সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছি মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।
সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )
সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন ( ? ) । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি একটা আদৌ সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলন তো সাহিত্যের আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল । কতোটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, সে বিষয়ে আমি কোনো মতামত দেব না । সেটা এখনকার যারা পাঠক তারাই বিচার করবে । তবে নতুন কোনো একটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল এটা ঠিক ।
সুমিতাভ : তখনকার সাহিত্যে এই আন্দোলনের কোনো প্রতিচ্ছবি পড়েছিল কি?
সুনীল : দুটো ব্যাপার হয়েছিল । একটা হয়েছিল কী হাংরি আন্দোলনের যারা প্রধান তারা কিছু কিছু পত্র পত্রিকায় লিফলেট ইত্যাদি ছাপাতে শুরু করে । এই সাহিত্যকে বদলাতে হবে ; অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করে পুরোনো মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিতে হবে ইত্যাদি ।
সুমিতাভ : না, সাহিত্যে এর কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে কি ?
সুনীল : না । আমি বলব সাহিত্যে এর কোনো ছাপ পড়েছে বলে আমি মনে করি না । তবে এটা একটা গোষ্ঠী, অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল । তবে অ্যাবরাপ্টলি এই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় । তবে এতোদিন বাদে আবার সেসব নিয়ে আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি । মাঝখানে দশ বছর হাংরিদের সম্পর্কে কথাবার্তা শুনিনি । ( এই দশ বছর মলয় রায়চৌধুরী কলকাতার সাহিত্য জগতের বাইরে ছিলেন, বুলেটিন প্রকাশ করার জন্য টাকা তিনিই দিতেন )।
সুমিতাভ : ট্রাডিশানাল বাংলা সাহিত্যকে কোনোভাবেই এরা একটুও বদলাতে পেরেছিল কি ?
সুনীল : সেটা তো আমি বলতে ওপারব না । হাংরিদের যারা প্রথান, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, এরা হাংরি আন্দোলনের মাঝামাঝি অবস্হায় এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । যখন এই নিয়ে কোর্টে কেস হয়, তখন এরা বিবৃতি দেয় যে, আমাদের সঙ্গে হাংরির কোনো সম্পর্ক নেই । ওদের লেখা আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার সঙ্গেই যুক্ত । আলাদাভাবে হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না ।
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কছু লেখক থাকা সত্ত্বেও, হাংরি আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কারণ কি ?
সুনীল : ক্ষমতাবান লেখকরা প্রথমে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন । দ্বিতীয় কথা, এরা সিরিয়াসলি সাহিত্য রচনা করার বদলে এমন কিছু কাজ করতে লাগলেন, যেগুলো অনেকেরই বিরক্তি উদ্রেক করলো । যেমন ধরো এরা কাউকে জুতোর মালা পাঠিয়ে দিল । কাউকে একটা মুখোশ পাঠিয়ে দিল । বা কাউকে টেলিফোন করে বলল, আপনার ছেলে মারা গেছে, বাড়ি চলে যান । এইভাবে কিছু কিছু অল্প বয়সের চ্যাংড়ামি --- এটা অনেকেই করে, অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু এটাই যেন প্রধান হয়ে দাঁড়াল । লেখার মধ্যে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করার করার জন্য অযথা এবং অকারণ অশ্লীলতা আনার চেষ্টা করল । আমি অবশ্য কোনো শব্দকেই অশ্লীল বলে মনে করি না । তথাকথিত অশ্লীলতা, তথাকথিত অশ্লীল শব্দ । বা আরেকটা ছিল, অন্যকে গালাগালি দেওয়া । এই সমস্ত দিকেই যেন তাদের মন বেশি গেল । অবশ্য অন্য লোকের অন্য মত থাকতে পারে ।
সুমিতাভ : হাংরি লেখাগুলোতে আত্মকামিতা জিনিসটার কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করেন?
