মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জয়িতা ভট্টাচার্য
মলয় : তুই তো এর আগে একটা ইনটারভিউ নিয়েছিলিস ?
জয়িতা : তাতে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়নি ।
মলয় : আচ্ছা । কী প্রশ্ন ?
জয়িতা : মামলা জেতার পর তুমি নাকি লিখেছিলে হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । তারপর বেশ কয়েক বছর সাহিত্যের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল না । সত্য ঘটনা জানতে চাই ।
মলয়: না আমি অমন কিছুই লিখিনি । কোথায়ই বা লিখবো ? মামলার সময়ে কলকাতায় দুবেলা খাওয়া জুটতো না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । কেস জেতার পর চাকরিটা ফিরে পাই । কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট নষ্ট করা আর পোড়ানোর চাকরি আর করতে চাইছিলুম না । একে তো পচা নোটের ঢিবির মাঝে বসে-বসে শরীর খারাপ হবার যোগাড়, তার ওপর ভীষণ রিস্কি। বিপদের ব্যাপারটা লিখেছি আমার ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসে । অন্য চাকরি খুঁজছিলুম আর অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের ট্যুর করার চাকরি পেলুম লখনউতে। পরে ওটা নাবার্ডে মিশে যায় । প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হলো গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে--- চাষি, জেলে, কুমোর, কামার, হস্তশিল্পী, তাঁতি, হর্টিকালচার, পশুপালন, জলসেচ ইত্যাদি--- আমি তার আগে কিছুই জানতুম না । লেখার জগত থেকে বেরিয়ে একেবারে আলাদা জগতে পৌঁছে গেলুম । আক্রান্ত হলুম যাকে বলে রাইটার্স ব্লকে । আর এতো ট্যুর করতে হতো যে ঘোরাঘুরির একটা আলাদা আনন্দে মজে থাকতুম । আবার লেখা আরম্ভ করি পূর্ব পাকিস্তানের মাহমুদ কামাল আর মীজানুর রহমানের অবিরাম অনুরোধে। কৌরবের কমল চক্রবর্তীও চাপ দিতে থাকে ।
জয়িতা : তাহলে, তুমি যখন কলকাতায় ছিলে না তখন তোমার বিরুদ্ধে কেন প্রচার চালাতো তোমার এক সময়ের হাংরি সহযাত্রীরা ?
মলয় : অলোক গোস্বামীর ‘মেমারি লোকাল’ বইটা পড়লে জানতে পারবি । শৈলেশ্বর ঘোষ আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ওর চেলাদের বোঝাচ্ছিল যে হাংরি মামলাটা ওর ‘তিন বিধবা’ কবিতার জন্য হয়েছিল । অথচ মামলাটা হয়েছিল আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার কারণে ; জেল-জরিমানা আমারই হয়েছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষরা আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হবার দরুন অপরাধবোধে ভুগতো । উত্তম দাশ আমার লখনউয়ের বাসায় এসে মামলার কাগজপত্র নিয়ে গিয়ে ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় লেখার ফলে সব ফাঁস হয়ে যায় । ওরাও আমাকে গালমন্দ করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ওরা মারা গেছে কিন্তু ওদের কুচুটে চেলারা আমাকে গালমন্দ করে চলেছে । শৈলেশ্বরের চেলারা সুভাষকেও মারধর করেছিল । সৌভাগ্যবশত আমি চেলার দল গড়তে পারিনি। মরব আর হাপিশ হয়ে যাবো । ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ নামে একটি কবিতা সঙ্কলন বার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯৩৮ সালে। কিন্তু চার দিক থেকে এত নিন্দে হল এই সঙ্কলনের যে, রবীন্দ্রনাথ বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন। দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করলেন অনেক আশা করে, কিন্তু ছাপা গেল না তাও। খোদ রবীন্দ্রনাথকেই এরকম প্রচুর নিন্দে আর আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে ।
