবং, সেই যে যৌনায়িত নারী শরীর হাংরি কবিতার পরিধিতে তা টিকে থাকে একটি উপলক্ষ্য হয়ে। অলিখিত পাতার মতো— শূন্য, সাদা। যে সাদা পাতায় লেখা হবে রাগী হাংরি কবির যৌনকামনা।
হাংরি লিরিকের যে ‘‘আমি’’ সেখানে তাই প্রবেশাধিকার নেই আমার মতো কারুর। মাথা থেকে পা অবধি একটি রাজনৈতিক মেয়ের। নিজের যৌন-স্বাধীনতা যে বুঝে নিতে পারে। যার আছে স্বাধীন যৌন কল্পনা। নিজের। কিন্তু, সেই স্বাধীন যৌনচেতনা থাকার প্রাথমিক শর্তই তো হল আমি কারুর যৌনবস্তু নই। এবং, সেই যৌন চেতনাই কেবল অধিকার করে থাকে না আমার মানুষ ও নারী হিসেবে বেঁচে থাকার গোটা চেতনাকে। বরং, সেখানে আছে রাজনীতি, আছে শিল্পবোধ, সাহিত্যবোধ, মনস্বিতা। এবং, হাংরি কবিতার পাতায় নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি, হাংরি কবিতা ঠিক আমার মতো পাঠকের কথা ভেবে লেখা হয়নি। অর্থাৎ, হাংরি লেখালেখির প্রতীকী বিশ্ব গঠিত হয় এক ধরনের প্রগাঢ় কল্পনার খামতির মধ্য দিয়ে। যেখানে, বারবার প্রতিফলিত হয় এই সত্য যে, মেয়েদের বাস্তবিক জীবন ও অন্তর্জীবনের রূপায়ণে হাংরি লেখক-কবিরা এক্কেবারে অক্ষম।
এবং, এই কল্পনার খামতি প্রতিফলিত হয় হাংরি ইতিহাসের কবি-পরিচিতির মধ্যে। বহু ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি পেয়েছি একটি নারী নাম— আলো মিত্র। হাংরি দলিল-দস্তাবেজে তিনি ত্রিদিব মিত্রের স্ত্রী বলে চিহ্নিত। এই বিপুল পিতৃতান্ত্রিক নির্ভরতার সূচক ছাড়া, তাঁর অন্য‌ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না অন্য‌ কোনো লেখা। কোনো পাঠক যদি অন্য‌ কোনো ইতিহাসের হদিশ দিতে পারেন আমায়, দিতে পারেন অন্য‌ কোনো তথ্য‌, বাধিত হব। বদলে নেব নিজের ভাবনাচিন্তার গতিপথও। পরবর্তী সময়ে সুনীতা ঘোষ নামে এক কবির কবিতা পাওয়া যায় দু-একটি সংকলনে। কিন্তু, তাঁর সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারা যায় না। তাঁর কবিতাতেও এমন কোনো লিঙ্গচেতনা পাওয়া যায় না, যা ভেঙে দেবে বা সমস্যায়িত করবে হাংরিধর্মীয়দের যৌনচেতনার আধিপত্যকারী বয়ানকে।
অবশ্য, হাংরি চেতনার নিজস্ব তত্ত্বায়নের ধারার মধ্য দিয়ে দেখলে, তাদের লিঙ্গদর্শন নিয়ে খুব বেশি দ্বন্দ্বের কোনো জায়গা থাকে না। যেমন ধরুন, হাংরি তত্ত্বায়নে আমরা পাই একধরনের আত্মকথার প্রবর্তন। কাজেই, ইস্তেহারের পর ইস্তেহারে লেখা হয় ‘‘আপাদমস্তক কেবল নিজেকেই ব্যবহার করা’’, ‘‘নিজেকে দেখাই জগৎ কে দেখা, দেখাই জ্ঞান’’, ‘‘অভিজ্ঞতা ছাড়া সত্যকে ধরবার কোনো উপায় নেই— শুদ্ধ বুদ্ধি জীবন সত্যকে ধরতে পারে না’’ জাতীয় বাক্য। মানে, একধরনের সচেতন আত্মধর্মিতার নন্দনতত্ত্ব করা হয় হাংরি কবিতায়। সত্যি বলতে কী এধরনের সচেতন আত্মকথাকেন্দ্রিকতা হয়তো বাংলাসাহিত্যে সেইভাবে ছিল না।
কিন্তু, অন্যন্য হাংরি তত্ত্বায়নের মতোই এই আত্মকথাকেন্দ্রিকতা নিয়েও কোনো বিশদ বা গভীর আলাপ-আলোচনা হল না হাংরি লেখালেখিতে। কাজেই, আমরা এইসব ইস্তেহার থেকে পেলাম না ‘‘আমি’’ বা ‘‘নিজ’’ এককগুলির কোনো সংজ্ঞায়ন। ‘‘আমি’’টি কে? তার শ্রেণী কী? লিঙ্গ কী? জাতপাত কী? সমকামী না বিসমকামী এ ‘‘আমি’’? এবং যেহেতু ‘‘আমি’’-র কোনো সংজ্ঞায়ন পেলাম না, বিবিধধারার ‘‘আমি’’-র মধ্যেকার বহুমুখী দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই যে গঠিত হয় আমাদের সামাজিক ইতিহাসসমূহ, তারও কোনো বিশ্লেষণ বা একটি সাধারণ স্বীকারোক্তিও এল না কোনো হাংরি রচনায়। অতএব এই সংজ্ঞায়নের অভাবে যে ‘‘আমি’’ আমরা বারবার পেলাম, তা হল এক মধ্যবিত্ত ‘‘আমি’’। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে, ‘মধ্যবিত্ত পুরুষ আমি’। আর, যেহেতু সগর্বে, সশব্দে ইস্তেহারে ইস্তেহারে ঘোষণা করা হল, নিজেকে-দেখাই-জগৎকে-দেখা জাতীয় মন্তব্য, তাই মধ্যবিত্ত পৌরুষের দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া আর কিছুই এল না হাংরি লেখালেখির পরিধিতে।
এছাড়া, এই আত্মকথাকেন্দ্রিকতার পাশাপাশি এল আর একটি উচ্চারণ— ‘‘জীবনকে ত্যাগ করে নয়, জীবনের কাদামাটি অশ্লীলতার মধ্যে ডুব দিয়ে আবার বেরিয়ে আসা।’’ যার অর্থ সহজ বাংলায় বললে দাঁড়ায়, আমি কতো খারাপ তা পরত খুলে খুলে দেখাতে হবে। অর্থাৎ, একধরনের এক্সপোজার বা উন্মুক্তির নন্দনতত্ত্ব ও রাজনীতি। এই ছক অনুয়াসী যা দাঁড়ায়, তা  হল, মধ্যবিত্ত পুরুষ অসৎ। পিতৃতান্ত্রিক যৌন আগ্রাসনের ইচ্ছা পৌরুষের আদিগন্ত বাস্তব। কাজেই, সে সামাজিক ও অর্ন্তবাস্তবকে বারবার নিয়ে এসো নিজের কবিতায়।
