স্মরণ : আমার উৎপল-আবিষ্কার, উৎপল-ভাবনা
০৯ অক্টোবর ২০১৫, ১৩:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৫, ১২:৫৪
অঞ্জন আচার্য
‘মন মানে না বৃষ্টি হলো এত/সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে/আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল/স্পর্শ করি জলের অধিকারে।’ গানটা শুনে বেশ আপ্লুত হই আমি। সাদ্দুর মুখেই জানতে পারি, এটি একটি কবিতা, কবি উৎপলকুমার বসুর। সে সময় না জানলেও আজ জানি, সেটা উৎপলের ‘নবধারাজলে’ কবিতার প্রথম অংশ।
সেই ভালো লাগা থাকে আমার অনেক দিন। এরপর দুর্গাবাড়ির বৈকালিক লাইব্রেরিতে বসে উৎপলকুমারের কবিতার ওপর একটা আলোচনা পড়ি ‘দেশ’ পত্রিকায়। লিখেছিলেন কবি জয় গোস্বামী। সেই অনন্যসাধারণ আলোচনাটি দারুণভাবে নাড়া দেয় আমাকে। একে একে আবিষ্কার করি উৎপল বসুকে।
সেই লেখার একটি কবিতা এখনো আমি মনে মনে পাঠ করি : ‘বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা—বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।’ কবিতাটি উৎপলকুমারের ‘সলমা-জরির কাজ’ বইয়ের সপ্তম ক্রম কবিতা।
ময়মনসিংহের মতো ছোট্ট শহরে বসে উৎপলকুমার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা সহজ ছিল না। তবে মনের ভেতর উৎপল ছিল। তাঁর কবিতা ছিল। আমায় ভাবাত। ২০০৫ সালে ঢাকায় পুরোপুরি চলে আসার পর সে কী সংগ্রামী জীবন আমার! চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে মফস্বলের ঘ্রাণে ভরা এই আমি তখন কংক্রিটের নগরীর চাপায় পিষ্টপ্রায়। তবে লেখার ইচ্ছেটা হাত ফসকে যায়নি কখনো। ঢাকায় এসে নতুন করে অনেককেই পাই সাহিত্য-বন্ধু হিসেবে।
এদের অনেকেই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে লেখায়, পড়ায়, চিন্তা-চেতনায়। আমি তাদের সঙ্গে দৌড়ে পারি না। তবে বুকের ভেতর লালিত স্বপ্নের জোরেই নিজেকে জ্যামিতিক হারে খাটাতে থাকি। উৎপলকুমার তখনও ভেতরে বুদবুদ দিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। পড়া হয় তাঁর অনেক কবিতা। জানা হয়ে যায় তাঁকে নিয়ে অনেক জানা-অজানা কথা।
এবার একটু ইতিহাসের কাছ থেকে ধার নিই কিছু তথ্য। সময়টা ১৯৬১, বাংলা সাহিত্যের অবস্থা প্রায় অনেকটাই স্থবির। সেই স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে আন্দোলনের ডাক দেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়সহ আরো কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক।
ইশতেহারগুলোর মধ্যে ছিল কবিতা-বিষয়ক প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেম্বর ১৯৬১), মুক্তি-বিষয়ক ১৪-বিন্দু ইশতাহার (১৯৬২), রাজনীতি-বিষয়ক ইশতাহার (১৯৬৩)। যা পরিচিত ‘হাংরি মুভমেন্ট’ বা ‘হাংরি আন্দোলন’ নামে। অনেকে যাকে বলেন ‘হাংরিয়ালিস্ট’, ‘ক্ষুধিত’, ‘ক্ষুৎকাতর’, ‘ক্ষুধার্ত আন্দোলন’।
‘আর্তি’ বা ‘কাতরতা’ শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারবে না বলে আন্দোলনকারীরা শেষতক গ্রহণ করেন ‘হাংরি’ শব্দটি।
আন্দোলনকারীরা ‘হাংরি’ শব্দটি সংগ্রহ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে। আর তাত্ত্বিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থটির দর্শন থেকে।
১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে সূত্রপাত হয় হাংরি আন্দোলনের। শুরুর দিকে আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক গভীর হলেও ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায়। নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
১৯৬২-৬৩ সালে এই হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফাল্গুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
এরপর ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা। সেগুলো হলো : সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ‘ফুঃ’, সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত ‘এষণা’, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি ‘দ্য ওয়েস্ট পেপার’।
