দুটি আন্দোলনেই, কবি ও লেখকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে, বেশ কম লোককেই পাওয়া যাবে যিনি তর্ক জুড়বেন যে বিট আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল সাহিত্যের আন্দোলন । দুটি আন্দোলনই ডাডাবাদীদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাকে আকৃষ্ট করলেও, কেউই এই দুটিকে শিল্পের আন্দোলন বলতে চাইবেন না, যা কিনা ডাডা আন্দোলনকে বলা হয়, তাঁদের গোষ্ঠীতে সাহিত্যিকরা থাকলেও ।
কিন্তু বিট এবং হাংরিয়ালিস্টদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকারকে যদি খুটিয়ে দেখা হয় তাহলে সন্দেহ থাকে না যে যেমনটা আলোচকরা মনে করেন তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি ছিল শিল্পীদের অবদান এই দুটি আন্দোলনে। বিট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিশ্লেষণেই তা সত্য বলে প্রমাণিত হয় । তাঁদের আন্দোলনে শিল্পের যে স্হির-নিবদ্ধ সন্দর্ভ প্রধম থেকে ছিল তা কখনও থামেনি । অবশ্য মনে রাখতে হবে যে বিটদের সম্পর্কে তথ্যাদি ভালোভাবে নথি করা হয়েছে, যা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে হয়নি, ব্যাপারটা প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের ফাটলের অবদান । বিট আন্দোলন কাউন্টার কালচার হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে উদয় হয়েছিল, যখন কিনা হাংরি আন্দোলন তার কায়া পেয়েছিল দরিদ্র, অবিকশিত একটি দেশে, তাও তারা সীমিত ছিল একটি রাজ্যে বা এলাকায় । তাছাড়াও, হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিকভাবে এমন করে দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল যা বিটনিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই ঘটেনি । গিন্সবার্গ, ফেরলিংঘেট্টি, কোরসো, বারোজ এবং বাকি সবাই তাঁদের কুখ্যাতিকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাঁরা তা না চাইলেও পেরেছিলেন । এর ফলে তাঁদের আন্দোলন বহুকাল টিকে থাকতে পেরেছিল এবং লতায় পাতায় বেড়ে উঠতে পেরেছিল, জনমানসে কাল্ট হিসাবে স্হান করে নিতে পেরেছিল ।
অপরপক্ষে, ১৯৬১ সালে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী ও দেবী রায় যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারি লাঠিচালনা ও নিজেদের মধ্যে অবনিবনার কারণে স্তিমিত হয়ে যায়, অবনিবনার কারণ ছিল সরকারের লোকেদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের হয়রানি ও নাকাল করার চাপ । অশ্লীলতার আরোপে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা ও পরে মলয়ের জেলজরিমানা ছিল হাংরি আন্দোলন ভেঙে ফেলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা । তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে নির্মম পুলিশি হানা দিয়ে বৌদ্ধিক ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, বই, পাণ্ডুলিপি এবং চিঠিপত্র ।
