অনুপম মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে ১টি পুনরাধুনিক কাজ
এই মুহূর্তে, অর্থাৎ ২০১৯-এর পশ্চিমবঙ্গে এই যে উত্তপ্ত মে মাস চলছে, লোকসভা নির্বাচনের দামামাকে দূরাগত ঢক্কানিনাদ মনে হচ্ছে, যেন আমরা যে ট্রাইবের অন্তর্গত তার বিরাট পরবটি এসে পড়েছে, ঠিক এখনই, এই ভূতের নাচের মধ্যে, অশীতিপর মলয় রায়চৌধুরীকে আমার ভারতের একমাত্র বাংলাভাষী আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক বলে মনে হয়। আজ তিনিই একমাত্র জীবিত আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ভারতীয় বাংলা ভাষায়। এটা আবেগ থেকে বলছি না। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকেও বলছি না। এটা ঘটনা। ষাটের দশক থেকে আজ অবধি মলয় রায়চৌধুরীর সারাজীবনের সাহিত্যিক কাজকর্ম দেখলেই সেটা বোঝা যাবে। এই মুহূর্তেও তিনি প্রচুর লিখছেন, কিন্তু, মৃত্যুচেতনার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করছেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে এই বয়সে এসে একরকম অনিশ্চিত হতাশাও হয়ত তাঁকে ঘিরেছে। কিছুদিন আগে আমাকে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে লিখেছেন- ‘আমাকে নিয়ে তো কেউ লেখে না! কী হল এত লিখে?’ এই জিজ্ঞাসার ন্যায্য হতাশা হয়ত শেষ জীবনে সবারই প্রাপ্য থাকে। যদি খুব ভুল না করে থাকি, রবীন্দ্রনাথও তাঁর শেষ জীবনে এই বোধটা থেকে মুক্তি পাননি। এটা বাংলাদেশ। এখানে বড় গাছগুলোকে আগাছারা আড়াল করতে পারে, কী করে পারে সেটা একটা দীর্ঘ প্রবন্ধের বিষয় হতে পারে, এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
তাছাড়া এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি পচে যাওয়া মাখনের মতো। তার বিশ্লেষণ হয়, কিন্তু ব্যাখ্যা হয় না। মলয় রায়চৌধুরীও সেই ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে অসফল। তাই, যেটা তাঁর সফলতা, শেষ অবধি সেটা তাঁর কবি আর গল্পকার সত্বার জয়। প্রাবন্ধিক মলয়ের নয়। মলয় রায়চৌধুরী সেই ধুরন্ধর সাহিত্যিক যিনি জানেন সারা পৃথিবীতে কী লেখা হয়েছে, কী লেখা হচ্ছে, এবং সেই অনুসারেই তিনি জানেন আর কী লেখা যেতে পারে। কোন লেখা তাঁর অপেক্ষায় আছে, লিখতে বাকি আছে, এই মোক্ষম সচেতনতা ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি সাহিত্যিকদের অনেকের মধ্যে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ছিল, কারণ তখন কলকাতা ছিল পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, উপমহাদেশের রাজধানী, সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-ডিরোজিও-মাইকেল-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের শহর, তখন সারা ভারতের মধ্যে কোনো চিন্তা প্রথম জাগ্রত হত বাঙালির ধূসর পদার্থে। আজ যা পরিস্থিতি, মলয় রায়চৌধুরীর মতো একজন