জয়িতা :নব্বই ও শূন্য দশকে লিখতে আসা লিখিয়েরা অনেকেই বাস্তবিক তোমার বিশাল লেখার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অজ্ঞ । যদিও বা নামটা শুনেছে, "হাংরি" কবি হিসেবে জানে, কিন্তু সেই হাংরি আন্দোলন বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলেও সেটা মাথায় দেয় না গায়ে মাখে কিছু জানে না।
মলয় : আমি একাকীত্ব ভালোবাসি । প্রথমত, কলকাতায় ফেরার পর, আমি কলকাতার আর মফসসলের সাহিত্যসভা, কবিতাপাঠ, কবিদের বাড়িতে আড্ডা, কফিহাউসে যাতায়াত ইত্যাদি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলুম বলে ওনারা আমার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত নন । দ্বিতীয়ত, আমার বইপত্র বইবাজারে পাওয়া যায় না। আসলে প্রকাশক পাই না । গাঙচিলের অধীর বিশ্বাস একটা প্রবন্ধ সংকলন বের করার পর বললেন, “আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহ’র মতন বিক্রি হবে না। কেন ছাপবো আপনার বই ?” দে’জ আমার বই বের করতে চায়নি কেননা ওনাদের কমিটিতে যাঁরা ছিলেন বা আছেন, তাঁরা আমার নাম অ্যাপ্রুভ করেন না । আমার বই যাঁরা প্রকাশ করেছেন তাঁরা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ; তাঁদের নেটওয়র্ক তেমন ভালো নয় । ইনটারনেটে আমার প্রচুর লেখা রয়েছে ; সেগুলো নিয়ে বই করলে গোটা পঞ্চাশেক বই হয়ে যাবে । প্রতিভাস বলেছে আমার বই একে একে প্রকাশ করবে কিন্তু কবে করবে জানি না । হাংরি আন্দোলন নিয়ে এখন বেশ কয়েকটা বই আছে-- যারা আগ্রহী তারা ঠিকই যোগাড় করে পড়ে । হাংরি নিয়ে গবেষণাও তো হচ্ছে বিদেশের আর পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ।
জয়িতা : "ক্ষুধার্ত আন্দোলনের" একেবারে গোড়ার কথা যদি একটু বলো এবং কোন ঘটনা ও পরিস্থিতিতে এই ভাবনার জন্ম সেটাও একটু বলো। :প্রসঙ্গত এটা মনে হলো "ক্ষুধার্ত " শব্দটির পরিবর্তে "হাংরি" ,যা কিনা সংকরায়িত একটি শব্দ এটি কেন ব্যবহার করতে হলো। সেটা কী আন্তর্জাতিকতা আনার জন্য?
মলয় : গোড়ার কথা তো বহুবার লিখেছি নেটে আর প্রিন্ট ম্যাগাজিনে । উইকিপেডিয়ায় বাংলাদেশের কোনো সম্পাদক যা লিখেছেন সেটা পড়াচ্ছি, তাহলে আর নিজের ঢোল পেটাবার প্রসঙ্গ উঠবে না । “বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে ভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেয়া তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি । আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তারা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ।”
জয়িতা : আরেকটু বিশদ করো।
মলয় : আবার উইকির হাংরি প্রজন্মের পাতাটাই পড়াই, এটা সেকেণ্ড প্যারা, “মলয় রায়চৌধুরী হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে , অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তিনি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন । তাত্ত্বিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । সেকারণে মলয় রায়চৌধুরীকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে মনে করা হয় । হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স।তারা বললেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত ।" তারা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্থানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক ননগদনতন্ত্রের আগেকার প্রাক-ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষ্যণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।”
জয়িতা :ভাবগত কল্পনার জগত ও আত্মোপলব্ধি নয় সরাসরি জৈবিক তাড়না, জীবন যন্ত্রণার প্রতি স্তরের অভিব্যক্তি কে হুবুহু তোমরা তুলে ধরতে চেয়েছ, ধ্বনি ও শব্দ পরিশিলীত ও আরোপিত না করে, একেবারে নগ্ন এই উপস্থাপনার পেছনে হাংরি ফিলোসফির কথা শুনতে চাই ।