সত্তর দশকের শেষ দিকে আন্দোলনটিকে পুনরায় জীবিত করার যখন অসফল প্রয়াস করা হয়েছিল, তখন অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন ‘জিরাফ’, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন ‘আর্তনাদ’; এবং অন্যান্যরা প্রকাশ করেন ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’, ‘ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ’, ‘রোবট’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’ ইত্যাদি পত্রিকা।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য ও সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়।
মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। মোকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু যোগমায়াদেবী কলেজের প্রভাষকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, বিশ্বভারতী থেকে রাসটিকেট হন প্রদীপ চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে বদলি করে দেওয়া হয় কলকাতার বাইরে, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান।
এ সময় অনেকে ভয়ে হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে চলে যান। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেস্টিগেটিং বোর্ড, যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারাল।
গ্রেপ্তারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ডভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পাণ্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল, তা আর তাঁরা ফেরত পাননি কোনো কবিই।
হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত পাটনা থেকে এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। কখনো বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তাঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতেহার লেখা ছাড়াও কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করতেন।
হ্যান্ডবিলের মতো বুলেটিনগুলো তাঁরা বিতরণ করতেন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদি জায়গায়। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এটিই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতো প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নিজেরাই, কেননা অধিকাংশ বুলেটিন সংগ্রাহকের পক্ষেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
উৎপলকুমারের মৃত্যুর পর (৩ অক্টোবর) মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখেন : ‘হাংরি বুলেটিনে কবিতা লেখার অপরাধে যোগমায়াদেবী কলেজের লেকচারারের চাকরি থেকে ১৯৬৪ সালে বরখাস্ত হয়েছিলেন উৎপলকুমার বসু।’ পরের দিন (৪ অক্টোবর) তিনি আরো লিখছেন : ‘হাংরি মামলায় উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে কেন যে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত জানা হলো না; উত্তরে ওনার নির্বাক গাম্ভীর্যকেও ডিকোড করতে পারিনি।’
এই রাজসাক্ষী দেওয়ার পর ১৯৬৫ সালে অভিমানাহত উৎপল বসবাস আরম্ভ করেন লন্ডনে গিয়ে। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বিয়ে করেন এবং কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নেন। সেখানে দীর্ঘ সময় কাটান তিনি। ১৯৭৭ সালে ২৩ জানুয়ারি বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীকে (মলয় রায়চৌধুরীর বড় ভাই) লেখা একটি চিঠি পেলাম কিছুদিন আগে। সেই চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, কী অস্থির ও ফেরারি জীবন পার করেছেন উৎপল বসু।
উৎপলকুমার বসু
২৩/১/১৯৭৭
লন্ডন
প্রিয় সমীর
তোমার চিঠি পেলাম। আরো অনেককে বাড়ির ব্যাপারে লিখেছি। তোমার কাছ থেকেই প্রথম আশাপ্রদ উত্তর পাওয়া গেল। তুমি অবিলম্বে তোমার বাঁশদ্রোণীর বাড়ির ঠিকানা আমাকে জানিও। সান্ত্বনার দিদি টালিগঞ্জে থাকেন। তিনি ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এসি বিদ্যুৎ কি না অবশ্যই জানিও।
