সমীর রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প
হাংরি আন্দোলনের পুরোধা সমীর রায়চৌধুরী আজ ২২ জুন সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেছেন। কলেজ জীবনে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, ১৯৬১ সালের নভেম্বরে তিনি ছোট ভাই মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়-এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করেন। হাংরি আন্দোলনের শতাধিক বুলেটিনের অধিকাংশ তাঁরই খরচে প্রকাশিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তিনি গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তরুণদের বিপথগামী করছেন। তাঁর ছোটগল্পের বই: সিগারেটের তিরোভাব ও অন্যান্য, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখ, পোস্টমডার্ন গল্পগুচ্ছ, খুল যা সিমসিম। কাব্যগ্রন্থ: ঝর্নার পাশে শুয়ে আছি, আমার ভিয়েতনাম, জানোয়ার, মাংসের কস্তুরীকল্প, পোস্টমডার্ন কবিতাগুচ্ছ, বিদুরের খড়ম, নির্বাচিত কবিতা। প্রবন্ধের বই: কবিতার আলো অন্ধকার, পোস্টমডার্ন কবিতা বিচার, পোস্টমডার্ন বিড়ালের সন্ধানে, উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ।
এখানে তাঁর তিনটি গল্প প্রকাশ করা হলো
মানুষবাজার
রিক্সা করে পাটনা সচিবালয়ে যাচ্ছি–। স্টেট ব্যাঙ্কের সচিবালয় শাখা থেকে পেনশন তুলি। যখন যেখানে থাকি এটিএম কার্ড সঙ্গে থাকে, তবে প্রত্যেক বছর নভেম্বর মাসে বেঁচে থাকার ‘এই তো আছি’ জানাতে আসি। কিন্তু আসার আসল উদ্দেশ্য ছেলে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যাওয়া আর পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। তবে মাঝে-মাঝে বহুকালের ভুলে-যাওয়া সম্পর্কের হঠাৎ রিনিউয়াল ঘটে। রিক্সা চলেছে, কাজকর্ম মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি, যাতে মিস না করি। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে আসা নীল ইন্ডিকা গাড়ি পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে, জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে, হ্যাঁ, আমাকেই—
…এই…এই…সুকুমার…আবে…আবে…
ইদানিং হয়তো বয়সের জন্য আমার ভাবা-মন ইচ্ছে মতো বা রিফ্লেক্সে সাড়া দেয় না, একটু সময় লাগে। এখন প্রথম অভ্যাস না চেনা, না-করনের ডাঠা আর বসত। পেছোতে পেছোতে স্কুলজীবনে।
আরে শ্রীবাস্তব !
রিক্সার ভাড়া দিয়ে খুচরো ফেরত নিতে ভুলে যাই। নেমে পড়ি। স্কুল জীবনের বন্ধু। পড়াশোনায় ভালো ছিল। সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখত নতুন কিছু করবে। শ্রীবাস্তব আমারই বয়সী, অথচ এখনও স্বপ্নময় মুখ, বেশ হাট্টাকাট্টা। স্কুলের শেষ ক্লাস পেরিয়ে হঠাৎ একদিন রওনা দিল বম্বেতে। তখনও মুম্বাই হয়নি। ওর এক দূর সম্পর্কের কাকা থাকেন ভেরসোভায়। তখনও সমুদ্রের ধারে মেছোদের গ্রাম, একটু একটু শহরের অংশ হয়ে উঠছে। আজকের ভেরসোভার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শ্রীবাস্তব হাফপ্যান্ট পরেই পাটনা থেকে ভেরসোভা। কী যে করছে ,বন্ধুবান্ধবরা কেউ জানতে পারিনি বহুকাল। কেউ কেউ বলত চলতা-পুরজা। শ্রীবাস্তবকে এভাবেই বারবার দেখতে পেয়েছি। দেখেছি, বন্ধুবান্ধবের কথা ঠিক নয়। তার ভাবনা-চিন্তার ফসল বেশ ঈর্ষাজনক, অভিনবত্ব তার সহজ দখলে।
কবে পাটনা এসেছিস ?
—আরে স্থায়ীভাবে মুম্বাই ছেড়ে বেশ কয়েক বছর আগে পাটনা চলে এসেছি। মুম্বাইতে ফিল্মে এক্সট্রা মানুষজন সাপ্লাইয়ের কাজ করছি। তবে অন্য এলাকায়। ইদানিং মানুষ সাপ্লাই করি মিছিলের জন্য… আনুষঙ্গিক জিনিস, পতাকা…ফেসটুন…এসব রাখি...
কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল?
—প্রায় সব দলকেই জোগান দিই…যার যত লাগে…হঠাৎ প্রতিবাদে এদের মানুষ জোটাতে বেশ অসুবিধে হয়…
একই লোক সবার মিছিলে দিস, নাকি আলাদা ব্যবস্থা আছে?
…একই লোক বলতে পারিস…বেকার মানুষের তো অভাব নেই…আর কিছু লিঙ্কম্যান আছে…তাদের মাধ্যমেও মানুষ জোটাই…
মতাদর্শের কী হয়?
–সে আবার কি জিনিস
জেডিইউ…বিজেপি…আরজেডি…কংগ্রেস…কত সব দল আছে…
—মতাদর্শ নেতাদের ঝক্কি…দ্যাখ সব হিন্দু যেমন হিন্দুত্ববাদী নয়…সব বামপন্থী যেমন একরকম নয়…সব কংগ্রেসি একরকম নয়…সাধারণ মানুষের কী যায় আসে…তার সমস্যা বেঁচে থাকা…
আর নেতাদের সমস্যা ক্ষমতাদখল…তাই কী…
—চল অফিস এসে গেছে
শ্রীবাস্তবের গ্রাউন্ডফ্লোরে অফিস…মাটির তলায়…মালপত্তর রাখতে গোডাউন…বেশ সাজানো গোছানো…বেশ কয়েকজন কর্মচারী…আলমারি, সাজানো ফাইল…রেজিস্টার
—এই যে লিংকম্যানদের রেজিস্টার…সকলের ঠিকানা…ফোন নাম্বার
সব দল সব সময়েই কী মানুষ জোটানোর জন্য তোর কাছে আসে?
