অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস অথবা নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক
বহতা অংশুমালী
উপন্যাস-এর নামটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি। প্রচ্ছদে যুবতীর ছবি দেখে মনে হয় কোনো রগরগে রবিবাসরীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝি নি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে। এক অন্যধরণের সত্যানুসন্ধান, সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তেলেগুতে এনক্রিপ্টেড, বাংলায় লেখা, সিডিতে সংরক্ষিত ডায়রিলেখনে বন্দী হয়ে থাকে সেই জীবনকাহিনী। আর কংকাল প্রেমিক-এর জীবন ও মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয় নোংরা পরীর হাতে।
নোংরা পরী, ববিটাইজিং ভীতির কার্যকারিতা আর সারল্যের সংজ্ঞা
নোংরা পরী বেরিয়ে এসেছে Edith Wharton এর বর্ণিত The Age of Innocence এর পর্দা কেটে। ইন্সপেক্টর রিমা খান অপরাধীর চোখের গতির ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ঠ্যাঙায়। যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি, যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি। বুকের দিকে তাকিয়ে থাকারা নাকি তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক, রিমা খানের ভাষায় তারা প্রকৃতির মাদার-সান-ইন্সটিংক্ট মেনে চলে। তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করে না, সাব-ইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দেয়।
রিমা খানকে উপন্যাসের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নাম দিয়েছে ‘নোংরা পরি’। নোংরা- কারণ সে সিমেন-দি-বভার সেকে -সেক্স হতে রাজী নয়। সে আদ্যোপান্ত পুলিশ, প্রফেশনাল সমস্ত অর্থে, এমনকি ছুটকো ঘুষ নেবার ক্ষেত্রেও। সে দুর্দান্ত, দুঁদে। তার ভয়ে তার অঞ্চলের ক্রিমিনালরা লোক্যালিটি বদলে ফেলে।
বেটি ফ্রিড্যান যে ফেমিনিন-মিস্টিককে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তা এখনো আজকের সমাজেও পৃথিবী জুড়ে বর্তমান। এই নারীত্বের রহস্য শতকের পর শতক কখনো চীনে মেয়েদের পা জুতোয় ঢুকিয়ে ছোটো করতে বাধ্য করে, আফ্রিকার উপজাতির মেয়েদের মরাল গ্রীবাকে দীর্ঘায়িত করতে ধাতব বালায় বালায় বরবাদ করে দেয় ঘাড়ের মাথাকে ধরে রাখার কার্যকারীতাটুকু। এই নারীত্বের সন্ধানে ইউরোপের শিক্ষিতা মহিলা প্রেমপত্রে বানান ভুল করে, পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি না নিয়ে পড়তে চায় সুললিত আর্টস।
রিমা খানের মধ্যে সেই সারল্যটুকু নেই, সভ্যতা যে সারল্য শেখায় মেয়েদের, কাঁচের-পাথরবাটির মতো। যে শিক্ষিত সারল্যে মেয়েরা দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েও সেক্সটকের অধিকার পায় না, বলে ‘ইস ছি ছি ছি’, আজকের জমানাতেও। রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ করে। রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে। তাতে অরগ্যাজম হয় রিমা খানের। এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায়, স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে, সেখানে এই ডিলডো প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীও বটে। তাকে কোথাও প্লেস করা যায় না, কোনো গ্রাফ এ ফেলা যায় না! তার উলঙ্গ সত্ত্বায় কোনো কালো-দস্তানা-মোজা পরা লজ্জার ভেজাল ভঙ্গিমাও নেই। তাই সে মানুষী নয়। মানুষের ভোগ্যাও নয় হয়তো। বাঘিনী বাঘের জন্যে ভার্জিনিটি-টুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল। তা চারদিকে তো শুধুই ছাগল গবাদি পশু তার। তাই কুমারীত্ব ঘোচেনি কোনোদিন। এক ব্যতিক্রম কংকাল প্রেমিক। যে কংকাল সে শুধু প্রেমিক।
প্রেম কয়প্রকারের হয়ে থাকে? বহু প্রকারের হয়ে থাকে প্রেম। মেয়ে মাকড়শার সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম, রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণমূলক প্রেম, সতী নারীর পতিপ্রেম, বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরালভাবে সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের।
আমাদের কংকাল, যিনি কিনা ইন্সপেক্টর রিমা খানের আবার চাকরি ফিরে পাবার পাসপোর্ট, তিনি ছিলেন গণিতবিদ। এখানে মলয় রায়চৌধুরী বোধ হয় গণিতের অবতারণা করেছেন কুয়াশাহীন শুদ্ধচিন্তার প্রতীক হিসেবে। নিরঞ্জন, ওরফে কঙ্কাল, বুঝে গিয়েছিলেন তিনি বহুগামী। তাই কোন মহিলাকে এবং নিজেকে সমস্যা না দিতে চেয়ে, বিয়ে টিয়ে না করে, শুদ্ধ গণিত ও শুদ্ধ যৌনতার চর্চা করেছেন প্রেমে পড়ার আগে অব্দি। মলয় রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন তাঁর দুরকম প্রেম।
