হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত : মলয় রায়চৌধুরী
নিজের ঢোল নিজে না পিটে বাংলা সাহিত্যের মহাফেজখানার কুবের সন্দীপ দত্তের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি । সম্প্রতি বীজেশ সাহা সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ১ জুন ২০২২ সংখ্যায় ‘পাঁচ ছয় দশকের কিছু পত্রিকা-কথা’ প্রবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কর্নধার সন্দীপ দত্ত, যাঁর লাইব্রেরিতে ভারতের ও বিদেশের নানা ভাষার লেখক-গবেষকরা পুরোনো বই-পত্রিকার খোঁজে যান, তাঁর রচনাটা পড়ে মনে পড়ে গেল । সন্দীপ দত্ত জানিয়েছেন, ড্যানিয়েলার মতোই, বাঙালি প্রবীণ সাহিত্যিকরা হাংরি আন্দোলনের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করলেও সর্বভারতীয় ভাষাগুলোয় ও বিদেশে বরেণ্য হয়েছিল এই আন্দোলন । বলা বাহুল্য যে ভারতের বিভিন্ন ভাষার পত্রিকা ও লেখকদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল কারণ প্রথমদিকের বহু লিফলেট-বুলেটিন পাটনায় ইংরেজিতে ছাপিয়েছিলুম । পত্রিকার তুলনায় লিফলেট বিলি করার মাধ্যমে হাংরি জেনারেশান আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল ।
সন্দীপ দত্তের প্রবন্ধটা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে দিচ্ছি :
“বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে হাংরি প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন । ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের মাধ্যমে যার সূচনা । স্রষ্টা, নেতৃত্ব ও সম্পাদক যথাক্রমে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায় । পত্রিকার চিন্তনভূমি পাটনা হলেও তার প্রকাশ স্হান ছিল ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া ; হারাধন ধাড়া বা দেবী রায়ের ঠিকানা । যদিও ছাপা হয়েছিল পাটনা থেকে ।
“মলয় রায়চৌধুরী তখন ২২ বছরের তরুণ, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ।কবি জিওফ্রে চসারের ( ১৯৩৯ - ১৪০০ ) In The Sowre Hungry Tyme পড়ে মলয় Hungry শব্দের অভিঘাতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । হাংরির পরিকল্পনা তখন থেকেই । সময়ের প্রেক্ষাপটটিও গুরুত্বপূর্ণ । সদ্য স্বাধীন দেশ । দেশভাগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় । দারিদ্র, ক্ষুধা, নিরন্ন মানুষ । বাংলা কবিতার হালও খুব খারাপ । ৩০ - ৪০-এর গতানুগতিক কবিতা নির্জীব হচ্ছে । ৫০-এর কবিরা সবে নিজেদের প্রকাশ করছে । নিজস্বভূমি আবিষ্কার হয়নি । শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় এলেন পাটনায় । মলয় শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা বলেন । প্রথম বুলেটিনে কবিতা বিষয়ক একটি ইশতাহার ইংরেজিতে ছাপা হলো ।
“১৯৬২ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলায় প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশ পায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ পায় । এইসব বুলেটিনে প্রকাশের কোনো তারিখ থাকতো না । নানা রঙের কাগজে, এমনকি মলাটের বাদামি কাগজেও বেরোতো এক সপ্তাহে ২৪টি আবার কখনও বছরে একটি হয়তো ।
“হাংরি সূচনাকালে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাত্র চারজন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী । এরপর একে একে যুক্ত হন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, অরুণেশ ঘোষ, সুবো আচার্য প্রমুখ ।
“ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে অস্বীকার ও প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখালিখিতে নতুন আবিষ্কারই প্রকৃত সাহসী ও মৌলিক পথ মানতো হাংরিরা । কৃত্তিবাস বা শতভিষা গোষ্ঠী হাংরি আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেনি । প্রবীণ সাহিত্যকাররাও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন হাংরিদের সম্পর্কে । সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে হাংরি গোষ্ঠী ।