আমরা লন্ডন থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বা মার্চ মাসে কলকাতায় পৌঁছব। প্রথম দু'এক দিন হয়তো সান্ত্বনার দিদির বাড়িতে কাটবে। তারপর থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের ঘরবাড়ির জিনিষপত্র জাহাজে কলকাতায় পৌঁছে যাবে আশা করা যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে এই সব জিনিস রওনা হচ্ছে। এখন তুমুল বেগে গোছানো এবং লিস্ট করা চলছে। বহুদিন এ দেশে থাকলাম... প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় প্রচুর জিনিসপত্র জমেছে। রাশীকৃত বই কাগজ হাঁড়ি-বাসন বাক্স-ট্রাঙ্কের জঙ্গলে বসে এই চিঠি লিখছি।
আজ এই পর্যন্ত। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হবে নিশ্চই।
ইতি
উৎপল
১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ থেকেই উৎপল অনন্য, অনুনকরণীয়৷ তাঁর কবিতার ডিকশন, আলো-আঁধারি ভাষা তাঁকে জীবনানন্দ-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে চিরস্মরণীয় করে রাখবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজের কবিতার ভাষাকে ক্রমাগত ভাঙচুর করতে করতে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক ম্যাজিক-উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছতে পিঠে এক ব্যাগ অতি-প্রাকৃতিক মন্তাজ ও মাথায় এক আকাশ নক্ষত্র প্রয়োজন।
তবুও তাঁর কবিতাকে ‘দুর্বোধ্য’ বলা যাবে না, বরং বলা যায় উৎপলকুমারের কবিতা এক আশ্চর্য ছায়াময়তা, রহস্য-ইশারায় গভীরভাবে ছুঁয়ে এসেছে বাংলা কবিতার পাঠককুলকে৷ ‘পুরী সিরিজ’ কিংবা ‘আবার পুরী সিরিজ’-এর বিখ্যাত ‘ট্রাভেল পোয়েট্রি’ বাংলা কবিতার পাঠককে প্রথম পরিচয় করায় অদ্ভুত এক ‘পোস্টমডার্ন কনশাসনেস’-এর সঙ্গে, যেখানে ভ্রাম্যমাণ বোহেমিয়ানা গিয়ে মেশে সমুদ্রের সীমাহীনতায়, ঢেউ, সিগারেট, বালি, সিগাল—সব ছুঁয়ে যেখানে মহাজীবনের করিডোরে হেঁটে চলে আমাদের পুরোনো হাসি, ভেসে যায় ছেঁড়া চিরকুটে লেখা কবেকার নাম৷
ভূতত্ত্ববিদ উৎপল ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবীতে, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ইস্তেফা দিয়েছেন কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে, ভাগ্যান্বেষণে চলে গিয়েছেন ইউরোপে, ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজেকে জড়িয়েছেন সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে। তাঁর কবিতায় আমরা তাই পাই এক ধরনের ব্যাপ্তি, যা সমাজ, কাঁটাতার, জাগতিক সবকিছু ছাড়িয়ে ছুঁয়ে নেয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সেই অনন্ত চলাচলের সেতুকে। যেখানে সত্যি বলতে কি, খুব কম কবিই এ পর্যন্ত পা রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
১৯৩৭ সালে কলকাতার ভবানীপুরে জন্ম উৎপলকুমার বসুর। ৫০’র দশকে যাত্রা শুরু তাঁর। ১৯৫৬ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘কৃত্তিবাস’ থেকে প্রকাশ করেন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কাব্যশৈলী, অভিব্যক্তি এবং কবিতার কাঠামো দিয়েই অচিরেই পাঠক মনে জায়গা করে নেন।
১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটতেই তাতে যোগ দেন তিনি,এবং তাঁর কবিতা রচনার ধারায় ঘটে বাঁকবদল। দুই দশক পর আশির দশকের দিকে কলকাতায় ফিরে আবার কবিতা লেখা শুরু করেন উৎপলকুমার। তাঁর সমসাময়িক, এমনকি তরুণতর কবিদের তুলনায় তাঁর কবিতা ছিল সম্পূর্ণ নূতন। নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তুস্বভাবের যথাযথ বর্ণনা তাঁর কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য। বস্তুর অভ্যন্তর সত্যের অভিমুখে কবিতাকে চালনা করেছেন উৎপল বসু। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবন-প্রকৃতি কোনো রহস্যভূমি রচনা না করেই তাঁর কবিতাতে মেলে ধরেন চলমান সমাজবাস্তবতা।
একাধিকবার এই সৈকতে এসে
বলেছি আমার মতো পুরুষকে তো কিছু
কলঙ্কের ভাগ তুমি দিতে পারো। হয়নি,
শোননি কেউ, শুধু বালিয়াড়ি ধসে
পড়েছে সাগরজলে।
স্তব্ধতা থেকে কোলাহলে
আবার যাত্রা শুরু, পাপ থেকে
পাপের স্খালনে। ঝাউবনে উড্ডীন
পতাকাবিদ্রোহ থেকে রঞ্জনরশ্মির অনলে—
চলেছি সকলে।
এই মদ কীভাবে করব পান—
বলে দাও। দাঁড়িয়ে জলের ধারে?