কিন্তু, মুশকিলটা হল গিয়ে এইখানে যে, মধ্যবিত্ত পিতৃতান্ত্রিতাকে চেনার জন্যে আমার তো কোনো হাংরি কবিতার দরকার নেই! সে তো জন্মইস্তক পরিবারের মধ্যে, পরিবারের বাইরে, ক্লাসরুমে, কফিহাউসের আড্ডায় দেখে চলেছি তো দেখেই চলেছি। জানি, এই কথাটি বলার সাথে সাথে রে রে করে উঠবে আমার বহু বহু পুরুষ বন্ধুরা। বলবে, যে মেয়েরা ভাবনাচিন্তা করে— অর্থাৎ, আমাদের, মানে আঁতেল ছেলেদের মতোই— তাদের ওইটুকু একটু হজম করে নিতে হবে। সে ‘ওইটুকু’ হতে পারে হাংরি কবিতা, বাউলগান, কামু, কাফকা, মার্ক্স বা রামকৃষ্ণের পিতৃতান্ত্রিকা। কারণ, ওই পিতৃতন্ত্র ব্যাপারটা একটু হজম করে নিলেই যে মিলে যাবে আরও বৃহত্তর মুক্তির দিশা।
তো, এই বলে শুরু করি— না, হজম করব না। তাই, উল্টো এক পদ্ধতিতে পড়ব যাবতীয় হাংরি কবিতা। এবং বলব, যদি সাহস থাকে, আপনিও বেছে নিন সেই উল্টোপাঠের প্রক্রিয়া। শৈলেশ্বর ঘোষ থেকে মলয় রায়চৌধুরী, সুবো আচার্য থেকে ফাল্গুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ থেকে বাসুদেব দাশগুপ্ত, পড়তে বসুন হাতে কলম নিয়ে। দাগাতে থাকুন যৌনতা-বিষয়ক ক্ষুদ্রতম রেফারেন্সটিও। কেন্দ্রে রাখুন নারীবিষয়ক ক্ষুদ্রতম শব্দটিকেও। মার্জিনে পাঠিয়ে দিন সমস্ত যা ছিল এতোদিন হাংরি পাঠের কেন্দ্রে— প্রতিবাদ, বিপ্রতীপতা, প্রতিষ্ঠাবিরোধিতা, বিদ্রোহ— ইত্যাদি শব্দগুলো। ছুঁড়ে ফেলুন পৌরুষের যন্ত্রণা আর বিবিক্তানিসৃত দৃষ্টিভঙ্গী। ভুলে যান যৌবন। আবারও বলি, কেন্দ্রে রাখুন হাংরি কবিতার, গদ্যের মেয়েদের। হাংরি বিবিক্তা ও বিদ্রোহের বয়ান দেখতে চেষ্টা করুন ওইসব মেয়েদের চোখ দিয়ে। না পারলে, শিখুন। আবার পড়ুন। শিখুন। শিখুন। শিখুন। এবার বলুন, কেমন ঠেকছে হাংরি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বয়ান?
পড়ুন এই লাইনগুলো: ‘‘বোনের বুকের থেকে সরে যায় আমার অস্বস্তিময় চোখ/আমি ভাইফোঁটার দিন হেঁটে বেড়াই বেশ্যা পাড়ায়।’’ বলুন, ঠিক কোনধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বয়ান গড়ে উঠেছে এখানে? হ্যাঁ, বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না যে একধরনের বিনির্মাণ ঘটছে এই লেখায়। বিনির্মাণ করা হচ্ছে ভাইফোঁটা নামের সেই উৎসবটিকে যা নাকি ভাইবোনেরদের মধ্যেকার চিরকালীন ভালবাসার প্রতীক। বদলে তুলে ধরা হয়েছে এখানে ভাইফোঁটার পরোক্ষ রূপকল্পকে। ফোঁটার বিনিময়ে বোনের ঠিক কী রক্ষা করে ভাইয়েরা? প্রাথমিক নৃতত্ত্ববোধ বলে, যৌনতা। পরিবারের মানসম্মান। নারীযৌনতার নিপাট আইনানুগ হাতবদল। মালিকানাবদল। বাবা-ভাইয়ের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে স্বামীর ঘরে। এবং, এই বিনির্মাণে ফাল্গুনীর মূল হাতিয়ার হল আগ্রাসী পুরুষ যৌনতা। যে পুরুষ যৌনতা আসলে অবদমিত, এবং যার নিজস্ব অবদমনের বলয় মধ্যে আগ্রাসী, প্রায় খাদকসম।কিন্তু মুশকিলটা হল গিয়ে এই যে, এইজাতীয় আগ্রাসী পুরুষ যৌনতা যে বোনেদের, ভাইঝিদের, কন্যাদের বুকে ও শরীরের অন্যত্র ঘুর ঘুর করে, তা মেয়েদের ফাল্গুনীর কবিতা পড়ে জানতে হয় না। কাজেই, বিনির্মাণ না দেখে এই পংক্তিগুলিতে আমি দেখি উদযাপন। আগ্রাসী পুরুষ যৌনতার উদয‌াপন।
ঠিক যেভাবে, আমার কাছে কবিতায় বিবিক্তালিপির বারংবার পুনরাবৃত্তি যথেষ্ট নয়, তেমনি যদি এ হয় সৎ বিনির্মাণ বা উন্মুক্তিকরণ, তাও যথেষ্ট নয়। এই আত্মবিমোচনের রাজনীতিকে আমি দেখি একধরনের কল্পনার সীমাবদ্ধতার রূপক হিসেবে। তাই, যেখানে প্রয়োজন ছিল পরিবার ও তদ্-অন্তর্গত পিতৃতান্ত্রিকতার রাজনীতির ভাষা ও বাস্তবিকতা নিয়ে নাড়াচাড়া, সেখানে আমরা পেলাম মধ্যবিত্ত পুরুষের প্যাঁচপেঁচে নৈতিকতা। যেখানে ‘বোন’ ও ‘গণিকা’কে মুখোমুখি রেখে তৈরি করা হল একটি দ্বৈত। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবং, করা হল এইধরনের সংশ্লেষণের যৌন রাজনীতির ধারণা ছাড়াই। এবং, এই জাতীয় সংশ্লেষণ ফাল্গুনীর কবিতার অন্যতম মূল ভিত্তি তো বটেই, অন্যতম মূল ভিত্তি সার্বিকভাবে হাংরি কবিতার লিঙ্গ-যৌনতার রাজনীতিরও।