হাংরি আন্দোলনের শিল্পীদের ক্ষেত্রে, বেনারসে, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় এবং সহযোগী শিল্পীদের ‘ডেভিলস ওয়র্কশপ’ নামে স্টুডিও তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ, নষ্ট করে দিয়েছিল তাঁদের আঁকা পেইইনটিঙ, আন্দোলনের নথিপত্র, যা পরে আর ফেরত পাওয়া যায়নি । সৌভাগ্যবশত অনিল করঞ্জাইয়ের কিছু কাজ, হাংরি আন্দোলনের লাগোয়া সময়ের, সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল এবং তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য সম্পদ হিসাবে সংরক্ষণ করা গেছে, যেগুলোয় পাওয়া যাবে হাংরি আন্দোলনের আইডিয়া এবং উদ্বেগ । এগুলো থেকে হাংরি আন্দোলনকে আরও গভীর ভাবে বোঝা যায় । এটা বলা ক্লিশে হবে না যে শব্দাবলীর তুলনায় উদ্দেশ্যকে ছবি আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরতে পারে। অনিল করঞ্জাই ( ১৯৪০ - ২০০১ ) ছিলেন হাংরি আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত একমাত্র শিল্পী । একই ধরণের বিট চিত্রশিল্পী ছিলেন রবার্ট লাভাইন ( ১৯২৮ - ২০১৪ )। অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন যে বিট আন্দোলনের জন্ম দেয়ায় রবার্টের বেশ বড়ো অবদান আছে । রবার্টের সান ফ্রানসিসকোর বিশাল বাড়িতে বোহামিয়ান, পোশাকহীন, বুনো তরুণ-তরুণী বিট আন্দোলনকারীরা সবাই মিলে বিট আন্দোলনকে চরিত্র দিয়েছিলেন । বিট আন্দোলনের গ্রাফিক্স আর পোস্টার এঁকে দিতেন রবার্ট। অনিল এবং করুণাও হাংরি আন্দোলনে একই কাজ করতেন ।
গিন্সবার্গ এবং রবার্ট নিজেদের মধ্যে নান্দনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন । তাঁরা দুজনেই আণবিক কাখণ্ডে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত যুবসমাজের চেতনায় প্রতিফলিত অবক্ষয় ও মৃত্যুবোধকে নিজেদের কাজে প্রতিফলিত করতে চাইতেন, রবার্ট লাভাইনের কথায়, “স্হায়ীত্বের মিথ্যা” সম্পর্কে তিনি গিন্সবার্গের থেকে জেনেছিলেন । যে জগতের ভবিষ্যৎ নেই সেখানে স্হায়ী শিল্পকর্মের ধারণা তাঁকে অবশ করে দিয়েছিল, যা থেকে তাঁর মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল যদি না তিনি বিটনিকদের সংস্পর্শে আসতেন । ‘পাগল, ল্যাংটো কবি’ হিসাবে লোকে গিন্সবার্গকে জানতো, এবং রবার্টকে গিন্সবার্গ বলেছিলেন ‘মহান উলঙ্গ শিল্পী’, দুজনেই সহকর্মী ও বন্ধুদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন নিজের নিজের কাজে, প্রথমজন জ্বলন্ত ‘হাউল’ কবিতায় এবং দ্বিতীয়জন তাঁর রেখা ও রঙে । তাঁর আঁকা যুবক গিন্সবার্গের অয়েলপেইন্ট ব্যাপারটাকে বিশদ করে তুলেছে ।
বিটদের তুলনায় অনিল করঞ্জাই পোরট্রেট আঁকা বেশ দেরিতে আরম্ভ করেন । স্টাইলের দিক থেকেই আর্টিস্ট দুজন ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের আঁকা বেশ কিছু পোরট্রেটে পাওয়া যাবে ব্যক্তিবিষয়ের কোমলতা । এটা অনিলের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে করুণার বাচ্চা মেয়ের চারকোল স্কেচে, যে বাচ্চাটাকে অনিল জন্মের সময় থেকেই জানতো, আর হাংরি আন্দোলনকারীদের ম্যাসকট হয়ে উঠেছিল ।
রবার্ট লাভাইন, প্রেমে গিন্সবার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী, পিটার অরলভস্কির যে বিরাট পেইনটিঙ এঁকেছিলেন, সেইটিই ছিল গিন্সবার্গের সবচেয়ে প্রিয় ছবি । উলঙ্গ, সুন্নৎ না-করা লিঙ্গ যৌনচুলে ঢাকা, ছবিটা যৌনতা উত্তেজক হলেও দুঃখি আর বিষণ্ণ । গিন্সবার্গ লিখেছেন যে তিনি পিটার অরলভস্কির সঙ্গে পরিচয়ের আগে ছবিটা যখন দেখেছিলেন তখন ‘চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে বিদ্যুৎপৃষ্ট বোধ করেছিলেন।’ সেই সময়কার মানদণ্ড অনুযায়ী গিন্সবার্গ এবং লাভাইন দুজনেই ছিলেন পর্নোগ্রাফার । কিন্তু কবির তুলনায় শিল্পী বেঁচে গিয়েছিলেন আদালতের হয়রানি থেকে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কেননা সত্তর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সামনাসামনি নগ্নতা এবং সমকামকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করা হতো । রবার্ট লাভাইনের মতো অনিল করঞ্জাইও নগ্নিকা এঁকেছিলেন এবং আদালতের চোখরাঙানি পোহাতে হয়নি । কিন্তু অনিলের ‘ক্লাউডস ইন দি মুনলাইট ( ১৯৭০ ) রোমা্টিক ক্যানভাসে বিট পেইনটারের তুলনায় অনিলকে ভিশানারি বলে মনে হয় ।
প্রখ্যাত কবি এবং ‘সিটি লাইটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, যাঁকে ‘হাউল’ প্রকাশ করার জন্য অশ্লীলতার আরোপের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের মামলার সময়ে হাংরিয়ালিস্টদের রচনা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেও শিল্পী ছিলেন । ফেরলিংঘেট্টির এক্সপ্রেশানিস্ট দৃশ্যাবলী, প্রথম দিকে বিমূর্ত, পরে ফিগারেটিভ এবং প্রায়ই সরাসরি রাজনৈতিক -- দর্শকদের নাড়া দেয় এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধি করে ।
‘নেকেড লাঞ্চ’ গ্রন্হের লেখক উইলিয়াম বারোজ, যাঁকে আইনের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল, বিট জেনারেশনের একজন নামকরা সদস্য, তিনিও ছিলেন ভিশুয়াল আর্টিস্ট । কিন্তু বারোজের পেইনটিঙ এবং ভাস্কর্য প্রকৃতপক্ষে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী । তিনি অনেক সময়ে নিজের মনের গভীরতাকে তুলে ধরার জন্য চোখ বন্ধ করে আঁকতেন, যাগুলো হতো উন্মাদগ্রস্ত, কেবল কড়া মাদক সেবনের এবং অযাচারী যৌনতার ফলেই নয়। বেশ কিছু ক্যানভাসে বুলেটের ছ্যাঁদা আছে, তাঁর দর্শকদের জানাবার জন্য যে উইলিয়াম টেলের মতন গুলি চালাতে গেলে তিনি নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন, স্ত্রীর মাথাকে খেলার বল মনে করে । বারোজকে বলা হতো ‘পাঙ্ক’-এর পিতা, পরে ‘পপ শিল্পের পিতা’ অ্যাণ্ডি ওয়ারহল-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং দুজনে একত্র হলে আমোদ করতেন । অ্যাণ্ডি ওয়ারহল বন্দুকের ব্যাপার ভালোই জানতেন, যদিও তিনি ছিলেন আক্রান্ত, আক্রমণকারী নন । ‘দি ফ্যাক্টরি’ নামে খ্যাত ওয়ারহলের নিউ ইয়র্কের স্টুডিওতে বারোজ প্রায়ই যেতেন ।
প্রথম দিকে বিটদের বিমূর্ত এক্সপ্রেসানিস্ট পেইনটারদের সঙ্গে একাসনে বসানো হয়েছিল, যদিও বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটাররা তাঁদের জীবনযাত্রায় বিটদের অচিরাচরিত ব্যক্তিগত জীবনের মতন ভবঘুরে ছিলেন না । তাঁরাও মিডিয়াকে ও দর্শকদের তাঁদের কাজের মাধ্যমে চমকে দেবার প্রয়াস করতেন । তাঁরাও, একইভাবে, প্রথানুগত আঁকার রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতেন । তার জন্য তাঁরা বিশাল বিশাল ক্যানভাসে দ্রুত তরল স্ট্রোক দিতেন ; একে তাঁরা বলতেন ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’, আর এই ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’ ছিল হাংরিয়ালিজমের মননবিন্দু । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটিঙকে এখন নৈরাজ্যবাদী মনে হতে পারে, যা বিট এবং হাংরি আন্দোলনের রচনাপদ্ধতিতে একই ধরনের ছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু হাংরি পেইনটারদের শিল্পকলা ছিল সুচিন্তিত, তাঁদের কেঅস ছিল পরিকল্পিত ।
একজন শিল্পী উন্মাদের মতন অনিয়ন্ত্রিত আবেগে এঁকে চলেছেন ব্যাপারটা নিছক ক্লিশে, এবং কম সংখ্যক শিল্পীই অনিল করঞ্জাইয়ের মতন এই ব্যাপারটায় জোর দিয়েছেন । নিওফাইট হিসাবেও, অস্হির তেজোময়তা ও পরিপূর্ণ জোশে অনিল করঞ্জাই এঁকেছেন প্ররিশ্রমান্তিক সুচিন্তিত ক্যানভাস । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকার কারণে, যাঁদের মধ্যে তাঁর বয়স ছিল সবচেয়ে কম, এই বৈশিষ্ট্যগুলো গুরুত্ব পেয়েছে । যে একমাত্র শিল্পী তাঁকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন ডাচ শিল্পী হিয়েরোনিমাস বশ ( ১৪৫০ - ১৫১৬ ) । বশের গ্রটেস্ক বিদ্রুপাত্মক চিত্রকল্প অনিল করঞ্জাইকে অনুপ্রাণিত করত, যে সময়ে অনিল শ্রেণিবিভাজিত এবং শোষিত সমাজের একক ভিশন নিজের পেইনটিঙে গড়ে নেবার প্রয়াস করছিলেন । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিজম সম্পর্কে অনিল বহু পরে জেনেছেন ।
সবচেয়ে কুখ্যাত বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট জ্যাকসন পোলক -- ‘ফোঁটাগড়ানো জ্যাক’ --- একজন ‘অ্যাকশান পেইনটার’, ক্যালিফর্নিয়ার ‘দি আমেরিকান মিউজিয়াম অভ বিট আর্ট’’-এ বহু শিল্পীর সঙ্গে স্হান পেয়েছেন । চরম ডাডাবাদী মার্সেল দুশঁও পেয়েছ, যিনি, বিটনিকরা জন্মাবার আগেই ‘অ্যান্টি-আর্ট’ শব্দবন্ধটির উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং সেকারণে বিটদের আদর্শ । কিন্তু শোনা যায় যে পঞ্চাশের দশকে যখন অ্যালেন গিন্সবার্গ ও গ্রেগরি কোরসো প্যারিসে দুশঁর সঙ্গে দেখা করেন, দুজনে নেশায় এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে গিন্সবার্গ দুশঁর হাঁটুতে চুমুখান, আর কোরসো নিজের টাই কেটে ফ্যালেন । বয়স্ক দুশঁর তা পছন্দ হয়নি । বিটদের সেসময়ের আচরণ এমনই স্বার্থপরভাবে অসংযত ছিল যে তাঁরা অনেককে চটিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন, এমনকি জাঁ জেনেকেও, যাঁর আদবকায়দা মোটেই ভালো ছিল না ।
বেনারসে বসবাসের সময়ে অনিল করঞ্জাই ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মাঝে ছবি আঁকার বিষয় নিয়ে কোনো অর্থবহ আলোচনা হয়েছিল বলে মনে হয় না । মার্কিন লোকটির আগ্রহ ছিল উচ্চতর ব্যাপারে প্রতি, অর্থাৎ সাধু, শ্মশানঘাট, মন্ত্র, গাঁজা ইত্যাদি । হিন্দি ভাষার বৌদ্ধ কবি নাগার্জুনের সঙ্গে অনিল ও করুণা অ্যালেন গিন্সবার্গকে হারমোনিয়ামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি গিন্সবার্গ ও অরলভস্কিকে ছিলিম টানার কায়দা শিখিয়ে ছিলেন, যা প্রায় ধর্মাচরণের ব্যাপার এবং মোটেই সহজ নয় । এ ছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকায় গিন্সবার্গ বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । অনিলের খারাপ লাগেনি কেননা তাঁর বয়স তখন কম ছিল, আনন্দ পেয়েছিলেন ইংরেজিতে কথা বলার সুযোগ পেয়ে, যা ভাষায় অনিল তখন অত সড়গড় ছিলেন না । অনিল আর করুণা দুজনেই খ্যাতিপ্রাপ্ত মার্কিন সাহেবকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের আমেরিকা কবিতার পঙক্তি চেঁচিয়ে অনিল বলতেন, “আমেরিকা তোমার ডিমগুলো কবে ভারতে পাঠাবে?”