“অথচ সর্বভারতীয় ভাষায় বরেণ্য হয়েছিল এই আন্দোলন । হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি তরুণ লেখকরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল । অন্য ভারতীয় ভাষার পত্রপত্রিকায় প্রভাব পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের । মারাঠি ভাষার লেখক অশোক সাহানে, দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলটকর প্রমুখ, তেলেগু ভাষায় নিখিলেশ্বর, নগ্নমুনি, জ্বলামুখী প্রমুখ । হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ হাংরি লেখকদের মূল্যায়ন করেন ।
“বহির্বিশ্বেও হাংরি আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ।
“১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে হাংরি জেনারেশনের একটি বুলেটিনকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগে মলয় রায়চৌধুরীসহ হাংরিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয় । ৪৮ শঙ্কর হালদার লেন, আহিরিটোলা, কলকাতা- ৫ থেকে ওই সংখ্যায় দশজন লেখক ও প্রকাশক সমীর রায়চৌধুরীর নাম পাওয়া যায় । লেখক তালিকায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ও সুবো আচার্য । এই বুলেটিনেই প্রকাশ পায় মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ।
“এই কবিতাকে কেন্দ্র করে অশ্লীল রচনার দায়ে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার বিরুদ্ধে লালবাজার প্রেস সেকশনের সাব ইন্সপেক্টর কালীকিঙ্কর দাস অভিযোগ আনলেন । শুরু হলো ধড়পাকড় । ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ধরা হলো ৬ জনকে । মামলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে । দীর্ঘ দিন মামলা চলল । ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয় । এই ১৯৬৫ সালেই হাংরি আন্দোলনের ইতি ঘটে । এই বছরেই ২৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে মলয় রায়চৌধুরীর সাজা হয় । পরে, ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে পিটিশন দ্বারা মামলা করার ভিত্তিতে, তাঁকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি দেয়া হয় ।
“আন্দোলনের কথা পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের TIME পত্রিকায় । এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা বিদেশে প্রচারিত হলো । প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি জেনারেশনের এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে একটি দীঘস্হায়ী ছাপ রেখে গেল ।”
সন্দীপ দত্তের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে আমাদের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বুলেটিন প্রকাশের মাধ্যমে । তখন ছাপানোর খরচও কম ছিল । পাঁচ টাকায় এক হাজার বুলেটিন ছাপিয়ে দেবী রায়কে পাঠিয়ে দিতুম আর দেবী রায় কলকাতার কফিহাউস, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকা দপতর ইত্যাদিতে বিলি করতো । ১৯৬২ থেকে বাংলায় বুলেটিন ছাপাবার জন্য আমি দেবী রায়কে ম্যাটার আর টাকা পাঠিয়ে দিতুম । যেহেতু আধুনিকতার একরৈখিকতার বিরোধিতা করা জরুরি ছিল, আমি বুলেটিনগুলোতে ধারাবাহিক নম্বর দিতুম ; কখনও বা নম্বরহীন বুলেটিন প্রকাশ করা হতো, যেমন উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ কবিতা ।
১৯৬৩ সালের শুরুতে সুবিমল বসাক যোগ দেবার ফলে ওর লাইন ড্রইঙ আর তার সঙ্গে গদ্য প্রকাশ করা হতো সাইক্লোস্টাইল করে, অনেকটা এখনকার জেরক্সের মতন । সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিনে কেবল একটারই নম্বর দেয়া হয়েছিল, উনিশ নম্বর, যাতে কবিদের বংশতালিকা তৈরি করা হয়েছিল চার্টের মাধ্যমে; দেখানো হয়েছিল উচ্চবর্ণের আধুনিক কবিদের পুর্বপুরুষরা সবাই নিম্নবর্ণের কবিয়াল । অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, দুজন চিত্রশিল্পী যোগ দেবার পর পোস্টকার্ডে আর পোস্টারে কবিতা বা স্লোগান লেখা হতো, সেগুলো ছাপানো হতো উর্দু সংবাদপত্রের লিথোপ্রেস থেকে । ত্রিদিব মিত্র আর ওর প্রেমিকা আলো মিত্র পোস্টারগুলো নানা জায়গায় দেয়ালে লাগাতো।