যেমন ধরুন, শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা ‘‘পাখির মাংস, পাখির গান’’-এর কয়েকটি লাইন : ‘‘যাকে বলে ভালোবেসে ঘাড় ভেঙে দেওয়া, এভাবে আমরা আছি বেঁচে /প্রণয়িনীগণ দুনিয়া যাচাইয়ের কাজে শেষে প্রথমেই গণিকা ভঙ্গীতে নাচে, /পাখির মাংস খাওয়া শেষ হলে ভাঙা রেকর্ডে পাখির গান উঠল বেজে!’’ লাইনগুলির মধ্যে আছে একধরনের হাংরি-স্বভাবোচিত আবেগ ও তীব্রতা। কিন্তু, সেই আবেগ ও তীব্রতা তাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে আবারও একধরনের প্রচলিত, আধিপত্যকারী নৈতিকতার ভাষার মধ্যে।সে নৈতিকতার মধ্যে জটিল রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জায়গা বড় কম। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, সেই নীতিবোধের ভাষায় নারী, নারীর সক্রিয় যৌনতা ও শরীর হয়ে উঠে যাবতীয় বাণিজ্যিকীরণের রূপক। তাই, জানতে ইচ্ছে হয়, শৈলেশ্বরের এই উচ্চারণ প্রচলিত কামিনীকাঞ্চন-হইতে-দূরে-থাকো বয়ানের থেকে আলাদা কোথায়? আর, আলাদা যদি না হয়, তাহলে শৈলেশ্বর তথা তাঁর ক্ষুধার্ত সাঙ্গোপাঙ্গোদের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় আমার কি ছেঁড়া গেল?
এবং, লিঙ্গ ও যৌনতার রাজনীতির চশমা দিয়ে দেখলে, যেটা প্রথমেই লক্ষ্য করা যায়, তা হল, হাংরিজাত যে মতাদর্শগত লিপি, তার মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, নৈতিক বিরোধিতা। তাহলে, হাংরি নৈতিকতার সাথে মধ্যবিত্ত ভদ্রলৌকিক যৌন নীতিকথার পার্থক্য করা রীতিমতো অসাধ্যসাধন। অতএব, শৈলেশ্বরের বিতর্কিত কবিতা ‘‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’’তে যখন এইজাতীয় লাইন লেখা হয়, ‘‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্যধর্মহীন/রহস্যতলার হে ঘোড়া/পরিবহণযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে আছে’’ এবং তার ব্যাখ্যা হিসেবে শৈলেশ্বর লেখেন, ‘‘সত্য‌ শিব সুন্দর—তিনজনই বিধবা, কেননা, ঈশ্বর আজ মৃত। তারা গর্ভবতী, কেননা তারা ধর্ষিতা এই আধুনিক সভ্যতার হাতে। কিন্তু, ধর্ষণের পর আধুনিক মানুষও আর মানুষ থাকে না। পরিণত হয় জন্তুতে, ভারবাহী পশুতে, যার সামনে আবশিষ্ট জীবনের জন্য পরিবহণযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে থাকে‘‘, তখন, মনে রাখবেন, পাঠক, অশ্লীলতা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় না। যেমনটি হয়েছিল শৈলেশ্বরের সমসময়ের পাঠকদের। আবারও বলি, শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, যথেষ্ট মাথাব্যথা আছে কোনো কবিতায় বা গদ্যে শব্দবন্ধ, রূপক, পংক্তিবিভাজনে ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ঠিক কী ধরনের ক্ষমতা-পরিকাঠামোর বয়ান তৈরি হল, তা নিয়ে। তো শৈলেশ্বরের এই পংক্তিগুলিতে ধর্ষণ হয়ে উঠল সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতীক। বুঝলাম। ধর্ষিতা নারী-শরীর সেই অবক্ষয়ের যৌনায়িত ও লিঙ্গায়িত রূপক। তাও বুঝলাম। শুধু তাই-ই নয়, শৈলেশ্বরের বয়ানে, সেই ধর্ষিতা শরীর হাজির হল নিষ্ক্রিয়তার রূপক হিসেবেও। তারা নিষ্ক্রিয়, তাই তারা শায়িত। তারা ধর্ষিত, কারণ তারা ধব— অর্থাৎ পরিত্রাতাবিহীন। তারা সামাজিক অবক্ষয়ের রূপকই হতে পারে শুধু। সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে— মায় তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া যৌন হিংসার বিরুদ্ধে— লড়াইয়ে নামার ক্ষমতা তাদের নেই। এক্কেরে এজেন্সীবিহীন নারীকুল। এজেন্সী-অর্থাৎ কর্মক্ষমতা— তা আছে কেবল পৌরুষের হাতে। যে পৌরুষ আজ ধর্ষণক্রিরায় লিপ্ত হতে হতে ক্ষয়িষ্ণু।
পাঠকবন্ধুরা, পরিচিত লাগে কী এই লিঙ্গায়িত রূপকল্পের ছক? খুব দূরে মনে হয় কি এই রূপকল্প জাতীয়তাবাদী-ভারতমাতার রূপটি থেকে? বঙ্গমাতা জাতীয় ভাবনাচিন্তার থেকে? মানে, আর.এস.এস. হিন্দুত্ববাদী রূপকল্পের থেকে ঠিক কতো দূরে এই হাংরিয়ালিস্ট লিঙ্গ-যৌন-চেতনা, যেখানে মেয়েরা হয়ে ওঠে একাধারে সমস্ত ক্ষয় ও সামাজিক অবমাননার সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় রূপক?