লেখকের লেখা বোঝার লোক খুব কমে গেছে। তিনি জনসাধারণের জন্য লেখেন না, এটাই যদি সাধারণ চিন্তা হয়, সেটা আমি মেনে নিতে পারি না। মলয়ের কবিতার মধ্যে ‘পিপল’স পোয়েট’ হয়ে ওঠার শক্তি এখনকার যে কোনো কবির চেয়ে বেশি। মানুষ যে তাঁর কবিতা পড়ল না, তার একমাত্র কারণ তাঁর কবিতাকে মানুষের কাছে যেতে দেওয়া হল না। তাঁর উপন্যাস বেস্ট সেলার লিস্টে পাকাপাকিভাবেই থাকত, যদি তিনি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাথা বিকোতেন, অথবা, প্রতিষ্ঠান তাঁর জন্য নিজের দিশা বদলাত, যদি তার আদৌ কোনো দিশা থেকে থাকে।
আজ সেই লংকা নেই, কারণ অন্যরূপে রাবণ থাকলেও তার দশ মাথা নেই, অথচ যেদিকে তাকাবেন দেখবেন রাবণ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে, এই হয়ত মলয় রায়চৌধুরীর ব্যাখ্যাকৃত পোস্টমডার্ন পরিসর। যদিও, আমার মতে, যেমন আমি আমার পুনরাধুনিক বিষয়ক গ্রন্থে দেখিয়েছি, এই পরিসর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই কলকাতায় এসে পড়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী সেটাকে শনাক্ত করেন নব্বইয়ের দশকে, কিন্তু এমনভাবে করেন যেন সেটা সেই মুহূর্তেই প্রকটিত হল। জীবনানন্দ দাশ বা সমর সেনই যে তিরিশের দশকেই বাংলা কবিতার পোস্টমডার্ন এনে ফেলেছিলেন, মোটেই ৯০ দশকীয় কোনো পত্রিকার কাজ সেটা নয়, এটা কেন বলে ওঠেননি, আমার কৌতূহল আছে। ষাটের দশকে মলয়েরই নেতৃত্বাধীন হাংরি আন্দোলন কি প্রথম পোস্টমডার্ন সাহিত্য আন্দোলন নয় বাংলা ভাষার? অবিশ্যি পোস্টমডার্নে কোনো নেতা তো থাকতে পারে না। তাতে আর অসুবিধা কোথায়? ওই আন্দোলনের অন্তর্ভুক্তজনেদের মধ্যে অধিকাংশই তো মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁদের নেতা আজ আর মানেন না, তাঁকে হেয় করেন, তাঁদের কার কারও সন্তানরাও মলয়ের প্রতি বিদ্বিষ্ট, এমনকি এমন অনেকেই আছেন যাঁরা মলয়কে হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস থেকে বাদ দিয়ে স্বস্তি পেতে চান। শ্রীকৃষ্ণকে বাদ দিয়েই কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে, সেই চেষ্টাটাও ভেরি মাচ পোস্টমডার্ন, তাই নয় কি? হাংরি আন্দোলনের শত্রুরাই আজ ঠিক করে দিচ্ছে হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস, এ এক প্যারাডক্স। আবার এটাও ঠিক, মলয় এগুলো নিয়ে না ভাবলেই পারেন। হাংরি আন্দোলন নিয়ে তিনি এই ২০১৯-এও বেশ অবসেসড্। ৫০ বছর আগে ফেলে আসা আন্দোলনটিকে তিনি আজও ভুলতে পারেননি। নিজেই ব্লগ বানিয়ে তার আর্কাইভ করেন। আজও হাংরি নিয়ে গদ্যের পর গদ্য লেখেন। এই অবসেসন তাঁর সাম্প্রতিক সাহিত্যকর্মে কিছুটা হলেও ছায়া ফেলে থাকবে, এমন আশঙ্কা মাঝেমধ্যে আমার মাথায় এসেছে। আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে তিনি কি কিছুটা পটাতে চাননি এই একটা ব্যাপারে? এই একটাই ব্যাপারে?
দিল্লিতে ভারতের রাজধানী চলে যাওয়ার পরে, দেশভাগের দ্বারা বাঙালিকে ২ টুকরো করে দেওয়ার পরে, কংগ্রেস-নকশাল-সিপিএম-মাওবাদ-তৃণমূল-বিজেপি বিন্দুগুলিকে স্পর্শ করে করে আজ বাঙালি ভারতের একটি প্রান্তিক রাজ্যের অবহেলিত ফতুর জনসাধারণে পুনরায় রূপান্তরিত হয়েছে, পলিটিক্স সাহিত্য আর সংস্কৃতির দিক থেকে বাঙালি আজ অধঃপতিত হয়েই চলেছে, যেমন অবস্থায় সে প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে ছিল, কোনো মোগল সম্রাটের তখন বাংলাদেশে পা রাখার প্রয়োজনই হত না, আজ পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রীয় মূল্য ৪২টা লোকসভা আসনেই চুকিয়ে ফেলা যাচ্ছে। তার ফলেই সিনেমা বা সাহিত্যের চেয়ে পলিটিক্স আজ অনেক বেশি অন্তঃসারশূন্য ও দক্ষিনী সিনেমার চেয়েও এন্টারটেইনিং। মন খারাপ হলে মুখর নেতা বা মুখরা নেত্রীর স্ট্যান্ড আপ কমেডি ভিডিও দেখে নেওয়া যাচ্ছে ইউটিউবে গিয়ে, এবং হা হা হো হো করে নেওয়া যাচ্ছে। মলয় রায়চৌধুরী এটাকেই পোস্টমডার্ন পরিসর বলবেন, যথার্থই বলবেন, কিন্তু এই পরিসর তাঁকেও যথেষ্ট হেনস্থা করছে, কারণ, তাঁকে এখানে অনেকেই বুঝতে পারছে না, না বুঝে রিঅ্যাক্ট করছে, বুঝেও চুপ করে থাকছে, তাঁরই ব্যাখ্যা করা পরিসরে তিনি স্বয়ং কি যথেষ্ট বেমানান নন? সেটা না হলে তিনি বড় নন।
মলয় রায়চৌধুরীর স্বাভাবিক বিরোধাভাসটা এই যে, তিনি নিজেকে ছোটলোক ইত্যাদি দাবি করেও, বাঙালির সামগ্রিক হড়কে যাওয়ার কবন্ধ শরিক হননি, বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক খুড়োর কলে নিজেকে জুড়ে ফেলেননি, বরং নিজেকে সারা পৃথিবীর সাপেক্ষে জায়মান লেখক করে তুলতে পেরেছেন। তাঁর উপন্যাস এবং কবিতা এবং প্রবন্ধকে প্রাদেশিক চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়া যায়। এটা এই মুহূর্তে জীবিত দ্বিতীয় কোনো বাঙালি সাহিত্যিক সম্পর্কে আমি বলতে পারছি না। এটা আমার অজ্ঞতাপ্রসূত হলেও, দৃঢ় ধারণা, এবং কোনো প্রশংসাবাক্য নয়। একজন লেখকের জীবনে প্রায়ই এটা ঘটে যে, তিনি নিজের জন্য একটি লাগসই ভাবমূর্তি বেছে নিলেন, কিন্তু নিজেকে সেই মাপে ঢালতেই পারলেন না। মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। তিনি নিজেকে বিহারের ইমলিতলা থেকে উঠে আসা ছোটলোক হিসাবে পেশ করতে চাইলেন, কিন্তু হাড়ে হাড়ে বোঝা গেল এই লেখকটি সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশপরিচয়েই অধিক মানানসই, কারণ, মলয়ের মধ্যে যে আভিজাত্য আছে, যে আত্মসচেতন উদাসীনতা আছে, তা গত ১০০ বছরের বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট দুর্লভ, তাঁর মধ্যে অস্তিত্বের উৎকণ্ঠা থাকলেও বাংলা বাজারের ইতরতা নেই, প্রান্তিকতা যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা স্বরচিত। তাঁর আচরণের মানবিক স্তরটিতে আছে এক আশ্চর্য খেঁকুরেপনা, অমরত্বের অদ্ভুত উদাসীন বাসনা আর দুর্দান্ত সেন্স অফ হিউমারের মিশ্রণ, যেটা তিক্ত যোদ্ধাকে মানায়, ব্যর্থ প্রেমিককে মানায়, প্রতিষ্ঠার ভিখারী বা প্রতিষ্ঠানের দালালদের কিন্তু মানায় না। মলয় নিছক ছোটলোক নন। তিনি একজন অভিজাত ছোটলোক। ছোটলোক অভিজাত নন। বলা বাহুল্য এখানে আমি জাতপাতের কথা বললাম না।
মলয় রায়চৌধুরী যে শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায় বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের চেয়ে ঢের বড় মাপের সাহিত্যিক এটাও মুক্তকন্ঠেই বলতে চাই। কারণ এঁদের মতো তিনি বিগত শতাব্দীর কবিলেখক নন। তিনি একবিংশ শতাব্দির সঙ্গে তুমুলভাবে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, তাঁর উপন্যাস থেকে বাংলা সিরিয়াল হবে না। সিনেমাও হওয়া মুশকিল। তাঁর কবিতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত আবৃত্তি করা চলবে না। মলয় মেজর সাহিত্যিকের ধারণাকে অস্বীকার করেন, সেটা তাঁর কিছুটা গড়ে তোলা এবং কিছুটা আমদানিকৃত তত্ববিশ্বের ব্যাপার। আমি মলয় রায়চৌধুরীর তত্বকে মলয়ের কবিতা আর উপন্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা খুব জরুরি মনে করি না। আমি মেজর সাহিত্যিকের ধারনায় কঠিনভাবে বিশ্বাস করি, এবং, মলয় রায়চৌধুরীকে একজন যথার্থ মেজর সাহিত্যিক বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বলেছিলাম কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল না, বাঙালি কাউকে দিতেই হলে ওটা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে দেওয়া যেত। আমার এই উক্তিতে ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ে যায়, এবং অনেকের দ্বারা আক্রান্ত হই। তাঁদের মধ্যে একজন বদমেজাজি সম্পাদক বলেছিলেন আমি মলয় রায়চৌধুরীর নাম কেন করলাম না জ্ঞানপীঠের যোগ্য প্রাপক হিসেবে। সম্ভবত এই উক্তি যিনি করেছিলেন আমাকে তিনি মলয় রায়চৌধুরীর নিকটস্থ গুণমুগ্ধ একজন ঠাউরেছিলেন এবং ভেবেছিলেন মলয়ের নাম না করাটা আমার অবস্থানের ভণ্ডামি ধরিয়ে দেবে। মজার ব্যাপার হল, সেদিন দেখলাম মলয় রায়চৌধুরী ওই ব্যক্তির ওই উক্তিকে নিজের ব্লগে সযত্নে জায়গা দিয়েছেন, অর্থাৎ গুরুত্ব দিয়েছেন, যদিও নিজে কোনো মন্তব্য করেননি।
আজ এই লেখায় স্পষ্ট বলতে চাইব, মলয়কে আমি এই মুহূর্তের বাংলাভাষায় একমাত্র আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক মনে করলেও শুধু জ্ঞানপীঠ কেন অন্য যে কোনো ভারতীয় পুরস্কারের প্রাপক হিসাবেই মলয়ের নাম কল্পনা করতে পারি না। পুরস্কার সর্বদাই উপর থেকে আসে, এবং হাত পেতে সেটা নিতে হয়। সেই পুরস্কারই নেওয়া চলে যেটার উচ্চতা লেখকের চেয়ে বেশি, এবং সেটায় তাঁর কোনো গ্লানি নেই। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজে মানায়, রবীন্দ্র পুরস্কার তাঁর নেওয়া চলে কি? জ্ঞানপীঠও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মানাত, তিনি পেয়েওছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানাত না। মলয় রায়চৌধুরীকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার দেওয়ার অর্থ তাঁর স্তরকে মাঝারিয়ানায় নামিয়ে এনে তাঁর জায়মানতাকে খতম করে দেওয়া। মলয়ের মতো সাহিত্যিকরা পুরস্কৃত হতে জন্মান না। পুরস্কার তাঁদের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দ্যায়। যে কোনো সাহিত্যিকেরই বারোটা বাজায় একটা প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার, কিন্তু তাতে সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের খুব একটা ক্ষতি হয় না। মলয় রায়চৌধুরীকে পুরস্কৃত করলে, কোনো সাহিত্যসভায় ধরে নিয়ে গিয়ে ফিতে কাটালে, কোমর নুইয়ে প্রদীপ জ্বালালে মলয়ের ব্যক্তিগত ক্ষতি কী হবে সে তো বললামই, বাংলা সাহিত্যের অনেক কিছুই ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে, সেই বিচ্ছিরি জট আর খোলা যাবে না।
প্রতাপশালী কোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া মুকুট পরলেই যে ওঁর মাথাটি হাতছাড়া হয়ে যাবে, মলয় সেটা নিজে খুব ভাল জানেন। যে কোনো মুকুটই আসলে একটি সাব্লিমেটেড টুপি। উনি যদি কাউকে মাথা কেটে পাঠান, সেটা প্রেমের উপহার হবে, লোভের নয়। সম্প্রতি ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে উনি লিখেছেন- ‘প্রতিষ্ঠান কখন আপনাকে টুপি পরিয়ে দেবে আপনি বুঝতেই পারবেন না।’ সম্ভবত এই উক্তি উনি শৈলেশ্বর ঘোষের প্রসঙ্গে করে থাকবেন, এটা আমার অনুমান, কারণ মাথায় শীতের টুপি পরে প্রয়াত শৈলেশ্বর ঘোষ কোনো একটা সাহিত্যমেলা উদ্বোধন করছেন, এমন একটা ছবি সেই সময়ে ফেসবুকে ভেসে উঠেছিল। মলয় এভাবেই খোলাখুলি কথা বলতে পারেন এই বৃদ্ধ বয়সেও, এমনকি, নিজের তথাকথিত রাইভ্যালদের নিয়ে খিল্লি করতেও উনি কোনো দ্বিধা দেখান না। আমার মনে হয়, এটা শিক্ষণীয়। সোনার হরিণের প্রতি এই বেপরোয়া সাহিত্যিকের কোনো লোভ নেই, কারণ তিনি জানেন সোনার হরিণ হয় না, সেটার পিছনে অবশ্যই কোনো মায়াবী ফাঁদ লুকিয়ে থাকে, অনেক বড় কিছু কেড়ে নেওয়ার জন্য। বঙ্কিম পুরস্কার, আকাদেমি পুরস্কার পেয়ে মলয়ের আখের কিছুই গোছানো হবে না। যেটার প্রতি ওঁর আসল লোভ, সেই ইতিহাস তাহলে ভড়কে যাবে। মলয় তাই নিজেকে ইতিহাসে রাখার দায়টা নিজেই নিয়েছেন, এবং ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করে নিতে। ইন্টারনেটকে মলয় রায়চৌধুরী যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা শিক্ষণীয়। এটা তাঁর কাছে বাঙালির শেখার আছে।
একটা কথা মলয়ের বিরোধিরা প্রায়ই বলে থাকেন, যে মলয় খুব আত্মপ্রচার করেন। নিজের ব্লগ, নিজের উইকিপিডিয়া, নিজের সমস্ত লেখার সংরক্ষণের ব্যাপারে উনি সর্বদা যত্নশীল। নিজের লেখা নিজেই গিয়ে লোককে পড়তে বলেন। নিজের লেখার লিংক কেউ না চাইলেও তার ফেসবুক টাইমলাইনে গিয়ে পোস্ট করে আসেন। বলা বাহুল্য, একজন কিংবদন্তি সাহিত্যিকের কাছে বাঙালি এই আচরণ আশা করে না, এটা বাঙালির অভ্যাস আর প্রত্যাশার