Friday, December 6, 2019

হাংরি জেনারেশন - জ্যোতির্ময় মুখার্জি আলোচনা করেছেন মলয় রায়চৌধুরীর "জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা"

জ্যোতির্ময় মুখার্জি : মলয় রায়চৌধুরীর 'জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা' -- একটি আলোচনা



আমার ছোটবেলা কেটেছে রূপকথার দেশেই। ব‍্যাঙ্গমা-ব‍্যাঙ্গমি, সুয়োরানি-দুয়োরানি, ব‍্যাং-রাজা ইত‍্যাদির  খোঁজে প্রায়ই পাড়ি দিতাম কল্পনার সাতসমুদ্র তেরোনদীর পারে, আমার প্রিয় পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে। তখন তো মোবাইল ছিল না বা ভিডিও গেম, কার্টুন চ‍্যানেল। টিভি ছিল বটে, কিন্তু বয়স্কদের মতে টিভি দেখলে যেহেতু ছোটদের চোখ পচে যায় তাই টিভির সাথে বন্ধুত্ব হয়নি কোনদিন। হলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না, সেই তো গুরুগম্ভীর ডি.ডি। তাই ছোটবেলায় আনন্দ বলতে চুটিয়ে খেলা খেলা আর খেলা। মাটি মেখে ধুলো মেখে জলে ভিজে কাদা মেখে গাছে চড়ে পুকুরে সাঁতরেই কেটে গেছে আমার ছেলেবেলা। এসব রিয়ালিটির মাঝেই কল্পনার ফানুস উড়িয়ে দিতাম চাঁদমামা, শুকতারা, কিশোরভারতী, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলি, আবোল তাবোল, ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত  ইত্যাদিতে। রূপকথার গল্প সমন্ধে তাই আমার একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল বা আছে। মলয় রায়চৌধুরী যখন বললেন, ‘তুমি আমার একটা গল্প আলোচনা করো ।’’ তখন আমি ভয় পেয়ে গেলেও বিশ্বাস ছিল যে কিছু একটা লিখতে পারব। কিন্তু সেই সমস্যা যে কতবড় পদক্ষেপ ছিল, তা বুঝতে পারলাম ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ গল্পটি পড়তে গিয়েই , মলয় রায়চৌধুরীর ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভুক্ত একটি কাহিনি । আত্মপ্রশ্নে ক্রমাগত আক্রমণ সয়ে যাবার পর ভাবলাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা নামের কাহিনির বুনন ও বাঙালি ‘পলিটি’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা নিয়েই লিখি ।

গল্পের নাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা। প্রকৃত প্রস্তাবে রূপকথা এটি রূপকথা নয়, অরূপকথা, বাস্তবতা থেকে ছেঁকে নেয়া অতিবাস্তব রূপকথা । লেখা হয়েছে, ২০০৬-এ। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বইটির ১০০ বছর পূর্তিতে।

কাহিনির প্রধান চরিত্র এক যুবক শকুন, যার নাম শিলাদ, সে শকুন পরিবারের শেষ সদস্য । কিন্তু সেই অর্থে শিলাদ কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। শিলাদের ক্রম পরিবর্তনশীল কায়া, আকার, রূপ, জীবন ও যাপনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে গল্পস্রোত এবং পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জীবনযাপনকে । অবশ্য  শিলাদের সঙ্গে সঙ্গে এগোয়নি গল্প, ও গল্পটি ওপন এনডেড । পোস্টমডার্ন বলা হবে নাকি হাইপাররিয়াল ? কনফিউজড্‌? দেখা যাক ।

আসুন, এবার তবে ঢোকা যাক গল্পের মধ্যে। গল্পের মূল কাহিনীটা ঠিক এইরকম, শিলাদ নামক একটা শকুন যে তার দাদুর সঙ্গে গভীর আকাশে উড়ছিল, দাদুর সান্নিধ্য থেকে হারিয়ে গিয়ে,  গল্পের ধাপে-ধাপে সে অন্যান্য প্রাণিতে পরিবর্তিত হয়েছে । প্রথমে পেঁচা তারপর টিকটিকি (গিরিগিটি) তারপর মাছ তারপর বাঘ এবং শিকারীর গুলিতে সুন্দরবনের নদীতে সমুদ্রের দিকে ভেসে গেছে সে ; তার চামড়া ছাড়ানো দেহের ওপরে বসে তার দাদু তার নাম ধরে ডাকলেও সে শুনতে পাচ্ছে না । শিলাদের এই প্রতিটি রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে কাহিনী। শিলাদের চোখ দিয়ে দেখছি পৃথিবী আর কান দিয়ে শুনে নিচ্ছি পৃথিবীর অরূপকথন। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, জঙ্গল, ভূগর্ভ থেকে, দিনে ও রাতেও। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন গল্পকার,  শিলাদের অস্তিত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে । মুভি ক‍্যামেরা নিয়ে পশ্চিমবাংলার রূপান্তরিত ঘটনাবলীর পেছু নেবার মতো । এখানে ক‍্যামেরা হল শিলাদ আর জীববিজ্ঞানী ক‍্যামেরাম‍্যান? মলয় রায়চৌধুরী।

গল্পের কাহিনী এগিয়েছে ক‍্যামেরাম‍্যানের সাথে সাথে উত্তরাধুনিক ক‍্যামেরার পরিবর্তিত অবস্থান ও লেন্সে। গল্পটি পড়তে পড়তে তাই আমরা যা পড়ছি, মানে গল্পের মূলটেক্সট,  তার বাইরেও রয়েছে আরো একাধিক সাবটেক্সট। যা বলা হচ্ছে না, বা যা লেখা নেই। পাঠককে সবই একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে-করতে এগোতে হবে, সমান্তরাল ভাবে। গল্পের মধ্যে ছাড়া আছে সেই পরিসরগুলো, যার মধ্যে দিয়ে পাঠক অনায়াসে ঢুকে জেনে নিতে পারেন না-লেখা সাবটেক্সটগুলো । গদ‍্যের নির্মাণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঠক প্রতিমুহূর্তে পরিসর খুঁজে পায় গল্প থেকে গল্পের বাইরের ইশারাগুলো বুঝে  নেওয়ার। পাঠককে গল্পটি পড়ার সময়ে এগোতে হবে একাধিক দিক থেকে, একইসাথে, মস্তিষ্কের রসায়নে। মলয় রায়চৌধুরীর রচনামাত্রেই সিরিয়াস অনুধাবন দাবি করে ।

মুসলমান শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নত-উল-বিলাদ। অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপট অখণ্ড বাংলা নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনৈতিক, প্রসাশনিক, শিক্ষাব‍্যবস্থা ইত‍্যাদির কঙ্কালটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়াই মলয়ের ঝুলির এই  আড়ালে অরূপকথনের লক্ষ্য।
‘যাতুধান তরফদার…. এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’…….উত্তর-ঔপনিবেশিক  পশ্চিমবাংলায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো । টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর গঠন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং মূল‍্যবোধ। যৌথ-পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী মলয় রায়চৌধুরীর কি দীর্ঘশ্বাস পড়েছে যাতুধান তরফদারের বুকের বিদার থেকে ? তাঁর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ কি প্রতিফলিত এই অরূপকথনে ? জানি না। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা যে আর সম্ভব নয় সেটা মলয় রায়চৌধুরীর’ বিভিন্ন প্রবন্ধে আমরা পড়েছি । খোপ-বাড়ির খোপে খোপে বাস করা বাঙালির চিন্তা জগতেও যে দৈন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে এই ব‍্যাপারেও মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধে।
বহুত্বের পাঁচমেশালি পঞ্চরত্ন বা লাবড়া নয়, বাঙালি তৃপ্ত আজ আলুভাতে ডালভাত আর পোস্তগোলাতেই। একান্নবর্তী পরিবারের  বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক ও তার টানাপোড়েন, বিতর্ক-বিবাদের পর’ও একসাথে, একই ছাদের নিচে, বাস করার যে সহনশীলতার শিক্ষা,  তা থেকে বাঙালি আজ বঞ্চিত। বঞ্চিত নিজেকে বহুধায় বিভক্ত করতে, যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে, সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, চিন্তায় ভাবনায়, লেখালেখি শিল্পজগতে। মলয় রায়চৌধুরী,  স্বীকার করেন যে, লেখালেখি ঘরের দরজা জানলা এঁটে সাধনা নয়। মানুষ ও সমাজবর্জিত হয়ে চিন্তাজগতে ঢেউ তোলা নয়। তাতে সাহিত্য খন্ডিত বা একপেশে হয়ে পড়ে, তাতে আর যা হোক সমাজের আসল চিত্রটি প্রতিফলিত হয় না। লেখক-শিল্পী যত মানুষের সাথে মিশবেন, যত সমাজের আনাচে কানাচে পৌঁছাবেন তত পুষ্ট হবে তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ইরিটেশনেই নির্মিত হবে সাহিত্য, শিল্প।

