শিল্প-সাহিত্যের তাত্ত্বিক আন্দোলনগুলোকে সরলরেখায় ফেলে বিবেচনা করলে ভুল হবে না। কারণ, এ বঙ্গ তথাকথিত সভ্য হওয়ার আগে ইজমনির্ভর সাহিত্য আন্দোলনগুলো অনেকটাই ইউরোপ থেকে আমদানি করা হয়েছে। মূলত এ সব আন্দোলন সময়তাড়িত। আর এ সরল রেখায় যুক্ত হয়েছিল ৪৭-পরবর্তী উপনিবেশ-নির্ভর সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস। ওই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় দেখা মেলে ব্যক্তি-প্রজ্ঞার ব্যবহারের।
ইশতাহার প্রকাশ করে প্রচলরীতির বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যে হাংরি আন্দোলনের জন্ম। এই আন্দোলনও তত্ত্বনির্ভর ছিল। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত। আর এই আন্দোলনের পুরোধা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়। আন্দোলনের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায়। হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়িয়ে রাজনীতি, ধর্ম, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবিআঁকা, সংস্কৃতি নিয়ে পরিহাস করা শুরু করেন। ৬১ থেকে শুরু করে ৬৫ পর্যন্ত যার ব্যপ্তি ছিল। সাহিত্য নির্ভর আন্দোলনের ধারণাটি নতুন করে এ প্রজন্মের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সামান্য বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় কলকাতার তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সিনেমা ‘২২শে শ্রাবণ’-এ। ষাটের দশকে ঘটে যাওয়া হাংরি আন্দোলনসৃষ্ট ‘২২ শে শ্রাবণ’ সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা। হাংরি আন্দোলন ইশতাহারের মূল বিষয় ছিল, কবিতাকে প্রচলিত ফরমেট ভেঙে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহৃত হবে, ছন্দ মানা হবে না, এমনকি প্রচলিত মূল্যবোধকেও ভেঙে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হবে। সে রকম থিম নিয়েই ‘২২ শে শ্রাবণ’ চলচ্চিত্রটিও নির্মিত। এছাড়া এ ছবিতেও রয়েছে অসংলগ্ন সংলাপ, অনিয়ন্ত্রিত আচরণ দেখানো হয়েছে।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশিথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি;
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি;
আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কলকাতা। শহরের ফুটপাত ধরে জীবনানন্দের শব্দগুলো ছড়িয়ে পড়ছে আক্ষেপের সুরে। যেখানে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তীর মানসিক বিকারগ্রস্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, সময়ের ফেরে কিভাবে শেষ হয়ে যায় শিল্পের চাহিদা। কেউ যেন ভুল না ভাবেন যে, আমি বলছি, ফুরিয়েছে কবিতার চাহিদা। বলছি, যাপিত জীবনে সমাজের অব্যবস্থপনাগুলোর বিরক্তি প্রকাশ হয় কেবল দীর্ঘশ্বাসের মধ্যদিয়ে। পরিচালক পুরো সিনেমাটির মাঝে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তৎকালীন ও সমকালীন পোর্স্ট মডার্নাইজেশনের প্রভাব-পরিণতি। এককথায় বলাই যায়, সিনেমাটি হচ্ছে বাণিজ্যিক আবহের মাঝে অতীত-বর্তমানের যোগসূত্র খুঁজে নেওয়ার সামন্য চেষ্টা মাত্র।
সময়ের প্রয়োজনে ষাটের দশক নয়, বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই ফুটে উঠেছে সিনেমায়। সাইকোলজিক্যাল-ক্রাইম থ্রিলার এই সিনেমায় কলকাতা শহরে একের পর এক ঘটে যাওয়া নির্ভুল ছাপহীন নির্মম হত্যাকাণ্ড, খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সাধারণ কিছু প্রেমের গল্প যোগ করেছে রোমাঞ্চ। ফলে বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শককে দেওয়া হয়েছে একটি কমন গ্রাউন্ড।
অল্পকথায় সিনেমাটি দেখে ফেলি আগে। একদিকে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী একের পর এক লিখে যাচ্ছেন কবিতা। গভীর রাতে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেলফোনে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলছেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত অপরাধী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কোনো এক বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিংও একসময় এই কবির দিকেই আঙুল তুলে ধরে।
অন্যদিকে প্রবীর রায় চৌধুরী নামের বরখাস্ত হওয়া রগচটা-মেধাবী পুলিশ অফিসারের সহযোগী হয়ে আরেক রগচটা পুলিশ অভিজিত পাকরাশী খুনির পেছনে তাড়া করছেন নিজের তৈরি কিছু যুক্তি নিয়ে। প্রবীর রায় চৌধুরীর জীবনে স্ত্রী-পুত্র হারানোর বেদনা থাকলেও সেই বেদনার প্রভাব তার কর্মে পড়ে না বলেই দাবি তার।
তবে ক্রাইম থ্রিলারে চটকদার নারী টিভি সাংবাদিকের উপস্থিতি দিয়েছে থ্রিলারের মধ্যে রোমাঞ্চের অনুভূতি। যেটি দর্শক ধরে রাখার একটু কৌশল। দেখা যায়, প্রতিটি খুনের পাশে একটি করে কবিতা, বিকারগ্রস্ত কবিকে হত্যাকারী সাজাতে সহায়তা করেছে যথেষ্ট। তবে হতাশাজনক হলেও সত্য, হাংরি মুভমেন্ট নির্ভর করে সিনেমার কেন্দ্র হলেও কোনো চিরকুটে পাওয়া যায়নি, ওই বিষয়ক কোনো কবিতা। ফলে হাংরি আন্দোলনকে যুক্ত করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আসা যাক, মূলে গল্পের সঙ্গে দর্শনগত রকম ফেরে। একেক জন অকাল প্রয়াত কবির মৃত্যবার্ষির্কীতে একটি করে হত্যা। অতপর সেই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা। সেই হিসাবে চারটি খুনের পর আসে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যুদিবসে খুনির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সিনেমা প্রায় শেষ।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যুদিবসে খুনির মৃত্যুর পরেই কাহিনি সমাপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। সিরিয়াল কিলিং সমস্যার সফল সমাধানে আবার পুলিশ বাহিনীতে মর্যাদার সঙ্গে প্রবীর রায় চৌধুরী আসীন হওয়ায় গল্প শেষ হতে পারত, কিন্তু শেষ না হওয়ায় বোঝা গেল, শেষটা এখনো বাকি। মূলত, পরিচালক এখানেই দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মূল প্রশ্নটি।
সিনেমার পুরোটায় কোনো ক্লু ছিল না—অথচ সিনেমার শেষপ্রান্তে এসে প্রবীর উদ্যোগী হয়ে জানালেন, আজ ২২ শ্রাবণ। সুতরাং আজ আরও একটি হত্যাকাণ্ড হতে যাচ্ছে। একে একে প্রবীর বলে চললেন, নিজের ক্ষোভগুলো কিভাবে ঝেড়েছেন সমাজের ওপর। পরিচালক সেই রহস্যটি প্রকাশ করেছেন সিনেমার এ অংশে।
একজন সৎ পুলিশ অফিসার, যিনি কিনা যেকোনো মূল্যে শেষ করতে চান সন্ত্রাস, তার কাজের জন্য হারাতে হয়েছে পরিবার আর পদবি। ক্ষোভ থেকে এ হত্যাগুলো পরিকল্পিতভাবে এমন আঙ্গিকে করেছেন যেন স্বয়ং পুলিশ ডিপার্টমেন্টকেই তার শরণাপন্ন হতে হয়।
প্রশ্ন জাগে মনে, পরিচালক কি হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার অনুকরণে সাধারণের মনে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন—দীর্ঘস্থায়ী ভালো কিছুর জন্য সাময়িক বিচ্যুতির প্রয়োজন আছে কি না?
পরিণতি অজানা। কারণ, হাংরি আন্দোলনে যেমন দিক নির্দেশনা ছিল প্রথাবিরোধী নতুন সাহিত্য সৃষ্টির, একইভাবে সিনেমায়ও অন্যায় দিয়ে অন্যায় ঠেকানোর এ কৌশলও গ্রহণযোগ্য কি না, তাও বিবেচ্য। ২২ শ্রাবণ প্রবীরের আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে পরিচালক এ প্রশ্নটি রেখে গেছেন সবার জন্য।
No comments:
Post a Comment