এবং এই অর্ন্তদ্বন্দ্বের হাত ধরে আর একটু নিবিড় পাঠের মধ্যে ঢুকলে দেখা যাবে যে, স্বাধীন  বৈষয়িকতার স্বাতন্ত্রে দীপ্ত নারী যৌনতা নিয়ে এক গভীর উৎকণ্ঠাপূর্ণ আকুলিবিকুলি আছে হাংরি দর্শনের অভ্যন্তরে। যেমন আছে নারীর বৌদ্ধিকতা ও রাজনৈতিক চেতনা নিয়েও। কাজেই, সুবো আচার্য যখন তাঁর ‘‘রাইনের মারিয়া রিলকের জন্মদিনে ১৫ পয়সার ডাক টিকিট’’ কবিতায় লেখেন, ‘‘অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু রবিঠাকুরের/খুবই বিশ্বস্ত শিষ্য একথা বলায় সাধনা ও তার মেজদি রেগে গিয়েছিল /আমি সাধনাকে চাই তার মেজদিকেও চাই /শেকড়ের মতো শরীর শুষে নিয়েও আমার পিপাসা মেটে না’’, তখন আগ্রাসী পুরুষ যৌনতা ও পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গচেতনা মিলেমিশে এক জটিল আবহের সৃষ্টি হয়। জটিল, একদিক থেকে দেখলে। আবার, অন্যদিক থেকে দেখলে অতীব সরল। সাধনা ও তার তার মেজদির প্রতিমূর্তিতে আমরা পাই বাংলা কবিতার দুই পাঠিকাকে। এবং শুধু গোগ্রাসে গিলে চলা, সমালোচনাবিহীন পাঠিকা নয়, এমন পাঠিকা যাদের কবিতা বিষয়ে আছে নিজস্ব জোরালো মতামত।
এমনিতে, বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়ের কবিতাপাঠের ইতিহাস ও তার সাথে ভদ্রলৌকিক আধুনিকতার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে একাধিক গবেষণা হতে পারে। হওয়া উচিত। এবং, সুবোর কবিতায় ধরা পড়ল সেই পাঠিকার ছায়া। পড়ল, আর মধ্যবিত্ত বিবিক্তাপ্রিয় ‘ক্ষুধার্ত’ কবিকে ভরপুর চুলকে দিল। তাই, কবিতায় আমরা সেই পাঠিকাদের সাথে কবিতার কথকের কোনো রকম মতবিনিময়ের ভাষ্য পাই না। বিতর্ক বা মতবিরোধও নয়। যে ধরনের মতবিরোধ নাকি ধরে রাখে আমাদের বৌদ্ধিক চর্চার পরিমণ্ডলগুলিকে।
তার বদলে আমরা পেলাম, দুই পাঠিকার যৌনায়ন। সুবোর কবিতার পরিসরে কবিতার পাঠিকা, সমালোচক থেকে তাদের নামিয়ে আনা হল দুটি যৌনবস্তুতে। যৌনায়নের মধ্য দিয়ে, বলা যেতে পারে, তাদের পথে আনা হল। হুঁ হুঁ বাবা, যতই কবিতা আর বুদ্ধদেব বসু আর বড় বড় বিষয় নিয়ে কথা বোলো না কেন, শেষ পর্যন্ত তো তুমি আসলে ফুটো! কাজেই, কবিতার পরিসরে সাধনা ও তার মেজদির সাথে ক্ষুধার্তবংশীয় কবির মতবিরোধ প্রকাশ তো দিত তাদের একধরনের সম্মান— প্রতিপক্ষের সম্মান, সমগোত্রীয়ের সম্মান। সেসব আবার হতে দেওয়া যায় না কি? তাই, আমরা প্রত্যশামতোই দেখলাম পুরুষ যৌনতা হয়ে উঠল একধরনের অস্ত্র এখানে। আগমার্কা মেয়েদের বাগে আনা যায় যা দিয়ে।
প্রিয় পাঠক, খুব অপরিচিত ঠেকছে এই পুরুষ যৌনতা, তথা পুরুষ যৌনাঙ্গের অস্ত্রীকরণ? মনে পড়ে যাচ্ছে না কি ২০১২-পরবর্তী সমকালীন ভারতবর্ষে একটির পর একটি ধর্ষণের ঘটনা? তবে, চিন্তা করবেন না। সুবো আচার্যের কবিতায় ধর্ষকল্প যদি হাজির হয়ে থাকে পরোক্ষভাবে, প্রত্যক্ষ ধর্ষকল্পেরও কোনো অভাব নেই হাংরি কবিতাভাণ্ডারে। এবং, সেই ধর্ষকল্পের আরো বিশদ আলোচনার জন্য পড়ুন আয়নানগরের বইমেলা ২০১৫ (মুদ্রিত) সংখ্যায় দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মলয় রায়চৌধুরীর ‘‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’’ কবিতাটির বিশ্লেষণ। আমি আর এই লেখায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাব না। তার বদলে আর একটি উদাহরণ দিই। সুভাষ ঘোষের ‘‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’’ লেখাটি থেকে—‘‘নীলা সেবার তোমাকে ল্যান্ডমাস্টারের পাশে সিটি মারার কারণ, অকস্মাৎ পাশে, বিশাল শো-কেসে একপাল মেয়ে এসে পড়ে, ওদের মেলানো ছাতার মতো পাছার উপরে থমকে যাই, প্রবেশ চাই, পাই না, খাবি খাই, তাবৎ শিক্ষা পারিপার্শ্বিকবোধ দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়— ।’’ তো, আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, মেয়েদের টোন মারাটা ঠিক কি ধরনের বিদ্রোহ বা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা? কেউ একটু বুঝিয়ে দেবেন আমাকে? আমি শুনতে রাজি আছি।
কিন্তু, আসলে এটাই সত্য যে হাংরি সাহিত্য আন্দোলনজাত লেখালেখি একটু গভীরভাবে পড়লে যেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, হাংরি আন্দোলনের যে বিদ্রোহের ধারণা ও তত্ত্বায়ন, তা আপাদমস্তক দাঁড়িয়ে আছে নারীশরীরকে বস্তুকরণের মধ্যে, লঙ্ঘনের মধ্যে। তদুপরি, স্বাধীন নারী যৌনতার কথা বলতে গেলে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বেরিয়ে পড়ে ভদ্রলৌকিক যৌন নৈতিকতা। যেমন ধরুন, ফাল্গুনী রায়ের যে লাইনদুটি কোটিয়ে কোটিয়ে বাংলার সমালোচককূল একদম শ্যাষ কইরা দিছে, তা হল, ‘‘আমি নারী মুখ দ্যাখার ইচ্ছায় মাইলের পর মাইল হেঁটে দেখি/ শুধু মাগীদের ভিড়।’’
