বাংলা
কবিতায় ষাটের দশকে একঝাঁক তরুণ কবি প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে আক্রমণ নিজেদের
‘হাংরি জেনারেশন’ বলে ঘোষণা করেন, এবং জীবনানন্দকে তাদের নিজস্ব ভাবধারার
পূর্বসূরী বলে দাবি করেন। হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ মলয় রায় চৌধুরী তাঁর
কবিতায় জীবনানন্দের কথা সরাসরি উল্লেখ করেছেন,
--------------------------------------------------------------------------
শিল্পের স্বাধীনতা যে চায় সে মূর্খ
আমি শিল্পীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে
শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের কেনা চাকররাই স্বাধীন কেননা তারা শিল্পী নয়, তারা মিথ্যাবাদী চুরিবিশারদ আর মরা রোবোট
উন্মাদ সংস্কৃতিগুলোই কেবল শিল্পীকে চায়
শিল্প হল ভবিষ্যবাণী কেননা সর্বনাশের আগে দরকার অমঙ্গলের পূর্বাভাস
বিবেকী সভ্যতার জন্যে চাই লোকসংস্কৃতি যা আসলে প্রকৃতি, তা মোটেই শিল্প নয়
কোনো বিবেকী সরকারের আবির্ভাব এখনও হয়নি
কোনো শিল্পীর পক্ষে সমঝোতা করা সম্ভব নয় কেননা সে আসলে তিনি
শিল্প হল আঘাতের উপশম
আমি মানবতার আঘাতপ্রাপ্তি চাই না কেননা আমি সর্বনাশের বিরুদ্ধে
শিল্পীকে একা যুঝতে হবে কেননা সে-ই তো উপশম আনে
শিল্পীকে নিজের পথ নিজে তৈরি করতে হবে
স্বাধীনতার জন্যে সে ভিক্ষা চাইবে না বা দরদস্তুর করবে না
বাইরে থেকে স্বাধীনতা পাবার জন্যে সে দুর্বলের কান্না কাঁদবে না
মিশর বয়ে চলে গেছে নীল নদের জলে
'লোহার দেয়াল' ভেঙেছেন ভ্যান গঘ যা তিনি একটি চিঠিতে বলেছিলেন
কলকাতাও মিশে যাবে ধুলায়
কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকবেন চিরকাল আমার আর তোমার ভেতর
আমি শিল্পের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে
অসুস্হ নৃশংস ব্যবস্হায় শিল্পীর অস্তিত্ব অসম্ভব
মানবতার বেদীতে শিল্প হল আত্মাহুতি
তাই আমি বলি শিল্পীর জন্যে চাই জিঞ্জির
তাকে ঘিরে উঠুক পাতালের নীলাভ বিষবাষ্প
তাকে বসাও বিদ্যুৎবাহী চেয়ারে
তার জন্যে চাই ফাঁসিকাঠ
জীবন্ত পোড়াও তাকে
তাকে পাঠাও অন্ধকার স্যাঁতসেতে ঘেমো জেলখানায়
তার জন্যে পাগলাগারদ
কেননা ফ্রাংকো আর সালাজারের কবর হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের গোরস্হান
অবিনশ্বরতায় পাস্তেরনাকের পাশে ঘুমাবেন লোরকা আর আমিও থাকব সেখানে
আমি কারোর কাছে স্বাধীনতার গারেন্টি চাই না
আমার যেমন ইচ্ছে হবে তেমন লিখব
যেখানেই থাকি না কেন যা ভাল লাগবে তা-ই লিখব
চন্দ্রালোকের মহাপ্লাবনে ওঠা আমার রক্তের জোয়ারধ্বনি আমি শুনতে পাই
আমি কারোর কাছে আমার স্বাধীনতা দাবি করি না
অজস্র সরকার উড়ে যাবে কবিতার ফুঁয়ে
শিল্পীর সামনে তাবৎ উন্মাদ সভ্যতা হাঁটু গেড়ে গোঙাবে
সময় যার আরেক নাম কবিতা তার সুষমাকে কোনো আণবিক বিস্ফোরণ দমাতে পারবে না
(শিল্পের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে: মলয় রায়চৌধুরী)
-------------------------------------------------------------------------------
জীবনানন্দের
এ অবদানকে তারা উদযাপনও করেছেন সুযোগ পেলেই। কলকাতার খালাসী তলা’র
খালাসীদের বারে বসে হাংরি জেনারেশনের কবিরা জীবনানন্দের জন্মোৎসব উদযাপন