সন্দেহ নেই যে গিন্সবার্গ রেসিস্ট ছিলেন না, অন্তত সচেতনতার স্তরে । কিন্তু তাঁর মধ্যে সাদা চামড়ার মানুষের ঔদ্ধত্য ছিল, যা অন্যান্য বিটদের মধ্যেও ছিল । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন হওয়া সতবেও একটা স্তরে তা ছিল অত্যন্ত এলিটিস্ট । যেমন বারোজ, স্ত্রীকে খুন করার পরেও ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, কেননা তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছিলেন এবং তাঁর পরিবার ছিল বৈভবশালী । গিন্সবার্গ ততোটা ধনী পরিবারের না হলেও বেশ কমবয়সেই সুপারস্টার হয়েগিয়েছিলেন । তিনি ভারতে এসে যতোই গরিব সেজে থাকুন, তা তাঁকে তাঁর মঞ্চ থেকে নামাতে পারেনি, তা ছাড়া ভারতে তিনি চামচাগিরির সুখও পেয়ে থাকবেন । সম্ভবত হাংরি আন্দোলনকারীরাই একমাত্র তাঁর সঙ্গে সমানে-সমানে আইডিয়া আদান-প্রদান করেছিলেন এবং তাঁর কবিতায় ও ভাবনাচিন্তায় হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রভাব স্বীকার না করাটা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে না ।
গিন্সবার্গ, যিনি ভারতের ধর্মে পরোক্ষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়, হাংরি আন্দোলনকারীদের ধর্ম সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তাকে গ্রহণ করতে পারেননি । হাংরি আন্দোলনকারীরা ঈশ্বরকে বিসর্জন দিয়েছিলেন আর যে কোনো ধরণের উপাসনা-অর্চনা সম্পর্কিত বিশ্বাসকে সমসাময়িক ভাষায় নিন্দা করেছেন । অনিলের শৈশব বেনারসে কাটার দরুন তিনি ছোটোবেলা থেকেই ধর্মে বিশ্বাস করতেন না ; তিনি মন্দিরের বয়স্কদের বারো বছর বয়স থেকেই চ্যালেঞ্জ করতেন, আর তাদের তর্কে হারিয়ে দিতেন হিন্দুধর্মের জ্ঞানের সাহায্যে । বিজ্ঞাননির্ভর মানসিকতা নিয়ে অনিল সারাজীবন আস্তিক ছিলেন । প্রথম দিকের বৌদ্ধধর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করলেও অনিল তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সমালোচনা করতেন, আর শেষ জীবনে অ্যালেন গিন্সবার্গ এই ধর্মে ধর্মান্তরিত হন । অবশ্য বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে বিট কবিদের যুদ্ধবিরোধী রাজনীতির মিল ছিল, যেমনটা ছিল হাংরি আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যদের ।
হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনীতির কথা যদি বলতে হয়, শেকড়পোঁতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবাই যেমন তীব্র আক্রমণ চালাতো তাকে অনিল করঞ্জাই সমর্থন করতেন, কিন্তু তাদের অ্যানার্কিজমকে মেনে নিতে পারেননি অনিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের বক্তব্য যে মানবাস্তিত্ব হল রাজনীতিরও আগের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে বর্জন করা দরকার, তাও মানতে পারেননি অনিল । অনিল কিছু দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার আগেই বেরিয়ে আসেন । তা সত্বেও অতিবামের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল । হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পরে তিনি নকশাল দলে যোগ দিয়েছিলেন, এই কথাটা সত্য নয় ।
এ কথা সত্য যে বেনারস ও কাঠমাণ্ডুতে হাংরি আন্দোলনকারীরা যৌথ যৌনতার অর্গিতে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তা বিটদের যৌনজীবনের হইচইয়ের সামনে অত্যন্ত হালকা । অনিল এবং করুণা হিপি আর বিদেশি সাধক-সাধিকাদের সঙ্গে বেনারসে আন্তর্জাতিক কমিউনে বসবাস করেছিলেন, এমনকি করুণা ছিলেন সেই কমিউনের ম্যানেজার ও মুখ্যরাঁধুনি । চেতনার বিস্তারের জন্য তাঁরা এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ইত্যাদি মাদক নিয়ে পাঁচিল ঘেরা জায়গায় নীরক্ষা করতেন । অনিলের চেতনায় এর প্রগাঢ় প্রভাব পড়েছিল কেননা অনিল দায়িত্বহীনভাবে মাদক সেবন করতেন না, পজিটিভ থাকার প্রয়াস করতেন, পেইনটার হিসাবে ভিশানের বিস্তার ছিল তাঁর কাম্য । ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ’ বলতে যা বোঝায় তার খপ্পরে তিনি পড়েননি ।
হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের পেইনটিঙ ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটাও বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তৈরি করা গালগল্প, ১৯৬৭ সালে কাঠমাণ্ডুর বিখ্যাত একটি গ্যালারিতে প্রদর্শনীর শেষে এই সমস্ত ব্যাপার ঘটেছিল বলে প্রচার করা হয় । লেখকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাতে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল । করুণা তার যাবতীয় পেইনটিঙ পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলেন । অনিল করঞ্জাই একপাশে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করেছিলেন । অমন শিল্পবিরোধী কাজ তাঁর মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি । অনিলের আইকনোক্লাজম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ।
হাংরি আন্দোলনকারীদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর কিছুটা অমিল থাকলেও, হাংরির নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে দিয়েছিলেন অনিল । ষাটের দশকে বেনারসের কমিউনে টানা বাহান্ন ঘণ্টায় আঁকা তাঁর ‘দি কমপিটিশন’ পেইনটিঙে তা প্রতিফলিত হয়েছে, কাজটা একটা বটগাছকে নিয়ে, যাকে তিনি উপস্হাপন করেছিলেন কেঅস এবং সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের মেটাফর হিসাবে । এই পেইনটিঙে হাংরি আন্দোলনকারিদের উদ্দেশ্য যেমন ফুটে উঠেছে তেমনই বিটদের উদ্দেশ্য ; প্রকৃতিপৃথিবীর সঙ্গে মানুষের একাত্মতা, যে পৃথিবীতে অশ্লীলতা বলে কিছু হয় না এবং মানুষের ইনোসেন্স পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।
হাংরি আন্দোলনের পরের দশকগুলোয় অনিল করঞ্জাইয়ের অঙ্কনজগতে পরিবর্তন ও পূর্নতাপ্রাপ্তি ঘটলেও, হাংরি আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা তাঁর চেতনায় থেকে গিয়েছিল । তাঁর আইডিয়াগুলো হয়তো বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত, কিন্তু হাংরি আন্দোলনের লক্ষ্য তাঁর দৃষ্টির বাইরে ককনও যায়নি । তাঁর আঁকা পরবর্তীকালের ছবিগুলো অনেকাংশে ক্লাসিকাল, বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপগুলো দেখলে প্রথমদিকের পরাবাস্তব চিত্রকল্পের বিরোধাভাসমূলক মনে হবে, যা তাঁর দর্শকদের বিভ্রান্ত করে । কিন্তু একথা নিশ্চয় বলা যেতে পারে যে প্ররোচনাদায়ক অলঙ্কারপূর্ণ চিত্রকল্প থেকে তিনি দূরে সরে গেলেও, ছবির ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটেনি । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনিল করঞ্জাইয়ের ছবিতে পাওয়া যাবে মানবাস্তিত্বের নাট্য যা প্রকৃতি নিজের মুড ও আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে । আর হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতার সঙ্গে তা খাপ খায় ।
বিনয় মজুমদার তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় চিত্রকল্পর আত্মাকে ধরে রেখেছেন, যখন তিনি বলেন:
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী
দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা ।
অনিল করঞ্জাইয়ের জীবনেও মিলনের এই স্বপ্ন বার বার ফিরে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিগুলোয় । ১৯৬৯ সালে আঁকা ‘দি ড্রিমার’ নামের পেইনটিঙে অনিল স্পষ্ট করে তুলেছেন সৃষ্টিকর্মীর একাকীত্ব : সেই ‘ড্রিমার’ হাংরি আন্দোলনের সংঘর্ষময় এলএসডি মাদকে মুখিয়ে রয়েছে ; অনিলের আরেকটি ওয়াটার কালারে মলয় রায়চৌধুরীর ঘোষণা এসেছে ছবির থিম হয়ে । মলয় বলেছিলেন, “আমি মনে করি প্রথম কবি ছিলেন সেই জিনজাসথ্রপাস প্রাণী যিনি লক্ষ লক্ষ বছর আগে মাটি থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে তাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন।” পরের দিকে অনিলের একা কবি ও দার্শনিকরা, পাথরে খোদাই করা, প্রকৃতির শৌর্যমণ্ডিত, তাদের অস্ত্র কেবল তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা । এই ছবিগুলো মহান আর্টিস্টের মতন করে আঁকা । হাংরি আন্দোলন-এ অনিলের মতন এমন একজন ছবি আঁকিয়ে ছিলেন যিনি মৌলিক ।
No comments:
Post a Comment