আদি
কবি বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগ-জনিত শোকই শ্লোকরূপে উৎসারিত হয়েছিল।
সহচারী-বিয়োগকাতর ক্রৌঞ্চের বেদনায় কবি চিত্তে বেদনার সঞ্চার হয়। এই
বেদনা থেকেই সহসা ‘অপূর্ব ছন্দে কবি-কণ্ঠে উচ্চারিত হল-
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।। ”
এই হল
কবিতার জন্মরহস্য। সেই তুলনয় বাংলা কবিতার বয়স চর্যার কাল থেকে ধরলে হাজার
বছর মোটে। কবিতা তো সাহিত্যের সেই হিরন্ময় হাতিয়ার যা মানব অন্তরকে দলিত,
মথিত ও স্পন্দিত করে; সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের পক্ষে যা সম্ভব নয়।
বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাস কবিতার
দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস।” আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সম্ভবত এ কথার
যথার্থতা অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষের জীবনে আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক
কবিতার বিশেষ কোন ভূমিকা আছে কিনা সে সম্পর্কে অতীতেও বিতর্ক ছিল আজও হয়তো
আছে কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বিপুলভাবে যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও কবিতাকে
নির্বাসিত করা হয়নি।বর্তমান কালের কবিতা মানবীয় ইচ্ছাকে অতিক্রম করে মানব
স্বভাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির মত।কবিতার উদ্দেশ্য, পরিধি, গঠন,
কৌশল, ছন্দ, আবৃত্তি ইত্যাদি কারণে দশকে দশকে বদলে গেছে কবিতা। কবিতার
পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় ত্রিশের কবিরা
কবিতা বদলে দিয়েছেন। এই রেশ কাটতে না কাটতেই হাজির হয়েছেন
চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের কবিরা। প্রতিটি দশকেই কবিতার উন্নতি অনেক স্পষ্ট
হয়েছে। দশকওয়ারি এই বিবর্তনধারায় বাংলা কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে অনেক
কবিকেই দশকের ছকে বেঁধে ফেলা যায় না। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ভালো
কবিতা লেখার একটি চেষ্টা সবার মধ্যেই ছিল। এই চেষ্টার পেছনে রয়েছে মানুষ
যাতে কবিতা থেকে দূরে চলে না যায়, সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন না
হয়ে যায়। গদ্য ভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। ছন্দোবদ্ধ কবিতা যথাযথ
ভাবপ্রকাশের গতির সাথে চলতে পারত না। তাই অনিবার্য ছিল অক্ষরবৃত্ত বা গদ্য
কবিতার। এতে কবিতার সুসময় ফিরে এসেছে তা নয়। তবে কবিতা মাঝে মাঝে তীব্র
আলোর ঝলকানি ছড়িয়েছে।
তারপর ক্রমে বিদগ্ধজনেরা সমাজের নৈরাশ্যচেতনা ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা
করেন।তাঁরা একেবারে গোড়া থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী।সমাজ ও দেশের পূরানো
মতবাদ,ঈশ্বরবিশ্বাস ও চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের
চিন্তা,চেতনা ও লেখায় ঈর্ষণীয় সাফল্য ফুটে ওঠে,ফুটে ওঠে নান্দনিক
শিল্পকলায়।১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে ধরা হয় আধুনিকতাবাদের শ্রেষ্ঠ সময়।
এই
ধারনার বশবর্তী হয়ে অনেকেই এই ঔপনিবেশিক মত পোষণ করেন যে, পাশ্চাত্য
সাহিত্যের কবিতার মতই হবে আধুনিক বাংলা কবিতা। এই অনুসরণ শেষপর্যন্ত
অনুকরণে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ভাষা একটি পরিশীলিত ভাষার রূপ
পায়, একটি উন্নত রুচি তৈরি করে দেন তিনি। নজরুলের হাতে পায় বারুদগর্ভ ভাব ও
অগ্নিঝরা সুর-ছন্দ-তাল প্রকাশের শক্তি ও বীররস, তার হাতে বাংলা ভাষা হয়ে
ওঠে ‘অরুগ্ণ-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতায় অনবদ্য’। শামসুর রাহমান বাংলা
ভাষার শরীরে যোগ করেছেন আধুনিক ও শাহরিক চারিত্র্য; শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কবিতায় ব্যবহার করেছেন অনেক অপরিশীলিত বা অশ্লীল শব্দ, যা রবীন্দ্রনাথ
কল্পনা করতেও পারেতন না। আল মাহমুদ সংযোজন করেছেন পরিশীলিত লোকায়ত প্রাণরস।
তা ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ
আহমদ, শামসুর রাহমান বাংলা ভাষায় জুতসইভাবে যোগ করেছেন আরবি-ফার্সি
শব্দসমষ্টি। শব্দ-মিথ-উপমা-চিত্রকল্প-কল্পচিত্র ব্যবহারে নতুনত্ব আনয়ন,
বাক্য গঠনে অভিনব ভঙ্গি প্রয়োগ, স্পেস তৈরি ইত্যাদি বিষয় কোন কবিকে
স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সহায়তা করে। এতে ভাষার প্রকাশক্ষমতা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি
পায়। কিন্তু যাচ্ছেতাইভাবে শব্দ প্রয়োগ ও বাক্য নির্মাণ ভাষার কোনো কাজে
আসে না। লাভ হয় না কারুরই। আসলে এটা ক্ষমতার ব্যাপার, শুধু ইচ্ছার ব্যাপার
নয়।
”তিরিশের
দশকের বাঙালি কবিরা এলিয়টের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কবিতা রচনা শুরু করেন।
এলিয়টের অনুকরণে কলকাতা নগরীকে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন ভিড়াক্রান্ত লন্ডন
নগরীর অশুভ পাপময়তা-পচনশীলতার এতদ্দেশীয় প্রতিরূপ হিসেবে। (এলিয়টের লন্ডন
নিজেই ছিল আধুনিকবাদের আদিগুরু বোদলেয়ারের প্যারিসের প্রতিরূপ।) তারপর থেকে
দীর্ঘ দিন বাঙালি কবির কাছে আকাশ মানেই ছিল বিধ্বস্ত নীলিমা, বাতাস মানেই
অসুস্থ বিকারগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের ঘামের গন্ধে বিষাক্ত, বিষন্ন।
বাংলা
কবিতায় ষাটের দশকে একঝাঁক তরুণ কবি প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে আক্রমণ করে নিজেদের
‘হাংরি জেনারেশন’ বলে ঘোষণা করেন, এবং জীবনানন্দকে তাদের নিজস্ব ভাবধারার
পূর্বসূরী বলে দাবি করেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি
ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর
রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে
দেবী রায় ।১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার,
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র,
ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ,
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু,
বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ,
আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়,
শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল,
রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল এবং
করুনা ছিলেন চিত্রকর । সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে
তোলার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু,
অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর
সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার,
দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়,
রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত,
সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব
আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।হাংরি আন্দোলনের
বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য
লিখেছেন যে সেগুলো “সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত,
প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া,
এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক” । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান
ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল
ভাংচুর” করেছেন তাঁরা, এবং “যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও
অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তঁরা নিরপেক্ষ
হয়ে যান” । মাত্র চার বছর স্থায়ী হয়েছিল এই আন্দোলন । সুনীল , শক্তি,
বিনয় মজুমদার, উৎপল বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা হাংরি দর্শনেই প্রভাবিত
হয়ে তাদের কাব্যজীবন শুরু করেছিলেন । সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’ অবশ্য ঘোষণা
করেছিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নিজেও তাঁর অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়েছিলেন “আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ
করি না (সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে),আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত
হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৪ তেই হাংরি সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন ।
বিনয় মজুমদার, উৎপল বসুরাও প্রতিষ্ঠানে ফিরে বাংলা কাব্য জগতকে দারুণ
সমৃদ্ধ করলেন । “ধরো, আমি একটি কবিতা পড়লাম। তারপর সেই কবিতা থেকে মনে মেন
আবৃত্তি করলাম- ‘আমি ফাগুন এলে কুড়িয়ে নেব’। সঙ্গে সঙ্গে কবির মুখটা আমি
দেখতে পাচ্ছি-হাবড়া প্ল্যাটফর্মে”। – বিনয় মজুমদারের এই উপলব্ধিই যেন কবি,
এবং কবিতা। কবির জীবনযাপনের সঙ্গেই, তাঁর কবিতার উপলব্ধি বসবাস করে। পাঠকও
এই উপলব্ধির মধ্যে প্রবেশ করে। তখন কবি এবং কবির দর্শনকে পাঠক দেখতে পায়।
কবির প্রতিটি কবিতা একটি অভিজ্ঞতামুহূর্ত। তাঁর কাব্যের প্রকাশ হয়ে ওঠে
অভিজ্ঞতার ডায়রি।
No comments:
Post a Comment