তো, প্রথমত জানতে ইচ্ছে করে, নারীর সংজ্ঞা কী? মাগীরই বা সংজ্ঞা কী? মানে, লজ্জাবনতা, নীরব, রাঁধে, বাড়ে, স্বামীসেবা করে? যেমন নাকি ছিলেন সুভাষ ও শৈলেশ্বর ঘোষের স্ত্রী? যাঁদের কথা লিখতে গিয়ে মার্কিনী কবি জর্জ ডাওডেন লিখেছিলেন, ‘‘I have marvelous meals at the rooms of Saileswar and Subhash… their wives cook them and serve them and say very little… shy… proper.’’ আর, মাগীরা কারা? আমার এবং আমার বান্ধবীদের মতো মেয়েরা? ঠিক কী কী করলে ‘‘নারী’’রা ‘‘মাগী’’ হয়? আচ্ছা, একবার ‘‘মাগী’’ বলে চিহ্নিত হলে কি আবার ‘‘নারী’’ হওয়া যায়? তো, এই যে ফাল্গুনী রায় তৈরি করলেন ‘‘নারী/মাগী’’ দ্বৈত, বা বলা ভালো পুনরাবৃত্তি ঘটালেন, তার মধ্যে দিয়ে সেই আবার দেখলাম আমরা জাতীয়তাবাদ থেকে ধর্মীয় দক্ষিণপন্থা থেকে বিপ্লবী বাম বয়ানে যে উদ্বেগমাখা ক্ষেত্রের মধ্যে বিরাজ করে নারী যৌনতা, তার একটি জোরালো উদাহরণ।
কাজেই, যদিও হাংরি লেখালেখি সরে এল মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যতার ক্ষেত্রগুলি থেকে, মধ্যবিত্ত বসার ঘর ও শোবার ঘরের ঢলাঢলি, নাটকের থেকে রাস্তার ধারে, শুঁড়িখানায়, লালবাতি অঞ্চলে, তাদের লেখা থেকে সতী-বেশ্যা, গৃহবধূ-গণিকা ইত্যাদি দ্বৈততা মুছল না। অর্থাৎ, ভদ্রলৌকিক মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যতার সংস্কৃতি যে মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে, তার অবলোপন ঘটল না। কিন্তু, সময়টা ষাটের দশক। নকশালবাড়ী-পরবর্তী বাংলা তথা কোলকাতা। তাই, এই সতী-বেশ্যা দ্বৈততাতেও কখনো কখনো পড়ল নকশালবাড়ির ছায়া। সমসময়ের রাজনৈতিক উত্তালতার ছায়া।
‘‘কবিতা বুলেট’’ কবিতায় যখন ফাল্গুনী লেখেন, ‘‘মৃত সব শহীদ বন্ধুর শেষ যৌনেচ্ছার উদ্দেশ্যে / আমি একদিন করেছিলুম শোকপালন বন্ধ করে মাস্টারবেশন / বেশ্যার ঘরে থাকে টেলিভিশন তাদের কুকুরের জন্যও বরাদ্দ থাকে মাংস / দেওয়ালে ঝোলেন সেখানেও সস্ত্রীক পরমহংস / আর কতো সত্যিকারের সতী মেয়ে বিপ্লবের কারণে / যৌনাঙ্গে বহন করে পুলিশের চুরুটের ছ্যাঁকা / তাদের প্রেমিক কেরিয়ারিস্ট হতে না পারায় সমাজের চোখে বনে যায় বোকা’’, তখন আমরা মুখোমুখি দাঁড়াই একধরনের ঘাঁটা রাজনীতির সামনে। সেখানে একদিকে যেমন আছে সত্তর দশকের শহীদদের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধাঞ্জলি, তেমনি সেই শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্যে নিহিত হয়ে আছে একপ্রকার মূর্তিভাঙার নন্দনতত্ত্বের চোরাবালি। তাই, শহীদের যৌনেচ্ছার কথা বলে ফাল্গুনী পাঠকের সামনে হাজির করেন একটি রক্তমাংসের শরীর, জীবনের থেকে বড় শহীদ-প্রতিমূর্তি নয়। পাথরের মূর্তি নয়। বুঝলাম। আপত্তিও নেই কোনো। একই সাথে পেলাম কেরিয়ারিজমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, কেরিয়ারিজম বর্জন করতে পেরেছে যে বিপ্লবী যুবক,তার প্রতি নির্নিমেষ শ্রদ্ধা। এবং, বলা যেতে পারে, হাংরি নিয়মবর্জিতভাবেই, আমরা পেলাম সেই কেরিয়ার বর্জনকারী যুবকের প্রেমিকার প্রতিমূর্তি। তাকে ফাল্গুনী কবিতায় বর্ণনা করলেন, ‘‘সত্যিকারের সতী মেয়ে’’ বলে। এবং, সেইসব মেয়েদের প্রতি ফাল্গুনীর শ্রদ্ধাসত্ত্বেও, তাঁর কবিতার গহ্বরে ঘটল একধরনের লিঙ্গভিত্তিক মতাদর্শগত হিংসা। মেয়েদের রাজনৈতিক চেতনা ফাল্গুনীর কাছে হয়ে উঠল সতীত্বের সমার্থক। কাজেই, তিনি যখন বলতে চাইলেন নারীদের বিপ্লবী চেতনার কথাও, সেই বয়ান নারীদের যৌনায়িত আত্মতার গণ্ডী ডিঙোতে পারল না। আর, পারল না বলেই, ফাল্গুনী তাদের রাজনৈতিক চেতনাকে দেখলেন গণিকাবৃত্তির সাথে দ্বৈততায়। সপাটে তাঁর কবিতায় এইভাবেই ফিরিয়ে আনলেন ভদ্রলৌকিক যৌন নীতিবাগীশতাকে।
হাংরি কবিতায় তাই যখন আসে ‘‘গণিকাসভ্যতা’’-র মতো একটি শব্দ, এবং আসে স্বাধীনতা-পরবর্তী সামাজিক ডামাডোল ও রাজনৈতিক অবক্ষয়কে বোঝাতে, তখন আরো-আরো বেশি করে মূর্ত হয় সেই নীতিবাগীশতা আর, আমার মতো ছ্যাঁচড়া পাঠকরা, যারা গণিকাবৃত্তিকে ঠিক ওই নীতিবাগীশতা দিয়ে দেখে না, গণিকাবৃত্তির সমস্ত হিংস্রতা, ভয়াবহতা ও অসাম্যতার বাস্তবতা মেনে নিয়েও, বিষয়টিকে দেখে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পুঁজির ঘাতপ্রতিঘাতজাত চশমার মধ্য দিয়ে, তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, পচে যাওয়া, গলে যাওয়া এই সমাজ যদি হয় ‘‘গণিকাতুল্য’’, তবে ‘‘গণিকা’’ শব্দটির আড়ালে যে রক্তমাংসের মানুষটি রয়েছেন, তাঁকে ঠিক কীভাবে দেখেন হাংরিরা তাঁদের কবিতায়, লেখায়? ঠিক কোন কোন প্রতীকের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় এই গণিকা-প্রতিমূর্তি?