মলয় : আমার ছোটোবেলা কেটেছে ইমলিতলা নামে পাটনা শহরের এক বস্তিতে, যে-পাড়ায় থাকতো বিহারি অন্ত্যজ আর অত্যন্ত গরিব মুসলমানরা, যারা একটা উৎসবে পরা পোশাক পরের উৎসবে পালটাতো । তাদের কাজ ছিল চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, পিম্পগিরি, মেয়েদের বেশ্যাগিরি ইত্যাদি । পাড়াটায় নিষিদ্ধ বলে কিছু ছিল না যার দরুন আমি মধ্যবিত্ত বাঙালি মূল্যবোধের বাইরে গড়ে উঠেছি আর তাই ওই জীবন আর বাকজগত আপনা থেকে এসেছে আমার লেখালিখিতে । ইমলিতলার বাড়িতে একটা কুয়ো ছিল আর পাড়ার বউরা তাকে ঘিরে যে গানগুলো গাইতো তাকে বাঙালিরা বলতো অশ্লীল আর নোংরা, ওই যাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন গা রি রি করে, সেরকম । পাড়ার প্রভাবে দাদা খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে বাবা ওনাকে কলকাতায় সিটি কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা যে যার জীবন থেকে লেখার মাল-মশলা এনেছে ; তুই শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, অবনী ধর, দেবী রায়, সুবিমল বসাক প্রমুখকে পড়লেই টের পাবি যে দর্শনটা প্রত্যেকের জীবন থেকে পাওয়া ।
জয়িতা : যে কোনো আন্দোলন তার রেশ রেখে যায় ভবিষ্যতের কাছে তাই কোনো আন্দোলনকে ব্যর্থ বলা যায় না বিশেষত হাংরি আন্দোলনকে । কিন্তু দুঃখের বিষয়ে প্রথম পর্বের হাংরি পত্রিকাগুলি কেন সঠিকভাবে সংরক্ষণের কথা কেউ ভাবলেন না। উল্লেখযোগ্য পত্রিকা যেমন তোমার "জেব্রা ", সুবিমল বসাকের "প্রতিদ্বন্দ্বী " ,ত্রিদিব মিত্র র"উন্মার্গ", কেন হারিয়ে গেল দেবী রায়ের "চিহ্ন"অথবা প্রদীপ চৌধুরী র "ফুঃ", আলো মিত্রর ‘দি ওয়েস্ট পেপার’। কেন এই বিস্মরণ ?
মলয় : “জেব্রা” কেবল দুটো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ; সম্প্রতি মুর্শিদ ‘অখণ্ড জেব্রা’ প্রকাশ করেছে। প্রদীপ চৌধুরী মৃত্যুর আগে পর্যন্ত “ফুঃ” প্রকাশ করেছে, তবে মামলার পরে প্রদীপ ওটাকে ফরাসী আর ইংরেজিভাষী পত্রিকায় পালটে ফ্যালে---ফ্রান্সে ও বেশি পরিচিত ছিল । অন্য পত্রিকাগুলো সমীরণ মোদক সংগ্রহ করেছে কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছে না । সম্পাদকরা কেউই ভাবেনি যে এককালে হাংরি আন্দোলন খ্যাতি পাবে আর তাদের পত্রিকার চাহিদা হবে । বুলেটিনগুলোও পাওয়া যায় না --- মামলার সময়ে ভয়ে অনেকে ফেলে দিয়েছে সেগুলো । মুর্শিদাবাদের এবাদুল হক বেশ কয়েকটা বুলেটিন সংগ্রহ করে বই বের করেছিলেন ।
জয়িতা :কলকাতার প্রতি তোমার তীব্র অভিমান যথাযথ। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্রমণ ছাড়াও হাংরিয়ানদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়। এই বিষয়ে নানা গসিপ,নানা মত। এই মতবিরোধের ফলশ্রুতি আন্দোলনে ভাঙন সম্পর্কে একেবারে স্পষ্ট কথা শুনতে আগ্রহী।
মলয় : এই প্রশ্নের উত্তর অজিত রায়ের প্রবন্ধ থেকে দিই, “মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।” কলকাতার প্রতি অভিমান বলতে তুই যা বোঝাতে চাইছিস তা রয়েছে প্রতিটি সাবর্ণ চৌধুরীর রক্তে, কেননা পরিবারটা বাধ্য হয়েছিল কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ইজারা কোম্পানিকে লিখে দিতে।
জয়িতা : হাংরিদের পরস্পরের মতবিরোধ তাদের রচনার চেয়ে বেশি চর্চিত । এই বিষয়ে কী বলবে? ১৯৬৫ র পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও পরিবর্তিত রূপে হাংরিয়ালিস্ট কিছু পত্রিকা বেরোতে শুরু করে যেমন,অরুনেশ ঘোষের ‘জিরাফ’, আলোক গোস্বামী র "কনসেনট্রেশন ক্যাম্প", উত্তরবঙ্গের পত্রিকা ধৃতরাষ্ট্র, রোবট। এই পত্রিকাগুলি র সঙ্গে তোমার যোগাযোগ কতটা এবং তোমার মতামত কি। পত্রিকাগুলি কতটা হাংরি ভাবাদর্শ অনুকরণে নির্মিত।