প্রথম কয়েকটা বুলেটিনের সম্পাদকীয় দপতর দেবী রায়ের হাওড়ার বস্তিবাড়ি দেখানো হয়েছিল । এরকম একটা কেন্দ্রের ধারণা যেহেতু আধুনিকতার তৈরি তাই আমি ঠিক করলুম যে যার যেখান থেকে ইচ্ছে বুলেটিন প্রকাশ করতে পারে। হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার বা পলিটব্যোরো বা হাইকমান্ড থাকবে না ।কিন্তু নিজের টাকা খরচ করে বুলেটিন ছাপার ব্যাপারে কেউ বিশেষ চাড় দেখায়নি । বুলেটিনে নেতার নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমিই ছাপিয়েছিলুম আর এই ব্যাপারটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চটিয়েছিল । পরে বিনয় মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে নেতা হবার কথা ছিল তাঁর । বিনয় আমাকে তাঁর মনের কথা বলেননি । নয়তো শক্তির বদলে আমি বিনয়ের নাম নেতা হিসাবে ছাপিয়ে দিতুম । ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ নামে একটা বই বেরিয়েছে তালপাতা প্রকাশনী থেকে ; তাতে হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীলকে লেখা অনেক চিঠি আছে । আমার চিঠিও আছে, যাতে আমি ওনাকে নেতৃত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলুম ।
সন্দীপ দত্ত যেমন বলেছেন, মামলাটা আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল । আমার বিরুদ্ধে লালবাজারে স্টেটমেন্ট আর আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিল শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, শৈলেশ্বর আর সুভাষ । মামলা জেতার পর আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল এই তথাকথিত বন্ধুদের সম্পর্কে। মামলা জিতে আমি পচা-ছাতাপড়া-তেলচিটে নোট পোড়াবার চাকরিতে যোগ দিই । এই চাকরি থেকে তাড়াতাড়ি অন্য চাকরি পাবার চেষ্টায় সফল হই । অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের লখনউ অফিসে যোগ দিয়ে টের পাই যে আমি ভারতের গ্রামীণ জীবন আর চাষবাস সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না । সাহিত্যের বই পড়ার বদলে আমাকে চাষবাস, পশুপালন, তাঁত, হাতের কাজ, চাল-ডাল জোয়ার-বাজরার ভেদাভেদ নিয়ে বই পড়া আরম্ভ করতে হয় ।
আমার কলকাতায় অনুপস্হিতির সুযোগ নিয়ে শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত নানা গল্প রটিয়ে দিতে থাকে । পাঠকরা জানতোই না যে আন্দোলনটা আমি আরম্ভ করেছিলুম, মামলাটা আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল। ওরা ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশ করলেও, সাঙ্গঠনিক দক্ষতার অভাবে কাছে টানার বদলে সহযোগীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে আর হাংরি আন্দোলনকে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছোতে দেয়নি । অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, সমীরণ ঘোষ প্রমুখ উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করলে তাকে ভেঙে দেন শৈলেশ্বর ঘোষ, সে-ঘটনা অলোক গোস্বামী বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা ‘মেমারি লোকাল’-এ ।
আমি আবার কলকাতায় ফিরতেই হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত কথাবার্তা সাহিত্যিকদের মাঝে ফিরে আসে। উত্তম দাশ তাঁর মহাদিগন্ত পত্রিকায় যাবতীয় নথিপত্র প্রকাশ করার ফলে হইচই আরম্ভ হয় । যারা কখনও হাংরি আন্দোলনে ছিল না তাদের লেখাপত্র নিয়ে দে’জ থেকে সংকলন প্রকাশিত হয় ।
সমীরণ মোদক আমার সম্পাদিত ‘জেব্রা’ পত্রিকা সংকলিত করেছেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের চিঠিপত্র সংগ্রহ করছেন সংকলন প্রকাশের জন্য । এই সংকলনে তিনি হাংরি বুলেটিনগুলো একত্রিত করেছেন, সবগুলো নয়, যতোগুলো পেয়েছেন । তাঁর এই শ্রমসাধ্য কাজের জন্য আমরা সবাই তাঁর কাছে ঋণী ।
No comments:
Post a Comment