ছিঁড়ে-আনা এই ফুলগুলি
ঘুমন্ত খ্রিষ্টগাছে ফুটেছিল—
কীভাবে ভাসবে তারা মাতৃসমা জলে?
(কহবতীর নাচ)
বহুলব্যবহৃত শব্দগুলোকে উৎপলকুমার কবিতার শরীরে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যে, এর ফলে তৈরি হয়েছে বাক্যের নতুন মাত্রা। অনেকে অবশ্য বলেন তাঁর কবিতা 'আকারসর্বস্ব'। বর্তমান সময়ের মধ্যে ঢুকে বসে থাকা ছিল তার একটা স্বভাব, শব্দের পিঠে হাত বুলিয়ে বসে এনে একে একে তৈরি করেছেন নতুন মাত্রা। নতুনত্ব নিয়ে বেঁচে ছিলেন যতদিন তার চেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। তাঁর কবিতার কয়েকটি লাইন এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যাক :
গাছে উঠে বসে থাকি। ফল খাই। ব্যক্তিমানুষের দিকে
আঁটি ছুঁড়ে মারি। নীচে হাহাকার পড়ে যায়। বেশ লাগে।
মাঝে মাঝে বাউল সংগীত গাই। ওরা শোনে। বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে আসে। তাল দেয়। বোধহয় ছবিও তুলেছে। সেদিন
এক গবেষক বাণী চাইল। ভাবলাম বলি : আমার জীবনই
আমার বাণী। কিন্তু সম্ভবত এটি বলা হয়ে গেছে। অতএব
নিজস্ব ভঙ্গিতে, কিছুটা আপন মনে বিড় বিড় করি—
‘দেখেছি পাহাড়। দেখে জটিল হয়েছি।’ (সুখ-দুঃখের সাথী-১৫)
তাঁর পুরী সিরিজ (সন্ধ্যাভাষা প্রেস, ১৯৬৪), আবার পুরী সিরিজ (বিশ্ববাণী, ১৯৭৮), লোচনদাস কারিগর (প্রতিবিম্ব, ১৯৮২), খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন (প্রতিবিম্ব, ১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ কবিতা (প্রতিভাস, ১৯৯১), নরখাদক (দেশবাণী, ১৯৭০), ধূসর আতাগাছ (কৌরব, ১৯৯৪), সলমা-জরির কাজ (কবিতা পাক্ষিক, ১৯৯৫), অগ্রন্থিত কবিতা (কবিতাসংগ্রহ প্রথম সংস্করণ), কবিতা সংগ্রহ (দে’জ, ১৯৯৬), কহবতীর নাচ (প্রচ্ছায়া, ১৯৯৭), স্বনির্বাচিত কবিতা (মডেল, ১৯৯৮), উৎপলকুমার বসুর গল্প (প্রতিবিম্ব, ১৯৯৮), নাইট স্কুল (গান্ধার, ১৯৯৯), টুসু আমার চিন্তামণি (কবিতা পাক্ষিক, ২০০২), মীনযুদ্ধ (দাহপত্র, ২০০১), নতুন কবিতা (সৃষ্টি, ২০০২), প্রেমের কবিতা (পত্রলেখা, ২০০২), বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে (কবীর, ২০০৪), গদ্য সংগ্রহ-১ (নান্দীমুখ সংসদ, ২০০৫) তীর ও উদ্যান (কবিকথা, ২০০৬), সুখ-দুঃখের সাথী (সপ্তর্ষি, ২০০৬), কথাবার্তা (সপ্তর্ষি, ২০০৬) প্রভৃতি গ্রন্থ নানাভাবে প্রভাবিত করে পাঠক মনকে।
২০০৬ সালে ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন আনন্দ পুরস্কার। ২০১৪ সালে তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
বাংলার প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি, এই মাটি ও মানুষের প্রতি উৎপলকুমার কতখানি ব্যাকুল ছিলেন তা তাঁর ‘আমার কষ্টকথা, স্বপ্নকথা’ লেখাটি পড়লে স্পষ্ট অনুধাবন হয় :
