হাংরি
জেনারেশন” নিয়ে অনেক কথা শুনেছি, তবে সেটা কি ছিল, খেত না মাথায় দিত, সেসব
নিয়ে একদমই কোনও আইডিয়া নেই। আমার শেষ সম্বল বই; সেদিন লাইব্রেরি ঘাঁটতে
গিয়ে একটা বই পেলাম, “হাংরি জেনারেশন আন্দোলন” (প্রতিভাস, ১৯৯৫, কলকাতা)।
লেখক, শৈলেশ্বর ঘোষ! এই ঘোষবাবু কে আমি জানি না, কস্মিনকালেও নাম শুনিনি।
কৌতূহল থেকেই বইটা খুলে নিয়ে বসলাম। ঘোষবাবু দাবি করলেন, ইতিহাস লিখতে চান,
কিন্তু তৃতীয় পুরুষে ‘হাংরি আন্দোলন ও তার সঙ্গে যুক্তরা’ থেকে শুরু করে
লেখায় যেভাবে ‘আমরা’-তে চলে এলেন, তাতে মনে হয় ইনিও ওই আন্দোলনের কুশীলবদের
কেউ হবেন।
যাই হোক, গোড়া থেকেই ঘোষবাবু প্রায় খ্যাপা ষাঁড়ের মত শিং বাগিয়ে তেড়ে এলেন। কারণ হাংরি সাহিত্যই নাকি তাই, ‘...এ সাহিত্যের কোনও বিনোদনমূল্য নেই—এ সাহিত্য আক্রমণাত্মক!’ তাঁর বা তাঁদের, মানে হাংরি জেনারেশনের সামনে লাল কাপড় দুলিয়েছিল ‘প্রতিষ্ঠান’, ফলে ‘প্রতিষ্ঠান’ নামক ধারণাকেই তূর্যধ্বনি করে তেজস্কর শৃঙ্গাঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। লম্বাচওড়া নানা কথা অবশ্য আছে, “হাংরি কবি লেখকদের ঘোষিত উদ্দেশ্য, পাঠককে হস্টাইল করে তোলা” ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানই যত নষ্টের গোড়া, পাঠক প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার বাইরে কিছু ভাবতে পারছেন না, অতএব দাও সব ভেঙে। বিশেষ করে দেশ-আনন্দবাজারের ওপর রাগ তো বইটা যতখানি পড়লাম, তার প্রায় ছত্রে ছত্রে! শক্তি-সুনীল-সন্দীপন-উৎপল বসুদের নামেও কম লাভা বেরোয়নি (যদিও এদের কারোর লেখাই আমি পড়িনি, ফলে ন্যায্যতার বিচার আমি করব না)। শিবের গীতও যথারীতি গাওয়া হয়েছে, “হাংরি সাহিত্য সার্বিক মুক্তির কথা বলে!”
অতি উত্তম। তবে বইজুড়ে অজস্র বানান ভুল বাদ দিলে (সেটাও প্রতিষ্ঠানের দোষ, মানে প্রতিভাস প্রকাশনার ছাপার ভুল হতে পারে) সারা বই জুড়ে যা যা মণিমাণিক্য ছড়িয়ে আছে, তার কিছু স্যাম্পেল ছাড়ছি। বলে দিলাম, কোনও বক্তব্যই বিকৃত নয়, বইতে যা লেখা, সেইটুকুই অনুসরণ করেছি। বইয়ের ডিটেলস দেওয়া আছে, চাইলেই কেউ দেখে নিতে পারেন।
প্রথমেই নারীগনের পতিনিন্দা। “ষাট দশক থেকে ওই শতাব্দির (বানান অপরিবর্তিত) শেষ পর্যন্ত এই বাংলায় এমন কোনও কবি বা লেখকে পাওয়া গেল না, মেইনস্ট্রীম সাহিত্যে, যার রচনাকে যে কোনও দৃষ্টিতেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে।... আমরা মনে করেছি, এই সাহিত্যের আর কোনও প্রয়োজন নেই।” পরের অংশ জুড়ে প্রতিষ্ঠানের নিন্দে। প্রতিষ্ঠানের ছাতায় সাহিত্য তৈরি হয় না, ইত্যাদি। আত্মত্যাগই আসল, যেভাবে বহু স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক দিনের পর দিন অর্থাভাবে কষ্ট পেয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে মারা গেছেন, তা এনাদের কাছে মহৎ ত্যাগ! হাংরি কবিরা গেরুয়া পরে গঙ্গার ঘাটে বসে তপস্যা করতেন কিনা, সেটা অবশ্য লেখা নেই। যাই হোক। পরের ধাপে আসছে পুরষ্কার। প্রাতিষ্ঠানিক পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হওয়াটাও দোষের। কারণ? “নিজের জীবনের সত্যকে মানুষ দেখতে ভালোবাসে না।... যে রচনায় সত্যের এই উদ্ঘাটন হয়, এবং নবতর চেতনায় তা উদ্ভাসিত হয়, সেই রচনা পড়ার জন্য পাঠকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে না। শব্দের ক্ষমতা অসীম, সাহিত্য শব্দে সৃষ্ট বলে তা পাঠকে মর্মমূলে ঢুকে পড়বে, পাঠক আক্রান্ত বোধ করবে। এই শব্দস্রোতকে পাঠক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই বিপজ্জনক রচনাকে প্রতিষ্ঠান ভয় পায়! পুরষ্কার পাবে সেইসব রচনা, প্রতিষ্ঠান যাকে বাহবা দিয়ে বলবে, ‘বাহ এই তো!’” অর্থাৎ, পুরষ্কার পেলেই সেই রচনার জাত যাবে। আধুনিক লিটল ম্যাগের মত ব্যাপার আর কি, গছান ও গোছান, বিক্রি না হলে “বৈপ্লবিক সাহিত্য তো বাজারে বিক্রির জন্য নয়!”
