সমরজিৎ সিংহ : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় উহুরু
( Uhuru শব্দটি সোয়াহিলি, অর্থ স্বাধীনতা )
মলয় রায়চৌধুরী কে ?
এই নিরীহ, আপাত শান্ত, সাদামাটা প্রশ্নের সামনে, আমাকে, দুমিনিট, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় ; কেননা, একজন অশিক্ষিত পাঠক বলে, মলয় রায়চৌধুরীকে আমার জানা হয়ে ওঠেনি । দু-একটি সামান্য তথ্য আমি, একেবারেই ছিল না, তা নয় ; আবার, তাও জেনেছি ‘হাংরি সাক্ষাৎকারমালা’ এবং আমার দু-একটি ‘ছিটমহলবাসী’ হাংরি বন্ধুদের সৌজন্যে, তাদের দেওয়া বইপত্তর ঘেঁটে । একে কি, সত্যিই, জানা বলে ? আমি জানি না ।
সম্ভবত, ১৯৯০ বা তার আগে-পরে, কোনও এক সময়ে, কীভাবে যেন আমার হাতে এসে পড়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার বই ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ ( ১৯৮৭ ) । বইটির রচয়িতা আর কেউ নয়, মলয় রায়চৌধুরী, যাঁকে হাংরি কবি হিসাবে, আগরতলার এই ছিটমহলে, তখনও বেশ তোল্লাই দেওয়া হতো।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, এই কবিতার বইয়ের ভাষা, ও মা ! এ তো বাংলা ভাষাই । পঞ্চাশের দশকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে মুখের ভাষাকে ঠাঁই দিতে চেয়েছিলেন কবিতায়, মলয়ও, ‘ইতর লেকসিকন’ ব্যবহার করে, নতুন করে গড়তে চাইছেন । তবে, ওই যে, সুনীলীয় ভাবে নয়। সুনীলকে কেউ-কেউ বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন ভেবে, গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ; এই তথ্য মলয়ের জানা ছিল কিনা জানি না ; তবু , তিনিও খুব সচেতনভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বাঁক বদলের, অন্তত এই বইতে । আমি বেশ মজা পাই এতে, এই সচেতন প্রয়াস দেখে ।
কবিকে নিজের শৈলী বানাতে হয়, এই ‘চালু চেতনার ফাঁদ’ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে গিয়ে, কীভাবে একজন সচেতন কবিতা-লেখক, ওই ফাঁদের ফাঁস গলায় পরে ছটফট করছেন, এটা লক্ষ্য করলে, মজা পাও্য়া যায় বৈকি! মলয়, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এ নাটুকেপনা বিস্তর করেছেন ; গিমিক বলা উচিত হবে কিনা, এ বিষয়ে সংশয় আছে বলে, আমি সেদিকে যাচ্ছি না ; তবে ওই যে নাটুকেপনা করতে গিয়ে যাত্রাপালার অভিনয়ে যা হয়ে থাকে, চিচিচকার, মলয়ের চিচিচকার, বড় বেশি কানে লাগে ; লাগে, তবে মর্মে বেঁধে না । এতদসত্বেও, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ আমাকে চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে, ভাষায় । মলয়ের সাহস ও শব্দ ব্যবহারবিধি আচ্ছন্ন করে রাখে বহুদিন :-
ফেরার সময়ে ওরা ঘিরে ধরে । ছসাতজন । প্রত্যেকেরই
রয়েছে কিছু-না-কিছু হাতে । আসার সময়ে জানতুম আজ
গোলমাল হবে, তাই তৈরি হয়েই এসেছি । তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাব না সেটা ঠিক করা আছে ।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, ‘পেরেম করতে এয়েচো
এপাড়ায় ! কেন ? নিজের বাড়িতে মাগ নেই ?’
দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি ল তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে, যেটা হাত দিয়ে টের পাই ।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি ল মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি---
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় ছিদাম লেখা একপিঠে মাকলী ওপিঠে ।
জটলা ছিৎরে যায় ! চাকু-দেবতার নামে কতোগুণ আছে
সকলে জানে না । মানব কেন অমন কুচুটে ?
প্রেমিকের জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই ? এই যে ছ’সাতজন
মনের স্বামীত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটু ঝলকে
( দোটানা ২৯ আষাঢ় ১৩৯২ )
ওই ঝলক দেখেই, হয়তো শত দোষ সত্বেও, আমার মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা ।
বাংলা কবিতার আবহমান রীতি ভেঙেচুরে দিতে, ঐতিহ্য ও ধ্যানধারণাকে পালটে দিতে, হাংরিদের আবির্ভাব, এরকমই একটা কথা, কোথায় যেন শুনেছিলাম, এবং মলয় নিজে এই হাংরিদের পুরোধাপুরুষ বলে, হয়তো, তাঁর কবিতায় ওই ধাক্কা দেবার অনলস প্রবাস আমি লক্ষ্য করি, যাকে মলয় বলতে চেয়েছেন ‘পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান’ । এইটে করেছেন ‘অচেনা ভাষা ইউনিট’ গড়ে, অন্তত তিনি তাই প্রণিধান করতে চেয়েছেন কোনও এক লেখায়, এবং যথেষ্ট ‘মাজা ঘষার পর, ঠাণ্ডা মাথায় ।’
ফলে, আমার সংশয়, আচ্ছন্নতার রেশ কাটতে না কাততেই, আরও বাড়ে, বেড়ে যায়, কেন এটা করতে চাইছেন মলয় ? এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতার জন্য ? স্রেফ বিরোধিতা, আর কিছু নয় ? পূর্ববিধানকে হটিয়ে নববিধান রূপায়ণের জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য ? তার মানে এসটাবলিশমেন্টের ক্ষমতার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা ? ব্যাপারটা বড়ো গোলমেলে মনে হয় । যদি বিরোধিতাই হয়ে থাকে উদ্দেশ্য, বচনবয়নের রূপ পালটেদেওয়াটাই যদি এসটাবলিশমিন্ট বিরোধিতা হয়ে থাকে, এলিট শব্দকোষের বদলে তিনি যে ভাষা বয়ন করেছেন ননএলিট লেকসিকন ব্যবহার করে, তা যে ওই এসটাবলিশমেন্ট-পালিত ‘তোলা আদায়কারী মস্তানবাহিনী’-রই মুখের ভাষা ‘আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির’, সে যে কার ভাষা, তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, এবং তা ব্যবহার করে পরোক্ষে, তিনিই এসটাবলিশমেন্টের পাছার কাপড় ঠিক করে দিচ্ছেন, এই ভূমিকা লক্ষ্য করেই আমার এত সংশয়:-
যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে-কে আছে
পেটো ্কিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফূট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুচি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ুমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো ।
( মেসোমশায় পর্ব, ২৭ নৈশাখ ১৩৯২ )
‘ঘুণপোকার সিংহাসন’ বা এরকম আরও কিছু কবিতা এ সংশয় আরও প্রগাঢ় করে তোলে যখন দেখি, ‘নোকরশাহির রাজ্য এনেছো এ-দেশে’ বলে মলয় তৃপ্তি পাচ্ছেন, অথচ ওই নোকরশাহিকেই তিনি করে তুলেছেন মহিমামণ্ডিত :-
ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান পপাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছ এদেশে ।
( ঘুণপোকার সিংহাসন, ২ ভাদ্র ১৩৯২ )
আমি ভুলে যেতে পারি না মলয়ের কবিতায় শ্রেণিচেতনার গাঢ় উন্মেষ দেখে, একথা আরও উল্লেখ করতে চাইছি, আমাদের দেশের বামপন্হী আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনসহ, সব আন্দোলনই মূলত এসটাবলিশমেন্টকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ; উপরি কাঠামোতে একটু গুঁজগাঁজ দিয়ে, আরও বেশি । এর ফলে নিজেকে সংহত করে ওই এসটাবলিশমেন্ট । আমি জানি ,মলয়ের এই বাগব্যবহারবিধি তাঁর ভাষাকে দিয়েছে প্রচণ্ড গতি ও তেজ, কবিতার ক্ষীণ ও প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ধমনীতে চালিত করতে পেরেছেন টাটকা রক্ত, এক বিদ্যুৎপ্রবাহ, যার সামনে আমার সন্ত্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না । সে অর্থে হলে, মলয় সত্যিই ধন্যবাদার্হ ।
‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কতোবার যে পড়লাম তার ইয়ত্তা নেই । মনে হয় মলয়, শুধু বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যাক, এটা বোধহয় চাইছেন না । আরও কিছু চাইছেন, খুব সচেতনভাবে । এখানেই আমার আপত্তি । একটা পুরোনো বাংলা সিনেমায়, সম্ভবত ‘চারমূর্তি’ হবে সিনেমাটা, ক্যাবলা কংকাল সেজে ভয় দেখাতে গেলে, টেনিদা-রূপী চিন্ময় রায় মূর্ছা যান । জ্ঞান ফিরে এলে, উঠে, গা ঝাড়তে ঝাড়তে বন্ধুদের চিন্ময় বলেন, একটু ভড়কি দিলাম আরকি ! মলয় কি ভড়কিই দিতে চাইছেন শুধু ? আমি আরও মুশকিলে পড়ে যাই, যখন মলয় নিজেই স্বীকার করছেন, “আমি সত্যিই শিল্পের বিরুদ্ধে ও সংস্কৃতির স্বপক্ষে বলতে চেয়েছিলুম ।”
তাহলে, শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল কী ? মলয়ের যুদ্ধঘোষণা, তাহলে শিল্পের বিরুদ্ধে, যাকে তিনি কখনও ঔপনিবেশিকতার উপহার হিসেবে চি্হ্ণিত করতে চাইছেন, কোথাও কোথাও, সেই শিল্পের বিরুদ্ধে ? তখনই, আবার অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লক্ষ্য করতে হয়, এ কোন যুদ্ধ ? ‘মেসোমশায় পর্ব’ কবিতার যদি সাক্ষ্য নিই, দেখি, আহ্বান তিনি জানাচ্ছেন বটে যুদ্ধের, যুধিষ্ঠির/আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির/বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে/ নিয়ায় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে কে আছে/পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন…’, সন্দেহ নেই, তিনি যতই অস্বীকার করুন, এখানে ‘বহুতলবাড়ি’ শব্দের শ্রেণি অভিঘাতে, নতুন প্রতীকি মাত্রা পেয়েছে; দ্বাপর যুগের ওই চেতনাপ্রবাহ কী করে যেন এসে, কলকাতা শহরে, নকশাল-মাস্তান মিলেমিশে, একাকার হয়ে শ্রেণিযুদ্ধ থেকে বাঁক নিয়ে, একাকী, নিঃসঙ্গ কবির মরণপণ সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে যায় । তবু যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, আর ওই বহুতল বাড়িরই তৈরি করে দেওয়া মিথকেই ক্রমে সন্মানিত করে তুলছেন, ‘দেখে নিস তোরা/মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাবো’, এই ঘোষণা দিয়ে ।
শেষ পর্যন্ত ওই জ্যোতির্বলয় গড়ে তোলার জন্য মলয়ের এত কসরত, এত চেষ্টা, এত হাঁকডাক ? তাহলে যুদ্ধের আহ্বান কেন ? না কি, মলয়ও চাইছেন, যেভাবেই হোক, বা, বৈরীভাবেই হোক, এসটাবলিশমেন্টে পাতে বসার সুযোগ পেতে ? যে-আবহমান বাংলা কবিতারীতি তিনি ভাঙতে চাইছেন ঠাণ্ডা মাথায়, সেই আবহমানতা তিনি, অজান্তে, বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাঁধে করে, এটা দেখে, আমারও কষ্ট হয়, মলয়ের জন্য । তিনি, অসহায়ভাবে, কখনও কখনও, মেনে নিচ্ছেন, অক্ষরবৃত্তের বিলাসিতা, ডুবে যাচ্ছেন বৃহত্তর মায়ায় । আবার, কবিতার ভাষা বদলাতে গিয়ে, শব্দ বদলে দিচ্ছেন, কিন্তু মেনে নিচ্ছেন ব্যাকরণের রক্তচক্ষু, আঁকড়ে ধরছেন কবিতাপ্রতিমার পুরোনো কাঠামো ।
এত স্ববিরোধিতা, তবু, অল্প জানি বলেই, মলয়কে আমার ভালো লাগে । আমার, বরাবরই মনে হয়, মলয়, তাঁর রাগি চেহারা নিয়েও, প্রবল-রোমান্টিকতা বিরোধী বলে, নিজেকে বরাবর চি্হ্ণিত করতে চাইলেও, আদ্যোপান্ত এক রোমান্টিক কবি, বড় রোমান্টিক । তিনি প্যানপ্যানানি বলে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন একে, তবু, আমি তা বলছি, আর আমার এই বক্তব্যকে সমর্থন করতে ্গিয়ে এসে সাক্ষ্য দেবে তাঁরই কয়েকটি কবিতার পংক্তি :-
সে শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ
দোলো লাশ নামাবার জন্য আছি আমি ।
( বিজ্ঞানসন্মত কীর্তি ১৯ শ্রাবণ ১৩৯২ )
আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচবো সকলে তুর্কি গাঁজাভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নমে যাক ।
( শিল্পোন্নয়ন ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে ।
( ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ ২২ শ্রাবণ ১৩৯২ )
কী রকম জ্বলে ওঠো দেখতে চেয়েছি
শাদা ত্বক এক লহমায় পুড়ে কালো
চোখ থেকে চাউনি উধাও জানুদেশ
থির থির কেঁপে ছিটকে ঘাসের ওপরে
পড়ে তুমি বারকয় নড়েচড়ে স্হির
শেষবার তারপর ঝুঁকে চুমু খাবো ।
( উৎপাদন পদ্ধতি ২১ শ্রাবণ ১৩৯২ )
দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি
বলবে, ‘আমাকে যেতে দিন’।
( বাজারিনী ২৮ আষাঢ় ১৩৯২ )
সাক্ষ্যপ্রমাণ থাক, দিতে গেলে আরও দেয়া যাবে বিস্তর, মলয় কী চাইছেন আর শেষ পর্যন্ত কী করতে গিয়ে কী করছেন, সেটা থাক । আমি শুরু করেছিলাম ‘মলয় রায়চৌধুরী কে?’ এই নিরীহ প্রশ্ন সামনে রেখে ; ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ পড়ে, যত সংশয় মনে আসুক, আমি তবু আবিষ্কার করি, মলয়, এই বাংলা ভাষারই আবহমান ঐতিহ্যের পথ ধরে ক্রম অগ্রসরমান এক উজ্জবল কবি, যাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা ধনী হচ্ছে, যিনি ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ লিখে সকল স্ববিরোধিতার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হা থেকে নিজেকে উদ্ধার করেন শেষ পর্যন্ত :-
আজকে শুক্কুরবার । মাইনে পেয়েচি । বোধায় শরৎকালের পুন্নিমে ।
পাতলা মেঘের মধ্যে জ্যোসনা খেলছে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাৎ কুচকুচে কালো নেড়িকুকুরের দল
ঘেউঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
কেউ তো বিশ্বাস করবে না ! ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতোকাল ।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন !
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করেচি বুঝি ।
যা কইনি সেকথা বলেচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
কেন এই মাইনে পাওয়া ? কেন গান ! কেন তাড়ি ?
আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শুঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
( বজ্রমূর্খের তর্ক ২৭ আষাঢ় ১৩৯২ )
মলয় টের পান, প্রশ্ন করেন নিজেকেই, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নিজেই, ‘আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতে।’ ওইখানেই মলয়ের সার্থকতা, তা তিনি যতই শিল্পের বিরুদ্ধে চিচিচকার করুন । ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামে কোনও সংকলন যদি কেউ করেন, তাহলে ‘বজ্রমূর্খের তর্ক’ তাতে অবশ্যই সংকলিত হওয়া উচিত । না হলে বুঝব, ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা’ নামকরণ বিফলে গেল, অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ওই সংকলনটি ।
[ হাওয়া৪৯ এপ্রিল ২০০১ সংখ্যা থেকে নেয়া ]
No comments:
Post a Comment