—কেউ কেউ জিনিসপত্তরের জন্য আসে…আবার যে ক্ষমতায় থাকে তাদের সবসময় মানুষ সাপ্লাই করতে হয় না। ক্ষমতার আসেপাশে মানুষ ঘুরঘুর করে…
কলকাতায় আছি…পাড়ায় অবশ্য দেখছি…এক ভাই তৃণমূলে আর এক ভাই সিপিএমে– আবার পাশের পাড়ায় দেখছি কিছু মানুষ একদল থেকে আরেক দলে ঢলে গেল…ক্ষমতায় যে দল, সবাই সেদিকে ভিড়ে যাচ্ছে…কাগজেও পড়ি…টিভি নিউজেও দেখছি…তবে রাজনীতি বা রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই
—নেতাদের মধ্যে কিন্তু এখনও কিছু-কিছু সৎ, আদর্শবান মানুষ আছে…তবে সংখ্যায় কম…যাকগে নিজের কথা বল…মুম্বাইতে তুই যখন চার্চগেটের কাছে পিজি হস্টেলে ছিলিস…সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে…
অত কাছ থেকে সেই প্রথম শুটিং দেখি…বোধহয় মালা সিনহার একটা ফিল্ম…টুকিটাকি ভিড়ভাড়…নাচাগানা…ডবলবডি…ডামি…এসব লোকজন তুই দিতিস
—ফিল্ম লাইনের কমোডিটি বলতে পারিস
তোর কাজ-কারবার নিরালি…তুলনা হয় না…তবে পাড়ায় দেখেছি কিছু-কিছু মিস্ত্রি বাড়ি তৈরির লাইনে…শহরে কাজকর্মে লোকের জোগান দেয়…আয়া সেন্টার…গাড়িচালকের সেন্টার…বাঁশদ্রৌণীতে আছে…ফোন করলেই আয়া বা গাড়িচালক পাওয়া যায়…আজকাল অনেকের গাড়ি আছে তবে মাস মাইনের লোক রাখে না…প্রয়োজনমতো সেন্টার থেকে লোক নেয়
—সে তো মানুষবাজারের অনেক লাইন…তুই অত-শত জানিস না
তবে তোর লাইন দুটোতেই একটা এলিমেন্ট কমন…
—হ্যাঁ, অভিনয়
ব্যাপারটা আরো মডার্ন
—তোদের লাইনে যেমন একজন লেখক আর টেক্সটের বক্তব্য এক নাও হতে পারে
আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেকেই দেখেছি যে, লোকটা ব্যক্তিজীবনে যা আর তার লেখায় যা, তা এক নয়
—তোদের ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’ তো সোস্যালিস্ট ছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করার সময়ে বলেননি যে গ্রামে তাঁর আরেক পরিবার আছে…সত্য গোপন করেছিলেন…
সে তো ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার রেণু সংখ্যায় লতিকাদির লেখায় আছে…তিনি নিজেই সেসব কথা লিখেছিলেন…তাঁর কেনা পাটনার বাড়িতে তো এখন প্রথম স্ত্রীর ছেলে থাকেন…যিনি বিজেপির এমএলএ…এগুলো মডার্নিটির ব্যাধি বলতে পারিস…তা না, প্রায়ই তো দেখি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলবদল
—আজকাল অবশ্য আইন বদলেছে…তাই কম ঘটছে…তবে মানুষবাজারের ব্যাপার, ঐ যে বললি মডার্নিটির জন্যে মানুষের মধ্যে অভিনয়ের এলিমেন্ট…
শুধু ঐ কথায় সবটা বলা হয় না রে…দ্যাখ জন্মসূত্রে আর বহুকালের বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ জেনেছে যে ভাষার আড়ালে লুকোনো যায় নিজেকে…
—হ্যাঁ, জীবজন্তু তো যে যার মতো লুকোয়…নানা…গর্তে…ছদ্মবেশে…প্রকৃতির নানা ধরনের আড়ালে
সে আড়াল বাহ্যিক হতে পারে বা স্বভাবজ ভেতরের ব্যাপার…মানি স্বজ্ঞাত হতে পারে তবে মানুষের মেইন আড়াল তার ভাষা, তার নিজস্ব যুক্তিপদ্ধতি
—সে তো ভালোভাবেই জানি…সে দিক থেকে ফিল্মের বা প্রকৃত অভিনেতারা সন্মানীয়…তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তার অবস্থান স্বচ্ছ..আর এতে তোর চলে যায়? মুম্বাই থেকে চলে এলি কেন?
—মুম্বাইতে আমার একটা ফ্ল্যাট আছে…ছেলে ওখানে চাকরি করে….মেয়ের বিয়ে বিহারেই দিয়েছি।
এখানে রাজনীতিতে জাতপাত তো একটা ফ্যাক্টার…
—তা তুইও তো জানিস…তবে কোলকাতিয়া দলগুলোর মতো শাসকদল এখানে কথায় কথায় প্রতিবাদ মিছিল বের করে না…নীতিশকুমার কাজ করছে…লোকে মানছে…
ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের তুই বিশ্বাস করিস?
—ক্ষমতা দূর্নীতির মূল…তবে কমবেশির তফাত আছে…নীতিশ সাফসুতরা…তা তার বিরোধীরাও মানে…
মানুষবাজারে মানুষকে তোর কমোডিটি মনে হয়…বাজারে আর সব প্রডাক্টের মতো…?
—হ্যাঁ…কাঁচের জিনিসের বাজারের মতো।
শ্রীবাস্তবের অফিসে তার বসার চেয়ারের পেছনের দেওয়ালে ওমকারের ছবি…ওম থেকে উঠে আসছে আগুনের শিখা….বিহারে বেশ কমন…ভ্রামরী আসন বহুকাল আগেই বিহারের মানুষ জানে…দ্বারভাঙ্গাতে থাকার সময়েও দেখেছি…ধ্বনি আর আগুনের সম্পর্ক…মানুষের ভেতরে তাপ সঞ্চার করে…উম দেয়…
তুই কি নিয়মিত যোগব্যায়াম করিস …? ওটা আমাদের পরিবারে বহুকাল থেকে চলে আসছে…তুই করিস কি…?
—হ্যাঁ, একটা আত্মবিশ্বাস দেয়।
মেয়েমানুষ আর নাবালক পাচারকারীরাও মানুষবাজারের অবৈধ কমোডিটি, তবে তোর মানুষজনকে বৈধ কমোডিটি বলা যায়…
—মানুষবাজারের এলাকা আর সব বাজারের থেকে আলাদা নয়…
সেখানে কি বাজারদরের ওঠানামার নিয়ম কাজ করে…?