শৈলেশ্বর ঘোষের লেখায় তাঁরা এলেন নীরব, নিষ্ক্রিয়, অত্যাচারিত হিসেবে, আমাদের মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টালিটির প্রতিভূ হয়ে— ‘‘প্রতিদিন ডজন ডজন মেয়ে বিক্রি হয়ে যায়, ভরে ওঠে ক্রীড়াক্ষেত্র বেশ্যাখানা /ক্রেতা বিক্রেতা দুপক্ষই জানে, লাভের পাল্লাটি ভারী হলে তুলাদণ্ড লোকসানটি চাপিয়ে করে ন্যায়ের সূচনা” আর সেই ‘‘ডজন ডজন মেয়েরা’’— তাঁরা শৈলেশ্বরের কবিতায় হাজির হন বিমূর্ত উপস্থিতি হিসেবে। প্রায় যেন ভৌতিক। তাঁদের কোনো চেতনা নেই, নেই কোনো প্রাত্যহিক জীবন। কিন্তু এই সেন্টিমেন্টালিটিজাত প্রায় সামন্ততান্ত্রিক ছিটেফাঁটা যে মানবতাবোধ নিয়ে শৈলেশ্বর দেখলেন এই মেয়েদের, তার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট রইল না বাকীদের লেখায়।
তাই, বাকীরা— ফাল্গুনী রায় থেকে সুভাষ ঘোষ থেকে অবনী ধর থেকে বাসুদেব দাশগুপ্ত— তাঁরা লালবাতি অঞ্চল ও তদস্থ বসবাসকারী দেহোপজীবীনী মেয়েদের করে তুলতেন নিজেদের ফ্যান্টাসির ক্ষেত্র। তাই, ফাল্গুনীর কবিতায় যখন পাই কবিতার কথকের ‘‘বেশ্যার নাঙ হয়ে জীবন কাটাতে চাই’’ ঘোষণা, তখন, হ্যাঁ, খুব এক চিলতে হলেও ভাঙা হয় বটে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকজনোচিত মূল্যবোধ, কিন্তু সেই ভাঙার প্রচেষ্টা ঘটে থাকে গরিব খেটেখাওয়া মেয়েদের, বেশ্যা মেয়েদের ঘাড়ে পা রেখে। তাই, হাংরি কবিতায় বেশ্যালয়ে গিয়ে মধ্যবিত্ত সামাজিকতার ঘাড় ভাঙা কথকের যে প্রতিমূর্তি পাই, লালবাতি অঞ্চলের মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক ভোক্তা তথা খাদকের। তাই, ঠিক যেভাবে ছিঁচকাঁদুনেপনা, ক্রোধ আর আত্মসমবেদনার জালের তলা থেকে কখনো বেরোয় না হাংরি কবিতায় পরিবারসম্বন্ধীয় একটিও গূঢ় বিশ্লেষণও, তেমনি লালবাতি অঞ্চল, যৌনব্যবসা, গণিকাবৃত্তি ইত্যাদি নিয়েও একটিও বিশ্লেষণমূলক লাইন পাওয়া যাবে না হাংরি কবিতায়, গদ্যে।
যেমন, ‘‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’’ গদ্যে সুভাষ ঘোষ লেখেন, ‘‘বাড়ি ফিরতে বেবিকে খুবই মনে পড়ে, মনে পড়ে পাশাপাশি লিলিকে, ওরা কে কাকে যে টুকে নিয়েছে, সেবার দেখেই বেবিকে পছন্দ করি এই জন্যেই কি— /সত্যিই কি যে কাঠি— সামান্য ছোঁয়ায় লিলি কতো বড়ো ঘরের ছেলের বৌ হয়ে যায়, (আমার ছোঁয়া পেয়েও) বধূমাতা হয়ে যায় লিলি— ছোঁয়া না পেয়েই চলে আসে অথবা এসে পড়ে আমারই নখ ও থাবার সামনে বেবি —’’ বেবি, অর্থাৎ লালবাতি অঞ্চলের দেহোপজীবিনী। লিলি, অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত ‘‘ভদ্রবাড়ি’’-র মেয়ে। কথকের প্রাক্তন প্রেমিকা। বুঝলাম। বুঝলাম কি করা হচ্ছে এখানে। দেহোপজীবিনীর সাথে পাশাপাশি রেখে বধূমাতার যে আধিপত্যকারী ন্যাকান্যাকা নির্মাণসমূহ, সেসব ভাঙা হল। ভাঙা হল গৃহবধূর প্রতিমূর্তিকে যৌনায়িত করে। ভাঙা হল বধূমাতার বহুগমনের কথা বলে। কিন্তু, সেই বিনির্মাণের পাশাপাশি গড়ে উঠল না কোনো গৃহবধূর সামাজিক অবস্থানটি নিয়ে কোনো গাঁড় ফাটানো বিশ্লেষণ। বরং থাকল একটু হাহাকার। আহা রে, সময় এতো খারাপ যে ঘরের বৌ আর ঘরের বৌ থাকল না রে! হয়ে গেল বাজারের মাগী! তো, এ কথা পড়ার জন্য, এই উপলবদ্ধিতে আসার জন্য আবারও অতো হাংরি-মাংরি আঁতলামোর কি আছে? তৃতীয় শ্রেণীর টলি-বলির ছবিই তো যথেষ্ট। কাজেই, আবারও বলি, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কণামাত্রও নেই এখানে। আছে প্রগাঢ় স্থিতাবস্থামুখীনতা।
কিন্তু, মাইরি বলছি, এতে অবাক হবার কিচ্ছুটি নেই। এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কাজেই, চলুন ফিরে যাই সেই মুহূর্তটিতে, যখন ‘‘মুক্ত কবিতার ইস্তেহার’’-এ লেখা হল, ‘‘মৃত্যু আর যৌনতা যা মানুষের সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, লেখায় সেই রুদ্ধ চেতনাকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া— অবসেসনগুলিকে লেখায় মুক্তি দিতে হবে—  সেটাই বুর্জোয়ার বিপদ।’’ এবং, এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে হাংরি লেখালেখি—যার যথেষ্ট উদাহরণ এই লেখার শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে— সেসব বোধগম্য‌ হতে শুরু করে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সামাজিক যৌন অবদমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, হাংরি ধারার অন্যতম রাজনৈতিক ও দার্শনিক কেন্দ্রবিন্দু। সে কথা আরো বিশদে লিখলেন শৈলেশ্বর তাঁর ‘‘ভাষা বিমোচন’’ প্রবন্ধে : ‘‘মানুষের যৌনতার অবদমন ঘটে ক্ষমতার স্বার্থে। যৌনতার মুক্তি মানুষের স্বাধীনতা চেতনাকে আরও প্রসারিত করে।’’ এবং, এই ধারার বক্তব্য‌ের পুনরাবৃত্তি হতে থাকল হাংরি লেখকদের লেখায়, হাংরিপন্থী সমালোচকদের লেখায়। কিন্তু, এই যৌন অবদমনের আলোচনায় যে প্রশ্নটি কখনো উঠল না, তা হল, কার যৌন অবদমন।