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি  একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — “লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ।” বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছেন, “পলিটি”-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।’

‘জিন্নতুলবিলাদ’ সম্পর্কিত কাহিনি জুড়েই লেখকের এই অভিজ্ঞতা বা শিলাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মননের জার্নিটা স্পষ্ট। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, দিন-রাত, জঙ্গল-নদী, আন্ডার গ্রাউন্ড-মাল্টিপ্লেক্স, বেশ‍্যাপল্লী-ক্লাসরুম  ইত্যাদি সময় পরিবেশ ও অবস্থানের যে বর্ণনা আমরা পাই এবং তার সাথে সাথে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃতি তা যে মোটেই ভাববিলাসে লিখিত নয়, এইটুকু স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। ঘটনা, পরিবেশ ও চরিত্রের এই নিঁখুত নির্মাণ বা শার্পনেস্ স্পষ্ট করে দেয় যে এ সবই লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমরা জানি যে গ্রামোন্নয়ন অফিসারের চাকুরিতে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার, গ্রামে-গঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, ছুতোর, খেতমজুর ইত্যাদি মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন
লেখার সততা রক্ষার জন্য কলমকে অবশ্যই হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে সমাজের কোণে কোণে। শুধু আলোলাগা পথে পথে নয়, ছায়ামায়া গলিতে গলিতে নয় এমনকি কালোআলো সুড়ঙ্গেও। সমাজের প্রতিটি অন্ধকার, নগ্ন, পুঁজমাখা ক্ষতকেও লেখার মধ্যে ধরতে পারলেই লেখাটি তার সততা রক্ষা করবে। তুলে ধরতে পারবে সমাজের প্রকৃত ছবি। তাহলেই পাঠক অনায়াসে নিজস্ব দৃষ্টিপ্রতিভা ও মন দিয়ে পড়ে নিতে পারে সমাজের প্রকৃত চিত্রটিকে। লেখকের কাজই হলো লেখার এই সততা রক্ষা করা এবং সেই লক্ষ্যের পথে যাবতীয় বাধা ও ঠিক-ভুলের দ্বন্দ্ব, ন‍্যায় অন‍্যায়ের যাবতীয় বেড়াগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাওয়া। লেখার জায়গায় লেখকই নির্মাণকর্তা। আর ঈশ্বর যখন, তখন বিরাজ করবেন সর্বভূতে।

গল্পকার উত্তরঔপনিবেশিক বাঙালির বাস্তবজীবনকে অনবরত স্ক‍্যানিং করে গেছেন। পাঠবস্তু নির্মাণে তাই কোনো বাছবিচার নেই। নেই নেকুপুসু মার্কা শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব। গল্পের সাবজেক্ট পজিশনেও তাই বহুত্বের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট। গল্পের হাঁ-মুখে সেঁধিয়ে গেছে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা ইত্যাদি । অনায়াসে সবকিছুকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে পাঠবস্তুটি। কখনো পাশাপাশি আবার কখনও বা একটার সাথে আর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবস্থান করছে। পাঠককে যে সবসময় পাকগুলো খুলে খুলে পড়তে হবে এমনও নয়। পাঠবস্তুটি সবকিছু গলাধঃকরণ করে নিজেই একটা আলাদা সাবজেক্ট-বহুত্ব গড়ে তুলেছে। সবজিগুলো তাই তাদের একই খেতে উৎপাদিত  হয়েই খুশি। অথচ কনট্রাস্টটি হলো পাঠবস্তুটি যখন বহুধায় বিভক্ত তখন শিলাদকে সামনে রেখে গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী নির্মাণ করে গেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা বা ইউনিকনেস। একদিকে গল্পের কৌম-পরিসর বাড়িয়েছেন, খুলে দিয়েছেন পাঠবস্তুকে। অপরদিকে ব‍্যক্তিকে একক হিসাবে ধরে ব‍্যক্তির ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাদা কালো ধলো দিয়ে নির্মাণ করেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা। সামাজিক জীব হয়েও ব‍্যক্তি এককের নিজস্বতা বা ইউনিকনেস নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পুরো অরূপকথন জুড়ে।
‘আমি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা শিলাদ ঘুমের মধ্যে নিজেকে দিয়ে বলালো।’ মানুষ সামাজিক জীব হলেও যে সে আদতে আলাদা বা ইউনিক, প্রতিটি মানুষেরই যে কৌম এবং নিজস্ব আইডেন্টিটি থাকা উচিত, সে যে ভিড়ের মাছ নয় বা পালের ভেড়া নয়, সে যে চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন  মানুষ এটাই বারবার হাইলাইট করেছেন শিলাদের চরিত্র নির্মাণে। আবার নির্মাণের সাথে সাথে তিনি ভেঙে ফেলেছেন নির্মিত চরিত্রের ইঁট-বালি-রড-পাথর। ব‍্যাক্তি এককের আইডেন্টিটি বা ইউনিকনেস নির্মাণ ও বিনির্মাণের খেলা চলেছে পুরো অরূপকথন জুড়ে। ‘রাতের জীবন চেয়ে শেষে কি এই ঘন অন্ধকার জুটল?’ ক্রিয়েট করেছেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। বারবার। বারবার শিলাদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে নিয়ে, নিজের পরিচয় নিয়ে, আত্মজিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হয় । ‘জীবনের মানে খুঁজতে চাই। নিজেকে ডিফাইন করতে চাই।’….’আমি একটা পারপাস চাই, অতিরঞ্জন চাই, কর্মব্যস্ততা চাই।’ আবার ঠিক পরক্ষণেই ‘কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই আমি, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, জাস্ট চিল, হ্যাভ ফান।’ পাঠককে খুব সচেতন ভাবে খেয়াল রাখতে হবে এই ভাঙা-গড়ার খেলাটি। ‘আমি তো অন্যরকম জীবন চেয়েছিলুম’ ; কীভাবে সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুযোগ, লোভের তালে তালে মানুষ পাল্টে ফেলে তার রং। ‘স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্থা বুঝে নিজেকে বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকেই পাল্টি খায়।’

‘এসে পড়েছে যখন-তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু, শকুন যুবতীর খোঁজে বহু ব্যর্থ ওড়াউড়ির শেষে, সাতসকালে, একজন বয়স্কা ভূবনচিল যখন বটগাছের ন্যাড়া ডালে বসে তৃপ্তি করে মুর্গিছানার হৃৎপিন্ড চোষায় মগ্ন, শিলাদ তার অন্যমনস্ক পিঠে আলতো করে নেমে, ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। অসবর্ণ সঙ্গমের হবোহবো মুহূর্তে, ওই চিলগৃহিণীর পরিবারের লোকজন শিলাদকে ঘিরে ফেলে হৈ-চৈ বাধাতে, প্যাঁদানির ভয়ে মেঘের এগলি-সেগলি হয়ে ও পালায়, চিলেদের অনধিগম্য আকাশে, যেখানে ওকে হাঁপাতে দেখে, জেরা করে সবকিছু জানার পর, যাতুধান ওকে বুড়ি শঙ্খচিল, খুকি উটপাখি আর সোমত্ত টার্কিদের নামঠিকানা বাতলায়, যাদের ওপর আচমকা বসে তাড়াতাড়ি পায়ুসঙ্গম বা ধর্ষণ সেরে কেটে পড়া যায়, যদিও তাতে মন ভরবে না, উল্টে আনচান বেড়ে অসুখ করবে। বাট দেন, দ্যাট ইজ লাইফ।’.….যৌনতা এবং জাতিপ্রথার দ্বন্দ্ব এসেছে এভাবেই, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। জীবনের অংশ হিসেবে নয়, সমাজের সদস্যদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়া হিসাবে। ইয়েস্ দ‍্যাট্ ইজ লাইফ। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।

সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা নিয়ে এখনকার মতো ভিকটোরিয় বাছবিচার ছিল না, বরঞ্চ যৌনতা ছিল জীবন-শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক শর্ত। দেখা হতো লেখাটি নবরসকে মান্যতা দিয়েছে কিনা। আর শৃঙ্গার তো নিজেই আদিরস। যৌনতা ব‍্যভিচার নয়, সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা আবশ্যিক যাপন। ক্রমশ ইসলামি শাসন তারপর খ্রিস্টধর্মি যাযকদের চাপানো মূল‍্যবোধে মাথা গেঁজিয়ে এবং দেখনদারি হিন্দুয়ানার দাপটে ভারতবর্ষের এই স্বাভাবিক ব‍্যাপারটাই অস্বাভাবিক বা অশ্লীল হয়ে পড়েছে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় আমরা সনাতন ভারতবর্ষের সেই স্বাভাবিক যৌনতাকে রিগেন করতে দেখি স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতা আরোপিত নয় বা লেখায় মশলা মেশাবার উদ্দেশ্যেও নয়। 

হাগা-মোতা-খাওয়া-শোওয়ার মতোই যৌনতা এসেছে দৈনন্দিন যাপনে। আবার ওনার লেখায় যৌনসংসর্গের অভাবহেতু যেমন যৌনতার হাহাকার দেখি তেমনি দেখতে পাই ক্রমাগত সেক্স করতে করতে মেন্টাল ফ‍্যাটিগনেস। ‘আমার এই জীবন এমনই সুখী যে ভীষণ রিপিটিটিভ হয়ে গেছে, প্লিজ ডু সামথিং, একদম ভাল্লাগছে না। এরকম খাও-দাও-সঙ্গম করো জীবনের মানে হয় না’ যৌনক্রিয়া বা সেক্সকে তিনি বিভিন্ন ডাইমেনশনে ধরেছেন। সেক্সকেই একটা নিজস্ব চরিত্র করে তুলেছেন, যা প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে, স্বভাবে ও অভাবে ক্রমাগত বদলে বদলে ফেলে তার আদল। শকুন-শিলাদ যখন যৌনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গীর অভাবে ইভটিজিং ও ধর্ষণে উদ‍্যত তখন মাছ-শিলাদের সে সাহস নেই। সে দূর থেকেই দৃশ‍্যসুখে ও কল্পনায় পরিতৃপ্ত হতে বাধ্য। কিন্তু আপনা হাত জগন্নাথ নয়। ‘যারা পাত্তা পায় না তারা মাছকুমারীটাকে লক্ষ্য করে ফিচিক-ফিচিক বীর্য ছোঁড়ে। শিলাদের অনেকটা জমে ভাঁড়ার থইথই টসটস রসরস, কিন্তু ছুঁড়ে অপচয়ের মানে হয় না বলে যোগ্য-অযোগ্য যে-কাউকে খুঁজে বেড়িয়েও জোটাতে পারেনি।’…..স্বমেহনকে মলয় রায়চৌধুরী একবারো যৌনক্রিয়ার মধ্যে ফেলেননি। এটা আমার বেশ আবাকই লেগেছে, বরঞ্চ মাছ-শিলাদ খোঁজ করছে সমকামী সঙ্গীর। ‘মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।’

শকুন শিলাদের মধ্যে আবার দেখতে পাই খাদ‍্যযোগ‍্য পাখিদের খাদ্য হিসাবে নয়,  যৌনক্রিয়ার খেলনা হিসাবে ভাবছে। ‘সবরকম রঙের প্রাণী খেলে স্বাস্থ‍্য নাকি ভাল থাকে। অথচ শিলাদের ইচ্ছে করে রোজ একটা রঙ বেছে নিয়ে সেই রঙের পাখির পিঠে বসে, মাথার চাঁদিতে চঞ্চু টিপে ধরে, দুপাশে ডানা নামিয়ে ইয়ে করে।’ অর্থাৎ তারমধ্যে নারীদের সেক্স এলিমেন্ট হিসাবে দেখার প্রবণতা প্রবল। শুধু অভাবে নয়, স্বভাবেও সে ইভটিজার ও ধর্ষণকারী। কখনো বাস্তবে আবার কখনোবা কল্পনায়। বাসে ট্রেনে রাস্তা ঘাটে শকুন-শিলাদদের যে অভাব নেই সে তো স্পষ্ট আর ধর্ষণের বিরামহীন ঘটনায় শকুন-শিলাদরা যে শুধুই যৌনসঙ্গীর অভাবে ধর্ষণ করে এমন নয়, মানসিক চরিত্রের অভিঘাতেই একজন মানুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, ‘এসে পড়ে যখন তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু’। অপরদিকে প‍্যাঁচা-শিলাদের সুখী ও পরিপূর্ণ সেক্স লাইফ। খাও-হাগো-শোও আর সেক্স করো, শোও-হাগো-খাও আর সেক্স করো। সুন্দরী ও তৃপ্তিযোগ্য সেক্স পার্টনার, সেক্সকে আকর্ষণীয়, নিত্য-নতুন রঙিন করে তোলার জন্য বিছানার ডেকরেশনে অনবরত পরিবর্তন, তবুও প‍্যাঁচা-শিলাদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, কাজ নেই, কর্মব্যস্ততা নেই, শুধু সেক্স সেক্স আর সেক্স,  একটা প্রাণীকে ক্লান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

শিলাদ বুঝতে পারছিল যে খারাপ লাগার ক্রিয়াটা রয়েছে ওর নিজের প্যাঁচা-মস্তিষ্কে, ঘাপটি মেরে, তাতে ফর্সা-তামাটে-কালোর কিছু করার নেই, চব্বিশ ঘন্টা অহরহ সঙ্গম করেও তা যাচ্ছে না, নানা সুরের মিউজিকাল কন্ডোম পরা সত্বেও।’ সেক্সের জন্য লাইফ নয়, লাইফের জন্য সেক্স। যৌনতাকে আলোকিত করার জন্য লেখা নয়, লেখার প্রয়োজনেই যৌনতা আসবে স্বাভাবিক ভাবে, মলয় রায়চৌধুরীর এই বার্তা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায় এই অরূপকথন থেকে। আবার গিরিগিটিরূপী শিলাদের সেক্স লাইফ দ্রুত, ঝটিতি, স‍্যাটাস‍্যাট মাল খসিয়ে খালাস। ‘ওরফে গরম-গরম উত্তেজিত স্বরে বলল, কী রে রঙ্গিলা স্পাই, টিপতে এসছিস মাই, নে, কত টিপবি; বি কুইক অ্যান্ড ফাস্ট।’ যুবতীটির নাম ‘ওরফে’ ; যৌনকর্মীরা যেমন প্রতি সন্ধ্যায় নাম পালটে নতিন নাম রাখেন. সেই সতত নাম পরিবর্তনকে ‘ওরফে’ শব্দের সাহায্যে আক্রমণ করেছেন মলয় । আমরা দেখেছি,  পার্কে, হোটেলে, ঝোঁপে ঝাঁড়ে রকেটসেক্স ঘটতে ? তাও তো রকেটসেক্সের পিছনে কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সেক্স এন্ড ওনলি সেক্স। কিন্তু বাঘ-শিলাদের সেক্স লাইফ আবার শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য। কোনো উপভোগ্য যৌনক্রিয় নয়, জাস্ট প্রয়োজনের তাগিদে ঝটতি সেক্স। গড় বাঙালির সেক্স লাইফ তো আদতে তাই-ই। আমাদের সমাজ ও ধর্মের জ‍্যেঠামশাইরাও ভাবেন ঠিক এমনই। যৌনতা সন্তান উৎপাদনের তরে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, আর নারী সেই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণানায় সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজনে আসা সেক্স পার্টনারের মুখ দিয়ে বারবার ‘হালুম’ শব্দের প্রয়োগ কি এই সেক্স নিয়ে অচলায়তন ধারণাকে টিটকারি মারা? ব‍্যঙ্গ করা? হয়তো তাই ।
কাহিনির বাকি অংশের সাথে ‘হালুমের’ রিপিটেশন খাপ খায় না। এই অংশটি পড়তে বেশ বিরক্তি লাগে, দুর্বল লাগে গল্পের বুনোটে। ‘ল্যাজের অবগুন্ঠন সরিয়ে আগে আমার স্ত্রীযন্ত্রের অগরু শোঁকো মুখপোড়া, হালুম, তবে তো বুঝবে, হালুম, আমি অনঘ-নিরঞ্জন হিটে আছি কি না, হালুম, নাক দিয়ে হৃদয়ে সৌরভবার্তা গেলেই, হালুম, দেখবে বাদবাকি কাজ আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে, হালুম।’ হয়তো বিরক্তি সৃষ্টি করাই এই দুর্বল বুননের উদ্দেশ্য। পাঠকের লিঙ্গ দাঁড়াবে না বা সেক্স ফিল হবার সুযোগটুকুও দিতে চান না গল্পকার। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি করে ফেলেছেন ঘর ঘরকা সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনা। ‘ভারজিন যুবকের বীজ নিলুম, হালুম, আনন্দ নিলুম, হালুম, চললুম, হালুম।’ আর সেক্স পরবর্তী মানসিক অবস্থার সাথেও বেশ পরিচিত বেশিরভাগ বাঙালিরা বিশেষ করে বাঙালি বধূরা। শুধু তাই নয় সমাজে অসম বয়স্ক যৌনক্রিয়ার চাহিদাকেও তিনি দেখিয়েছেন অনায়াসে, ‘হ্যাঁ, আজকাল তো বয়স্কা বাঘিনীরা টয়বয় খোঁজে।’