মলয় : মতবিরোধ ডাডাবাদী, সুররিয়ালিস্ট, বিটনিক এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতেও ছিল। কৃত্তিবাস থেকে আনন্দ বাগচী আর দীপক মজুমদারকে ক্লিক করে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল । এতোগুলো মানুষ জড়ো হলে মতবিরোধ হবেই । হাংরি আন্দোলনে যারা সরকারি সাক্ষী হয়েছিল তারা আমার বিরুদ্ধে লিখতো । সুভাষ ঘোষকে মারধর করা হলো । উত্তরবঙ্গে অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, মনোজ রাউত, সমীরণ ঘোষ, জীবতোষ দাশ, দেবজ্যোতি রায় প্রমুখ আবার জাগিয়ে তুলছিলেন আন্দোলনটা কিন্তু শৈলেশ্বর লোক পাঠিয়ে তাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । অরুণেশ ঘোষ যখন উত্তম দাশের মহাদিগন্ত পড়ে সবকিছু জানতে পারলো তখন নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিল । আমি উত্তরবঙ্গে সেই সময় যাইনি, তাই ওনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি । ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ পত্রিকায় সম্ভবত লিখেছিলুম । অলোক গোস্বামীকে বাড়ির গেট থেকে শৈলেশ্বর ঘোষ তাড়িয়ে দেবার পর ও বন্ধ করে দিয়েছিল পত্রিকাটা। ওদের লেখাপত্র ভালোই এগোচ্ছিল । শৈলেশ্বর ঘোষ কেন যে অমন কুচুটে ছিল কে জানে, কেননা কবিতা যা লিখতো তা এক কথায় আউটস্ট্যাণ্ডিং ।
জয়িতা :জানতে চাই আলো মিত্র র হাংরি ইংলিশ জার্নাল " দি ওয়েস্ট পেপার "সম্পর্কে।
মলয় : আলো ছিল ত্রিদিব মিত্রের প্রেমিকা । সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক বোল্ড । আলো চাকরি করতো বলে ইংরেজি পত্রিকাটা বের করার সুবিধা হয়ে গিয়েছিল । ওদের দুজনকে বাদ দিয়ে সুভাষ-শৈলেশ্বর-বাসুদেব ‘ক্ষুধার্ত’ আরম্ভ করার পর ওরা বিরক্ত হয়ে লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিল । ‘দি ওয়েস্ট পেপার’ পত্রিকার কারণে আমরা বিদেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পেরেছিলুম । আলো আর ত্রিদিব এখন হাওড়ায় নিজেদের বাড়ি তৈরি করে সেখানেই থাকে । আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই । সুবিমল বসাক বলছিল ফোন করলেও যৎসামান্য কথা বলে রেখে দ্যায় । নন্দিনী ধর নামে একজন লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনে শুধু একজন মহিলা ছিলেন কেন ! উনি ওনার ঠাকুমা-দিদিমার বয়সী কবিদের জিগ্যেস করলেই পারতেন যে তাঁরা কেউ কেন হাংরি আন্দোলনে যোগ দেননি ।
জয়িতা :হাংরি আন্দোলন বিদেশি প্রভাবিত এমন শোনো যায়। বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার তখনই প্রকাশিত হয়েছিল । র্যাঁবো, ভেরলেন, বোদলেয়ারের জীবনযাপন কি আকৃষ্ট করেছিল তোমাদের ? প্রসঙ্গত অ্যালেন গিনসবার্গ এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় কীভাবে এবং তাঁর কতটা অবদান এই আন্দোলনে।
মলয় : উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য বিদেশি প্রভাব ছাড়া আরম্ভ হতো না । গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক সবই তো বিদেশ থেকে এসেছে । বঙ্কিম আর মধুসূদন ইংরেজিতেই লেখা আরম্ভ করেছিলেন । বোদলেয়ার, র্যাঁবো, ভেরলেন প্রমুখকে আমি পড়েছি ইংরেজিতে । আগেই তো বললুম, আমার জীবন ইমলিতলা পাড়ার দ্বারা প্রভাবিত । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর গিন্সবার্গ আমাদের পাটনার বাড়িতে এসেছিল ১৯৬৩ সালে । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির পত্রিকায় আমাদের কবিতা আর মামলার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর ফেরলিংঘেট্টি আমাকে ‘হাউল’ আর ‘ক্যাডিশ’ পাঠিয়েছিল । যে লেখকরা প্রভাবের কথা বলেন তাঁরা নিজেদের লেখার কাঠামো কোথা থেকে এলো তা ভাবেন না । এমনকী সনেট, ভিলানেল, লিমেরিক লেখকরাও অমন আরোপ করেন ।
জয়িতা :ব্যক্তিগতভাবে তোমার উপন্যাস আমার অনেক বেশি প্রিয়। " Ahead of time". প্রথম উপন্যাস কবে এবং কোন ভাবনা থেকে লেখা ?
মলয় : আমার প্রথম দিকের সব উপন্যাসই জীবনের ঘটনা থেকে নেয়া । পরে নানা জেনারের উপন্যাস, যেমন ইরটিক, ডিটেকটিভ ইত্যাদি লেখার সময়ে ঘটনা তৈরি করেছি । অবশ্য তাতেও নিজের জীবনের ঘটনা মিশিয়েছি। প্রথম উপন্যাস লিখেছিলুম নব্বুই দশকের প্রথম দিকে, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, নোট নষ্ট করা আর পোড়ানোর পৃষ্ঠপটে, কর্মী বন্ধু-বন্ধুনীদের নিয়ে । দাদা “হাওয়া৪৯” পত্রিকা আরম্ভ করে একটা উপন্যাস লিখতে বলেন, তখন লিখি ; ওটা অনেকবার রিপ্রিন্ট হয়েছে ।
জয়িতা : প্রবন্ধকার হিসেবে তোমার কথা পাঠক কম জানে। প্রবন্ধকার মলয় রায়চৌধুরী ও ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরীর জনপ্রিয়তা তেমন নেই কেন ?
মলয় : প্রকাশক পাই না তো লোকে জানবে কেমন করে ? নামকরা প্রকাশক না পেলে পাঠকদের কাছে পৌঁছোনো যায় না । প্রতিভাস যে তিনটে বই বের করেছে, সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গেছে বলে শুনেছি । প্রতিভাসও তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বহু দূরে । কবিতা জায়গা পায় লিটল ম্যাগাজিনে । উপন্যাস পায় না । আর জনপ্রিয় হতে গেলে পাল্প ফিকশান লিখতে হবে, যা আমি পারি না ।
জয়িতা :তুমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী নও ; প্রতিষ্ঠান তোমার বিরোধী কেন ? তোমার লেখক-সত্ত্বা কলকাতার সাহিত্য-সমাজ দীর্ঘদিন অবদমিত রাখার প্রচেষ্টা করেছে । কেন ? কিসের ভয়?
মলয় : নিছক সাহিত্যিক রাজনীতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ; যেমন গানের রাজনীতি দেবব্রত বিশ্বাসকে চেপে দেবার চেষ্টা করেছিল, বড়ো মাপের কাপ্তান আর মাস্তানরা তা করেছিলেন । আনন্দবাজার পত্রিকা তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী । অধ্যাপক অভীক মজুমদার লিখেছেন, “‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে (১৯৬৬) মধ্যচৈত্রে। কবিতার সংখ্যা ৭১। ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত, প্রচলিত সমাজ-সংসার-সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধ আর ভণ্ডামিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার গনগনে গর্জন। এক ছন্নছাড়া, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, উদ্ধত তরুণের সঙ্গে কাব্যসংলাপে সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, ওই কবিতা থেকে আর মন সরাতে পারলাম কই?” আনন্দবাজার যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে চালাতে চায়, তাহলে আমাকে ওরা ওদের বিরোধী বলেই মনে করবে । সুনীলের এই বইটার কবিতাগুলো হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে লেখা --- হাংরিদের টক্কর দেবার চেষ্টায় ।
জয়িতা : হাংরিদের প্রভাব সম্পর্কে বলো ।
মলয় : সুনীল নিজেই হাংরিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যৌনতার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । উনি লিখলেন, “শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি/মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি।” হাংরি আন্দোলনে পুলিশের মামলা দায়েরের পরেই কৃত্তিবাস একটা যৌন কবিতা সংখ্যা বের করেছিল ; সেটা যে হাংরিদের প্রভাবে, সেকথা প্রতিষ্ঠানের আলোচকরা চেপে যায়। পরবর্তীকালে মহিলা কবিরাও প্রভাবিত হয়েছেন । যেমন চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “যার কোন উত্থানপতন নেই, আমি সেই /ছাতাপড়া অঙ্গটিকে গড় না করতেই পারি/যদ্যপি সে আমার স্বামীর।” সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কাটাকুটি খেলতে গিয়ে বরাবর ভুল ঘরে ভুল গোল্লাগুলি বসিয়েছ । দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছ নিজের দুই ঠোঁট।