আলোচনায় আনা হল না এই কথাটা যে মানুষের যৌনতা সম্পৃক্ত থাকে সামাজিক সম্পর্কে, এবং সেই সামাজিক সম্পর্কের অন্যতম ভরকেন্দ্র লিঙ্গ। কাজেই, হাংরি লেখালেখিতে ‘‘যৌনতা’’ এককটি এল ‘‘লিঙ্গ’’ এককটির সাথে সম্পর্কবিছিন্নভাবে। যৌন অবদমন ভাঙার কথা এল, এল না পিতৃতন্ত্রাধীন বৈধ যৌনতার রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা। কেমনভাবে পিতৃতান্ত্রিক যৌন সম্পর্কে পুরুষলিঙ্গ হয়ে ওঠে রাষ্ট্র, পরিবার, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অস্ত্র, সেসব নিয়ে কোনো আলোচনাই হল না।আর, তার ফলে, অবশ্যম্ভাবীভাবে, যা দাঁড়ালো, তা হল, যৌনতা অর্থই বিসমকামী পুরুষ যৌনতা। এবং হাংরি কবিতায় ও গদ্যে সে যৌনতা তার অবদমন ভাঙতে চাইল নারী শরীর ও নারী যৌনতার ওপর তার কর্তৃত্ত্ব ও আগ্রাসনের কাহিনীর মধ্য দিয়ে।
কিন্তু, তৎসত্ত্বেও বলব, এসবের মধ্যেও অবাক হবার কিছু নেই। এই রাজনৈতিক শৈল্পিক সীমাবদ্ধতার বীজ লুকিয়ে আছে হাংরি দর্শনের ভিত্তির পরতে পরতে। বিশেষত তার আত্মজৈবনিকতার দর্শনের মধ্যে। যে জোর দিয়ে আত্মজীবনীকে দেখা হল হাংরি দর্শনে, সেই জোরের মধ্য দিয়েই বন্ধ হল একাধিক দরজা। একথা আমিও মনে করি যে, আত্মজীবনী বাদ দিয়ে কোনো লেখাজোখা হয় না। কিন্তু আবার শুধু আত্মজীবনী দিয়েও কোনো সাহিত্য, কবিতা বা রাজনীতি হয় না। এবং একটু চারপাশটা তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে,সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রচলিত ধারাই হল আত্মজীবনী। আমরা অনেকেই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা গোগ্রাসে গিলি। তাই, শুধুই আত্মজৈবনিকতার পুনরাবৃত্তির মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানবিরেধিতা নেই। কার আত্মজীবনী, কীভাবে আত্মজীবনী, কেমনভাবে আত্মজীবনী, এসব প্রশ্নের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বীজ। কিন্তু, এই জাতীয় জটিল প্রশ্নের উত্থাপন হাংরি জেনারেশনের স্বভাববিরুদ্ধ। তাই, আমরা হাংরি দর্শনে আত্মজৈবনিকতার নামে যা পেলাম তা হল একধরনের আত্মজীবনীর উপধর্মময়তা।
আসলে, হাংরি আত্মজীবনী তো বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষের আত্মতার গল্প। অর্থাৎ, বাংলার আধুনিকতার বিকাশের আধিপত্যকারী শ্রেণীচেতনার গল্প, আধিপত্যকারী লিঙ্গচেতনার গল্প। এবং, সেই গল্প আমাদের পারিপার্শ্বিকের গলা কামড়ে ধরে আছে। তাই, যা দাঁড়ায় এখানে, তা হল— হাংরি আন্দোলনের মূল ভিত্তিই নির্মিত হয়েছে মধ্যবিত্ত পুরুষের শ্রেণীগত, লিঙ্গগত সুবিধাভোগিতা আড়াল করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। হাহাকার, বিবিক্তার ভাষার আড়ালে নিজের মধ্যবিত্ত মুখ লুকিয়েছে হাংরি লেখককুল— তাদের কবিতার ‘‘আমি’’-রা। এই বিশেষ রকমের অসততার আত্মজৈবনিকতার খতিয়ান লেখার সাহস হাংরিদের কোনোদিনও ছিল না। এখনও নেই। তাই, হাংরি আত্মজৈবনিকতার মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে এই মুখ লুকোনোর উদযাপন।
কাজেই, আক্রমণ কখনো করা হয়নি হাংরি আত্মজীবনীতে মধ্যবিত্ত বাঙালী পুরুষের পৌরুষজাত শ্রেণী ও লিঙ্গজাত বিবিক্তামুখরিত পশ্চাৎপদতাকে। কিন্তু, ওই যে আগেই বলেছি না, মধ্যবিত্ত পৌরুষের পশ্চাৎপদতা জানার জন্য কোনো হাংরি বা অন্য কোনো ধরনের কবিতা পড়ার কোনো দরকার নেই আমাদের। আমাদের কবিতার কাছে আমাদের দাবি অনেক বেশি। কবিতার কাছে আমরা চাই সেই পশ্চাৎপদতা ভাঙার দলিল, সেই ভাঙনের জটিলতার খতিয়ান। সেখানে আত্মজীবনীর একটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। কিন্তু শুধু আত্মজৈবনিকতা দিয়ে সে কাজ সম্ভব নয়। আত্মজৈবনিকতা থেকে বেরনোর প্রচেষ্টার ওপরেও অনেকাংশেই নির্ভর করবে এই ভাঙন লেখার কাজ।
উপংহার
একথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের পৃথিবী পুড়ছে, আমরা পুড়ছি। আমরা যে খারাপ আছি, একথা জানার জন্য কোনো কবিতা পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তেমনি, কেমনভাবে আমি ও আমরা খারাপ আছি, এই কথা জানার জন্য কোনো কবিতা, বা অন্য কোনো শিল্পের কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কাজেই, এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে হাংরি কবিতা আমাদের কোনো ধরনের নতুন উপলব্ধির সামনে টেনেহিঁচড়ে এনে দাঁড় করায় না। পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলা যদি হয়ে থাকে হাংরি লেখালেখির অন্যতম মূল লক্ষ্য, তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, হাংরি কবিতার ফলাফল আমার ওপর হয় ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ, বড়ই স্বস্তিদায়ক বোধ হয় হাংরি বয়ানের বিবিক্তাস্ফালন।
