কোনো কোনো লেখক থাকেন সব দেশে সব কালেই, সময়ের চাপ যাঁকে/যাঁদের সইতে হয় সবথেকে বেশি --- হয়তো বা সময়ের থেকে তাঁরা বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকেন, এগিয়ে ভাবেন বলেই। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, কালে তো অবস্থাটা আরো একটু বেশিই ঘোরালো, কারণ এখানে তাঁদের সামাল দিতে হয় সময়ের চাপকে এটা যেমন ঘটনা, তেমনি, সেইসঙ্গে নিজস্ব নির্মাণের প্রক্রিয়ার চাপটাও এক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য , সমান কার্যকরী রয়ে যায়। এ দুইয়ের সমান চাপ ব্যক্তি মানুষটিকে, অর্থাৎ যিনি নিজের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করবেন, স্রোতের সামান্য বিপরীতে হলেও দাঁড়িয়ে , তাঁকে /তাঁদের সর্বদা যে সিধে থাকতে দেয় না, অনবরত চেষ্টা করে নুইয়ে দিতে, এ আমরা প্রায়শ দেখেছি তো বটেই, দেখি ও দেখবও। দেখব কারণ, এই দেখাটাকেই বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক ও তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনার ইতিহাস তার নিজস্ব নির্বিকার নিয়মে নির্মাণ করে থাকে । এই ভয়াবহ বিভিন্নমুখী চাপ স্ব-অভিমুখী একজন ব্যক্তি মানুষকে তুবড়ে দুমড়ে কীভাবে মাপমতন করে নিতে চায় তার নিদর্শন আমাদের চারপাশে আমরা প্রতিনিয়ত যেমন দেখি , তেমনি কাউকে কাউকে এমনো আবার দেখা যায় যিনি বা যাঁরা এই চাপকে হয়তো সর্বতোভাবে ঠেকাতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু সেই না পারাটাকেও যে কীভাবে নিজের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে নেওয়া যায় তার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা , হ্যাঁ, প্রচেষ্টাই বলা যাক, চালান। তবে কিনা আমাদের এই কর্তাভজা কালে, যখন শাসকের সংস্কৃতিহীনতার সাংস্কৃতিক বারফট্টাইকেও আমাদের মানতে বাধ্য করা হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতির মূলধারা বলে, তখন, এঁদের দেখা মেলে বটে তবে কিনা হরদম মোটেই নয়।
গত শতকের শেষ-সত্তর থেকে আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন সদ্য হাংরি প্রজন্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছি তখন একটি নাম আমাদের চারপাশে সসম্ভ্রম কিছু বা ভীতির সঙ্গে উচ্চারিত হত, সে নাম মলয় রায়চৌধুরীর। তাঁর মাত্রই দু-একটি লেখার সঙ্গে (বই নয়) পরিচয় তার আগে আমাদের একেবারে যে হয়নি তা নিশ্চয় নয়, কিন্তু মূলত যেটা হয়েছিল তা হল উক্ত আন্দোলন-জনিত হইচই সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল হওয়া। এবং যা হবার হয়, আমাদের চোখ এবং মন দুই-ই ধাঁধিয়ে যায়।
তখনো ক্ষুধার্ত প্রজন্মের নামবাহী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকা মিলত এখানে-ওখানে। চোখ ও মন দুইয়েরই সচকিত হবার যথেষ্ট কারণ , বলা বাহুল্য, নিহিত ছিল তাইতেই। তবে যেটা ভেবে তখন সত্যিই অবাক লাগত সেটা হল, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বলে খ্যাত অন্যান্যদের লেখা ও বইপত্র যদি বা মেলে, এমনকী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকাও, তাহলে এই একজনের কিছু লেখা বা বইপত্র একেবারেই মেলে না কেন !