যৌনতা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর এই দ্বিধাহীন স্পষ্ট ও বহুরৈখিক ভাবনার পরিচয় পাই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকেই। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনচেতনা। এই কবিতাটির উপর অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও আমার মনে হয় প্রশাসনের কাছে এই অশ্লীলতার অভিযোগটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ একটা অভিযোগ খাড়া করা। কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর মানসে করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, এবং সেই অভিযোগটা আদালতে এনে ফেললে নিজেদেরই নিম্নদেশ বস্ত্রহীন হবে দেখে, অশ্লীলতার অভিযোগটিকেই ভেসে যাওয়া খড়খুটো হিসাবে ধরা। যদিও এই অভিযোগটিতে মলয় রায়চৌধুরীর লাভ হয়েছিল প্রচুর, ও ক্ষতিও। মামলা চলাকালীন সময়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিঃসঙ্গে, কপর্দকহীন, অসহায় ও অসহ্য জীবনের কথা মাথায় রেখেও বলব এই অভিযোগ রাতারাতি মলয় রায়চৌধুরীকে হেডলাইন বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে ও বিদেশেও।

এই একটি কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে খ‍্যাতির চূড়ায় টেনে তুলেছে, তাঁকে মিথ বানিয়ে তুলেছে। এই ব‍্যপারটা আমরা সবাই জানি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলন ও ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়েও কোনো একদিন আমার মতামত লিখব কোথাও। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও চিন্তা ভাবনা সত্ত্বেও কীভাবে একটা ছোট্ট ভুল এক আলোকবর্ষ দূরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বলব সেটাও কোনো একদিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গ্রেপ্তারি ও কবিতাকেন্দ্রিক মামলা,  এই ঘটনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিও করেছে প্রচুর এবং করে চলেছে আজও । ব‍্যক্তি মলয় রায়চৌধুরীর কথা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিশীল মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিটা অপরিসীম। মলয় রায়চৌধুরীকে মিথ বানিয়ে আর ওই একটি কবিতাতে মগজ নয় শুধু হাত সেঁকেই মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক-পাঠিকারা স‍্যালুট ঠোকে বারংবার। এই পপসঙ্গে জিন্নতুলবিলাদে একটি চরিত্রের উক্তি প্রসঙ্গিক: ‘আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।’ মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলোর আগে-আগে ছোটে ওনার কিংবদন্তি । অথচ ওনার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, প্রায় শতাধিক বই আছে ওনার,  উনি বারবার চেয়েছেন বা মনে করেন, লেখক নয়, রচনা-বিশেষের গুরুত্ব থাকা উচিত পাঠকের কাছে। অথচ ওনার ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। সাধারণ পাঠক-পাঠিকা  ওনার অন্য লেখা পড়েন না বা পড়তে চান না, ওই একটা কবিতা দিয়েই দূর থেকে মেপে নিতে চান মলয় রায়চৌধুরীকে। অথচ যখন তিনি বারবার বদলে ফেলছেন তাঁর গদ্যের ডিকশন, কবিতার ফর্ম, সিরিয়াস পাঠক ছাড়া  খেয়াল করেন না সেটা।

সে-সময়ে নিচু জাতের, নিচু জাতের চেয়ে নিচু জাতের, তার চেয়েও নিচু জাতের, অঢেল দাসী বাঁদি চাকরানি ঝি কামিলনি নড়ি আমিনী কিংকরী ভাতুনি প্রেষিনী খানজাদনি পুষতো খানদানি লোকেরা। তারা মরে গেলে তাদের অচ্ছুৎ মড়া না পুঁতে না পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিত নদীতে, যার ওপর আরাম করে বসে ভাবতে-ভাবতে হাসতে-হাসতে কাশতে-কাশতে ভাসতে-ভাসতে ঠাকুর্দার বাপ-পিতেমো চলে যেত অনেক-অনেক দূরে। কত ভাগাড় দেখা হতো। কত শ্মশান। কত তান্ত্রিকের যোগাড়যন্তর। স্বাদ বদলাতে একান্নবর্তী শকুনরা এক ভাসন্ত মড়া থেকে উড়ে আরেক ভাসন্ত মড়ায় গিয়ে বসত।’…..দগদগে ঘায়ের মতো জাতিপ্রথা ও ক্রীতদাসপ্রথার ইতিহাস এসেছে এইভাবেই। স্বতঃস্ফূর্ত, গল্পের স্রোতকে  না ভেঙেই।

একইসাথে ধর্মের নামে নষ্টামিকে তুলে ধরতেও তিনি পিছহাত নন। ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপও করেছেন অনায়াসে। অবলীলায় আঘাত করেছেন ধর্মের অচলায়তনে। ‘ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।’ অবশ্য ধর্মের নামে বিভিন্ন অমানবিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি চিরদিনই সোচ্চার। হাংরি আন্দোলনের সময়েও তাই দেখি আলাদা ভাবে ধর্ম নিয়ে ইশতাহার । শিলাদকে তার দাদু বলছে, ‘এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে।’ এইভাবেই ধর্মের মুলো ঝুলিয়ে চলছে অবিরত ধর্মের গুরুঠাকুরদের ব‍্যবসা। বংশপরম্পরায় বসে খাওয়ার সুবন্দো‍বস্ত। রাজতন্ত্র আর ধর্ম চিরদিনই হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। একজন আর একজনকে পুষ্ট করে ক্ষমতা বাড়িয়েছে দুজনরেই, যাতে নিশ্চিন্তে ভোগবিলাসে দিন কেটে যায় এবং রাত। ‘লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।’ এই কথাটি এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সত্য ।

‘আজকাল যে-সব মড়া পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই গরু ছাগল আর ভেড়ার রুগি লাশ। গরু-মোষের স্বাস্হ্যবান মড়া হলে তার মাংসে এত কীটনাশক যে অক্কা অনিবার্য। ওসব খেয়েই তো শকুনরা আজ নির্বংশ।’….বিজ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগেও তাঁর সজাগ শকুনের দৃষ্টি। ‘সেদিনকে একটা আড়মাছ ধরেছিল শিলাদ; ছেড়ে দিতে হল। মহিষাসুরের গায়ের তিতকুটে সবুজ রঙ খেয়ে মায়ের দয়া হয়েছিল মাছটার।’