—ফিল্মলাইনে সে চান্স পাওয়া যেত, তবে মিছিল ক্ষমতাবাজ তুখোড়দের ব্যাপার, বেশি ঘাঁটানো বিপজ্জনক…এখন আমার আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই…আমি এবং আমার স্ত্রী, আর মা কখনও আমার কাছে কখনও ছোটোভাইয়ের কাছে গিয়ে থাকেন…
যোগব্যায়ামের ক্যাম্প করেও আজকাল মানুষবাজার থেকে টাকা তোলা হচ্ছে…
—তবে কারো মানুষবাজার বাড়তে থাকলে ক্ষমতার লোভ বাড়তে পারে…সাবধানে না ব্যবহার করলে হাত পুড়তে পারে…
আমার ইচ্ছে করছে প্রত্যেক দলের মিছিলে যোগ দিই…ব্যাপারটা নিজে ফিল করি…
—তা করতেই পারিস…তবে তোকে নিয়ে মুশকিল…তোর মুখ ভিড়ের মুখের মতো নয়…শিল্পীদের এই একটা মুশকিল…তার মুখ…দৃষ্টি…ক্রমশ ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যায়…সিনেমায় অভিনয়ের জন্য দরকার পড়ে মেকআপ ম্যানের…যে তার ছিরিছাঁদ বদলে দেয়, আর সে নিজে চলনে-বলনে পার্ধক্য আনে পরিচালকের সাজেশান জেনে নিয়ে…লুকোনোর জায়গা এগুলো।
তাহলে যত বহুত্ব নিয়ে সে খেলে তত তার একক পরিচিতির বাড়বাড়ন্ত হয়…
—অতশত বুঝি না, মানুষবাজারের চেয়ে আর ভালো বাজার নেই, সব চেয়ে কম লগ্নীর ব্যবসা।
আর দ্যাখ, বাজার কাউকে ছাড়ে না ।
গান্ধারী – পুং
সেদিন ভোরে শেফালি লাফিংক্লাব থেকে রিকশয় বাড়ি ফেরে। অথচ প্রতিদিন পাড়ার আর সবার সঙ্গে হেঁটেই ফেরে, যায় হেঁটে। সেদিন দেখি এক হাতে বাঁ-চোখ ঢেকে গেট থেকে আমায় দেখে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছে। ছুটতে ছুটতেই বলে ‘আমার বাঁ-চোখে কী যেন পড়েছে মনে হচ্ছে, আক রাশ বালি, খুব ইরিটেশান হচ্ছে, বের করে দাও’। হাত ধরে ওয়াশবেসিনের কাছে নিয়ে গিয়ে বলি ‘চোখে অ্যাকোয়াগার্ডের জল দিয়ে ঝাপট দাও’।
আমার চোখে তখনও শেফালির চোখের বালি-টালি নজরে আসেনি। ঝাপটা দিয়ে তবু বলে, ‘কই বেরোচ্ছে ?’ বিছানায় শুইয়ে ক্ষুদে অক্ষর পড়ার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে চোখ তন্ন তন্ন করে দেখি কোথায় বালি, বাইরের কিছু নয়, ভেতরের কোনো উদ্রেক।
মনে পড়ে যায় ফ্রিজে কিনে রাখা ‘টিয়ার্স’ আই ড্রপের কথা। বের করে দুচোখে ড্রপ দিই। ড. শ্রীমতি রায় বলেছিলেন, ‘কোনো হার্ম করে না, চোখ ধুয়ে দেবেন, কান্নার বিকল্প ভাবতে পারেন, চোখটাকে রিফ্রেশ করে দ্যায়, বেশি বয়সে বা কম বয়সেও আজকাল পরিবেশগত কারণে নেত্রনলিতে অবরোধ দেখা দেয়, এই ওষুধটা কান্নাকে উসকে দ্যায়’।
আবার বলেন, ‘সংবেদনশীলতার মাত্রা অনুযায়ী কান্নার মাত্রা আর রসায়ন নির্ভর করে, প্রয়োজনে প্রতিদিন দিতে পারেন, নয়তো হাতের কাছে রাখবেন, হঠাৎ কিছু ঘটলে প্রাথমিক সাহায্য।’
তবু কমছে না। ‘রিফ্রেশ লিকুইজেল আইড্রপ’ দিলাম। বলা যায় ‘টিয়ার্স’ এর পরের ধাপ। তাও কিছু হল না। শেফালি যন্ত্রণায় ছটফট করছে কেবলই, বলছে জ্বলুনি বাড়ছে। ডাক্তারকে মোবাইলে জানিয়ে ছুটলাম আই হসপিটালে, যেখানে তাঁর চেম্বার। ভাগ্যক্রমে আজ পেশেন্ট দেখার দিন, ‘ও টি’র কেস থাকে না। বরং তার ফলো আপ থাকে। কাউন্টার থেকে স্লিপ নিয়ে তাঁর সহযোগীদের একজনের হাতে দিলাম। তিনি ডাক্তারের চেম্বারে রেখে এসে বললেন, ‘বসুন, আপনাদের এবার ডাকবেন’।
চেম্বার থেকে পেশেন্ট বেরোতেই প্রথমেই শেফালিকে ডাকলেন; হাত ধরে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। ফোনে আগেভাগে সবকিছু জানিয়ে রেখেছি। ডাক্তার যন্ত্রে শেফালির থুতিনি রাখিয়ে বাঁ-চোখ দেখতে থাকলেন। সহযোগীরা তাঁর নির্দেশমতো আরও কিছু যন্ত্র এগিয়ে দিচ্ছেন। দেখেশুনে বললেন, মনে হচ্ছে ভাইরাল ইনফেকশানের ফলে আলসার হয়েছে’।
শেফালিকে বললেন, ‘ওটিতে চলুন। সহযোগীরা হাত ধরে ওটিতে নিয়ে গেলেন। মনে হলো কেসটায় ইমিডিয়েটলি অ্যাকশান প্রয়োজন। যেজন্য তিনিও এমন তৎপর। শেফালি তাহলে ঠিক বলেছিল। আমাকে ওটির বাইরে বসতে বলে ওয়েটিং প্লেসে বসতে বলে ডাক্তার ওটিতে ঢুকলেন।
বসার জায়গায় চোখের অনেকগুলি পত্রিকা রাখা হয়েছে। পাতা ওল্টাই, শিরোনাম দেখি। কিছুটা অন্যমনস্ক থাকা যাবে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি লেখার শিরোনাম ত্রিনেত্র। দর্শন বা আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে লেখা নয়। পড়ে দেখি, চোখের সম্পর্কে একটি বিশেষ লেখায় আজকের ডাক্তারদের স্টাডি রিপোর্ট।
চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সারা বিশ্বে আধুনিক উন্নয়নজনিত প্রদূষণের ফলে এখন প্রায় পাঁচকোটি মানুষ পরিবেশগত কারণে অন্ধ; প্রতি বৎসর এই সংখ্যা উর্ধ্বগামী। অবশ্য এই পরিসংখ্যান কেবল সেই সব পেশেন্টকে নিয়ে যাঁরা চিকিৎসালয়ে গেছেন, চিকিৎসক দেখিয়েছেন। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিসংখ্যান নেই। এদেশে আর্থসামাজিক কারণে অধিকাংশ মানুষের বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার সামর্থ নেই। কিছু-কিছু চিকিৎসক স্বয়ং এই ব্যাপারে তৎপর হয়েছেন। আজকের জীবনযাত্রা আর রাষ্ট্রব্যবস্হার কারণে মানুষ স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা হারাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।’
তাহলে ‘ত্রিনেত্র’ কি !
