পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বিশ্বের নানা প্রান্তে সংঘটিত হয়েছিলো তৎকালীন সময়কেন্দ্রিক কিছু শিল্প-সাহিত্য আন্দোলন। সেগুলো ছিলো মূলত নির্দিষ্ট কোনো প্রোপ্যাগান্ডাকে সামনে তুলে আনার একটা প্রয়াস। যেমন অ্যালান গিন্সবার্গের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের ‘বিট জেনারেশন’। যার প্রভাব কেবলমাত্র আমেরিকা কিংবা ইউরোপে নয়, এই সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ প্রভাব ফেলেছিল সারা পৃথিবীতেই। এরকমভাবে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত সাহিত্য আন্দোলনের নাম ‘হাংরি আন্দোলন’। ১৯৬০ সালে এই আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত গড়েছিলেন ২১ বছর বয়সী মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৫৯-৬০ সালে ইতিহাসের দর্শন এবং মার্কসবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে দুইটি লেখা নিয়ে কাজ করার সময় হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা তিনি অনুভব করেন। ‘হাংরি’ শব্দটি প্রথমে পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলেন ওসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট’ বইটি থেকে। স্পেংলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী ‘প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেনঃ
একদিকে স্পেংলারের লেখা মলয়ের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্যদিকে দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার ভয়ংকর বিশৃঙ্খল অবস্থা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তুপাড়ায় ভিড়, রাজনৈতিক সংকট, সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকাদারি মিলেমিশে একধরণের টালমাতাল বিষণ্ণ কোলাজ। এগুলো প্রত্যক্ষ করে তার মনে হয়েছিলো আওয়াজ তোলাটা দরকার, প্রয়োজন আন্দোলনের। তখন তিনি তার আইডিয়া ব্যাখা করেছিলেন বন্ধু দেবী রায়(হারাধন ধাড়া), দাদা সমীর রায়চৌধুরী এবং তার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘হাংরি’ নাম দিয়ে একটা আন্দোলন আরম্ভ করার। এই চার নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনা অনুসারে বুলেটিন সম্পাদনা ও বিতরণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন দেবী রায়, নেতৃত্বের দায়িত্বে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সংগঠিত করার কাজটা দেখতেন সমীর রায়চৌধুরী আর ছাপা এবং ছাপানোর খরচ যোগানোর দায়িত্ব মলয় রায়চৌধুরী নিজেই নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬১ সালের ১৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের পাটনা শহর থেকে আন্দোলনের ইশতেহার সম্বলিত একটি বুলেটিন প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিলো। তখন পাটনায় বাংলা ছাপাবার কোনো প্রেস না থাকায় বাধ্য হয়েই বুলেটিন প্রকাশ করতে হয়েছিলো ইংরেজি ভাষায়। বুলেটিন প্রকাশের মাধ্যমে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন প্রচলিত ধারার সাহিত্য ও চলমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কবিতার ইশতেহারে মলয় লিখেছিলেনঃ‘একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।’
‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’। ‘এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।’
১৯৬২ সালের শেষেরদিকে আন্দোলনে সামিল হওয়া তরুণ কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সমীরের বন্ধু উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সহ মলয়ের বন্ধু সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর বিনয় মজুমদার, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃত তনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে হাংরিতে যোগ দেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় হাংরি আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিলো দিল্লী,আসাম এমনকি বাংলাদেশ, নেপালের তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও। ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার সহ আরো অনেকে। অনেকেই তখনও জানতেন না যে মলয়রা প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে ক্যানো প্রকাশ করেছিলেন। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিলো ইংরেজিতে ইশতেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