করেন (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮)। পাটনায় বাস করার কারণে মলয় রায় চৌধুরী হয়তো এ
উৎসবে সামিল হতে পারেন নি। স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর বেরোয়,
''গত
সোমবার (১৯শে ফেব্রুয়ারি) কলকাতার তরুণ কবিদের, যারা নিজেদের বিদ্রোহী বলে
দাবি করেন তাদের জন্য ছিলো একটা বিশেষ দিন। সেদিন ছিলো তাদের গুরু এবং
অনুপ্রেরণার উৎস জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন, যদিও জীবনানন্দের জীবদ্দশায় তারা
বোধহয় কেউই তাঁর সংস্পর্শে আসেন নি। সাধারণত এরকম উৎসব যেভাবে উদযাপিত
হয়, তার থেকে এ অনুষ্ঠান ছিলো স্পষ্টই আলাদা, এর আয়োজকদের পরিকল্পনাও
তেমনটাই ছিলো। শহরের কোনো সাংস্কৃতিক সদন এর পরিবর্তে এ উদযাপন অনুষ্ঠিত
হয় সেন্ট্রাল কলকাতার একটি দেশি মদের দোকানে। অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি
বলতে কেউ ছিলো না। অশরীরী কিন্তু সর্বব্যাপী জীবনানন্দীয় স্পিরিট ছিলো সে
সন্ধ্যার প্রধান অতিথি।।
হাংরি জি’স এর কবিরা
এককোণে নড়বড়ে একটা টেবিল দখল করে সেলিব্রেশন শুরু করলেন। উদযাপন শুরু হলো
সকলের এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে। শালেশ্বর ঘোষ, যিনি এ প্রজন্মের
কাছে উদীয়মান কবি হিসেবে সম্মানিত তিনি প্রথমেই ব্যাখ্যা করলেন,
‘জীবনানন্দের জন্মবার্ষিকীর উদযাপন কেন এখানে হচ্ছে? কারণ জীবনানন্দ এ
জায়গা দ্বারা সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সুতরাং আমরা শুধু প্রথার
অনুসারী। চশমা অলঙ্কৃত শীর্ণদেহী কবি তারপর স্বরচিত ‘জন্মনিয়ন্ত্রন’
কবিতাটি পড়তে শুরু করলেন। অতিসম্প্রতি লেখা সে কবিতার বিষয়সম্ভার অতি
বিচিত্র; জন্মপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে রন্ধনশিল্প পর্যন্ত সবই তার
অন্তর্গত। তবে শ্রোতারা বড়ই অমনোযোগী, কবির কণ্ঠ অবিরাম হইচই এর মধ্যে
ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছিলো।
এরপর আরেকজন
‘হাংরি জি’স তাদের এ আন্দোলনের প্রতিকূলতার কথা বর্ণনা করে উষ্মা এবং
দুঃখপ্রকাশ করলেন। ‘আমাদের দল ভেঙে যাচ্ছে, আমাদের লেখা কেউ ছাপাতে চায়
না, আমাদের সহযোদ্ধাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা অজানা কারণে সর্বত্র
অনুসরণ করে চলেছেন’। এরপর তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন, ‘যারা ভাবে আমরা লিখতে
জানি না, তাদের ধিক্কার জানাই। আমরা স্বাধীন। আমাদের চিত্ত যে কোন বিষয়ে
ভাবতে পারে, আমাদের কলম যেকোনো কিছু লিখতে পারে’। ‘একদিন আমাদের সৃষ্টি
সমস্ত বাঙালী জাতির কাছে সমাদৃত হবে’ এই বলে তিনি তার বক্তৃতার ইতি টানলেন।
স্বাভাবিকভাবেই অসংখ্য বোতল এবং পেয়ালা চৌচির ভাঙার উৎসবের মধ্য দিয়ে
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো''। (২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮)
জীবনানন্দ
নিশ্চিতভাবেই কখনো খালাসী তলায় যান নি; সেখানে রাত জেগে পান করা দূরে থাক।
সে’রাতে এই কবিদের একেকজন যা পান করেছিলেন, জীবনানন্দ সারাজীবনে সে পরিমাণ
পান করেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু তিনি সর্বস্তরের এবং সববয়েসী কবিদের
নানানভাবে কতটা প্রভাবিত করেছিলেন উপরের ঘটনা থেকে তা পরিষ্কার ।
No comments:
Post a Comment