জবাব পেয়ে যাই পরের পাতায়–
‘মাদুরাই-এর অরবিন্দ আই হসপিটাল ব্যাংগালুরুর ইনডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্শেস, মাদুরাই-এর অরোল্যাব, নেদারল্যান্ডসের মেকাল-ফোকালের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তৈরি হয়েছে এই ‘ত্রিনেত্র’ যন্ত্র। ‘ত্রিনেত্র’ প্রজেক্ট পেয়েছে ‘ইন্ডোডাচ ইনোভেশান গ্র্যান্ট’ । যন্ত্রে মুহূর্তে ধরা পড়বে চোখের ভেতরের ছবি। বেরিয়ে আসবে যাবতীয় চক্ষুরোগের ইমিডিয়েট আর সর্বাঙ্গীন ডিটেল রিপোর্ট আর ছবি। রিপোর্ট বের করার খরছ সাকুল্যে মাত্র ৫০ টাকার মধ্যে। চোখ রাখলেই দু’চার মিনিটে রিপোর্ট বেরিয়ে আসবে। শীঘ্রই বাজারে আসছে। বরাত নেওয়া হচ্ছে।
শেফালি ওটি থেকে বেরলো। সহযোগীরা হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন চেম্বারে। আগে যেখানে দেখালাম। ডাক্তার আমাকে বললেন, ‘চেম্বারে আসুন’।
চেম্বারে ঢুকে প্রথমেই বললেন, ‘আলসার ছিল, রিমুভ করেভ দিয়েছি, ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, ঠিকমতো দেবেন’। নতুন আইড্রপ, খাওয়ার ওষুধ, অয়েন্টমেন্ট প্রেসক্রাইব করে পাশে শূন্য চিহ্ণ লিখে কোনটা কখন কবার শাফালিকে দেওয়া হবে জানিয়ে দিলেন। বাইরে সহযোগীরা আরও ডিটেলে বুঝিয়ে দিলেন। দুদিন পরে আবার এসে দেখাতে বললেন।
ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ‘ফ্রাঙ্করস’ আর ‘ধন্বন্তরী ফার্মেসি’র দোকান পাশাপাশি দেখে প্রথমে সব ওষুধপত্তর কিনে, ট্যাক্সিতে দিতে দিতেই বাড়ি ফিরলাম। শেফালি ক্রমাগত বলে চলেছে, ‘আর পারছি না, টাটানি আরও বেড়েছে, জ্বলুনিও কমেনি’। বুঝিয়ে শান্ত করি। ওষুধপত্তর নির্দেশমতো প্রয়োগ করি, এর বেশি আর তো এই মুহূর্তে আমার কিছু করণীয় নেই।
আমার অবস্হা গান্ধারের রাজকুমারী মহিষী গান্ধারীর মতো। তবে গান্ধারী-পুং বলাই ভালো। চোখে পটি বাঁধলে তো আজ বিপরীত কাজ হবে। তাঁর সান্নিধ্যে ছিল রাজপুরোহিত আর রাজবৈদ্য। আজকের দৃষ্টিকোণে যাদের অবস্হান ছিল ক্যাবিনেট র্যাঙ্কে।
ধন্বন্তরী সুশ্রুত সম্পর্কে তো মহাভারতে আর গড়ুরপুরাণে পড়েছি। ধন্বন্তরী ছিলেন দেববৈদ্য। সমুদ্র মন্হনের সময় অমৃতকলস হাতে তিনি জল থেকে উঠে এসেছিলেন। অর্থাৎ প্রকৃতিস্হ প্রসেসে, জনঅভিজ্ঞতার সমষ্টিগত বিচারের রূপক। সমষ্টি এখানে ব্যক্তিবিশেষ। ভেষজ চিকিৎসার গাছগাছড়ার ওঢ়ধিগুণ সবই তো ভারতে জনঅভিজ্ঞতার ফসল। সেকালের মানুষের ছিলন প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কে ছিল সিমবায়োটিক। পারস্পারিকতায় সম্পৃক্ত।
ঔপনিবেশিকি পর্বে সেই প্রকৃতিস্হ সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। উত্তরাধিকার আড়াল হয়ে গেছে। আজ আবার উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আপডেটেড রূপে হচ্ছে। তা না হলে ‘ত্রিনেত্র’ বিশ্বস্তরে পেটেন্টসত্ত্ব বা ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট পায় কী ভাবে ! মহাভারতের গান্ধারী ছিলেন আদর্শ সহধর্মিনীর দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি চাক্ষুষ দেখা থেকে সরে গিয়ে অনুভূতির দেখাকে শ্রেয় মেনে বেছে নিয়েছিলেন। মহাকাব্যের সমগ্র ধর্মচেতনায় কাব্যার্থে যা মানিয়ে যায়।
মনে পড়ে ফণীদাদুর সঙ্গে থিয়েটার হলে গিয়ে মঞ্চের সামনে প্রথম সারিতে বসে দেখেছিলাম, কৃষ্ণচন্দ্র দাদুর বিবেকের গান। নাটক শেষ হলে দাদু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কৈশোরে সেসব কথা বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি, যেমন বুঝতে পারি হিন্দিবলয়ের অন্ধ কবি সুরদাসকে। বিবেকের গান শুনে দর্শকশ্রোতার দু চোখ বেয়ে ওরিজিনাল টিয়ার্স গড়াতো।
আজকের সমস্যা শেফালির বাঁচোখে আর আমার নিরুপায় অবস্হা।
দুদিন আমি সারাক্ষণ জেগে আর মাঝে মাঝে আধোঘুমে কাটিয়ে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলি, শেফালির কষ্ট আর দেখা যায় না। সুশ্রুতকে বলা হয় ‘বহুভির্ষত’, ভেষজবিজ্ঞানের সব শাখায় তাঁর জ্ঞান। আর আমি বাস্তব জীবনে দাম্পত্য সহযোগে এমনই অস্হির। এমনই আমার করুণ অবস্হা। নিরুপায়।
দাদুর পেশা আর শখ ছিল পোর্ট্রেট আঁকার আর পাশাপাশি ভেষজ ওষুধ তৈরি করা। গ্রামে গঞ্জে বেচার জন্য ভেষজ ওষুধ পাঠাতেন। এসব নিয়েই ছিল তাঁদের প্রজন্মের স্বাচ্ছন্দ্য।