মানে, ব্যাপারটা কী বুঝলেন তো, আমাদের প্রজন্ম হল গিয়ে ‘বিবিক্তাসেন্ট্রাল’। ‘‘ডিপ্রেসন ডিপ্রেসন’’ করে চেঁচাই, নিজেকে একটু ‘‘মেন্টালি ইল‘‘ বলে ভাবতে না পারলে আমাদের সংবেদনশীলতার কোটা পূর্ণ হয় না। যে বিবিক্তাবিলাস গুলে খেয়ে হাংরি দর্শন শুরু করেছিল তার কথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যাত্রা, সে বিবিক্তাবিলাস আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপপ্রাপ্ত। মধ্যবিত্তের বিবিক্তাবিলাস একইসাথে টিকিয়ে রেখে তাকে সামাজিকে মূলস্রোতের সাথে জুড়ে, তাকে উৎপাদনশীল রাখতে মজুত আছে মানসিক-অসুখ ইণ্ডাস্ট্রি, কাউন্সেলিং ইণ্ডাস্ট্রি। আর্থাৎ, বিবিক্তা আজ আর কোনো ব্যতিক্রমী সংস্কৃতির ধারকবাহক নয়। বিবিক্তা আজ পুরোমাত্রায় নয়া-উদারনৈতিক, পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠাসমূহের অঙ্গাঙ্গী একটি বৈশিষ্ট্য‌। বিবিক্তা দিয়ে তাই কোনো প্রতিবাদ শুরু হতে পারে, শুরু হতে পারে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। কিন্তু, বিবিক্তা শুধুই বিবিক্তা— মানুষকে এক চুলের বেশি নড়াতে পারে না। পারে নি। তার জন্য প্রয়োজন, আরও অনেক কিছু। সেই অনেক কিছুর কাছে গিয়ে ফেল মেরে গেছে হাংরি দর্শন। ডাহা ফেল মেরে গেছে।
আমি জানি, অনেক পাঠকের কাছে আমার এ মূল্যায়ন জীভে বালির মতো ঠেকবে। বাপু হে, তোমাকে কী ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা এমন কোনো কথা দিয়েছিল নাকি, যে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, নয়া-উদারনীতি বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, দক্ষিণপন্থার উদ্ভব— এই সমস্ত বিবিধ সংকটে তারা তোমাকে ভাষা দেবে?
না, সত্যিই বলেননি হাংরি কবিরা এমন সব কথা। কিন্তু, আমি তো মার্ক্সের সমালোচনাও করি না তাঁর দাগিয়ে দেওয়া জমির ওপর দাঁড়িয়ে। বা, মোদী-চিহ্নিত বা আর.এস.এস.-বর্ণিত তাত্ত্বিক এককগুলির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা করি না হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনা। কারণ, আমরা তো বিশ্বাস করি, বহিরাগত ভাবনাচিন্তার ধাক্কাতেই যে কোনো দর্শনের সম্প্রসারণ ঘটে। অথবা তা হয়ে যায় অপ্রাসঙ্গিক।
হাংরি দর্শনের মধ্যে সেইরকম সম্প্রসারণের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু, যদি বা সেই সম্প্রসারণের সম্ভাবনা থেকে থাকে, তা হলে তা নির্মিত হবে হাংরি দর্শনের আঁক কাটাকাটির পরিধির বাইরে গিয়েই। ঠিক সেই কারণেই লিঙ্গ বিষয়টি আমার কাছে হাংরি সমালোচনার ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এবং, এ কথাও আমি জোরের সাথে বলব, হাংরি দর্শনে, শ্রেণী ও লিঙ্গ টিকে আছে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে। লিঙ্গ বাদ দিয়ে হাংরি দর্শনের শ্রেণীচেতনার কোনো আলোচনায় সম্ভব নয়। যদিও, আবারও জানি যে, এ প্রশ্নও উঠবে যে, লিঙ্গই কি মূল বা একমাত্র কথা? মানে, শুধুই লিঙ্গচেতনার পশ্চাৎপদতা, পিতৃতন্ত্রের মাপকাঠিতেই কি নাকচ করে দেবে তুমি হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস?
উত্তরটা হল, হ্যাঁ। যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আমাকে দেখে শুধুই কতোগুলো ফুটোর সমাহার বা যোনি হিসেবে, তাকে আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলে মনে করি না। ধর্ষকাম আমার কাছে বিদ্রোহ নয়। আমি শৈলেশ্বরের কবিতার লিঙ্গায়িত রূপক নই। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার ‘‘শিল্প’’ নই। নই তাঁর কবিতার লাবিয়া মেহোরা। হাংরি লেখকদের কাছে ‘‘শিল্প’’ বদলে ‘‘লাবিয়া মেহোরা’’ লেখা বিদ্রোহ বলে মনে হতে পারে। আমার কাছে, তা স্রেফ পিতৃতন্ত্র। দুই ভিন্ন ধারায় পিতৃতন্ত্র, কিন্তু পিতৃতন্ত্রই। বিবিক্তা বিবিক্তা খেলার সময় আমার নেই। আমি বা আমার বন্ধুরা যখন নিজেরা লিখতে বসি, আমাদের কলম বিচরণ করতে পারে সেসব জায়গায়, যেখানে আড়চোখে তাকানোর সাহসও হাংরিদের হয়নি। তাই, ওই তো প্রদীপ-মলয়-ফাল্গুনী-সুভাষ-সুবো-অরুণেশ-ত্রিদিব-সমীরণ-শৈলেশ্বরের কবিতায় পোঁদ মুছে উঠে দাঁড়াচ্ছে আমাদের কবিতা। আমার। আমাদের। আমাদের। আমাদের। কবিতা।
       
                   

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...