‘পার্টি-অপার্টির লোকেরা খুনোখুনি করে লাশ ফেললে পুলিশে তুলে নিয়ে যায়, আমাদের খেতে দেয় না। মর্গের বাইরে যে মড়াগুলো ফেলে দেয় সেগুলো চুরি করে নিয়ে যায় কংকালের ব্যাপারীরা।’ ….. টকে যাওয়া রাজনীতি আর সমাজের পচনশীল শবগুলোর ভিতরেও গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই। ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে আনেন বঙ্গসমাজের পচা-মাংসের টুকরো, পচে-যাওয়া নাড়িভুঁড়ি। এখানে ‘অপার্টি’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তুমি আমার দলের নও, মানে তুমি ‘অপর’, দি আদার । বিরোধী পার্টি আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম, কে বলল? ওসব বইয়েতে লেখা থাকে, বাস্তবে নয়। ‘সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।’ সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখোশ খুলেছেন তিনি অনায়াসেই। ‘এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।’

সংবাদমাধ‍্যমের দ্বিচারিতা, নিজেদের লাভের কথা মাথায় রেখে মিথ্যা খবর তৈরি করাকেও তিনি মোটেই ভালোভাবে নেননি। ‘আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হবে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।’ গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনে করা হয় সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের জাগ্রত প্রহরী। কিন্তু এটাও সেই খাতায় কলমেই থেকে গেছে। ভুয়ো আর মিথ্যা খবর গিলে-গিলেই আমরা আজ অভ‍্যস্থ । ‘নজরে পড়লেই সংবাদ মাধ্যমের ছোঁড়াছুঁড়িরা আজেবাজে কথা রসিয়ে-খসিয়ে লিখে দেবে। ও হয়ত বলল হা-লু-ম। ওরা লিখে দেবে শিলাদ তরফদার বলেছেন, মুখে হাগুম।’ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা পার্থক্য করতে, ভাবতেই ভুলে গেছে সংবাদখাদকরা । খবরটাও এখন ব‍্যবহৃত হয় এন্টারটেইনমেন্ট পার্পাস। ‘ব্রেকিং নিউজের খাতিরে আজকাল তো ধর্ষকদের ক্যামেরার সামনে আবার ধর্ষণ করে ঘটনা তুলে ধরতে হয়, যাতে জনসাধারণ স্বচক্ষে দেখতে পায়। অবশ্য তার জন্যে সস্তার অভিনেতা-অভিনেত্রী ভাড়া করতে হয়।’

হাংরি আন্দোলনের সময় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগটা চেপে গিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগটা সামনে আনা। হাংরি মানে যে কবি ও কবিতার (সৃষ্টিশীলতা) সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, সর্বগ্রাস, অনেক দিন খেতে না পাওয়া মানুষের মতো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলা সবকিছুই, খাওয়ার নিয়ম নীতি শিষ্টাচার কিছুই না মেনে। কবিতার পাঠবস্তুটি কখনো কোনকিছুতে বাছবিচার করবে না, তার প্রকান্ড হাঁ-মুখে তলিয়ে যাবে সবকিছুই। থাকবে না কোনো বাইনারি বৈপরীত্য,  হ‍্যাঁ-না, ঠিক-ভুল, ন‍্যায়-অন‍্যায়, শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব, এটাকে সম্পূর্ণ না জেনে, না বুঝে প্রচার করা হল হাংরি আন্দোলন মানে না খেয়ে, খালি পেটে কবিতা লেখা । তারসাথে নেশা করা, যৌনক্ষুধা ইত্যাদির মশালাদার খবর তো আছেই। সেই সময়ের সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই চোখে পড়বে নানা রকমের রসালো গালগল্প তৈরি করেছে লেখক-সাংবাদিকরা । জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছিলেন, ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’ ।

চাকরির পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে যখন শিক্ষিত বেকারের দল (না, শিক্ষিত বলব না, ডিগ্রিধারী বেকারের দল) খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো হচ্ছে সুটেডবুটেড ফেরিওয়ালা। সামান্য একটা জিনিস বেচার জন্য আন্তরিক মিথ্যা কথা বলছে, তাদের সেই তাড়না, তাদের সেই নিরুপায় তাগিদটা চোখে পড়ার মতো। একইসাথে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে আবার চোখের কোণে কোণে খেলে যায় তাচ্ছিল্যের হাসি। ‘ভাল্লাগবে স্যার উলুক, অবশ্যই ভাল্লাগবে, আমি দুবছরের গ্যারেন্টি আর তিন বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি, একবার এসে চোখ আর লিঙ্গ সার্থক করুন, তারপর বলবেন। ক্যাশ ডিসকাউন্ট আছে।’

যৌনপল্লীর বর্ণনাতেও গল্পকার বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং রিয়ালিস্টিক। ‘ডালে-ডালে কোটরবাড়ির দরজায় পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যাঁচাপেঁচি বুলেভার্দের দামি-দামি কলগার্ল। খুড়ুল্লে প্যাঁচা যার গায়ে বুটিদার বুটিক শাড়ি, ছাইরঙা টু-পিসে হুতুমনি, ফিল্ম স্টারের ডিজাইনার পোশাকে লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বাদামি চুড়িদার কুর্তায় ভুতুমনি, খয়েরি মিনি স্কার্ট-ব্লাউজে কালোপ্যাঁচা। ঠোঁট দিয়ে গায়ের পোকা বেছে রূপটান দিচ্ছে ভুতুমনি।’ শুধু বাইরে নয়, ভিতরেও। ফার্স্ট টাইমারের ফিলফিল ফ‍্যালফ‍্যালে ফিলিংস থেকে ফুরফুরে ফুর্তিটুকু বেশ যত্ন সহকারে বর্ণিত। ‘কী ভাবে শুরু করবে ভাবছিল শিলাদ। কিছুক্ষণেই যার সঙ্গে শোবে, এমন সুশ্রী সুবেশা অপরিচিতার সঙ্গে কথা বলার মাত্রা ওর জানা নেই। ইতস্তত ভাবটাই বা কাটানো যায় কী ভাবে? নিঋিতির জানা আছে প্রেমিকদের প্রাথমিক সমস্যা; তাই ওই শুরু করল। ……শিলাদের অস্বস্তির ভিন্ন ব্যাখ্যা করে নিঋিতি বলল, তুমি কি প্রথমবার? দাঁড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি কী ভাবে এগোবে। এই নাও কন্ডোম, এটা পরে নাও, ঝিঁঝির অন্তর্বাস-ডানা দিয়ে তৈরি মিউজিকাল কন্ডোম।’

‘নিঋিতির কথাটা শেষ হতেই, গ্রেনেড ফাটার আর গুলি চলার শব্দে শিলাদকে চমকে উঠতে দেখে ও বলল, ও কিছু নয়, সম্ভবত সন্ত্রাসবাদীরা খুনোখুনি খেলতে বেরিয়েছে, কিংবা বোধহয় চিনের কয়লাখনিতে সাপ্তাহিক বিস্ফোরণ হল।’……হ‍্যাঁ, চমকানোর কিছু নেই, এ তো ডেলি রুটিন। কিছু না হলেই বরঞ্চ বাসি বাসি লাগে।

‘এভাবে, সরকারি কর্মীর মতন, শিলাদের ঘুমিয়ে দিন যায়, জেগে রাত যায়।’….গল্পকারের স‍্যাটায়ারের প্রয়োগেও একইসাথে ফিচিক ফিচিক হাসি আর কর্কশ নিমতেতো।  ‘বাইরে শ-খানেক চড়াইপাখি জোরে-জোরে স্লোগান দিচ্ছে, চলবে না চলবে না, চক্রান্তকারীর হলুদডানা গুঁড়িয়ে দাও গুঁড়িয়ে দাও, আমাদের আবাসন বানিয়ে দিতে হবে দিতে হবে, কুটোকাঠি এনে দিতে হবে দিতে হবে, বাবুইবাসা চলবে না চলবে না’…..মিছিলনগরী কোলকাতার স্মৃতি তো আজও স্বপ্নে ও জাগরণে। পাল্লা দিয়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ। আমি আজ পর্যন্ত এই কালো হাতগুলোকে কোনদিন দেখতে পাইনি। ভাঙতে বা গুড়িয়ে যেতেও দেখিনি। কিন্তু আছে জানি, থাকবেও। কিন্তু দেখতে পাই না কখনো। হয়তো কালো কালো হাতের সারি চোখের সামনেই। আসলে দুরকমের যাতায়াত থাকে সিঁড়ি বেয়ে। এই যে সব নীরব মিছিল বা উদ‍্যত হাত। বিজ্ঞাপনে দীর্ঘ হয় জুতোর আকার। ‘এর সঙ্গে যোগ হল একমাসের বেশি রোজ ভোরে ঘুমোতে যাবার সময় থেকে সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙার সময় পর্যন্ত ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ছ্যাঁচোড়দের এই ধরনের অবিরাম গলাবাজি । …জলে স্হলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র এই বকুনিবাতেলার চোঙা।’ কী আর করা যাবে, সইতে তো হবেই। গণতন্ত্রের গণোৎসব।