দুদিন পর সকাল সকাল শেফালিকে নিয়ে ট্যাক্সি করে আবার ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি আজও শেফালির চোখ যন্ত্রের সাহায্যে দেখে বললেন, ‘গ্রোথ রিপেয়্যার করেছে’। চেম্বারে আমাদের উপস্হিতিতে কার সঙ্গে যেন শেফালির চোখের ব্যাপারে ডিটেলে কথা বললেন। আর আমাদের বললেন, আমি রেফার করেভ দিচ্ছি কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ ড. ত্রিবেদীজিকে। এখনই যান, আমি সব বলে দিয়েছি। আপনারা যাবেন প্রিয়ংবদা বিড়লাতে, বেলভিউয়ের ঠিক পাশে। কাউন্টারে এই প্রেসক্রিপশান দেখাবেন। উনি আপনাদের ডেকে নেবেন’। ঠিক তাই হলো। আমরা লিফ্ট দিয়ে ওপরে গেলাম।
ড. ত্রিবেদী অন্য একটি অচেনা যন্ত্রে শেফালির থুতনি রেখে পরীক্ষা করতে থাকলেন। সহযোগীরা একের পর এক আরও অচেনা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি এগিয়ে দিলেন, কেবল বোঝা গেল ওই যন্ত্রের মধ্যে একটা ক্যামেরাও রয়েছে, যার তোলা ছবিগুলো পাশের টেবিলে রাখা কমপিউটারে ভেসে উঠছে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমাকে বাইরে বসতে বললেন।
শেফালিকে নিয়ে গেলেন পাশের আরও একটি চেম্বারে। নেমপ্লেট দেখে বুঝলাম তিনিও কর্নিয়া রোগের বিশেষজ্ঞ। আরও মিনিট কুড়ি পরে আমাকে সেই চেম্বারে ডাকলেন, বললেন, ‘এই ওষুধগুলো হসপিটাল থেকে বেরোনোর মুখে ফার্মাসিতে পাবেন। সবগুলোই বিদেশি ওষুধ। চমৎকার কাজ করে। কর্নিয়ার এই রোগটা আমাদের ভালোভাবেই চেনা। আজকাল আকছার অনেকেরই হচ্ছে। বলতে পারেন, আজকের রোগ। চিন্তা করবেন না, সেরে যাবে।’ পাঁচ দিনের দিন আবার আসতে বললেন। তবু তাঁর মোবাইল নাম্বার প্রেসক্রিপশানের ওপরে লিখে দিলেন।, ‘কোনো প্রয়োজন ঘটলে তৎক্ষণাৎ জানাবেন’।
শেফালি বলল, ‘আমিও সঙ্গে যাব’। দেখি শেফালি তত ছটফট করছে না। অর্থাৎ জ্বলুনি, টাটানি কিছুটা কমেছে। জানতে চাইলাম, ওঁরা কি আবার আলসার রিমুভ করেছেন ?’
শেফালি জানালো, ‘না, তিন রকমের ড্রপ চোখে দিয়েছেন। ঐ ড্রপগুলোই প্রেসক্রাইব করেছেন। অয়েন্টমেন্টের বদলে তারই ট্যাবলেট দিয়েছেন। দিনে পাঁচবার খেতে হবে। তার ফলে অয়েন্টমেন্টে যে জ্বলুনি হচ্ছিল তা আর হবে না। আমিও সেটা কিছুটা বুঝতে পারছি। ঐ ট্যাবলেটও একটা খাইয়েছেন। একটু বোসো, তারপর দুজনে একসঙ্গে বেরোবো’।
বেরিয়ে ফার্মাসিতে গিয়ে সব ওষুধগুলো কিনে ফেলি। অত টাকা সঙ্গে ছিল না। ক্রেডিট কার্ডে কিনি। সেলস কাউন্টারের মানুষটিকে দেখে মনে হলো ডাক্তার ইতিমধ্যে ফোনে নির্দেশ দিয়েছেন, কেননা ডিউ রাখতে তার দ্বিধা ছিল না। ওষুধপত্তর নিয়ে ফার্মাসি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল উল্টো দিকের ফুটপাথের একটি দোকানে যুবক ডাক্তারদের লাইন।
শেফালিকে ফার্মাসিতে বসিয়ে রেখে উল্টো দিকের ফুটপাথে গিয়ে খোঁজ নিই কিসের লাইন ! দেখি নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় নতুন যন্ত্রপাতি ঐ দোকানে পাওয়া যায়। এমনকি যেগুলো অদূর ভবিষ্যতে বাজারে আসছে সেই সংস্হার নির্দেশে অগ্রিম বুকিঙের ব্যবস্হা রয়েছে। অদৃশ্য কারণগুলোকে দৃষ্টিগোচর করে তুলছে এইসব গ্যাজেট যন্ত্রপাতি, যন্ত্রসমন্বয়, চিকিৎসকদের সমন্বয়, যন্ত্রপাতি উৎপাদকদের সমন্বয়ের যৌথ প্রয়াসে।
যেমন ঘটেছে ‘ত্রিনেত্র’ আবিষ্কারে। আমাদের প্রজন্মে জানতাম ‘ত্রিনেত্র’ একটি দার্শনিক….আধ্যাত্মিক টার্ম। অথচ আজ তা বিশ্বস্তরে পেটেন্টের অন্তর্গত চিকিৎসাবিজ্ঞানের টার্ম; বাস্তব, চাক্ষুষ একটি যন্ত্র। রোগের কারণ হয়ে ওঠা নিত্যনতুন নিরাময় আবিষ্কার আজকের জীবনের বাধ্যবাধকতা। ট্যাক্সি ডেকে শেফালিকে নিয়ে বাড়ি ফিরি। এবারের বাড়ি ফেরা প্রথম কয়েকবারের চেয়ে স্বস্তির।
চারদিন ম্যারাথন নিয়ম-পালন করে চলি। বুঝতে পারি, শেফালি একটু একটু করে সেরে উঠছে। শেফালি নিজেও তা বুঝতে পারছে। চোখে-মুখে হতাশার ভাব, কষ্ট আর যন্ত্রণার চিহ্ণগুলো মুছে যাচ্ছে।
পাঁচ দিনের দিন আবার প্রিয়ংবদা আই হসপিটালে যাই। ড. ত্রিবেদীর কাছে। তিনি এবং তাঁর সঙ্গী দুজনে ডিটেলে পরীক্ষা করেন। এবারে আমাকে বাইরে থেকে ডেকে নেন। বলেন, ‘আলসার এবার ওষুধেই লোপ পেয়েছে। এই ওষুধগুলোর প্রথমটা দিন পনেরো আর ড্রপ এক মাস কনটিনিউ করুন। প্রেসক্রিপশানে ডিটেলে সব কথা লিখে দিচ্ছি। দেখবেন, যতদিন না চোখের মধ্যে ভারের অনুভূতি লোপ পাচ্ছে আর স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে, যা নিজেই বুঝতে পারবেন, ততদিন এসব চালিয়ে যাবেন। আগামীকাল সকালে গিয়ে ড. রায়ের চেম্বারে দেখা করুন। আমি ফোনে বলে দিচ্ছি সব’। এবার ওষুধ দেবার সময় শেফালির চোখেমুখে গ্রহণ করার আমন্ত্রণ। কোনোওরকম রিফিউজাল নেই।