হাংরি আন্দোলনের সময়কাল ছিলো মূলত ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। এই স্বল্প সময়ে শ’খানেক ছাপানো বুলেটিন তারা প্রকাশ করতে পেরেছিলো যার অধিকাংশই ছিলো হ্যান্ডবিল, এক ফর্মার বই, পোস্টকার্ড কিংবা পোস্টারের মতো। এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে বুলেটিন প্রকাশ, এসবের পেছনেও ছিলো তৎকালীন গতানুগতিক সাহিত্যধারাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেওয়া। এই এক পাতার বুলেটিনে থাকতো কবিতা, গদ্য, ছোটগল্প, নাটক, আন্দোলনের উদ্দেশ্য-দর্শন বিষয়ে ইশতেহার, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতো করে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস, পত্রিকা অফিসের সামনে, কলেজের লাইব্রেরি সহ অলিগলিতে বিতরণ করতেন। এর ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই মুভমেন্ট ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। পত্রিকাগুলো হাংরিদের সমালোচনা করে তাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে নিয়মিত লেখা ছাপতে লাগলো। সেসময় বেশকিছু পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিলো হাংরিদের, সেগুলোর মধ্যে সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী‘, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা‘, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ‘ফুঃ‘ অন্যতম। লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল এই হাংরিরা। ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দালনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখা শুরু করেছিলেন জেব্রা, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, ফুঃ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি।
কয়েকটি হাংরি প্রকাশনা
হাংরি কবিতাকে অশ্লীল সাহিত্য হিসেবে
আখ্যায়িত করেছে সেসময়ের অনেক প্রথাগত লেখক। তবে সেসময় হাংরিরা শুধু কবিতা
লিখেই ক্ষান্ত হননি। ১৯৬৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, এমএলএ, সচিব
থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক লেখক-সম্পাদক, সাংবাদিককে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ
পাঠাতে আরম্ভ করলেন। জন্তু-জানোয়ার, জোকার, মিকি মাউস, দেবতা সহ বিভিন্ন
ধরনের মুখোশ পাঠিয়ে চিরকুটে লিখে দিতেন ‘দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন’। অন্যদিকে ছাপোষা বা প্রতিষ্ঠানের দালানী করা কবি সাহিত্যিকদের পাঠাতেন বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা থাকতো “Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry”।
আবার আনন্দবাজারের মতো মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর অফিসে ছোটগল্পের
নামে পাঠাতেন সাদা কাগজ কিংবা বুক রিভিউয়ের জন্য জুতোর বাক্স। কখনও একটি এক
ফর্মার বইয়ের দাম ধরতেন লাখ টাকা। আবার কখনো শ্মশানে চিত্রপ্রদর্শনীর
আয়োজন করে শেষদিন পুড়িয়ে ফেললেন সমস্ত চিত্রকর্ম।
প্রথাগত সাহিত্য-সংস্কারকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিলো ‘হাংরি মুভমেন্ট’।
সমাজে হাংরিরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন যেটা ষাটের
দশকের বাংলা সাহিত্যে হওয়া অন্য কোনো মুভমেন্ট করতে পারেনি, সবকিছুকে
এভাবে ভেঙ্গে ফেলতে পারেনি। হাংরি আন্দোলনের সাথে প্রথাগত সাহিত্যের যে
পার্থক্য সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে হাংরি কবি সুবিমল বসাক,
হিন্দি ভাষার হাংরি কবি রাজকমল চৌধুরীর করা একটি ত্রিভাষিক
(বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি) হাংরি বুলেটিনে প্রকাশ পাওয়া একটি তালিকা থেকে –
প্রথাগত সাহিত্য |
হাংরি সাহিত্য |
প্রাতিষ্ঠানিক | প্রতিষ্ঠানবিরোধী |
শাসক সম্প্রদায় | শাসকবিরোধী |
ভেতরের লোক | বহিরাগত |
এলিটের সংস্কৃতি | জনসংস্কৃতি |
তৃপ্ত | অতৃপ্ত |
আসঞ্জনশীল | খাপছাড়া |
লোকদেখানো | চামড়া ছড়ানো |
জ্ঞাত যৌনতা | অজ্ঞান যৌনতা |
প্রেমিক | শোককারী |
নিশ্চল | তোলপাড় |
ঘৃণার ক্যামোফ্লোজ | খাঁটি ঘৃণা |
আর্ট | জনগন |
শিল্প | জীবন সমগ্র |
রবীন্দ্রসঙ্গীত | যে কোনো গান |
শিষ্ট ভাষা | গণভাষা |
দায়মুক্ত | দায়বদ্ধ |
ফ্রেমের মধ্যে | ফ্রেমহীন |
উদাসীন | এথিকস আক্রান্ত |
মেইনিস্ট্রিম | ওয়াটারশেড |
কৌতুহল | উদ্বেগ |
ক্ষমতাকেন্দ্রিক | ক্ষমতাবিরোধী |
এন্টারটেইনার | থটপ্রোভোকার |
আত্মপক্ষ সমর্থন | আত্ম আক্রমণ |
আমি কেমন আছি | সবাই কেমন আছে |
ছন্দের একাউন্টটেন্ট | বেহিসেবি ছন্দ খরচ |
কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা রিভাইজ | জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ |
কল্পনার খেলা | কল্পনার কাজ |
আনন্দ | উৎকণ্ঠা |
হাংরি আন্দোলনের কোনো হেড কোয়ার্টার, হাইকমান্ড, গভর্নিং কাউন্সিল ছিলো না। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে আন্দোলনকে সবখানে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। হাংরি জেনারেশন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় দারুণ আঘাত হেনেছিল। প্রতিঘাতে তাদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। প্রথম ধাক্কাতেই ৬৫ সালেই আন্দোলন মূলত একপ্রকারে স্থিমিত হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৬৪ এর সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সমীর রায়চৌধুরী। এই একই অভিযোগে উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলেও তাঁরা প্রেপ্তার এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। হাতে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো-করা হয়েছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা। এরপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় ছাড়া বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দেয়া হলো। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছিলো যে সাম্প্রতিক হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। কবিতাটির প্রথম কয়েক লাইনঃ
মলয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলো শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী হয়েছিলেন বলে। এরপর আদালতে তোলা হলে হাংরি বুলেটিনের লিডার শক্তি চট্টোপাধ্যায় সাক্ষ্য দিলেন মলয়ের বিপক্ষে, অন্যদিকে পক্ষে সাক্ষী দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আদালতে সুনীল বলেছিলেন, কবিতাটিতে তিনি কোনো অশ্লীলতা পাননি। ফলে নিম্নআদালতে সাজা হবার পরেও উচ্চআদালতের দেওয়া রায়ে ১৯৬৭ সালে খালাস পেয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। ওদিকে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিলো তাদের কারো কারো চাকরি চলে গেলো, কয়েকজনকে করা হলো বদলি। ফলে একপ্রকারে বন্ধ হয়ে গেলো হাংরি আন্দোলন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত অনেকবার এই আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের শেষদিকে উত্তরবঙ্গ ও ত্রিপুরার কবিরা আবারও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও তাত্ত্বিক ভিত্তি ঠিকমত না জানায় তারা এগোতে পারেননি। এই শতাব্দীতেও কয়েকবার বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে হাংরি বুলেটিন। দুইহাজার আঠারো সালে এসেও অনেক তরুণ হাংরি জেনারেশন থেকে প্রভাবিত হয়ে কবিতা লিখে চলেছেন। প্রকাশ হয়েছে হাংরি আন্দোলনকে নিয়ে একাধিক বই।‘ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায় সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও’
হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলে ভূমিকম্পের মতো। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্হ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা।’’
ষাটের দশকেই এই আন্দোলন একভাবে থমকে গেলেও এইধরণের সাহিত্য রচনার প্রয়োজন এখনও ফুরায়নি। মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতা এসব শুধু টার্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মতপ্রকাশের অধিকার আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। এখনকার এই প্রচলিত সাহিত্যচর্চা সমাজকে কতোটা পরিবর্তন করতে পারছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বস্তুত সেই থ মেরে থাকা অবস্থা সাহিত্যে আজো কাটেনি, সাহিত্য এখনও কর্পোরেট দাসত্বে আটকে আছে। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় লেখকের স্বাধীনতা এখন খাঁচায় বন্দী। সর্বপরি সাহিত্যের বর্তমান সরলরৈখিকতাকে ভেঙ্গেচুরে ফেলতে এরকম আরো আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে জরুরী ।
No comments:
Post a Comment