কিন্তু অরুণেশ হাত তুলে নিলেই তো কেসটা চুকেবুকে যায় না। শেষ না দেখে
ছাড়ার বান্দা শৈলেশ্বর ঘোষ নন। আরেক জন তো রয়েছে, সে দিক কৈফিয়ত।
কে সে? সুভাষ ঘোষ। সুভাষ ঘোষ কেন? কারণ ততদিনে বেশ কয়েকবার উত্তরবঙ্গে এসেছেন সুভাষ। আমরাও গিয়ে থেকেছি ওর বাড়িতে। সুতরাং উত্তরবঙ্গ নামক ফ্রন্টটিকে দেখভালের অলিখিত দায়িত্ব সুভাষের ওপরই ন্যস্ত করেছিলেন শৈলেশ্বর। যদিও প্রকৃত ঘটনাটা ছিল উল্টো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়মিত লেখা দেয়া এবং আমাদের লেখাপত্রের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া সুভাষের অন্য কোনো ভূমিকাই ছিল না। এমন কী ফালগুনি রায়ের রচনা প্রকাশ করার যে পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছিলাম, সেটাও ছিল আমাদের নিজস্ব। কিন্তু সে কথা শৈলেশ্বর ঘোষ বিশ্বাস করলে তো!
বাল্যবন্ধু তথা একসঙ্গে বালুরঘাট ছেড়ে মহানগরে আসা শৈলেশ্বরের আজ্ঞাকে মান্যতা দিতে বাধ্য হলেন সুভাষ ঘোষ। এলেন শিলিগুড়িতে। জমিদারী মানসিকতাকে ঘৃণা করা এবং নামাবলি খান খান করার কাজে আস্থা রাখা সত্বেও বন্ধুর ক্রোধে বিচলিত সুভাষ সমঝোতার কথা বলতে চাইলেন আমাদের সঙ্গে। স্বজন ধ্বংসী যুদ্ধে মূলতঃ কারা লাভবান হবে, বোঝাতে চাইলেন। সাদা বাংলায় যাকে বলে, কুরুক্ষেত্র থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরাতে চাইলেন। এবং ব্যর্থ হলেন। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ আমাদের প্রতিবাদ কোনো ব্যক্তিগত অসূয়া কিংবা নেতৃত্বের লোভজাত ছিল না। আমরা কোনো গদির ভাগও চাইনি যে সমঝোতা করবো। বরং চেয়েছি, ফের একবার আন্দোলিত হোক বাংলা সাহিত্য। শুধু মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি নন, সেই আন্দোলনের শরিক হোন প্রতিটি সাহিত্য পিয়াসী মানুষ। অন্ততঃ যারা,‘সৎ সাহিত্য’-- এমত শব্দবন্ধে আস্থা রাখেন। আর তার জন্য যেহেতু স্ববিরোধিতা মুক্ত হওয়াটা জরুরী তাই আঙুল তুলেছিলাম স্ব-ত্রুটিগুলোর বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, আমাদের আঙুল কিন্তু কারো কোনো ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ওঠেনি। উঠেছিল সাহিত্য কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার স্ববিরোধিতা নিয়ে। এবং সেসবের লক্ষ্য শুধুই শৈলেশ্বর ঘোষ ছিলেন না, প্রায় সবাই ছিলেন। এমন কী নিজেদের ছাল চামড়া খুলে নিতেও দ্বিধা ছিল না আমাদের।
সুতরাং সম্মিলিত ভাবে দূত সুভাষকে চেপে ধরা হলো । না, কমরেডশিপে আস্থা রাখা মানুষটিকে এক তিলও সরানো গেল না । বন্ধু শৈলেশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা তো দূরস্থান, শুনতেও নারাজ। বাকি বন্ধুদের ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি। কিন্তু আমরা যে পাল্টা যুক্তিগুলো তুলে ছিলাম সুভাষের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেসব খন্ডন করাও। খন্ডন করতেও চাননি হয়তো। কেননা সমঝোতার পরিণতি কী--সেটা সুভাষ হাড়ে হাড়ে জানতেন। তাছাড়া কবি শৈলেশ্বরকে তো আমরা কখনই অস্বীকার করিনি! যেভাবে করতে চাইনি বাংলা সাহিত্যে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের ভূমিকা।
স্থির করা হলো পত্রিকার তরফ থেকে এমন একজন ক্ষুধার্তের সাক্ষাতকার নেয়া হবে যিনি সোজা সাপ্টা প্রশ্নের উত্তর সোজা সাপ্টা ভাবেই দেবেন। কোনো ছেঁদো দার্শনিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বিষয়টা ঘুলিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না।
কিন্তু কে সেই ব্যক্তি?
বলাবাহুল্য দুই সনত্, অরুণেশ এবং শৈলেশ্বরের নাম ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি। প্রদীপ চৌধুরী বহুবছর আগেই তাঁর পত্রিকা, ‘স্বকাল’ এ ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন সুতরাং সাক্ষাৎকারের জন্য তিনিও উপযুক্ত। চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু ওঁর বাং-ফরাসী আদব কায়দার খোলস ভেঙে শাঁসে প্রবেশ করাটা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হওয়ায় পরিকল্পনা ক্যানসেলড।
তো সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য যে নামটা অবশিষ্ট থাকে সেটা হলো সুভাষ ঘোষ। সেদিন একমাত্র সুভাষকেই উপযুক্ত মনে হয়েছিল কারণ লক্ষ্য করেছিলাম, শুধু বিষয় নয়,আঙ্গিক মারফতও প্রথম থেকে একমাত্র সুভাষই নিজেকে এতটাই অস্পৃশ্য করে তুলতে পেরেছেন যে প্রতিষ্ঠানের কোনদিন সাধ্য হবে না ওকে ছোঁয়ার।একমাত্র ওর রচনাতেই রয়েছে গা-গতরের গন্ধ। বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসের বিরুদ্ধে ওকেই দেখছি ক্রমাগত কামান দাগিয়ে চলতে।
মিথ,মেটাফর,অ্যালিগরি,সিম্বলিজমকে সপাটে লাথি মেরে উড়িয়ে সুভাষই লিখতে পেরেছেন--
--“পটলের সন্তান পটল হয়--আলুর সন্তান নিখাদ আলু--কুকুরের সন্তান আদ্যন্ত কুকুর এক--মানুষের সন্তান মানুষ কি না আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি--”
--“এখানে স্পেডকে স্পেড বলা হয় না। এটা বুর্জোয়াদের মুক্তমেলার দেশ--মুক্ত বাজারের দেশ--এটা বুর্জোয়াদের রূপক জগৎ--রূপক দেশ--রূপক মানুষ রূপক জীবন ভালোবাসে--রূপক তথা খোলসটা ছিঁড়ে দিলাম। দগদগে চেহারা বেরিয়ে পড়ল। গেল গেল রব উঠল। হ্যাঁ,ওরা ওই বিত্তবান,মধ্যবিত্ত,এলিট শ্রমিক, পোষা টিয়া ময়না--টিয়া ময়না ওই এদেশের এলিট,অ্যাকাডেমি বাজারজাত লেখক,কবি।”
সেই সাক্ষাৎকারটিতে রাখা হয়েছিল চোখা চোখা প্রশ্ন কিন্তু হায় হতভাগ্য, প্রায় সব ক’টা প্রশ্নই কৌশলে এড়িয়ে গেলেন সুভাষ ঘোষ। যেটুকু বললেন সেটা প্রায় না বলার মতই, তবুও ওই বলাটুকুই ছিল আমাদের কাছে যথেষ্ট।
শুধু আমাদের কাছে নয়,শৈলেশ্বর ঘোষের কাছেও। ওই সাক্ষাৎকারটি থেকে দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তিনি, দূত হিসেবে সুভাষ চূড়ান্ত ব্যর্থ এবং এই ব্যর্থতা মূলতঃ বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। শৈলেশ্বর নিশ্চিত হয়ে গেলেন, উত্তরবঙ্গের এই পাল্টা অভ্যুথ্থান মূলতঃ মলয়ের উস্কানি এবং সুভাষ ঘোষের প্রশ্রয়জাত। শৈলেশ্বরকে হঠিয়ে ক্ষুধার্ত রথের প্রধান সারথি হতে চাইছেন সুভাষ। যদিও রথটি তখন মূলতঃ তিন চাক্কায় ভর করে চলছিল, দুটি চাক্কা শৈলেশ্বর এবং সুভাষ। অন্য চাক্কার অর্ধেক প্রদীপ চৌধুরী, বাকি অর্ধেক অরুণেশ ঘোষ।
সুভাষ লিখেছিলেন--“ কামরোগ ভয় আমার--
নামরোগ ভয় আমার--
‘আমি’রোগ ভয় আমার--ক্ষমতারোগ-”
লিখেছিলেন,“ দান,ভিক্ষাবৃত্তি,হ্যাংলামিপনা যদিও আমাদের জাতীয় মজ্জায় প্রায় অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আমি তার কেউ নই--দাদা ধরা,বাবা ধরা আজকাল জলচল হয়েছে--দেখে ঘেন্না ধরে--”
আমরা যারা অনেক পরে সুভাষ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তারা জানতাম ওইসব লেখা সুভাষ নিছকই বানিয়ে বানিয়ে লেখেননি, একদম প্রাণের কথা ওঁর। ক্যাডার-লিডার নয়, সুভাষ বিশ্বাস করেন কমরেডশিপে। এবং সেই বিশ্বাস ছিল এতটাই দৃঢ় এবং সুপ্রোথিত যে সেটাকে,‘সৌভ্রাতৃত্ব বোধ’ নামক ছেঁদো অভিধায় অপমানিত করা চলে না।
সুভাষের সঙ্গে বাল্যবন্ধুত্বের সুবাদে ওই সব তথ্য শৈলেশ্বরেরও জানা ছিল কিন্তু সন্দেহ বহোত খতরনাক চিজ। অভ্যেস মোতাবেক অতীত ভুলে যেতে অসুবিধে হলো না শৈলেশ্বরের। মনগড়া অভিমানে আহত হলেন শৈলেশ্বর।মফঃস্বলের ছেলেদের বাড়াবাড়ি দেখে অহঙে আঘাত পেলেন। কে না জানে, কবিকে যদি বা আঘাত করা যায়, নেতাকবিকে আঘাত করা অত সোজা নয়! অহং চোট গ্রস্ত হলে সে কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। কইতে জানে না। সুতরাং এবার শুরু হলো প্রত্যাঘাতের পালা।
অথচ কবি শৈলেশ্বরকে কিন্তু কখনই অস্বীকার করিনি আমরা। করা যায় না। কিভাবে ভুলব সেই সব অমোঘ লাইন--
বৃক্ষাকাশে কবিতা টাঙাবো না আমরা, শোবার ঘরেই গাছ সঞ্চার হয়েছে,
গাছেতে ভূমধ্যাকর্ষণ হয় চোরাচালান বোঝে— শোবার ঘরেই চলে
অহরহ বিক্ষোভ-আক্রমণ; গাছের সঙ্গেই সুদীর্ঘকাল ফলে ওঠে
ভালবাসাবাসি— কলকাতায় দশবছর খারিজ নীলাম
দরসরবরাহ নিদ্রাপ্রেমের মূল্যবৃদ্ধি— ফাটকায় হাতবদল
দিনমান হৃদয় চিৎ— দিনমানভর তেত্রিশ হিজরের গর্ভ হয়
দিনমান ধরে হে ঘোড়া ভৌতিক ক্ষুধা কবিতার ।
কিন্তু সেইডা পাগোল মনডারে বুঝাই ক্যামনে! এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফের সেই কথায় আসি।
সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
--কী চাই!
মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
--কে আপনি?
এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
--কি কথা?
--গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
--কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
--এভাবে কথা বলছেন কেন?
--যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
--ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
--কোন পত্রিকা?
--কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
--নেব না। যান।
এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি। (ক্রমশ)
কে সে? সুভাষ ঘোষ। সুভাষ ঘোষ কেন? কারণ ততদিনে বেশ কয়েকবার উত্তরবঙ্গে এসেছেন সুভাষ। আমরাও গিয়ে থেকেছি ওর বাড়িতে। সুতরাং উত্তরবঙ্গ নামক ফ্রন্টটিকে দেখভালের অলিখিত দায়িত্ব সুভাষের ওপরই ন্যস্ত করেছিলেন শৈলেশ্বর। যদিও প্রকৃত ঘটনাটা ছিল উল্টো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়মিত লেখা দেয়া এবং আমাদের লেখাপত্রের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া সুভাষের অন্য কোনো ভূমিকাই ছিল না। এমন কী ফালগুনি রায়ের রচনা প্রকাশ করার যে পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছিলাম, সেটাও ছিল আমাদের নিজস্ব। কিন্তু সে কথা শৈলেশ্বর ঘোষ বিশ্বাস করলে তো!
বাল্যবন্ধু তথা একসঙ্গে বালুরঘাট ছেড়ে মহানগরে আসা শৈলেশ্বরের আজ্ঞাকে মান্যতা দিতে বাধ্য হলেন সুভাষ ঘোষ। এলেন শিলিগুড়িতে। জমিদারী মানসিকতাকে ঘৃণা করা এবং নামাবলি খান খান করার কাজে আস্থা রাখা সত্বেও বন্ধুর ক্রোধে বিচলিত সুভাষ সমঝোতার কথা বলতে চাইলেন আমাদের সঙ্গে। স্বজন ধ্বংসী যুদ্ধে মূলতঃ কারা লাভবান হবে, বোঝাতে চাইলেন। সাদা বাংলায় যাকে বলে, কুরুক্ষেত্র থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরাতে চাইলেন। এবং ব্যর্থ হলেন। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ আমাদের প্রতিবাদ কোনো ব্যক্তিগত অসূয়া কিংবা নেতৃত্বের লোভজাত ছিল না। আমরা কোনো গদির ভাগও চাইনি যে সমঝোতা করবো। বরং চেয়েছি, ফের একবার আন্দোলিত হোক বাংলা সাহিত্য। শুধু মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি নন, সেই আন্দোলনের শরিক হোন প্রতিটি সাহিত্য পিয়াসী মানুষ। অন্ততঃ যারা,‘সৎ সাহিত্য’-- এমত শব্দবন্ধে আস্থা রাখেন। আর তার জন্য যেহেতু স্ববিরোধিতা মুক্ত হওয়াটা জরুরী তাই আঙুল তুলেছিলাম স্ব-ত্রুটিগুলোর বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, আমাদের আঙুল কিন্তু কারো কোনো ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ওঠেনি। উঠেছিল সাহিত্য কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার স্ববিরোধিতা নিয়ে। এবং সেসবের লক্ষ্য শুধুই শৈলেশ্বর ঘোষ ছিলেন না, প্রায় সবাই ছিলেন। এমন কী নিজেদের ছাল চামড়া খুলে নিতেও দ্বিধা ছিল না আমাদের।
সুতরাং সম্মিলিত ভাবে দূত সুভাষকে চেপে ধরা হলো । না, কমরেডশিপে আস্থা রাখা মানুষটিকে এক তিলও সরানো গেল না । বন্ধু শৈলেশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা তো দূরস্থান, শুনতেও নারাজ। বাকি বন্ধুদের ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি। কিন্তু আমরা যে পাল্টা যুক্তিগুলো তুলে ছিলাম সুভাষের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেসব খন্ডন করাও। খন্ডন করতেও চাননি হয়তো। কেননা সমঝোতার পরিণতি কী--সেটা সুভাষ হাড়ে হাড়ে জানতেন। তাছাড়া কবি শৈলেশ্বরকে তো আমরা কখনই অস্বীকার করিনি! যেভাবে করতে চাইনি বাংলা সাহিত্যে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের ভূমিকা।
স্থির করা হলো পত্রিকার তরফ থেকে এমন একজন ক্ষুধার্তের সাক্ষাতকার নেয়া হবে যিনি সোজা সাপ্টা প্রশ্নের উত্তর সোজা সাপ্টা ভাবেই দেবেন। কোনো ছেঁদো দার্শনিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বিষয়টা ঘুলিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না।
কিন্তু কে সেই ব্যক্তি?