পরদিন আবার দুজনে ড. রায়ের চেম্বারে যাই। তিনিও সব দেখলেন, বুঝিয়ে দিলেন, নতুন কোনো ওষুধ দিলেন না। তবে গ্লুকোমার একটা ওষুধ পালটে দিলেন। কেননা প্রথম ওষুধটা ভাইরাল আক্রমণের অনুকূল পরিস্হিতি তৈরি করতে পারে। বললেন, ‘বাইরে থেকে অনুকূল পরিবেশ যামন ভাইরাল গ্রোথে সাহায্য করে, ঠিক তেমনই ভিতরে ভিতরে অনুকূল পরিস্হিতি দেখা দিলে ভাইরাস ইনফেকশান ঘটতে পারে। এক সপ্তাহ পরে আসবেন, হয়তো চশমার পাওয়ার বাড়াতে বা কমাতে হতে পারে। এই ভাইরাস মানুষের শরীরের ভেতরেই বাসা বেঁধেছে, ডরম্যান্ট থাকে, অর্থাৎ সুপ্ত অবস্হায় অনুকূল পরিবেশে যা আক্রমণমুখী হয়ে ওঠে। ভেরে ভেরেই কর্নিয়াতে পৌঁছে বিপদ ডেকে আনে।’
আবার বললেন, ‘এই ড্রপটার মূল রসায়ন ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরা। চোখের মসৃণতা বা ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে দ্যায়, জার্মান টেকনোলজি। একমাস দেবেন। আগের প্যাকটা ফুরিয়ে যাবে। বড়ো বড়ো ফার্মাসিতে প্রেসক্রিপশান দেখালেই পাবেন। দেখবেন, বয়স বাড়লেও চোখ দুটো যুবতী। দিনেরাতে বেশি করে ঘুমোবেন। ঘুম স্বাভাবিকভাবেই আসা দরকার। এই ওষুধগুলোর মধ্যে সেই রসায়নও আছে। স্লিপ, টিয়ার্স, ঘুম— চোখের স্বাভাবিক নিরাময়ের উপায়।’
শেফালির চোখের দিকে না-দেখার আমার নিরুপায় ইচ্ছের ফাঁড়া কাটল; এবার থেকে লাফিং ক্লাব, টিয়ার্স, মসৃণতা ও ঔজ্জ্বল্যের ড্রপ মিস করব না।
আজ এখন, এই মুহূর্তে, সেই প্রবল অনুভূতি…কান্নাহাসি যখন একই সঙ্গে ঘটে, অনুভূত হয়। রোদবৃষ্টিতে রামধনু ওঠে।
—------------------------------------------------------------------------------------------
মেথি শাকের গন্ধ
অনেক দিন পর আবার লোডশেডিং।
মুহূর্তে চারিদিক অন্ধকার। আলোয় অভ্যস্ত স্বভাব অস্বস্তিতে। যা-কিছু আমার বলার মতো বিষয়-সম্পদ জড়ো করেছি সব আড়াল হয়ে গেল।
টেবিল চেয়ার বেডরুম টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন শেফালি ঘরদোর বুকসেল্ফ সিলিং-ফ্যান কবিতার খাতা পাশবই…ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ বাড়ির যা-কিছু দৃষ্টিগোচর, এই মধঊর্তে নিজের নিজের অবস্হান থেকে সেই উপস্হিতি এই অন্ধকারে নিভে গেছে। যে অবস্হানগুলো নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে মহাবিশ্বে আমার জলজ্যান্ত থেকে যাওয়া।
ছোটোবেলায় মা অন্ধকার দিয়ে ভয় দেখিয়ে শাসনে রাখতেন…সে সময় ধারনা হয়েছিল…অন্ধকারে জুজুবুড়ি, রাক্ষস খোক্কোস শাঁকচুন্নি একানড়েরা থাকে…মা-র কথা না শুনলে খপ করে খেয়ে নেয়…তারপর মা যখন মামারবাড়ি পাণিহাটিতে নিয়ে যেতেন…রাঙাদিদু কাছে টেনে সবাইকে রাক্ষস খোক্কোস জয় করার রূপকথা শোনাতেন…আমরা নিজেরাই কেউ রাক্ষস খোক্কোস কেউ রাজপুত্র সেজে জয়ের খেলা খেলতাম…খেলতে খেলতে ভয় কেটে গেল…রাঙাদিদু স্বামীর ঘর করার আগেই বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে বিধবা হয়েগিয়েছিলেন…ছোটোছোটো কদমছাঁট চুল…ফরসা রং…রোগা রোগা হাত পা…পরনে থান কাপড়…সবাই বলত নেড়ি পাগলি…আমাদের রাগদুঃখ বাড়ত…সেই রাঙাদিদু হঠাৎ মারা গেলেন…পরের বার পাণিহাটিতে গিয়ে আর দেখা হল না…মা বললেন…অন্ধকারের দেশে চলে গেছেন…সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাসা তৈরি হল…তারপর এক এক করে মা বাবা ছোড়দি মেজো জ্যাঠা ন-কাকা বন্ধুবান্ধব কত প্রিয়জন সেই অন্ধকারে চলে গেল…
আজ রামতনুর আসার কথা। রামতনু কবি। এলে, বেশ জম্পেশ আড্ডা হয়। তবে এখন আর কলিংবেল বাজবে না। বিদ্যুৎ নেই। গেট খোলার শব্দের দিকে একটা কান রাখতে হবে।
রান্নাঘরের দিক থেকে শেফালি চিৎকার করে উঠল: যে যেখানে আছো সেখানেই থাকো…মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে আসছি…
শেফালির কন্ঠস্বর মিশে হঠাৎ আসা অন্ধকারের নিঃসঙ্গতা কাটল। কিন্তু শেফালি বহুবচনে সাবধান জানাল কেন ! আমি তো এঘরে একা !