নিম্নগামী প্রেমটি (মস্তিষ্ক থেকে শীষ্ণ হয়ে এসে হৃদয়ে যা ইকুইলিব্রিয়াম পেলো, মাসিকের আবর্তনে মাপলো সময়) একজন জীবন খুঁজতে পালিয়েছিল, অন্যজন গিয়েছিল শুধু পলায়নপরাকে দেখে। মায়া পাল পুরোদস্তুর আধুনিক যুবতী, যিনি কুড়ুমুড়ে ইংরেজি বলতে বলতে অনায়াসে উচ্চপদের চাকরি পেতে পারেন, তিনি সুপুরুষ গণিতবিদের হাত ধরে বললেন ‘চলুন পালাই’। আর কামুক বিশ্বামিত্র ও তাঁর সঙ্গিনী চললেন অরূপের সন্ধানে, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারাইটস খনি অঞ্চলে। তাঁদের অতিপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতিক প্রেম সেই অরণ্যে যাপিত হয়। অতিপ্রাকৃতিক কারণ মলয় রায়চৌধুরী এখানে খুঁজতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীভাবে যাপিত জীবনের দিকটি। বাছুরকে দুধ থেকে বঞ্চিত না করে, মুরগীর ছাল ছাড়িয়ে না নিয়ে, ভেড়ার লোম কেটে না নিয়ে বাঁচার পদ্ধতি। মায়ার এনভায়রনমেণ্টা লিজম, জীবপ্রেম।
মলয় রায়চৌধুরী এখানে মনে করিয়ে দেন আমাদের ভুলে যাওয়া নারী পুরুষের প্রেমের রূপটিও। এখানে এক মানুষীর গায়ের গন্ধটি প্রেমিক চেনেন। প্রেমিক প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করতে থাকেন মনের তাপে, আর রোজ আলিঙ্গন করতে করতে বুঝতে পারেন তাপের তারতম্য, ডিম্বাণুর আবির্ভাব। তাঁরা প্রেমটুকু চেয়েছিলেন, বীজটুকু নয়। তাই নিরোধ প্রক্রিয়া, অদ্ভুত আত্মনিয়ন্ত্রণ। মায়া নিরঞ্জনকে সেই প্রেম শেখান যাতে শরীর বড় হয়েও ওঠে না অযথা, ছোটও হয় না। যতটুকু আসে সহজে আসে। এই প্রথম নিরঞ্জন কোনো নারীর আলিঙ্গনে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হন। এখানে খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে দুজন মানুষের একে অন্যকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার আনন্দ। এখানে নিরঞ্জন ঘড়ির অভাবে মায়ার মাসিক বা ঋতূস্রাব এর দিন গুলিকে গাছের গুঁড়িতে খোদাই করে রাখেন। আর হিসেব রাখেন দিন মাস বছরের। Metaformic theorists also discuss how cultures, like the Romans and Gaelic used the same words for menstruation and the keeping of time, while the Mayan calendar was directly influenced by women’s menstrual cycles.’ (উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত) উইকিপিডিয়া আর গুগল আমাদের বলে দেবে, মহাজাগতিক ক্যালেণ্ডারটি অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে প্রাচীনকালে নারীর শরীরের ঋতূচক্রের দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল। কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ দিনের বিরতিতে।
এই প্রেমে এক মানুষী বলেন আমি সবটুকু দেব, আর পুরুষটি বলেন আমি সবটুকু নেব। আর ঋতূস্রাবের পরে প্রেমিক ধুইয়ে দেন পরম আদরে প্রেমিকার রসস্থল, আরণ্যক দিনে। ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা (সখীর জন্যে বীজ শুয়ে আছে বরফে)
শরীরের ভালোবাসাকে আমরা মাঝে মাঝেই একটু নিম্নমানের বলি, পর্দা তুলে দিই। ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।’ যেন কামগন্ধ খারাপ বস্তু। যেন আমাদের সব্বার উৎস্য লজ্জার। এই ক্রিশ্চান ওরিজিন্যাল-সিন এর পাপবোধ যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যে পাপবোধ থেকে আজ বহু মেয়ের অঙ্গ কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা ‘শয়তানি আনন্দ’ উপভোগ না করে শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসেবে নিজেদের বহন করতে পারে, সেখানে মিলি একদমকা খোলা হাওয়া। মিলি কিশোর আনাড়ি নিরঞ্জনকে ‘ভালোবাসতে’ শেখায়। তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর নিয়ে খেলে, জানতে পারে যান্ত্রিক ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আনন্দের উৎস্যমুখ। সে তো সেতার বাজাবার আগে টুংটাং টুকু না করলেই নয়।
মিলি ভালোবেসেছিল কংকালকে। নিরঞ্জন ভালোবাসেননি সেই অর্থে। তিনি তখন-ও পুরুষ নন। বৃন্দাবনবিলাসী কিশোর, যে পালিয়ে যাবে, পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিলি বিয়ে করেন নি। আর নিরঞ্জনের সন্তান পাওয়ার জন্যে জোরাজুরিও করেছেন বহুবছর পরে দেখা হলে। নিরঞ্জন ভালোবেসেছেন মায়াকে। কিন্তু মিলির জন্যে মৃত্যুর আগে রেখে গেছিলেন শুক্র, ডাক্তারের কাছে। মিলি সন্তান চেয়েছিল, মায়া চায়নি। এখানে শিষ্ণ থেকে উঠে গেছে ভালোবাসা হার্ট এ। কি মন্ত্রে কে জানে।
এক্ষেত্রে মলয় রায়চৌধুরীর একটি ইন্টারভিউ মনে পড়ে গেল Alexander Jorgensen কে দেওয়া। Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where would you choose to do it ?
Malay : I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness’। আমার যেন মনে হয় ভুবনমোহিনী কোথাও মিলি, তার সমস্ত কোমলতা নিয়ে, যেখানে নিরঞ্জনের কৈশোর আটকে আছে।
মায়ার সত্যি নিরঞ্জনের সত্যি, মায়ার জীবনদর্শন
কাহিনীটি তো ডিটেকটিভকে নিয়ে। সত্যানুসন্ধান! Akira Kurosawa i Rashomon র জধংযড়সড়হ যেমন দেখিয়ে দেয়, বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয়, প্রেমিক নিরঞ্জন ও প্রেমিকা মায়ার সত্যিও আলাদা।
মায়া আধুনিক, কিন্তু পুনরাধুনিক। তিনি জানতে চেয়েছেন জীবনের যাপনগত সত্যটা। মানুষ ঠিক কোন আঙ্গিকে সভ্য, জীবহত্যার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীতার মাধ্যমে বাঁচা যায় কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই দুধের শিশুকে ছেড়ে, স্বামী ও সমাজের দেওয়া অসহিষ্ণুতা ও অপমান থেকে পালিয়ে যেতে, তিনি ‘খপ করে’ নিরঞ্জন-এর হাত ধরে বলেছিলেন ‘চলুন পালাই’
নিরঞ্জন লিখেছেন, ‘সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর, এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো। তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা। তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি। বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন। ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক না কেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর। সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য। কিন্তু নিরঞ্জন এর সত্য আলাদা। তিনি মূলতঃ প্রেমিক। তিনি নিজেকে দেখেন এইভাবে -‘মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে। তা এই যে, আমি একজন কুকুর। যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি: প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি। কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে। থাকবে। এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে। ‘এই আকাশমুখী লেজ এই গণিতবিদের জীবনচেতনা।
নিরঞ্জনের জীবনচেতনার অন্য একটি দিক দেখা যায়, তাঁর চেতনায় ‘পবিত্র’ শব্দটির অভিঘাতে। নিরঞ্জন লিখছেন- ‘আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব। তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না। বলেছিলুম, পবিত্র? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ।’
নিরঞ্জন এক জমির মতন পড়ে থাকেন সমস্ত জীবন। নানান মেয়ে, মহিলা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যায়, তাকে উর্বর করেন, তাঁকে ভেঙ্গে দেন। তাঁর ল্যান্ডস্কেপ পালটে দেন। এভাবেই মানবজমিনের চাষ করে গেছেন নিরঞ্জন শেষ দিন অবধি। তিনি কোনো মহিলা কে ‘ডিমিন’ করেন নি কখনো। দেহ ব্যবসায়িনীর ‘গিগলিং’ টুকুকেও নয়। ‘পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ। জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি। জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি। ‘- নিরঞ্জন এমনই ভাবেন, বলেন, বাঁচেন। এই নারীসঙ্গ ইচ্ছা সামগ্রিক শারীরীক কাম নয় একেবারে। তিনি শেষ বয়সেও ‘শেষণীর’ সঙ্গ চান উত্থানরহিত অবস্থায়। যেমন ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড’ এর লেখক লুই ক্যারল এর স্নেহের ডাকে খোকারা সুবিধে করে উঠতে পারতো না। তিনি খুকিদের বলতেন গল্প শুনতে আসতে। আর বলতেন ভাইদের ঘরে রেখে এসো। যে তার যে সুরে বাজে, সে তার সেই সুরেই বাজে। অন্যথা পচে যায়, যেমন আমরা পচে যাই অহরহ।
সত্যানুসন্ধান কি? ভিলেন কারা কারা? কাঠগড়ার এপারে ওপারে।
ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবু সন্তু এই সব্বার থেকে আলাদা নোংরা পরী, ডিটেকটিভ রিমা খান। ১) তিনি পুলিশ, সখের গোয়েন্দা নন ২) তিনি মহিলা, প্রথম, একমাত্র মহিলা সত্যানুসন্ধানী বাংলা উপন্যাসের। তিনি ক্ষমতাশালী, ইনফর্মার কনস্টেবল ইত্যাদি প্রয়োগে সমর্থ। যদিও তিনি সাসপেন্ডেড। ববিটাইজ-করার ভয় দেখাবার প্রক্রিয়ায় নোংরা।
রাষ্ট্রই ভিলেন নম্বর ওয়ান
এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে। আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী। কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে। কিভাবে ক্যাপিটালিজম-এর, ব্যবসায়িক উদারনীতির, শিকার হয় অরণ্যের মানুষ। যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের ‘সমাজ’ ব্যবস্থা, নীতি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না, যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই, তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন, কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টাকে পুলিশ অবলীলায় বলে ‘উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে।’ এই ভারসাম্য ফেরত আসে, যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনি শ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই, কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে। সবুজ নষ্ট হয়ে যায়। মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয়।
মায়ার ‘আচ্ছা চলি’র পিছনে রাষ্ট্র নামক ভিলেনের কি অবদান তা বোঝার জন্যে পড়ে দেখুন উপন্যাসটা।
ভিলেন নম্বর দুই বলব না। তাহলে আর কী পড়ে দেখবেন। কিন্তু রিমা বুঝতে পেরেছিলেন ভিলেন কে। কংকাল প্রেমিকের ঘাতক কে। আর সেই ভিলেন কে বানিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজের হাশহাশ নীতি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। যারা ভালবাসা দেখতে পায় না। ভালবাসার অভাব দেখতে পায় না। পবিত্র বিবাহগ্রন্থির নীচে চেপে রাখতে চায় সব রকম অতৃপ্তির চিৎকার। আর গ্রন্থিমুক্ত হতে চাইলে আঘাত করে সেই মানুষটিকে সুপরিকল্পিতভাবে।
ভিলেনের স্মৃতিসৌধ
মায়ার ‘আচ্ছা চলির’ পরে, মায়ালিঙ্গার পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হবার পরে, তুরুপ প্রজাতির জঙ্গলে মানুষই পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে নিরঞ্জনকে। মায়া ছিলেন তাদের জন্য শিক্ষিকা, মাতৃরূপিণী , জীবন্ত দেবী, আম্মা। আর মায়াগারু সেই দেবীর জীবনের অঙ্গ। তুরুপ গোষ্ঠীর এই মানুষদের সমাজচেতনা আলাদা।
তারা মায়া-নিরঞ্জনকে গ্রহণ করেছিল খুব সহজভাবে, বর্তমানে নির্ভর করে, তাদের অতীত না খুঁড়ে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে তারা কুঁড়ে ঘরটাকে মন্দিরের সম্মান দেয়। কোন বিগ্রহহীন মন্দির। কিন্তু মায়ার আকস্মিক প্রস্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতা গোষ্ঠী, কুঁড়েটাকে ধর্মের দোকান বানিয়ে ফেলে অচিরেই। বহু পরে রিমা খান অকুস্থলে গিয়ে দেখতে পান, এক অদ্ভুত মূর্তিসহকারে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে মায়া পাল-এর ভাবমূর্তি বেচে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খনি-মাফিয়ার দল বেশ দু পয়সা আয়ও করে নিচ্ছে।
এভাবেই আমাদের দেশে সতী প্রথা থেকে শুরু করে অনার-কিলিং অব্দি বিভিন্নভাবে একটি মেয়ের সত্ত্বা ও অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাকে ‘ধার্মিক’ প্রমাণ করে, দেবী প্রমাণ করে, তার ব্যক্তিসত্তা ছিনিয়ে নিয়ে সমাজ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নিজের মধ্যে।
মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া!
বহতা অংশুমালী
উপন্যাস-এর নামটা আমাকে বুঝতেই দেয় নি ভিতরের খনিজের উপস্থিতি। প্রচ্ছদে যুবতীর ছবি দেখে মনে হয় কোনো রগরগে রবিবাসরীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝি নি এই অতি সংক্ষিপ্ত উপন্যাসের প্রতিটি লাইন এক বিরল জীবনদর্শনের মুখোমুখি করে দেবে আমাকে। এক অন্যধরণের সত্যানুসন্ধান, সাধারণ খুনের মামলার প্রেক্ষাপটে যা এক যুবক যুবতীর উৎকেন্দ্রিক আরণ্যক ভালোবাসা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তেলেগুতে এনক্রিপ্টেড, বাংলায় লেখা, সিডিতে সংরক্ষিত ডায়রিলেখনে বন্দী হয়ে থাকে সেই জীবনকাহিনী। আর কংকাল প্রেমিক-এর জীবন ও মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হয় নোংরা পরীর হাতে।
নোংরা পরী, ববিটাইজিং ভীতির কার্যকারিতা আর সারল্যের সংজ্ঞা
নোংরা পরী বেরিয়ে এসেছে Edith Wharton এর বর্ণিত The Age of Innocence এর পর্দা কেটে। ইন্সপেক্টর রিমা খান অপরাধীর চোখের গতির ভিত্তিতে ক্রিমিনাল ঠ্যাঙায়। যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি, যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি। বুকের দিকে তাকিয়ে থাকারা নাকি তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক, রিমা খানের ভাষায় তারা প্রকৃতির মাদার-সান-ইন্সটিংক্ট মেনে চলে। তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করে না, সাব-ইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দেয়।
রিমা খানকে উপন্যাসের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নাম দিয়েছে ‘নোংরা পরি’। নোংরা- কারণ সে সিমেন-দি-বভার সেকে -সেক্স হতে রাজী নয়। সে আদ্যোপান্ত পুলিশ, প্রফেশনাল সমস্ত অর্থে, এমনকি ছুটকো ঘুষ নেবার ক্ষেত্রেও। সে দুর্দান্ত, দুঁদে। তার ভয়ে তার অঞ্চলের ক্রিমিনালরা লোক্যালিটি বদলে ফেলে।
বেটি ফ্রিড্যান যে ফেমিনিন-মিস্টিককে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তা এখনো আজকের সমাজেও পৃথিবী জুড়ে বর্তমান। এই নারীত্বের রহস্য শতকের পর শতক কখনো চীনে মেয়েদের পা জুতোয় ঢুকিয়ে ছোটো করতে বাধ্য করে, আফ্রিকার উপজাতির মেয়েদের মরাল গ্রীবাকে দীর্ঘায়িত করতে ধাতব বালায় বালায় বরবাদ করে দেয় ঘাড়ের মাথাকে ধরে রাখার কার্যকারীতাটুকু। এই নারীত্বের সন্ধানে ইউরোপের শিক্ষিতা মহিলা প্রেমপত্রে বানান ভুল করে, পদার্থবিদ্যার ডিগ্রি না নিয়ে পড়তে চায় সুললিত আর্টস।
রিমা খানের মধ্যে সেই সারল্যটুকু নেই, সভ্যতা যে সারল্য শেখায় মেয়েদের, কাঁচের-পাথরবাটির মতো। যে শিক্ষিত সারল্যে মেয়েরা দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েও সেক্সটকের অধিকার পায় না, বলে ‘ইস ছি ছি ছি’, আজকের জমানাতেও। রিমা খান বিন্দাস গালিগালাজ করে। রিমা আবিষ্কার করে ফেলেছে যে ববিটাইজ করার ভয় দেখালে আবালবৃদ্ধ-ক্রিমিনাল খুব আকুল হয়ে পড়ে। তাতে অরগ্যাজম হয় রিমা খানের। এখন যে যুগ এ জিন্স এর সঙ্গে এক-হাত লাঠি-চুড়ি পরে মডার্ন ফেমিনিন ঘুরে বেড়ায়, স্ট্রিপটিজ দেখে আবার সন্তোষীমা-ও করে, সেখানে এই ডিলডো প্রেমী পুলিস অফিসারটি নোংরাও বটে পরীও বটে। তাকে কোথাও প্লেস করা যায় না, কোনো গ্রাফ এ ফেলা যায় না! তার উলঙ্গ সত্ত্বায় কোনো কালো-দস্তানা-মোজা পরা লজ্জার ভেজাল ভঙ্গিমাও নেই। তাই সে মানুষী নয়। মানুষের ভোগ্যাও নয় হয়তো। বাঘিনী বাঘের জন্যে ভার্জিনিটি-টুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল। তা চারদিকে তো শুধুই ছাগল গবাদি পশু তার। তাই কুমারীত্ব ঘোচেনি কোনোদিন। এক ব্যতিক্রম কংকাল প্রেমিক। যে কংকাল সে শুধু প্রেমিক।
প্রেম কয়প্রকারের হয়ে থাকে? বহু প্রকারের হয়ে থাকে প্রেম। মেয়ে মাকড়শার সামনে পুরুষ মাকড়শার সুইসাইডাল প্রেম, মক্ষীরাণীর সামনে খুদে মৌমাছি শ্রমিকের প্রেম, রেপিস্ট হাঁসের প্রতি হংসিনীর প্রেম, ডলফিনের হরণ বা অপহরণমূলক প্রেম, সতী নারীর পতিপ্রেম, বড়োলোকের বেশ্যাপ্রেম এবং সমান্তরালভাবে সন্তানের মায়ের প্রতি প্রেম এমন অনেক রকমের।