বলাবাহুল্য দুই সনত্, অরুণেশ এবং শৈলেশ্বরের নাম ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি। প্রদীপ চৌধুরী বহুবছর আগেই তাঁর পত্রিকা, ‘স্বকাল’ এ ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন সুতরাং সাক্ষাৎকারের জন্য তিনিও উপযুক্ত। চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু ওঁর বাং-ফরাসী আদব কায়দার খোলস ভেঙে শাঁসে প্রবেশ করাটা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হওয়ায় পরিকল্পনা ক্যানসেলড।
তো সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য যে নামটা অবশিষ্ট থাকে সেটা হলো সুভাষ ঘোষ। সেদিন একমাত্র সুভাষকেই উপযুক্ত মনে হয়েছিল কারণ লক্ষ্য করেছিলাম, শুধু বিষয় নয়,আঙ্গিক মারফতও প্রথম থেকে একমাত্র সুভাষই নিজেকে এতটাই অস্পৃশ্য করে তুলতে পেরেছেন যে প্রতিষ্ঠানের কোনদিন সাধ্য হবে না ওকে ছোঁয়ার।একমাত্র ওর রচনাতেই রয়েছে গা-গতরের গন্ধ। বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসের বিরুদ্ধে ওকেই দেখছি ক্রমাগত কামান দাগিয়ে চলতে।
মিথ,মেটাফর,অ্যালিগরি,সিম্বলিজমকে সপাটে লাথি মেরে উড়িয়ে সুভাষই লিখতে পেরেছেন--
--“পটলের সন্তান পটল হয়--আলুর সন্তান নিখাদ আলু--কুকুরের সন্তান আদ্যন্ত কুকুর এক--মানুষের সন্তান মানুষ কি না আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি--”
--“এখানে স্পেডকে স্পেড বলা হয় না। এটা বুর্জোয়াদের মুক্তমেলার দেশ--মুক্ত বাজারের দেশ--এটা বুর্জোয়াদের রূপক জগৎ--রূপক দেশ--রূপক মানুষ রূপক জীবন ভালোবাসে--রূপক তথা খোলসটা ছিঁড়ে দিলাম। দগদগে চেহারা বেরিয়ে পড়ল। গেল গেল রব উঠল। হ্যাঁ,ওরা ওই বিত্তবান,মধ্যবিত্ত,এলিট শ্রমিক, পোষা টিয়া ময়না--টিয়া ময়না ওই এদেশের এলিট,অ্যাকাডেমি বাজারজাত লেখক,কবি।”
সেই সাক্ষাৎকারটিতে রাখা হয়েছিল চোখা চোখা প্রশ্ন কিন্তু হায় হতভাগ্য, প্রায় সব ক’টা প্রশ্নই কৌশলে এড়িয়ে গেলেন সুভাষ ঘোষ। যেটুকু বললেন সেটা প্রায় না বলার মতই, তবুও ওই বলাটুকুই ছিল আমাদের কাছে যথেষ্ট।
শুধু আমাদের কাছে নয়,শৈলেশ্বর ঘোষের কাছেও। ওই সাক্ষাৎকারটি থেকে দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তিনি, দূত হিসেবে সুভাষ চূড়ান্ত ব্যর্থ এবং এই ব্যর্থতা মূলতঃ বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। শৈলেশ্বর নিশ্চিত হয়ে গেলেন, উত্তরবঙ্গের এই পাল্টা অভ্যুথ্থান মূলতঃ মলয়ের উস্কানি এবং সুভাষ ঘোষের প্রশ্রয়জাত। শৈলেশ্বরকে হঠিয়ে ক্ষুধার্ত রথের প্রধান সারথি হতে চাইছেন সুভাষ। যদিও রথটি তখন মূলতঃ তিন চাক্কায় ভর করে চলছিল, দুটি চাক্কা শৈলেশ্বর এবং সুভাষ। অন্য চাক্কার অর্ধেক প্রদীপ চৌধুরী, বাকি অর্ধেক অরুণেশ ঘোষ।