আজ আবার কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী। চাঁদ প্রায় নেই হয়ে দেরি করে উঠবে। দরজা জানলা খোলা থাকলে আশপাশ থেকে কিছু টুকরো আলো ঠিকরে আসে। কিন্তু মশার উপদ্রবের জন্য শেফালি বেকেল হওয়ার আগে থেকে ঘরদোর আঁটোসাঁটো বন্ধ রাখে। চুরির ভয়ের খিল ছিটকিনির চেয়ে এই বন্ধ আরও নিশ্ছিদ্র। আমাদের প্রতিবেশীরাও একই নিত্যের শামিল। এটা আবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা তাই লোকে যাতে মনে না করে নিজের এরিয়ায় তিনি বেশি কাজ করছেন তাই খুব একটা পাবলিক ওয়ার্ক এলাকায় হয় না। আর যাই হোক পার্টির এই সব নির্ভীক সততা আছে।
এই ব্রহ্মপুর খালপারের এলাকা স্টেট ইলেকট্রিসিটির আওটায় : ওপারে সি,ই,এস.সি.। ওপারের চেয়ে এদিকে লোডশেডিং বেশি তবে আগের তুলনায় কমেছে। এইসব নিয়ে এই অঞ্চলে আলোচনা হয়, বটতলা বাজারে, চায়ের দোকানে আর মহিলামহলে। কত রকমের কথা আর কথাকাটাকাটি বেরিয়ে আসে।
তবে একটা ব্যাপার সুখের। নিয়মিত লোডশেডিং হওয়ার ফলে জেনারেটরের ব্যবসা, মশার রকমারি ওষুধপত্তরের বিক্রিবাটা, মোমবাতি আর ব্ল্যাকে কেরোসিন ইত্যাদির ব্যবসা বেড়েছে। কিছু বেকার ছেলের তবু যাহোক হিল্লে হয়েছে।
অবশ্য রিটায়ারমেন্টের পর আমাকে জেনারেটারের লাইন কাটিয়ে দিতে হয়েছে। বাড়তি খরচ কমিয়ে আনতে। যদিও পথেঘাটে তত আলোর ব্যবস্হানেই। একটা স্হায়ী অন্ধকার এলাকায় আছে।
কতকটা বাল্মীকির আশ্রমের মতো, তাঁর আশ্রম ছিল তমসা নদীতীরে। এই তমসা নদীর তীর পর্যন্ত সুমন্ত্র রামচন্দ্রকে অনুগমন করেছিলেন। যেখানে লবকুশকে সঙ্গে নিয়ে সীতা থাকতেন। কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায় মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম এই তমসা তীরে। যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বলেন, দ্য গ্রেট অ্যাবাউট টার্ন। গন্ধ শব্দ স্পর্শ এভাবে একটা মাত্র বৈশিষ্ট্যের পথ না বেছে নিয়ে সবদিকে সচেতন হওয়ার মন। আর এই মনের প্রশ্রয় তমসাকে ভর করে।
একটা কিছুর শব্দ হল; না, রামতনুর আসার শব্দ নয়। রান্নাঘরে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ। শেফালি চেঁচিয়ে উঠল: মেথিশাক আর বেগুন দিয়ে মেথিবেগুন চাপিয়েছিলুম…পুড়ে না যায়, সামলাতে গিয়ে তেলের শিশি অন্ধকারে হাত লেগে র্যাক থেকে পড়ে গেল…চারিদিকে তেল আর কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে…সামলে আসছি…তুমি এদিকে এসো না…
সাবধান করে দিয়ে শেফালি ভালো করেছে…শেফালির দিকে এগোনোর রিস্ক নেব ভাবছিলাম। মেথিশাকের গন্ধ ভেসে এসে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার হদিস দিয়ে গেছে। যদিও একেবারেই কিছু দেখা যাচ্ছে না। বেশ জমাট অন্ধকার। সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। আকারের যে হট্টোগোল আমার আকারটুকু সায় দিয়ে রেখেছে সেইসব কিছু অন্ধকারের মধ্যে লোপাট হয়ে গেছে। এই অন্ধকারে আমার সম্বল ওই মেথিশাকের গন্ধ আর শেফালির কন্ঠস্বর। মেথিশাক দিয়ে বেগুন না মেথিশাক দিয়ে শেফালির কন্ঠস্বরের ব্যঞ্জন, এই মুহূর্তে ঠিক কী বলা যাবে ! মেথিশাকের গন্ধে মেথিশাকের শরীর ছাপিয়ে এই জীবনের আরও কত কি যে ক্রমশ সেঁধিয়ে গেছে। ছোড়দি ভালোবাসত মেথি শাক দিয়ে শুকনো শুকনো কইমাছ । মা মেথি পাতা শুকিয়ে রাখতেন, ফোড়ন দেওয়ার জন্য কিংবা মুগডালে দিতেন।
সাহস করে চেয়ার ছেড়ে উঠেছি। সামনে টেবিল আছে জানি, তার দু পাশ দিয়ে দুটো আলাদা স্পেসের বাইলান, বাঁদিক ধরে এগোলে এক হাতের মধ্যে করিডরের দরজা। অন্ধকারের ভিতর কত পরিসরের অলিগলি। অন্ধকারের মধ্যে এক ধরনের ফাটল।
বাঁধন বলত, অন্ধকারের স্হানিকতা। স্পেস যেভাবে সম্পর্ক গড়ে। এগোচ্ছি। টেবিল ছাড়িয়ে ঠিক বেরোতে পেরেছি মনে হচ্ছে। দরজা হাতড়াচ্ছি। এই তো দরজা। আলতো ভাব রেখেছি চলাফেরায়। তবু দরজায় হাত ঠেকে ঠুক করে শব্দ হল। যা ভেবেছি ঠিক তাই। শেফালি ওই ক্ষীণ শব্দটুকুও শুনতে পেয়েছে। সে প্রতিবাদ জানায়—
:তোমায় তোমার জায়গায় স্হির থাকতে বলেছি না…মনে হচ্ছে আমার দিকে আসার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছ…এসো না…ওখানেই থাকো…
—সাবধানে একটু একটু করে এগোচ্ছি
:তুমি তো বেশির ভাগ দিন এই সময়ে বাড়িতে থাকো না…আমি থাকি তাই আমার অন্ধকারে চলাফেরার অভ্যাস হয়ে গেছে…আমি চিনি জানি…
দরজা পেরিয়ে গেছি। ডানদিকে করিডরের দেয়াল ডান হাতে ঠেকছে। এবার বাঁদিকে এগোতে হবে। বাঁদিকের দেয়াল ধরে এগোলে হদিস পেয়ে যাব। প্রথমে খাবার ঘরের জানলা পড়বে তারপর খাবার ঘরের দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনে ডাইনিং টেবিল। ডান হাতের দেয়াল ঘেঁঢ়ে ক্রকারি রাখার আলমারি। সেই আলমারি ছাড়িয়ে একটু এগোলে রান্নাঘরার দরজা। রান্নাঘরে দুদিক দিয়ে যাওয়া যায়। করিডর দিয়ে এগোনো যেত। কিন্তু সেখানে এই অন্ধকারে সব গোলমাল হয়ে যেতে পারে। বুকসেল্ফগুলো আর আয়না রাখা আছে। তাছাড়া দেয়ালের দুদিকে বিস্তর ছবি টাঙানো। বেমক্কা হাত লেগে কোনোক্রমে যদি পড়ে যায়। টাঙানোর পেরেক লাগানো হয়েছিল ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে দিয়ে। চেনাজানা শিল্পীদের ছবি টাঙানো হয়েছে।
প্রথম ফ্রেম রুনুর, রুনু মানে অমিতাভ ধর। পেন্টার এইট্টিস-এর শিল্পী। ওর ছবিতে কালো রঙের চমৎকার কাজ প্রচুর। বিড়লা অ্যাকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে। ছোটোবেলা থেকে ওর এই ছেচল্লিশ বছরের জীবনে তিনবার বাড়ি বদল হয়েছে। আমি যেমন বদলির চাকরির সূত্রে পাহাড় নদী পথঘাট প্রতিবেশী দখল করেছি বারবার। ওর স্মৃতির মধ্যে সেই সব বাড়ি বদল আর সেখানকার ঘটনার পরত থেকে গেছে। প্রথম বাড়ি ছিল খিদিরপুরে। তারপর চৌরঙ্গিতে নিউ ক্যাথের ওপারে।
প্রথম বাড়িতে প্রচুর পায়রা ছিল। খোলামেলা থাকত ছাদে। বেশ পোশ মেনেছিল। রুনুর সঙ্গে পায়রাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন ছাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে রুনু বহুক্ষণ সময় কাটাত। একদিন পাশের বাড়ির কাকিমা দুটো পায়রা চাইলেন। কেন যে…
মা বললেন,— কেউ কিছু চাইলে ভালো মনে দিতে হয়। বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী চেয়েছে। মনে অসহ্য কষ্ট হল তবু মায়ের কথার জন্য —ম দিলাম।
হঠাৎ মা বললেন, — তোকেই কেটে দিতে হবে। কাকিমা পারবে না। তবে ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে নেবে।
— সে কী, কাকিমার পায়রা দেখে যেতে ইচ্ছে হয়েছে… আমি তো ওদের খাওয়াতে ভালোবাসি… ওড়াউড়ি দেখি… কোনো দিন কই খেতে ইচ্ছে হয়নিতো… ওদের সঙ্গে শুধু মিশতে ভালো লাগে…
মা বললেন, — গুরুজুন, ইচ্ছে হয়েছে যখন… দিলে আশীর্বাদ পাবে…
গিয়ে এক ঝটকায় কেটে দিয়ে এলাম — মনে থেকে গেল তাদের বিহ্বল পাখা ঝাপটানো… শেষ সময়েও উড়ে চলে যেতে চেয়েছিল…
আমার যে স্পর্শ ছিল ভরসার সেখানে অবিশ্বাস আর নিষ্ঠুরতাও মিশে গেল…
রুনুর পেন্টিঙে কালো রঙের সূক্ষ্ম কাজের মধ্যে লাল রঙের রক্তের ইশারা। কালো রং টুকরো টুকরো হয়ে ডানা মেলতে চাইছে। অসংখ্য আলগা স্মৃতির পরত। রুনুর মেমোরেবিলিয়া মানে স্মৃতিমন্হন সিরিজের। আমার প্রিয় ছবি। একদিন রাতে ঝোঁকের মাথায় রুনু আমাকে এই পরিসরের একটা ছবি ভালোবেসে দিয়েছিল। প্রত্যেক ছবিই এমনই সব নানা ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়েই এই করিডরের দেয়ালের পেরেক অবধি পৌঁছেচে।
যেমন প্রকাশের কালো রঙের কাজ একেবারে আলাদা। ওই দ্বিতীয় পেরেকে… আর তৃতীয় পেরেকে বাঁধন দাশের আঁকা ছবি।
বাঁধনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে আজ। মাত্র দুদিন হল সে মারা গেছে। অথচ এই সেদিন শান্তিনিকেতনের কলোক্যুইয়ামে কত কথা হল। ঘুরে ফিরে সেই স্হানীয়-লোকাল এইসব কথা কত সহজভাবে বোঝাতে চেয়েছিল আমাকে। বিশ্বায়নে স্হানীয়টুকুর গুরুত্ব যেন থাকে। যা আছে তার ওই কালো রঙের স্পেসে। আজ বাঁধন নিজেই আমার এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের কোনো এক অলিগলির পরতে। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে বাঁধন চলে গেল। করিডরে রাখা তার পেন্টিং আজ আরও প্রিয়…
ফলে ওদিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। অন্য কোনো অঘটন যাতে না ঘটে। সাবধান হওয়াই ঠিক। তেলের শিশি ভেঙেছে, ঠিক আছে। ও তো পরিষ্কার করে নেবে শেফালি। আর সকালে তো কাজের মেয়ে আসবে। তাছাড়া মেথি শাকের গন্ধ খাবার ঘরের দিকেই বাড়ছে। যেভাবে গন্ধ ছড়িয়ে আছে সেপথ দিয়ে যাওয়াই সুবিধের হবে। রুনুর পেন্টিঙে যেভাবে কাকিমার মাংস রাঁধার আর পাখিদের উড়ে যাওয়ার গন্ধ মিশে আছে…
এখন আর আমার নিজেরই অন্ধকারের দেশে চলে যাওয়ার তত দ্বিধা নেই… সেখানে বাঁধন আছে শক্তি আছে… রাঙাদিদু মা বাবা ছোড়দি… সবাই তো সেখানেই… অন্ধকার এখন প্রিয়জনের সংসার…
তবু শেফালিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না বলেই অন্ধকারে… কালো রঙের ঘরোয়া স্পেসে এভাবে ঘুরতে খারাপ লাগে না…
রুনু কেন দেবারতিকে বিয়ে করছে না… কত দীর্ঘ দুজনের ভালোবাসা… ও কি এই পৃথিবীতে মায়া বাড়াতে চায় না… কালীকৃষ্ণ এসব নিয়ে কত কথা রুনুকে বোঝাতে চায়… রুনু একটা নীল রঙের ওয়াটার কালার পেন্টিং দিয়েছে কালীকৃষ্ণকে… ছবিতে ফাংগাস যাতে না লাগে তার টিপসগুলোও দিয়েছে সেই সঙ্গে… কত ধরনের ফাংগাস আছে যারা এক-একটা রং এক-একটা স্পেস খেয়ে ফেলতে ভালোইবাসে…
এক জাবগায় গিয়ে নিশ্চই মেথি শাকের গন্ধের সঙ্গে শেফালির উপস্হিতির জৈব গন্ধ মিশবে। যেখানে এই মুহূর্তে অন্ধকারের হদিস রেখে আমাকে পৌঁছতে হবে। এ বাড়ির আর সব কিছুর মতো, যেগুলো আলোর মধ্যেই পরিচিত তার বাইরে। এ বাড়িতে আশ্রিত অন্ধকার আর তার অলিগলি এবাড়িরই আরেকটা দিক। যা আমাদের দুজনের নিজস্ব অন্ধকার।
শীতের সকালের দিকে যেমন, ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং টেবিলের ডান কোনে একচিলতে চেনাজানা এবাড়ির নিজস্ব রোদ আসে। একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকারও সমান চেনাজানাখ চলতে ফিরতে, সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই। এই অন্ধকার নিজস্ব বিষয়-সম্পদের বাইরে নয়।
কালো রঙের কাজ…
( ছোটো গল্প এতাবৎ লেখা হয়েছে ব্যক্তিমানুষকে নিয়ে। সমীরের এই গল্পের কেন্দ্র মানুষ নয়। এই গল্পের কেন্দ্র হল অন্ধকার। )
—------------------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment