কেন লিখি : মলয় রায়চৌধুরী
কেন লিখি ভাবনাটা আমার পক্ষে খাটে না । বলতে হবে কেন লিখতে শুরু করলুম । তার পৃষ্ঠপট হিসেবে আমার শৈশবের কথা বলতে হয় । আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ( ১১.জানুয়ারি ১৮৬৬ - ৮ আগস্ট ১৯৩৩) সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উত্তরপাড়া শাখার বংশধর হলেও জীবিকা আরম্ভ করেছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ও আর্টিস্ট হিসাবে; বেশির ভাগ সময় সপরিবারে কাটিয়েছিলেন আফগানিস্তান আর এখনকার পাকিস্তানে । হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দাদু পাটনায় মারা যান যার দরুন তাঁর ছয় ছেলে আর এক মেয়ের দায়ীত্ব বর্তায় ছেলেদের ওপর, যাঁরা কেউই স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পাননি। দাদু ফারসি, আরবি, সংস্কৃত জানতেন । দাদুর মৃত্যুর পর বাবা রঞ্জিত ( ১৯১২ - ১৯৯১ ) পাটনায় ফোটোগ্রাফি এবং তা থেকে তৈলচিত্র আঁকার ব্যবসায় আরম্ভ করেন । ভাইরা সবাই মিলে স্ত্রীর গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে পাটনার এক বস্তিতে বাড়ি করেন । মানে, আমি ছিলুম ইমলিতলা পাড়ায় কুড়িজনের একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য । ইমলিতলা পাড়া ছিল গোলটালির চালাবাড়ি-ঘেরা বিহারি নিম্নবর্ণের অতিদরিদ্র পরিবার ও লখনউ নবাবের হারেমের গরিব শিয়া বংশধর অধ্যুষিত, যারা একই পোশাকে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতো । পাড়ার লোকেরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, বিড়ি তৈরি, দুধ বিক্রি, ডিম আর ছাগলবাচ্চা বেচে সংসার চালাতো । জাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন ছাড়া আমরা ছিলুম দুই ভাই । বড়োজেঠা দেড়শো টাকা দিয়ে এক বেশ্যার কাছ থেকে একটি শিশু কিনেছিলেন, সে ছিল আমাদের মেজদা, পাড়ার প্রভাবে গুণ্ডা হয়ে ওঠে আর কম বয়সে মারা যায়। ইমলিতলা পাড়ায় আমরা বাল্যকাল থেকে ইঁদুর-পোড়া, শুয়োর ও গোরুর মাংস, ছাগলের নাড়িভুঁড়ির বড়া, তাড়ি, দিশি মদ ও গাঁজা ফোঁকার সঙ্গে পরিচিত হই ।
পাটনার সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা কেউই ইমলিতলায় আসতেন না ; আমার স্কুলের সহপাঠীরাও আসতো না, তার কারণ ইমলিতলা পাড়ার কুখ্যাতি । ফলে, আমরা ছিলুম বঙ্গসংস্কৃতির বাইরের মানুষ এবং আমাদের মনে করা হতো ‘ছোটোলোক’ । অর্থাৎ শৈশব থেকেই প্রতিষ্ঠানের মোকাবেলা করতে হয়েছে। পাটনায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর দাদাকে কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, যাতে ইমলিতলার কুসংসর্গে ‘খারাপ’ না হয়ে যান । দাদা উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের খণ্ডহর-বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন । আমাদের বাড়িতে প্রথম স্কুল-কলেজে পড়া সদস্য ছিলেন দাদা । সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আর সিনেমা দেখাকে ইমলিতলার বাড়িতে মনে করা হতো অধঃপতনের নিদর্শন । ইমলিতলার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, কেননা বড়োজেঠা আর ঠাকুমা ব্রাহ্ম-বিরোধী ছিলেন । পাটনার বঙ্গসংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকরা সেসময়ে ছিলেন ব্রাহ্ম। কলকাতায় গিয়ে দাদা সমীর রায়চৌধুরী ( ১৯৩৩ - ২০১৬ ) প্রথমে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন এবং পরে ১৯৬১ সালে আমার সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেন ; নব্বুই দশকের প্রথম দিকে চাকুরি থেকে অবসরের পর দাদা কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন ।
আমিও ‘খারাপ’ হয়ে যাচ্ছি অনুমান করে বাবা দরিয়াপুর নামে পাড়ায় চালাঘর কিনে বাড়ি তৈরি করেন । আমরা সেখানে উঠে যাবার পর পাটনা শহরের বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে।
বস্তুত বঙ্গসংস্কৃতিতে জোর করে প্রবেশের জন্য আমি আর দাদা দুজনেই ইমলিতলার নিষেধগুলো উপেক্ষা করে সংবাদপত্র-নাটক-উপন্যাস পড়া আরম্ভ করেছিলুম । দাদা কলকাতা থেকে তিরিশের দশকের কবিদের বই আর খ্যাতিমান লেখকদের বই আনতেন । মায়ের জোরাজুরিতে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে ভর্তি করা হয় । এই স্কুলের গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্ররোচনায় আমি রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন ব্রাহ্ম ভাবুকদের বই বাড়িতে আনা আরম্ভ করেছিলুম । চাকুরিসূত্রে চল্লিশ বছর সারা ভারতের অজস্র গ্রাম ঘুরে-দেখে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দাঁত-নখ প্রয়োগের ক্ষমতার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় হয়েছে ।
বঙ্গসংস্কৃতিতে প্রবেশের আগল ভাঙার জন্য লেখালিখি জরুরি হয়ে গেল । বাবা একটা ডায়েরি দিয়েছিলেন । আমি তাতে মনের কথা লিখতুম । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর বুঝতে পারলুম যে কলকাতায় বিশেষ কিছু মানুষ নিজেদের মনে করেন বঙ্গসংস্কৃতির মালিক । সুতরাং কলকাতাতেও সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলা জরুরি হয়ে দেখা দিল । আমার লেখালিখি মূলত প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার আধার । আমি টাকাকড়ি, পুরস্কার, সম্বর্ধনা ইত্যাদির জন্য লিখি না । লিখি প্রতিষ্ঠানের ঠেকগুলোর দেওয়াল ভেঙে ফেলার জন্য ।
No comments:
Post a Comment