আমাদের কংকাল, যিনি কিনা ইন্সপেক্টর রিমা খানের আবার চাকরি ফিরে পাবার পাসপোর্ট, তিনি ছিলেন গণিতবিদ। এখানে মলয় রায়চৌধুরী বোধ হয় গণিতের অবতারণা করেছেন কুয়াশাহীন শুদ্ধচিন্তার প্রতীক হিসেবে। নিরঞ্জন, ওরফে কঙ্কাল, বুঝে গিয়েছিলেন তিনি বহুগামী। তাই কোন মহিলাকে এবং নিজেকে সমস্যা না দিতে চেয়ে, বিয়ে টিয়ে না করে, শুদ্ধ গণিত ও শুদ্ধ যৌনতার চর্চা করেছেন প্রেমে পড়ার আগে অব্দি। মলয় রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন তাঁর দুরকম প্রেম।
নিম্নগামী প্রেমটি (মস্তিষ্ক থেকে শীষ্ণ হয়ে এসে হৃদয়ে যা ইকুইলিব্রিয়াম পেলো, মাসিকের আবর্তনে মাপলো সময়) একজন জীবন খুঁজতে পালিয়েছিল, অন্যজন গিয়েছিল শুধু পলায়নপরাকে দেখে। মায়া পাল পুরোদস্তুর আধুনিক যুবতী, যিনি কুড়ুমুড়ে ইংরেজি বলতে বলতে অনায়াসে উচ্চপদের চাকরি পেতে পারেন, তিনি সুপুরুষ গণিতবিদের হাত ধরে বললেন ‘চলুন পালাই’। আর কামুক বিশ্বামিত্র ও তাঁর সঙ্গিনী চললেন অরূপের সন্ধানে, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারাইটস খনি অঞ্চলে। তাঁদের অতিপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতিক প্রেম সেই অরণ্যে যাপিত হয়। অতিপ্রাকৃতিক কারণ মলয় রায়চৌধুরী এখানে খুঁজতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীভাবে যাপিত জীবনের দিকটি। বাছুরকে দুধ থেকে বঞ্চিত না করে, মুরগীর ছাল ছাড়িয়ে না নিয়ে, ভেড়ার লোম কেটে না নিয়ে বাঁচার পদ্ধতি। মায়ার এনভায়রনমেণ্টা লিজম, জীবপ্রেম।
মলয় রায়চৌধুরী এখানে মনে করিয়ে দেন আমাদের ভুলে যাওয়া নারী পুরুষের প্রেমের রূপটিও। এখানে এক মানুষীর গায়ের গন্ধটি প্রেমিক চেনেন। প্রেমিক প্রেমিকাকে আলিঙ্গন করতে থাকেন মনের তাপে, আর রোজ আলিঙ্গন করতে করতে বুঝতে পারেন তাপের তারতম্য, ডিম্বাণুর আবির্ভাব। তাঁরা প্রেমটুকু চেয়েছিলেন, বীজটুকু নয়। তাই নিরোধ প্রক্রিয়া, অদ্ভুত আত্মনিয়ন্ত্রণ। মায়া নিরঞ্জনকে সেই প্রেম শেখান যাতে শরীর বড় হয়েও ওঠে না অযথা, ছোটও হয় না। যতটুকু আসে সহজে আসে। এই প্রথম নিরঞ্জন কোনো নারীর আলিঙ্গনে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হন। এখানে খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে দুজন মানুষের একে অন্যকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার আনন্দ। এখানে নিরঞ্জন ঘড়ির অভাবে মায়ার মাসিক বা ঋতূস্রাব এর দিন গুলিকে গাছের গুঁড়িতে খোদাই করে রাখেন। আর হিসেব রাখেন দিন মাস বছরের। Metaformic theorists also discuss how cultures, like the Romans and Gaelic used the same words for menstruation and the keeping of time, while the Mayan calendar was directly influenced by women’s menstrual cycles.’ (উইকিপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত) উইকিপিডিয়া আর গুগল আমাদের বলে দেবে, মহাজাগতিক ক্যালেণ্ডারটি অনেক ক্ষেত্রেই কিভাবে প্রাচীনকালে নারীর শরীরের ঋতূচক্রের দিকে তাকিয়ে বানানো হয়েছিল। কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ দিনের বিরতিতে।
এই প্রেমে এক মানুষী বলেন আমি সবটুকু দেব, আর পুরুষটি বলেন আমি সবটুকু নেব। আর ঋতূস্রাবের পরে প্রেমিক ধুইয়ে দেন পরম আদরে প্রেমিকার রসস্থল, আরণ্যক দিনে। ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা (সখীর জন্যে বীজ শুয়ে আছে বরফে)
শরীরের ভালোবাসাকে আমরা মাঝে মাঝেই একটু নিম্নমানের বলি, পর্দা তুলে দিই। ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।’ যেন কামগন্ধ খারাপ বস্তু। যেন আমাদের সব্বার উৎস্য লজ্জার। এই ক্রিশ্চান ওরিজিন্যাল-সিন এর পাপবোধ যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যে পাপবোধ থেকে আজ বহু মেয়ের অঙ্গ কেটে দেওয়া হয় যাতে তারা ‘শয়তানি আনন্দ’ উপভোগ না করে শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসেবে নিজেদের বহন করতে পারে, সেখানে মিলি একদমকা খোলা হাওয়া। মিলি কিশোর আনাড়ি নিরঞ্জনকে ‘ভালোবাসতে’ শেখায়। তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর নিয়ে খেলে, জানতে পারে যান্ত্রিক ভঙ্গীতেই বিভিন্ন আনন্দের উৎস্যমুখ। সে তো সেতার বাজাবার আগে টুংটাং টুকু না করলেই নয়।
মিলি ভালোবেসেছিল কংকালকে। নিরঞ্জন ভালোবাসেননি সেই অর্থে। তিনি তখন-ও পুরুষ নন। বৃন্দাবনবিলাসী কিশোর, যে পালিয়ে যাবে, পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিলি বিয়ে করেন নি। আর নিরঞ্জনের সন্তান পাওয়ার জন্যে জোরাজুরিও করেছেন বহুবছর পরে দেখা হলে। নিরঞ্জন ভালোবেসেছেন মায়াকে। কিন্তু মিলির জন্যে মৃত্যুর আগে রেখে গেছিলেন শুক্র, ডাক্তারের কাছে। মিলি সন্তান চেয়েছিল, মায়া চায়নি। এখানে শিষ্ণ থেকে উঠে গেছে ভালোবাসা হার্ট এ। কি মন্ত্রে কে জানে।
এক্ষেত্রে মলয় রায়চৌধুরীর একটি ইন্টারভিউ মনে পড়ে গেল Alexander Jorgensen কে দেওয়া। Alex: If you could walk a mile in whatever circumstance, where would you choose to do it ?
Malay : I would go to the bank of river Ganges, at the place where I had kissed my Nepali classmate Bhuvanmohini Rana. My first and memorable kiss. I do not know where she is now. Must have become old or might have died ; she was two years older than me. I would sit at the same spot at the same time of autumn evening to revisit her tenderness’। আমার যেন মনে হয় ভুবনমোহিনী কোথাও মিলি, তার সমস্ত কোমলতা নিয়ে, যেখানে নিরঞ্জনের কৈশোর আটকে আছে।
মায়ার সত্যি নিরঞ্জনের সত্যি, মায়ার জীবনদর্শন
কাহিনীটি তো ডিটেকটিভকে নিয়ে। সত্যানুসন্ধান! Akira Kurosawa i Rashomon র জধংযড়সড়হ যেমন দেখিয়ে দেয়, বিষয়গত তথ্য আর বিষয়ীগত সত্য এক নয়, প্রেমিক নিরঞ্জন ও প্রেমিকা মায়ার সত্যিও আলাদা।
মায়া আধুনিক, কিন্তু পুনরাধুনিক। তিনি জানতে চেয়েছেন জীবনের যাপনগত সত্যটা। মানুষ ঠিক কোন আঙ্গিকে সভ্য, জীবহত্যার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোজীবীতার মাধ্যমে বাঁচা যায় কিনা, তাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই দুধের শিশুকে ছেড়ে, স্বামী ও সমাজের দেওয়া অসহিষ্ণুতা ও অপমান থেকে পালিয়ে যেতে, তিনি ‘খপ করে’ নিরঞ্জন-এর হাত ধরে বলেছিলেন ‘চলুন পালাই’
নিরঞ্জন লিখেছেন, ‘সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর, এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো। তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা। তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি। বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন। ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক না কেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর। সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য। কিন্তু নিরঞ্জন এর সত্য আলাদা। তিনি মূলতঃ প্রেমিক। তিনি নিজেকে দেখেন এইভাবে -‘মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে। তা এই যে, আমি একজন কুকুর। যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি: প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি। কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে। থাকবে। এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে। ‘এই আকাশমুখী লেজ এই গণিতবিদের জীবনচেতনা।
নিরঞ্জনের জীবনচেতনার অন্য একটি দিক দেখা যায়, তাঁর চেতনায় ‘পবিত্র’ শব্দটির অভিঘাতে। নিরঞ্জন লিখছেন- ‘আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব। তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না। বলেছিলুম, পবিত্র? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ।’
নিরঞ্জন এক জমির মতন পড়ে থাকেন সমস্ত জীবন। নানান মেয়ে, মহিলা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যায়, তাকে উর্বর করেন, তাঁকে ভেঙ্গে দেন। তাঁর ল্যান্ডস্কেপ পালটে দেন। এভাবেই মানবজমিনের চাষ করে গেছেন নিরঞ্জন শেষ দিন অবধি। তিনি কোনো মহিলা কে ‘ডিমিন’ করেন নি কখনো। দেহ ব্যবসায়িনীর ‘গিগলিং’ টুকুকেও নয়। ‘পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ। জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি। জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি। ‘- নিরঞ্জন এমনই ভাবেন, বলেন, বাঁচেন। এই নারীসঙ্গ ইচ্ছা সামগ্রিক শারীরীক কাম নয় একেবারে। তিনি শেষ বয়সেও ‘শেষণীর’ সঙ্গ চান উত্থানরহিত অবস্থায়। যেমন ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড’ এর লেখক লুই ক্যারল এর স্নেহের ডাকে খোকারা সুবিধে করে উঠতে পারতো না। তিনি খুকিদের বলতেন গল্প শুনতে আসতে। আর বলতেন ভাইদের ঘরে রেখে এসো। যে তার যে সুরে বাজে, সে তার সেই সুরেই বাজে। অন্যথা পচে যায়, যেমন আমরা পচে যাই অহরহ।
সত্যানুসন্ধান কি? ভিলেন কারা কারা? কাঠগড়ার এপারে ওপারে।
ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবু সন্তু এই সব্বার থেকে আলাদা নোংরা পরী, ডিটেকটিভ রিমা খান। ১) তিনি পুলিশ, সখের গোয়েন্দা নন ২) তিনি মহিলা, প্রথম, একমাত্র মহিলা সত্যানুসন্ধানী বাংলা উপন্যাসের। তিনি ক্ষমতাশালী, ইনফর্মার কনস্টেবল ইত্যাদি প্রয়োগে সমর্থ। যদিও তিনি সাসপেন্ডেড। ববিটাইজ-করার ভয় দেখাবার প্রক্রিয়ায় নোংরা।
রাষ্ট্রই ভিলেন নম্বর ওয়ান
এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে। আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী। কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে। কিভাবে ক্যাপিটালিজম-এর, ব্যবসায়িক উদারনীতির, শিকার হয় অরণ্যের মানুষ। যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের ‘সমাজ’ ব্যবস্থা, নীতি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না, যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই, তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন, কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টাকে পুলিশ অবলীলায় বলে ‘উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে।’ এই ভারসাম্য ফেরত আসে, যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনি শ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই, কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে। সবুজ নষ্ট হয়ে যায়। মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয়।
মায়ার ‘আচ্ছা চলি’র পিছনে রাষ্ট্র নামক ভিলেনের কি অবদান তা বোঝার জন্যে পড়ে দেখুন উপন্যাসটা।
ভিলেন নম্বর দুই বলব না। তাহলে আর কী পড়ে দেখবেন। কিন্তু রিমা বুঝতে পেরেছিলেন ভিলেন কে। কংকাল প্রেমিকের ঘাতক কে। আর সেই ভিলেন কে বানিয়েছিল মধ্যবিত্ত সমাজের হাশহাশ নীতি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। যারা ভালবাসা দেখতে পায় না। ভালবাসার অভাব দেখতে পায় না। পবিত্র বিবাহগ্রন্থির নীচে চেপে রাখতে চায় সব রকম অতৃপ্তির চিৎকার। আর গ্রন্থিমুক্ত হতে চাইলে আঘাত করে সেই মানুষটিকে সুপরিকল্পিতভাবে।
ভিলেনের স্মৃতিসৌধ
মায়ার ‘আচ্ছা চলির’ পরে, মায়ালিঙ্গার পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হবার পরে, তুরুপ প্রজাতির জঙ্গলে মানুষই পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনে নিরঞ্জনকে। মায়া ছিলেন তাদের জন্য শিক্ষিকা, মাতৃরূপিণী , জীবন্ত দেবী, আম্মা। আর মায়াগারু সেই দেবীর জীবনের অঙ্গ। তুরুপ গোষ্ঠীর এই মানুষদের সমাজচেতনা আলাদা।
তারা মায়া-নিরঞ্জনকে গ্রহণ করেছিল খুব সহজভাবে, বর্তমানে নির্ভর করে, তাদের অতীত না খুঁড়ে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে তারা কুঁড়ে ঘরটাকে মন্দিরের সম্মান দেয়। কোন বিগ্রহহীন মন্দির। কিন্তু মায়ার আকস্মিক প্রস্থানের জন্য দায়ী ক্ষমতা গোষ্ঠী, কুঁড়েটাকে ধর্মের দোকান বানিয়ে ফেলে অচিরেই। বহু পরে রিমা খান অকুস্থলে গিয়ে দেখতে পান, এক অদ্ভুত মূর্তিসহকারে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে মায়া পাল-এর ভাবমূর্তি বেচে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে খনি-মাফিয়ার দল বেশ দু পয়সা আয়ও করে নিচ্ছে।
এভাবেই আমাদের দেশে সতী প্রথা থেকে শুরু করে অনার-কিলিং অব্দি বিভিন্নভাবে একটি মেয়ের সত্ত্বা ও অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাকে ‘ধার্মিক’ প্রমাণ করে, দেবী প্রমাণ করে, তার ব্যক্তিসত্তা ছিনিয়ে নিয়ে সমাজ তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় নিজের মধ্যে।
মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া!
No comments:
Post a Comment