এইবার আসল খেল। ঘোষবাবু প্রায় আধুনিক কবিতার ঢঙে ইতিহাস শুরু করেছেন... হুবহু তার কিছু অংশ, হীরে-জহরত খচিত অংশ, তুলে দিচ্ছি, কোনও মতামত ও এডিট ছাড়া।
১) “আধুনিকতা নাম্নী হিজড়েটিকে আমরা চুম্বন করতে পারিনি। ঐ সালঙ্কারা হিজড়েকে নিয়ে কবি লেখকদের লোফালুফি আমাদের স্তম্ভিত করেছে! আমাদের সৃষ্টি-লিঙ্গ চেয়েছে নারী, যার সৃষ্টি-যোনি আছে। আমরা এই হিজড়েকে আরও দেখেছি নপুংসক, দাঁতাল প্রতিষ্ঠানের কোলে বসে থাকতে...”
২) “আধুনিকতা রক্ষিতা হবার সমস্ত সর্তই (বানান অপরিবর্তিত) পূরণ করেছে। সে আর বিপ্লবী কবিলেখকদের প্রেয়সী নয়। তৃতীয় স্তরের পপ কবিলেখকদের আরাধ্যা সে।”
৩) “আধুনিকতার শবদেহের ওপর উল্লাসময় নৃত্যের নামই হাংরি জেনারেশন! হাংরি সাহিত্য! হাংরি আন্দোলন!!! উত্তরাধিকারকে বলি আমরা, ‘বাবা, আমার বর্বরতা তোমার বর্বরতাকে ধর্ষণ করেছে।”
৪) “...অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান লালিত, মেইনস্ট্রীম সাহিত্যের অবস্থা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া বয়স্কা নারীর মত!”
এসব মণিমুক্তো দেখে স্যাকরার দায়িত্ব আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। ‘ইহা ছহিহ হাংরি নয়, ঘোষ অন্য ফ্যাকশন’ বাদে সবই সাদরে গৃহীত হবে। পদস্খলন তত্ত্বও।
শৈলেশ্বরবাবুর বাংলোবাড়ি
প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সরকারি সাহিত্যসভায় শৈলেশ্বরবাবু
এই সরকারি সভায় হাংরি জেনারেশন নিয়ে মুখ খোলেননি শৈলেশ্বরবাবু
যাই হোক, গোড়া থেকেই ঘোষবাবু প্রায় খ্যাপা ষাঁড়ের মত শিং বাগিয়ে তেড়ে এলেন। কারণ হাংরি সাহিত্যই নাকি তাই, ‘...এ সাহিত্যের কোনও বিনোদনমূল্য নেই—এ সাহিত্য আক্রমণাত্মক!’ তাঁর বা তাঁদের, মানে হাংরি জেনারেশনের সামনে লাল কাপড় দুলিয়েছিল ‘প্রতিষ্ঠান’, ফলে ‘প্রতিষ্ঠান’ নামক ধারণাকেই তূর্যধ্বনি করে তেজস্কর শৃঙ্গাঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। লম্বাচওড়া নানা কথা অবশ্য আছে, “হাংরি কবি লেখকদের ঘোষিত উদ্দেশ্য, পাঠককে হস্টাইল করে তোলা” ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানই যত নষ্টের গোড়া, পাঠক প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার বাইরে কিছু ভাবতে পারছেন না, অতএব দাও সব ভেঙে। বিশেষ করে দেশ-আনন্দবাজারের ওপর রাগ তো বইটা যতখানি পড়লাম, তার প্রায় ছত্রে ছত্রে! শক্তি-সুনীল-সন্দীপন-উৎপল বসুদের নামেও কম লাভা বেরোয়নি (যদিও এদের কারোর লেখাই আমি পড়িনি, ফলে ন্যায্যতার বিচার আমি করব না)। শিবের গীতও যথারীতি গাওয়া হয়েছে, “হাংরি সাহিত্য সার্বিক মুক্তির কথা বলে!”
