বিষয় মলয় রায়চৌধুরী : কৌশিক সরকার-এর কথামৃত
তোমাদের কাছে কবুল করতে লজ্জা নেই, আমি না লোকটা খুব -- যতই পাঙ্গা নিই না কেন -- আদতে, ষেনটিমেনটাল। আজ মলয়দার একটা পোস্ট দেখে চোখে জল এসে গেল। একা আমার নয়, আশা করি, আরো অনেকেরই। মলয়দা এটা চাইছিলেন এমন নয়। হিড়িক দেবার মতো, পাবলিককে, খামখা, বয়স তাঁর নেই। বাপকেলে অই একজনই বুজ়উর্গ আদমি টিঁকে আছেন এই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, সমাজ দুনিয়ায়। কাশ এভাবে যদি সন্দীপন সুনীল শৈলেশ্বর সুবিমলদাকে পেতাম ফেসবুকে নট টু সে অ্যাবাউট কমল মজুমদার। ওঁরা অন্য এরার লোক। মলয়দা একটা অদ্ভুত কথা লিখলেন। "কত বই পড়া হয়নি। আর পড়ার সময়ও নেই।" আমি বিশ্ব ন্যাকা একটা লোক। আমোদগেঁড়ে। চোখ ফেটে জল এল। ষিনেমা দেখতে গেলেও আমার বুক ভেসে যায় চোখের জলে। চোখের জলে না বীর্যের জলে! সন্দীপনদা বলত। পিচকিরি দিয়ে জোকারের মতো কাঁদি। কমলবাবু বলতেন আমার কান্নায় যেন বাজ না পড়ে। গাছ শুকিয়ে যাক তিনি চাননি। এ হল গিয়ে রামকৃষ্ণ লাইন, উচ্চাঙ্গের নওটঙ্কি। আমি বলব, বই পড়ে সময় নষ্ট করবেন না মলয়দা। আর বই পড়াটা শুধু টেমপোরাল ব্যাপার নয়। ওটা অ্যাট দা সেম টাইম একটা টেকনিকাল কারসাজি, গ্যাঁড়াকল, উইজ়ডম। বাঙালিরা হিজিবিজি বই পড়বে। যে এখনো আরো পঞ্চাশ বছর বাঁচবে সে-ও অগ্রিম বঞ্চিত। এ শুধু অশিতিপর মানুষের দুঃখ নয়। কী পড়তে হবে সেটা কি একজন জানে! পড়তে অনেক সাহস লাগে। এখানে নিটশের পাঠকই নেই তো দেরিদা হাইডেগার। বাঙালি জাতটা স্কলারলি নয়। নট অ্যাটঅল। কোথায় এলান ভিতাল। কোথায় আমোর ফাতি। সন্দীপন তো মালদোরর বগলে নিয়ে ঘুরত। কেউ চাইলে তাকে আবার মুরগি করত। হেব্বি বৈঠকবাজি। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেনট্রাল অ্যাভিনউ কফিহাউসে। একাধিক লেখককে ধুর বানাতে। এমনকি শৈবাল মিত্রকে যেভাবে খোরাক করলেন। আমি মনে মনে খুব হাততালি দিয়েছি। সুবো আচার্য আরেক ধুর, লোত্রেমো চেয়েছিল। সেটা কথা নয়। অথচ সন্দীপনদা শন দো মালদোরর নিয়ে কোনোদিন কিছু লিখলো না। আসলে পড়াশোনা জারি রাখেনি। সারাজীবন শুধু আউটসাইডার নিয়েই কপচে গেল। কামু তো ছেলে ভোলানো ছড়া। তাও যদি দা ফলটা পড়ত। অথচ, উৎপল বসু ছিল এই সন্দীপনেরই ধামাধরা। মানে বইটই না পড়া ব্যাপারে। ক্ষুধার্তদেরও ঐ একই দশা। কবে শৈলেশ্বর আর্তো পড়েছে, সুভাষ ঘোষ হেনরি মিলার, বাসুদেব সেলিন কোনো চিহ্ন এমনকি সিনডার্স পর্যন্ত পাওয়া যায় না টেক্সটুয়ালিটির ভেতর। আমি মলয়দাকে বললাম, ফেসবুকে লাইভ করুন। মুখে বকে যান অনর্গল। কথাই থাকবে। ইউটিউবে আপলোড দেওয়ার লোক আছে। টকিং কিওর। ভাষা চিকিৎসা। ডাজ়াইন তো বাই ডেফিনিশন জন্ম-মরিজ। অস্তিত্বই বিমারি: নিরাময়। বকে যান। যে কথা বলে সে-ই জয়েসের কাছাকাছি। কথাই সাহিত্য। ভয়েস-বহেস। স্বর সংগ্রহ। পাখির নীড়ের থেকে খড়। হাঁসের নীড়ের থেকে খড়। স্বরই এফিজি: খোড়ো কাঠামো। জাতীয় গ্রন্থাগারে দেখা হলে যখন তাঁকে জিগেস করতাম সুবিমলদা আফসোস করে বলতেন লেখা হচ্ছে না হাতে ব্যথা। আমি বললাম, ডিকটেশন দিন। কত লোক বোর্হেসের কথা টুকে নিত। লেখক অরিজিনালি ধৃতরাষ্ট্র, পর্নস্টার, জন্মান্ধ, হোমার, একশো ছেলের বাবা, অথচ স্ত্রীযোনিই দর্শন করেনি, একেই বলে শব্দভেদী বাণ, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। কথাই স্কাল্পচার। সুবিমলদা বলল হাতে না লিখলে পুরোটা নিজেকে প্রকাশ করা যায় না। এসব ভুল ধারণা। টেপরেকর্ডার এক্সপেরিমেন্ট। লেখা একটা বোরিং প্রক্রিয়া। তুমি কি ওস্তাগর। ঠায় বসে ঐ নিজামের গায়ে নাচনেওয়ালির ঘাঘরায় চুমকি বসাবে! তুমি শালা শিল্পী সামুরাই। লেখা একটা মুভিং কারবার। ছবি আঁকার মতো। দূরে বসে সিগারেট টানো আর দ্যাখো, নিজের অর্ধসমাপ্ত ক্যানভাস। আর্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছাড়াও অব্যবহিত দূরত্ব দরকার। লেখা মাইওপিক। সক্রিটিস তাই কখনো লেখেনি। আপনি দরকার হলে আত্মজীবনী লিখুন। আবারও। রুশো তো চারবার লিখেছিল। এগজহসট করা যায় না আত্মঅটোপসি। সুনীলের জন্য তাই আমার বড় দুঃখ হয়। গর্ব করত ওর লেখা নাকি স্বীকারোক্তিমূলক। সব কথা কি লিখে গ্যাছে! লিখতে হবে। দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। আসুরিক টাস্ক। মানুষ সিসিফাস। সব কিছু ফাঁস করতে এসেছে। তুমি প্রমিথিউস। সুনীল আগে প্রমিথিউয়ান ছিল। তাই লিখতে পেরেছিল: গভীর রাত্তিরে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে, ও গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই। কবিতা এভাবেই মিথ্যে কথা বলে যা সত্যের চেয়েও সেনসেসনাল। সব কথা বলে দিতে হবে। নিজেকে ধ্বংস করে। লেখকের কোনো মা বাপ থাকে না। সে অনাথ, বেজন্মা। তার পিছুটান কী আছে। যা কেউ করেনি আপনি তাই করুন। সব বলে দিন। পৃথিবীর শেষ বইটা আপনাকেই লিখে যেতে হবে।
No comments:
Post a Comment