গাঁয়ে-গঞ্জে ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ফলে অনেক মানুষ ইঁদুরের বাড়ি থেকে ধান চুরি করছে তা তো আমরা স্বচক্ষে নাইটভিশানে দেখেছি।’ আরে ভোটের তো কিছু খরচ-খরচা আছে, নাকি। আহা বেচারিরা পাবে কোথায়, সারাটা জীবন তো শুধু নিঃস্বার্থভাবে সমাজের সেবা করে গেল। দাও, দাও হাত উপুড় করে। আর না দিলে ? ছিঃ ছিঃ এসব পোলাপানামো মৃত‍্যুপথযাত্রীরা করে। আর বলছিলাম কী, বাড়ি টাড়ি করলে আমাদেরকে বলবেন, কোনো সমস্যা হবে না। ইঁট-বালি-সিমেন্ট ইত্যাদির ব‍্যবস্থা আমরাই করে দেবো। আপনাদের কোনো সমস্যা হোক এটা আমরা ভাবতে পারি, বলুন। অবশ্য কিছু দোষ তো থাকতেই পারে, বলুন। কাজ করলেই ভুল হবে। ‘সুপারির ট্যাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করিস না, বিরোধী প্রার্থীকে মাস্তান সাপ্লাই দিয়েছিস, ধর্ষণে যাবার আগে আমাদের সঙ্গী করিস না, আমার এলাকায় ট্রাক লুটিস, পুকুর বোজাবার আমাদের গুয়ের গাড়ি ছিনিয়ে নিস, আমাদের এলাকার ঠিকেদারি নিয়ে নিস, পুজোয় তোলা আদায় করে পুরোটা রেখে নিস, আমার চুল্লুঠেকের খবর পুলিশকে দিস, আমাদের পাচারের মাগিদের পেছন শুঁকে বেড়াস, ইত্যাদি।’

‘থলথলে ঘাড়েগর্দান বনবাবু বলছিল, আরে ওখানে একটা আধফোকলা বুড়ো বাঘ থাকে যার এই বয়সে ম্যানইটার হওয়া অসম্ভব; আপনারা নিশ্চিত হয়ে চিংড়িপোনা ধরুন, আমরা তো আছি, ভয় কিসের।’….প্রশাসনের মিথ্যা আশ্বাস আর মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখার এক ওয়েস্টবেঙ্গলসম দক্ষতা এড়িয়ে যায়নি গল্পকারের চোখ থেকে। হাংরি আন্দোলনের সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এটাও ছিল একটা মস্ত কারণ।  হাংরি আন্দোলনের পরপরই পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেছিল নকশাল আন্দোলন। দেবেশ রায় এই দুটি আন্দোলনে একই বিশ্ববীক্ষার কথা বলেছিলেন । অথচ দুটোর উদ্দেশ্য, প্রস্তুতি ও গভীরতা সম্পূর্ণ আলাদা । হাংরি আন্দোলন যেখানে দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল , সেখানে নকশাল আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কসীয় পন্হায় রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল । হাংরি আন্দোলনে ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে জেহাদ তার কারণ মূলত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং শিল্প ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের বাণিজ্যিক প্রয়াস। শিল্প ও সাহিত্যের পায়ে ভিক্টোরিয়ান মূল‍্যবোধের বেড়ি পরিয়ে দেওয়া। তাছাড়া শিল্প ও সাহিত্যজগতের মানুষের মধ্যে এসেছিল জাড্যের উদাসীন স্থিতাবস্থা। সমাজবিমুখ হয়ে সাহিত্য ও শিল্পের বাজার আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । ভাবনাতেও এসে গেছিল দৈন্য। কোনো নতুন আইডিয়া নেই। শুধু কালিতে কালি বুলিয়ে সুখী সুখী নির্মাণই ছিল শিল্প ও সাহিত্য সাধনা। এরসাথে যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার পদলেহন করে স্বীকৃতি যোগাড়। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছিল হাংরি আন্দোলন। যদিও অ্যাবস্ট্রাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ায় আজও কোনো হেলদোল নেই।
হাংরি একটা কামড়  দিতে পেড়েছিল সেই পচাগলা মাংসে। হাংরি আন্দোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড বা চোরাগোপ্তা পথের কোনো স্থান ছিল না। যুদ্ধটা সামনাসামনি। আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল নয়, কলম-তুলি। যা মুখোশ খোলে, রক্ত খায় না। ‘ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে।’….নকশাল আন্দোলন ছিল অপরদিকে  চোরাপথে গেরিলা কায়দায় আঘাত হানা, এখন মাওবাদীরা জঙ্গলে লুকিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াস করছেন, ভারতের জাতিপ্রথার কোনো বিশ্লেষণ তাঁরা করেন না । গল্পকার যে এই চোরাগোপ্তা পথে মানুষখুনের আন্দোলনগুলিকে ভালো ভাবে নেননি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই গল্প থেকে। ‘সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা।’ মার্কসবাদকে সামনে রেখে দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সবচেয়ে ভুল ছিল, আঞ্চলিক বা নিজস্ব সমস্যাকে বিচার বা বিশ্লেষণ না করে সবকিছুকেই মার্কসবাদের আলোকে ফেলা। অর্থাৎ এখানেও যেন সেই ধর্মের মতো গোঁড়ামি। নিজস্ব চিন্তাভাবনা নয়, নিজের সমাজকে চিনে বিচার বিশ্লেষণ নয়, ধর্মগ্রন্থের মতো একটি বইয়ের কথাগুলিকে চিরসত‍্য ধরে তা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পালন করে যাওয়া। ‘মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা’-র মধ্য দিয়ে গল্পকার যেন এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, কীভাবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভারতীয় আইডেন্টিটি ভুলে গিয়ে, নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিসরটাকে শূন্য করে ক্রমাগত কপচে যায় মুখস্থ করা বুলি। আর অ্যাকশন্ ঠিক সেই আদি অকৃত্রিম পথেই। নিজস্ব পথ আবিস্কারের কোনো চেষ্টা নেই।

একের পর এক দিগগজ নেতার তরল সান্দ্র গভীর সংঘাতী তঞ্চিত খামিরি মাতানো ধূমিত রসাল ভারিক লঘু চোহেল আবিল সতেজ শুটকো আধসেদ্ধ বিদগ্ধ বক্তৃতা শুনতে-শুনতে জঙ্গিলা-জীবন আর জীবনদর্শন সম্পর্কে খটকা লাগল শিলাদের। বিস্ফোরক বানানো, সেটাকে যার মাথায় ইচ্ছা ফাটানো, আর যার মাথায় ফাটানো হচ্ছে তাকে জঙ্গিলা শত্রু ঘোষণা করা, এইই মনে হচ্ছে মোদ্দা কথা।’……এইভাবেই তিনি সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনগুলিকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ মেরে আর যাইহোক সমাজের ভালো কিছু হয় না। যা মানবিক নয়, যা ধ্বংস করে মানবিকতাকে তাকে সরকারি সন্ত্রাসবাদ বলতে তিনি দ্বিধাহীন। কোনো আদর্শের মোড়কেই এই মানুষ হত‍্যাকে তিনি জাস্টিফাই করতে চান না। শ্রীকৃষ্ণের হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, যুদ্ধের সাথে হত্যার সাথে ধর্মকে সরাসরি মিলিয়ে দেওয়া, তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজও । আসলে রক্তে হাত ভেজানোটাই আসল। আদর্শ, মতবাদ,  জাস্ট আই-ওয়াশ, ঝুলিয়ে রাখা কেতাবি ধুলো। ‘আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী; হয়ে গেলুম সেলাম-গ্রহণকারী উড়োনছু কংকাল, ওই সব জঙ্গিলাগুলোর জন্যেই। কত ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে আমায় করে ফেললে উড়োনছু কংকাল আর নিজেরা দিব্বি আমোদ-প্রোমোদ নিয়ে মজা করে চালালে।’ ব্যাপারটি যেন পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পটচিত্র ।

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ রক্তপায়ী। রক্ত পান করার সুযোগ তাকে ছলে বলে কৌশলে আবিস্কার করে নিতেই হয়। সন্ত্রাসীদের দ্বিচারিতাও ধরা পড়েছে শিলাদের কথায়, স্পষ্টভাবেই, ‘জঙ্গিলা জীবনের কত কি জানত না শিলাদ। নানা রঙ্গিলার দেশে গিয়ে তাদের পয়সায় ডেঁড়েমুশে খেয়ে মৌজ করা, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা যে জঙ্গিলার উদ্দেশ্য তা জানত না । ভ্যাবাচাকা গিলে-গিলে খেতে লাগল শিলাদ।’ বহু লেখক ও কবি একসময়ে সোভিয়েত দেশে যেতেন, ছেলে-মেয়েদের পাঠাতেন আনন্দ করার জন্য । তাদের মুখোশ খুলতে, তাদের নগ্ন করতে, মহান আদর্শের ফাঁকা বুলি ঝেড়ে, আন্ডারগ্রাউন্ডে ঘটে চলা প্রকৃত সত্যকে তিনি আমাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছেন । ‘অধৈর্য হবেন না সাথী; অ্যানোলসাথী এবার চরস গাঁজা আফিম কোকেন হেরোইন বিক্রির টাকা ডলার পাউন্ড ইয়েন রিয়াল রুবল লিরা দিরহাম ফ্রাঁ মার্ক আমাদের বিলি করবেন।…….হ্যাঁ সাথী, তা না হলে আর্ডিএক্স মর্টার বাজুকা রকেট রাইফেল গ্রেনেড ডিটোনেটর কিনবেন কী করে? খালি হাতে কজনকেই বা মারবেন? আর চোখ কান বুজে মারতেই যদি না পারলেন তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পুরো হবে?….শুনে, দমে গেল, মুষড়ে পড়ল শিলাদ, হতাশ, মনোহত। জঙ্গিলা মানে কি মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা? ধুসশালা।’…..এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা খুঁজে পাইনি। হয়তো পাবোও না কোনদিন। ধুসশালা।

বিশ্বজুড়ে বাড়বাড়ন্ত সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, বালক-কিশোর সন্ত্রাসবাদী। শৈশবকে জাস্ট খুন করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে অস্ত্র। কখনোবা তারা মানববোমা। বালক হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক সময় সন্দেহের বাইরে থাকে তারা। এই সুযোগটাই বারবার নিয়ে চলেছে সন্ত্রাসের সর্বাধিনায়কেরা। আবার অনেক সময় শিশু চুরি করে এনে ছোট থেকেই ব্রেন ওয়াশ করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে হার্ডকোর টেররিস্ট রূপে। আদিম যোদ্ধাগোষ্ঠীগুলোতেও ছিল এই একই প্রক্রিয়া। তা সে চেঙ্গিজের বা আত্তিলার সেনা, নিনজা হোক বা স্পার্টান। বর্তমানের কদর্যতম রূপ এটাই যে বালিকা ও কিশোরীদের অপহরণ করা হচ্ছে সন্ত্রাসীবাদীদের যৌনদাসী হিসাবে ব‍্যবহার করায় জন‍্যে। ‘আমরা রঙ্গিলা ডিম চুরি করে এনে জন্মের আগে থেকে জঙ্গিলা বানাই। জঙ্গিলা গোষ্ঠীর রঙ অনুযায়ী সেই মতাদর্শের আরকে চোবাই। ডিম ফুটে বেরোলেই ওদের ইনডকট্রিনেট করে জীবন্ত অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে শত্রু নিধনে পাঠানো হয়।’

‘রঙ্গিলা জীবনে ল্যাজ নিয়ে করবিটা কী? কাউকে কায়দামাফিক সেলাম ঠুকতে হয় না। তোদের তো হেঁ হেঁ করলি, হাত কচলালি, ব্যাস, সেলাম হয়ে গেল।’…..সন্ত্রাসীদের নগ্ন ছবি আঁকতে আঁকতে মেরুদন্ডহীন দুধে ভাতে বাঙালিকে কি খোঁটা দিয়ে গেলেন গল্পকার?
‘আপনি ভুল করছেন। জঙ্গিলা আমি স্বেচ্ছায় হয়েছি। কেউ আমায় ভুল বুঝিয়ে, ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে, কেতাব পড়িয়ে বা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে জঙ্গিলা বানায়নি।’….স্বেচ্ছায় যে কেউ সন্ত্রাসবাদী হয় না, তার পিছনে যে থাকে নেতারা, এই নির্জলা সত‍্যটাকে তুলে ধরতে কসুর করেননি গল্পকার। মহাভারতের  সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুন’ও নাকি তাঁর অস্ত্র নামিয়ে নিয়েছিলেন । তারপর তাঁর রথের উপর উপবিষ্ট সর্বাধিনায়কের ব্রেন ওয়াশের পর সে নির্দ্ধিধায় লেগে যায় মারো মারো আর মারোর রক্তপানে। ফর্ গডস্ সেক্, হোল্ড ইয়োর বো এন্ড কিল্ দ‍্য এনিমি। এনিমি? শত্রু? কে শত্রু? তুমি যাকে মারবে সেই তোমার শত্রু। যে অপর, সেই তোমার শত্রু। বিরুদ্ধ মত ও পথ বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না। হয় ‘আমরা’ নয় ‘ওরা’ । আবার সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে বিভাজনটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট। সবাই ফ্রন্টে গিয়ে গুলি খাওয়ার রিস্ক নেয় না। তাদের জীবন যে ভীষণ ‘দামি’। তাই কেউ কেউ মারে ও মরে আর কারো কারো হাতে রথের দড়ি। ‘ওইটুকু জঙ্গিলা জীবনে ও দেখেছিল তাদের মধ্যে খয়রাতি জঙ্গিলা আর ভিখিরি জঙ্গিলার মাঝে বর্ণভেদ রয়েছে, তেমনই আছে বড়লোক জঙ্গিলা আর ছোটলোক জঙ্গিলার মাঝে, ডলার জঙ্গিলার সঙ্গে টাকা জঙ্গিলার, শাস্ত্রজ্ঞের সঙ্গে আনপঢ়ের, আস্তিকের সঙ্গে না-আস্তিকের, গোরার সঙ্গে কালার, বলিতে পাঠাও আর বলিদান দাও জঙ্গিলার মাঝে, বস্তিছাপ আর এয়ারকান্ডিশান জঙ্গিলার মাঝে।’ বিপ্লবের রোমান্টিসিজম্ এইভাবেই শুষে নিয়ে গল্পকার, কদর্য সত‍্যটাকে তুলে ধরেছেন। ‘জঙ্গিলাজীবন আর আগেকার কালের হিরো-জীবনের মতন রোমান্টিক নেই; এখন সবাই ধান্দাবাজ।’

শুধু সমাজ-বদলকারীদের নয়,  সুখী সামাজিক মানুষদের শ্রেণিবিভাজন’টাও তিনি ধরেছেন  নিপুণভাবে। ‘রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদের পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি।’ এই বিভাজনকে বৈচিত্র্য মেনে মানুষ’ও বেশ খুশি। তাই  সুখী খুশি কানে যদি কেউ নতুন কিছু শোনাতে যায় শোনে না, ভাবতেও চায় না, শুনতেও। ‘রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে’। চিরদিনই নতুন কিছু যাঁরা জানাতে চেয়েছেন মানুষকে, তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে।

এই অরূপকথনে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির দাদাগিরিকেও তিনি শিলাদের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে।’ হয়তো উপনিবেশের রঙ পাল্টে গেছে, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’ এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন। কিন্তু তার এফেক্ট একই। অসংখ্য হাড়জিরজিরে মানুষের লাশের উপর গুটিকয় নাদুসনুদুস মানুষের ভুড়ি ভুড়ি ভুরিভোজ। ‘দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল।’