বাইরের ব্যাপার। আমি আগেই বলেছি মলয় রায়চৌধুরী অমরত্বের বাসনা রাখেন, ইতিহাসে থাকতে চান নিজের মর্জি অনুসারী ইমেজে। সেটাকে লোভ বললেও কি খুব খারাপ হয়? আমার মতে, মলয়ের অতীতচারিতা অর্থাৎ হাংরি-অবসেসন যদি বাদ দিই, একজন সাহিত্যিকের অমরত্বের বাসনা, যশের আকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত, সে বঙ্কিম যাই বলে থাকুন, সাহিত্যক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সফলতার লোভ খুবই প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। লেখক কোনো সন্ন্যাসী তো নন! কাম ছাড়া যেমন পরিবার হয় না, ক্রোধ ছাড়া যুদ্ধ হয় না, সঠিক লোভ ছাড়া একজন শিল্পীর অগ্রগতি হয় না। ‘অগ্রগতি’ শব্দটাও মলয় রায়চৌধুরীর তত্ববিশ্বে বেমানান। কিন্তু আমার প্রিয়। পরিমিত ও সুনির্বাচিত লোভের দিকে একজন স্রষ্টা এগোবেন, এটা আমি সমর্থন করি। সেই লোভ বাঘের, তাজা রক্ত আর গরম মাংস নিজের সামর্থে লাভ করার, সেই লোভ হায়নার নয় যে যে কোনো একটা মৃতদেহ হলেই চলে যাবে। কেন একজন লেখক তাঁর লেখা একজন পাঠকের সামনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেবেন না? কেন একজন পাঠককে শিকার করবেন না তিনি! বাঘ যেভাবে তার হরিণকে ধরে, একজন লেখকেরও কাজ তাঁর পাঠককে ধরা, দাঁত এবং নখের সার্বিক প্রয়োগ করে। সভ্যতা ভব্যতা প্রোটোকল এসব ছাপোষা আর ক্রীতদাসদের মানায়, কবিকে নয়।
এবং মলয় জানেন, তিনি হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ হলেও, তাঁর উপরে অজস্র লেখালেখি হলেও, গবেষণা হলেও, তাঁকে নিয়ে কাজ করে পিএইচডি নিয়ে কেউ কেউ ঘুরে বেড়ালেও, তিনিই স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলখাটা কবি হলেও, সাধারণ বাঙালি তাঁর নামই আজ অবধি জানে না। তারাই মলয়ের নাম জানে যারা স্বয়ং লেখালেখি করে, অথবা বাংলা সাহিত্যের হার্ডকোর পাঠক। আজ থেকে প্রায় বছর পনের আগে আমি প্রথম মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপিত হই একজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে বিশেষ দরকারে ফোন করতে গিয়ে রং নাম্বার ডায়াল করে ফেলায়। মলয় বুঝতে পেরেছিলেন আমি কাকে ফোন করতে গিয়ে তাঁকে ফোন করেছি। কিন্তু আমি লজ্জিত হলেও, তিনি রাগ করেননি। বরং সাগ্রহে আমার মতো একজন আনকোরা ছোকরাকে জানিয়েছিলেন তাঁর নাম মলয় রায়চৌধুরী, এবং ‘তিনিও’ লেখালেখি করে থাকেন। আমার মনে হয়েছিল নিজের এই পরিচয় তাঁকে দিতে হয়, নিজের পরিচয় নিজেই দিতে তিনি অভ্যস্ত, কারণ তাঁর সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় করে দেওয়ার এজেন্সি তাঁর কাছ থেকে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নেয়নি, তিনিও দেননি। এটা শিক্ষণীয়। আমি তাঁর কাছে এটা শিখেছি। আমি যে আজ নিজের ঢাক বাজাতে কোনো দ্বিধা করি না, কারণ আমিই প্রথম নই, আমার আগে মলয় আছেন। পোস্টমডার্ন মলয় নন। বাঘ মলয়।
No comments:
Post a Comment