জ্যান্ত শুক্রবীজগুলি মুখে শুষে নাও আজ আর থুৎকারে থুৎকারে ছুঁড়ে ফেলে দাও।” সুতপা সেনগুপ্ত লিখেছেন “তোমার নরম ভারি শরীরের নীচে শুয়ে/ফিরে আসছে আমারও পুরনো/খেলা ও খেলুড়িপনা, পুরুষ ছোঁয়ার মজা/শঙখ লাগা অমৃত ছোবল/তুমিও কী অপরূপ শিখে নিচ্ছ ভাঙাগড়া/ঠোঁটে কামড়ে বুকে পিষে ফেলে/বলেছ রোয়াব নিয়ে, আমিই শাসন করব/কিছুই বোঝ না, বাচ্চা ছেলে।” রাজশ্রী চক্রবর্তী লিখেছেন, “
ডিম পাঁউরুটির মত জীবনে, তুমি এলে / একটি হলুদ রঙের কলা / নিটোল আকার দেখে, বিশ্বাস করো, / ভারি খিদে পায়।” অনুরাধা মহাপাত্র লিখেছেন, “ সঙ্গমে ভিন্ন কোন আলো নেই- প্রকৃতি অথবা ঈশ্বরের/উপবাস ও পূজার কোন চিদাকাশ নেই/ আত্মত্যাগ, আত্মহত্যা উভয়ই সমান/
প্রেমিকের মাথা আকাশে তুললেও তবু মুখ,/ নেমে আসে অন্ধ পুকুরে।” শবরী ঘোষ লিখেছেন, “এক্ষুণি একজন পুরুষ চাই আমার/ রাত্রি যেভাবে সূর্যের সঙ্গে মেলে/ সেরকম সম্পূর্ণ মিলনের জন্য চাই/ তবু প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত/ ঠিক নিরানব্বই জন হিজড়ের সঙ্গেই শুধু/ ঘুরে ফিরে দেখা হয়ে যায় আমার !/ হায় হিজড়েরা সঙ্গম জানে না।/ এখনই একজন যথার্থ পুরুষ চাই আমার/
আমি তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছি !”
জয়িতা : আর গদ্যে ?
মলয় : আমি প্রবুদ্ধ ঘোষের লেখা থেকে তোকে শোনাচ্ছি, তাহলে টের পাবি : “আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে-- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের এই আন্দোলনের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তা’লে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবেনা বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্কোর্স তৈরি করেছে। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। বুঝে নেওয়া দরকার হাংরি-প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনের নিভন্ত আগুন এবং সেই আগুনে শাসক-রাষ্ট্রের ক্রমাগত শান্তির জল ঢেলে যাওয়া; অথচ সেই নিভু আগুনের থেকে ফিনিক্সের জেগে ওঠা। নিওফ্যাসিজম্ বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভাবে দখল চালানো তো বটেই, তার সাথেই থাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আগ্রাসন। আর, পুঁজিবাদ নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তার উৎপাদন-পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, তেমনি সাহিত্যকেও যেহেতু পুঁজিবাদ পণ্য হিসেবেই দেখে, তাই তার উৎপাদন-কৌশলেও নতুন ফর্মুলা নিয়ে আসতে চায়। আর, সেই ফর্ম্যুলার অন্যতম হল, একদা যা ছিল প্রান্তিক, যা ছিল শাসকের ‘ডিস্কোর্সের’ বাইরে, তাকেই কেন্দ্রের দিকে ঢুকিয়ে দেওয়া, শাসকের ‘ডিস্কোর্সে’ তাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া। হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের সময় যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি তাদের ‘প্রান্তিক’ করে রেখেছিল, পরে সময়-সুযোগ বুঝে তাকেই প্রতিষ্ঠানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে নেয়। অ্যাণ্টি-কাল্চার ও কি বাজার-কাল্চার এ ঢুকে পড়ে? যখন তার প্রভাব এড়ানো যায়না আর, যখন ছাই হয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে ওঠে ফের তার ভাষা-সংস্কৃতি তখন বাজার নতুন ভাবে নামে? প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় বিগত সব প্রত্যাঘাতগুলো? একদা ‘ওরা অশ্লীল’ বলে চেঁচানো সাহিত্যিকেরাও লিখে ফেলেন হাংরি-দের কথা। বাণিজ্যিক ছবি হয়, সেখানে হাংরি-লেখক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রুফ-চেক্ করাতে মুখিয়ে থাকে। এ-ও তো এক সংস্কৃতি। প্রতিস্পর্ধাকে নমনীয় করে, দোষারোপ গুলোকে বড়ো করে প্রতিস্পর্ধী-সংস্কৃতর ‘সংস্কৃতি’-কে ভুলিয়ে দেওয়া। কারণগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া, প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতকে গুলিয়ে দেওয়া। ক্ষুধার্ত কবিরা দেখেছে প্রতিশ্রুতির গলিত শব, দেখেছে একের পর এক মিছিল ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার হয়ে যায়। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় লেখকের নয়। হাংরি লেখকেরা তাঁদের লেখালেখিতে জোর দিচ্ছেন পাঠের ওপর। অর্থাৎ, লেখকের ভাষাগত চাতুর্য, শব্দলালিত্য আর বিচার্য নয় বরং বিচার্য পাঠবস্তুটি। ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে হাংরি-দের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রানিং কমেণ্টারির মতোন অর্থাৎ, চলন্ত ধারাভাষ্যের মতো সাহিত্য। যা ঘটছে, যা অভিজ্ঞতা সেটাকেই গল্প বা কবিতায় তুলে আনা। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোসহ বহু প্রাচীনপন্থীর মতামত এই ছিল যে, কবিতা বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অথচ, হাংরি-দের কবিতা পড়লে কিন্তু তার উল্টোটাই মনে হয়। বড়ো বেশিই যেন বাস্তবের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে পাঠককে, সঙ্গে নিজেরাও। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে হইহই করে লেখক নিজেকেও এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লেখার মধ্যেই। এর ফলে কবিতার চিরাচরিত সম্বোধক-সম্বোধিত বা অ্যাড্রেসার-অ্যাড্রেসি নিয়ম ধাক্কা খাচ্ছে। সাহিত্য আর ততটা দূর থেকে বসে, নিরাপদে লেখার বিষয় থাকছে না; যখন পৃথিবী পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে তখন লেখাও পুড়তে বাধ্য। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। হাংরি-দের লেখায় আত্ম-কে আবিষ্কার, জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা অন্য কোথাও, তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো। ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখাকে বিশ্লেষণ না করেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে তাকেই আত্তীকরণ করে বাজারজাত পণ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা।”
জয়িতা : তোমার নতুন পর্যায়ের কবিতার মানুষী ‘অবন্তিকা’ একেবারে জৈবিক ও মাটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। নেই পূর্বতন কবিদের মত নেবুলাস কল্পনা ও সৌন্দর্য পূজা। এই ব্যাপারে একটু জানতে চাইব।
মলয় : না, অবন্তিকা বনলতা সেন, নীরা, সুপর্ণা নয় । অবন্তিকা ভারতীয় পুঁজিবাদের সৃষ্টি, যাকে তুই সর্বত্র দেখতে পাবি । টিভির পর্দায়, গ্লসি পত্রিকায়, পেজ থ্রি সমাগমে, করণ জোহর-ফারহা খান টাইপের সিনেমায়, মল-মালটিপ্লেক্সে, ট্রেন দুর্ঘটনার মাংসপিণ্ডে, রুজি বাঁচাবার ধান্দায় জরায়ু কাটিয়ে ফেলা মেয়ে শ্রমিকে, সন্ধ্যার যৌনকর্মী পাড়ায়, রেভ পার্টিতে, প্লাস্টিক সার্জারির ডাক্তারের চেম্বারে, জামাই ষষ্ঠীর বাজারে, সংবাদপত্র দপতরে, কফিহাউসে, অ্যাকেডেমি-নন্দন চত্তরে ।
No comments:
Post a Comment