যাই হোক, মোদ্দা বিষয়টা যেটা তা হল, মলয় রায়চৌধুরী নামে ব্যক্তি-সাহিত্যিক তথা চিন্তককে তখনো আমরা চিনি না বলাই ভালো ; চিনব আরো পরে, আটের একদম শেষ , না, নয়ের গোড়াতেই সম্ভবত, যখন শিবনারায়ণ রায় কলকাতায় ফিরে এসেছেন, শুরু হয়েছে ‘জিজ্ঞাসা’ নামে একটি যথেষ্টই গম্ভীর দর্শন কিন্তু আকর্ষণীয় পত্রিকা ; কেবল তা-ই নয়, তাঁর সঙ্গে আমাদের মতন নেহাৎই এলেবেলে আর অপাংক্তেয়দেরও আড্ডা জমছে, মাঝেমধ্যে হলেও। এবং তখনো, আগেই বলেছি যে , আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ ; সে বই ১৯৮৫ সালে বেরোলেও আমরা অন্তত পড়িনি তখনো। জানতামও না ইকনমিকসে স্নাতকোত্তর মলয় ব্যাঙ্ক নোট পুড়িয়ে নষ্ট করার জীবিকা দিয়ে আরম্ভ করে ঢের দিন হল গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের চাকরিতে কেবল যোগই দেননি, সেইসূত্রে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাঁয়ে–গঞ্জে চাষি-জেলে-তাঁতি-হস্তশিল্পীদের সঙ্গ করেছেন শুধু নয়, সবথেকে বড় কথা, ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ নামে ভূখণ্ডটিকে হাতের তালুর মতো চেনবার সুযোগ পেয়েছেন --- যা যতদিন যাবে ছায়া তো ফেলবেই , সেই সঙ্গে তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে (ও নিয়েছে) ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘জলাঞ্জলি’, ‘নামগন্ধ’, ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসের পাশাপাশি এমনকী ‘নখদন্ত’ বা ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’-র মতো স্তরে স্তরে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে-চিনিয়ে দেওয়া যায় এমনভাবে বিন্যস্ত অথচ আপাত-এলোমেলো গ্রন্থরাজিও --- যা আমাদের সযত্ন-লালিত সাহিত্য-সংস্কৃতি তো বটেই, এমনকী আমাদের রক্তের অভ্যন্তরে প্রোথিত থাকা গোটা হয়ে-ওঠার ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবনধারণারও শিকড় অবধি আমূল নড়বড়ে করে ফেলার স্পর্ধা দেখাবে।
এবং কথা হচ্ছে, এইটা করতে গিয়ে তিনি, মলয়, আদ্যন্ত যেটা করেন/করেছেন তা হল, নিজের সময় ও সমকালকে তো বটেই, এমনকী নিজের সামাজিক অবস্থানকেও সেই সঙ্গে, কতকগুলো মূল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, যা একই সঙ্গে আমাদের, পাঠকদের মনোসামাজিক ভিতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেমন ধরা যাক , মলয় কেবল নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ডই বলেননি, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও আত্মজীবনীর পাতায় নিজের পরিবারের এমন কিছু বাঁক তুলে দিয়েছেন যা অবশ্যম্ভাবীভাবে সঙ্গেসঙ্গেই ঔপনিবেশিক মনোসামাজিক ভূমিতে আজন্ম লালিত পারিবারিক ধারণার কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে (যেমন , ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’-য় সটান বলে দেওয়া, যে, তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের নিজের ছেলে নয়, তাকে এক বেশ্যার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। কুলসম আপার ঘটনাটাও অবশ্যই এই পর্যায়েই পড়বে।) ; এবং করে যেহেতু, ফলে সব মিলিয়ে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় আজও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। কেবল তা-ই নয়, এর অভিঘাতেই ২০১৫-তে এসেও মলয়কে জানাতে হয়, ‘এতকাল পাঠকরা আমার বইপত্র খুঁজেও পেতেন না। তাঁদের দৃষ্টিতে আমার মামলাটাই জীবন্ত ছিল।’ বা আশির দশকের শেষের পর্বেও তাঁর অভিজ্ঞতা বলে , ‘কলকাতার সম্পাদকরা ভয়ে সিটিয়ে থাকত, ওই অশ্লীল কবিতার ভয়ে...’ একদিকে অবস্থা ছিল এই, আবার অন্য দিকে ক্ষুধার্ত প্রজন্মের এমন একটা বাজার তৈরি করে তোলে যেখানে মলয় কী বলেন বা ভাবেন নয়, বরং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের একদা কর্মকাণ্ড বা ওইসব তথাকথিত-যৌন অনুষঙ্গগুলি, যেগুলি মলয়রা সেদিন তাঁদের কবিতায়/লেখায় ব্যবহার করছিলেন। এই দিকটিকেই ফণিশ্বরনাথ রেণু হাংরি মামলা চলার সময় মলয়ের কাছে চিহ্নিত করেছিলেন এইভাবে যে, ‘এই যে তোমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়ে অবসিনিটি আর সাবভারশানের মামলা আরম্ভ হল তো , তুমি দেখবে তুমি ক্রমশ ওই অশ্লীলতার জন্যই পাঠকদের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েটেড হয়ে যাচ্ছো ; শুঁটকি মাছের গন্ধ আমাদের ভালো লাগে, টাটকার থেকেও বেশি টানে।’ বা গিন্সবার্গ বলেছিলেন, ‘এত কবিতা লিখছি, তবু সবাই কবিতার চেয়ে আমি কী করে বেড়িয়েছি তাতে ইন্টারেস্টেড।’ স্বাভাবিক। স্বাভাবিক যে-মানসিকতা উপরিউক্ত এই বাজারটা নির্মাণ করে তিলে তিলে, করে এবং শৈশব থেকেই আমাকে-আপনাকে ঝুঁটি ধরে তার অধীনে নিয়ে গিয়ে ফেলে প্রশ্নাতীত ক্ষমতার আঙুলে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে।
কেউ কেউ বলবেন হয়ত এখন অবস্থা বদলেছে , অন্তত উপরের দিক থেকে হলেও খানিকটা, কিন্তু বাংলা কবিতা বলুন বা গদ্যের মূল যে ভাবনাধারা, তার ক্ষেত্রে সে বদল, পাঠক জানেন, তা-ও ওই ওপর ওপর, এবং ওই খানিকটাই। হ্যাঁ, আর তাই এখন আর মলয়ের লেখাকে সেই অর্থে অশ্লীল হয়ত বলা হয় না ঠিক কথা, কিন্তু মলয় কি সেই অর্থে আবার যাকে বলে বহুলপঠিতও বটে ? এখনও ? না হলে, কেন নন ?
নন কারণ, মলয় কিন্তু সেই অর্থে যাকে বলে সাহিত্য/লেখালেখিকে দেখার যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ করে দেওয়া অ্যাটিট্যুড, যাকে আমাদের দেশে আমাদের তদবধি প্রচলিত দেখার চোখকে ধ্বংস করে সেই উপনিবেশ পর্বের গোড়াতেই তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, এবং যত দিন গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু সামান্য বিবর্তিত হয়েছে মাত্র, এবং একই সঙ্গে বিশেষ করে দাঁতে-নখে আরো আক্রমণাত্মক ও সার্বিক হয়ে উঠেছে, তাকে মান্য করে নিজের রচনার ভাবনা কাঠামোকে নির্মাণ করেননি/ করেন না। বরং আমরা যে প্রশ্নের কথা বলছিলাম, তাকে সেই প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে দেন। যে ভূমি থেকে ২০১৭-তে এসেও তিনি এরকম বলেন যে, ‘আমি মূলত সমাজের পর্যবেক্ষক এবং নিজের মতামত উপস্থাপন করি।’ কেবল তা-ই নয়, এই জায়গা থেকেই আরো বলার যে, মলয়ের উপন্যাস, গল্প , প্রবন্ধ , কবিতা সমূহ বিপজ্জনক ; কারণ, মলয় যা লেখেন তার অনেকটাই বিস্ফোরক রকম ইন্সটিঙ্কটিভ। তাঁর লেখা, তা সে যে গোত্রেরই হোক, স্পষ্ট একটা রক্তান্তর্গত রাজনৈতিক মতামত বহন করে। এবং এই বহন করাটাকে মলয়, আরো অনেকের মতো , ভাষার আচ্ছাদনে আড়াল তো করেনই না, বরং, সেই ভাষার অস্ত্রেই, তাকে হা-হা রকম হাটখোলা করে মেলে ধরেন। আর এটা তিনি করেন যেহেতু নিজের ইন্সটিঙ্কটে নিহিত রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই, নিজস্ব নির্মাণের পাথেয়, কিম্বা বলা যাক উপাদান তিনি যেহেতু সংগ্রহ করে নেন এর অভ্যন্তর থেকেই, ফলে, ১৯৯৫-এ কলকাতায় এই নিবন্ধকারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সটান ছোবল তুলতে বাধে না, যে, ‘কে প্রলেতারিয়েত ? তুমি, না যারা এটা পড়বে--- কারা ? যাদের বাড়ির ভেতরেই পায়খানা থাকে, তাদের প্রলেতারিয়েত বলা যায় না।’ কেবল তা-ই নয়, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁকে ভুরু কুঁচকে বলতে হয়, ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো , যিনি বা যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন যোগাবার জন্যে নেওয়া... প্রায় সবই মোটিভেটেড। সকলেই মোটামুটি একটা হাংরি ইমেজ নির্মাণ বা অবিনির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন। ...অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, নিজেদের ডিসকোর্সকে জায়গা করে দিতে চেয়েছেন।’
অর্থাৎ মলয় চিহ্নিত করেছেন কীভাবে তাঁর পরের প্রজন্ম , তৎকালীন সময় থেকে দূরে/পরিবর্তিত কালে বসেও, অন্তর্গত সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের চাপের সৃষ্টি হিসাবে সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের স্বার্থকেই বজায় রাখবার দায় থেকে গৃহীত হাংরি ইমেজকে খাড়া রাখবার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করছে যেমন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে হাংরি আন্দোলন নামে এক বিস্ফোরণের চরিত্রকেও এই ক্ষমতার চোখ এবং মন দিয়েই দেখতে ও পড়তে মগ্ন থাকছে। এই অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারাকে মলয় বলছেন পীড়া, যে পীড়াকে, মলয়ের স্পষ্ট বক্তব্য , ‘শেয়ার করা যায় না।’ এবং শুধু তা-ই নয় , এই পীড়াই তাঁকে যে এম আর চোওধারি নামে আরেক অস্তিত্বকেও খাড়া করতে বাধ্য করেছে তা-ও মলয়ের বয়ানেই আমরা জানতে পারছি।
এটা একটা দিক, আর অন্য দিকে এই এখান থেকেই জাত হয় সেই পরিস্থিতি যেখানে মলয় বলেছেন, ‘গ্রহণ-বর্জনের বৈভিন্ন্যের নিরন্তর টানাপোড়েনে পাঠকৃতি-বিশেষ তার নিজের পরিসর অহরহ গড়ে নিতে থাকে। তার কিনারায় গালে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।’ এবং এইখানেই মলয় নিজের জন্যে ‘ফালচার’-শীর্ষক এক বর্গ নির্মাণ করে নেন --- যার গভীরে নিহিত থাকে একটা ‘ইরর্যাশন্যালিটি’, যাকে আবার নির্মাণ করছে , মলয় বলছেন, ‘পাশাপাশি মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুল’-এর যাদু-বাস্তবতা --- যে বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মলয় লিখছেন, ‘আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, ব্রাহ্ম বলে। পিরিলি বাউনদের বজরা উত্তরপাড়ার গঙ্গায় ভাসলে স্নান অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠাকুমার পালকি ফিরে আসত। সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ ছিল কেননা তা লোচ্চাদের তামাসবিনি।’ এবং এইখানেই ‘প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা’ আর মিশনারি স্কুলের মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাতটা বাধে, এবং মলয়ের রক্তান্তর্গত রাজনীতির ভাবনা-বিশ্ব তথা দেখার-চোখ গড়ে ওঠে। এই দেখার চোখটাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো লেখা, ‘শয়তানের মুখ’ বা ‘জখম’-এর মতো হাড় অব্দি চমকে দেওয়া কাব্যগ্রন্থ, ‘নপুংপুং’,’ইল্লত’,’হিবাকুষা’-র মতো নাটক বা রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে ম্যানিফেস্টোগুলি, যা মলয় রায়চৌধুরী নামক ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্ণধারদের বিপরীতে গলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের মতো বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে অশ্লীলতার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার পর প্রথম একজন কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা/তকমা ঝুলিয়ে দেয় (সে অভিযোগ অবিশ্যি পরে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবু)। এবং সম্ভবত এইখান থেকেই অদ্যাবধি মলয়ের বই যত না, বেশি আলোচিত হয়েছেন মলয় নিজে—হয়েছেন কারণ, মলয় যে নিজেকেই লেখার বিষয় করেছেন। করেছেন নিজের সামান্য-টিল্টেড দেখার চোখকেই, যে চোখ দ্যাখে ‘কোরা মার্কিন কাপড়ের পুঁটুলিতে রাজপথ থেকে ছেঁকে তোলা মানবলাবণ্য’ (মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর ) বা যে চোখের দৃষ্টিশক্তির অভ্যন্তরে নিহিত থাকে ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ কিম্বা ‘ঘোগ’-এর ভাষা-বাস্তবতার শিকড়। বিষয়কেন্দ্রহীন মুক্ত সূচনা ও মুক্ত সমাপ্তির মধ্যবর্তী পর্বে লজিক্যাল সিকোয়েন্স-বর্জিত ছেঁড়া ছেঁড়া চিত্রকল্পে গেঁথে তোলা এই যে সব পাঠবস্তু , যাদের হাঁ-মুখে নির্বিচারে ঢুকে যায় দলা পাকিয়ে ওঠা রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি মথিত আমাদের গোটা সমসময় , যার সম্মুখবর্তী না হলে বোঝাই যায় না কেন, কোন জায়গা থেকে বাজার নামক প্রধান ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মলয় বলেন তিনি কবিতাকে, লেখালেখিকে জীবনে ফিরিয়ে দিতে চান ( অনেকটা ক্ষেত্রে দিয়েওছেন। অন্তত ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের’, ‘ভালোবাসার উৎসব’-এর মতো লেখা বা ধরা যাক ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসটি পড়ে উঠলে বেশ টের পাওয়া যায়), এবং কেন আজও মলয়ের লেখালেখি নিয়ে যে কোনো আলোচনার কেন্দ্রে ঘুরেফিরে এসে যায়ই হাংরি প্রসঙ্গ এবং তৎসংক্রান্ত ডিবেটগুলি, যা , নিহিত উত্তেজনার কারণেই অনেকটা , মুহূর্তে পাঠকের নজরের লক্ষ্যবিন্দুকে গ্রাস করে এমনকী যখন স্বয়ং মলয় বলেই দিচ্ছেন যে তিনি মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, হাংরি বা অ-হাংরি হিসেবে নয় , তখনো গোটা আলোচনাটিরই ভরকেন্দ্রকে, ক্ষমতার ইচ্ছে/স্ট্রাটেজি-মতো , বাধ্যতামূলক ভিন্নমুখী করে দিয়ে।
মলয় রায়চৌধুরীর লেখালেখি সম্পর্কে তা-ই আপাতত কথা রয়ে যায় একটাই , যে, তিনি আমাদের মানসিকতার গভীরে বাজারি আঙুলে আমূল প্রোথিত করে দিতে চাওয়া মানসিকতাটাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার প্রেক্ষিতেই নিজেকে যাচিয়ে দেখতে চান। এই চাওয়াটাই মলয়কে প্রতি মুহূর্তে যেমন সমকালীন রাখে, বিপজ্জনক হিসাবে প্রতিভাত করে, তেমনি আদ্যন্ত সচেতন নিজস্বতায় জারিতও করে নিঃসন্দেহে। তাঁর গল্প-উপন্যাস বলুন বা কবিতা, নাটক কিম্বা কাব্যনাট্যগুলি, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ অথবা আত্মজীবনী --- সবের মধ্যেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে থাকেন সেই মানুষটি, উত্তর-ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিষ-আঙুল যাঁর ভাবনা-কেন্দ্রে কোনো রদ-বদলই ঘটাতে পারেনি, বরং নিজেই সামান্য হলেও বদলে গেছে --- এই যা !
No comments:
Post a Comment