অতি উত্তম। তবে বইজুড়ে অজস্র বানান ভুল বাদ দিলে (সেটাও প্রতিষ্ঠানের দোষ, মানে প্রতিভাস প্রকাশনার ছাপার ভুল হতে পারে) সারা বই জুড়ে যা যা মণিমাণিক্য ছড়িয়ে আছে, তার কিছু স্যাম্পেল ছাড়ছি। বলে দিলাম, কোনও বক্তব্যই বিকৃত নয়, বইতে যা লেখা, সেইটুকুই অনুসরণ করেছি। বইয়ের ডিটেলস দেওয়া আছে, চাইলেই কেউ দেখে নিতে পারেন।
প্রথমেই নারীগনের পতিনিন্দা। “ষাট দশক থেকে ওই শতাব্দির (বানান অপরিবর্তিত) শেষ পর্যন্ত এই বাংলায় এমন কোনও কবি বা লেখকে পাওয়া গেল না, মেইনস্ট্রীম সাহিত্যে, যার রচনাকে যে কোনও দৃষ্টিতেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে।... আমরা মনে করেছি, এই সাহিত্যের আর কোনও প্রয়োজন নেই।” পরের অংশ জুড়ে প্রতিষ্ঠানের নিন্দে। প্রতিষ্ঠানের ছাতায় সাহিত্য তৈরি হয় না, ইত্যাদি। আত্মত্যাগই আসল, যেভাবে বহু স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক দিনের পর দিন অর্থাভাবে কষ্ট পেয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে মারা গেছেন, তা এনাদের কাছে মহৎ ত্যাগ! হাংরি কবিরা গেরুয়া পরে গঙ্গার ঘাটে বসে তপস্যা করতেন কিনা, সেটা অবশ্য লেখা নেই। যাই হোক। পরের ধাপে আসছে পুরষ্কার। প্রাতিষ্ঠানিক পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হওয়াটাও দোষের। কারণ? “নিজের জীবনের সত্যকে মানুষ দেখতে ভালোবাসে না।... যে রচনায় সত্যের এই উদ্ঘাটন হয়, এবং নবতর চেতনায় তা উদ্ভাসিত হয়, সেই রচনা পড়ার জন্য পাঠকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে না। শব্দের ক্ষমতা অসীম, সাহিত্য শব্দে সৃষ্ট বলে তা পাঠকে মর্মমূলে ঢুকে পড়বে, পাঠক আক্রান্ত বোধ করবে। এই শব্দস্রোতকে পাঠক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই বিপজ্জনক রচনাকে প্রতিষ্ঠান ভয় পায়! পুরষ্কার পাবে সেইসব রচনা, প্রতিষ্ঠান যাকে বাহবা দিয়ে বলবে, ‘বাহ এই তো!’” অর্থাৎ, পুরষ্কার পেলেই সেই রচনার জাত যাবে। আধুনিক লিটল ম্যাগের মত ব্যাপার আর কি, গছান ও গোছান, বিক্রি না হলে “বৈপ্লবিক সাহিত্য তো বাজারে বিক্রির জন্য নয়!”
এইবার আসল খেল। ঘোষবাবু প্রায় আধুনিক কবিতার ঢঙে ইতিহাস শুরু করেছেন... হুবহু তার কিছু অংশ, হীরে-জহরত খচিত অংশ, তুলে দিচ্ছি, কোনও মতামত ও এডিট ছাড়া।
১) “আধুনিকতা নাম্নী হিজড়েটিকে আমরা চুম্বন করতে পারিনি। ঐ সালঙ্কারা হিজড়েকে নিয়ে কবি লেখকদের লোফালুফি আমাদের স্তম্ভিত করেছে! আমাদের সৃষ্টি-লিঙ্গ চেয়েছে নারী, যার সৃষ্টি-যোনি আছে। আমরা এই হিজড়েকে আরও দেখেছি নপুংসক, দাঁতাল প্রতিষ্ঠানের কোলে বসে থাকতে...”
২) “আধুনিকতা রক্ষিতা হবার সমস্ত সর্তই (বানান অপরিবর্তিত) পূরণ করেছে। সে আর বিপ্লবী কবিলেখকদের প্রেয়সী নয়। তৃতীয় স্তরের পপ কবিলেখকদের আরাধ্যা সে।”
৩) “আধুনিকতার শবদেহের ওপর উল্লাসময় নৃত্যের নামই হাংরি জেনারেশন! হাংরি সাহিত্য! হাংরি আন্দোলন!!! উত্তরাধিকারকে বলি আমরা, ‘বাবা, আমার বর্বরতা তোমার বর্বরতাকে ধর্ষণ করেছে।”
৪) “...অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান লালিত, মেইনস্ট্রীম সাহিত্যের অবস্থা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া বয়স্কা নারীর মত!”
এসব মণিমুক্তো দেখে স্যাকরার দায়িত্ব আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। ‘ইহা ছহিহ হাংরি নয়, ঘোষ অন্য ফ্যাকশন’ বাদে সবই সাদরে গৃহীত হবে। পদস্খলন তত্ত্বও।
শৈলেশ্বরবাবুর বাংলোবাড়ি
প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সরকারি সাহিত্যসভায় শৈলেশ্বরবাবু
এই সরকারি সভায় হাংরি জেনারেশন নিয়ে মুখ খোলেননি শৈলেশ্বরবাবু
No comments:
Post a Comment