সুনীল : তা, আত্মকামীতা মানে ধরো, আমরা কৃত্তিবাসে যেটা বলতাম, যে নতুন আধুনিক সাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝতাম ?তখন আমরা বলতাম যে কৃত্তিবাসের মূল সুর হচ্ছে কনফেশন । স্বীকারোক্তিমূলক লেখা । আমরা যেভাবে জীবন যাপন করছি সাহিত্যে সেটাকে ঠিক সেভাবেই স্বীকার করে নেওয়া দরকার । হাংরিরা হয়তো তার থেকেও আরো এক্সট্রিম-এ চলে গিয়েছিল । তারা, যাকে বলে আত্মকণ্ডূয়ন, সেটার দিকে চলে গিয়েছিল । তবে আমার মনে হয় হাংরি আন্দোলনের মূল সুর কৃত্তিবাস ধারারই একটা অঙ্গ ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, আর হাংরি আন্দোলন, মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে আপনি মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনের মধ্যে রাজনীতি কিছু ছিল না । তবে ক্ষুধার ব্যাপারটা ছিল । তবে সেটা খাদ্য অভাবের যে ক্ষুধা, তা নয় বোধহয় । এটা বোধহয় অন্য কোনো ক্ষুধার কথা ওরা বলতে চেয়েছিল । নকশাল আন্দোলন অনেক ব্যাপক, অনেক মহৎ আত্মত্যাগ আছে । হাংরি আন্দোলন সেরকম কিছু একটা নয় ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কম-বেশি পঁচিশ বছর পর, আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া, বিশেষত ছোটো পত্র-পত্রিকাগুলোয় চোখে পড়ছে । এরকমটা কেন হচ্ছে বলতে পারেন ?
সুনীল : সেরকম কোনো আবহাওয়া আমার চোখে পড়ছে না । যা চোখে পড়ছে তা হলো হাংরিদের নিয়ে আবার লেখালিখি শুরু হয়েছে । কোনো কোনো পত্রিকায় এদের কেস টেস ছাপা হচ্ছে, হিস্ট্রিটাও ছাপা হয়েছে। মলয় রায়চৌধুরীকে বহুদিন নীরবতার পর আবার লেখালিখি করতে দেখছি ।
সুমিতাভ : সেটা এতদিন পরে হঠাৎ কি কারণে ?
সুনীল : আলাদা কোনো কারণ নেই । এটা নেহাতই কলকাতার ব্যাপার ।
সুমিতাভ : ধন্যবাদ । আমরা তাহলে উঠি…
সুনীল : তবে এটা বলছি, আমার সঙ্গে হাংরিদের সম্পর্ক এই যে আমি তাদের কোনো পত্র-পত্রিকায় লিখিনি । তাদের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক মিলও ছিল না । আন্দোলনেও অংশ নিইনি । তবে যখন মামলা হয়, তখন আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরী এসেছিল, যেন আমি তার হয়ে সাক্ষ্য দিই । আমি তার পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছি । আদালতে দাঁড়িয়ে আমি বলেছিলুম, মলয় রায়চৌধুরীর কোনো কবিতায় আমি কোনো অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি । আদালতে এটাই আমার সাক্ষ্য ছিল ।
সুমিতাভ : সেটা আপনি স্নেহের বশে করেছিলেন, না নিজের বিশ্বাসে ?
সুনীল : আমি পরে মলয়কে বাড়িতে বলেছিলাম, দেখ তোমার কোনো কবিতাকে যদিও আমি সার্থক কবিতা বলে মনে করি না, কিন্তু কেউ একটা কবিতার মধ্যে কিছি অশ্লীল শব্দ লিখেছে বলে তাকে আদালতে ডেকে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, সেটাও আমি সমর্থনযোগ্য মনে করি না । সাহিত্যের জন্য শাস্তিদানের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তবে আমি সবসময় অভিযুক্তের পক্ষেই থাকব ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত )
No comments:
Post a Comment