পশ্চিমবঙ্গের পুঁথিনির্ভর শিক্ষকমুখী শিক্ষাব‍্যবস্থার হাল যে কতখানি করুণ তা আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা যেন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, সবাই মানে তবু হরিদাসের গোয়াল খালি থাকে না। উপায়ও নেই। যেন তেন প্রকারেণ চাই ডিগ্রি, পরীক্ষায় পাশ করাটাই সাফল্যের খতিয়ান। শিক্ষা? সেটা আবার কী স‍্যার? ‘শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ। প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।’….শিক্ষকরা নিজেরাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর তারাই দেয় বিজ্ঞানের শিক্ষা। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া ছেলেমেয়েরা আসে ফ্রি স্কুলে শিক্ষা নিতে। বাড়িতে ঠিকঠাক খেতেও পায় না। অপুষ্টি শরীরে ও মনে, আর তারাই মুখস্থ করে বাড়ি ফেরে ভিটামিন কাহারে কয়। এই দূরাবস্থা থেকে আজ আশার আলো স্কুলে-স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্প। এই গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মিড-ডে মিল চালু হয়নি। তাই গল্পকারের তর্জনী নিক্ষেপ সফল। অবশ্য শুধু সরকারি ফ্রি স্কুল নয়, ঝাঁ চকচকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব‍্যবস্থাও যে খুব ভালো এমনও নয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব‍্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো নাম্বার, আরো নাম্বার, আরো আরো নাম্বার। নো ইনোভেশন ওনলি মুখস্থং নোটং।

একজন টিচার বেশ ঠাটি, ফুটেক ল্যাজের ছড়ি উঁচিয়ে, মগডাল থেকে তাক-তিড়িং-তুং লাফ মেরে ক্লাসে নামল, তারপর, হেঁচকা মেরে, এক মাওরা ছাত্রীকে চামড়াসুদ্ধ এক-খাবলা লোম তুলে নিয়ে যেতে, বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেছনের দুহাতে তালি বাজিয়ে বাহবা দিল। এরপর এক ধিঙ্গিনাচন শিক্ষিকা, পলাশের কাঁটাদার জিঙ্গলকাঠি ভেঙে তিন হাত দিয়ে এক কচি ছাত্রকে দমাদম উত্তম-মধ্যম দিতে, সে আধমরা হয়ে গাছের নমনা আঁকড়ে ঝুলতে লাগল।’…….শিক্ষার অধিকার আইনে আজ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক ন‍্যূনতম নির্যাতন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আজও শিক্ষার্থীরা একইরকম শারীরিক ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়ে চলেছে প্রতি মুহুর্তে।

শিলাদ তরফদার নিজেকে বোঝাল, ভাগ্যিস ও মানবজীবন চায়নি বা পায়নি। সেক্ষেত্রে ছাত্র আর শিক্ষক দুটো স্তরের রাঙাপোঁদা রাঙামুখো পর্ব পেরোতে হতো। শিক্ষকরা তো মানব গড়ার কারিগর।’ তবে আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, এই ব‍্যাপারটা এখন অনেক কমেছে। শিক্ষার্থীরা আজ অনেকটাই শিক্ষক-শিক্ষিকার বন্ধুর মতো। ঠিক ভয় পায় না, কিন্তু ভালোবাসে। এখানেও আবার দেখি উল্টো সমস্যা, গার্জেনদের বলতে শুনি, এখনকার চ‍্যাংড়া মাস্টাররা সব পড়ায় কোথায়? ক্লাসে বসে শুধু গল্প আর আড্ডা। সারা ক্লাস জুড়ে শুধু হো হো আর হা হা। আমাদের সময় ক্লাসে মাস্টার ঢুকলে ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। উফ্ কী পড়াতেন, পড়া ধরতেন, বাড়ির জন্য হোমটাস্ক দিতেন আর না বলতে পারলেই মার। এদের সে দায়িত্ব কোথায়, এরা তো জানে মাস ফুরালেই মোটা মাইনে তাই পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ।

‘ডাকাতগুলো এখন পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাবে। তারপর ছ-জন নাক ডেকে ঘুমিয়ে রাতে বেরোবে গেরস্ত জেলেদের নৌকোসুদ্ধ বমাল ধরতে। কাদের ধরতে হবে সে খবর ওরা পঞ্চায়েতের লোকেদের ভাঙিয়ে জেনেছে।’…….সুন্দরবন খাড়ি অঞ্চলে জলদস‍্যুদের উৎপাত একটা জ্বলন্ত আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই জলদস্যুরা বেশিরভাগই আসে বাংলাদেশ থেকে। লোকাল সোর্স’ও থাকে। ডাকাতি করে তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে যায়। হাতেনাতে না ধরতে পারলে প্রশাসন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। অবশ্য সুন্দরবন অঞ্চলে প্রসাশনের অস্তিত্ব প্রায় নামেই। জঙ্গলে চলে জঙ্গলেরই নিয়ম। বাঘ কুমির আর ডাকাতদের সাথেই সহবাস সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষদের। আমার একজন বন্ধুর সুন্দরবনের কোনো এক ছোট্ট দ্বীপে বাড়ি। ও বলতো, আমাদের গ্রামে প্রায়ই বাঘ আসে। গরু ছাগল খেতে। তবে বেশিরভাই বুড়ো বাঘ। তোরা যেভাবে কুকুর তাড়া করিস আমরা সেইভাবেই লাঠি নিয়ে সবাই মিলে বাঘ তাড়া করি। বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে বিস্ময়ের। মৃত্যু তো স্বাভাবিক পরিণতি। প্রায় প্রতি ঘরে বিধবার অস্তিত্ব সেই তথ‍্যকে পুষ্টি যোগায়। এরসাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। মূলত বাঘের চামড়ার কারবারিরা আসে বাঘশিকার করতে। ‘কপালে গুলি মারলি কেন? মাথার চামড়াটা ড্যামেজ হলে ভাল দাম পেতে অসুবিধা হবে,  জানিস না?’ তাদের হাতে মানুষের সরাসরি কোনো ক্ষতি হয় না ঠিকই, বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকাল ইন্ধন থাকে পুরোপুরি। কিন্তু বাস্তুতন্ত্র তথা সুন্দরবনের মূল বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ বিলুপ্তির মুখে। সরকারি প্রচার ও বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংস্থার প্রচারে বর্তমানে সুন্দরবন বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু সচেতনতা দেখা দিয়েছে।

‘পর-পর চারটে গুলি লাগল বুকে আর পেটে। শিলাদ বুঝতে পারল ও মরে যাচ্ছে।’……শকুন থেকে যে জার্নিটা শুধু হয়েছিল গল্পকারের এবং আমার, শিলাদের অস্তিত্বের অবসানে চোখ শুকনো রাখার কোনো উপায় ছিল না আর। শিলাদের সাথে আমিও এতক্ষন এগিয়ে গেছি অরূপকথনের পথে । নিজেকে যেন আমি শিলাদের সাথে এক করে ফেলেছিলাম। হয়তো এটা গল্পকারের দক্ষতা বা আমার মানসিক দুর্বলতা। সে যাইহোক, গুলি খেতেই চমক ভাঙল, বুঝলাম যে আমি বেঁচে আছি আর শিলাদ নেই। ‘ও চলে গেল জলের তলায়।’….’দাদুকে চিনতে অসুবিধা হয়নি শিলাদের। দাদু-দাদু চিৎকার করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। নিজের শবের ওপর দাদুকে নিয়ে ভেসে চলল শিলাদ তরফদার।’……শেষ হলো একটা জার্নি।
মন খারাপ হলেও অবকাশ পেলাম নিজেকে খোঁজার, জীবনের অর্থ খোঁজার শিলাদের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। ‘নানা পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে সন্দেহ ধরে গেল যে জগৎসংসার সম্ভবত বোধগম্য, সুসংহত, আসঞ্জনশীল ব্যবস্থা নয়। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?’ প্রশ্ন করতে বাধ‍্য হই নিজেকে, আর উত্তর? ‘নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।’

No comments:

Post a Comment

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে

  হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় : নিখিল পাণ্ডে প্রখ্যাত কবি, হাংরির কবি দেবী রায় ৩ অক্টোবর ২০২৩ চলে গেছেন --- "কাব্য অমৃতলোক " ফ্ল্...