“আমি যদিও কলকাতায় জন্মেছি, কিন্তু ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় আমার মাসি উত্তরবঙ্গের দিনহাটায় নিয়ে গিয়ে প্রতিপালন করেন। তাই আমার ছোটবেলার প্রথম অংশ কেটেছে ওই দিনহাটায়, কুচবিহারে। আমাদের এই দিনহাটা দেশবিভাগের সময় পূর্ব-পাকিস্তানে পড়বে, নাকি ভারতের সঙ্গে থাকবে, তা নিয়ে একটা চাপা আতঙ্ক ছিল। এটা যে কী ভয়ংকর জিনিস করে দিয়ে গেছে! এটা হচ্ছে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক রাজনীতির একটা কূটচাল; এবং আমরা সব সময়ই সাহেবদের কাছে মাথা নীচু করে আসছি। গান্ধীজি তো ১৫ আগস্টের স্বাধীনতার সময় পতাকা উত্তোলনে যোগদানই করেননি। তার আগের দিন পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে, কলকাতায় যেখানে-সেখানে দাঙ্গা! সে যে কী নৃশংস সময়! রাজনীতিবিদদের যা চরিত্র দেখেছি তাতে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা তলানিতে চলে গেছিল। স্বচক্ষে বা সামনাসামনি কোনো দাঙ্গা দেখিনি, তবে রাস্তায় ডেডবডি পড়ে আছে—এমন দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছি। নানা কারণে বাংলাদেশ নিয়ে আমি ভীষণ উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশ হলো আমার অতি প্রিয় স্বপ্ন-বিহ্বল দেশ। এর ভাষা, প্রকৃতি আমি যতটুকু দেখেছি তা অতি মনোমুঙ্কর। সে জন্য আমি দু'বছর আগে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন এয়ারে না গিয়ে বাসরুট বেছে নিয়েছিলাম। জানালার পাশে বসে বাংলাদেশকে যা দেখলাম, সেটা আমার ছেলেবেলায় দেখা নর্থ বেঙ্গলেরই প্রকৃতি। আমাদের দিনহাটার কাছেই লালমনিরহাট বলে একটা জায়গা ছিল। ছোটবেলায় আমরা দিনহাটা থেকে ট্রেন ধরে লালমনিরহাটে গিয়েছি, আবার ফিরে আসতাম। দিনহাটায় আমাদের বাড়ির পেছনে এক উকিল সাহেবের বাড়ি ছিল, তাঁর ছেলে পরবর্তী সমেয় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি এরশাদ। ডাকনাম পেয়ারা। আমরা পেয়ারা'দা বলে ডাকতাম, আমাদের দাদার মতো ছিলেন আর কী। তিনি, বলা যায়, আমাদের একজন লিডার ছিলেন। পেয়ারাদা আর কমল গুহ (পরবর্তীকালে কমলদা পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী হয়েছিলেন) এঁদের দুজনের ভেতরে খুব বন্ধুত্ব ছিল। এঁরা ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে পিয়ার গ্রুপ। বাংলাদেশটাকে কখনই আমি অন্য দেশ বলে ভাবতে পারি না। হঠাৎ রাতারাতি একটা লাইন টেনে দিয়ে বলা হলো, এ ধারে আসবে না, ধারে যাবে না—এটা আমি কোনোদিন মানতে পারিনি। ইংরেজদের বদমায়েশির তুলনা নেই। এবং তাদের কিছু কিছু বদমায়েশি এখন আমেরিকা করছে। দেশ ছেড়ে যাব, যাব; কিন্তু তার আগে দেশটার সর্বনাশ করে দিয়ে যাব—এই হচ্ছে এদের মতলব। সবদিক থেকে। অর্থনীতির দিক থেকে, মানবিক দিক থেকে, সংস্কৃতিক দিক থেকে। কীভাবে যে এরা এখন ইরাকে ধ্বংস করছে! আফগানিস্তানে ধ্বংস করছে, গাজায় ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। এককথায়, এরাই প্রকৃত ক্রিমিনাল। ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে এদেরই প্রথম বিচার হওয়া উচিত। আমার হাতে যদি জাদুর কাঠি থাকত, তাহলে প্রথমেই এই সীমারেখা মুছে দিতাম। ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ রেখা মুছে দিতাম। আমাদের এই অঞ্চলটা হলো পূর্ব-ভারত। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ এসব বলে কিছু ছিল না। এখান থেকে দুটো বিরাট ধর্মের উৎপত্তি; তার একটা হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম, অন্যটা জৈন ধর্ম। এবং তার সঙ্গে যদি বৈষ্ণম ধর্ম ধরি তা হলে দেখা যাচ্ছে তিনটে ধর্মের উৎপত্তি এই পূর্ব-ভারত থেকে। এবং এই একেকটা ধর্মের উৎপত্তি তো সহজ কথা নয়। বহু তর্ক-বিতর্কের পর একটা ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা আসলে 'আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান'—তর্কপ্রিয় বাঙালি। আমরা দৈহিক নির্যাতন, নরহত্যা, জিঘাংসা, নৃশংসতায় বিশ্বাসী না, পছন্দ করি না, এটা আমরা হাজার হাজার বছর ধরে চর্চা করে আসছি। দেশভাগের অর্থই হচ্ছে এসব সৃষ্টি সৌন্দর্যের ব্যাপারগুলো যেন হারিয়ে যায়! আমার কখনোই কোনোদিন নিজেকে কোনো ধর্মের বলে মনে হয়নি। তখনো না, এখনো না। আমি নিঃশঙ্ক মধ্য আরবে ঘুরেছি এবং আমার প্রবাসী জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকেই মধ্য আরবের। আমার বাড়িতে ইসমাইল কাজী নামের একজন নিয়মিত আসতেন, তাকে আমি পিতৃতুল্য জ্ঞান করতাম। আমার ছেলে হওয়ার পর তিনি তার নাম দেন 'ফিরোজ'। তারপর উনি আমাকে জানান- এই নাম নিয়ে ইন্ডিয়াতে গেলে আপনি কিন্তু বিপদে পড়ে যাবেন। আমি বললাম, আমি যতই বিপদে পড়ি না কেন, আপনি যেহেতু নাম রেখেছেন তাই এই ফিরোজ নামের কোনো পরিবর্তন হবে না। আমার ছেলে এখন একটা কলেজে পড়ায়, সেই থেকে ফিরোজ নামেই পরিচিত। আমার ছেলেকে তার নাম আর 'বসু' টাইটেল দেখে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেছে—তার মা-বাবার ভেতরে কেউ মহামেডান (মুসলিম) কি না! আমি পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরেছি, থেকেছি—কিন্তু কখনোই ধর্মের কারণে বিপন্ন বোধ করিনি।”
গত ৩ অক্টোবর থেমে গেল হাংরি জেনারেশনের এই কবির কলম। কয়েক দিনের অসুস্থতা শেষে ওই দিন দুপুরে জীবনাবসান হয় মিতভাষী এই কবির। বয়স হয়েছিল তাঁর ৭৮ বছর। পরিবার সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, কয়েক দিন আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন উৎপল। দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলেন তিনি। ওই ক্লিনিকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। কবির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও নীরব অশ্রুপাত।
বারবার আজ মনে পড়ছে ‘সলমা-জরির কাজ’ কবিতাগ্রন্থের সেই কবিতাটি...
শ্বাসকষ্ট উঠলেই বুঝতে পারি ফুলডুঙরি পাহাড় আর বেশি দূরে নয়
নইলে এমন হাঁপাচ্ছি কেন? কেন ওষুধে সারে না?
ঐ পাহাড়ের মাথায় উঠলে এ-বছর কী দেখব কে জানে—
যে-পাথরে আমরা সবাই নাম লিখিয়েছিলাম সেটি হয়ত
নীচে গড়িয়ে পড়ে গেছে,
যে-জলস্রোত লাফিয়ে পার হয়েছিলাম তাকে ঘুরিয়ে
চাষজমির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল—
যদি তাই হয়ে থাকে তবে আর তাকে আমি খুঁজে পাবো না,
এইসব ভাবি আর হাসপাতালের বিছানা শুকনো ডালপালায়,
ছেঁড়া কাগজে আর পরিত্যক্ত সাপের খোলসে ভরে ওঠে—
এত জঞ্জাল সরাবে কে? আমি কি সময় করে উঠতে পারবো?
আমি তো ফুলডুঙরি পাহাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছি।
চেপারামের ঘরটা
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আরেকটু পা চালিয়ে
উঠে গেলেই হয়।
No comments:
Post a Comment