সুভাষ লিখেছিলেন--“ কামরোগ ভয় আমার--
নামরোগ ভয় আমার--
‘আমি’রোগ ভয় আমার--ক্ষমতারোগ-”
লিখেছিলেন,“ দান,ভিক্ষাবৃত্তি,হ্যাংলামিপনা যদিও আমাদের জাতীয় মজ্জায় প্রায় অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আমি তার কেউ নই--দাদা ধরা,বাবা ধরা আজকাল জলচল হয়েছে--দেখে ঘেন্না ধরে--”
আমরা যারা অনেক পরে সুভাষ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তারা জানতাম ওইসব লেখা সুভাষ নিছকই বানিয়ে বানিয়ে লেখেননি, একদম প্রাণের কথা ওঁর। ক্যাডার-লিডার নয়, সুভাষ বিশ্বাস করেন কমরেডশিপে। এবং সেই বিশ্বাস ছিল এতটাই দৃঢ় এবং সুপ্রোথিত যে সেটাকে,‘সৌভ্রাতৃত্ব বোধ’ নামক ছেঁদো অভিধায় অপমানিত করা চলে না।
সুভাষের সঙ্গে বাল্যবন্ধুত্বের সুবাদে ওই সব তথ্য শৈলেশ্বরেরও জানা ছিল কিন্তু সন্দেহ বহোত খতরনাক চিজ। অভ্যেস মোতাবেক অতীত ভুলে যেতে অসুবিধে হলো না শৈলেশ্বরের। মনগড়া অভিমানে আহত হলেন শৈলেশ্বর।মফঃস্বলের ছেলেদের বাড়াবাড়ি দেখে অহঙে আঘাত পেলেন। কে না জানে, কবিকে যদি বা আঘাত করা যায়, নেতাকবিকে আঘাত করা অত সোজা নয়! অহং চোট গ্রস্ত হলে সে কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। কইতে জানে না। সুতরাং এবার শুরু হলো প্রত্যাঘাতের পালা।
অথচ কবি শৈলেশ্বরকে কিন্তু কখনই অস্বীকার করিনি আমরা। করা যায় না। কিভাবে ভুলব সেই সব অমোঘ লাইন--
বৃক্ষাকাশে কবিতা টাঙাবো না আমরা, শোবার ঘরেই গাছ সঞ্চার হয়েছে,
গাছেতে ভূমধ্যাকর্ষণ হয় চোরাচালান বোঝে— শোবার ঘরেই চলে
অহরহ বিক্ষোভ-আক্রমণ; গাছের সঙ্গেই সুদীর্ঘকাল ফলে ওঠে
ভালবাসাবাসি— কলকাতায় দশবছর খারিজ নীলাম
দরসরবরাহ নিদ্রাপ্রেমের মূল্যবৃদ্ধি— ফাটকায় হাতবদল
দিনমান হৃদয় চিৎ— দিনমানভর তেত্রিশ হিজরের গর্ভ হয়
দিনমান ধরে হে ঘোড়া ভৌতিক ক্ষুধা কবিতার ।
কিন্তু সেইডা পাগোল মনডারে বুঝাই ক্যামনে! এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফের সেই কথায় আসি।
সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
--কী চাই!
মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
--কে আপনি?
এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
--কি কথা?
--গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
--কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
--এভাবে কথা বলছেন কেন?
--যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
--ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
--কোন পত্রিকা?
--কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
--নেব না। যান।
এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি। (ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment